একটি প্রস্তাবিত মৃত্যু ও একজন ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮

একটি প্রস্তাবিত মৃত্যু ও একজন ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ

একটি প্রস্তাবিত মৃত্যু এবং একজন ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ
হে মৃত্যু, সময় হলো! এই দেশ নির্বেদ বিধুর।
এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি হে মৃত্যু প্রাচীন!
কা-ারী তুমি তো জানো, অন্ধকার অম্বর সিন্দুর
অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের প্রাণের পুলিন।


মানুষ মানুষকেই কাছে ডাকে। মানুষ মানুষকেই প্রার্থনা করে। মানুষের প্রতিরূপে ঈশ্বরও তার হুকুমকে প্রতিপালন করেন, নিজের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তাহলে তিনি নিজেকে মানুষ রূপে নির্মাণ করেন? নিজেই নিজেকে প্রতারণার দীর্ঘ শেকলে বেঁধে ফেলেন? প্রশ্ন থাকতে নেই জীহ্বায়-লালসায়। তবুও প্রশ্নগুলো নিজের ভিতর থেকে চরিত্র সৃষ্টি করে। কি সেই চরিত্র? এটি এমন এক চরিত্র যা পাঠককুলকে একটি আত্মসংঘাত অথবা অনিবার্য জীবনবোধের কাছে টেনে নিয়ে যায়। জীবন? একদিকে গরল অন্ধকার, অন্যদিকে ধবল দিনমান। অন্ধকারগুলো দিনের মতো সচ্ছ নয় বরং নিপীড়িত-বঞ্চিত জনপদের মতো পিছন থেকে টেনে ধরে। আর দিনগুলো সভ্যতার ডানায় ভেসে বেড়ায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে তাহলে সত্য কোনটি অন্ধকার না আলো? আমরা কোনদিকে যাবো? পাঠকগণ কাকে কাছে টেনে নিবেন আলো না অন্ধকার? আমাদের জানা নেই কিছুই। কেননা আমরা এখনো পর্যন্ত এই দুইয়ের গভীরতম রহস্যের উপলব্ধি থেকে ক্রমশ: পিছনের দিকে ছুটছি। উল্টোপথ। উল্টোরথ। ঈশ্বর কি আমাদের এই সিদ্ধান্তহীনতাকে প্রভাবিত করছেন নাকি আমরা তার সিদ্ধান্তকে থোড়াই কেয়ার করছি। একবার ভাবুন বিবেকবান পাঠক এই কথাগুলো কেনো বলছি।
পৃথিবীটা বুড়ো-ধাড়ীদের মতো ন্যুয়ে পড়েছে হে ঈশ্বর। এবার তুমিও বুড়ো হতে চলেছো। লাঠি ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে তোমাকেও ঘুরতে হবে পাড়ায় পাড়ায়। অচল পৃথিবীর মতো তোমাকে অচল বানালো কে? কোন অগ্নিপরিহাস তোমাকে এমন ঢিল ছুঁড়লো? কথাগুলো শাফি সমুদ্র বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে যায়, যেখানে যাবার আছে তার। তার এই অনুভূতিগুলো প্রকাশের ভঙ্গিমা অনেক্ষণ ধরে দেখছি। ভাবলাম ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কতো না অভিযোগ থাকে মানুষের। মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বর কতো মাইল দূরে থাকে? তিনি কি লাল রঙ ভালোবাসেন? নীল রঙ? কোন রঙ তার কাছে পছন্দের? তিনি মানুষকে কোন কোন রঙ দিয়ে নির্মাণ করেছেন? দারিদ্রতার রঙ কি কমলা বা হলুদ? নাকি মানব জাতি সৃষ্টিতে তিনি একজন ব্যার্থ স্রষ্টা। আমরা তাকে কি বলতে পারি? এইরকম প্রশ্ন হরহামেশা সে করে বেড়ায়।
ঈশ্বরের সাথে তার এই দূরত্ব কেন প্রশ্ন করলে হেলায় হেলায় উত্তর আসে-‘তিনি অযথা মানব জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কাজ কি? শুধু প্রার্থনা করা? মানুষকে কি তিনি শুধু তার আরাধনার জন্য সৃষ্টি করেছেন? তাহলে মানুষের ক্ষুধা লাগে কেন? কেন ক্লান্ত হয়? কেন ক্ষমতা কেন্দ্রীক হয়?  মানুষ কেন দরিদ্র থাকে, কেন ধনী হয়?’ এইসব অজস্র প্রশ্ন সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে। তার কাছে এসব অর্থহীন মনে হয়। সে বিশ্বাস করে তিনি (জনাব ঈশ্বর) যদি মানুষকে সেরা জীব হিসেবে তৈরী করেন তবে ভারসাম্যহীন করলেন কেন? সবাইকে ধনী বা সবাইকে দরিদ্র করলেন না কেন? পাপের ভিতর দিয়ে তিনি সৃষ্টি করলেন কেন?
একবার শাফি সমুদ্র এক প্রতিবেশীর আত্মহত্যা দেখে সারা গ্রামময় ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। আত্মহত্যাকে সে সব সময়ই স্বাগত জানায় এবং এর জন্য অন্যদেরকেও প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ করে। কেননা সে বিশ্বাস করে যে- ‘আত্মহত্যাই পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। সবাই ইচ্ছা করলেই এ পথ গ্রহণ করতে পারে না। এটি একটি শিল্প, কেননা সব শিল্পেরই জন্ম একটি দুঃসাহসের ভিতর দিয়ে। আত্মহত্যা মানেই এই অপ্রয়োজনীয় পৃথিবীটাকে ধীক্কার জানানো। পৃথিবীটা মানুষের জন্য নয়। এটি একটি প্রকৃতি কেন্দ্রীক গ্রহ হতে পারতো। এখানে জীব-জানোয়ারের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতিকে সংগ্রাম করতে হয় না। চুরি-ডাকাতি করতে হয় না। খাদ্যের জন্য অনিশ্চয়তার দিকে ছুটতে হয় না। জীব সাধারণকেই এই প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। ঈশ্বর প্রাণিকূলক কেন এই সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছেন? এর অর্থ কি? অকারণেই পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছেন আবার সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছেন কেন? এসব অনিয়মের কারণে প্রাণীকূলকে প্রতিবাদ সরূপ এ পৃথিবী থেকে সেচ্ছায় বিদায় নেয়া উচিৎ। যারা স্বেচ্চায় বিদায় নেয় তারা গর্বিত।’

