বনবিবি || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

শুক্রবার, ৯ মে, ২০২৫

বনবিবি || শাফি সমুদ্র

 




বনবিবি

শাফি সমুদ্র


সময়কাল: ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট

দৃশ্যসংখ্যা: ১৭

শৈলী: লোকনাট্য, সংগীত ও সংলাপনির্ভর



চরিত্র: বনবিবি, দক্ষিণ রায়, গাজীপীর, গায়েন দল, পিশাচের দল।



দৃশ্য ১: গায়েনদের গান ও সুন্দরবনের ভয় ও দেবীর ডাক


(মঞ্চ অন্ধকার, কুয়াশায় ঢাকা। ঝাপসা সবুজ আলো দুলছে। পেছনে ঢোল, দোতারা, বাঁশির মৃদু সুর। গায়েনরা লাল ফেটা বাঁধা, ধুতি-কুর্তা পরা, একতারা হাতে।)

কোরাস গান (গায়েনরা)

(বাঁশি আর ঢোলের মৃদু ছন্দে গায়েনরা গেয়ে ওঠে)

(কোরাস - প্রথম স্তবক)

১.

কাঙালেরও মাতা তুমি বিপদনাশিনী

আমারও দুঃখের মাঝে তরাবে আপনি।।

বনবিবিগো

ও বনবিবিগো।।

বনবিবি মাগো তোমার ভরসাতে এলাম

দুধেভাতে থাকবো সুখে সেলাম দিলাম।।


যেনো বাঘে ছুয়ে না

যেনো বাঘে ছুয়ে না

গায়েন ১ : (স্বরে হালকা ভয় ও বিস্ময়) এই বন... এই নদী...জলে মিশে আছে প্রাণের কান্না। পাতার ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় চাপা ফিসফিসানি— 'ভয় করো, ভয় করো! কার ভয়? বাঘের? নাকি সেই পুরনো অভিশাপের— যেখানে শক্তি মানে শুধু ছিনিয়ে নেওয়া, জীবন মানে শুধু পালিয়ে বাঁচা?

(এক মুহূর্ত থেমে গায়েন ১ চারদিকে তাকায়, যেন বনের ভয় অনুভব করছে।)

গায়েন ২ : (আবেগে কাঁপা কণ্ঠে) আমরা যারা নদী মাপি, গাছের ছায়ায় ঘুমাই, আমরা যারা মৌচাক কেটে মধু নিই —আমরা জানি, এই বন কারো নয়! তবুও ভয়...ভয়ের ঘ্রাণ থাকে বাতাসে, বাঘের পায়ের ছাপ থাকে কাদায়, আর আমাদের বুকের মধ্যে থাকে—প্রত্যেক নিঃশ্বাসে!”

গায়েন ৩ : (ঝড়ের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে) কিন্তু শোনো! শোনো! আজ, বহু বছরের নীরবতার পর, ভেঙে এসেছে এক পায়ের শব্দ! ভেঙে এসেছে এক চোখের জ্যোতি! তিনি আসছেন— সেই দেবী, যিনি ভয় নয়, সাহস দেবেন। শাস্তি নয়, ন্যায় দেবেন। কারো রাজত্ব নয়, বরং বনের মুক্তি দেবেন!

(সব গায়েন একত্র হয়ে উচ্চারণ করে যেন মন্ত্রপাঠের মতো)


(কোরাস - দ্বিতীয় স্তবক)


২.

বনের হরিণ সব খোদার মেহের

হামেশা পালন করে বনবিবির তরে

বেহেশতের নুর এসে কোলে কাঁখে নিয়া

তুষিয়া মায়ের মত ফেরে বেড়াইয়া।।


গায়েন ১ : (নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে) বনে যারা বাস করে, তারা জানে — কখনও বাঘের গর্জনে, কখনও নদীর ডাকে কখনও ঝড়ের রাতে ছিন্ন পাতার কান্নায়—ডাকে সেই অদৃশ্য মা! ডাকে বনবিবি।

গায়েন ২ : (স্বপ্নময় ভঙ্গিতে) যখন বাঘ দাঁত বের করে, যখন জল সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়— তখন গোপনে ভেসে আসে এক আশীর্বাদের ফিসফিসানি— 'ভয় করো না, আমি আছি!' সেই কণ্ঠ বনবিবির।

গায়েন ৩ : (আবেগের চূড়ায় উঠে) আজ, আজকের রাতে— যখন অন্ধকারও ভয় পায় নিজের ছায়াকে— সেই রাতে, এক জোছনার মৃদু আলোয়, ডাক শুনেছি আমরা— ডাক শুনেছে বন, জল, মাটি আর আকাশ!

(তখন দূরে একটা ছায়াময় নারী অবয়ব উদয় হয় — বনবিবির ছায়া।)


শেষ সুর:

ঢোলের গম্ভীর শব্দে আরেকবার গান শুরু হয়। গায়েনরা ধীরে ধীরে বনবিবির ছায়ার দিকে এগোয়, মাথা নিচু করে প্রণাম করে।


(কোরাস - শেষ লাইন)

৩.

“নিন্দের খুমারো ধোনা হাতে কয়।

আপনি কে বটে মোরে দেহ পরিচয়।।

শুনিয়া দক্ষিণরায় কহে এ প্রকার।

মোম মধু বাদাবনে সৃজন আমার।।

দণ্ড বক্ষ মুনি ছিল ভাটির প্রধান।

দক্ষিণা রায় নাম আমি তাহার সন্তান।।” 

(আলো ধীরে ধীরে নিভে যায়। মঞ্চ অন্ধকারে ঢেকে যায়।)



দৃশ্য ২: দক্ষিণ রায়ের হিংস্র আধিপত্য

(অন্ধকার মঞ্চে রক্তলাল আলো। গর্জন, ঝড়ের শব্দ, পাতা ছিঁড়ে পড়ার আওয়াজ। দূরে বাঘের হুঙ্কার। মঞ্চের মাঝখানে দক্ষিণ রায় — বিশাল কুৎসিত চেহারা, বাঘের চামড়া জড়ানো, হাতে ত্রিশূল, চোখে রক্তিম আলো। ছায়া-নাচ শুরু হয় — বিশালাকার বাঘ, মৃত গাছের ছায়া, বুনো পশুর ছায়া মঞ্চজুড়ে নাচে। ব্যাকগ্রাউন্ডে দ্রুত ঘুরতে থাকা ছায়া যেন বনের আতঙ্কের প্রতীক। তার প্রবেশের সাথে মঞ্চে ধোঁয়া উঠবে, ঝড়ের গর্জন বাড়বে, ছায়া-নাচ ধীরে ধীরে থেমে যাবে, তখন রায়ের গর্জনপূর্ণ সংলাপ শুরু হবে)

কোরাস গান (ভয়াবহ সুরে)

জঙ্গল কাঁপে রাজার ডাকে,

ভয় আর আতঙ্ক থাকে বাকে।

দক্ষিণ রায়, রক্তলোভী,

খাদে গরল, দাহে শোভা।


জলে কাঁপে, স্থলে কাঁপে,

ভয়ের ঢেউ মন্দ্র সাঁপে।

দস্যুর রাজার নিদান বয়ে,

কাঁদে বন, কাঁপে নদী বয়ে!


(ছোট্ট বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার)


(দক্ষিণ রায় সিংহাসনের উপর দাঁড়িয়ে। চোখ জ্বলছে আগুনে। চারদিকের বনবাসীরা থরথর কাঁপছে। দক্ষিণ রায় আকাশের দিকে ত্রিশূল তুলে গর্জন করে শুরু করে —)

দক্ষিণ রায় :  (অগ্নিময় কণ্ঠে) আমি! দক্ষিণ রায়! আমি বাঘের মাংসে ধুয়ে জন্ম নিয়েছি! আমি হিংস্রতার দুধ পান করে বড় হয়েছি! আমার শ্বাসে লতার প্রাণ শুকায়, আমার দৃষ্টিতে জল শুকায়, আমার স্পর্শে পাথর গলে যায়। আমি ছিলাম এখানে জন্মের আগেও, ছিলাম শিকড়ের নিচে, নদীর গভীরে, বাতাসের রন্ধ্রে। আমি এই বনের রক্ত! আমি এই মাটির হিংসা! আমি এই জলন্ত আগুনের ঠাণ্ডা মৃত্যু! (রায় মাটিতে ত্রিশূল মেরে বজ্রধ্বনি তোলে)

(আরো উগ্র স্বরে) শুনে রাখো, হে নস্যি প্রাণী! এই বন — কোনো দেবীর নহে, কোনো সাধুর নহে, কোনো কল্পিত ঈশ্বরের নহে —এই বন আমার! আমার চঞ্চুতে বিধান লেখা! আমার থাবায় শাসন জাগে! আমার দৃষ্টিতে মৃত্যু নাচে! কে তোমাদের বলেছে এখানে শান্তি আসবে? কে বলেছে এখানে করুণা বর্ষিত হবে? এখানে জন্ম শুধু ভয়কে, শুধু ত্রাসকে, শুধু মৃত্যুতে!

(রায় চারদিকে ঘুরতে থাকে, মৌয়ালরা মাটিতে বসে যায় ভয়ে)

(দক্ষিণ রায় নির্দয় ঠাট্টায়) বেঁচে থাকতে চাও? মাথা নত করো! দুই হাতে রক্তের অঞ্জলি নিয়ে এসো আমার চরণে। জীবন চাইলে ভয় কিনতে হবে— বিনিময়ে কাঁপা প্রাণের ভিক্ষা নিতে হবে! আমি ভক্তি চাহি না— আমি চাহি তোমাদের নতজানু হাড়ভাঙ্গা আত্মসমর্পণ!

(একজন বৃদ্ধ মৌয়াল এগিয়ে আসে, কাঁপতে কাঁপতে মধু কিছু মাটিতে রাখে। রায় নাক সিঁটকায়, তীব্র ঘৃণায়। চরম অবজ্ঞায়, গর্জে ওঠে) 

কি আনলে? মধু? কাঠ? যে মধু গাছের কান্না দিয়ে জমেছে, যে কাঠ মৃত বৃক্ষের হাড়গোড়— সেই সামান্য দান দিয়ে রাজা কিনবে? আমি তো চাই তোমাদের ভয়! তোমাদের নিঃশ্বাস থামিয়ে দিতে চাই আমার ইশারায়! (রায় ত্রিশূল দিয়ে মাটিতে আবার আঘাত করে— বাঘের গর্জন শুনি।)

শুনে রাখো —যদি কারো পায়ের শব্দ শুনি আমার অরণ্যে, যদি কারো হাতের স্পর্শ পাই আমার বৃক্ষে, যদি কারো নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায় আমার বাতাস—আমি বাঘ পাঠাবো, মৃত্যু পাঠাবো, দুর্ভিক্ষ পাঠাবো! এই বনে আমার রাজত্ব— এখানে 'নিবেদন' নেই, আছে 'নিপীড়ন'। এখানে 'ভালবাসা' নেই, আছে 'ভয়'। এখানে ঈশ্বর নয়— দক্ষিণ রায়ই একমাত্র বিধাতা! (দক্ষিণ রায় ছাদের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়ে। আলোক ঝলকানি, মঞ্চ কাঁপে।)


শেষে কোরাস (ভীতিপ্রদ সুরে)


নিঃশ্বাস চেপে রাখে বাঘ,

হরিণ ডাকে নীরব বাধ।

পাখির ডানা থেমে যায়,

বনবিবির ডাকই চায়।


ভয় মিশে আছে পাতায় পাতায়,

ভয় মিশে আছে বাতাস বয়ে।

রক্তের রাজা, দুঃস্বপ্ন বয়ে,

জলে-স্থলে দাহ ছড়ায় রয়।


(মঞ্চ অন্ধকারে ডুবে যায়। দক্ষিণ রায়ের উন্মাদ হাসি ভেসে আসে।)



দৃশ্য ৩: দূর্গা রূপে বনবিবির আবির্ভাব


(মঞ্চের চারপাশ এখনো অন্ধকার। দক্ষিণ রায়ের ভয়াল দৃশ্যের পর খানিক সময় অশান্ত বাতাসের শব্দ, যেন বন থেমে গেছে। ধীরে ধীরে পেছন থেকে এক শুভ্র আলো ছড়িয়ে পড়ে। বাজে ধীরগতির, গভীর ঢোল আর শঙ্খের ধ্বনি। মঞ্চের কেন্দ্রে ধীরে ধীরে উদিত হন বনবিবি — সাদা, সবুজ ও সোনালি পোশাকে; মাথায় সূক্ষ্ম আলোকিত মুকুট। পেছনে বাঁশি বা শিঙার মিষ্টি সুর বয়ে আসে।)


বনবিবি : আমি বনবিবি! আমি দয়া, আমি সাহস, আমি বনভূমির নির্ভীক মা! দক্ষিণের ভয়াল থাবা ভেদ করে, উত্তর-দক্ষিণের বাতাসে আজ আমার গান বয়। কুকুরের মতো মানুষ শিকারের দিন ফুরালো! মৌয়াল, কাঠুরে, জেলে—তাদের শ্রম, তাদের ঘামই বনের পবিত্র অর্ঘ্য। বন কারো সম্পত্তি নয়! বন কারো খেলার বস্তু নয়! আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে —যে বনের বুকে ঘুমায়, যে বনের জলে পিপাসা মেটায়, যে বনের আকাশের পাখি হয়ে উড়ে— সে-ই বনভূমির উত্তরাধিকারী! (একটু থেমে, গর্জন করে) দক্ষিণ রায়, তোমার দম্ভ ভেঙে পড়বে! ত্রাস নয়, ভালোবাসা হবে বনের নতুন শাসন! (দর্শকদের দিকে ফিরে) এসো, বনভূমির সন্তানেরা, এসো, আলোকিত করো তোমাদের বেঁচে থাকার অধিকার!


