এ্যান্থনি ও ডানাভাঙা বাদুড় - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮

এ্যান্থনি ও ডানাভাঙা বাদুড়

কপালের ঘাম মুছে এ্যান্থনি গাছের নিচে ধপ করে বসে তার লম্বা দুই পা ছড়িয়ে দেয় রাস্তার দিকে। চোখে ঘুম ঘুম নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমুতে থাকে। যখন এ্যান্থনির চোখ বন্ধ হয়ে আসে ঠিক তখন পায়ের উপর দিয়ে পিঁপড়ার দল হেঁটে যায়, লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়া। এ্যান্থনি টের পেয়ে ধীর চোখে সারিবদ্ধ পিঁপড়ার হেঁটে যাওয়া দ্যাখে। আনন্দ পায়। পিঁপড়ার সাথে গল্প করে। আঙুলের ডগায় একটা পিঁপড়ার বাচ্চা তুলে নিয়ে আদর করে। চুমু খায়। পিঁপড়াদের সাথে গল্প করতে করতে তার কপালের ঘাম শুকিয়ে আসে। পকেট থেকে একটুকরো সাদা কাগজ বের করে পিঁপড়াকে কাগজের উপর রাখে। যতোবার ও কাগজের উপর থেকে বেরিয়ে যেতে চায় ঠিক ততোবারই এ্যান্থনি আঙুল দিয়ে সরিয়ে কাগজের মাঝখানে নিয়ে আসে। 

তার স্থির পায়ের উপর দিয়ে এবার কালো রঙের পিঁপড়ে হেঁটে যেতে দেখে আরেকটা পিঁপড়ার বাচ্চা তুলে এনে কাগজের উপর রাখে। খুব ভালোভাবে পিঁপড়ের দু'টোকে দ্যাখে। ওদের সাথে খেলা করে। কথা বলে। অনেক্ষণ ধরে দুই রঙের দুই পিঁপড়াকে মুখোমুখি করে দেয়। কিন্তু যতোবারই মুখোমুখি করে দেয় ততোবারই পরষ্পর মিলিত হয়ে পিঁপড়া দু'টো দুই দিকে চলে যায়। খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে এ্যান্থনি। ওদের সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে আখের চিনি আর খেজুরের গুড় খাওয়ার লোভ দেখায়। তবুও ওরা এ্যান্থনির কথা শোনেনা। দু'টোকে কোন ভাবেই সমান্তরালে কিংবা পরস্পর মুখোমুখি হাঁটাতে পারেনা। রাগে বিড়বিড় করতে থাকে। আবার সোনাযাদুমনি বলে মিষ্টি করে ডাকও দেয়।
যে গাছের নিচে বসে আছে এ্যান্থনি, সেটি একটি প্রাচীন অশ্বত্থগাছ। প্রায় দেড়শ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। প্রতিদিন সূর্যের ভয়ে লুকিয়ে থাকা বাদুড়গুলো এই অশ্বত্থের ডালেই আশ্রয় নেয় প্রায় একশ বছর ধরে। এই বাদুড় এবং চামচিকাদের সাথে এ্যান্থনির খুব সখ্যতা। ওরাও তাকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করে। এ্যান্থনির মাথার উপর কখনো কখনো চামচিকাগুলো এসে বসে, গায়ে জড়িয়ে থাকে। ওদের সাথেও নানান রকম গল্প করে। গান শোনায়। একবার গ্রামের এক বজ্জাত বালক জিয়াল গাছের আঠা দিয়ে ফাঁদ পেতে রেখেছিলো। ঐ ফাঁদে চামচিকার একটি বাচ্চা আটকে ছিলো সারাদিন। আক্রান্ত চামচিকাটি ভয়ে কিচ্মিচ  করে, কান্নাকাটি করে। তখন মা চামচিকাটিও ওর চারিদিক দিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে। কোনভাবেই পায়ে জড়ানো আঁঠা ছাড়াতে পারছিলো না। বাচ্চা চামচিকার অন্যান্য বন্ধুরাও এসে ওই বাচ্চাটির অসহায় চিৎকার চেচামেচি দেখে ওরাও চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে। এমন সময় এ্যান্থনি ঐ অশ্বত্থের নিচে এগুলো দেখতে পায়। সেও ঐ বাচ্চাটির কষ্টের ভাগি হয়। খুব যতেœর সাথে চমচিকার পায়ের আঠা ছাড়িয়ে দেয়। তখন ওদের চিৎকার চেচামেচি থেমে যায়। তারপর এ্যান্থনি অনেক্ষণ হাত দিয়ে ওকে আদর করে ছেড়ে দেয়। বাচ্চাটি উড়ে গিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে মিশে যায়। তারপর থেকে ওদের সাথে এ্যান্থনির বন্ধুত্ব ও ভাবের শুরু হয়। 

