জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর জন্য প্রণীত আদি ও সহি গল্প - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০২০

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর জন্য প্রণীত আদি ও সহি গল্প



যে নগরে আমি থাকি সে শহরের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই। যে নামেই ডাকা হোক- শহরটি সেই নামেই খ্যাত হয়ে ওঠে। কোন নাম নেই বলে কেউ কেউ বেওয়ারিশ শহরও বলে থাকে। তবে কাগজে কলমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারন করে নগর তার রঙ বদলায়। শহরের একজন পিতা আছেন, সুরক্ষিত দেয়ালের ভেতরে সকল রাজনীতি আর উন্নয়নের ফর্দ নিয়ে খেলতে থাকেন। শহরপিতা এবং কতিপয় প্রশাসনিক কেরানী নিয়ে নগরের আদব-কায়দার নীতিমালা প্রণয়ন করে নগরবাসির কাঁধে চাপিয়ে দেন। নগরভবনের সামনে বহুবছর ধরে অশ্বত্থ গাছটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। যে অশ্বত্থ নিঃশর্তভাবে আশ্রয় দেয় নগরপিতার কাছে আর্জি নিয়ে আসা নাগরিককে, পথে ক্লান্তিতে ন্যুয়ে পড়া কুকুরকেও আশ্রয় দিতে দ্বিধা করে না। 

বহুকাল ধরে বেঁচেবর্তে থাকা এই গাছটিকে ঘিরে নগরের কয়েকটি কাক তাদের নিবাস বানিয়ে রেখেছে। যে কাকগুলোর কাছে নগরের সব খবরাখবর পাওয়া যায়। তারা নগরের প্রতিটি মানুষের ঘরের খবর পর্যন্ত রাখে। রাজনীতির খবর, ব্যবসাবাণিজ্যের খবর, সাংস্কৃতির খবর, খেলাধুলার খবর, হরতাল অবোরধের খবর, সন্ত্রাসীদের অভ্যান্তরীন দ্বন্দ্ব আর বস্তির না খাওয়া মানুষের খবরসহ সবকিছু তাদের নখদর্পনে। এই কাকেরা জানে-এ বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত আদি ও সহি কিতাবের কিস্সা-কাহিনী। কাকগুলোর ভেতরেও দলকানা ও দলবিভক্তি বিষয়াদি লক্ষ্য করার মতো। সরকার দলীয় কাক, বিরোধী দলীয় কাক, সামাজিক ও পরিবেশবাদী কাকও আছে, আছে সাংষ্কৃতিক অঙ্গনে ঘোটপাকাপাকি, লাশ ব্যবসায়ীর মতো শহীদ মিনারের পাদদেশে ফন্ধি-ফিকিরে ব্যস্ত থাকা বুদ্ধিজীবি ঘরানার কাকও রয়েছে। সকালসন্ধ্যা তাদের ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে কর্কশধ্বনীতে নিজেদের ভেতরে ঝগড়া-আলাপ-আলোচনা-মিছিল-হুমকী-পাল্টা হুমকীতে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে। কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত কাকেদের একেকটি টীমের সরদারও আছে। সরদার কা কা করতে করতে একটুকরো মাংসের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে তার অনুসারিরাও সেখানে ছুটে যায়। একেকটি টীমের অধীনে একেকটি ডাস্টবিন দখল আছে। আবার মাংসের টুকরার উপর নিজের ভোগ অধিকার নিশ্চিত না করতে পেরে বিরোধীদলীয় কাকগুলো বিষ্টা ছড়াতে ছড়াতে সাধারণ মানুষের উপর তার ক্রোধ ঝাড়তে থাকে। দস্যু দলের মতো পরিবেশ বিঘ্ন করে তছনছ করতে থাকে মানুষের শান্তি। যে সামাজিক ও পরিবেশবাদী কাকেরা কোকিলের ঘরে ডিম পাড়তে ব্যস্ত থাকে তারা বাইরে এসে অধিকারের প্রবঞ্চনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সভা-সমাবেশ-সেমিনার-বিভিন্ন দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে নিজের উদরপূর্তি নিশ্চিত করে ওঁম শান্তি ওঁম শান্তি বলতে বলতে দূর আকাশের দিকে উড়ে যায়। 

অন্যদিকে সমাবেত সঙ্গীতের কোরাসে ঢুলতে ঢুলতে অপেক্ষা করতে থাকে আমাদের নগরের বুদ্ধিদীপ্ত কোন কাকের অন্তিম যাত্রার। অজস্র মিডিয়ার সামনে ব্যক্তিত্ব প্রকাশে, ব্যক্তিগত শোকের মাতমে পরিবেশকে গুরুগাম্ভীর্য করে সংস্কৃতিদাসী এই কাকেরা তাদের ক্রিয়াকর্ম জানান দিতে থাকে। আবার রাজনৈতিক কাকেরা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বাহ্বা দিয়ে ঘরে ঢেকে এনে গচ্ছিত কিছু মাংসের টুকরো ধরিয়ে দেয়। 

একবার এই শহরে নগর ভবনের ঠিক পাশের বহুতল ভবনে অজানা কারণে আগুন লাগলো। চারিদিকে মিডিয়ার সরগম, উৎসুক জনতার চাহুনী, ফায়ারসার্ভিসের ক্রিয়াকর্মসহ তাবৎ হুড়োহুড়ির ভেতরে ভবনের ছাদে আটকে থাকা মোবাইল টাওয়ারের উপরে অলস কর্মহীন একটা কাক দীর্ঘক্ষণ ধরে অবলোকন করছিলো এদের কার্যক্রম। একপর্যায়ে যখন একজন সংবাদ কর্মি সদ্য উদ্ধার হওয়া একজন মানুষের সাক্ষাৎকার নেবার জন্য আহত মানুষটার আগুনে পুড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া নিচ্ছিলো ঠিক তখন অলস কাকটা উড়ে এসে টিভি ক্যামেরার উপর বিষ্ঠা ছড়িয়ে আবার উড়ে গেলো তার পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। এতে সংবাদদাতা কিছুটা বিব্রত হয়ে কাকটির দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে গালিগালাজ শুরু করে দিলো। অলস কাকটি তখন চিৎকার দিয়ে বলতে থাকলো- ‘এইভাবে টিআরপি বাড়ানো যায় নারে বোকা মানুষ! টিআরপি বাড়াতে হলে আরো ইউনিক হতে হবে।’ টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন দূর থেকে জুম করে করে ধোঁয়ার কু-ুলির ভেতর থেকে কাকের তীক্ষ্ম দৃষ্টির দিকে ক্যামেরা ধরার সাথে সাথে নিরীহ কাক উড়ে চলে গেলো।

এই টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদক বহুদিন থেকে একটা ইউনিক স্টোরি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর চিন্তা ভাবনা করতে করতে অবশেষ কোন উপায় খুঁজে পেলো না। কর্পোরেট মিডিয়া কর্তৃক তার উপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিলো তা থেকে বেরুবোর নানান উপায় খুঁজতে চেষ্টা করে। তার সামনে কোন গল্প এসে হাজির হয় না। গল্পরা ক্যামেরা দেখলেই অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আপাতত ধরা যাক এই প্রতিবেদকের নাম টডরমল্ল। প্রতিটি টেলিভিশনের একই স্টোরিতে টেলিভিশনের দর্শকেরাও চরম বিব্রত। নতুন কোন গল্প নেই, নতুন কোনো ঘটনা নেই, রাজনৈতিক কোন ইস্যূ নেই, হরতাল নেই, অবরোধ নেই, মিছিল নেই, সংঘর্ষ নেই, জনতা পুলিশ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া নেই। মাঝে মাঝে ছাত্র রাজনীতির ভেতরে কিছু আন্দোলন জমে উঠলেও দুদিন পরে তা আবার অজানা কারণে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এবং সে আবিষ্কার করতে থাকে এদেশে কোনো আন্দোলন চারদিনের বেশি টিকে থাকে না। আন্দোলনের ক্ষেত্রে মূলত দুটি ঘটনা তার চোখে ধরা পড়ে:

  • আন্দোলন তুমুলভাবে চলাকালীন সময়ে অজ্ঞাতকারণে আন্দোলনকারীদের ভেতরে বিভিন্ন দলের উষ্কানীদাতার ঢুকে আন্দোলনকে ছিনতাই করে ফেলে আর তখন সেই আন্দোলনের পার্শ্ব -প্রতিক্রিয়াসরূপ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে। 
  • যখন এরূপ কোনো আন্দোলনে বাইরের কোন শক্তি ঢুকে পড়তে পারে না তখন আন্দোলনকারীদের ভেতরে ঢুকে পড়ে সরকারী ফর্মুলা, সারা দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সেই অজ্ঞাত কারণেই একজন আন্দোলনকারী নেতার ইশারায় তা স্থগিত করে দেয়ায় বাইরে থেকে ঢুকতে না পারা অন্যদলগুলোর হতাশা চরমে পৌঁছায়। সঙ্গত কারনে আবার সেই একই প্যাঁচাল, শাদাকালো কাহিনী, নিরুত্ত্বাপ নগরের আবহাওয়া। 
  • এই যখন গোটা শহরের অবস্থা তখন প্রতিবেদক বেরিয়ে পড়লো নতুন কোন গল্পের খোঁজে, নতুন কোন বিষয়ের গভীরে। নগর ভবন থেকে শুরু করে তার নিয়মিত চলাচলের স্থানগুলোতে খুঁজতে থাকে গল্পের কাকগুলোকে। 


দৃশ্যপট-১: বাংলাদেশ শিল্পকলাএকাডেমী

সেই একই ধরনের চরিত্রের কাকগুলো দখল করে আছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দেয়াল। এই কাকগুলো অন্যসব কাকের মতো খুব বেশি বিশ্রী এবং কর্কশধ্বনীতে কাকা করে না। এরাও বেশ শিল্প মর্যাদা সম্পন্ন। দৃষ্টিভঙ্গি গম্ভীর এবং রাশভারি। অন্যসব কাকদলের মতো ডাস্টবিন দখল করে প্রভাব প্রতিপত্তি না দেখালেও ঠিকঠাক কোকিল সম্প্রদায়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত উৎসবগুলোর এরা নিয়মিত দর্শক। তৃণমূল পর্যায়ে শিল্প সংস্কৃতি পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমি যে বিস্তার লাভ করেছে এবং এর ভেতরের ফন্দিফিকিরে যারা নিজেদেরকে নানান পর্যায়ের কর্মে ব্যস্ত রেখেছে। ক্ষুদ্রক্ষুদ্র জাতিগোষ্টির প্রণোদনার ভিত্তিতে নিজস্ব সংষ্কৃতি ধরে রাখার উৎসব থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফরমায়েশি উৎসবের আমেজ ঢেলে দেয় আগত দরর্শনার্থীদের। আর সেই কাকেরা আগত দর্শকের মতো নিজেরাও উপভোগ করতে থাকে।

টডরমল্ল যখন শিল্পকলা একাডেমির উৎসব কভার করতে আসে তখন সেখানেও এই কাকগুলোর উপস্থিতি তাকে বারবারই বিব্রত করে। চলতি বছরের বাজেট পরবর্তি শিল্পকলার জন্য বরাদ্দ অর্থ নিয়ে বাৎসরিক পরিকল্পনা বিষয়ক এক সাক্ষাৎকারে জনৈক মহাপরিচালকের অভিব্যক্তি নেবার সময় কোত্থেকে একদল কাক উড়ে এসে মহাপরিচালকের মাথায় হাগু করে কা...কা... শব্দে উড়ে চলে যায়। টডরমল্লকে চিৎকার দিয়ে একটি কাক বলতে থাকে ‘মহাশয়, আগে উনাকে প্রশ্ন করুন, ‘নাট্যকর্মী’ না ‘নাট্যশিল্পী’, কোন শব্দটা আত্মপরিচয়ের জন্য যথেষ্ট? আর এর জন্য গ্রুফ থিয়েটার ফেডারেশনের মাধ্যমে কোন অর্থ বরাদ্দ ছিলো কিনা?’ মহাপরিচালক মহোদয়ে কাকের এই বিব্রতকর প্রশ্নের কোন সদূত্তোর না দিয়ে ক্যামেরার সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেললেন। সঙ্গত কারণে টডরমল্ল শিল্পকলা একাডেমি থেকে কোন স্টোরি তৈরি করতে পারলো না।

একদল কাক যখন নৃত্যশালার দিকে উড়ে যাচ্ছিলো তখন সেদল থেকে উপদলের সৃষ্টি করে চিত্রশালাভিমুখে আরেকদল কাক উড়ে গেলো। সেখানে নানান ফরমায়েশি বুদ্ধিজীবিদের দলে ভীড়ে কাকেরাও কেমন বুদ্ধিজীবি বনে গেলো। নৃত্যকলা ও চিত্রকলার বিশারদগণ ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে এই অঞ্চলে বিচরণ করে থাকে। এখানকার কাকগুলো তাদের চরিত্রধারন করে চিত্রকলার বিভিন্ন ইজম নিয়ে নিজেদের ভেতরে বাকবিতণ্ডা শুরু করে দেয়। টডরমল্ল কাকদের এইসব বাকবিত-া বেশ উপভোগ করতে করতে খুঁজে পায় এসকল শিল্পবিশরদগণ কেবল অতীতের শিল্পকলা বিষয়কজ্ঞানেই কেবল সীমাবদ্ধ। নিজেদের নতুন ইজম কিংবা ফর্ম নিয়ে মাথা ব্যাথা না থাকায় এখান থেকে ইউনিক স্টোরির সন্ধান মিলবে না। টডরমল্ল সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলো না। শিল্পকলা একাডেমি থেকে সোজা চলে গেলো মহান বাংলা একাডেমির দিকে। ক্যামেরা পার্সনকে সাথে নিয়ে টডরমল্ল সোজা বাংলা একাডেমির দিকে যাত্রা করলো, সেখানে চলছে আসন্ন বইমেলা, বাংলা একাডেমি পুরষ্কার নিয়ে প্রস্তুতি সভা।

দৃশ্যপট-২: বাংলা একাডেমি

বসুন্ধরা নির্মিত বাংলা একাডেমির প্রবেশ গেইট এর উপর বসে বাংলা একাডেমি কেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার করা কাক সর্দারের ছত্রছায়া একদল কাক কবিদের মতো আলখেল্লা স্বভাব নিয়ে নিয়মিতভাবে হহৈুল্লোড়ে মেতে থাকে। এই কাকগুলো জানে বাংলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে কোন কোন লেখক বা লেখকসম্প্রদায় একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তরুণ লেখক প্রকল্প নিয়ে এই কাকেরা তুমুল আড্ডা বসিয়েছে। লেখক বানাবার নানা ক্রিয়া-কৌশলের ফর্দ নিয়ে একটা কাক উড়ে এলো বাংলা একাডেমির সামনে অবস্থিত ডাস্টবিন থেকে। এই ফর্দ নিয়ে কাকদের ভেতরে তুমুল আলোচনা। ভীড়ের ভেতর থেকে শান্ত স্বভাবের একটি কাক একটু উচ্চস্বরেই কা...কা... করে এই আধাখেচড়া শহরের বাজারী পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ লেখক প্রকল্পের তৈরিকৃত একজন তরুণ কবির কবিতা কুড়িয়ে নিয়ে আসলো পাশের চায়ের দোকানের সামনে থেকে। এই চায়ের দোকানের সামনে জমে থাকা কাদাপানি ছিটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভূতপূর্ব অধ্যাপকের সদ্য রঙ করা জুতায় এসে লাগলো। জনৈক অধ্যাপক দ্রুত চায়ের দোকন থেকে বাজারী পত্রিকার একটা পাতা ছিঁড়ে তার জুতাটা পরিষ্কার করে পাতাটা রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়েছে। চায়ের দোকানের সাথে গাছটাতে শান্ত স্বভাবের এই কাকটা দীর্ঘক্ষণ অধ্যাপকের এই বিব্রত পরিস্থিতি অবলোকন করছিলো। অধ্যাপক সাহেব যখন কাগজটা ছুঁড়ে দিয়েছিলো তখন কাকটা ছোঁ মেরে কাগজের টুকরাটা মুখে নিয়ে বাংলা একাডেমির প্রবেশ গেটের মাথায় উড়ে এলো। তো উপস্থিত কাকেরা তরুণ লেখকটির কবিতা সমস্বরে আবৃত্তি করতে লাগলো-
...............................................................................................................................................................................................................................................................................
‘আমাদের নয়নতারা ঝরে পড়েছে
তোমাদের উঠোনে,
দশদিগন্ত থেকে ছুটে এসেছেন কৈলাশের দেবী
ও দেবী ও সর্বমায়া
তোমার চরণতলে আমার সর্বস্ব উজাড়
প্রণতিসম ধ্যানবিদ্যায় দিও ঠাই...’
..............................................................................................................................................................................................................................................................

টডরমল্ল কাকের ক্ষুদ্র সমাবেশ ফ্রেম বন্দী করে ঢুকে পড়লো বাংলা একাডেমির ভেতরে। সুসজ্জিত হলরুমে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আসন্ন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার ও বইমেলা শীর্ষক প্রস্তুতিসভা উত্তর পুরষ্কারপ্রাপ্তিদের তালিকা ঘোষণার মঞ্চে ক্যামেরার্পাসনকে নিয়ে টডরমল্ল উপস্থিত মিডিয়াকর্মিদের ভীড় ঠেলে ঢুকে পড়লো। দেনদরবার করে সম্ভাব্য পুরষ্কার পাওয়া লেখকগণের নাম ঘোষণা এবং উপস্থিত লেখকদের ছোট ছোট সাক্ষাৎকার নিয়ে যখন টযরমল্ল গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো তখন বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিনের আবাসগড়ে তোলা কাকের দল তার পথ আগলে দাঁড়ালো। জমিদারের ভঙ্গিতে কাক সরদার টডরমল্লর দিকে এগিয়ে এসে কা...কা... করতে লাগলো। ক্যামেরাপারসন কাকের এই মেজাজকে ক্যামেরা ধারন করলো। উপস্থিত কাক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে সরদার কাক ঘোষণা করতে থাকলো যে- 

‘উপস্থিত কাক প্রজাতির পক্ষিকূল! আপনাদেরকে আজ বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনে হাজির হবার জন্য সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা জানেন, ষাটোর্দ্ধ বাংলা একাডেমি এমন এক অথর্ব প্রতিষ্ঠান যার নামকরণটি নিয়ে এখনো দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখা হয়েছে। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দান করে সে জাতির সৃজনশীল মনন তৈরি করার প্রতিষ্ঠানের নাম আজও বাংলায় রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। সেই অর্ধ বাংলা আর অর্ধ ইংরেজি ভাষার নামধারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আজ বাৎসরিক পুরষ্কারের জন্য যে নামগুলি ঘোষিত হলো তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এই পুরষ্কার প্রক্রিয়ার পেছনে অর্থঘণিষ্ঠ, স্বজনপ্রীতি, মুখচেনা চরিত্র বহমান রয়েছে। অথচ এদেশে পুঁজি ও পক্ষপাতিত্ত্বের মুখোশ পরে থাকা মিডিয়াগুলো তা জাতির সামনে সগৌরবে তুলে ধরছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা কওে বাংলা একাডেমি থেকে আমাদের বসবাস প্রত্যাহার করলাম’


এই ঘোষণাটি দেবার সাথে সাথে কাকদল বাংলা একাডেমি থেকে তাদের আবাস সরিয়ে নিয়ে উড়ে গেলো দূর আকাশের দিকে কিংবা শহরের অন্য কোনো প্রান্তরে। ক্যামেরা লংশর্টে কাকের উড়ে যাওয়া দৃশ্য ধারন করতে থাকে। তখন টডরমল্লর একটা ফোন আসে যে দেশের একজন ভাষা সৈনিকের মৃত্যুর খবর। কিছুক্ষণ বাদে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারের পাদদেশে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশের নাগরিকগণ তার লাশের উপর শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

দৃশ্যপট-৩: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বছরের অধিকাংশ সময়ে দখলে থাকে সম্মিলীত সাংস্কৃতিক জোটের। শহীদমিনার কেন্দ্রীক কাকগুলো একটু রুগ্ন চেহারার হয়ে থাকে। কাকগুলোর কাছে খবর থাকে এখানকার প্রতিমুহূর্তের ঘটনার। এদের ধারনা এখানে প্রায় দিনই সম্মিলীত সাংস্কৃতিক জোট লাশ কেন্দ্রীক শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মটি করে থাকে। বোধ হয় সম্মিলীত সাংস্কৃতিক জোটের এটাই একমাত্র কাজ। দেশের কোন বিশিষ্ট নাগরিকের মৃত্যুর খোঁজ-খবর রাখা, শৎকারের ব্যবস্থা, মাইক টাঙিয়ে শোকসভা করা ছাড়া এদের হয়তো আর কোনো কাজ থাকা উচিত না। এখানে বসবাস গড়ে তোলা কাকগুলো সম্মিলীত সাংস্কৃতিক জোটের উপর একারণেই সবসময় মনোক্ষুন্ন হতে থাকে। কেবল লাশের গায়ে লেপ্টে থাকা কপ্পুরের গন্ধ আগর বাতি, গোলাপ জলের উচ্ছিষ্ট গন্ধ ছাড়া এদের ভাগ্যে আর কিছু জোটে না। সংগত কারনে এখান কাকেরা সম্মিলীত সাংস্কৃতিক জোটের এসব ক্রিয়াকর্মে যথেষ্ট নাখোশ। 

প্রায়ই না খেয়ে থাকা এসব কাকেরা সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃবৃন্দকে দেখলেই কর্কশ ধ্বনীতে কা...কা... করে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করতে থাকে। টডরমল্ল এই কাকদের ভাষা না বুঝলেও তাদের চরিত্র সম্পর্কে বেশ ধারনা অর্জন করতে পেরেছে ইতিমধ্যে। কাকের রক্তচক্ষুকেও সে এখন টের পায়। ক্যামেরা পার্সন একটি রুগ্ন কাকের চোখ থেকে জুম করে ক্যামেরার ফ্রেম টেনে নিয়ে আসে শহীদ মিনারের পাদদেশে একজন ভাষা সৈনিকের মৃত্যুতে তার উপরে নিবেদিত কবিতা আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠানে। 

ভাষা সৈনিক এর মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত আবৃত্তি পরিষদের এই অনুষ্ঠান কাভার করতে আসা টডরমল্ল যখন মাইক্রোফন হাতে নিয়ে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্যগুলি রেকর্ড করছে তখন একদল কাকের ভেতর থেকে নেতা ধরনের একটি স্বাস্থ্যবান কাক কা...কা...  করে উঠে বলতে থাকে- ‘আরে পাগলা, আবৃত্তি কোনো শিল্পের পর্যায়ে পড়ে না। এটা গলা বেচাকেনার ব্যাপার স্যাপার। আবৃত্তির নামে শুদ্ধ উচ্চারণ শিখে বিভিন্ন চ্যানেলে অ্যা অ্যা অ্যা করে জন্য নিউজ প্রেজেন্ডার হবার ধান্দার বাইরে কিছু নয়। এরা সেই বুড়ো আর মরে যাওয়া কবিদের কবিতার বাইরে কিচ্ছু পড়তে জানেনা। এই নিউজ পাবলিক খায় না।’  

টডরমল্ল চরম বিরক্ত ও হতাশ হয়ে বসে পড়লো। আর ভাবতে থাকলো তার বোধ হয় আর চাকুরি থাকবে না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্টি করার মতো তার হাতে আর কোনো স্টোরি নেই। একটা ইউনিক স্টোরি তৈরিতে সে সম্পূর্ণ একজন ব্যর্থ মানুষ। টডরমল্ল’র মনে পড়ে যায় একদিন সেও এরকম এক আবৃত্তি চর্চার সংগঠন থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে টেলিভিশন এর সংবাদদাতা হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলো। অবশেষে মন খারাপ করে একেবারেই শূন্য হাতে টডরমল্ল নিউজ রুমে ফিরে গেলো। আজই হয়তো এই টেলিভিশনে তার শেষ কর্মদিন একজন ব্যর্থ সংবাদাতা হিসাবে। 

নিজউজ রুমে সে কিছুক্ষণ মাথা টেবিলে ঠেকিয়ে ঝিমোতে থাকলো আর নানান দুশ্চিন্তা তাকে একের পর এক আক্রমণ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে সে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে থাকে চারিদিকে। কোথাও কাউকে ঠিকঠাক দেখতে পারে না। সবকিছু কেমন যেনো ঝাপসা দেখতে লাগেলো। রুম ভর্তি যে মানুষগুলো গিজগিজ করছিলো সেই মানুষগুলোকে সে এখন দেখতে পাচ্ছে না। অনেকগুলো কাক কেবলই তার চারপাশে কা কা করছে। একপর্যায়ে জেষ্ঠ্য সাংবাদিক একজন তার পেছন থেকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে কোন স্টোরি তৈরি করতে পেরেছে কিনা। আশ্চর্য হয়ে টডরমল্ল তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকে চিনতে চেষ্টা করলো। আসলে সে যা দেখতে পাচ্ছে তা অন্যরকম কিছু, অনেক্ষণ খেয়াল করে দেখলো প্রকৃতপক্ষে সে একজন জেষ্ঠ্য সাংবাদিক নয় ঠিক যেনো একটা কাক তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছে। সে লক্ষ্য করলো, এতোদিন ধরে তার চারপাশে কাজ করা মানুষেরা সবাই কাক হয়ে গেছে। তো সেই জেষ্ঠ্য কাক সাংবাদিকের কথার উল্টর দিতে যেয়ে হঠাৎ টডরমল্ল লক্ষ্য করতে লাগলো যে সে আর কথা বলতে পারছে না। তা গলা দিয়ে কোনো বাক্য বের হচ্ছে না। সে যা বলছে তা কেবলই কা...কা...কা... ধ্বনীতে রূপান্তরীত হয়ে বেরিয়ে আসছে। শহরের সব কাকদের ভাষা তার কণ্ঠ দিয়ে বের হতে লাগলো। টডরমল্লর শরীর ক্রমশ কাকের শরীরের মতো কালো হয়ে যাচ্ছে এবং সে আবিষ্কার করতে থাকলো মানুষ থেকে ক্রমশ কাকে রূপান্তরীত হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভেতরে তার পীঠ থেকে দুটো কালো ডানা বের হবে এবং সে উড়তে শুরু করবে...

এই নগর মানুষের নগর থেকে কাকের নগরে পরিণত হবে। আগামি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরে এই শহরের প্রতিটি মানুষ একেকটি অভিজ্ঞ কাক হয়ে যাবে, আর নিজেরদের মাংসের টুকরো নিয়ে নিজেদের ভেতরে ভাগাভাগি করতে থাকবে...


- শাফি সমুদ্র



Pages