কোরাস ১ম স্তবক


আলো ফুঁটে অরণ্যপথে,

বনমা আসেন দীপ্ত রথে।

সিংহ গর্জে পায়ের তলে,

ভয় হারায় অশান্ত ঢলে।

আশার দীপ জ্বলে হৃদয়ে,

বিবির নামে সাহস বয়ে।


বনবিবি : আমি পৃথিবী, আমি আকাশ, আমি অতলান্তি—আমারই প্রলয়ে সৃষ্টি, আমারই অবলম্বনে মৃত্যু। আমি চিরকাল—যেন মহাকালের আলোর মধ্যে শীতল ছায়া। (দ্রুত কথা বলার পরিবর্তে, স্বরগুলোর মধ্যে এক একটি গতি ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে আসে। তার বাণী যেন শোনা যাবে নীরবতার মাঝেও) আমি সেই মাকে জানি, যে গর্ভে নিঃশব্দে সৃষ্টিকে ধারণ করে, আমি সেই রক্তের সম্পর্কের মতোই প্রবাহিত, যখন বৃক্ষের শিকড়ে নোনা পানি প্রবাহিত হয়— তেমন আমারই স্পর্শে বেড়ে ওঠে জীবনের রূপরেখা।

তুমি, দক্ষিণ রায়, তুমি কি জানো, যে বনের গভীর অন্ধকারে প্রথম আলো ছিল, সে তুমি নও! (একটু থেমে, যেন একটি দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে) তুমি কেবল তোমার শ্রেষ্ঠত্বের নামে দাবী করো—তোমার শাসন কি প্রকৃতির ঋণ থেকে আসবে? তুমি কি জানো, বন, আমার বন—সেই বন, যে কখনো শাসন শিখেনি! বন তো সেই প্রাচীন নদী, যা মুক্তির দিকে প্রবাহিত—শাসন করতে হলে তোমাকে আমার মতো, প্রকৃতির ভাষা শিখতে হবে।

(এখন তিনি সকলের দিকে তাকিয়ে, স্নেহের সুরে, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে) আমি এসেছি, আমার কথায় কোনো দম্ভ নেই, আমি এসেছি—যত্নে, সহানুভূতির সঙ্গী হচ্ছে। আমি এসেছি, কারণ বন বলে ‘সকলের’। আমার কাছে কোনো প্রান্তিকতা নেই, যেমন নদীর মাঝের কনকনে স্রোত, সে কখনো তার পথ ভুলে যায় না। একে একে, হাজার বছর পর, পৃথিবী আমার কাছে ফিরে আসবে— জীবনের যে সংজ্ঞা ভুলে গেছে, আমি তাকে জানিয়ে দেব। (চোখের গভীরতা বেড়ে গিয়ে, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা, স্নেহের ভাব) দক্ষিণ রায়, তুমি যতই শক্তিশালি হও, তুমি যখন যতই শিকার করো, তোমার শিকারকে হাড়ে-হাড়ে স্পর্শ করো— আমি সেই শক্তি, যে প্রতিটি কাঁটা, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাপড়ি— আমি তাদের প্রাণ, তাদের ইতিহাস, তাদের স্মৃতি হয়ে আছি।

আমি কখনো ভাঙি না, আমি কখনো ভেঙে যাই না— আমি বাঁচিয়ে রাখি। বাঁচিয়ে রাখি তোমার মতো ভ্রান্তির শিকার দক্ষিণ রায়কেও। আমি বাঁচিয়ে রাখি সবার জন্য— কারণ বন—বন আমার, বন সকলের!


কোরাস ২য় স্তবক


ঝড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে,

বিবি মা রক্ষা করেন ডাকে।

পাষাণ বুকে ফুল ফোটায়,

ভীত প্রাণে বল ফিরায়।

দূর্গা রূপে এলেন ধরণে,

জয় বনমা, রাখো বরণে!


(কোরাসের গান গাওয়া হচ্ছে, মঞ্চে আলো বাড়ছে, গাছপালা ছড়িয়ে পড়ছে এবং সবাই যেন নতুন একটা সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা অনুভূতি পাচ্ছে।)



দৃশ্য ৪: স্বপ্নে বনবিবির ডাকে গাজী পীর এর আগমন


(মঞ্চে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বাতি মৃদু সরে যায় এবং গাজী পীর এক সন্ন্যাসী রূপে মঞ্চে প্রবেশ করেন। তার চোখে গভীর দৃষ্টি, যেন সারা পৃথিবী তিনি একাই অনুভব করছেন। তার পরণে সুতি কাপড়, হাতে একটি ধূপদান এবং তার সাথে কিছু মন্ত্র জপ করার জন্য তবলাও রয়েছে। কিছুক্ষণ তিনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখ বন্ধ করে।)

(গাজী পীর মন্ত্রমুখী, চোখ বন্ধ, গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। মন্ত্র উচ্চারণের পরে ধীরে ধীরে কণ্ঠে এক গম্ভীর ও পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি)

গাজী পীর : (চোখ বন্ধ, গভীর ধ্যানমগ্ন, এক হাত প্রসারিত, দ্বিতীয় হাতে ধূপদান ধরে) এ কী রহস্যময় সুর? আমি যে পথের সন্ধানে ছিলাম, সেই পথ কি সত্যিই দেখা দেয়? অন্ধকারের পর, কী এক দীপ্ত আলো দেখা দেয়! (একটু থেমে, ধীরে ধীরে একটি সুফি সুরে কথা বলতে শুরু করেন)

‘ও সন্ন্যাসী, তুমি কোথা থেকে এসো?’ আমি বলি—‘আমি এসেছি পৃথিবীর প্রান্তর থেকে, যেখানে শরীর ক্ষয় হয়, কিন্তু আত্মা এক স্থানে নিবদ্ধ থাকে।’ (চোখ খুলে, যেন সে সবকিছু অনুভব করছে) আমি যে সূর্যের আলো, তাকে দেখি—আমি যে অগ্নির স্রোত, তাকে জানি। (কিছুক্ষণ থেমে, গভীর স্নিগ্ধ কণ্ঠে) আমি কি জানি, সুরের মাঝে কোথাও এক বিদ্রোহী অন্তর, যেখানে সবকিছু এক হয়ে যায়— আমি সেই আকাশের দিকে তাকাই, যেখানে জীবনের সকল সুর একাকার হয়ে ওঠে।

'বনবিবি'—এই নাম, যা বাতাসে ভাসে, তাঁর আওয়াজ কি শোনা যায়! আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্নায়ু এতো সময় ধরে তাকে খুঁজছে! (একটু থেমে, চোখ বন্ধ করেন, যেন কোনো স্বপ্নের মগ্নতা ভেদ করে) 'ও' তুমি, বনবিবি, সেই আলো যার মধ্যে অন্ধকার গোপন, যে অশান্ত নদীকে শান্তি দেয়— তুমি সে দেবী, যে আমাকে ডাকেছো, কিন্তু কেন? (গভীর শ্বাস নিয়ে, কণ্ঠে সুর তোলেন) অগ্নির মতো সেদিন গিয়েছিলাম যেখানে, সেখানে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি— কিন্তু তুমি, তুমি সেই আগুন, যে আগুনে আমি ধিকৃত! তুমি আমাকে যা বলো, তা শোনার আগে, আমাকে প্রস্তুত হতে হবে— তুমি যে আমাকে ডাকছো, সেই ডাক শোনার মতো কিছু নেই!

(একটু থেমে, মন্ত্র উচ্চারণের মতো তার কণ্ঠ অদৃশ্যভাবে আরও গভীর হয়ে ওঠে) 'তুমি যে ডেকে পাঠাচ্ছো, আমি সেই পথেই চলেছি— আমার আত্মা এখন তোমার ডাকের সুরে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। (হাত আকাশের দিকে প্রসারিত, ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলেন) তুমি বনবিবি, তুমি সেই দেবী, যে স্বপ্নের মাধ্যমে আমাকে কল্যাণের পথে ডাকো, আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দেবো— যেহেতু আমার পথ একেই বলে চিহ্নিত হয়েছে!


কোরাস (গাজী পীরের সংলাপের পর)


সুফি গান: গাজী পীরের বরণ

(মৃদু বাদ্যযন্ত্রের সাথে, ধীর তালে)


বাতাস বয়ে নরম গানে,

আসেন গাজী শান্তা প্রাণে।

ধুলায় ভরা পথের কোলে,

চরণ রাখেন দয়া ঢোলে।

আলো জাগে নিশির মাঝে,

পীরের বাণী প্রাণে বাজে।


(সকল কণ্ঠ মিলে ধীর ঘূর্ণির মতো)


আল্লা হু, আল্লা হু,

গাজী পীর, আল্লা হু।

আল্লা হু, আল্লা হু,

রহমত বয়, আল্লা হু।


চোখে দীপ্তি, মুখে করুণা,

আনে আশার অমল ধারা।

সীমার মাঝে অসীমের ডাক,

গাজী পীরের রহমত পাক।

ভয়ারে কাঁপে, প্রেমে জাগে,

তিনির ছায়া বনে লাগে।


আল্লা হু, আল্লা হু,

গাজী পীর, আল্লা হু।

আল্লা হু, আল্লা হু,

রহমত বয়, আল্লা হু।




দৃশ্য ৫: বনবিবির আগমনে দক্ষিণ রায়ের বিচলিতি মুহূর্ত


(মঞ্চে অন্ধকার পরিবেশ। মেঘে ঢাকা আকাশের নীচে দক্ষিণ রায় দাঁড়িয়ে আছেন, চারপাশে তার শিষ্য এবং পিশাচরা। দক্ষিণ রায় রাগে কাঁপছেন, তার চোখে ক্ষোভ এবং অন্তর্নিহিত ভয়। পিশাচরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, কিছুটা ভয়ানকভাবে তাকিয়ে আছেন। মঞ্চে অগ্নির শিখা, জলবায়ু উত্তপ্ত। দক্ষিণ রায় উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করেন।)

দক্ষিণ রায় : (শক্ত কণ্ঠে, ঘৃণায় গর্জন করে) অ! বনবিবি! কে সে? যে বনকে মাতৃরূপে দাবী করে, যে বনকে সবার অধিকারে দেখতে চায়! কে তাকে অনুমতি দিয়েছে, এই বনে তার পদচারণের অধিকার! কে সে, যে আমার অগ্নির শিখায় নিজেকে প্রজ্বলিত করতে চায়! এই বনের শাসক আমি—দক্ষিণ রায়! এবং আমি চাই, এই বনে কারও না কারও প্রাধান্য থাকবে! বনবিবি? হা! কেবল এক মায়া, এক অশুভ শঙ্কা—অদৃশ্য মূর্তি! তাকে আমি কখনও মেনে নেব না! এই বন কেবল আমার। এই বনের ইতিহাস, ঐতিহ্য—সবই আমার!