এ্যান্থনির মন খারাপ হলে ওরা বুঝতে পারে। আবার যখন খুব বেশি মন ভালো থাকে তখনো চামচিকাগুলো আনন্দ পায় ওকে ঘিরে ওড়াউড়ি করে। আর মন খারাপের সময় এ্যান্থনির হাঁটুর উপর চড়ে বসে ছোট্ট চামচিকাগুলো। ছোটছোট চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিচমিচ করে ওর সাথে কথা বলে, এ্যান্থনি সায় দেয়। তারপর প্রাণ খুলে ওদের সাথে কথা বলে। তার ভিতরের কষ্টগুলোও মুহূর্তে হারিয়ে যায়। 

আর বাদুড়ের দল মাথার উপরে যখন ঘুমিয়ে থাকে, এ্যান্থনি ওদের ঘুমানোগুলো খুব মজা করে দ্যাখে, উপভোগ করে। সন্ধ্যা হলে ওরা উড়ে যায়। ওদের ওড়াটাও দ্যাখে। একটা বাদুড় কখনো উড়তে পারেনা। জন্মাবধি ওর ডানাভাঙা। অশ্বত্থের ডালে সবসময় ঝুলে থাকে। এ ডাল ও ডাল করেই তার জীবন যায়। এ্যান্থনি ওর নাম রেখেছে নিজের নামে। ওকেও এ্যান্থনি বলে ডাকে। কিভাবে যেন এ্যান্থনি ওর জীবনের ভিতরে অই বাদুড়টিকে খুঁজে পায়। যাকে ওর জীবনের ভিতরে খুঁজে পায় তার নামই ওর নামের সাথে মিলিয়ে রাখে। এ্যান্থনি বিশ্বাস করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণির বৈশিষ্ট্য-আচারণ, প্রকৃতির সমস্ত রূপ  প্রত্যেক মানুষের ভিতরে আছে। এর এ কারণেই সব সময় তাদের ভিতরে নিজের সমস্ত ক্রিয়া-কৌশল খুঁজতে থাকে। জন্মবধি এ বিশ্বাসকে ধারণ করেই সে বন-বাদাড়-পাহাড়-নদী সবখানে হরহামেশা ঘুরে বেড়ায়। নিঃসঙ্গতা ওর চিরোদিনের সঙ্গী। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের অনুভূতি কেমন হতে পারে তা অই বাদুড়টিকে না দেখলে কখনোই সে বুঝতো না। সব বাদুড় যখন সন্ধ্যেবেলায় উড়ে যায় মেঘের নিচে দিয়ে তখন ঐ ডানাভাঙা বাদুড়টি চেয়ে থাকে, মাথা উঁচু করে হা-হুতাশ করে। নিজেও উড়ার চেষ্টা করে, উড়তে পারে না। যখনই উড়াল দেবার চেষ্টা করে তখনই ডাল থেকে নিচে পড়ে যায়, চিৎকার চেচামেচি করে। এ্যান্থনি এ দৃশ্য দেখে ওকেও হাতের উপর তুলে নিয়ে অনুভব করে চোখের লোনা জল বের করে দেয়। বাদুড়টি ওর চোখের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, এ্যান্থনিও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দু’জনই দু’জনকে অনুবাদ করে নেয়। আর সেদিন থেকে ডানাভাঙা বাদুড়টি আর উড়াল দেবার চেষ্টা করে না। যখন সবাই উড়াল দিয়ে চলে যায় তখন সে এ্যান্থনির জন্য অপেক্ষা করে। অন্য বাদুড়গুলো এ্যান্থনির এই মমত্ববোধকে কুর্ণিশ করে। ওরাও কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকে। অন্তত ঐ বাদুড়টির সাথে সঙ্গ দেবার জন্য একজন বন্ধু পেলো। এভাবে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যে কেটে যায় এ্যান্থনির। ওরাও খুব মজা করে তার সাথে সময় কাটায়। 

কয়েকদিন ধরে এ্যান্থনি অশ্বত্থের নিচে আসেনা। যে যায়গাটিতে এ্যান্থনি পিঁপড়ে দলের সাথে দুষ্টুমি করতো সেখানে পিঁপড়েগুলো জড়ো হয়ে থাকে। ওরা এ্যান্থনিকে খুঁজতে থাকে। প্রত্যেকটি পিঁপড়া একে অপরের মুখোমুখি হয়, নিজেদের ভিতরে কথোপকথোন করতে থাকে। প্রতিদিনের সারিবদ্ধতা ভেঙে আজ ওরা সবাই জড়ো হয়ে রয়েছে। চামচিকাগুলোও খুব বেশি কিচিরমিচির শুরু করেছে। এ ডাল ও ডাল এ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কান্নাকাটি করছে। অশ্বত্থের ডালে ডালে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো নিঃশব্দে ঝুলে আছে। যেদিন থেকে এ্যান্থনি এখানে আসেনা সেদিন থেকে বাঁদুড়গুলোও উড়াল দিয়ে অন্য কোথাও যায়না। ডানাভাঙা বাদুড়টি গলা উঁচু করে হা-হুতাশ করছে। চিৎকার দিয়ে বাতাস ভারী করছে। যে পথ দিয়ে এ্যান্থনি এখানে আসে সে দিকে একটা মস্ত বড়ো অশ্বত্থের ডাল ঝুলে আছে। প্রতিদিন সব বাদুড়গুলো অই ডালে এসে ঝুলে থাকে। ঝুলে ঝুলে এ্যান্থনির আসার পথের দিকে চেয়ে থাকে।

এ্যান্থনি অসুস্থতাবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে অশ্বত্থের নিচে এগিয়ে আসে। অমনি চামচিকাগুলো তুমুল ওড়াওড়ি শুরু করে দিলো ওকে ঘিরে আর ডানাভাঙা বাদুড়টি এ্যান্থনিকে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। অন্যবাদুড়গুলো নেচে ওঠে, এ ডাল থেকে ও ডালে ঝুলে পড়ে। এ্যান্থনি ধীর পায়ে এসে অশ্বত্থের নিচে বসে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে চোখে শুধু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে অশ্বত্থের নিচে পড়ে থাকে। যেখানে এইমাত্র বাদুর আর চামচিকাদের কোলাহলে মুগ্ধ হয়ে ছিলো অশ্বত্থ গাছ জুড়ে। সেখানে চারিদিকে সুনশান নিরবতা নেমে আসে।
অমীমাংসিত তীরন্দাজ

সব মানুষকে মানুষ ভাবেনা তীরন্দাজ। মানুষের ভিতরে শ্রেণিগত পার্থক্যই সে সব সময় খুঁজে বেড়ায়। সে দাবি করে মানুষ পূর্বজন্ম থেকেই তার নিজের শ্রেণি নির্ধারণ করেই জন্ম লাভ করে। মানুষের ভাগ্য বংশপরম্পরায় একটি পরিকল্পিত ব্যাপার এবং একমাত্র মানুষই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে। প্রত্যেকে তার ভবিষ্যৎ অনুধাবন করতে পারে, তার মৃত্যুও সে টের পায়। এ নিয়ে তীরন্দাজের সাথে বিভিন্নজনের প্রায়ই হাতাহাতি হয়। তাদেরকে গাল দিয়ে চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে তারপর ঘরে ফেরে। এটাই তার প্রতিদিনের কাজ। মানুষজনও সুযোগ পেলে ওকে ক্ষেপিয়ে তোলে, ওকে ক্ষেপিয়ে অনেকেই মজা পায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সূর্যের উপর বিরক্ত হয়, ও সূর্যকে এই নিয়মতান্ত্রিকতাকে দাসত্বের সাথে তুলনা করে। প্রকৃতি কেন একটা চলমান নিয়মে আবদ্ধ থাকবে? আজ সে পূর্ব দিক থেকে উঠবে, কাল উত্তর দিক থেকে উঠবে পরশু পশ্চিম দিক থেকে উঠবে কিংবা কোনো কোনো দিন উঠবেই না।  
তীরন্দাজ যখন খেতে বসে তখনই দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। ভাতের সাথে তার ঝগড়া জ্ঞান হবার পর থেকেই। ভাবে মানুষ যদি ভাত না খেয়ে থাকতে পরতো তা হলে পৃথিবীতে সমস্যা বলে কোন শব্দ থাকতো না। শুধুমাত্র এই ভাতের জন্যে মানুষে মানুষে এতো বিভাজন, এতো উৎপাত। সংগত কারণেই ও কখনো ভাত মুখে দেয় না। ফল-মূল খেয়ে বেঁচে থাকে। কখনো কখনো অন্য প্রাণীর মতো ঘাস-লতা-পাতা খায়। তীরন্দাজ চিন্তা করে পৃথিবীর সব প্রাণীর একই রকমের খাদ্য থাকা উচিৎ এবং সে সেটাই মেনে চলে। তার এই বেঁচে থাকার কোনো নাম কেউ দেয়নি। অনেকেই মাঝে মাঝে উন্মাদ বলে ডাকে। এতে তার কোন আপত্তিও নেই, সায় দেয় না ওসব কথায়। 

মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলতে যতো আপত্তি তার। সবার কাছে বলে বেড়ায় পৃথিবীর সব প্রাণিই নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা বলে বিবেচনা করে। মানুষ সেসব প্রাণিরই অংশমাত্র। মানুষ শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিদীপ্ত হিংস্র প্রজাতির প্রাণি। সে যদি তার হিংস্রতা দিয়ে অন্য প্রাণিকে বধ না করতো, অন্যসব প্রাণিকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা না করতো তাহলে হয়তো সেসব প্রাণি নিজ নিজ সৃষ্টিতে মত্ত থাকতো। এই যে পাখি তার ডানা মেলে স্বাধীন ভাবে উড়তে থাকে, মানুষ সেটা পারেনা। ঈশ্বর মানুষকে সে ক্ষমতা দেয়নি বরং মানুষই নির্ভর হয়ে থেকেছে জড়বস্তুর উপর, আর পাখি নির্ভর করে তার ডানার উপর। মানুষ আর পাখিদের এই পার্থক্যে মানুষদের উপরে পাখিদের স্থান দেয় সে। আবার এই মানুষেরা প্রাণি হত্যা করে তার মাংসভোজী হয়। তো অই পশুর মেধা এবং অন্তশক্তি মানুষ তার ভিতরে নিয়ে নেয়। ফলে মানুষ উদ্ভাবণ করে নতুন কোন সৃষ্টির, এটা নিয়ে তার যতো বিরোধ। এভাবেই মানুষ পরনির্ভরশীল হয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে অযৌক্তিক দাবি করে। তীরন্দাজ ভাবে মানুষ যখন তৃণভোজী ছিলো তখনই সব প্রাণিদের মতোই একটি সাধারণ প্রাণি সে ছিলো, তারপর যখন প্রাণি হত্যা করা শিখলো তখন থেকেই সে ঐ প্রাণির মেধাটুকু ছিনিয়ে নিলো। কে জানে মানুষ যদি তার আদি অবস্থায় থাকতো তাহলে হয়তো অই প্রাণিকূলই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাদেরকে দাবী করতো। তারাও আবিষ্কার করতো ক্রমিক সভ্যতার। অই প্রাণিকূলই হয়তো নিজেদের ভাবনায় ঈশ্বরকে সৃষ্টি করতো, পবিত্র গ্রন্থগুলো তারাই সৃষ্টি করতো। বিভিন্ন প্রাণি-প্রজাতির উপর বিভিন্ন ওহী নাযিল হতো। যেটা মানুষ পেয়েছে এবং করেছে। তীরন্দাজ এসব কে মানুষের হিংস্রতার ফসল বৈ অন্যকিছু ভাবে না। 

সকালে ফল-মূল খেয়ে তীরন্দাজ বাজারের দিকে বেরিয়ে যায়। সে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তায় বছর খানেক আগে পিচ ঢেলেছে সরকার। কিন্তু জায়গায় জায়গায় পিচ উঠে বড়ো বড়ো গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ দেখে চিৎকার-চেচামেচি করে মানুষজন জড়ো করে তীরন্দাজ। সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘এই যে আমরা গরু ছাগল পুষি, হাঁস মুরগী পুষি ওদের হাঁটার জন্যে পিচঢালা পথের প্রয়োজন হয় না। এই পাকারাস্তার জন্য ওদের কোন শোকতাপ নেই। যে কোন পথই ওদের কাছে পথ। ওরাও দেখেশুনে চলতে পারে। নিজেদের চলার রাস্তা ওরা কখনো নষ্ট করেনা। আর দ্যাখ এই মানুষের দল নিজেরা চলবে যে পথে সে পথেও ধান্দাবাজী করে। লুটপাট করে। মানুষ আর প্রাণীর মধ্যেও পার্থক্য এখানে। মানুষেরা লুটপাট করে আর পশুরা সেটা করেনা। এই পশুরাই সৃষ্টির সেরা জীব। ওদেরকে যদি মানুষ সভ্যতা সৃষ্টি করার সুযোগ দিতো তাহলে ওরা এতো দুর্নিতীবাজ হয়তো হতোনা।’ তীরন্দাজের এই ভাষণ শুনে গ্রামের লোকেরা মুখটিপে হাসে। বিভিন্ন কথা বলে উস্কানী দেয়। কেউ কেউ ওকে হুনুমানের বংশধর বলে গালিও দেয়। এসব কথা শুনে তীরন্দাজ আরো চেচামেচি করতে থাকে। উপস্থিত সবার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে। পিছন থেকে অন্যেরা আলোচনা করে বলতে থাকে তীরন্দাজ নিশ্চয়ই মানুষ না, ভুলক্রমে আল্লা-ভগবান মানুষ বানিয়ে ওকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।  

বাজারে চায়ের দোকানে বসে মানুষদের চা খাওয়া খুব মনোযোগ দিয়ে দ্যাখে, হাসে। এ দেখে চা খেকো মানুষেরা বিরক্ত হয়। ওকে চলে যেতে বলে। চায়ের দোকানীও ওকে গালমন্দ করে। তাতে তীরন্দাজের কিছু যায় আসে না। তীরন্দাজ ভাবে যে মানুষগুলো এভাবে চুকচুক করে চা খায় এগুলো তারা পশুদের কাছ থেকে নকল করে শিখেছে। পশুরা এভাবেই জলপান করে। আর চুকচুক করে শব্দ করে। বাজারের একপাশে সার্কাস থেকে বিতাড়িত জোকারদের খেলা দেখার জন্য লোকজন জড়ো হয়ে বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে। লোকেরা জোকারদের খেলা দেখে মজাও পাচ্ছে। তাদের এই মজা পাওয়ার দৃশ্যগুলো তীরন্দাজ উপলব্ধি করে। পশুদের বিভিন্ন আচরণ নকল করে খেলা দেখাচ্ছে অবিকল মানুষের সেই আদিরূপ। এ দেখে তীরন্দাজও ফিরে যায় মানুষের আদিরূপে, মিল খুঁজতে থাকে মানুষ ও অন্যপ্রাণীর সাদৃশ্যগত বৈশিষ্ট্য। সার্কাস দল থেকে বিতাড়িত দলের ভিতরে একটা বানর ও আছে। সার্কাস বালকটি যা যা করছে বানরটিও সেটা নকল করছে। বালকটি যখন মাটিতে গড়াগড়ি খায় বানরটিও গড়াগড়ি খায়। বানর ও মানুষের আচরণ ঠিক একই রকম। তীরন্দাজ ভাবে মানুষই তাদের সব কিছূ পশুদের কাছ থেকে শিখেছে এটা চিরন্তন সত্য। যা মানুষ অস্বীকার করে। 

মানুষের ভাষা নিয়ে একটা নতুন চিন্তা ঢুকেছে তীরন্দাজের ভিতরে। মানুষ ভাষা পেলো কোথায়? এটা কার কাছ থেকে নকল করেছে। তীরন্দাজ বাজার থেকে একটু রাত করেই বাড়ি ফেরে। জোছনা রাতে একাকী বাড়ি ফিরছে। রাস্তার পাশে খোলা মাঠ, মাঠের মাঝখানে প্রাচীন একটা বট গাছ। গ্রামের লোকেরা এটাকে বড়োবটতলা বলে চেনে। ঠিক অই বটতলা থেকে একটা কালো রঙের কুকুর ছুটে এসে রাস্তায় তীরন্দাজের পথ আগলে দাঁড়ায়। কি যেন বলতে চাইছে। কিছুটা ভয়ও পেয়ে যায় সে। কিন্তু কুকুরের ভাষা সে বোঝে না। তীরন্দাজ ভাবে এই মানুষেরা কুকুর হত্যা করে প্রথমেই মাংসভোজী প্রাণী হয়। হতে পারে এটা তার ভাবনার একটা অংশ। তীরন্দাজের গা ঘেঁষে কুকুরটি দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে গোঙায়। তীরন্দাজ কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। তাপরপর যখন কুকুরটি জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে তখন প্রকৃত সমস্যা বুঝতে পারে। কুকুরটির দিকে ও ভালোভাবে খেয়াল করে। একটা আঘাতের চিহ্ন কুকুরের পিঠের ঠিক মাঝখানে দেখতে পায়। তীরন্দাজ কুকুরটিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। ওর ক্ষতস্থানে বিভিন্ন লাতাপাতার রস দিয়ে ব্যাথা দূর কের দেয়। 

কুকুরের সাথে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। কুকুরকে যা করতে বলে তা করে। তখন তীরন্দাজ বুঝে নেয় মানুষের ভাষা সে বোঝে। বোঝার চেষ্টা করে। মানুষ সেটা বোঝার চেষ্টা করেনা। হয়তো কোনদিন সব প্রাণীদের ভাষা বুঝতো আর প্রাণীরাও মানুষের ভাষা বুঝতো। মানুষ যখন সভ্যতার খাতায় নাম লিখিয়েছে, তখন তাদের সভ্যতার খাতিরে অসভ্য প্রাণিদেরকে সবক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করেছে। অবহেলা, অনাদর এবং অস্বীকার করেছে। মানুষের ভাষার যে ভিন্নরূপ তা মানুষের দ্বন্দ ও দূরত্বের কারণেই হয়েছে। কিন্তু প্রাণীদের ভাষার রূপ একই। তীরন্দাজ ঘরে ফিরে ঘুমোতে যায়। কুকুরটিও দরোজার সামনে গুটিমেরে ঘুমিয়ে থাকে।

ロ শাফি সমুদ্র



Pages