আমি তার আগে কখনও ক্ষুধাকে এতটা বাস্তব কোনো প্রাণীর মতো কল্পনা করিনি। একধরনের ছায়াজাত বাঘের মতো। যার চোখ দুটি অনন্ত অপেক্ষার আঁধারে ক্লান্ত হয়ে ওঠে। আমি তখন পাহাড়ের গায়ে তৈরি এক পোড়োবাড়ির ধ্বংসস্তূপে বসে আছি। আর একজন আছে , যে কিনা দরবেশ, নামহীন ও নির্বিকার। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনের খাজে খাজে ধ্যান নামায়। আরও একজন দস্যু আছে। ডাকাত দলের সরদার। আলগা দাঁতের মধ্যে সুপ্ত রক্তস্বাদ নিয়ে চোখ রাখে আমার রুটির ঝোলায়।
তারা জানে না, আমি একজন উপাসক। না ঈশ্বরের, না আলোর, না সত্যের। আমি উপাসনা করি তার, যার নাম অনুচ্চারিত। যার প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিষ আর প্রতিটি চিন্তায় প্রশ্ন। আমি শয়তানের উপাসক। এই বলে আমি একবার দরবেশের দিকে তাকাই। সে তখনও যেন ধ্যানাবিষ্ট। মুখে কথার রেখা নেই, শুধু শরীরজুড়ে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যেন সে ক্ষুধাকেও আলিঙ্গন করে নিয়ে তার আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ করেছে।
দস্যু গড়গড় করে ওঠে— ‘এই দুনিয়ায় ধ্যান দিয়ে পেট ভরে না।’ আমি কিছুই বলি না, শুধু মনোরম এক বৃত্ত এঁকে দিই বালির ওপর। ভেতরে তিনটি বিন্দু রাখি। একটা আমি, একটা সে, একটা তারা। তারপর বৃত্তের চারপাশে আঁকি ছায়া, দুঃস্বপ্ন এবং নক্ষত্রহীন রাতের রেখা। দরবেশ বলে— ‘এই ছায়াগুলো কি আমাদের অন্তঃসার?’ আমি বলি— ‘ছায়া আসলে আত্মার ক্ষুধা। পেটের নয়।’
সন্ধ্যার পর পাহাড় কেমন নিঃশব্দ কাঁপে। বাতাসে দুঃস্বপ্নের মতো সাঁ সাঁ শব্দ বাজে। সেই শব্দে আমার মনে হয় কেউ যেন আমার মগজের ভেতর ঢুকে যেতে চাইছে। তখনই আমি তাদের মাঝে ফেলে দিই সেই প্রশ্ন, যেটি আত্মা আর দেহের মাঝখানে কাঁটাতার টেনে দেয়—‘তোমরা কি জানো, তোমাদের ক্ষুধা কী শুধু শরীরের ক্ষুধা নাকি আত্মারও ক্ষুধা জেগে উঠেছে?’ দস্যু বলে, ‘আমার ক্ষুধা শুধু শরীরের। রক্ত, মাংস, রুটি এই নিয়ে আমি। আত্মার কোনো খেলা আমি বুঝি না।’ দরবেশ চুপ। তার চোখে তখনও গভীর ঘোর।
আমি হাসি। সেই হাসি শীতলতার নয়, উত্তপ্ত নয়, শুধু ফাঁকা। আমি জানি, এই ফাঁকা হাসিই তাদেও ভয়ঙ্কর অস্থির করে তুলবে। আমি বলি— ‘যদি আমি বলি, এই ক্ষুধা তোমাদের তৈরি করে দিচ্ছি আমি, তাহলে?’ তারা চমকে ওঠে না, কারণ সত্য কখনও হঠাৎ করে চমকায় না। সত্য একধরনের নিঃশব্দ আগুন, যা ধীরে ধীরে দগ্ধ করে।
রাত বাড়ে। আগুন জ্বলে। আমরা তিনজন বসে আছি চারদিকে শূন্যতা নিয়ে। তার মধ্যেই আমি তাদের দেখতে থাকি গভীর মনোযোগে। দেখার অর্থ এখানে শারীরিক নয়। আমি তাদের চেতনার ভেতর অবলীলায় ঢুকে পড়ি। তাদের জিজ্ঞাসাকে আরো উস্কে দিই, তাদের বিশ্বাসের ফাটলে করাত চালাই। দস্যু তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তার মুখ কুঁচকে আছে। সে ক্ষুধার স্বপ্ন দেখে—মাংসের, যুদ্ধের, ভোগের আর দরবেশ তখনও ধ্যানমগ্ন।
আমার মনে পড়ে একবার আমি এক পিশাচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ধ্যান আর দেহের সম্পর্ক কী? সে বলেছিল— ‘যে ধ্যান শরীরকে অস্বীকার করে, সে নিজেকেই মিথ্যে বানায়। আর যে ধ্যান শরীরকে অতিক্রম করে, সে হয়ে ওঠে অভিশপ্ত।’ তখনই আমি দরবেশের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলি— ‘তুমি কি সত্যি ক্ষুধার ঊর্ধ্বে? নাকি নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছো উপবাস দিয়ে?’