এইসব ধ্যান ধারণা নিয়ে শাফি সমুদ্র প্রচার প্রপাগা-া করে বেড়ায়। তার গ্রামে ঢোকার পথে ছোট একটা দেয়াল লিখন দেখলাম-‘এখানে ঈশ্বরের প্রবেশ নিষেধ’। একসময়ে জিজ্ঞেস করলাম এখানে এটা লিখেছেন কেন? সে নিরুত্তর থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমারদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললো। তারপর সোজা হেঁটে চললো তার বাড়ির বাইরের দিকে। আমিও পিছনে পিছনে হাঁটলাম। সোজা পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলো। আমাকে পানি দেখালো। পানি দেখলাম। পানির ভিতরে একজন নারীর ছবি দেখানো চেষ্টা করলো। 
বললো- ‘এই পানিতে তাকিয়ে দ্যাখো একজন নারী ভেসে আছে। হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।’ 
আমি বহুক্ষণ দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই ,পানিতে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বললাম-‘কই কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।’
আমাকে ধমক দিলো। আমি কিছুটা চুপসে গেলাম, ভাবলাম আক্রমণ করে বসে কি না। না। আক্রমণ করেনি। 
চাপা কণ্ঠে বললো-তোমরা অনুভূতির নরকে পুড়ছো, কিছুই দ্যাখোনা। দেখার চেষ্টা করো না। তোমাদের চোখ অন্ধ। তোমরা কানে শোননা। ঈশ্বর তোমাদের সে ক্ষমতা দেয়নি কেন? কি দোষ করেছো তোমরা? দ্যাখ, ঈশ্বর তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে তোমাদের কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। 
- আচ্ছা, পানির ভিতরে যে মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছেন সে কে?
- ও এই পৃথিবীটাকে ধীক্কার জানিয়েছে। এমন দুঃসাহসী মেয়েকে তিনি নির্মাণ করে ব্যার্থ হয়েছেন। এটা তার বাসযোগ্য পৃথিবী নয়। অযৌক্তিক ভাবে তিনি মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। 
- মেয়েটি কি এখানে এই জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলো?
- না
- তবে?
আমার দিকে আবারো চোখ মোটা মোটা করে তাকালো। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছি না। আবার ভাবছি বলেই ফেলি- ‘আপনি কি তাকে হত্যা করেছিলেন?’ ভয়ে বুক কাঁপছে। সে কি হত্যাকারী? ভাবলাম আমিও যদি এই পৃথিবীর জন্য অনর্থক হই তাহলে আমাকেও সে মেরে ফেলবে? তবুও বুকে সাহস নিয়ে বলে ফেললাম। সে বললো-
- হ্যাঁ। আমি তাকে হত্যা করেছি।
- কিভাবে?
- গলাটিপে।
- কী সর্বনাশ!
- সর্বনাশের কিছু নেই। আমিও তোমাকে এই মৃত্যুর জন্য আহ্বান করছি। হে মানুষ তুমিও সদানন্দে এটা গ্রহণ করো। ইতিহাস হবে।
-
আমার ভিতরে ভয় আরো ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচিছ। নিজের ভিতরে হারিয়ে যাচ্ছি।
- তুমিও এ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও হে অপ্রোয়জনীয় মানব।
- কেনো?
- পৃথিবীতে তুমি কিসের জন্য এসেছো? তোমার কাজটা কি? তোমাকে একদিন তো মরতেই হবে। তোমাদের ঈশ্বর তোমার কপালে একদিন মৃত্যু নিশ্চয়ই লিখে রেখেছেন তাই না?
- হ্যাঁ।
- তাহলে তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে আবার তোমাকে মেরে ফেলবে কেন? এর যুক্তি কি?
- জানি না।
- তার চেয়ে ভালো তার এই অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। যদি তুমি প্রতিবাদী হও, তুমি যদি সৃষ্টিটাকে আরো সুন্দর করে দেখতে চাও যেখানে মানুষের মৃত্যু নেই, যেখানে মানুষের কষ্ট নেই, যেখানে মানুষের বৈষম্য নেই, সংগ্রাম নেই, তাহলে তোমাকে সেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে প্রতিবাদ জানাতে হবে। 
- আমি মৃত্যু চাই না।
- তাহলে কি চাও?
- অমরত্ব।
- তিনি কি তোমাকে সেটা দিয়েছেন?
- না।
- তাহলে তোমার বেঁচে থাকার কোন দরকার নেই।
- যে ক’দিন পারি বেঁচে থাকি, এখন মৃত্যু চাই না।
- না, তুমি যে ক’দিন বেঁচে থাকবে সে ক’দিন ঈশ্বর তোমাকে নিয়ে খেলা করবে। নানান রকমের খেলা। তুমিতো অন্যের খেলার সামগ্রী নও। তুমি মানুষ। মানুষেরা কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। তুমি যদি মানুষ না হও তাহলে তুমি লাটিম। ঈশ্বর সুতো দিয়ে তোমাকে পেঁচিয়ে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন। তুমি ঘুরছো। ঘুরছো তো ঘুরছো। এখানে তোমার কোন স্বাধীনতা নেই। তোমার কোন ঘূর্ণয়মান কক্ষ নেই। তোমাকে কেন্দ্র করে কোনকিছু আবর্তিত হচ্ছেনা। তোমার বেঁচে থাকার কোন যুক্তি নেই।
-যুক্তি নেই। আমাকে মেরে ফেলুন। আমি অনর্থক বাঁচতে চাই না। আমাকে গলাটিপে মেরে ফেলুন। এ পৃথিবী আমার জন্য নয়। এখানে আমাকেও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমি আর বেঁচে থাকার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি কি কারণে বেঁচে থাকবো? কি কারণে আমার বেঁচে থাকা জরুরি? আমি জানি না। আমি বুঝতে চাই না। আমাকে মেরে ফেলুন। আমি পৃথিবীকে ধীক্কার জানাই।
-হ্যাঁ, তোমাকে বিদায় নিতে হবে। তুমি তোমাকে চিনতে পেরেছো। বুঝতে পেরেছো। তোমাকে ওই জলে ডোবা নারীর কাছে যেতে হবে। তুমিও প্রতিচ্ছবি হবে। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তুমিও হাসবে। ধীক্কার জানাবে আর ঈশ্বরের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তুমিও মেতে উঠবে।

বলতে বলতে শাফি সমুদ্র আমার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। আমার গলার কাছে তার হাত নিয়ে আসছে। তার দু’হাত দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসছে আমার মৃত্যুমুখি দরোজা। আমি নীল হয়ে যাচ্ছি। আমি ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছি। আমার শরীর থেকে সমস্ত রঙ নিভে যাচ্ছে। চারিদিকে ক্রমশঃ অন্ধকার নেমে আসছে। আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার চারপাশে প্রকৃতি-নদী-সূর্য-আকাশ কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শুধু অন্ধকারের ভিতরে জলেডোবা রূপান্তরিত নারীর অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছি। আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমিও আমার হাতটাকে প্রসারিত করছি। আমিও ডাকছি পৃথিবীর সকল মানুষদেরকে। তাদের জন্য আমার হাতটা আরো দীর্ঘ করে তুলছি।


ロ শাফি সমুদ্র



Pages