(দক্ষিণ রায় শিষ্যের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে, মুখের ক্ষোভ বেড়ে যায়। তিনি আরও উচ্চারণ করেন, যেন তার ঘৃণা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।)

(শিষ্যের দিকে ঘৃণাভরে) শিষ্য, শোনো! তুমি কি জানো, বনবিবি এসে কী করতে চায়? সে চায়, আমি এই বনের অধিকার ছাড়ি! সে চায়, বনে কারও শাসন থাকবে না, সবার সমান অধিকার হবে! কিন্তু জানো কি? এই বন আমি যখন জন্মেছি, তখন থেকেই আমি তার একমাত্র শাসক! এই বনকে আমি শক্তি দিয়ে শাসন করেছি, আমি জানি কীভাবে এই বনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বনবিবির মায়া-গল্প তুমি শোনো না, সে একজন মিথ্যাবাদী, সে আসবে তো? তবে তাকে বলো, ‘দক্ষিণ রায়ের কাছে তুমিই অজানা’!

(দক্ষিণ রায় আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তার হাত চেপে ধরেন। পিশাচরা কাছে চলে আসে, তারা দক্ষিণ রায়ের কাছ থেকে আরও আদেশ পেতে প্রস্তুত।)

(প্রচণ্ড রাগে, শিষ্যদের উদ্দেশ্যে) বনবিবি আসবে? হ্যাঁ! সে আসুক, কিন্তু মনে রেখো, আমি তাকে স্বাগত জানাব না—আমি তাকে পায়ের তলায় পদদলিত করবো! সে যদি এই বনে প্রবেশ করে, তার পায়ের তলাতেই থাকবে আমার অগ্নি! এই বন তার জন্য নয়, যাকে সবার অধিকারী বানানোর স্বপ্ন দেখায়— সে যদি আসে, তো তাকে বুঝিয়ে দেব, এই বনই আমার রাজত্ব! বনবিবি? সে যেহেতু আসে, তবে আমি জানি—আমাকে মোকাবেলা করতে তো তাকে আগে আসতেই হবে! (নির্বিকলঙ্কিত হয়ে শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে) আমরা বনবিবির শক্তিকে শীঘ্রই চূর্ণ করে দেব, তার কাছে এ বনের কোনো স্থান থাকবে না!

(দক্ষিণ রায় অগ্নির দিকে তাকান, সেখান থেকে একপ্রকার অসীম শক্তি বের হতে দেখে। পিশাচরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানান। দক্ষিণ রায়ের চোখে অগ্নি প্রবাহিত হয়, তার শরীর যেন এক তীব্র শক্তি ধারণ করে।)

শিষ্যগণ, পিশাচরা, শোনো! তোমরা যারা আমাকে অনুসরণ করো, আমি বলছি—যদি বনবিবি এখানে প্রবেশ করতে চায়, তাহলে আমি তাকে এখানে আমন্ত্রণ জানাব না, তাকে এক নিমেষে শেষ করে দেব! সে বনকে সবাইকে ভাগ করে দিতে চায়—আমিই তাকে বুঝিয়ে দেব, বনের নিয়মে আমারই কথা চলে! আর যদি বনবিবি এসে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তার সঙ্গে এই বনের কথা শেষ হয়ে যাবে। আমি, দক্ষিণ রায়—বনের একমাত্র শাসক! সে আসুক, যদি সে পারে, তবে দেখবো কীভাবে আমি তাকে তাড়িয়ে দেব!

(দক্ষিণ রায় পিশাচদের দিকে তাকিয়ে, আরও আক্রোশিত কণ্ঠে এক এক করে নির্দেশনা দেন। তার ভাষায় দম্ভ এবং রাগ প্রকট হয়ে ওঠে।)

(পিশাচদের দিকে কঠোর আদেশ দিয়ে) তোমরা যে-কিছু করতে পারো, তা নিয়ে দ্বিধা করো না! বনবিবি যে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাকে প্রতিহত করতে হবে! তাতে যদি আগুনের ঝড়, বন্যার স্রোত, পাথরের খণ্ড দিয়েও তার পথ আটকে দিতে হয়, আমি সে কাজও করবো! কিন্তু যে বন আমার নয়, তা আমি কখনো মেনে নেবো না! তুমি কি বুঝেছ, শিষ্য? বনবিবির মায়া ও জাদু শুধু বাতাসে উড়ে, কিন্তু আমি বাস্তবে শক্তি!

(পিশাচরা একে অপরকে উৎসাহিত করে, দক্ষিণ রায়ের নির্দেশ মেনে চলতে প্রস্তুত হয়। তাদের চোখে এক অদ্ভুত ভয়ানক দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। দক্ষিণ রায় মঞ্চের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মহিমা পূর্ণভাবে ঘোষণা করেন।) 

(অগ্নির দিকে তাকিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে) আজকে আমি বনবিবির আগমন বন্ধ করব, তার মায়াকে ধ্বংস করে দেব। আমি বন—এখানে আমারই রাজত্ব! শপথ করি, বনবিবির শক্তির বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়ে যাব, তাকে আমার বনের শাসন বুঝিয়ে দেব!

(দক্ষিণ রায় রাগের মধ্যে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যান, পিশাচরা তাকে অনুসরণ করে, তারা প্রস্তুতি নেয়।)



দৃশ্য ৬: বনবিবির দয়াপর্ব


(মঞ্চে একটি গ্রামঘাটের দৃশ্য। বনবিবি গাছের তলায় বসে আছেন, চারপাশে কিছু ক্ষুধার্ত মৌয়াল, তাদের চোখে নিঃসঙ্গতা ও ক্লান্তি। তারা একে অপরকে আশার দৃষ্টিতে দেখে, কিন্তু মুখে কোন হাসি নেই। বনবিবি তাদের দিকে তাকিয়ে কিছু সময় নীরব থাকেন, যেন তাদের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করছেন। তারপর তিনি মৃদু গলায় গান শুরু করেন, যাতে একটি শুদ্ধ প্রাকৃতিক সুরে তাদের মন শান্ত হয়।)

বনবিবি : হে মায়ের সন্তানেরা, তোমাদের বেদনা আমি শুনি, তোমাদের কান্না, তোমাদের ক্রন্দন— আজ আমি তোমাদের শান্তির বার্তা নিয়ে এলাম। বন আমার, বন তোমাদের, এই পৃথিবী একে অপরের, তোমরা কষ্ট পাবে না, তুমি রবে, আমি রবে।

(বনবিবি উঠে দাঁড়িয়ে, মৌয়ালদের দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি স্নেহের সাথে এক একজনের পাশে বসেন, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মৌয়ালরা কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা নির্ভার হয়ে যান।)

(প্রথম মৌয়ালের দিকে তাকিয়ে) তুমি তো অনেকক্ষণ চুপ, কেমন আছো? তোমার চোখে যে অশ্রু, তা আমার হৃদয়ে চেপে বসেছে। তোমার মুখে হাসি হারিয়ে গিয়েছে, হে সন্তানেরা! তোমরা কি জানো, তোমাদের দুঃখ, কষ্ট—আমারও তো সেই অনুভূতি, বনমায়ের সন্তান হিসেবে আমি তোমাদেরই এক অংশ।

মৌয়াল : (একটু হেসে, তবু কাঁদতে কাঁদতে) মা, মা, তোমার মঙ্গল হোক! আমরা তো বেঁচে আছি, কিন্তু কীভাবে বাঁচবো, জানি না। ক্ষুধার তাড়নায় আমাদের আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ধানক্ষেত, আমাদের আশ্রয়—সব কিছুই চলে গেছে, তবে, তুমি, মা—আমাদের দিকে আসলে যেন আমরা বাঁচার শক্তি পাই।

বনবিবি : (কাঁধে হাত রেখে, তার দিকে তাকিয়ে) তোমরা যে কষ্টে আছো, তা আমি ভালো করে জানি। আমি তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কারণ প্রকৃতির শক্তি, মা মাটির শক্তি তোমাদের মধ্যে রয়েছে। আমার বনে কখনো কষ্ট নেই—কেবল ভালোবাসা আছে। যতটুকু তোমরা ক্ষুধার্ত, আমি তাকে পূর্ণ করে দেবো। বনের সব কিছু তোমাদের, এই মাটি, এই পানি, এই ফল—সবই তোমাদের।


(বনবিবি তার হাতের মধ্যে কিছু ফল ও মধু তুলে দেন। মৌয়ালরা ধীরে ধীরে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করে, কিন্তু তাদের মুখে এখনও চিন্তা ও দুঃখের ছাপ দেখা যায়।)

মৌয়াল : (তৃষ্ণায়, খাবারের টুকরো হাতে) মা, তোমার কাছে কোনো কিছুর অভাব নেই, কিন্তু আমাদের অবস্থা, আমাদের ভবিষ্যৎ—তাতে কী হবে, মা? আমাদের যা কিছু ছিল, তা তো হারিয়ে গেছে। আমাদের বাচ্চারা এখন কিভাবে বড় হবে, তা জানি না। তুমি আমাদের স্নেহ দিলে, তবুও আমাদের বুকের ক্ষুধা যায় না। এই বন আমাদের শেষ আশ্রয়—তোমার স্নেহে হয়তো প্রাণ ফিরে পাবো, কিন্তু খাওয়ার পথ?

বনবিবি : (কিছু সময় নীরব, তারপর তাদের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে) হে সন্তানেরা, তোমরা যেন কোনদিন মনে না রেখো, যে প্রকৃতি তোমাদের পাশে, সে কখনো অবহেলা করবে না। বন মায়ের শক্তি অসীম। এই বন, এই গাছ, এই ফুল—সবকিছু তোমাদের। তোমাদের কষ্টে আমি সহানুভূতি জানাচ্ছি, তোমাদের প্রতি আমার স্নেহ অটুট থাকবে। জানো, আমার কাছে অল্প কিছুই নেই, তবে যা কিছু আছে, তা তোমাদের।

মৌয়াল : (চোখে জল, মাথা নত করে) তুমি মা, তুমি আমাদের জীবনের আলো, আমাদের অস্তিত্বের শক্তি।

তুমি যদি না থাকো, তবে আমরা কি বাঁচব? তুমি জানো না, মা—আমাদের বুকের ভেতর কী শূন্যতা, তোমার দান আমাদের জীবন, আমাদের অস্তিত্ব।

(বনবিবি তাদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কিছু সময় নীরব থাকেন, যেন তার মনের গভীর থেকে কিছু একটা বলতে চান।)

বনবিবি : (ধীরে ধীরে, গম্ভীর হয়ে) জীবন এক কঠিন পথ। কিন্তু তোমরা একা নও, আমি আছি। এ বন—এ পৃথিবী—আমাদের শত্রু নয়। যে যন্ত্রণা তোমরা অনুভব করছো, আমি তাকে জয় করবো। তোমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাও, দেখবে—এ পৃথিবীতে দুঃখের পর সুখ আসবেই। আর, মা কখনো সন্তানকে ক্ষুধার্ত দেখবে না।

(মঞ্চে গায়েনদের গান ফিরে আসে, শান্তি ও আশার সুরে। বনবিবি মৌয়ালদের স্নেহময় দৃষ্টিতে তাদের প্রেরণা দেন। মৌয়ালরা কিছুটা শান্ত হয়ে যায়, তাদের চোখে আশার আলো।)




দৃশ্য ৭: গাজী পীর বনবিবির সঙ্গে আত্মিক মিলন


(মঞ্চে আলো ক্রমশ শান্ত হয়ে আসে। গাজী পীর ধীর গতিতে প্রবেশ করেন, তার পদচারণায় এক গভীর আধ্যাত্মিকতা থাকে। সন্ন্যাসী পোশাকের মধ্যে পীরের মাথা উঁচু, চোখে এক অদ্ভুত শান্তি এবং প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে। বনবিবি তার সামনে দাঁড়িয়ে, মঞ্চে গ্রীষ্মের রাতে যেমন একটি শান্ত স্রোত বইতে থাকে, তেমন একটি স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা বিরাজমান। গাজী পীর বনবিবির দিকে এগিয়ে আসেন।)

গাজী পীর : (সামনে এসে, গভীর দৃষ্টিতে, শান্তভাবে) তুমি যে আছো বনমায়ের গর্ভে, তুমি যে চিরন্তন শক্তি, তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পাই সেই পুণ্যপথ, যা আমার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দেয়। আমি যে পথের দিশাহীন, সে পথেই তুমি আমার আলো, তুমি বনবিবি, সেই পথের রূপান্তর। তুমি যখন সূর্য হয়ো, আমি যেন তৃতীয় চোখ খুলে দেখি— এক গভীর অমিত জ্ঞান, এক অনন্ত রহস্য—এটাই তো প্রকৃতির পথ।