দরবেশ কিছুই না বলে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে। আমি তার সেই চোখে দেখি এক আগুনের বিচ্ছুরণ।
পরদিন সকালে আমি দু’জনকেই আলাদা করে ডাকি। প্রথমে দস্যুকে বললাম— ‘তুমি যদি দরবেশকে খাওয়াও, তবে সে তোমার প্রভু হয়ে যাবে।’ তার চোখ লাল হয়ে ওঠে— ‘আমি কাউকে খাওয়াই না। আমি কাড়ি। লুট করি।’ তারপর দরবেশকে বলি—‘তুমি যদি দস্যুকে ক্ষমা করো, তবে সে তোমার পথিক হবে।’ সে বলে—‘ক্ষমা করার মধ্যে কোনো আত্মতৃপ্তি নেই। আমি শুধু দেখি।’ তখন আমি বলি— ‘তুমি শুধু দেখো অথচ সে তো তাড়া করে বেড়ায় নিজের ছায়াকেও। তাহলে কার ক্ষুধা প্রকৃত?’ এই কথায় দরবেশ প্রথমবার কাঁপে।
রাতের একদম মধ্যভাগে, যখন ঘাস আর পাথর থেকে ওঠে একধরনের তপ্ত ধোঁয়া। অদ্ভুত গন্ধ—মিশ্রণ একধরনের আধপোড়া শূন্যতা আর বিবর্ণ বেঁচে থাকার মতো একপ্রকার গড়াগড়ি। তখন আমার ঘুম আসে না। আসবেই-বা কীভাবে? এই পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা পোড়োবাড়ির ছায়ার মধ্যে কোথাও এক অদৃশ্য চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয় এবং আমি শুনতে পাই মনের ভেতরের এক দরজা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কোনও অচেনা বাতাসের ধাক্কায়।
আমার ঘুম আসে না কোনওদিন। কারণ আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। স্বপ্ন নয়, আমি চাই জেগে থাকার ভেতরে জেগে থাকা কিংবা ঘুমের ভেতরে ঘুমিয়ে যাওয়া। সেইসব ঘোরলাগা সময়েই আমি তাদের ভাবি আমার দুইজন সঙ্গী। তারা যেন চিন্তার গভীরে জন্মানো পরীক্ষার ফলাফল। এক দেহে প্রবৃত্তি আরেক দেহে আত্মদাহ। আমাদের আশেপাশে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যেন সময়ও দম ধরে আছে। দূর পাহাড়ের গায়ে আঁকা রাত্রির অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে, যেন আকাশ নিজেই এক ছায়াজাত জন্তু। যার পেটের নিচে আমরা তিনটি বিন্দু কাঁপতে কাঁপতে অবস্থান করছি।
এই নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎই দরবেশ উঠে পড়ে। সে সোজা হাঁটতে শুরু করে পাহাড়ের গা বেয়ে। যেন কারও ডাকে সাড়া দিচ্ছে, অশরীরি কোনও কণ্ঠস্বর। তার চলনে নেই কোনও তাড়াহুড়া কিন্তু প্রতিটি পা যেন অদৃশ্য এক ভার টানছে। আমি তাকে অনুসরণ করি ছায়ার মতো, সুনিপুণ, শব্দহীন। তার পায়ের ছাপ ধুলোর ওপর পড়ে যায় আর আমি সেগুলো মুছে দিই নিজের উপস্থিতি দিয়ে। দরবেশ থামে এক পুরোনো ঝর্ণার পাশে। সেই ঝর্ণা এখন আর জলে বয় না। তার বুক ফেটে আছে গভীর এক জঠরের মতো নিঃশ্বাসহীন, নিঃসরণহীন। চারপাশের পাথরগুলোতেও যেন তাপ আছে। দিনভর সূর্যের কামড়ে জড়সড় হয়ে থাকা তারা এখনও ছেড়ে যাচ্ছে জ্বালা।
দরবেশ বসে পড়ে। তার শিরায় তখন আলো নয়, দীর্ঘ এক অন্তঃসারহীনতা সঞ্চারিত হচ্ছে। মুখে তার মন্ত্র নয়, নিঃশব্দে ওঠা এক দীর্ঘশ্বাস। যা বাতাসে মিশে গিয়ে গাছের পাতাকে নুয়ে দেয়। ‘তুমি কি জানো, এই ঝর্ণার পানি এক সময় গান হয়ে শোনা যেতো?’ আমি বলি পেছনে দাঁড়িয়ে। কণ্ঠে যেন পাথর গড়ানোর শব্দ। দরবেশ তাকায় না। তার চোখ আটকে আছে ফেটে যাওয়া শূন্যতায়। সে বলে— ‘জীবনের মতো, কিছু কিছু জিনিসের শব্দ হারিয়ে যায়। শুধু কাঠামো থাকে, আত্মা চলে যায়।’
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। তার পাশে বসি না, শুধু তার ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়ি আর বলতে থাকি— ‘তোমার আত্মাও কি ত্যাগ করেছে তোমাকে?’ সে চমকে ওঠে না। তার চোখে কিছু নেই, কোনও স্ফুলিঙ্গ না, কোনও নিঃশ্বাসের গতি না। যেন সেই মুহূর্তে সে নিজেকে ভেতর থেকে মুছে ফেলেছে। আমি আরও নিচু হয়ে তার কানের কাছে ফিসফিসাই— ‘তোমার উপবাস কি ঈশ্বরের জন্য, না নিজের অহংকারের জন্য? তুমি সত্যিই ক্ষুধাকে পরাজিত করেছো, না কেবল তাকে ভয় পেয়ে লুকিয়ে রেখেছো আধ্যাত্মিকতার কাপড়ের নিচে?’
দরবেশ এবার মুখ তোলে। তার চোখে নেই ক্রোধ, নেই বিস্ময়। আছে একধরনের লজ্জা, ক্লান্তি আর দীর্ঘতর যন্ত্রণার ছায়া। যেন প্রশ্নটি তার পূর্বপুরুষদের ঘুম ভেঙে দিয়েছে। সে কাঁপা গলায় বলে, ‘আমি জানি না, শুধু জানি, ক্ষুধা মানুষের ঈমানের সবচেয়ে গোপনীয়তম কুঠুরি। তুমি যদি সেখানে আলো জ্বালো, পবিত্রতা আর পশুত্বকে আলাদা করা যায় না।’
সকালে দস্যু উঠে দাঁড়ায়। তার গায়ে এখনো ঘুমের ধুলো লেগে আছে, চুলগুলো এলোমেলো এবং চোখে সেই অপরাধী স্বপ্নের আবিষ্ট। আমাকে দেখে সে হেসে ওঠে, ঠোঁটের কোণে ক্ষুধার মতোই তীক্ষ্ণতা। আমাকে বলে—‘তোর চোখ লাল। কি করছিলি রাতে?’ আমি ঠান্ডা কণ্ঠে বলি— ‘পাপের নতুন ভাষা আবিষ্কার করছিলাম।’
সে হাসে। সেই হাসি গভীর নয়, কিন্তু নিচে স্তরে স্তরে জমে আছে সন্দেহ। তার শরীর যেন ছিন্নভিন্ন কামনার ছাপে আঁকা এক চিত্র। যেখানে প্রশ্নগুলো খোদাই করা থাকে খুনে ছুরির ডগায়।
সে আমার দিকে এগিয়ে আসে, অন্ধকারকে ঠেলে বলে—‘শোন, ওই দরবেশটারে আমি বিশ্বাস করি না। সে না খেয়ে থেকে কেবল দেখায়। সে পবিত্র। অথচ রোজ রাতে তার চোখে আমি কামনা দেখি। খাবারের, মুক্তির, এমনকি হয়তো রক্তের।’
আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘তুমি খুব কাছ থেকে দেখো ওকে। সে নিজেকেই এত কষ্ট দেয় যেন সেই কষ্টই তার ঈশ্বর হয়ে ওঠে। বুঝতে পারো?’ দস্যুর চোখ ঝলকে ওঠে। আগুনের লেলিহান একটি রেখা যেন ওর মগজের গায়ে আঁচড় কেটে যায়।
—‘আমি যদি ওকে খাইয়ে দিই একদিন? যদি ওর মুখে নিজ হাতে ভাত তুলে দিই? তাহলে কি ওর ঈশ্বর ভেঙে যাবে?’
আমি বলি, —‘ না, ওর ঈশ্বরের মুখ খুলে যাবে আর সে দেখবে যে ঈশ্বরের জিভেও ক্ষুধা আছে।’
সেই রাতে আমি তাদের দুইজনকে আগুনের তিনদিকে বসাই। আগুনের আলো মৃদু এবং অনিশ্চিত। প্রতিটি শিখা যেন দ্বিধাগ্রস্ত। আলো আর ছায়া এমনভাবে মিশে থাকে যেন একে অপরের ভেতর জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি চেয়ে থাকি তাদের দিকে। একজন দেহের মধ্যে ঈশ্বর খোঁজে, আরেকজন ঈশ্বরের ভেতর দেহ খোঁজে। আমি বলি— ‘তোমরা জানো, আগুন কিভাবে নাচে? যখন তাকে ঠিক পরিমাণ কাঠ দেওয়া হয়। কম দিলে সে কাঁপে, বেশি দিলে সে পুড়ে যায়। মানুষের বিশ্বাসও তাই। তাকে না খাইয়ে রাখলে সে মরুভূমি হয় আর অতিরিক্ত খাইয়ে দিলে সে ফ্যানাটিক হয়ে ওঠে। আর আমি? আমি শুধু কাঠ সরবরাহ করি।’ দস্যু তখন হেসে বলে— ‘তুই কথা দিয়ে আগুন জ্বালাস।’ দরবেশ মৃদু গলায় বলে— ‘সব আগুন আলো দেয় না। কিছু শুধু পোড়ায়।’ আমি দুজনের দিকে চেয়ে থাকি। একটা নিরব সময় পড়ে থাকে, যেন রাত নিজেই আমাদের কথার ভারে জমে উঠেছে। আমি দরবেশকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি যদি আজ না খেতে পেতে মরতে, তাহলে কী ঈশ্বর তোমাকে কিছু দিতেন?’ সে কিছু বলে না। কেবল মুখ নিচু করে আগুনের দিকে চেয়ে থাকে, যেন সেই শিখার ভেতর কোনো উত্তর লুকানো আছে।
দস্যু বলে— ‘ঈশ্বর খিদে মেটান না। তিনি শেখান খিদে কীভাবে সহ্য করতে হয়।’
‘তবে ঈশ্বর কি কসাই নাকি?’— আমি হঠাৎই গলা চড়িয়ে বলি। কথাটি যেন আকাশ কাঁপিয়ে দেয়, ছায়াগুলো থমকে যায়। এই প্রশ্নে দরবেশ কেঁপে ওঠে। তার চোখে ভয়ের, ক্ষোভের, হয়তো আত্মসংশয়ের এক গাঢ় ছায়া ভেসে ওঠে। দস্যু ফিসফিস করে বলে—‘তুই তো শয়তানের মতো কথা বলিস’ আমি মাথা ঝাঁকাই, শুষ্ক হাসি ঠোঁটে নামিয়ে বলি— ‘আমি তো কখনই বলিনি আমি ঈশ্বরের মুখপাত্র। আমি শুধু কানের পেছনে ফিসফিস করি। তোমাদের যেটা বলতে ভয় হয়, সেটা আমি মুখে আনি।’
সেই রাতেই দরবেশ উঠে পড়ে চুপচাপ। তার চোখে ক্লান্তি নয়, প্রতিজ্ঞা। তার পায়ের তলায় যেন ছায়া জমে আছে। চেনা পথকেও অচেনা করে ফেলে এমন এক আঁধার। সে আমার রুটির থলে থেকে এক টুকরো রুটি চুরি করে। তার আঙুল কাঁপে, নিঃশব্দে। যেন চুরি নয়, এই একটুকরো রুটি সে ঈশ্বরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর আমি দেখি, সব দেখি। ইচ্ছা করেই কিছু বলি না। আমি দর্শক নাকি প্ররোচক সে সিদ্ধান্ত তার।
সে রুটি নিয়ে বসে ঝর্ণার ধারে। মুখে তুলতে গিয়েও থেমে যায়। তার ঠোঁট কাঁপে। চোখ ভিজে ওঠে। সে কাঁদে। চুপচাপ। কাঁদে, যেন আত্মার ফাটল দিয়ে জল পড়ছে। রুটি ফেলে দেয়। নিজের কপালে বাড়ি মারে সে বলে ফিসফিসিয়ে— ‘আমি ব্যর্থ, আমি বিশ্বাসঘাতক।’ আমি তার পাশে গিয়ে বসি না, শুধু কণ্ঠে নামিয়ে আনি করাতের মতো ঠাণ্ডা করুণা। বলি—‘না। তুমি এখনই প্রকৃত মানুষ হলে। ঈশ্বর নয়, মানুষ। ক্ষুধার কাছে মাথা নোয়ালে মানুষ হয়। আর শয়তান হয় সে, যে বলে তুমি পবিত্র হয়ে গেছো।’ সে তাকায় আমার চোখে। সেই দৃষ্টিতে প্রশ্নের চেয়ে উত্তর কম। সে বলে
—‘তুমি কি সত্যিই মানুষ?’ আমি হেসে উঠি। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে প্রতিধ্বনি বাজে। আগুন কেঁপে ওঠে।
—‘না। আমি তুমিই, যে প্রশ্ন করে। আমি সেই কণ্ঠ, যে বলে তুই ঈশ্বর না, তুই ক্ষুধা।’
জঙ্গলের প্রান্তঘেঁষে ভাঙা আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকে দস্যু। চোখে তার সেই শিকারির তৃষ্ণা, যা শুধু খাদ্যের জন্য নয়। যা শরীর চায়, জমি চায়, প্রতিশোধ চায়, স্বস্তির নামে এক পঙ্কিল প্রশান্তি চায়। পেছনে ভাঙাচোরা রোদের মতো পুড়ে যাচ্ছে দিনের শেষ আলো আর সামনে কুয়াশার মতো গাঢ় হয়ে উঠছে দস্যুর ভেতরকার ছায়া। তার চোখের নিচে ধূসর দাগ, যেন দীর্ঘ ক্ষুধার ছাপ। কপালের রেখায় জমে আছে সহিংস অতীতের অনুলিপি। ঠোঁটের কোণে জমে থাকা এক বিকৃত আকাঙ্ক্ষা। যা ভাষা চায় না, যা শরীর চায়, দেহের নয়, পৃথিবীর।
সে তার দীর্ঘ ছায়ার ওপর থুথু ফেলে, তারপর হাঁটা শুরু করে। প্রতিটি পা যেন চাপ ফেলে শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে। তার গতিতে কোনও লক্ষ্য নেই, কেবল এক প্রবাহ। যা লুটে নিতে চায় যা পায় আর পায় না বলে খুঁজতে বের হয় আরও গভীর গুহা, আরও দুর্বল শিকার।
তার ক্ষুধা শুধু অন্ত্রের নয়। সে ক্ষুধার্ত শরীরের, শ্রেষ্ঠত্বের, আধিপত্যের, কামনার। কামনা, যা কখনোই নির্দিষ্ট নয়। ছায়ার মতো পেছনে হাঁটে আর যখন ছায়াহীন আলো নামে, তখন দস্যুর চোখ ছলকে ওঠে অন্ধ বিস্ময়ে। পথে পথে সে দেখে ছিন্নমূল গাছ, গর্তের ভেতর কাঁপতে থাকা খরগোশ, মাটিতে পচে যাওয়া ফল। সে একটাও নেয় না। আজ তার ক্ষুধা ‘মাংসের’ না ‘ক্ষমতার’। সে চায় এমন কিছু, যা ফাটিয়ে ফেলবে ভেতরের আরাধ্য অভাব।
সে এক জায়গায় দাঁড়ায়। নিচু পাহাড়ের গায়ে আগাছার ছায়া। গা ছমছমে। পাথরের গায়ে হাত বুলিয়ে অনুভব করে স্তুপ হয়ে ওঠা লোভ, যা সময়ের আবরণে জমে আছে। হঠাৎ সে পেছনে তাকায়, যেন তার ঘাড়ে কারও নিঃশ্বাস পড়ছে । কেবল নিস্তব্ধতা এবং সেই নিস্তব্ধতার নিচে আমি।
দস্যু ফিরে আসে আগুনের পাশে। তার হাতে আজ কিছু নেই। চোখে অবসন্নতা নয়—রক্তচাপা উন্মত্ততা। চোখে যেমন আলো থাকে, তেমনই থাকে আগুন, সেই আগুনে নিজেই নিজেকে পোড়ায়। সে বসে, পিঠ সোজা করে না, যেন চাপে ভেঙে পড়েছে অদৃশ্য কিছু। আমি তাকে চুপচাপ দেখি। আমি তার ভেতরে যেন আগুন জ্বালিয়ে রেখেছি, সে এখন ধ্বংস চায়, কিংবা তৃপ্তি। কিন্তু এই তৃপ্তির সংজ্ঞা নেই, মানচিত্র নেই। কেবল অদৃশ্য ক্ষুধার একটা চেহারা, যা ভাঙা দর্পণের মতো তার ভেতরে প্রতিফলিত হয়।
হঠাৎ সে দরবেশের দিকে তাকায়। চোখে তার সেই স্নায়ুবিক পিপাসা। যা জিজ্ঞাসা করতে চায়, আবার অপমান করতেও চায়। ঠোঁটে না, চোখের কোণে পঁচা ঘৃণা। তার প্রশ্ন আসে কর্কশ, চূড়ান্ত এক ধ্বংসের ভাষায়—‘তোর ঈশ্বর কি তোকে এক মুঠো চালও দেয় না?’ আমি জানি, এই প্রশ্ন কোনো প্রশ্ন নয়। এটা একটা ছুঁড়ে মারা অস্ত্র, যার ফলার ভেতর জমে আছে নিজের অপূর্ণতা।
দরবেশ তাকিয়ে থাকে না। তার দৃষ্টি আকাশে, শূন্যে। যেন কিছু শুনেও শোনেনি বা শুনে নিজেকে থামিয়ে রেখেছে, অস্থিরতা ঢেকে রেখেছে বিশ্বাসের জোব্বায়। তার নিঃশব্দতা যেন উত্তর নয় তা এক ধরনের প্রতিরোধও বটে। আমি তখন দস্যুর কানে কানে বলি— ‘দেখিস, একদিন তুইও উপবাসীর মাটিতে মুখ ঠেকাবি, কেবল ক্ষমা চাওয়ার জন্য নয়, ভাত চাওয়ার জন্য।’ দস্যু সজোরে আমার দিকে ঘুরে তাকায়। তার চোখে ধিক্কার নেই। আতঙ্ক, যা কেউ নিজেকে খুব কাছ থেকে দেখে ফেলে। সে যেন বোঝে, আমি যা বলেছি, তা সে ভাবতেও চায়নি। তার গলায় এক শুষ্কতা, যেন তৃষ্ণা নয় তা যেনো দগ্ধ আত্মার ভাঙন।
রাত গভীর হলে দস্যু একা বসে। আগুন নিভে গেছে। চারপাশে ছায়া জমেছে জমাট অন্ধকারে। সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, যেখানে কোনো তারা নেই, কেবল ছায়া। সে চায় পাঁজরে হাত দিয়ে নিজেকে খুলে ফেলতে। সে চায়, নিজেকে দেখতে, যেভাবে আমি তাকে দেখি। তার সামনে এক পঁচে যাওয়া গাছের ডালে ভাঙা ফল ঝুলছে। সে হাতে নেয় ফলটি। দেখে, ভেতরে পোকা। তবুও সে কামড়ে কামড়ে খায়। যেন অভ্যন্তরের জ্বালা শুধু পচনেই শান্ত হয়। যেন পচনের মাঝেই জীবনের স্বাদ আর জীবনের মানে শুধুই পচন। আমি অন্ধকারে তাকে দেখি। নীরবে। আমি তার হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি— ‘তুই ক্ষুধার বাইরে যাইতে পারিস না। কারণ তুই নিজেই একটা ক্ষুধা, যার শরীর আছে, দাঁত আছে, ইতিহাস আছে।’ এই কথার শব্দ তার স্বপ্নে গুঁড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে সে দরবেশের পাশে গিয়ে বসে। দরবেশ তখন চোখ বন্ধ করে জপছে, ঠোঁটের নিচে নিঃশব্দে। সকালের আলো দরবেশের মুখে পড়ে যেন এক মায়াময় দাগ। তখন সে অন্ধকারেও আলো খোঁজে না, অন্ধকারকেই আলোকিত করে।
দস্যু চেয়ে থাকে। মুখ খুলে কিছু বলে, কিন্তু শব্দ বের হয় না। তার মনে হয়, উচ্চারণ করলেই সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সে চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ, ঠিক যেন প্রাণহীন কাঠামো। তার শরীরের ভেতরে তখনো চলমান ক্ষুধার ঢেউ। যা ভেঙে ফেলতে চায় শান্তি নামের প্রতিটি তটরেখা। দরবেশের স্থিরতা তাকে আক্রমণ করে, প্রলুব্ধ করে, আবার বিদ্ধ করে। যেন এক আয়না, যেখানে সে নিজের অভাব দেখে উল্টোভাবে।
রাতের মধ্যে আমি দস্যুর ঘুমন্ত মুখের ওপর দাঁড়াই। তার স্বপ্নে প্রবেশ করি, তার গভীরতম গুহায়। সেখানে আমি দেখি— সে শিশুকাল থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এক ক্ষুধার হাত থেকে, যা মায়ের মতোই চেনা, আবার কসাইয়ের মতোই নির্দয়। তার ভেতরকার বালকের চোখে ভয়। ভয় নয়, ক্ষুধা। সে খুঁজে বেড়ায় এমন কিছু, যা তাকে পূর্ণ করবে। কিন্তু যেটা পায়, তা কেবল ফাঁপা। ফাঁকা কলসির মতো বাজে, টিনের মতো কাঁপে।
স্বপ্নে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি—‘তুই কি তোর মাকে খেয়েছিলি একদিন?’ সে চমকে ওঠে। কাঁদে না, কাঁপে। আমি জেগে উঠে তাকে দেখি—ঘুমের ভেতর ঠোঁট নড়ে। সে বলছে— ‘ক্ষমা করে দিস, মা...’ তখন আমি জানি—এই দস্যুর ভেতরে যে চোরাবালি, আমি তাতে নিজের ছায়া ফেলে দিয়েছি। সেখানে আর আলো ফিরবে না।
আমি যে কারো ছায়ার পেছনে হাঁটি না। আমি নিজেই এক ছায়া স্পর্শহীন অথচ প্রবেশকামী। আমি জানি, আলো কোথায় জন্মায় আর তার বিপরীতে ছায়া কোথায় ফাটে। আমি সেই ফাটলের ভেতর বাস করি। দরবেশ ও দস্যু এদের জন্য আমি একজন আগন্তুক মাত্র। এক বেদনার ভাষ্যকার। কিন্তু বাস্তবে আমি তাদের প্রত্যেকের অন্তঃস্থলে কাটা একটি শব্দ। এমন এক শব্দ, যা উচ্চারিত হলে মন ভেঙে পড়ে এবং চুপ থাকলে মন ধ্বংস হয়।
আমি উপাসনা করি প্রবৃত্তির। পাপ আমার কাছে ধর্ম এবং লোভ আমার কাছে একটি সাধনা। আমার উপাসনা শয়তানের প্রতি নয় বরং শয়তান হওয়ার সম্ভাবনার প্রতি। আমি তার সীমানায় নই, আমি তার মধ্যেই বসবাস করি। কেউ যখন নিজেকে বাঁচায়, আমি তখন প্রশ্ন করি— ‘কিসের জন্য বাঁচা?’ কেউ যখন নিজেকে পবিত্র ভাবে, আমি তার পেটের কান্নাশব্দ শুনি। ক্ষুধারত অন্ত্র সব সত্যের গর্ভধারিণী।
আমি জানি, শরীর কেবল মাংস নয়। শরীর এক অভ্যন্তরীণ ভাষা, যাকে চুপ করিয়ে রাখলে সে স্বপ্নে ফেটে পড়ে। দরবেশের দেহ নিস্তব্ধ, দস্যুর শরীর অস্থির। কিন্তু তারা উভয়েই এক নির্দিষ্ট বিকারের যাত্রী। আমি তাদের এই বিকারকে অনুবাদ করি শব্দে, ঘ্রাণে, চামড়ার নিচে স্নায়ুর ছমছমে কাঁপন দিয়ে। ‘ক্ষুধা কোনো দোষ নয়। দোষ হলো নিজেকে ভুল বোঝানো যে তুমি পরম পবিত্র অথচ তোর পাকস্থলি ছুটছে খাবারের গন্ধে।’ এই বাক্য আমি উচ্চারণ করি না। আমি নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিই। আমি জানি শব্দ যদি নীরব হয়, তার তীব্রতা দ্বিগুণ হয়। যে কথাটি কেউ শোনে না, সেটাই গভীরে গেঁথে যায়। আমি জানি, এইসব পঙ্ক্তিরা কাঁটার মতো তাদের মস্তিষ্কে বসে, রক্তাক্ত করে না, তবে চুলকায়। তারা তৃষ্ণার মতো চুলকায়। মেটাতে গেলে পাপ লাগে, না মেটালে পীড়া।
তাদের মাঝখানে আমি কেবল দর্শক নই, আমি দিকনির্দেশক। আমি কখনো আগুন বাড়িয়ে দিই, কখনো বাতাসের গতি বদলাই। তারা বুঝতে পারে না কে উস্কায়, কে শান্ত করে। আমি আমার উপস্থিতিকে এমনভাবে আড়াল করি, যেন তা এক অবচেতনের ছায়া। অথচ আমি তাদের প্রত্যেকের চিন্তার প্রথম এবং শেষ সীমানা।
দস্যু যখন দরবেশকে দেখে, তার ভেতরে জমে থাকা ঈর্ষা ও অসমাপ্ত প্রতিযোগিতা মাথা তোলে। দরবেশের নিশ্চলতা, তার নির্লোভ দৃষ্টি, তার দীর্ঘশ্বাসহীন স্থিতি সবই দস্যুর কাছে এক উত্ত্যক্ত আয়না। আমি সেই আয়নার উপর হাত রাখি। হালকা চাপ দিই, যেন ফাটল তৈরি হয়। যেন দস্যুর চোখে দরবেশ আর ধার্মিক নয়, একজন প্রতিদ্বন্দ্বী, এক অচল অবয়ব, যাকে ভাঙা দরকার।
আমি দস্যুর দৃষ্টির গভীরতা দেখি। প্রতিদিন সে দরবেশের দিকে তাকাই. কখনো সোজা চোখে, কখনো চুরি করে। সে ভাবে, সে ঈর্ষান্বিত নয়; কিন্তু আমি জানি, ঈর্ষা ঠিক ততটুকুই টের পাওয়া যায় যতটা তা অস্বীকার করা হয়। আমি তার মধ্যে একটি গল্প বুনে দিই, একটি কল্পিত পুরস্কারের বিবরণ। আর সে গল্প বিশ্বাস করতে শুরু করলে আমি তাকে আরো একটি কল্পিত ক্ষত দিই, যেন সেই পুরস্কার তাকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
আর দরবেশ, তার নীরবতা অনেকখানি হিমবাহের মতো। উপরে জমাট, নিচে প্রবাহিত। আমি সেই বরফের নিচে শব্দের ঢেউ পাঠাই। সে হঠাৎ করে জেগে উঠে চমকে দেখে দস্যুর চোখে আগুন। কিন্তু সে জানে না, এই আগুন আমি ধরিয়েছি। তার স্তুতি, তার উপবাস, তার অপেক্ষা। সব কিছু যেন এক নিঃস্ব মৌনতার কাছে ধরা দেয়। আমি তাকে একটি প্রশ্ন দিই— ‘তুই কেন এত দীর্ঘ সময় ধরে নীরব? কীসের ভয় তোর নীরবতার পেছনে লুকায়?’
আমি তাদের মনস্তত্ত্বেও ভেতরে ঢুকে পড়ি— খালি পায়ে, শব্দহীন। আমি তাদের স্মৃতির সিঁড়িতে উঠি। দস্যুর ভেতরে আমি তার মায়ের মুখ দেখি, যার দিকে তাকানো মানেই কান্না। দরবেশের ভেতরে দেখি এক পলক প্রেম, যা তাকে একদিন ঠিক পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল। এইসব স্মৃতি নিঃশেষ হয়নি। আমি কেবল চুলের ডগায় আঙুল রাখি, স্মৃতি জেগে ওঠে।
দস্যু একদিন বলে— ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, মা একবার বলেছিল, কুকুরও কখনো কখনো ঈশ্বরকে ডাকে। তবে কুকুর জানে সে কেন ডাকে।’ আমি তখন তার চিন্তায় ফিসফিস করি— ‘তুই এখন কুকুর নাকি ঈশ্বর?’ সেই প্রশ্ন সে বুঝে না, উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু সে কাঁপে। আমি সেই কাঁপুনির সঙ্গেই থাকি।
আমি দরবেশের ঘুমে ঢুকি। তার নৈঃশব্দ্যের ভেতর একটি শব্দ রাখি— একটি নাম, এক নারীর। সে ঘুমের মধ্যে হাসে এবং হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে। আমি তখন জানি, তার ঈশ্বর এখন আর নির্বিশেষ নয়। ঈশ্বর হয়ে উঠেছে এক নির্দিষ্ট মুখ, এক অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং আমি জানি, এই ঋণ তাকে একদিন বোবা করে দেবে।
রাতে, যখন তারা ঘুমায়, আমি তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের নিঃশ্বাস গুনি, যেন সুর বাজে। এক তালে, আবার ভিন্ন স্বরে। দস্যুর নিঃশ্বাস জ্বলন্ত, দরবেশের নিঃশ্বাস শীতল। আমি মাঝে বসে আছি, গলে যাওয়া চাঁদের নিচে। আমি তাদের দুই বিপরীত মেরুর মাঝে এক ছায়ামণ্ডল। আমি জানি, নক্ষত্রের আলো আসে বিস্ফোরণ থেকে, আমি সেই বিস্ফোরণ ঘটাতে এসেছি।
আমি তাদের ঘুমন্ত মুখে চোখ রাখি যেন এক দীর্ঘ অপেরা। দস্যুর চোখের পাতা কাঁপে, যেন যুদ্ধ দেখছে। দরবেশের চোখে শান্তি, কিন্তু ঠোঁটের কোণে খাঁজ। তারা ঘুমে কথা বলে, আমি তাদের স্বপ্ন অনুবাদ করি। আমি দেখি, দস্যু দৌঁড়ায় আগুনের ভেতর দিয়ে আর দরবেশ হাঁটে বালির ভেতর। উভয়েই বাঁচতে চায়, কিন্তু জানে না তারা কোথায় পৌঁছাতে চায়।
আমি দুই হাত বাড়িয়ে সেই স্বপ্নদুটি একে অপরের দিকে ঠেলে দিই। যেন একদিন তাদের স্বপ্নে মুখোমুখি হয় তারা এবং বাস্তব যখন জেগে উঠবে, তাদের ভেতরে থাকবে একটি অচেনা পরিচয় আমি, তাদের অচিন আতিথ্য।
আমি একাকী থাকি না। আমার সঙ্গে থাকে আরেকটি সত্তা, আমারই ছায়া, আমার দ্বৈত। সে কখনো আমার চোখে কথা বলে, কখনো আমার স্পর্শে ফিসফিসায়। সে আমাকে বলে—‘তুই তো ওদের সৃষ্টিও করিসনি, তবু ওদের নিয়ন্ত্রণ করিস। কেমন শাসক হইলি রে তুই, যার কোনো রাষ্ট্র নেই?’ আমি তখন হাসি। কারণ আমি জানি— মানুষের মস্তিষ্কই আমার রাষ্ট্র। বিশ্বাস আর সংশয়ের মাঝখানে আমি যে সেতু বানাই, তার নিচেই জন্মায় বিদ্বেষ, ঈর্ষা, আকাঙ্ক্ষা। আমি সেই নদীর দিশারী।
আমার দ্বৈত আমাকে আবার বলে— ‘তুই কি ভয় পাস না, যদি তারা একদিন বুঝে যায় তুই কে?’ আমি তখন উত্তর দিই— ‘ভয় তোর জন্য। আমি তো তাদের ভেতরেই বাস করি। তারা যদি আমায় চিনে, নিজেরাই ভেঙে যাবে।’
আমি অপেক্ষা করি দরবেশের নৈঃশব্দের চিড় ধরার, দস্যুর প্রতাপের ভেঙে পড়ার। আমি জানি, একদিন তারা নিজেরাই একে অপরকে ছুঁড়বে, ছিন্ন করবে বিশ্বাসের ছেঁড়া কাপড়। আর আমি সেই কাপড়ের টুকরো দিয়ে বানাবো আমার পরবর্তী মুখোশ। আমি একটি প্রাচীন সত্য জানি, ছায়ার কোনো বয়স নেই, কেবল রূপ বদলায়। আমি সেই রূপান্তরের চিত্রকর।
রাত্রির কোনো গহীন মুহূর্তে, যখন পাহাড়ও নিঃশ্বাস নেয় ধীরতায়, দরবেশ উঠে বসে। তার চোখে ঘুম নেই। ঘামে ভেজা কপাল, শুকনো ঠোঁট, তলপেটে কাটা ছুরির মতো মোচড়। নীরব ক্ষুধা তার শরীরে পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। সে জানে, এই নিঃসঙ্গতা তাকে পবিত্র করেছে বহুদিন কিন্তু এখন তা শুধুই এক ধোঁয়াশা, একটি নিরর্থক যুদ্ধের নাম।
তার পায়ের নিচে ঠান্ডা মাটি, মাথার ওপরে আকাশ ছড়ানো অথচ তার ভেতরে জ্বলছে আগুন। সে ধীরে ধীরে ওঠে, স্নায়ুর ভাঁজে অস্পষ্ট কাঁপুনি। তাবুর কোণের দিকে তাকায়, দস্যুর ছায়া পড়ে আছে সেখানে, ম্লান কিন্তু সচেতন। একটা ছোট থলে রাখা, যার গায়ে হাতের স্পর্শ পড়েছে বহুবার, ভেতরে আছে সামান্য শুকনো রুটি আর দুটো মাংসের টুকরো। দরবেশ থেমে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখে উঠে আসে পূর্বের দৃশ্য। সে কিশোর, ঘরের কোণে বসে কাঁপছে, মায়ের কণ্ঠে ভেসে আসছে— ‘ক্ষুধার আগে ঈশ্বর আসে না।’ তখন সে ভেবেছিল ঈশ্বরই ক্ষুধাকে ছাপিয়ে যাবেন। এখন, এত বছর পর, তার মনে হয়— ঈশ্বরকে ডাকলে যদি রুটি না আসে, তবে ঈশ্বর কি রুটি চোর?
আমি সেখানে আছি। আমি তার কাঁপা ছায়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলি—‘ভাতের চেয়ে বড় কীসের উপাসনা করিস রে দরবেশ? ঈশ্বর তোকে কী দিয়েছে, এই শুকনো চুল আর পাঁজরের ছায়া ছাড়া?’ আমি জানি, আমার কণ্ঠ তার চিন্তার ভেতরে ঢোকে, যেন সে নিজেই ভাবছে এসব। আমি তাকে কোনো আদেশ দিই না। আমি কেবল প্রশ্ন করি। প্রশ্নই আমার অস্ত্র। উত্তর খোঁজার ভানেই সবাই পথ হারায়। দরবেশ এগিয়ে যায়। তার আঙুল থলের মুখে পড়ে, থেমে যায়। সে কাঁপছে, কিন্তু থেমে না। থলে খুলে নেয় একটুকরো রুটি। আর ঠিক তখনই দস্যুর শরীর সোজা হয়।
‘তুই করিস কী, দরবেশ?’— দস্যুর কণ্ঠ ঘুম ভেঙে উঠে আসা আগ্নেয়গিরির মতো। দরবেশ থমকে যায়। তার চোখে হঠাৎ স্রোত নামে। চোখের কোণে জমে থাকা সংযমের বাঁধ ভেঙে পড়ে। সে কাঁদে, চুপচাপ। ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কোনো ভাষা ফোটে না। মাটিতে বসে পড়ে, থলের মুখ থেকে রুটি পড়ে যায়। দস্যু এগিয়ে আসে। তার শরীর আগুন, চোখে ঘৃণা, পায়ে ক্রোধ। সে থেমে যায় দরবেশের মুখোমুখি। তার হাত মুষ্টিবদ্ধ, যেন এই মুহূর্তে কিল ঘুষি বসিয়ে দেবে। কিন্তু সে দেখে দরবেশ কাঁদছে। একটি রুটি তার সামনে পড়ে আছে, দরবেশ তাতে চোখ রাখেনি, কেবল কাঁপছে।
আমি তখন দস্যুর কানে কানে বলি— ‘তুই ভাবছিলি, তুই একা ক্ষুধার শিকার। দেখ, এই দরবেশের ঈশ্বরও এখন নীরব। তুই তো তাকে চোর ভাবিস অথচ সে চুরি করে ভেঙে পড়ছে।’ আমি জানি, দস্যুর মনে এক দ্বন্দ্ব উঠছে। সে ভাবছে, যদি দরবেশও চোর হয়, তবে সে নিজে কতটা পশু? সে কি এই চোরকে মারবে, নাকি এই কান্নাকে ক্ষমা করবে?
তাদের ভেতরকার লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দরবেশ তার ঈশ্বর হারায়, দস্যু তার অহংকার। আর আমি, দাঁড়িয়ে দেখি এক দুটি পতন। একটিতে বিশ্বাস গলে যায়, অন্যটিতে ক্ষমতার ছায়া ধসে পড়ে।
আমি এবার চিৎকার করে উঠি— কিন্তু কেবল তাদের ভেতরে। বাইরের আকাশ নিঃশব্দ। কেবল তাদের হৃদয়ে আমার কথার ধ্বনি বাজে—‘তোমরা কি সত্যিই একে অপরের চেয়েও বেশি ঈশ্বরকে ভালোবাসো? নাকি ক্ষুধাকে?’ এই প্রশ্ন তাদের কাঁপিয়ে দেয়। দস্যু তার মুষ্টি শিথিল করে, দরবেশ মুখ নিচু করে, রুটি স্পর্শ করে না কেউই। আমি জানি, এই মুহূর্তেই তারা ভেঙে গেছে। তাদের ভেতরের ভয়, ক্ষুধা, পবিত্রতা ও লোভ একে অপরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
এই দ্বন্দ্ব আমার জন্য এক পরম উল্লাস। আমি জানি, এবার তারা আর সেই আগের মতো থাকবে না। তারা একে অপরের দিকে আর সোজা চোখে তাকাতে পারবে না, যেমন কোনো আয়নায় আর নিজের মুখ দেখা যায় না। একবার ফাটল ধরলে প্রতিফলন শুধু বিকৃতি হয়ে থাকে। আমি তাদের এই বিকৃতি দিয়ে নির্মাণ করব পরবর্তী স্তর। যেখানে ঈশ্বর আর শয়তানের ভেদরেখা কুয়াশায় মিশে যায়। আমি জানি, তারা দুজনেই এখন আমাকে ধারণ করছে। একজন কান্নার মধ্যে, অন্যজন ক্ষমার ছায়ায়।
আয়নায় মুখ দেখার সময় মানুষ তার চুল ঠিক করে, দাঁতের ফাঁকে কিছু লেগে আছে কি না দেখে কিংবা মুখটা খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে কি না সে খেয়াল রাখে। কিন্তু দরবেশ ও দস্যু যে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তা ছিল ছিন্নভিন্ন, রক্তলেপা, কুয়াশায় ঢাকা।
সে রাতে, কান্না, শ্বাস ও নিঃশ্বাসের মাঝখানে, কিছু একটার ভেতরে তারা যেন ঢুকে পড়ল। এমন এক স্তরে, যেখানে ভাষা নেই, কেবল প্রতিফলন। আমি দূর থেকে দেখি, তারা কীভাবে নিজেদের ভাঙাচোরা অংশের মুখোমুখি হয়। দরবেশ মাটির ওপর মাথা ঠেকিয়ে কাঁদে না। সে এবার হাঁটু গেড়ে বসে, নিজের দুই হাতের তালু চেয়ে থাকে। যেন হাত দুটোই তাকে প্রশ্ন করছে—‘এত বছর ধরে যে ঈশ্বরের নাম জপলে, সে কি কখনও রুটি নামিয়েছে?’ আর সে প্রশ্নের মুখে, দরবেশ খুঁজে পায় না কোনো উত্তর।
আমার অস্তিত্ব ক্রমশ গভীর হয়। তারা আমাকে অনুভব করে, চিনতে পারে না। আমি তাদের চেতনার গোপন অলিন্দে ঢুকে পড়ি, বুনে দিই একেকটি প্রতিধ্বনি, যার উৎস অচিহ্নিত, কিন্তু যার গন্তব্য সুস্পষ্ট। ‘যে ঈশ্বর ক্ষুধার কাছে পরাজিত, সে কি আসলেই ঈশ্বর? যে শত্রুর কান্না দেখে তোর হাত থেমে যায়, সে কি তোর শত্রু? নাকি তুই নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী?’ এই প্রশ্নগুলো তারা নিজেদের বলে মনে করে। আমাকেও নয়, ঈশ্বরকেও নয়, কেবল নিজের ছায়াকেই। আর সেই ছায়া দিনে দিনে গাঢ় হয়, গাঢ় থেকে কালো, কালো থেকে শূন্য।
দস্যু, যে এতদিন শক্তির প্রতীক ছিল, এখন বসে থাকে দরবেশের পাশে। সে একটিও শব্দ করে না। তার মুখে আর রাগ নেই, কেবল হেরে যাওয়া অভিমানের রেখা। সে বুঝে গেছে, দরবেশও মানুষ, যেমন সে নিজে এবং সেই উপলব্ধিই তার গর্বকে ভেঙে ফেলে। সে বুঝতে পারে, ঈশ্বরকে না মানলেও, ক্ষুধাকে তো মানতেই হয়। আর এই স্বীকৃতি, তার চোখের পেছনে এক ধরণের জল গঠন করে।
‘তোদের মধ্যে একজনের ঈশ্বর মরে গেছে, আরেকজনের অহংকার। এখন তোরা শূন্য, আমি তোদের পূর্ণ করব’—আমি আবারো ফিসফিস করি। তাদের কানের ভেতরে যেন কেউ বাঁশি বাজায়। ধ্বনি নেই, তবু সুর বেজে চলে। আমি জানি, এখন তাদের ভেতরে আমি জন্ম নিচ্ছি। ধর্মহীন এক আকাঙ্ক্ষা, যুক্তিহীন এক প্রবৃত্তি, শব্দহীন এক কণ্ঠস্বর হয়ে।
রাত কেটে যায় কিন্তু তারা ঘুমায় না। তারা জেগে থাকে, কিন্তু একে অপরের দিকে তাকায় না। তাদের চোখে একটা অদৃশ্য পাপবোধ। তারা জানে না, কে বেশি পাপী, কিন্তু বুঝে যায় তারা কেউই আর পবিত্র নয়। এই সময়ে আমি প্রথম তাদের সামনে প্রতিফলনের এক ফাটল তুলে ধরি। এক অদৃশ্য আয়না, যাতে তারা দেখে নিজেদের সেই রূপ, যেটা তারা লুকিয়েছিল এতকাল।
দরবেশ দেখে— সে নিজেই এক ভিখারি, ঈশ্বর নয়, রুটির খোঁজে ছুটে চলা এক ক্ষুধিত প্রাণ।
দস্যু দেখে— তার রক্তচক্ষু আসলে ভয় ঢাকার মুখোশ আর তার লুণ্ঠন আসলে নিজের শূন্যতাকে ঢাকার চেষ্টা। তারা বোঝে, তারা পরস্পরের বিপরীত নয়, তারা একে অপরেরই ছায়া এবং আমি সেই ছায়ার উৎস।
তখন আমি আর ফিসফিস করি না। আমি কথা বলি তাদের চেতনার মধ্যস্থলে— ‘তোমরা কি ঈশ্বরকে চেয়েছিলে? নাকি কেবল নিজের ভয়কে ঢাকতে ঈশ্বরের মুখোশ পরেছিলে? তোমরা কি ক্ষুধার কাছে মাথা নত করেছ, না ভালোবাসার কাছে? তফাৎ জানো?’ এই প্রশ্নগুলো তাদের ভেতরের বালুকাবেলাকে সরিয়ে দেয় এবং তারা একে অপরকে আবার দেখে। একদম প্রথমবারের মতো। দস্যু দেখে দরবেশকে— ক্ষুধার কাছে পরাজিত, কিন্তু মিথ্যা অহংকারহীন। দরবেশ দেখে দস্যুকে— কাঁধে শিকারি অস্ত্র, কিন্তু চোখে শিশুর মত নরম ক্লান্তি। এই মিলন এক বিভ্রান্তির, এক ভাঙনের। কিন্তু তাতেই জন্ম নেয় কিছু। তারা নাম দিতে পারে না, আমি দিই—‘ভয়হীন প্রবৃত্তি’।
সেই রাতের শেষে, তারা দুজনেই কিছু বলে না। তারা কেবল একসাথে বসে থাকে, কোনো ভাষা নেই, কোনো ঈশ্বর নেই, কোনো লজ্জা নেই। কেবল একটিই জিনিস আছে, আমার উপস্থিতি। আমি তাদের মধ্যেই থাকি একজনের শ্বাসে, আরেকজনের দৃষ্টিতে। আমি জানি, তারা এখন আর আমাকে আলাদা করে চিনতে পারবে না। আমি হয়ে গেছি তাদের অংশ, তাদের বিকৃতি, তাদের প্রতিফলন এবং এই প্রতিফলনেই আমি আমার পূর্ণ রূপ দেখি। আমি— ছায়া, পাপ, প্রবৃত্তি, প্রশ্ন, এবং বিকৃত ঈশ্বর।
নৈঃশব্দ্য নিজে একটি কৌশলী পশুর বিবরণ। যখন তার ডানদিকে আলো পড়ে, তখন সে বামদিকে রক্ত রাখে। সেই রাতে, পাহাড়ের ভেতরের শূন্যতা ছিল এমন গভীর, যেন শব্দের জন্মই হয়নি। দরবেশ ও দস্যু, যারা একে অপরকে ভাষাহীন দৃষ্টিতে চিনেছে, এখন যেন এক ছিন্ন ইতিহাসের দুই প্রতিচ্ছবি। আমি, তাদের মাঝে, সেই শূন্যতায় ঘনীভূত হই। আমার শরীর নেই, কেবল ইচ্ছা। আমার ভাষা নেই, কেবল প্রতিধ্বনি। আমি তাদের রক্তের তলে ঘুমানো আরেক বিশ্বাসহীন ঈশ্বর। একজন অন্ধ জ্যোতিষী, যে আগুন দেখে না, শুধু পোড়ার গন্ধে ভবিষ্যৎ পড়ে।
তখনই ঠিক যখন তারা বুঝতে চায় কাকে ঘৃণা করে বেশি, ক্ষুধাকে না ঈশ্বরকে। ঠিক তখনই পাহাড়ে বজ্রপাত নামে। এক প্রকাণ্ড শব্দ, যেন চিরকাল চুপ থাকা কোনো প্রাণ চিৎকার দিল। দরবেশ দাঁড়ায়, হাত কাঁপে। দস্যু ঠোঁট কামড়ে ধরে, অস্ত্র হাতে নেয় না। কেবল বুক টেনে নেয় ভেতরে। তারা দুজনেই জানে, এখন কিছু ঘটবে। কিছু যেটা অনিবার্য এবং একদমই কাম্য নয়। আমি বলি না কিছু, শুধু উপস্থিত থাকি। আমার চেহারা দেখা যায় না কিন্তু আমার ছায়া ছড়িয়ে পড়ে তাদের মুখে, তাদের চিন্তার রেখায়।
এখানে ঈশ্বরের নাম নেই। কেবল স্বর আছে কর্কশ, মোহগ্রস্ত, থেমে যাওয়া রাগের মত। দস্যু হঠাৎ বলে ওঠে— ‘তুই যদি চুরি না করতিস, আমি তোকে মারতে তেড়ে আসতাম না।’ কিন্তু দরবেশ আর মাথা নিচু করে রাখে না। সে একদৃষ্টিতে তাকায় দস্যুর চোখে— ‘তুই যদি আমাকে মারতে চাস, তবে আমি কিছু বলব না। কিন্তু খেয়াল রাখিস, ঈশ্বর শুধু তোর হাতটা দেখছে না। তোর নিজের ভেতরটা দেখছে।’
এই মুহূর্তে আমি জানি, তারা দুজনেই বিশ্বাসের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন তারা কেবল মানুষ। কাঁপতে থাকা, কুয়াশায় ঢাকা, টিকে থাকার জন্য যেকোনো নীতিকে বর্জন করতে প্রস্তুত দুইটা প্রাণ।
আমি এবার নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিই। আমি থাকি দরবেশের মগজের গভীরে, যেখানে ঈশ্বরের প্রার্থনার জায়গায় আজ শুধুই অভিশাপ জমেছে। আমি থাকি দস্যুর হাতের পাতায়, যেখানে রক্তের বদলে জমে আছে স্মৃতির কাঁপুনি এবং আমি বলি— ‘তোমরা কেউই এখন ঈশ্বরের সন্তান নও। তোমরা আমার। তোমরা কেউই পবিত্র নও। তোমরা বাস্তব।’
এই বাস্তবতা এক অন্তহীন খাদের মত এবং সেই খাদেই তারা পড়ে যায়। কেউ হাতে হাত রেখে নয়, একে অপরের কাঁধে ছায়া রেখে। কারণ ছায়াই এখন তাদের একমাত্র পরিচয়।
যখন সূর্য উঠে আসে পাহাড়ের গা বেয়ে, আমি দেখি তারা আর নেই। কেবল দুইটা দাগ পড়ে আছে। একটাতে রক্ত, অন্যটাতে জল। আমি জানি না কোনটা দস্যুর, কোনটা দরবেশের। তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ তারা এখন একে অপরেরই আয়না। আমি তাদের রেখে যাই সেই পাহাড়ে, সেই নৈঃশব্দ্যে। আমি চলে যাই অন্য কারো চেতনার গভীরে, আরেকটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে।
এই গল্পের শেষ নয়। কারণ আমি কখনো শেষ হই না। আমি শয়তানের উপাসক নই। আমি শয়তান নিজেই, ছায়া হয়ে মানুষের পবিত্রতার ভেতর জন্ম নেই এবং তাকে প্রশ্ন করি— ‘তুই কি সত্যিই ঈশ্বরকে ভালোবাসিস, না কেবল তার নামটা ব্যবহার করিস নিজের ক্ষুধা ঢাকতে?’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন