কুকুর, চাঁদবন্ধু ও অন্যান্য - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮

কুকুর, চাঁদবন্ধু ও অন্যান্য

শাফি সমুদ্র

কুকুর আর চাঁদের ভিতরে খুব বেশি পার্থক্য নেই। চাঁদ রাত জেগে জেগে পৃথিবীটাকে পাহারা দেয় আর কুকুর জেগে জেগে পৃথিবীর মানুষদেরকে পাহারা দেয়। কুকুর ও চাঁদের ভিতরে বন্ধুত্বে ও ভাবের এটাই শুরু আদিকাল থেকেই। এ কারণ থেকে কুকুরটি সারারাত চাঁদের সাথে কথা বলে, হাসে, মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে আর চাঁদও সান্তনা দেয়, দু’জনের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। রাত গভীর হলে কুকুরটি খুব জোরে চিৎকার দিয়ে চাঁদকে নিচে নেমে আসতে বলে। আর চাঁদ তার আলো আরো বেশি ছড়িয়ে জানান দেয় আমিও তোমার পাশে আছি বন্ধু, আর ডেকোনা। দেখো-‘পৃথিবীর মানুষেরা কতো পবিত্র ঘুমে আচ্ছন্ন। এসো আমরা খুব গোপনে কথা বলি। আমাদের যতো কথা থাকে।’ এভাবেই চাঁদ ও কুকুরের ভিতরে প্রতিদিন কথা হয়। তারা পরস্পর আরো ঘণিষ্ঠ হয়। কুকুর চাঁদটিকে খুব ভালোবাসে আর চাঁদ কুকুরটিকে আরো আলোকজ্জ্বল করে তোলে। পৃথিবীতে সেদিন কি ঘটেছিলো তা আমাদের জানা নেই। যখন অমাবশ্যা নামে তখন কুকুরটির ভয় হয়। ভীষণ ভয়। আজ সে একা। এমনি এক রাতে কারা যেন একটি লাশ ফেলে গেলো, ঠিক যেখানে বসে কুকুরটি চাঁদকে কাছে ডেকে কথা বলে।

লাশ! যে লোকটি আজ লাশ হয়ে এখানে এলো, এক সময় কুকুরটির সাথে সে লোকটিরও ভাব ছিলো। প্রতিদিন সকালে রুটি ছিড়ে ছিড়ে ওকে খাওয়াতো। এসব কথা ওর মনে পড়ছে। এই লোকটাই একদিন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো পাহাড়ের উপরে। চাঁদের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। কুকুরটি অঝোরে কাঁদছে। পাশে কেউ নেই। মেঘের ওপারে যে চাঁদটি লুকিয়ে আছে তাকে চিৎকার দিয়ে ডাকে। চাঁদেরও কোন সাড়া-শব্দ নেই। লাশের পাশে বসে কুকুর আরো বেশি চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। একদিন এই লোকটি খুব দূরে প্রবাহিত একটা নদীর কাছে গিয়ে তাকে দেখালো কিভাবে নদীরা কাঁদে। কিভাবে নদীরা মা’কে ডাকে, প্রণাম করে। মায়ের আঁচলে খুব যতেœ ঘুমায়। সে এসব ঘুমের অজস্র বর্ণনা কুকুরের কাছে করেছে।

কুকুরের ভিতরে অজস্র কৃতজ্ঞতা থাকে। মানুষ বোঝেনা। লাশের সারা শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। তার মুখের কাছে কুকুরটি মুখ রাখে। কোন গন্ধও নেই। সারা শরীর খুব তীক্ষè নজরে দ্যাখে কোনো আঘাতের দাগও নেই। তাহলে লোকটি মরলো কিভাবে, কে তাকে মেরে ফেললো? কারা তাকে এখানে নিয়ে এলো? কতোগুলো চিন্তা তাকে বেশ আক্রমণ করে। সে একবার এদিকে ছুটছে আরেকবার অন্যদিকে ছুটছে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আশে পাশে কেউ নেই। কোন মানুষ নেই। কি করবে কুকুরটি এখন? ভাবনায় আসে না। একবার নদীর কাছে ছুটে গেলো। লোকটি যে নদীকে তার মা বলে সম্বোধন করে, মায়ের মতো নদীকে শ্রদ্ধা করে। হয়তো একমাত্র নদীটি জানে তার মৃত্যুর খবর আর কি কারণেই বা তার মৃত্যু ঘটেছিলো। 

নদীর কাছে বিনম্র শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে কুকুরটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। নদী ধীরে আরো ধীরে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে অন্য কোন দিকে। কুকুরটিও ছুটছে যে দিকে নদীটি চলে যাচ্ছে। চিৎকার করছে। সে কি চিৎকার! নদী কথা বলছেনা।  কাঁদছে। নদীর কান্না খুব সুর হয়ে বাজে হৃৎপিণ্ডের গহীন ভেতরে। কুকুরটি অনুভব করছে। তীব্র অনুভবে আরো বেশি চিৎকার করছে। মানুষের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। তবুও নদী নিরুত্তোর। আজ নদীর কী হয়েছে? কথা বলছেনা কেন? তার ভেতরে সন্দেহ হয়, এই নদীই বুঝি মানুষটির হত্যাকারী। সে এবার আরো স্তব্ধ হয়ে যায়। 

 লাশের কাছে সে ফিরে আসে। এবার দ্যাখে লাশটি ঘামছে। তার ঘামে নিচের মাটি ভিজে যাচ্ছে। তার ভেতরে আরো ভয় বেড়ে সে ক্রমশ হাফিয়ে ওঠে। এখন রাত গভীর। একা কি করবে বুঝতে পারছেনা। লাশটিকে কবর দেবে নাকি পাহারা দেবে। লাশের ঘাম কুকুরটি শুঁকে দ্যাখে। গোলাপ ফুলের গন্ধ। ঘামে গোলাপের গন্ধ, কুকুরটি বুঝতে পারছেনা কেন এই গন্ধটা। হঠাৎ মনে পড়লো একটি গোলাপ বনে লোকটি প্রায়ই যেতো। একটি গোলপের সাথে প্রায়ই কথা হতো। ভালোবাসার কথা। গোলাপকে খুব বেশি ভালোবাসতো আর গোলাপ ওকেও খুব ভালোবাসতো। কুকুর গোলাপটিকে চেনে। লোকটি একদিন ওই গোলাপের সাথে সঙ্গম করবে বলেছিলো। ফলে সে চিরোযৌবনের অসম্ভব শক্তি লাভ করবে। হাজার হাজার গোলাপ গাছের ভিতরে ওই গোলাপ কখনো ঝরে পড়েনা। কেউ ওকে ছিঁড়তে গেলে মুহূর্তে সে নিজেকে গাছের শরীরে লুকিয়ে রাখে। যাতে কেউ ওকে দেখতে না পারে। এভাবে গোলাপটি দস্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে। প্রতি পূর্ণিমায় অসম্ভব জোছনা সারা শরীরে মেখে স্নান করে। একেবারে নিজেকে উলঙ্গ করে দেয়। নাচে, গান করে। একমাত্র এই লোকটাই গোলাপের এই উলঙ্গ শরীর দেখে অনেক বেশি মাতাল হয়ে যায়। 

কুকুরটি ছুটে গেলো গোলাপ বাগানের দিকে। আশ্চর্য! গতকালও যে বাগানটি ছিলো ফুলে ফুলে সুরভিত, ফুলের সৌরভে গ্রামের মানুষদেরকে স্পর্শকাতর করে তুলতো আজ সেখানে গোলাপ বাগান নেই। খুটখুটে বিরাণ ভূমি। কোথায় গেলো বাগানটি? সে ভাবতে থাকে। এমনটিতো হবার কথা ছিলো না। বাগানের মাঝে যে চৌচালা ঘরটি ছিলো, সেটিও নেই। তাহলে গোলাপেরা গেলো কোথায়? উত্তর মেলে না। কুকুরটি ফিরে এলো লাশের কাছে। এবার সে সেই ঘাম আর দেখলো না। মৃত: শরীরে কোন গন্ধও নেই। আবার লাশটিকে ভালো ভাবে সে দেখলো। এবার হঠাৎ কপালে একটা ক্ষত চিহ্ন দেখতে পেলো। অনুভব করার চেষ্টা করলো, তাহলে কি  কেউ মাথায় আঘাত করলো? কিন্তু সামান্য এই আঘাতে মৃত্যু হবার কথা নয়। রক্ত ঝরছে। তাজা রক্ত। মনে হচ্ছে এইমাত্র তাকে কেউ আঘাত করেছে। কপাল বেয়ে মাটিতে রক্ত পড়ছে। লাল রক্ত। ধীরে ধীরে কালচে আকার ধারণ করছে। কুকুরটি বুঝতে পারছেনা মৃত মানুষের কপাল থেকে ঘামের মতো কিভাবে রক্ত ঝরে!

লোকটির সাথে কুকুরের যে রকম সখ্যতা ছিলো তাতে সে ভালোভাবেই জানে তার কোথায় কোথায় যাতায়ত ছিলো। এরকম সখ্যতা মানুষে মানুষে খুব কম থাকে। একজন  শৈশব বন্ধুর মতো লোকটির সাথে কুকুরও ঘুরে বেড়াতো পাড়ায় পাড়ায়। লোকটি যখন পতিতালয়ে যেত কুকুরটি তখন ঐ পল্লীর গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো। নানান রঙের পতিতাদের সাথে কুকুরটির বেশ ভাব ছিলো। ওরাও কুকুরটিকে বেশ ভালোবাসতো। খেতে দিতো। মাঝে মাঝে লোকটিকে ও যখন খুঁজে পেতোনা তখন এ গলির মাথায় এসে দাঁড়ালে পতিতারা তাকে বলে দিতো আজ নাগোর আসেনি কিংবা আজ কার ঘরে আছে। একদিন লোকটিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলোনা। পতিতালয়ে, গোলাপ বাগানে কিংবা নদীর ধারে কোথাও সে নেই। তাহলে কোথায় গেলো লোকটি? কুকুর ছুটে চললো এপাড়া থেকে ওপাড়ায়। হঠাৎ দুপুরের দিকে একটি প্রাচীন বৃক্ষের সাথে কথা বলতে দ্যাখে। বৃক্ষটিও লোকটির সাথে কথা বলে। বাতাস দেয়। তখন সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে ঘেউ ঘেউ করে তার উপস্থিতি জানান দেয়। আনন্দে ধূলোর উপর গড়াগড়ি খেলো কিছুক্ষণ। তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে লোকটির পিছন ঘেঁষে দাঁড়ালো।

বৃক্ষটি আরো বেশি দুলতে থাকে। কথা বলছে লোকটির সাথে। কি কথা তার সাথে? বৃক্ষটির পায়ের কাছে মাথা ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে কাঁদছে সে। সেদিন কুকুরটি তার মাথা থেকে যেভাবে রক্ত বের হতে দেখেছে, গড়িয়ে গড়িয়ে রক্তে মাটি ভিজে গেছে, রক্তের রঙ লাল থেকে যেভাবে কালচে হয়ে গেছে আজও ঠিক সেরকম লাগছে। কুকুরটি ভাবছে তাহলে ঐ প্রাচীন বৃক্ষটি হয়তো জানে আসলে প্রকৃত ঘটানা কি ঘটেছিলো। উপায়ন্তু না দেখে কুকুরটি ছুটে চললো বৃক্ষের কাছে। আবার ফিরে এলো। কেন জানি কুকুরটি যেতে চাইছেনা। ওর ভিতরে আবারো ভয় ঢুকে যাচ্ছে। একবার দৌঁড়াতে শুরু করে আবার ফিরে আসে। আবার কিছুদূর দৌঁড়ে ফিরে আসে। অবশেষে কুকুরটি ছুটে গেলো প্রাচীন বৃক্ষের দিকে।
রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ সে থেমে গেলো। ঠিক এই পথ তার কাছে অপরিচিত লাগছে। এটাতো নদীঘাটের পথ। আমি এই দিকে যাচ্ছি কেন? ও পথ হারিয়ে ফেলেছে। আবার পিছনে ফিরে এসে অন্যপথে ছুটে গেলো। ছুটতে ছুটতে আরো কিছুদূর সামনে গিয়ে পথ চিনতে পারছেনা। ক্রমশ পথ হারিয়ে ফেলছে। অবশেষে অনেক কষ্টে পথটি খুঁজে পেলো। আরো কিছুদূর সামনে হয়তো বৃক্ষটির দেখা পাবে।

কিন্তু এখানে এসেও কুকুরটি বিভ্রান্ত হলো। এখানে সেই প্রাচীন বৃক্ষটি আর নেই। গতকাল নাকি এই বৃক্ষটিকে কেউ হত্যা করেছে। কি কারণে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ? কে বা কারা এই কাজটি করলো কেউ জানে না। বৃক্ষটির অপরাধ কি ছিলো তা আমাদের জানা নেই। আহা! অপরাধী বৃক্ষ! মানুষ তোমাকে বুঝলো না।  কুকুরটি এভাবে ধীক্কার জানাতে থাকে আর ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার দিতে থাকে। বৃক্ষটির এ অবস্থা দেখে কুকুরটি গোঙাতে থাকে। চোখ থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরছে। সে তার কান্না থামাতে পারছেনা। অন্ধকার রাতজুড়ে চারিদিকে কেবল তার কান্না শোনা যায়। আবার লাশের কাছে কুকুরটি ফিরে আসে। এবার লাশটি বরফের মতো শীতল হয়ে যাচ্ছে আর দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লোকটির পাশে বসে বসে কুকুরটি কাঁদছে। মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এবার লাশটিকে কবর দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। নখের আঁচড় দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে কুকুর হাফিয়ে উঠছে। তবুও রাত শেষ হবার আগেই লাশটিকে কবর দিতে হবে। তা না হলে মানুষেরা এই লাশ নিয়ে টানা-ছেড়া শুরু করবে। সঙ্গত কারণেই কুকুরটি আরো ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সে ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে ওঠে। তবু বিশ্রাম নেই। শেষ রাতের দিকে কুকুরটি মাটি খোঁড়া শেষ করলো। তারপর লাশটির কাছে ছুটে এলো। কিন্তু কোথায় লাশ? কেউ নেই। যেখানে লাশটি দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো সেখানে লাশ নেই। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। লাশটিকে কারা নিয়ে গেলো বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ দৌঁড়াদৌঁড়ি করলো এদিক সেদিক। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। সম্ভবত: যারা লাশটি এখানে ফেলে গেলো, ওরা লাশ সরিয়ে ফেলেছে। সে অঝোরে কাঁদছে। ধীর পায়ে পাহাড়ের মাথায় এসে তার চাঁদবন্ধুকে ডাকছে আর কাঁদছে।


ロ শাফি সমুদ্র


Pages