বনবিবি : (ধীরে, এক স্থির অথচ শক্তিশালী সুরে) গাজী পীর, তুমি যে পথে চল, সে পথ আমি অতিক্রম করেছি। প্রকৃতি যখন নীরব হয়ে যায়, আমি তখনই গতি পাই, তোমার কথাগুলো আমার হৃদয়ের স্পন্দন, তুমি যেভাবে শান্তি চাও, তা আমি এককালীন অনুভব করি। আমি বন-মা, তুমি আধ্যাত্মিক পথিক, তুমি যখন আমাকে ডাকো, তখন আমার শরীরের প্রতিটি সেল ঝঙ্কৃত হয়। তুমি সেই পুরাণের ফেরেশতা, যিনি পৃথিবীকে শুদ্ধ করতে এসেছো, আর আমি সেই শক্তি, যিনি বনকে মাতৃরূপে ধারণ করি। আমাদের সম্পর্ক, গাজী পীর—এটা শুধুই মিলন নয়, এটা এক আধ্যাত্মিক সহাবস্থান, যেখানে একে অপরকে পূর্ণতা দিই।

গাজী পীর : (আলোর মতো, ভরাট ও শাশ্বত সুরে) তুমি যে শান্তির মূর্ত প্রতীক, তুমি যে সেই সৃষ্টি, তোমার মধ্যে আমি পুরাণের পুরুষ, আমি সেই মুহূর্তে ডুবে যাই, যখন তুমি প্রকৃতির প্রকৃত অধিকারী হয়ে ওঠো। আমি তো শুধু প্রার্থনা করি, বনবিবি— তোমার মধ্যে আমি আমার আত্মার সত্তা খুঁজে পাই, আমার ধ্যান যেখানে থেমে যায়, সেখানে তোমার চরণপ্রান্তে শান্তি নেমে আসে। তুমি বাঘ, তুমি দেবী— তুমি যে কোনো শক্তির উৎস, তুমি সেই পবিত্র মাতৃরূপ।

বনবিবি : (একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে, কাব্যিকভাবে) তুমি যে জ্ঞানী পীর, তোমার কথায় আমি শিখি— তুমি বলো, আমি শুনি, তুমি ভালোবাসো, আমি শিখি। প্রকৃতি শুধু আপন মায়া দিয়ে আমাদের পাথেয় দেয় না, প্রকৃতি আমাদের অন্তরবোধের গভীরতায় নেমে যায়, তোমার ধর্ম কি, গাজী পীর? তুমি যে পথে চলছো, সে পথ আমারও, তুমি যখন শরণ নাও, আমি তখন জীবন জাগ্রত করি। তোমার হৃদয়ে, আমার হৃদয়ে—এখানে কোনো ভেদ নেই, এই পৃথিবীর সমস্ত জীবের একাকার হয়ে থাকার জায়গা, সেটা তোমার মধ্যে, সেটা আমার মধ্যে।

গাজী পীর : (তীব্র অথচ শুদ্ধতা দিয়ে, উজ্জ্বল চোখে) বনবিবি, তুমি প্রকৃতির ভাষা, তুমি সেই অমোঘ জ্ঞান, আমি তো শুধু তোমার রূপে বিভোর— তোমার মধ্যে বাঘের গর্জন, তার শরণস্থল, তার মধ্যে আবার দেবীর গান, আর এই দুটি মিলন হলেই তো প্রকৃতির ঐশ্বর্য। তুমি যে পাহাড়, তুমি যে নদী, আমি সেই পথিক, যারা তোমার ছায়ায় পথ চলি, তুমি যে মিলনের সূত্র, তুমি যে প্রেমের রূপ, আমি তো সেই রূপে মগ্ন।


বনবিবি : (এক গভীর চুপচাপ মুহূর্তের পর, খুব মিষ্টি ও আবেগপূর্ণ কণ্ঠে) তুমি যখন আমাকে অভিবাদন জানাও, তখনই আমি আমার শক্তি পাই, আমার মধ্যে যখন তুমি দেখি, আমি তখন আশীর্বাদ হয়ে যাই। এই মিলনে, এই অন্তরের মেলবন্ধনে, আমি না বাঘ, না দেবী—আমি শুধু সেই শক্তি, যার মধ্যে সবার প্রাপ্য স্থান রয়েছে। তুমি আর আমি—আমরা শুধুই একাত্ম— যেখানে আমি এক দিক, তুমি আরেক। তোমার দৃষ্টিতে যা শুদ্ধ, তা আমার প্রতিটি পদক্ষেপে বিরাজমান, তুমি যা চাও, আমি তাই হয়ে উঠি— এক গভীর, অদ্ভুত সংযোগ, যেখানে প্রকৃতি ও মানবতা এক।

(দৃশ্যটি দীর্ঘতর হয়ে যায়, গাজী পীর ও বনবিবি একে অপরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের মধ্যে কোনো কথা নয়, শুধুমাত্র আত্মিক মিলন ও অনুভূতি চলে। মঞ্চে গায়েনদের গান বাজতে থাকে, তালে তালে সূর্যাস্তের আলো জ্বলজ্বল করে।)


কোরাস

চরণ ধুই রাঙা জলে,

ফুল ঝরে নরম বরণে।

গাজী-বিবি মাধুরী হাসে,

রহমত বয় আকাশ বাতাসে।

প্রেমে মিলে দুই পবন-প্রাণ,

জয় বনমা, জয় গাজী খান।


(গানের সুরে মঞ্চে এক পবিত্র এবং শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়, গাজী পীর ও বনবিবির মিলন দৃশ্যের সাথে মঞ্চে আলোর পরিবর্তন ঘটে, যেন আধ্যাত্মিক এক চেতনাত্মক অনুভূতি শীর্ষে পৌঁছায়।)




দৃশ্য ৮: যুদ্ধ ঘোষণা


(মঞ্চে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বজ্রধ্বনি, গর্জন। মৃদু লাল আলোয় দক্ষিণ রায় আবির্ভূত হন—এক ভয়ংকর বাঘের মূর্তিতে। তার চারপাশে পিশাচ অনুচররা, নৃত্যরত ছায়া। আগুনের টর্চের আলোর লেপ্টে থাকা রেখা।)

দক্ষিণ রায় : (রক্তগরম হুংকারে, গর্জে উঠছেন) ওরে বনের কুয়াশা! ওরে নদীর কাঁকুড়! শুনে রাখো! আমি দক্ষিণ রায়! যে নামে অরণ্যের গাছ থরথর করে কাঁপে, যার গর্জনে নদী পিছিয়ে যায় আপন গতিপথে। আমি কে? আমি ভয়! আমি মৃত্যু! আমি দুর্বিনীত নখর ও হিংস্রতার অপর নাম! "আমি সহ্য করবো, এক নারী দেবী হয়ে এসে, আমার রাজত্বের উপর দয়া বণ্টন করছে? আমি মেনে নেবো, এক সুফিসাধক এসে বাঘের চোখে প্রেমের পানি এনে দেয়? না! না! না! এ বনে কেবল একটাই আইন—শক্তির আইন! দুর্বলের জন্য এখানে কোনো আশ্রয় নাই! আজ থেকে ঘোষণা করছি— বনবিবি হোক দেবী কিংবা দানবী, গাজী পীর হোক সাধক কিংবা পুরুষোত্তম— আমি তাদের যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনবো! তাদের অহংকার আমি ছিন্নভিন্ন করবো! তাদের স্বপ্ন আমি থেতলে দেবো বাঘের থাবায়! এ বন—আমার ছিল, আছে, থাকবে!!

(আরো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে) এই বনে, যেখানে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা মিশে গাছের শিরায়, যেখানে মৃত মৌয়ালের হাড় শকুনেরা কামড়ে নিয়ে যায়, সেখানে আজ এক নারী আসিয়া ‘দয়া’র বাণী শোনায়? অরণ্যের নিয়ম কি শিশুর মায়ের কোলে ঘুমপাড়ানি গান? না! অরণ্যের নিয়ম রচিত হয়েছে বাঘের দাঁত, শকুনের ঠোঁট, সাপের বিষ দিয়ে! আর আমি—আমি সেই নিয়মের শ্রেষ্ঠ পুরোহিত!

(ভ্রূকুটি করে, মাটিতে থাবা দিয়ে) ওরে বনবিবি! ওরে কল্পলোকের মায়ার দেবী! কার আশায় এসেছিস আমার অরণ্যের প্রাচীন চত্বরে? কার শক্তি তোর পিছনে? যে যেখানে দাঁড়াবে, দাঁত বসিয়ে টেনে নামাবো! যে হাতে শান্তির পতাকা তুলবে, সে হাত ছিঁড়ে নিবো! যে কণ্ঠে প্রেমের গান তুলবে, সে কণ্ঠ চিরে দেবো! (পিশাচরা ভয়াল অঙ্গভঙ্গিতে ফুঁসতে থাকে। বাতাস থেমে যায়। দক্ষিণ রায় সামনে এগিয়ে আসেন। তার কণ্ঠ যেন বজ্রের গর্জন।)

(চোখে আগুন, কণ্ঠে বিষ) আর সেই গাজী পীর! দূরদেশের কোনো সুফির সন্তান! মাটির মিষ্টি গন্ধ ভুলে, স্বপ্নে চলে এসেছে— ভেবেছে এই বন তার মেহেরাব, এই নদী তার তসবীহ? ওরে মূর্খ! এই বন নামাজের চাটাই নয়! এই নদী দোয়ার দরবার নয়! এখানে প্রার্থনায় কাজ হয় না— এখানে টিকে থাকে যার নখর গভীর, যার দাঁত শাণিত!

(হুংকার ছেড়ে, পিশাচদের ডেকে) ওরে আমার পিশাচ সেনাপতিরা! জড়ো হও! আজ আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেব! আমরা বনের হাড়-গোড় নিয়ে দুর্গ গড়বো, নদীর রক্ত দিয়ে যুদ্ধের মন্ত্র লিখবো! বনবিবি হোক দেবী, হোক দুর্বল মায়ার রাণী, গাজী পীর হোক সাধক কিংবা স্বপ্নচারী—আমি তাদের একফোঁটা মায়াও এ বনে রাখবো না! তাদের অস্তিত্ব আমি উপড়ে ফেলবো! যেন আবারও বন জেগে ওঠে ভয়াল গর্জনে!

পিশাচরা উচ্চস্বরে চিৎকার করে: "যুদ্ধ! যুদ্ধ! যুদ্ধ!"

(শেষ হুঙ্কারে, মাথা তুলে আকাশের দিকে চেয়ে) ওরে অন্ধকারের দেবতারা! ওরে বাঘের আত্মারা! আজ তোমাদের নামে শপথ—আমি এ বন শুদ্ধ করবো! আমি হাড়ের সেতু বানাবো! আমি নদী ভরাবো কান্নায়! বন হবে আমার, ভয় হবে আমার, মৃত্যু হবে আমার—চিরদিন চিরকাল!


গায়েনদের ভয়াল কোরাস


"ঘন বন ডাকে অমাবস্যা রাতে,

রক্তের শপথে জ্বলে উঠুক পথে।

দক্ষিণের ডাক শুনি কাঁপে প্রাণ,

আসে তাণ্ডব, আসে ধ্বংসের গান!"


(মঞ্চের আলো লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। বজ্রপাত। ভীষণ এক যুদ্ধ-সংগীতের সুর উঠতে থাকে। দক্ষিণ রায় ও তার পিশাচ অনুচররা হুংকার দিতে দিতে অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে যায়।)




দৃশ্য ৯: যুক্তি


(মঞ্চের আলো হালকা সবুজাভ। পেছনে বাজছে মৃদু বাঁশির সুর। মাঝেমাঝে দূর থেকে মাঝিদের গান ভেসে আসে। "জলেরও মাঝে, জঙ্গলের মাঝে, খুঁজে ফিরি প্রাণের ঠিকানা..."। বনবিবি ও গাজী পীর বনের গভীরে এক শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে। গাঢ় ছায়া আর আলোয় আবৃত।)

বনবিবি : (স্বরে মৃদু বজ্র) গাজী ভাই... শুনছো? পাতার ফাঁকে বাতাসের কান্না? নদীর ঢেউয়ে স্তব্ধতার আর্তি? মাটির গায়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে শিকড়ের স্বপ্ন! দক্ষিণ রায় আজ বনের বুকে বুনে দিয়েছেন ভয়, যেনো বনের রক্তে চুইয়ে পড়ে রক্তাক্ত দখলের গান। কিন্তু মনে রেখো, গাছের কাণ্ড কাটলে পাতা ঝরে, হৃদয়ের প্রেম কাটলে— সৃষ্টিরই মৃত্যু হয়। বন শুধু পাতায় পাতায় নয়, বন, হৃদয়ের নিঃশ্বাসে। বন, শিশিরভেজা সুরে। বন, জীবনের অবিচ্ছেদ্য কবিতা।

গাজী পীর : (চোখে গভীরতা, স্বরে মায়া-মমতা) বোন বনবিবি...তুমি বলছো জীবনকথা। এই বন তো জন্ম দিয়েছিলো আমাদের সকলকে— পশুপাখি, মৌয়াল-মাঝি, ফুলফল-লতা-বৃক্ষ। এখানে ধর্মের বেড়া নেই, জাতের দেয়াল নেই। ঠিক যেমন আকাশের নীল কোনো একক পাথেয় নয়, ঠিক যেমন বাতাস কোনো জাতপাত চেনে না, তেমনি বন—প্রেমের বিশাল জলপ্রপাত, যেখানে সবাই সমানভাবে তৃষ্ণা মেটায়।

(মৃদু বাঁশির করুণ সুর।)

বনবিবি : (দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে) কিন্তু গাজী ভাই...দক্ষিণ রায় ভেবেছেন, বনের প্রতিটি কোকিলের গান, প্রতিটি বৃক্ষের ছায়া, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তিনি ভুলে গেছেন— যে মাটি মাকে পুষ্টি দেয়, সেই মাটিও তার সন্তানদের কাছে ঋণী। বনের শিকড়ে যে জীবন ঢেউ খেলে যায়, সে জীবন কারো একার নয়। বন, নদী, পশুপাখি— তারা তো মহাকালের যাত্রী, তাদের পথ আটকে রাখা মানে প্রকৃতির হৃদয়ে গিরি খোদাই করা।

গাজী পীর : (মৃদু হাসে, অলোকচিত্র আঁকে কথায়) দক্ষিণ রায় বুঝে না, বন হলো দরবেশের আস্তানা। এখানে প্রেম জাগে অচিন ফুলের মতো, এখানে করুণা ঝরে অশ্রুবিন্দুর মতো। বন কারো লাল পতাকা নয়, বন কারো ধর্মগ্রন্থের সীমারেখা নয়। বন হলো মুক্তির নীল সমুদ্র, যেখানে সকল প্রাণ একেকটি ঢেউ।

বনবিবি : (স্বরে বজ্রপাতের ঝিলিক) আরো শুনো, গাজী ভাই—বন হচ্ছে মাতৃত্বের চূড়ান্ত রূপ। মা যেমন সন্তান ভেদে ভালোবাসেন না, তেমনি বন মৌয়াল-মাঝি-পশু-পাখি-সাপ-বাঘ— সবাইকে আঁকড়ে রাখে সমান স্নেহে। দক্ষিণ রায় যদি ভালোবাসার ভাষা না বোঝেন, তবে তাঁকে আমরা ভাষা শিখাবো— ভালোবাসার, সম্মিলনের, সহাবস্থানের ভাষা।

গাজী পীর : (চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে, অলৌকিক কণ্ঠে) ভালোবাসাই হল সর্বোচ্চ সাধনা। ধর্মের আসল অর্থ—সৃষ্টি রক্ষা, জীবন সংরক্ষণ। যদি ধর্ম বিভেদ শেখায়, সে ধর্ম নয়। যদি শক্তি শুধু ধ্বংস শেখায়, সে শক্তি নয়। প্রকৃত ধর্ম হলো, বনের প্রতিটি পাতায় বেঁচে থাকা স্নেহের প্রার্থনা। আমরা সেই প্রার্থনার দূত।

(কোরাস আস্তে আস্তে ভেসে আসে—"গভীর অরণ্যে আলো জ্বালাবো, প্রেমের কথা ছড়িয়ে দেবো।")

বনবিবি : এসো গাজী ভাই, এসো, এই বনরক্ষার দীপ্ত মশাল আমরা হাতে তুলে নিই। ঝড় আসুক, বজ্র আসুক, আমরা থাকবো মাটির সন্তান হয়ে। এই মাটি থেকে, এই নদী থেকে, এই আকাশ থেকে আমরা শপথ নিই—বন সবার, বন মায়ের কোলে থাকা সবার জন্মস্বর। কেউ বনকে দাস করে রাখতে পারবে না।


কোরাস জোরে জোরে গায় 

"বন বাঁচাও, প্রাণ বাঁচাও, ভালোবাসায় সব জয় করো!")


(আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়।)



দৃশ্য ১০: দক্ষিণ রায়—রক্তবর্ণ


(মঞ্চ অন্ধকার। দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ। গর্জন। হঠাৎ করে ঝলকে উঠলো রক্তাভ আলো। দক্ষিণ রায় আসেন বিশাল রক্তবর্ণ আবরণ পরিহিত অবস্থায়। তার চোখে অগ্নি, কণ্ঠে বজ্রপাত। পেছনে কাঁপছে ছায়া-নাচ, ঘন ঘন ঢাক-ঢোলের গুরুগম্ভীর শব্দ।)

দক্ষিণ রায়: (আকাশের দিকে গর্জন করে) আমি ছিলাম আগে, আমিই ছিলাম বন! আমি সেই আদিম গর্জন, যে প্রথম ছিঁড়ে ফেলেছিলো নৈঃশব্দ্যের চাদর! যখন ভূমির বুক ছিলো ন্যাড়া, আকাশ ছিলো নির্বাক— আমি প্রথম ছুঁড়েছিলাম ঘন অরণ্যের বীজ। আমি প্রথম টেনে এনেছিলাম বাঘের হুঙ্কার, হাতির মস্তকোন্নতি। আমি—দক্ষিণ রায়, বন-পিশাচ, বাঘ-পাখির জনক, নদীর তপ্ত স্রোত আর পাখির রক্তাক্ত ডানায় আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম জীবন!

পেছনে পিশাচ ও শিষ্যরা হাঁক ছেড়ে চিৎকার করে উঠে: "জয় দক্ষিণ রায়! জয় দক্ষিণ রায়!"

দক্ষিণ রায় : (চোখে রক্তাভ আগুন) এখন? এখন দেখি কে? এক বনবিবি! এক গাজী পীর! তারা নাকি শেখাবে বনের ভাষা? তারা নাকি বলবে, বন সবার? না! এই অরণ্য আমার রাজত্ব। এই নদীর প্রতিটি ঢেউ আমার করতলে বন্দী। পাতার ফাঁকে জেগে থাকা প্রতিটি চোখ আমার নত। বনের মাটি আমার পায়ের তলায় চুম্বন খায়, আর আকাশ আমার হুঙ্কারে বিদীর্ণ হয়। আমি দক্ষিণ রায়— আমি বনের বালুকণায় লেখা অক্ষয় নাম। কোনো দেবী, কোনো দরবেশ আমার রাজ্য ভাগ করতে এলে— আমি তাদের ছিন্নভিন্ন করে ছুঁড়ে দেবো, বাঘের ক্ষুধার্ত থাবায় টুকরো করে দেবো, নদীর স্রোতে মিশিয়ে দেবো দুঃস্বপ্নের মত!

(ভয়াবহ ঝড়ের শব্দ। ধীরে ধীরে ছায়া-নাচে বাঘ, সাপ, পিশাচের ভয়াল প্রতিমা ফুটে ওঠে।)

দক্ষিণ রায় : (দাম্ভিকতায় স্ফীত) আমি দক্ষিণ রায়, পূর্ব পুরুষদের রক্তের পাথরে গড়া দেবতা। আমি সেই আদিরক্ত, যাকে ভয়ে কাঁপে আকাশের কণ্ঠী, আমি সেই কান্না, যাকে থামাতে পারে না কোনো প্রার্থনা। বন আমার শরীরের প্রসার। বাঘ আমার ধমনীর রক্ত। পাখির ডানায় লেখা আছে আমার শাসনের আইন। এখানে করুণা নেই। এখানে প্রেম নেই। এখানে আছে কেবল শক্তির অমোঘ বিধান। বনবিবি যদি মধুর স্বপ্ন বোনেন, গাজী পীর যদি কোমল গান শোনান— আমি তাঁদের স্বপ্ন ছিঁড়ে ফেলবো! আমি তাঁদের গান থামিয়ে দেবো বজ্রাঘাতে! কারণ, বেঁচে থাকার নিয়ম শুধুই শক্তি। জয়ী সেই, যে বাঁচতে জানে; হারে সে, যে প্রেমে বিলীন হয়ে যায়।

(পেছনে বাজে কাঁপন তোলা ঢাকের শব্দ। পিশাচরা দক্ষিণ রায়ের চারপাশে নৃত্য শুরু করে — কখনো বাঘের মত গর্জন করে, কখনো অরণ্যের গভীর আর্তনাদের মতো কাঁদে।)

দক্ষিণ রায় : চলো, আমার সন্তানেরা! তীক্ষ্ণ করো নখ, ধারালো করো দাঁত! বনের প্রতিটি পাতায় রক্তের ছাপ রাখো! আজ বনের বুকে ছড়িয়ে দাও ভয়, মৃত্যু আর অধিকার। আজ দেখিয়ে দাও, বন কার! বন কাদের জন্মভূমি! বন কাদের রক্তস্নান!

পিশাচরা একসঙ্গে হুংকার ছাড়ে: "বন আমাদের! বন আমাদের!"

(আলো আরো লালচে হয়ে ওঠে। মঞ্চ কাঁপে। দক্ষিণ রায় বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন—তার চোখে দাম্ভিক বিজয়ের অগ্নি।)



দৃশ্য ১১: প্রকৃতির অধিকার


(মঞ্চে আলো ধীরে ধীরে উদিত হয়। বনবিবি দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে। তার চারপাশে গাছেদের মৃদু দোলন। পেছনে মৃদু বাঁশি ও ঢোলের নরম সুর বাজছে। আকাশে নরম আলোকরেখা।)

বনবিবি : (ভয়াল নিশ্চুপতা ভেঙে শান্ত অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে) দক্ষিণ রায়! তোর গর্জন শুনেছি আমি, তোর দাম্ভিক উচ্চারণ কাঁপিয়ে দিয়েছে আকাশ। কিন্তু শুনে রাখ, বনের আত্মা কারো একার নয়। বন হলো মাতৃদুগ্ধের মতো— যে সকল প্রাণীকে আহার দেয়, আশ্রয় দেয়, শ্বাস দেয়। বন নদীর মতো— আপন গতিতে প্রবাহিত, আপন নিয়মে উদার। তার কোনো ধর্ম নেই, কোনো জাত নেই, কোনো সীমা নেই। যেখানে নদী সীমানা মানে না, যেখানে বাতাস মন্দির-মসজিদ জানে না, সেখানে তুই বলিস, তোর একার অধিকার?

পেছনে আস্তে আস্তে কোরাস গায়

"বনের অধিকার সকল প্রাণের অধিকার..."

বনবিবি : (উৎসারিত আবেগে, হৃদয়ের গভীর থেকে) দক্ষিণ রায়! ধর্ম মানুষের সৃষ্টি, প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে স্রষ্টা। ধর্মের বইয়ে সীমারেখা আঁকা যায়, কিন্তু বৃক্ষের শেকড় কাকে মেনে চলে? ধর্মের মন্ত্রে বিভাজন হয়, কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটা কি আলাদা করে দেখে, কার মাথায় পড়ছে? বল, কোন ধর্ম জানায়, সূর্য কাকে আলো দেবে, কাকে নয়? কোন মন্ত্র বাধে হাওয়ার রাস্তা? কোন পুঁথি থামায় ফুলের সুবাস?

(পেছনে হালকা ঢোলের চাপা শব্দ। পাখির ডাক।)

বনবিবি : (কণ্ঠ আরো গম্ভীর হয়ে উঠে) আমি বনবিবি, আমি সেই মাতৃত্বের প্রতিনিধি, যার বুকের দুধে সকল জীবের সমান অধিকার। আমি এখানে এসেছি অরণ্যের আদিম গান রক্ষা করতে— যে গান বলে, বেঁচে থাকার অধিকার সবার। আমি এসেছি এই গহীন সবুজের অধিকারীদের পাশে দাঁড়াতে— গরীব মৌয়াল, কাঠুরে, মাঝি, হরিণ, পাখি, পিঁপড়া, বৃক্ষ—সব প্রাণের পক্ষে। আমি এসেছি বলতে— প্রকৃতিতে ধর্মের খাঁচা চলে না। প্রকৃতি ঈশ্বরের খোলা হাত। সেখানে শুধু ভালোবাসা, সহাবস্থান, আর প্রাণের সমবায়।

পেছনে কোরাসের মৃদু গলা উঁচু হয়:

"সবাই মিলে, সবাই বাঁচে—বন সবার ঘর..."

বনবিবি : (চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে) আমি রক্তপাত চাই না, আমি চাই না বনের আকাশ লাল হয়ে উঠুক হিংসায়। আমি চাই বন হোক কোমলতার উৎসব। আমি চাই বন হোক সকল ধর্ম, সকল প্রাণের মহামিলন। আমি এসেছি যুদ্ধ থামাতে, অস্ত্র নয়, আমি হাতে এনেছি করুণা। আমার পায়ের ছোঁয়ায় মৃত মাটি ফুল হয়ে উঠবে। আমার কণ্ঠের ছোঁয়ায় পাখি গান ধরবে। আমার চোখের দৃষ্টিতে হিংস্র বাঘও কোমল সিংহাসনে বসবে। কারণ আমি বনবিবি—আমি কারো বিরুদ্ধে আসিনি। আমি এসেছি বনকে সকলের জন্য খুলে দিতে। দক্ষিণ রায়, মনে রেখো, প্রকৃতির পবিত্রতা ধর্মের চাইতেও পুরোনো। বন কারো সম্পত্তি নয়— বন হলো জীবন, আর জীবন বিভাজন চেনে না।

(পেছনে ঢোল আর বাঁশি উজ্জ্বল সুর তুলছে। মঞ্চজুড়ে নরম সবুজ আলো ছড়িয়ে পড়ে। বনবিবি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন—তার চেহারায় মাতৃত্বের দীপ্তি, চোখে অনড় প্রেমের প্রতিশ্রুতি।)


দৃশ্য ১২: ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষ (প্রতীকী ভাষায়)


(মঞ্চ অন্ধকার। চারদিকে কুয়াশা। মৃদু ঝড়ের শব্দ।একটি করুণ বাঁশির সুর দূর থেকে ভেসে আসে। আলো ধীরে ধীরে বাড়ে —লাল আভা একদিকে,সবুজাভ-নীল আভা অন্যদিকে।)

(প্রতীকী বাহিনী প্রবেশ)

দক্ষিণ রায়ের বাহিনী—পিশাচের দল। তাদের হাঁটায় কাঁপন। তাদের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে আগ্রাসন। বনবিবি ও গাজী পীরের বাহিনী—মৌয়াল, মাঝি, সাধুদের দল। তাদের গায়ে আকাশের রঙের শাড়ি, মাটির রঙের ধুতি। তাদের নাচ ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে— মাটির টানে, নদীর সুরে, পাতার ফিসফাসে।

(সংঘর্ষের শুরু — ঢাক, বাঁশি, শঙ্খ বাজে, দক্ষিণ রায়ের বাহিনী তেড়ে আসে।তাদের ছায়া ছিন্নভিন্ন করে দেয় আলোকে।)

দক্ষিণ রায় : (ভয়ংকর গর্জনে) আজ রক্ত ছিটবে পাতায় পাতায়! আজ বনের শ্বাস হবে আমার কন্ঠে বন্দী! বন আমার ছিল, থাকবে এবং থাকবে আমার লোহিত শাসনে! (এক ঝলক তীব্র লাল আলো। পিশাচেরা নাচতে নাচতে মাটিতে হাত ঠুকে উঠে।)

বনবিবি : (শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে, ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে) রক্ত দিয়ে কি জন্ম হয় বটগাছের? ভয় দিয়ে কি ফোটে পদ্মফুল? বন কারো রাজ্য নয় রায়, বন সবার শ্বাস—ছোট মৌয়াল থেকে বৃহৎ নদী পর্যন্ত।

পেছনে মৌয়ালের দল গেয়ে ওঠে ধীর সুরে:

"বাঁচার নাম বন..."

(প্রথম সংঘর্ষ — ছায়া ও আলো ছিটকে পড়ে দক্ষিণ রায়ের পিশাচেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মৌয়াল-মাঝিদের ওপর। তারা প্রতীকীভাবে বাতাস কেটে চলে, চারদিকে লাল আলো ছড়িয়ে দেয়। একদিকে গাছের ডালপালা ছিন্নভিন্ন হতে থাকে, অন্যদিকে পাখিরা আতঙ্কে উড়তে থাকে।)

গাজী পীর : (আধ্যাত্মিক তেজে, ঝাণ্ডা তুলে) শোনো রায়! ধ্বংসের মধু পান করলে বিষ হয় প্রাণে! বন কোনো একার অলংকার নয়, বন বেঁচে থাকে কাঁটায়-মাটিতে-পাঁকে-পল্লবে।

দক্ষিণ রায় : (হাসিতে ফেটে পড়ে, তীব্র দম্ভে) আমি জন্মের আগের ভয়! আমি গহন অরণ্যের নিসর্গ-শক্তি! আমি অন্ধকার, যেখানে তোমাদের সব আলো ম্লান হয়ে যাবে! (তার গর্জনে মঞ্চে প্রবল ঝড়ের শব্দ বেজে ওঠে। আলো লাল হয়ে জ্বলে ওঠে।)

(দ্বিতীয় সংঘর্ষ — ছায়ার লড়াই, দক্ষিণ রায় বনবিবির দিকে ছুটে যায়—তার ছায়া এক বিশাল দৈত্যাকৃতির রূপ নেয়। বনবিবি দুই হাত প্রসারিত করে তার দিকে ঘূর্ণির মতো আলো ছুড়ে দেন।)

বনবিবি : (বিকশিত কণ্ঠে, বজ্রনিনাদের মতো) তুমি ভয়, আমি আস্থার বাতি! তুমি শোষণ, আমি শ্যামল ছায়া!

তুমি মৃত্যু, আমি নবজন্ম! এসো—দেখো—প্রকৃতির শপথের সামনে সব অহং ভেসে যায়।


(তৃতীয় সংঘর্ষ — সঙ্গীতের বিস্ফোরণ, ঢোল-তবলার প্রবল বাজনা, খঞ্জনির দ্রুত ছন্দ। পিশাচ আর মৌয়াল-মাঝিরা নাচতে নাচতে মিশে যায় আলো ও ছায়ার প্রবাহে।)

গাজী পীর : (কবিতার মতো উচ্চারণে) মাটির নিচে গানের শিকড়, বাতাসে ভেসে ফুলের নাম। যার কণ্ঠে হিংস্রতা, সে ঝরে যাবে; যার হৃদয়ে ভালোবাসা, সে টিকে থাকবে। (তার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবল বাঁশির সুর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পিছনে সাদা পায়রার প্রতীকী উড্ডয়ন দেখা যায়।)

(চূড়ান্ত মুহূর্ত)

(বনবিবি ও গাজী পীর আলোর আবর্তনে উঠে দাঁড়ান। দক্ষিণ রায়ের ছায়া ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে, কিন্তু সে এখনো ক্ষিপ্র, এখনো চরম আগ্রাসী।)

দক্ষিণ রায় : (শেষবার গর্জে) এই বন নয় কারো! এই বন আমার ভয়ংকর সাম্রাজ্য! আমি ফিরে আসবো, বারবার!

(তার গর্জনের সঙ্গে মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়। শুধু মৃদু বাঁশির সুর থেকে যায়।)




দৃশ্য ১৩: সহাবস্থানের বন


(মঞ্চের মাঝখানে আধো অন্ধকার। তীব্র সংঘর্ষের পর ঘন নীরবতা। আকাশজুড়ে যেন এক অদৃশ্য কুয়াশা। দূরে বাঁশির করুণ সুর বাজছে। আলো ধীরে আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে। গাজী পীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার চারপাশে আহত মৌয়াল, ক্ষতবিক্ষত পিশাচেরা মাটিতে পড়ে আছে। বনবিবি ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন এক বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায়। দক্ষিণ রায় দূরে দাঁড়িয়ে—অভিমানী, ক্লান্ত, কিন্তু এখনো দম্ভিত। গাজী পীর এগিয়ে আসেন — হাত প্রসারিত করে)

গাজী পীর : (গম্ভীর, গভীর, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন স্বরে) এই রক্তপাতের শেষে কে বিজয়ী? ধূলি মেখে কে-ই বা অমর? যারা বন চাই, 

তারাও আজ বনের রক্ত ঝরালো। যারা বন রক্ষা চায়, তারাও আজ ধ্বংসের গাথা রচনা করলো। তাই বলি—রক্ত দিয়ে বন রচিত হয় না। হিংসায় ফুল ফোটে না। চাই এমন বন— যেখানে বাঘের গর্জন আর মৌয়ালের বাঁশি পাশাপাশি বেজে ওঠে। যেখানে পিশাচ নয়, সহিষ্ণুতা নৃত্য করে পাতায় পাতায়। যেখানে ভয় নয়, ভালোবাসা হবে বনের নতুন পত্র। (পেছনে বাঁশির সুর একটু উজ্জ্বল হয়।)

(দক্ষিণ রায় এগিয়ে আসে — ক্ষতবিক্ষত অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে)

দক্ষিণ রায় : (ঠান্ডা, তীব্র) সহাবস্থান? সহাবস্থান মানে কি আমার শক্তির অপমান? যে বন আমার ভয়ে কাঁপত, সে বন আজ ভালবাসবে? ভালবাসা দিয়ে কি শিকারী বাঁচে? ভয় ছাড়া কি অরণ্যের আইন চলে? (তার গলায় তীব্র বিদ্রুপ মিশে থাকে।)

(বনবিবি ধীরে উঠে দাঁড়ান — শান্ত অথচ বজ্রকণ্ঠে)

বনবিবি : (আলোকোজ্জ্বল ভাষায়) দক্ষিণ রায়, ভয় দিয়ে যে বন শাসিত হয়, সে বন মৃত নদীর মতো শীর্ণ হয়ে যায়। ভালোবাসায় যে বন বাঁচে, সে বন জন্ম দেয় অজস্র নদী, অসংখ্য পাখি। প্রকৃতি কোনো শাসকের বাগান নয়, প্রকৃতি হলো জন্মের অনন্ত লীলা। এখানে রাজত্ব নয়, সহাবস্থানই ধর্ম। ফুল যেমন কাঁটার পাশে হাসে, নদী যেমন পাথরের বুক চিরেও গান গায়— তেমনি বনের বুকেও একসাথে থাকবে শক্তি আর স্নেহ।

(গাজী পীর দুই হাত প্রসারিত করেন, যেনো আকাশ ছুঁতে চান)

গাজী পীর : (কবিতার মতো উচ্চারণে) চলো, আজ আমরা একটি বন গড়ি—যেখানে দক্ষিণ রায়ের গর্জনও থাকবে,

থাকবে মৌয়ালের গানও, থাকবে বনবিবির আশীর্বাদ। চলো, আজ আমরা একটি চুক্তি করি— শক্তির নয়, প্রেমের; শাসনের নয়, সহাবস্থানের; মৃত্যুর নয়, জীবনের। চলো আজ আমরা রক্ত নয়, বীজ বপন করি। চলো, বনটাকে আবার জীবন্ত করি। চলো, একটি নতুন ইতিহাস লিখি—যেখানে বনের প্রতিটি পাতায় লেখা থাকবে: 'এই বন সকলের!'"(তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে উচ্চ হয়—মঞ্চজুড়ে প্রতিধ্বনি হয়—"এই বন সকলের... সকলের... সকলের...")

(দক্ষিণ রায় নিচু হয়ে যায়, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে অভিমান, দম্ভের ছায়া; কিন্তু সেই ছায়ায় এক বিন্দু ম্রিয়মাণ বিস্ময়ও। পেছনে একটি করুণ অথচ আশাবাদী বাঁশির সুর বাজতে থাকে। আলো ধীরে ধীরে সবুজাভ রঙে মঞ্চ ভরিয়ে দেয়।)


কোরাস শুরু করে এক কোমল গান—


"পাতায় পাতায় মিশুক শ্বাস,

নদী-তটী-পাখির হাস।

বন সবার, বন সবার—

ভালবাসার বন সবার..."




দৃশ্য ১৪: দক্ষিণ রায় আত্মবিশ্লেষণ


(মঞ্চে অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে একটি রক্তিম আভা ফুটে ওঠে। দক্ষিণ রায় একাকী দাঁড়িয়ে, তার চোখে ক্ষোভ ও পরাজয়ের ছায়া। তার হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ, কণ্ঠে তীব্র আক্রোশ। পেছনে বাতাসের সুর, ঝড়ের গর্জন, যেন বনের আত্মা তাকে তাড়া করছে। দক্ষিণ রায়, নিজের সাথে কথা বলছেন, কণ্ঠে অভিমান ও ক্ষোভের গভীরতা)

দক্ষিণ রায় : (চোখে এক গভীর ক্ষোভ, জোরালো কণ্ঠে) তাহলে, আমি কি ভুল বুঝলাম? এতদিন ধরে কি আমি সেই বনের শক্তিকে শুধু ভয় হিসেবে দেখেছি? এতদিন ধরে আমি জানতাম—বন শুধুই আমার শক্তির প্রতীক, আর এই শক্তির সামনে সকলকে নত হতে হবে। কিন্তু, আজ কেন বনের গর্জন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে? কেন আমার হৃদয়ে এত তীব্র অনিশ্চয়তা? আমি তো বনকেই শাসন করতে চেয়েছিলাম, বনকে আমার রাজত্বের আওতায় এনে, আমি চাইতাম, বনের প্রতিটি শাখা আমার কথা শোনে, প্রতিটি শিকড় আমার ক্ষমতা অনুভব করে। কিন্তু কি ঘটেছে? আমি তো বনকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেই ভয় পেয়েছি! আমি কি জানতাম না, যে বনকে দমন করতে চাই, সেই বন একদিন আমাকে নিঃশেষ করে ছাড়বে? আমার এই খাঁচায় বন্দী হয়ে, আমি কখনোই মুক্ত হতে পারলাম না! (বিরতি, সত্তার সাথে কথোপকথন) আমি তো ভেবেছিলাম, বন মানে ভয়—শুধু ভয়! অথচ এখন বুঝতে পারছি—আমি যে ভয়কে শাসন করছিলাম, সেই ভয়ই আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে!

(দক্ষিণ রায় ধীরে ধীরে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে, নিজের ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। তার কণ্ঠে রাগের পাশাপাশি বিষণ্নতার ছায়া দেখা যায়।)

দক্ষিণ রায় : (বেশ কিছুক্ষণ থেমে, নিজেকে প্রশ্ন করছেন, আবার জোরালোভাবে) হ্যাঁ! বন তো আমার শাসন মানেনি। আর আমি তো ভাবলাম, যতটা ভয় দেখাব, ততটাই শক্তি পাব। কিন্তু... (ঠাস করে মুষ্টিবদ্ধ হাত) আজ আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে, আজ আমার মনের ভিতর গহ্বর খুঁজে পাচ্ছি না, সেই আগের শক্তি কোথায়? বন কি শুধুই ভয় সৃষ্টি করে? শুধু গর্জন, শুধুই তীব্রতা—এই কি এর বাস্তবতা? না, না, তা হতে পারে না! আমি কি ভুল বুঝেছি বনকে? আমি কি ভুল শাসন করেছি বনকে? যদি বনকে শাসন করার নামে, আমি তার মুক্তি কেড়ে নিই, তবে সেই বন আমাকে কি কখনো ক্ষমা করবে?

(এখন, বাতাস আরো তীব্র হয়ে ওঠে, বনের গর্জন এবং ঝড়ের শব্দ আবার দৃশ্যমান হয়। দক্ষিণ রায় ক্ষোভের সাথে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছেড়ে দেয়, যেন কিছু একটা বুঝতে পারছেন।)

দক্ষিণ রায় : (সামনে তাকিয়ে, তার কণ্ঠে এক ধরনের বিষণ্নতা, অবশেষে আত্মবিশ্লেষণ শুরু করেন) তবে কি আমি ভয় দিয়ে বনের শক্তিকে হারালাম? যে শক্তি আমি এতদিন ধরে ভেবেছিলাম, তা আসলে কেবল আমার ভ্রান্তি ছিল। কেন? কেন এই পরাজয়? (এক সুরেলা গর্জন ধীরে ধীরে থামে। দক্ষিণ রায়ের চোখে এক অদ্ভুত দুঃখের ছায়া আসে, যেন কিছু একটা চিরকালীন ভুল হয়ে গেছে।)

দক্ষিণ রায় : (ধীরে, প্রায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে) আমার সেই শক্তি কি আসলেই ভয় ছিল? ...কী জানি। বন কি শুধুই ভয় ছিল? কিংবা, আমি কি বুঝেছিলাম প্রকৃতির আসল ভাষা? (তার কণ্ঠে শেষ পর্যন্ত এক শূন্যতা ফুটে ওঠে। দক্ষিণ রায়, তার শাসনবিদ্ধ আত্মা, এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে তার হারানো শক্তির প্রমাণ।)

(গাজী পীর ধীরে ধীরে দক্ষিণ রায়ের কাছে এসে দাঁড়ান। তার চোখে সহানুভূতি এবং শান্তির ছায়া।)

গাজী পীর : (অথবা অত্যন্ত দয়ার সাথে, শান্ত ভাষায়) দক্ষিণ রায়, তুমি যে চিরকাল বনকে শাসন করতে চেয়েছিলে, তা জানি— তবে কখনো কি ভেবেছো, যে বনকে তুমি শাসন করো, সেই বনকেও তো তোমার সমান থাকতে হবে! যখন তুমি বনের একক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছিলে, তখন কি বনের জীবন্ত স্পন্দন অনুভব করতে পেরেছো? প্রকৃতি ভয়কে নয়, ভালোবাসাকে চাই।

জানো, সব বড় শক্তি কখনো নীরব। তুমি যদি প্রকৃতির শক্তিকে সঠিকভাবে বোঝো, তবে বুঝবে— বনের শক্তি ভয়ে নয়, সহাবস্থানে। (দক্ষিণ রায় কিছুটা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে কিছুটা কৌতুহল এবং দ্বিধা দেখা যায়।)

(কোরাস শুরু করে, অন্ধকারে একটি মৃদু সুর ভেসে ওঠে। তারপর আলো ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়, দক্ষিণ রায় এক গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।)



দৃশ্য ১৫: শপথ পর্ব


(মঞ্চে তিনটি চরিত্র: বনবিবি, দক্ষিণ রায়, এবং গাজী পীর। আলো ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল হয়, তাদের উপস্থিতি যেন জীবনের সব শক্তি ও প্রকৃতির মহিমা থেকে উদ্ভূত। একযোগে তাঁরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করে, এবং মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। গাঢ়, প্রাকৃতিক সুরে মৃদু সঙ্গীত বেজে ওঠে।)

বনবিবি : (গম্ভীর, কিন্তু শক্তিশালি, কণ্ঠে এক অনন্ত শক্তি) আমরা কী দেখি, দক্ষিণ রায়? তুমি বলেছিলে, 'বন কেবল তোমার', কিন্তু বন তো কি! বন তো প্রাণ—একটা জীবন্ত, শ্বাস নেয়ার মতো অস্তিত্ব, একটি কাল্পনিক সীমানা নয়, একটা অবিরাম অনুভূতি। তুমিই তো বলেছিলে—'আমি বন'! কিন্তু বন তো কেবল এক নিরব কান্না নয়, এটি গাছের শিকড়ে গড়ে ওঠা সমস্ত প্রাণীর আখড়া, তাদের অস্তিত্ব—এই প্রকৃতি, এই সাগর, এই নদী— এখানে অশান্তি নয়, এখানে শান্তির আবেদন— এখানে জীবন জয়লাভ করতে চায়, কিন্তু দমন নয়, শ্রদ্ধা চাই! তুমিও একদিন জানবে—এখানে গাছেরা, মাটি, জল— সমস্ত প্রাণী তাদের কথা বলার অধিকার রাখে। বন আর কারো নয়—এটি জীবনের সকলের, যেখানেই প্রকৃতি থাকে, সেখানে একসাথে চলা যায়!


(এখন গাজী পীর সান্নিধ্যরূপে সামনে এগিয়ে আসে, তার চোখে দৃঢ় আধ্যাত্মিকতাঃ)

গাজী পীর : (একটি সুফি দর্শনের সঙ্গে, শান্ত কিন্তু গম্ভীর ভাষায়) বনবিবি, তুমি যখন বলো—'এটি সকলের', আমি অনুভব করি সেই একই বাণী যা আমার আত্মার গভীরে লেগেছে। বন—এটি কোনো একক দ্বার নয়, এটি এক অনন্ত পথ, যা জীবনকে আত্মিকভাবে সমর্থন করে। যখন আমাদের আত্মা প্রবাহিত হয়, তখন বনের সঙ্গেই সে যুক্ত হয়, তার শিকড়, তার শাখা, তার পাতা, তার ফুল— এই প্রকৃতি আমাদের মধ্যে বাস করে, আমাদের অন্তরে ঢুকে যায়। যখন তুমি বলো—'বন সকলের', তখন তা আমাদের আত্মার সঙ্গী হয়ে ওঠে। এটা কোনো বস্তু নয়, এটা এক অনবদ্য অনুভূতি, আমাদের ধর্মের গভীরতা, আমাদের অস্তিত্বের সত্তা। আর সেই অনুভূতির মধ্যেই একমাত্র শর্ত, আমরা সকলেই, একে অপরের অঙ্গ।

(এখন দক্ষিণ রায় তার আবেগ ও গর্বের সাথে উঠে দাঁড়ায়, তার কণ্ঠে বিরাট অভিমান এবং ক্রোধ। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে, তবে তার গাঢ় হতাশা ও আক্রোশের প্রকাশ ঘটাতে থাকে।)

দক্ষিণ রায় : (গম্ভীর, তীব্র আক্রমণাত্মক, কিন্তু কিছুটা নরম স্বীকারোক্তি) আমি যখন বলি 'আমি ছিলাম আগে, আমি ছিলাম বন', তখন সে কি কেবল ইতিহাসের একটা কথা? না, এটা আমার আত্মার সঙ্গীত ছিল! আমি যে বনের ইতিহাসে শাসক ছিলাম, সেটা কি মিথ্যে ছিল? আমার পূর্বপুরুষরা বনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, তারা বনকে শাসন করে, তাদের কঠোরতা দিয়েই এই পৃথিবী বাঁচিয়ে রেখেছিল! আমি জানি, আমি জানি—এখন আমার শাসন কেবল অভিমানী কথা।


কিন্তু আজকের এই পৃথিবী, বন—এটা তো কোনো অস্তিত্ব নয়, এক অজানা স্তম্ভ, যে স্তম্ভে বহু শিকারী রয়েছে। আমি কি তখন ভুল ছিলাম? বন, প্রকৃতি—এটা কেবল শিকার নয়, এটা কি আমাদের শাসন করার জায়গা, না কি এটি চিরন্তন অধিকার? আমি যা করেছি, তা ছিল শুধু আত্ম-রক্ষার জন্য, আমার নখ, আমার শিকার—এটা কি প্রলয়ের পরিণতি? (তার কথার মধ্যে বিরক্তি, ক্ষোভ এবং পরাজয়ের ছায়া স্পষ্ট। তখন বনবিবি এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়, তার চোখে সহানুভূতি ও শান্তি।)

বনবিবি : (শান্ত এবং দৃঢ়, এক সুরেলা কণ্ঠে) দক্ষিণ রায়, তোমার শাসন, তোমার নখের শক্তি— কিন্তু কখনো জানো কি, প্রকৃতির হৃদয় কখনো ভয় পায় না? তোমার নখ, তোমার আক্রোশ—এরা কেবল তোমার অস্তিত্বকে বিভ্রান্ত করে, প্রকৃতি কখনো শাসিত হয় না, তবে সম্মানিত হয়, এই বনের শরীরে প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি শাখা, প্রতিটি শিকড়— সবই একটি উদ্দেশ্যে তৈরি—একসাথে বেঁচে থাকার জন্য,এটা কেবল ভয় নয়—এটা মুক্তি, প্রকৃতির প্রেম। তুমি শাসক হতে চেয়েছিলে—কিন্তু প্রকৃতি কারো কাছে রাজত্ব করতে দেয় না। তোমার শাসন অতীতে ছিল, কিন্তু এখন আমাদের শপথ—বন কারো নয়, এটি সকল জীবের, সকল প্রাণীর।

(এখানে গাজী পীর উঠে এসে, সমস্ত আলো তাদের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়, যেন এই মুহূর্তে তিনজনের মধ্যে ঐক্য এবং মিলনের প্রতীক।)

গাজী পীর : (সাধু অথচ দৃঢ় ভাষায়) আজ আমরা একত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমরা শপথ নিচ্ছি—'বন কারো নয়, সকল জীবের!' এখানে, পৃথিবী ও আকাশ, নদী ও পাহাড়— তাদের প্রতিটি শ্বাসে রয়েছে এক আত্মিক জীবনের ছোঁয়া। এই শপথ—এটি আমাদের মুক্তির চিহ্ন। বনের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি শিকড়— সেগুলি কেবল জীবনের অংশ, একে অপরের সঙ্গী। আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে এক অটুট সত্ত্বায় পরিণত হই— যে সত্ত্বা প্রকৃতির নিয়মে বাঁচে, একে অপরকে সম্মান জানায়। (এখন, তিনজন একত্রে শপথ নেয়, মঞ্চে শান্তি ও ঐক্যের এক অসীম প্রতীক প্রকাশ পায়। তাদের হাতে হাত রেখে একসঙ্গে তারা একটি শপথ পাঠ করে, যা মঞ্চের কোলাহলকে শান্ত করে।)



দৃশ্য ১৬: গায়েনদের গান — দেবী, বাঘ ও পীরের বনবিচার


এই দৃশ্যে বনবিবির সংলাপটি এমনভাবে সাজানো হবে যাতে তা দার্শনিক গভীরতা, প্রাণবন্ততা, এবং কাব্যময়তা দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ভাষার অলঙ্করণ, উপমা, এবং আবেগের সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে বনবিবি বনের প্রকৃতির শক্তি, তার সঙ্গতি, এবং এর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরবেন। গায়েনদের গানকে কেন্দ্র করে দৃশ্যটি একটি আধ্যাত্মিক সত্তা নিয়ে দর্শকদের ভাবনার জগতে ঢুকে যাবে।


গায়েনদের গান (শুরু)

গায়েনরা একে একে সুর তোলেন, গানের সূচনা হয়।


"বন গাঁথা দেবী, বাঘ ও পীরের শপথ,

বনের নিঃশ্বাসে, সবার আবেগ বেঁচে থাকে,

ধ্বনির শক্তি, বনের উজ্জ্বলতা,

কী জানে কেউ, বনের চেহারা কেমন?" 


(গায়েনরা ধীরে ধীরে গান গাইতে থাকে, তাদের সুরের মধ্যে একটি গম্ভীরতা ও ধ্বনির প্রবাহ তৈরি হয়। আলো একেকটি উজ্জ্বলতা ও ছায়ার খেলায় মঞ্চে ওঠে। বনবিবি আসেন, তার পরিভ্রমণ শুরু হয় এবং গায়েনদের গান আরও তীব্র হয়ে ওঠে।)

বনবিবি : (গায়েনদের গান শেষে, গভীর দার্শনিকভাবে, একটু থেমে, এক গভীর নিঃশ্বাস নেন, তারপর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলেন) প্রকৃতি কেবল সে নয়, যা আমাদের চোখের সামনে দেখা যায়, এটা স্রষ্টার এক অপার্থিব সঙ্গতি, যেখানে দেবী, বাঘ, পীর—তিনটি শক্তি একত্রে বাস করে। এরা কেউ একে অপরকে ছাড়ে না, এরা কেউ একে অপরকে বিনাশ করে না, যে বনে একসাথে বাস, সে বনকে চিরকাল সহাবস্থানের স্থান হতে হবে। আমরা বনকেই দেবী বলি, যেহেতু প্রকৃতির মধ্যে সবকিছুর সঠিক ভার থাকে।

(বনবিবি কিছু সময় নীরব থাকেন, তারপর আবার বলতে শুরু করেন)

বাঘের শক্তি, সে যদি ভয় ছড়ায়—তাহলে সে ভয়ের প্রতীক নয়, সে প্রকৃতির শক্তির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন আমি দেবী, তেমনই বাঘ— প্রকৃতির মধ্যে কষ্টকর, অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের সঙ্গেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যদি প্রকৃতির শক্তির সাথে সম্মিলন করতে না পারি, তাহলে কিভাবে আমরা শান্তির আস্বাদন করতে পারি? (বনবিবি আরও এক মুহূর্ত নীরব থাকেন, তারপর তাঁর কথায় এক শক্তিশালী আবেগ ফুটে ওঠে) এবং পীর—তার শাশ্বত শান্তি, তার আত্মিক সমাধি— সে আমাদের পথপ্রদর্শক, আমরা তার তত্ত্বে ছায়া পাই। পীরের শান্তি প্রকৃতির শক্তি বুঝতে সাহায্য করে। এমন এক শক্তি, যা কখনও নিজের সীমা ছাড়ায় না, এমন এক শক্তি, যা অতিক্রম করে না কোনো ধ্বংসের পথে। বনের বিচার, এই সব শক্তির মধ্যে তৈরি হয়, এটি মানুষের চিন্তার মাধুর্য এবং প্রাণের শান্তি।

(বনবিবি এবার গায়েনদের দিকে তাকিয়ে, গানের শেষে সুরের সাথে মিলে বলেন)

এবং সেই শান্তি, সেই একতা—যেটি দেবী, বাঘ ও পীরের মাঝের সেতু।যারা প্রকৃতির শক্তি বোঝে, তারা কখনও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে না,তারা জানে, বন কারো একক নয়—এটি সকল জীবের।এটি আমাদের—এটি সবার।

গায়েনরা একে একে মঞ্চের মাঝে ফিরে আসে এবং আবার গান শুরু করে। বনবিবির বক্তব্যের পর গায়েনদের সুর আরও একবার গম্ভীর হয়ে ওঠে, যেন তা এক ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। গানটির মধ্যে সকল জীবের অন্তর্গত একতা এবং সহাবস্থানের বার্তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।


"বন বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও,

প্রকৃতির মাঝে সবার সমান অধিকার,

বাঘ, দেবী, পীর—এই শক্তি এক,

এরা একসাথে, সবার জীবন স্পর্শে থাকে!"


(গায়েনদের গান শেষে, গায়েনরা একসাথে দাঁড়িয়ে সব সুরে ধীরে ধীরে শেষ করে দেয়। মঞ্চে এক শান্তিপূর্ণ নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে, দর্শকরা সঠিক সময়ে নিঃশ্বাস ফেলে এবং বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করতে শুরু করে।)


দৃশ্য ১৭: অন্তিম পর্ব

(গায়েনদের গান শেষ হয়ে গেছে, মঞ্চে একটি গভীর নীরবতা বিরাজ করছে। বনবিবি একমুখী শক্তিতে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চারপাশে স্নিগ্ধ আলো এবং পেছনে গায়েনরা সংগীতের মৃদু সুরে প্লাবিত করছে। আলো আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে, আর কেমন যেন একটি আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি হয়। মঞ্চের এক প্রান্তে দক্ষিণ রায় এবং গাজী পীরকে দেখা যায়। দক্ষিণ রায়ের চেহারায় অসীম ক্ষোভ, তার হাত তীব্রভাবে মুঠোবন্দি। গাজী পীর সান্নিধ্য থেকে এক সজীব আলো বিচ্ছুরিত হয়, তবে তার চোখে যেন এক শান্ত এবং মগ্ন ভাব। পেছনে, কিছু পিশাচদের অবয়ব খুব ধীরে, মনের অন্ধকার কোণে চলে যায়। তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনো পরাজয় বা আত্মবিশ্লেষণের মধ্যে।)

বনবিবি : (দর্শকদের দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে, শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে) তামরা যারা এখানে এসেছো, যারা এই বনকে, এই জীবনের রহস্যকে জানতে এসেছো— তোমরা জানো না, কিন্তু আমি জানি— এই বন এক বিশাল হৃদয়ের প্রতীক। এটির ভিতরে লুকিয়ে আছে এক শক্তি, যা আমাদের প্রত্যেককে আলোকিত করে, আর এই শক্তির কাছে কোন ভয় নেই, কোন অন্ধকার নেই।

(বনবিবি একটি ক্ষণস্থায়ী বিরতি নেন। দর্শকদের মধ্যে তার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কণ্ঠে যেন একটি প্রজ্ঞার সুর থাকে, যা বাতাসের মতো প্রবাহিত হয়।)

(আরও দৃঢ় হয়ে, শক্তিশালী কণ্ঠে) তবে, এই বন কারো নয়— এটি এক সবার, সবার অধিকার। এই বনের শরীরে যারা বাস করছে— তাদের সবার স্থান এখানে, এই পৃথিবীতে। প্রকৃতি কোনো একক ধর্মের, কোনো একক শক্তির নয়। প্রকৃতি তো জীবনের পূর্ণতা, এটা সবার জন্য, সমস্ত পৃথিবীজুড়ে।

(বনবিবি একটু এগিয়ে এসে, তার কণ্ঠের মধ্যে এক নরম, অথচ শক্তিশালী সুর ছড়িয়ে দেন।) আমরা, আমাদের এই অস্তিত্বের সাথে একত্রিত হই, এটা একটি সংগ্রাম নয়, এটা এক মিলনের পথ, একত্রে চলার পথ, যেখানে শান্তির সুর আছে। যতদিন আমরা প্রকৃতির শাসন বুঝে মেনে চলব, ততদিন কেউ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না, কেউ হারাবে না, কেউ নিঃশেষ হবে না।

(এই সময়ে, মঞ্চের এক কোণে দক্ষিণ রায়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। তার মুখে কঠিন অভিব্যক্তি, যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলছে, তা যেন খুবই পরিষ্কার। গাজী পীরের দৃষ্টি শান্ত, তবে তার চেহারায় এক গভীর বোধ ফুটে ওঠে। পিশাচরা, যে কখনও দক্ষিণ রায়ের অনুসারী ছিল, এখন নতমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা যেন অজানা এক আত্মবিশ্লেষণের মধ্যে ডুবে গেছে।)

বনবিবি : (মৃদু এক শ্বাস নিয়ে, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে, এক অনন্য সুরে) তোমরা যদি প্রকৃতির আইন বুঝো, যদি তুমি শুধু তোমার স্বার্থ চিন্তা না করো— তাহলে দেখবে যে, এই বন, এই পৃথিবী, এই সমস্ত জীব—তাদের জন্য, আমাদের জন্য, সকলের জন্য একে অপরের হাত ধরার সময় এসেছে। এটি শুধু একটি শপথ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রমাণ। একটি অনন্ত জীবন, যেখানে কেউ হারাবে না, সবাই বাঁচবে একসঙ্গে।

(বনবিবি একটি দৃঢ় ও শান্ত শপথ নেন, তার শব্দের মধ্যে এক স্থিরতা এবং নৈঃশব্দ্যের গভীরতা থাকে। মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। দক্ষিণ রায় তার অনুসারীদের দিকে একটি কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গাজী পীর শান্তভাবে মঞ্চে এক পবিত্র আলো সৃষ্টি করেন, আর পিশাচেরা দৃষ্টির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাদের মাথা নত হয়ে গেছে—এটা যেন পরাজয়ের প্রতীক।)

বনবিবি : (চোখে চোখ রেখে, দৃঢ়তার সঙ্গে, কিন্তু এক আবেগঘন সুরে শেষ কথা বলেন) এই বন, এই পৃথিবী—এটি শুধুমাত্র একে অপরের নয়। এটি আমাদের সকলের, সকল জীবের। আর যতদিন আমরা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখব, ততদিন আমরা একে অপরকে হারাবো না।

(এ দৃশ্যে, মঞ্চের অন্ধকারে গায়েনরা ধীরে ধীরে তাদের গান শুরু করেন, বনবিবি, গাজী পীর এবং দক্ষিণ রায় সকলের মুখে এক অদৃশ্য এক মিলনের শপথের দৃশ্য ফুটে ওঠে। পেছনে গায়েনদের গান থেকে আসা সুরের মধ্যে শান্তির এবং মিলনের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়, এবং মঞ্চের অন্ধকার ধীরে ধীরে এক আলোর আভা তৈরি করে। দর্শকরা যেন এক অনন্ত জীবনের শপথের সাক্ষী হয়ে যান।)



-সমাপ্ত-





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages