প্রথম দৃশ্য: পাশা ও অপমান
স্থান: রাজসভা, সময়কাল: সন্ধ্যার পরে, রাজসভা জ্বলন্ত প্রদীপের আলোয় ঝলমল করছে
পটভূমি: পাশা খেলা চলছে। দ্রৌপদী এখনও সভায় উপস্থিত নন। পাশার খেলায় একে একে সব কিছু হারিয়ে এবার যুধিষ্ঠির তার পত্নী দ্রৌপদীকেও বাজি রেখেছেন।
চরিত্রসমূহ এই দৃশ্যে: ধৃতরাষ্ট্র, দূর্যোধন, যুধিষ্ঠির, দ্রোণ, কর্ণ, ভীম, দুঃশাসন, বিদুর, দ্রৌপদী (পরে প্রবেশ), সভাসদগণ
কোরাস সংগীত (দৃশ্য শুরু হওয়ার আগে)
(আলো ধীরে ধীরে বাড়ে, একদল কোরাস মঞ্চের এক প্রান্তে এসে গান করে):
কোরাস
আগুনে যে খেলিছে ভাগ্য,
সে তো পুড়েই যাবে।
ন্যায়ের নামে অন্যায় খেলে
ধর্মও নীরব থাকে।
রাজা কাঁপে, সভা স্তব্ধ,
গর্জে ওঠে মেয়ে—
দ্রৌপদী নাম সে নারীর,
গেরুয়া আগুন ছায়ে।
(মঞ্চে পাশার ক্রীড়া চলছে। রাজসভা রৌদ্রবর্ণ আলোয় উদ্ভাসিত। যুধিষ্ঠির মাথা নিচু করে বসে আছেন। দূর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন গর্জন করে হাসছে।)
দূর্যোধন : (উচ্চস্বরে, কটাক্ষে) হা হা হা! রাজা যুধিষ্ঠির! রাজচক্রবর্তী মহাবীর! সমস্ত রাজ্য, অরণ্য, স্বর্ণ, ভ্রাতা—সবই তো গেল! এখন আর কি অবশিষ্ট রেখেছো বাজির পাতায়? (অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে) হে মহামান্য পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির! সারথিহীন রথ যেমন গন্তব্যহীন, তেমনি তোমার রাজ্যও আজ এক পদে পরাজিত!রাজ্য গিয়েছে, ভ্রাতা গিয়েছে, অরণ্যের অধিকার গেছে—এবার আর কিছু অবশিষ্ট রেখেছো? অথবা হাত তুলে বলো—তোমার কাছে এখনো কি কিছু বাকি?
যুধিষ্ঠির : (গম্ভীর, লজ্জিত, ধ্বস্ত কণ্ঠে) ধর্ম, সত্য, ন্যায়—সব হারালাম আমি। এখন যে অবশিষ্ট, সে আমার সম্মান, আমার স্ত্রী, পঞ্চকন্যা দ্রৌপদী। (মাথা নিচু, দৃষ্টি মাটিতে স্থির, স্বর ভারী) ধর্মকে আমি খেলায় এনেছি, সত্যকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি ধূলির ভেতরে। হ্যাঁ, এখনও কিছু বাকি আছে আমার। যা হারাইনি, তা আমার আত্মার পরিপূর্ণতা— আমার পত্নী, আমার সম্মান, আমার দ্রৌপদী। তাঁকে আমি আজ রাখি বাজির দানে, যেমন এক পুরুষ রাখে তার একমাত্র গর্বকে আগুনে।
(এক মুহূর্ত স্তব্ধতা)
সভায় শোরগোল কিছু সভাসদ: এটা অনুচিত! ধর্মের বিরুদ্ধ! এক স্ত্রী কি পণ হতে পারে?
বিদুর : (চিৎকার করে উঠেন) না! এটি অনুচিত, অগ্রহণযোগ্য! একজন মানুষ যখন নিজেকে বিক্রি করে, তার পরবর্তী বাজি কিভাবে অন্য মানুষ হতে পারে? দ্রৌপদী কোনও দ্রব্য নয়, মহারাজ! তিনি নারী—স্বাধীন আত্মা, একজন রাজকন্যা, একজন পত্নী!
দ্রোণ : (চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাস ছেড়ে) ধর্ম সুপ্ত, লজ্জা লাঞ্ছিত।
কর্ণ : (ঠাণ্ডা অথচ তীক্ষ্ম) কিন্তু রাজসভায় যখন পাশার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্যর্থতার হাতে, তখন মর্যাদাও তো হয় পণ। পাঁচ স্বামী যার, তিনিই হোন বাজির পরবর্তী মূর্তি।
দূর্যোধন : (উল্লাসে, কর্ণের দিকে চেয়ে) সঠিক বলেছেন মিত্র কর্ণ! তবে অপেক্ষা কেন? হে দুঃশাসন! যুধিষ্ঠির তাঁর দ্রৌপদীকে হেরেছেন। তাঁকে আনো! রাজসভা পঞ্চপাণ্ডবের লজ্জা দেখতে চায়। যুদ্ধশেষে যেমন বিজয়, তেমনই আমোদ এই জয়ে! হে দুঃশাসন! রাজা যুধিষ্ঠিরের দাসত্বে পড়েছে দ্রৌপদী। তাঁকে এনে দাও এই সভায়!
দুঃশাসন : (ঠোঁটে কুটিল হাসি, মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়) আজ দ্রৌপদী হবেন রাজসভার উপহাস! যেমন বল, ভাই! আমি যাই দ্রৌপদীর কাছে! (আলো কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ, দ্রৌপদী প্রবেশ করেন, ধ্বস্ত কিন্তু গম্ভীর। মঞ্চ জুড়ে হিমশীতল বাতাস যেন নেমে আসে।)
কর্ণ : (ঠাণ্ডা গলায়) রাজসভা এখন দেখবে নারী কীভাবে নিঃস্ব হয়। যিনি পাঁচ স্বামীর বরণীয়া, আজ তিনিই এক লাঞ্ছিতা দাসী। (দুঃশাসন দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে আসে মঞ্চে। দ্রৌপদী লাল রঙের শাড়িতে, চুল খোলা, চোখে আগুন। ধ্বস্ত কিন্তু অনড়।)
দ্রৌপদী : (আবির্ভাবেই উচ্চ কণ্ঠে) স্তব্ধ হোন! কে আছেন এখানে যে বলবেন, আমি কীভাবে এক দাসীর মত এই সভায় টেনে আনা হলাম? আমি পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী, রাজপুত্রীর সন্তান, ধর্মের বাণী। কে বললেন, আমি আর স্বাধীন নই? (দৃষ্টি যুধিষ্ঠিরের দিকে) প্রশ্ন করি আপনাকে, ধর্মরাজ! আপনি কি নিজেকে হারিয়ে, তারপর আমাকে বাজি রেখেছেন? স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র! এই কি কৌরবদের ন্যায়পরায়ণ সভা? (সোজা দাঁড়িয়ে, দৃপ্ত কণ্ঠে) কে ডেকেছেন আমাকে? কে সেই পুরুষ, যে সাহস করে নারীকে টেনে আনে সভার মাঝে, যেখানে বিচার হয় তার স্বাধীনতার, তার মর্যাদার, তার অস্তিত্বের? (সবার দিকে একবার তাকিয়ে, এরপর যুধিষ্ঠিরের দিকে) আমি তো আপনার পরিপূরক, আপনার সম্পদ নই! আমি কি আপনার জয় বা পরাজয়ের দ্রব্য? প্রত্যুত্তর দিন ধর্মপূত্র!
দ্রোণ :(চুপচাপ, মনে মনে) এই নারী আজ প্রশ্ন করছে ধর্মকেই। শত জ্ঞানেও আমি দিতে পারি না উত্তর।
দ্রৌপদী : (কণ্ঠ আরো দৃঢ়) কে বললেন, একজন পুরুষ হেরে গেলে তার পত্নীও হারায়? আমি কী তাঁর সম্পত্তি? না কি আত্মা? এই সভার প্রতিটি স্তম্ভকে আমি প্রশ্ন করি!
দুঃশাসন : (হাসতে হাসতে) তবে আমি খুলে নিই তোমার শাড়ি! তোমার প্রশ্নের উত্তর হবে আমার শক্তিতে! এই সভা দেখবে কে তুমি—এক পতিত দাসী না কি ভগবানের রক্ষা করা এক আত্মা! (সে এগোতে থাকে। দ্রৌপদী হাত তুলে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা করেন। আলো গাঢ় হয়। কোরাস গান শুরু করে। শাড়ি খুলছে বলে মনে হলেও একটি অসীম শাড়ির আবরণ ঘুরে ঘুরে চলে—দ্রৌপদীর শাড়ি ফুরোয় না। দুঃশাসন হাঁপিয়ে পড়ে।)
কোরাস সংগীত
না যায় ঢেকে সূর্যরশ্মি,
না যায় নত এক নারী।
যে আত্মায় জ্বলিছে দীপ,
সে নাস্তিকে কি হারে?
লজ্জার কাছে নত সভা,
দ্রৌপদী তব মন্ত্রে রক্ষা হইলে
সত্য কোথায় হারায়?
দ্বিতীয় দৃশ্য: আদালতের সূচনা ও প্রথম শুনানি
স্থান: কল্পনালোকের একটি মহাকাব্যিক আদালত—যেখানে পুরাণ ও ন্যায়বিচার মিলিত হয়েছে।
পটভূমি: দ্রৌপদী রাজসভায় বিচার দাবি করার পর সেই সভাই রূপ নেয় এক অলৌকিক আদালতে। সেখানে কোনো সাধারণ বিচারক নয়, ন্যায়ের প্রতীক এক চরিত্র (যাকে পরে নির্ধারণ করা যেতে পারে—যেমন "ধর্মরাজ" বা "সময়ের সাক্ষী") বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত হন।
চরিত্রাবলী এই দৃশ্যে: দ্রৌপদী (বাদী), দ্রৌপদীর পক্ষের আইনজীবী (পণ্ডিত ও যুক্তিবাদী এক নারী/পুরুষ চরিত্র), দূর্যোধন (বিবাদী), দূর্যোধনের পক্ষের আইনজীবী (বক্তৃতাবাজ, কৌশলী ও বুদ্ধিমান), বিচারপতি/ধর্মরাজ , সভাসদ/নিরপেক্ষ শ্রোতা, কোরাস
(আলো ধীরে বাড়ে, আদালতের আবহ)
কোরাস:
সভা বদলে আজ আদালত,
শব্দে ও নীরবতায় হয় বিচার।
রক্ত নয়, যুক্তির তরবারি;
বচনে জ্বলে মহাযুদ্ধের আগুন।
এক নারী আজ প্রশ্ন করিছে,
উত্তর চাইছে রাজনীতির মুখে।
দ্রৌপদীর চোখে জ্বলিছে অগ্নি—
সৃষ্টির ভিতরে কাঁপে সভ্যতা।
মঞ্চ বিন্যাস: মঞ্চের এক প্রান্তে বিচারপতির আসন। এক পাশে বাদীপক্ষ, আরেক পাশে বিবাদীপক্ষ। মাঝে একটি প্রতীকী মঞ্চ যেখানে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি চলবে।
বিচারপতি (ধর্মরাজ): (আলো ধীরে পড়ে, তিনি উঠে দাঁড়ান। কণ্ঠ ধীর, গভীর, শব্দে অলঙ্কার; যেন স্বয়ং কাল কথা বলছে)
সভাসদগণ, শ্রবণ করো—আজ এই পবিত্র সভা আর শুধু রাজসভা নয়, আজ এ স্থল রূপ নিয়েছে এক অলৌকিক বিচারাঙ্গনে। হস্তিনাপুর রাজসভায় দ্রৌপদী নাম্নী নারীর অপমান অভিযুক্ত— দূর্যোধন, পাণ্ডবগণ এবং নীরব সভাসদবৃন্দ বাদী— দ্রৌপদী, রাজ্যবধূা, ধর্মপথিক। নারী বিবাদীপক্ষ— কৌরবপক্ষ এই আদালত, ন্যায় ও ধর্মতত্ত্বের সমবায়ে পরিচালিত। শ্রবণ করা হইবে প্রথমে বাদী পক্ষের বক্তব্য। বক্তব্য হউক যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও সত্যের নির্যাসে গঠিত। যেখানে ন্যায় হইবে ভাষা, যুক্তি হইবে তরবারি আর সত্য—সে হইবে একমাত্র ধর্ম। আজ যাহারা মুখর হইবে, তাহারা কেবল নিজে কথা বলিবে না—তাহাদের শব্দে প্রতিধ্বনিত হইবে জাতির বিবেক, যুগের অনুশোচনা। সময় আজ অবিচারকে আসনে বসায় নাই, নিজেই দাঁড়াইয়াছে কাঠগড়ায়। পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই তাদের ভাষায় সত্যের দাবি করিবে, কিন্তু সত্য একটাই—সে থাকে আবেগের ওপারে, শব্দের গভীরে।
আমি, ধর্মরাজ, নই কেবল এই সভার সভাপতি— আমি হই সত্য ও অসময়ের সন্ধিক্ষণে জন্ম নেওয়া এক অনির্ণীত প্রতীক। আসুন,শুরু হউক এই মহামানবিক বিচার। বাদী—পাঞ্চালীর কন্যা দ্রৌপদী। বিবাদী—হস্তিনার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী দূর্যোধন। আইনজ্ঞেরা আসন গ্রহণ করুন। এ সভা এখন নীরবতা নয়—উচ্চারণে ন্যায় জাগ্রত করুক। বিচার শুরু হউক।
(আলো দ্রৌপদীর ওপর পড়ে, সে এগিয়ে আসে কাঠগড়ার কেন্দ্রে)
দ্রৌপদী : (অগ্নিস্নাতা ভাষায়, ধীরে ধীরে, কিন্তু স্থির স্বরে) হে ন্যায়! আমি নারী। আমি রাজবংশের কন্যা, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা,আমি পাঁচ রাজপুত্রের পত্নী। আমি সম্মান, আমি সংসার, আমি অন্নদাত্রী। তবু—আমি বিক্রীত, আমি টানাহেঁচড়া এক পিণ্ড। আমি সভায় দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিয়াছিলাম—‘স্বয়ং বিক্রীত ব্যক্তি কি অপরকে বিক্রয় করিতে পারে?’ উত্তর পাই নাই, পেয়েছি কেবল নীরবতা। সে নীরবতা আজ আমার বিবরণ। সে নীরবতা—বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, সভাসদ—তাহাদের সম্মতির সমান।
আমি বিক্রি হই নাই, আমি গৃহস্থালির দ্রব্য নহি। আমার সম্মান আমার স্বত্ব! আমার শরীর কেবল সৌন্দর্য নহে—
তা শক্তি, তা প্রতিবাদ, তা মাতৃত্ব। যে শরীর লাঞ্ছিত, সে কেবল রক্তমাংস নয়—সে লাঞ্ছিত ইতিহাস, ন্যায়ের স্তব্ধ স্বর! আমি চাহি—এই আদালত বলুক—দ্রৌপদী বিক্রীত কি না? যুধিষ্ঠিরের ‘দান’ ধর্মসঙ্গত কি না? দূর্যোধনের অঙ্গভঙ্গি কি শালীনতার অন্তর্গত? আমার শরীর হরণ নয় একক দুঃশাসনের—তা হস্তিনাপুর সভার সম্মিলিত অন্ধতা! আমি ন্যায় চাই—আমি শাস্ত্র চাই না, আমি বিধান চাই না—আমি চাই ধর্ম!
(দ্রৌপদী সরে দাঁড়ান, কাঠগড়ার এক প্রান্তে যান, চোখে আগুন কিন্তু মুখে শান্তি)
দ্রৌপদীর আইনজীবী: (পাণ্ডিত্যপূর্ণ নারী/পুরুষ চরিত্র। প্রবেশ করে দৃপ্ত পদক্ষেপে, উচ্চারণ বিশুদ্ধ, ন্যায়পথে দৃঢ়)
মাননীয় বিচারপতি, আমি এই আদালতের দরবারে প্রার্থনা করি—আজকের এই শুনানিতে প্রথমে তুলে ধরা হোক অপরাধের মূল। আমার মক্কেল, দ্রৌপদী—কৌরব বংশীয়দের হাতে এক নারকীয়, অমানবিক অপরাধের শিকার। তাঁকে প্রকাশ্য সভায় টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে, তাঁর সম্মানকে খেলনার মতো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। প্রশ্ন করি এই সভাকে— যে নারী স্বয়ং একজন রাজকন্যা, যে নারী একাধিক রাজপুত্রের পত্নী, তাঁকে কি কেবলমাত্র ‘বাজি’ হিসেবে গণ্য করা চলে? ধর্ম কি অনুমতি দেয়, যে নিজেকে দাস বলে ঘোষণা করেছে, সে তার পত্নীকেও দাসত্বে বিকিয়ে দিতে পারে? (একটু থেমে) এই প্রশ্ন ন্যায়ের ভিত্তিকে আন্দোলিত করে। আমরা চাই—এই প্রশ্নের যথাযথ ব্যাখ্যা।
বিবাদীর আইনজীবী: (দূর্যোধনের পক্ষ। একটি ঠাণ্ডা, কৌশলী হাসি নিয়ে কথা শুরু করে)
মাননীয় বিচারপতি, আমার সহকর্মীর আবেগপূর্ণ বক্তৃতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি— এই মামলা কেবল আবেগের নয়, এটি বিধির, নিয়মের, সামাজিক কাঠামোর। প্রথমত, যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছেন পাশার খেলায়। দ্বিতীয়ত, সেই খেলায় তিনি নিজের সমস্ত সম্পদ, রাজ্য ও দাসত্ব দান করেছেন। যখন তিনি নিজেকে দাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তখন তাঁর উপর থাকা সমস্ত অধিকার— বিশেষ করে তাঁর পত্নীর উপর— আর আইনত তাঁর ছিল না। সুতরাং, তিনি যখন দ্রৌপদীকে বাজি রাখেন, তখন তিনি রাখেন একজন দাসের পক্ষে দাসীকে। এতে আইনগত অন্যায় কোথায়?
দ্রৌপদীর আইনজীবী : (স্বর তীক্ষ্মতর হয়) ধর্মের কথা বলেন আপনি? তবে বলুন, কিসের ধর্ম সেই, যেখানে নারী হয় পণ, হয় দ্রব্য? তাহলে কি বিবাহও শুধুই এক সামাজিক চুক্তি? ভালোবাসা, সম্মান, সমতা—এগুলো কি তবে কেবল অলংকার? যুধিষ্ঠির যখন নিজেকে দাস বলেন, তিনি তখন আর স্বাধীন নন। তাহলে তাঁর পরবর্তী সিদ্ধান্ত—তাঁর পত্নীকে বাজি রাখা—সে সিদ্ধান্ত তো অবৈধ, বাতিলযোগ্য! আর বলুন তো—যদি ধর্ম নারীকে দ্রব্য বানায়, তবে কি সেই ধর্মই সত্য? না, এই সভা আজ সেই ধর্মকেই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।
দ্রৌপদী : (চোখে অগ্নি, বুক গর্জনে ফেটে পড়ে) আমি শুধু এক নারী নই, আমি এক প্রতীক। আমার অপমান মানে শতকোটি নারীর অপমান। আমি আজ নিজে ন্যায় চাই, শুধু আমার জন্য নয়, সমস্ত পৃথিবীর জন্য! ধর্ম যদি নীরব থাকে, সভা যদি চুপ করে—তবে আমি নিজেই আমার কণ্ঠে প্রতিষ্ঠা করবো বিচার। হে ধর্মাধীশ, আজ আমি এই সভায় দাঁড়িয়েছি একজন নারী হিসেবে নয়, আমি দাঁড়িয়েছি ইতিহাসের সামনে, আমি দাঁড়িয়েছি এক সামষ্টিক সম্মানের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। আমি দ্রৌপদী—পাঞ্চালরাজের কন্যা, পাণ্ডবদের পত্নী, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আমি এক চেতনার রূপ, এক প্রশ্নের রুদ্র অগ্নিশিখা—যে প্রশ্ন শুধুই আইনগত নয়, আত্মিক, নৈতিক এবং ঐতিহাসিক। বলুন ধর্মরাজ, যে নারী শত্রুদের আগুনে জন্ম নেয়, যে নারী অরণ্যে পতির পাশে দুঃখকে করেছে অলঙ্কার, যে নারী অশ্বমেধ যজ্ঞের আগুনে শপথ নিয়ে চলে এসেছে আত্মদান দিতে— তাকে কি ‘দাসী’ বলা চলে? তাকে কি টেনে আনা যায় সভায়, জনতার মধ্যে, নগ্ন করার অভিলাষে? কোন বিধান, কোন ধর্মগ্রন্থ, কোন যুগধর্ম— এই অপমানের স্বীকৃতি দেয়?
আমি যুধিষ্ঠিরের সহধর্মিণী। পতি যদি নিজেই নিজেকে বিক্রি করে, তবে তার কোনো অধিকার থাকে কি আর স্ত্রীর উপর? তাহলে কি আমি ছিলাম তাঁর স্বত্বাধীন কোনো সামগ্রী, যা তিনি বাজিতে তুলে দিতে পারেন? না, আমি কোনো বস্তু নই। আমি দ্রৌপদী, আমি মানবতার বিবেক! আর আমি প্রশ্ন করি সভাকে— ভীষ্ম! দ্রোণ! বিদুর! সভাসদগণ! তোমরা সবাই কি এই অন্যায়ের নীরব সাক্ষী হতে চান? নাকি আপনারা ইতিহাসের সেই করুণ পাতায় লেখা হতে চান, যেখানে লেখা থাকবে— ‘এক নারী আহ্বান করেছিল ন্যায়কে, আর সভা ছিল নির্বাক, মৃত, নিষ্প্রাণ’?
ধর্মরাজ, আমার গায়ে কোনো অলংকার নেই আজ— শুধু আছে অপমানের অগ্নি, যা আমার রক্তে জ্বলছে। আমার চোখে নেই কেবল জল, আছে প্রতিজ্ঞা, যে প্রতিজ্ঞা চূর্ণ করবে অসত্যের প্রাচীর। আমি দাবি করি— এই সভা উত্তর দিক, এই সভা বলুক— আমি কি দাসী? আমি কি দ্রব্য? নাকি আমি একজন স্বাধীন নারী, যার আত্মমর্যাদা স্পর্শযোগ্য নয়?(এক মুহূর্ত স্তব্ধতা... তারপর তার কণ্ঠ উঁচু হয়)
জানিয়ে রাখি—আজকের এই বিচার শুধু এক ব্যক্তির নয়, এ বিচার যুগ যুগের। এটি নির্ধারণ করবে— নারীর মর্যাদা কতটুকু স্বীকৃত এই সভ্যতায়। এটি বলবে—ধর্ম কেবল পুরুষের স্বার্থ রক্ষার যন্ত্র, না কি সে সত্যিই সকলের?
কোরাস সংগীত
(দৃশ্য শেষে ধীরে ধীরে আবৃত্তির মতো করে)
এক নারী দাঁড়ায় প্রশ্নে প্রশ্নে,
সভা স্তব্ধ, ভাষা নির্বাক।
শরীর নয়, প্রশ্ন জ্বলছে—
উত্তরের বোঝা কার কাঁধে রাখ?
রাজনীতি কি বলবে কিছু?
ধর্ম কি নেবে পক্ষে দান?
না কি সময় গড়বে আদালত,
যেখানে ন্যায় হবে সম্মান?
(আলো ধীরে নিভে যায়, পর্দা পড়ে)
তৃতীয় দৃশ্য: সাক্ষ্যপর্ব — ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর
মঞ্চের পটভূমি: আলো আবছা, এক একটি সাক্ষ্যদানের সময় আলোকস্রোত নির্দিষ্ট চরিত্রে ফোকাস করে। পেছনে কোরাস বসে মৃদুস্তবের সুরে বুনে চলে মুহূর্তের তীব্রতা।
ধর্মরাজ : (উচ্চাসনে দাঁড়িয়ে, দীপ্ত অথচ শীতল স্বরে) সময় এসেছে সাক্ষ্যের। সময় এসেছে আত্মা ও ইতিহাসের সম্মুখীন হবার। আহ্বান করা হইল সেইসব প্রাজ্ঞজন, যাঁহার চোখ দেখিয়াছে, হৃদয় অনুভব করিয়াছে, আর বিবেক—তাহাদের নিঃশব্দে প্রশ্ন করিয়াছে।
ভীষ্ম : (সম্মুখে আসেন, ধীর কণ্ঠে অগ্নিস্নিগ্ধ ভাষায়) আমি ভীষ্ম— প্রতিজ্ঞার পাষাণপ্রতিম, শান্তনুর উত্তরসূরি, যাঁহার মৌনতা কখনো অস্ত্রতুল্য, আবার কখনো অভিশাপপ্রাপ্ত। সে দিন—সভামধ্যে যখন হাহাকার ছিঁড়ে দিচ্ছিল নীরবতা, দ্রৌপদীর আহ্বানে যখন স্থবির হচ্ছিল সময়— আমি বসে ছিলাম, শূলের মতো গাঁথা রাজধর্মের শিকলে। কী বলি? কী করিনি? আমি কি ছিলাম ন্যায়রক্ষী? না অধর্মের নিঃশব্দ অনুমোদনকারী? হে ধর্মরাজ, আজ আমি স্বীকার করি—আমার নীরবতা ছিল এক প্রজ্জ্বলিত পাপ। পিতামহ আমি, কিন্তু পুত্রসম দূর্যোধনের পাশে আমি দাঁড়াতে পারিনি। দ্রৌপদী, তোমার প্রতি অপরাধ শুধু দূর্যোধনের নয়— আমারও, আমাদেরও। আমার চক্ষু দেখিয়াছে, কিন্তু হৃদয় বধির ছিল। আজ সেই হৃদয়ই কাঁদে, ফেটে পড়ে। ইতিহাসে লেখা হোক— ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল অটুট, কিন্তু ন্যায়বোধে এক ফাটল ছিল, যাহা আজও শোকে কাঁপে।
(আলো ম্লান হয়ে যায়। পেছনে কোরাস ধীরে গাইতে থাকে)।
দ্রোণ : (উঠে দাঁড়ান, গলার কণ্ঠে দ্বিধা ও গভীর বেদনা) আমি দ্রোণ—অস্ত্রের গুরু, জ্ঞানের ব্রতধারী। রাজপুরুষেরা যাহা জানে, তাহার অধিক জানার অধিকার আমার ছিল। কিন্তু জ্ঞান যদি অন্তর নির্মল না করে, সে জ্ঞান বৃথা। আমি সভায় ছিলাম। আমি শুনেছি দ্রৌপদীর কণ্ঠরোধী আর্তনাদ, আমি দেখেছি কাপড় টানার কুৎসিত উল্লাস, আমি জানতাম—এ ধর্ম নয়, এ শুধু শক্তির শিকার। তবু চুপ ছিলাম! কেন? কারণ আমি শৃঙ্খলিত ছিলাম সভার মায়াজালে।
হে বিচারপতি, আমি আজ বলি—আমি সেই শিক্ষক, যে অস্ত্র দিল পাণ্ডব ও কৌরবকে, কিন্তু ন্যায় ও মমতার পাঠ দিতে পারিনি। দ্রৌপদী ছিল রাজমহিষী নয় কেবল, সে ছিল যুগবোধের এক দীপ্ত প্রতিমা। তার উপর হাত তোলা মানেই সভ্যতার উপর আঘাত। আমি দণ্ডনীয়— কারণ আমি জেনেও প্রতিবাদ করিনি। আমার বিবেক রক্তাক্ত এবং সেই রক্তেই লেখা হোক আমার সাক্ষ্য। (আলো নিভে যায়, কোরাস গায়)
‘শিক্ষক যদি হয় নীরব,
শিষ্য করে পাপ নির্মম।
দ্রোণ কাঁদে—
অধর্মের পাঠ যে দিল নিজ অজ্ঞানে।’
বিদুর : (ধীরে উঠে আসেন, চোখে দীপ্তি, কণ্ঠে সংযত দ্রোহ) আমি বিদুর—কৌরববংশের চতুর্থ বংশধর। কিন্তু আত্মার প্রথম আলো। রাজরক্ত আমার নয়, তবু ন্যায়ের প্রবক্তা আমি। সে দিন আমি বলেছিলাম— ‘থামো! দ্রৌপদীকে সভায় টানিও না! সে দাসী নয়, সে রাজ্যের মুখ। তাকে অপমান করা মানে আত্মাকে অপমান করা।’ কিন্তু আমার বাক্য ছিল বাতাসের পত্র, রাজসিংহাসনের ধ্বনি তাকে গিলে ফেলেছিল। হে সভা, হে সময়, হে ইতিহাস— বিদুর কোনো রাজা নয়, তবু আজ আমি উচ্চারণ করি— দ্রৌপদীর সম্মান ছিল সভার শেষ মানচিত্র। সে মানচিত্র আজ ছিন্নভিন্ন। আমি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু একা ছিলাম। সেই একাকিত্বই যুগের অভিশাপ, যে যুগে শতক জন দেখে, আর এক জন বলে।
কোরাস (পেছন থেকে সুরে)
‘সত্য জানে যারা,
নীরব তারাই পাপে ভরা।
রাজসভা ছিল চুপ—
দ্রৌপদীর প্রশ্ন হাওয়ায় দোলা দেয়,
কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না।
আজ দাঁড়ায় তারা,
কিন্তু সময়ের শাস্তি হয়ে গেছে দৃঢ়।’
(আলো ধীরে স্তব্ধ হয়। পরবর্তী দৃশ্যের প্রস্তুতির আগমুহূর্তে দ্রৌপদী একা দাঁড়িয়ে থাকেন—মঞ্চের মাঝখানে, আলোকরেখায়, যেন একাকিত্বের মধ্যে দৃপ্ত।)
দৃশ্য- ৪: (১) বিবাদীপক্ষের আইনজীবীর প্রারম্ভিক বক্তব্য
মঞ্চ: আদালতের পরিবেশ যথারীতি গম্ভীর। আলো দূর্যোধনের আইনজীবীর উপর কেন্দ্রীভূত। ধর্মরাজ বিচারাসনে। পেছনে দ্রৌপদী স্থির, সামনে বাদী ও বিবাদীপক্ষ।
দূর্যোধনের আইনজীবী : (ধীর পদক্ষেপে উঠে দাঁড়ান, দীপ্তি ও আত্মবিশ্বাসে) মহামান্য ধর্মরাজ, সভার বিশিষ্ট সদস্যগণ আর সেই দ্রৌপদী—যার চোখে ঝরে অভিমান ও আগুন। আমি এই সভায় দাঁড়াই, কেবল দূর্যোধনের পক্ষে নয়, এক পরিপূর্ণ সত্যের পক্ষে। বিচার তখনই ন্যায়বান হয়, যখন আবেগ নয়, যুক্তি—হৃদয় নয়, বিধি—ইতিহাস নয়, বর্তমান—হয় তার পাথেয়। যাহা ঘটিয়াছে, তাহা বিচারের বিষয় নয় একমাত্র। কিভাবে, কিসের ভিত্তিতে ঘটিয়াছে—সেটাই মুখ্য।
হে সভ্যগণ, প্রথমত বলি—দ্রৌপদীর অভিযোগ দাঁড়িয়ে আছে এই এক ভিত্তির উপর—সে দাসী নহে, সুতরাং তার বস্ত্রহরণ অনধিকার। কিন্তু আমি প্রশ্ন করি—পাশা কি ছিল নিষিদ্ধ? না কি রাজধর্মের স্বীকৃত খেলা? যুধিষ্ঠির কি জোর করে খেলানো হয়েছিল? না কি নিজের সম্মতিতে প্রবেশ করিয়াছিল এক জুয়ার মঞ্চে? এবং সেই খেলার শেষে তিনি কি পরাজিত হননি? নিজেকে, ভ্রাতাগণকে, পরিশেষে দ্রৌপদীকেও কি তিনি সমর্পণ করেননি?
হে সভা, আমি জিজ্ঞাসা করি—একজন রাজা যখন নিজ পত্নীকেও হারায়, তখন সেই পত্নীর ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান কী? যদি যুধিষ্ঠিরই দ্রৌপদীর উপর অধিকার না রাখেন, তবে তিনি কিসের ভিত্তিতে তাঁকে দাবি করেন? দূর্যোধন দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়াছে—দাসীরূপে, এক জয়লাভের ঘোষণায়। তদ্বিষয়ক আচরণ যদি অনভিপ্রেত হয়, তবে দায় প্রথমত যাঁহার, তিনি যুধিষ্ঠির।
আরও বলি, হে বিচারসভা—সভার সম্মুখে আচরণ অবাঞ্ছিত হইতে পারে, কিন্তু আইন অনুসারে দূর্যোধনের অধিকার ছিল— দ্রৌপদীকে সভায় উপস্থিত করিবার। হে বিচারপতি, এই বিচারসভা কি আবেগের? না কি শাসন ও বিধির প্রতিচ্ছবি? দূর্যোধন হয়তো উগ্র ভাষায় কথা বলিয়াছেন, হয়তো তাঁর রসিকতা অনুচিত ছিল— কিন্তু আইন কি শব্দ বিশ্লেষণ করে? না কি ঘটনাপরম্পরার অন্তর্নিহিত সূত্র দেখে?
(কিছুক্ষণ নীরবতা। কোরাস নিঃশব্দে মৃদু গায়—‘আধারে আলোর খোঁজ, ন্যায়ের নামে কৌশল’)।
আজ, আমি এই আদালতের সামনে এ দাবি করিয়া বলি— দূর্যোধন ছিল শক্তিশালী, হয়তো উদ্ধত, কিন্তু সে এক বিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে চলিয়াছিল। সে রাজবংশের উত্তরাধিকারী, যাঁহার রক্তে প্রবাহিত রাজনীতি, ক্ষমতা ও বিধির বোধ। সে কখনো দ্রৌপদীর রক্ষাকর্তা ছিল না, যুধিষ্ঠিরই ছিলেন এবং যখন সেই রক্ষাকর্তা নিজেই রক্ষিতার উপর অধিকারের ত্যাগ করেন, তখন দূর্যোধনের অবস্থান হয় না অপরাধীর, হয় ঐতিহাসিক কার্যকারণের এক পরিণতি।
কোরাস (ছায়ার মতো পেছন থেকে)
‘নীতি কার? ধর্ম কার?
কে অপমানিত, আর কে অপমানের বর্ণনাকার?
সত্য বহু মুখোশ পরে—
আর আইন খুঁজে নিয়মের শিকড়।
(আলো নিভে আসে। মঞ্চে এক জটিল স্তব্ধতা নেমে আসে। দ্রৌপদীর দৃষ্টি কঠিন, চোখে ঝলসে ওঠা রাগ আর এক অদৃশ্য প্রশ্ন। বিচারপতি চুপচাপ বসে থাকেন, যেন তিনি সময়কে অনুভব করছেন।)
দৃশ্য- ৪ (২): বাদীপক্ষের প্রতিক্রিয়া
(আলো জ্বলে উঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী। তাঁর দৃষ্টি স্থির, হাত ন্যায়বোধের ভাষায় আন্দোলিত। মৃদু কোরাসের সুরপটে তিনি শুরু করেন।)
বাদীপক্ষের আইনজীবী : (আভিজাত্যপূর্ণ ভাষায়, ধীর কিন্তু শাণিত উচ্চারণে) মহামান্য বিচারপতি, সভার মহান সদস্যবৃন্দ এবং সকল দ্রষ্টা, যাঁরা ইতিহাসের এই অনুপম মুহূর্তের সাক্ষী—একটি সভ্যতার প্রকৃত মুখ তার আদালতে প্রতিফলিত হয় এবং এই আদালত কি শুধু শাস্ত্রের বিধানে চলে? না কি সে উত্তরাধিকার বহন করে মানবতার সূক্ষ্ম এক সুরকে? আমি আজ এই আদালতে দাঁড়িয়ে বলি—যদি কোনো সমাজের শাসনব্যবস্থা এক নারীর স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে ‘পরাজিত দ্রব্য’ রূপে গ্রহণ করে, তবে সেই সমাজ ইতিহাসে টিকে যায় না, সে লুপ্ত হয়।
হে সভ্যবৃন্দ, এক রাজার পাশায় পত্নী হারানো কোনো ধর্মীয় বা বৈধ ক্রিয়া নয়। এটি তার অসদ্ব্যবহার, এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্যচ্যুতি। এখন প্রশ্ন উঠবে— যুধিষ্ঠির কি দ্রৌপদীর উপর অধিকার রাখেন? আমি বলি—না। অধিকার কখনো ভোগের সূত্রে জন্মায় না। অধিকার জন্মায় দায়িত্বের মাধ্যমে, ভালোবাসার মাধ্যমে, সম্মানের মাধ্যমে। যদি একজন রাজা নিজ পত্নীকে, যিনি একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী, জুয়ার বোর্ডে রাখেন, তবে তার সেই স্ত্রীর উপর আর কোনো নৈতিক অধিকার থাকে না এবং সেই পত্নীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় না তার পতনের দ্বারা। ক্ষুণ্ন হয় সমাজের নৈতিকতার স্তম্ভ।
হে বিচারপতি, বিদ্বান প্রতিপক্ষ বলিলেন—‘দ্রৌপদী হৃত, সুতরাং দাসী, সুতরাং অধিকারবদ্ধ’। আমি বলি—যদি এক নারী স্বীয় সম্মতি ব্যতিরেকে ক্রীড়ার উপকরণ হন, তবে সেই ‘জয়’-এর পেছনে নেই গৌরব, আছে অপমানের তীক্ষ্ম ছায়া। জিজ্ঞাসা করি— দ্রৌপদী কি খেলায় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন? তিনি কি সম্মতি দিয়াছিলেন নিজেকে দান করিতে? একজন মানুষ কি অপরকে সম্পত্তির মতো হরণ করতে পারেন? হে সভা, আইন যখন ন্যায়ের থেকে বিচ্যুত হয়, তখন সে হয় নিঃসঙ্গ— এবং সেই নিঃসঙ্গ আইনেই জন্ম নেয় ‘ধর্ম নামে দুর্বৃত্ততা’। যে আইন দ্রৌপদীর রক্তবর্ণ বস্ত্রকে নিষ্পাপ ঘোষণা করে, সে আইন নয়, সে পাপের অনুবাদক।
হে সভ্যবৃন্দ, আজ যদি আমরা এই সভায় নিঃশব্দ থাকি। যদি আজ এই অপমানকে আমরা যুক্তির মোড়কে ঢাকি। তবে আগামীকাল কত দ্রৌপদী আরও জন্মাবে? আজকের রায় হবে কেবল এক মামলার রায় নয়, এটি হবে এক সভ্যতার পটভূমি রচনার বীজরোপণ।
তাই বলি—দূর্যোধনের এই কর্ম অধর্ম, অমানবিক, অবমাননাকর। এর প্রতিকার চাই। ন্যায় না দিলে, ন্যায় হারাবে। ন্যায় হারালে সভ্যতা নিঃস্ব হবে। ‘যে সভা এক নারীর চিৎকার শুনেও নীরব, সে সভা রাজার নয়, কেবল কালের শ্মশান।’
(পেছনে পিয়ানোর ধীর এক নোট বাজে। আলো কিছুটা গাঢ় হয়। আইনজীবীর কণ্ঠে ক্ষোভ ও শুদ্ধতার মিশ্র তেজ।)
আমি বলি—এই বিচার এক দূর্যোধনের নয়, এই বিচার এক সমাজের; এক দৃষ্টিভঙ্গির; এক অন্ধ মানসিকতার। দ্রৌপদী কেবল নারী নয়, সে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সকল নারীর মুখপাত্র হয়ে যাঁরা প্রতিদিন হারে নিঃশব্দ সমাজের বিপরীতে, বিধির নামে অসত্যের কাছে।
হে বিচারপতি, আপনার রায় শুধু এক ব্যক্তির নয়, এ রায় হবে সময়ের দিকে মুখ তুলে বলার অঙ্গীকার। যদি এই আদালত এই প্রতীকী বস্ত্রহরণের প্রতিবাদ না করে, তবে সে আজীবন এক ‘সভা’ নামক ভয়াবহ নীরবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে। বলুন, হে সভ্যবৃন্দ— দ্রৌপদীর চিৎকার কি এক নারীর ছিল? না কি সেটি ছিল আমাদের বিবেকের ডাক?
(আলো নিভে যায়। মঞ্চে গম্ভীরতা নেমে আসে। ধর্মরাজের মুখ ক্লান্ত, ভাবনাচূর্ণ। দূর্যোধনের চোখে বিরক্তির আগুন, আর দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে আছেন—ভঙ্গিমায় যেন পৃথিবীর সমস্ত শোক এবং সমস্ত ঔজ্জ্বল্য একসঙ্গে জমাট।)
দৃশ্য - ৫: ধর্মরাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব
(আলো ধীরে জ্বলে ওঠে। অন্ধকার মঞ্চের মাঝখানে এক উঁচু আসনে বসে আছেন ধর্মরাজ। তাঁর চারপাশে অস্থির আলোছায়া। পেছনে গাঢ়, মৃদু কোরাস—এক ধীর গীত ‘ধর্ম দ্বিধাগ্রস্ত, ন্যায় নিঃসঙ্গ’)।
ধর্মরাজ (বিচারপতি) : (ধীর, গম্ভীর, ভেতরের পীড়ায় কাঁপা কণ্ঠে)
আমি কে? ধর্মের ধারক? না কি এক নিঃসঙ্গ শাসক— যিনি বিধানের পৃষ্ঠার নিচে লুকিয়ে রাখেন মানবতার কান্না? আমি বিচার করি— অথচ আজ হৃদয় কাঁপে... গম্ভীর শ্লোকের ছায়ায় এক নারীর উন্মার্গিত চোখ ভাসে।
হে অন্তরাত্মা! বলো, এই ন্যায় কি সত্যিই ন্যায়? নাকি এ এক পাণ্ডিত্যনির্ভর নিষ্ঠুরতা— যেখানে নারী হয়ে ওঠে কেবল এক সিদ্ধান্তের বিষয়, এক নিঃশব্দ প্রতীক? (পেছনে দ্রৌপদীর অস্ফুট আর্তনাদ ধ্বনিত হয় ু ‘ধর্ম, আমি কোথায় দাঁড়িয়ে?’) যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—‘আমি তাঁকে হরণ করিয়াছি, তিনি আর আমার নন।’ দূর্যোধন বলিলেন—‘তবে তিনি আমার।’ এই লেনদেনে কি মানুষ থাকে? না কি সে হারায় স্বত্বা, স্বর, সত্তা? আমি বলি— যদি এক নারী নিজের সম্মতির বাহিরে কোনো খেলায় বাজি হয়, তবে সেই খেলা ধর্ম নহে, তা হয় এক অঘোষিত যুদ্ধ, যেখানে জয় মানে বিকৃতি, আর হার মানে পাপ।
(আলো আরো নিবিড় হয়, যেন চিন্তার ভারে ভারাক্রান্ত মঞ্চ। ধর্মরাজ উঠে দাঁড়ান। চোখ মেলেন আকাশের দিকে। সুর একটানা তীব্র হয়।)
হে বিধি, হে শাস্ত্র! তোমরা কি জানো এই সভা কতটা নির্বাক? কতটা ঠান্ডা? এবং এই ঠান্ডা কি কেবল নিয়মের শান্ততা? না কি পাপের পরম নিরবতা? আমি বিচার করিব, কিন্তু কিসের ভিত্তিতে? গ্রন্থের বর্ণানুক্রমিক নিয়মে? না কি দ্রৌপদীর চোখের জ্বলন্ত আগুনে?
(তিনি নিজেই নিজের দিকে ফিরে তাকান—নিজস্ব মুখোমুখি। এক মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তি—যেন দুই ধর্মরাজ কথা বলছেন একে অন্যকে। আলো দুদিক থেকে আসে।)
(প্রথম স্বর, বিধির স্বর) : ‘বিচার হোক নিয়মমাফিক, যুক্তির পরম্পরায়, ধর্মের ধ্বজায়। ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ।’
(দ্বিতীয় স্বর, হৃদয়ের স্বর) : ‘কিন্তু চোখে আমি যা দেখি, কাননে আমি যা শুনি, সে কি তোমার শাস্ত্র জানে?’
ধর্মরাজ (বিচারপতি) : দ্রৌপদী কাঁদছে, সভা নীরব, দূর্যোধন হাসছে, এ কোন ধর্ম! যেখানে ন্যায়ের মুখে কেবল পাণ্ডিত্যের মুখোশ?
কোরাস (দূর থেকে, ধ্বনি যেন দ্বিধার মন্ত্র)
‘বিচার কি নিঃস্পন্দ?
নাকি সে প্রাণময়?
গ্রন্থ বলে যা ধর্ম,
হৃদয় তা মানে নয়।’
ধর্মরাজ : (চূড়ান্ত মনোলোকে নিমজ্জিত, ধ্বনি যেন বজ্রের মতো) আমি আজ নিজেকে কাটাছেঁড়া করবো। আমাকে চাই না আর ‘বিচারপতি’ রূপে, আমি চাই মানবপতি হই, বিবেকের এক সেতু হই। যদি এক নারী সভার মাঝখানে হরণ হন, আর সভা চুপ থাকে, তবে সে সভা মরণপ্রায় এবং বিচারক যদি কেবল বিধির দাস হন, তবে সেই বিচার হয় গৃহহীন।
আমি বলি—বিচার তখনই ন্যায় হয়,যখন তাতে হৃদয় কাঁপে। যখন একজন নারীকে দেখে কাঁপে একটি সভ্যতার ভিত। আমি আজ কাঁপছি এবং সেই কাঁপনই আমার রায় হবে।
(আলো ধীরে নিভে যায়। পেছনে দ্রৌপদীর আর্ত স্বর একবার ধ্বনিত হয়—)
‘হে ধর্ম, তুমি কী কাঁদতে পারো?’
(কোরাস সেই আর্তনাদকে সুরে রূপ দেয়।)
দৃশ্য- ৬: বিবেকের সাক্ষ্য
মঞ্চবিন্যাস: আলো ধীরে স্পষ্ট হয়। বিচারমঞ্চে ধর্মরাজ নিঃশব্দ, অস্থির। চোখে গভীর দোলাচল। মঞ্চের একপাশ দিয়ে প্রবেশ করেন বিদুর—ধবধবে বসন, বেদগ্রন্থসম পুঁথি হাতে। আর একদিকে নারদ মুনি—বক্ষে বীণা, কপালে তিলক, যেন এক কালচিহ্ন ধারণকারী সাক্ষী।
ধর্মরাজ : হে মহামতি বিদুর, রাজনীতির মহাজ্ঞানী, নীতিশাস্ত্রের ধারক— বলুন, এই অমঙ্গল মুহূর্তে ধর্ম ও ন্যায় কোথায়? দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কি ছিল শাস্ত্রসম্মত? নাকি এ সভা এক মহাপাতকের সহযাত্রী?
বিদুর : (দীর্ঘনিঃশ্বাসে, ভারসাম্যপূর্ণ অথচ তীক্ষ্ম উচ্চারণে) হে ধর্মের প্রতিভূ, সভ্যতার এ অবক্ষয়দগ্ধ সময়ে আমি কেবল একজন প্রত্নস্মৃত পুরুষ, যিনি দেখে এসেছেন ধ্বংসের পূর্বলক্ষণ। শ্রবণে রাখুন, যে সভা নারীকে দ্রব্যে রূপান্তর করে, সে সভা আর্য ন্যায়চর্চার উপযোগী নয়।
দ্রৌপদী—সা কৌন্তেয়ানাম সহধর্মিণী, পত্নী, রাজমাতা, বেদবাক্যে স্বীকৃত পবিত্রা...
তাঁহার বস্ত্র হরণ মানে শুধু তাঁর অপমান নয়, আর্যধর্মের অলিখিত শপথের অপচ্যুতি। হে সভাসদগণ, ধর্ম যদি কেবল ‘উক্তবাক্য’-নির্ভর হয়, তবে সে ধর্ম ব্রাহ্ম নয়, সে কেবল এক শুষ্ক সূত্র, যেখানে হৃদয় নিষিদ্ধ এবং বিবেক নির্বাসিত।
(মঞ্চে নিস্তব্ধতা। বিদুর চোখ তুলে সভার দিকে চায়। কণ্ঠে প্রবল গম্ভীরতা ও প্রজ্ঞার দীপ্তি।)
আমি বলি—যিনি ধর্মের ব্যাখ্যায় নারীকে ‘পরবস্তু’ করেন, তিনি শাস্ত্রজ্ঞ নন—তিনি অপরাধী। দূর্যোধন যে ব্যভিচার করিয়াছে, তা কেবল ব্যক্তিগত পাপ নয়— তা রাজনীতির আত্মহত্যা এবং যে সভা চুপ থাকে— সে সভা ‘সভ্যতা’ নাম ধারণের অধিকার হারায়।
কোরাস (মৃদু সুরে)
‘যে ন্যায় হৃদয় ছাড়া চলে,
সে শাস্ত্র নয়—সে কারাগার।
যে সভা নীচে নত হয়,
তার ওপর উঠে পাপের ভার।’
বিচারপতি : (গভীর কণ্ঠে) হে নারদ, আপনি ঋষিদের শ্রেষ্ঠ, তপস্যার অগ্নিমূর্তি, বলুন—এই সভ্যতা, এই সভা, এই বিচারের ভিত্তি কোথায় পথ হারাল?
নারদ মুনি : (কণ্ঠে বিষাদ ও ব্যঞ্জনা মিশ্রিত, অলঙ্কারময় শুদ্ধ সংস্কৃতঘেঁষা বাংলায়) হে ধর্মরাজ, জ্ঞাত হোন—ধর্ম সর্বদা বহুমাত্রিক। সে কেবল ‘লিপিবদ্ধ বিধান’ নহে, সে এক চৈতন্যপ্রবাহ। যেখানে হৃদয়, বিবেক, বোধ ও সৎসঙ্কল্প একত্রিত হয়। কিন্তু আজ, এ সভা সাক্ষাৎ কলির অঙ্গন হয়ে উঠিয়াছে। কুরুচি ও কৌশলের সম্মিলনে ‘ধর্ম’ আজ পরিণত হইয়াছে এক বিচারহীন আচ্ছন্নতায়।
(নারদ উঠে দাঁড়ান, তাঁর দৃষ্টি শূন্যের দিকে, যেন তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎ একত্রে দেখতে পাচ্ছেন।)
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কেবল একটি নারী লাঞ্ছনা নহে, ইহা হইল ঋষিঋণ, পিতৃঋণ ও ধর্মঋণের অপমান। আর্য সভ্যতা কখনো নারীকে বস্তু জ্ঞান করেনি। শ্রুতি বলে— ‘যত্র নার্যস্ত পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতা।’ আজ দেবতারা কাঁদিতেছেন, কারণ তাঁদের পূজনীয়া সভার মধ্যে অপমানিত।
(নারদ থামেন। একটি দীর্ঘ, অতলনীয় নিরবতা মঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে। পেছনে বাজে স্তব পাঠের ধ্বনি মৃদু)
কোরাস (ধীরে, বিষাদে পূর্ণ)
‘যে সভা বিবেক ভুলে,
সে সভা শূন্যতায় ডুবে।
যেথা নারীর গৌরব নাহি,
সেথা ন্যায় কখনও রহে না।’
বিচারপতি : (চোখ বন্ধ করে, নিচু গলায়) আমি শুনিলাম এবং শুনিয়া কাঁপিলাম। আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করিব। কিন্তু সেই ন্যায় হইবে কেবল বিধানের নয়, আত্মার অন্তর্জাগরণের ভিত্তিতে।
(আলো ধীরে নিবে যায়। কোরাসের সুর এক চেতনাপূর্ণ স্তব গানে রূপ নেয়।)
দৃশ্য- ৭: কৃষ্ণের আবির্ভাব
মঞ্চবিন্যাস: আলো নিস্তেজ—ছায়া ও আলো মিশ্রিত। সপ্তম সুরের মৃদু ধ্বনি, গম্ভীরতা ও শক্তি অনুভূত হয়। দ্রৌপদী, ধর্মরাজ, বিদুর, নারদ, সবেই অস্থিরতা— যতক্ষণ না শ্রীকৃষ্ণ অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন, তাঁর উপস্থিতি যেন আলোকময় আভা।
বিচারপতি (ধর্মরাজ) : (অভিভূত, গম্ভীর ও আভিজাত্যপূর্ণ কণ্ঠে) হে দ্বারকাধীশ, তুমি যাঁর আগমনে ঘর আলোয় মুখরিত হয়। আজ তোমার নীরবতা যেন পুরো পৃথিবীকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তুমি না বললেও, তোমার নিরব উপস্থিতি হাজারো কথা বলে যায়। তুমি যে ন্যায়বিচারের আদর্শ, তবুও, আজ তোমার নিরবতা কেন? আমরা কি তোমার আশ্রয়ে হারিয়ে গেছি, নাকি আমরা ভুলে গেছি শাস্ত্রের সত্য? (কৃষ্ণ চোখে চোখ রাখেন—কোনো শব্দ নেই।)
দ্রৌপদী : (কণ্ঠে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রতিরোধের শক্তি, চোখে অগ্নি, ভাষায় একসঙ্গে আবেগ ও শক্তি) হে মাধব, আপনি যে চিরকাল ধরে এক অনন্ত শক্তি, আপনার নীরবতাই তো আমার কাছে এক মহাশক্তি। যখন ন্যায় তবু নির্বাক, যখন সম্মান সবই চুরি যায়, তখন কেবল আপনার উপস্থিতিই আমাদের শেষ আশ্রয়। হে কৃষ্ণ, আমি জানি— আপনি নিঃশব্দে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আছেন, আপনি মূর্তির মাঝে নেই, কিন্তু আপনার অক্ষয় শক্তি আমার অন্তরকে পূর্ণ করে। আপনি নেই, তবু আপনি আছেন। আপনিই আছেন আমার সাহসে, আপনিই আছেন আমার অনুশোচনায়। আপনি কৃপাসিন্ধু, আপনি বিশ্বপালক, আপনার হাতের আঙুলেই জীবন, মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। কিন্তু আপনি যেভাবে সমগ্র সভাকে ধ্বংস করেন, তেমনি চুপচাপ শান্তভাবে ঠিকই আপনি সবার অন্তরকে জাগ্রত করো।
(দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে, চোখে দীপ্তির এক শপথ; কৃষ্ণের দিকে মাথা নত করে)
হে শ্রীকৃষ্ণ, আমি কেবল সেই নারী নই, যাকে তাদের ধ্বংসের অভ্যন্তরীণ প্রয়াসে ব্যবহৃত হতে চেয়েছিল, আমি সেই নারী, যাকে আপনি নীরবেই ঐশ্বর্যের আসনে বসিয়েছেন। আজ যখন আমার সম্মানহানি ঘটেছে, আমি জানি আপনি একেবারে নিঃশব্দে এসে দেখেছেন— তবু আমি আপনার প্রেমের কাছে অস্থির। আপনি সত্তার সর্বোত্তম রূপ— আপনি, যিনি নিজের আবির্ভাবেও বিশ্বময় অন্ধকারকে অতিক্রম করেন।
(কৃষ্ণের দিকে এক দীর্ঘ চাহনি, তারপর দ্রৌপদী ফিরিয়ে নেন তাঁর দৃষ্টি)
কোরাস
(শব্দবিহীন, মন্ত্রময় ধ্বনি)
‘যিনি নীরব, তিনি সর্বজ্ঞ,
যিনি প্রেমে পূর্ণ, তিনিই সকল কষ্টের শান্তি।
কৃষ্ণের শান্তির তরে,
আমরা ক্ষুদ্র অথচ অসীম হয়ে উঠি।
পৃথিবীর বিশালতা ফিকে,
যখন তুমিই ধ্বংসের পর পুনরুত্থান ঘটাও।’
ধর্মরাজ : (অত্যন্ত গভীর শ্রদ্ধা ও দুঃখের সহিত, ন্যায়বিচারের প্রতি আত্মসমর্পণ) আপনার নিঃশব্দ উচ্চারণেই আমাদের অগোচর হৃদয়ে বিশ্বাস জন্মায়, তোমার চুপি চুপি হাসিতে, চিরকালীন সত্য উপলব্ধি হয়। আমরা, দৃষ্টিহীন, ন্যায়বিচারের পানে হারিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আপনি একপ্রকার নিঃশব্দে আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছো। আমি এখন বুঝি— যে ন্যায় শব্দ দিয়ে সম্বোধিত হয় না, সেই ন্যায় শুধু এক মহাশক্তি।
(আলো ধীরে কুয়াশার মতো ঘিরে নেয় কৃষ্ণকে, তিনি অনন্ত রূপে ম্লান হয়ে যান, দ্রৌপদী নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকেন।)
দৃশ্য - ৮: সভার পণ্ডিতদের বিতর্ক
মঞ্চবিন্যাস: সভাস্থল—গভীর আলো এবং ছায়ায় ঘেরা। ধর্মরাজ কেন্দ্রস্থলে; একদিকে রাজপুরোহিত, অপরদিকে রাজনীতিক চিন্তক, অন্যদিকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ। চতুর্দিকে শ্রোতৃমণ্ডলী—চোখে উৎসুক জিজ্ঞাসা।
প্রথম পণ্ডিত : (উচ্চ স্বরে, ধ্রুপদী ঘরানায়) ধর্মঃ স নি:শ্চলঃ, শাশ্বতঃ আপেক্ষিক নহে। যার ভিত্তি বেদে, উপনিষদে, সেই ধর্মকে উপেক্ষা করিয়া কোন বিধান, কোন সভা, কোন রাজনয়! যখন নারী লাঞ্ছিত, তখন ধর্ম লাঞ্ছিত। ধর্ম লাঞ্ছিত হইলে বিধানের কী অস্তিত্ব থাকে? (দৃষ্টি দিয়ে দূর্যোধনের আইনজীবীর দিকে তাকান) শাস্ত্রে বলা আছে— ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে, রমন্তে তত্র দেবতা’ তবে সভার সম্মুখে দ্রৌপদীর অবমাননার পরে দেবতারা কাঁদেননি— এমন কি রাজনীতি তাতে চুপ?
দ্বিতীয় পণ্ডিত :(রাজনীতিক পরামর্শদাতা, স্পষ্ট উচ্চারণে, যুক্তিনিষ্ঠ গাম্ভীর্যে) কিন্তু হে ব্রাহ্মণ, রাজ্যের চলন শাস্ত্রের অনুবর্তী নয়, রাজ্য চলে প্রথা ও রাষ্ট্রীয় চুক্তির রীতিতে। দ্রৌপদী যখন পণরূপে হারানো হইলেন, সে ছিল ধর্মীয় অবিচার, কিন্তু তা ঘটিয়াছে অনুমোদিত নিয়মের মধ্য দিয়া আর রাজনীতি সর্বদাই বাস্তববাদী। সে মূল্যায়ন করে ফল, অভিপ্রায় নয়। (একটু থেমে) আপনি বলিলেন নারীর পূজা; কিন্তু প্রশ্ন হইল, কাহার দ্বারা? নারীর মর্যাদা কি কেবল ধর্মের শ্লোকে থাকবে, নাকি রাষ্ট্র তাকে আইনি স্বীকৃতি দিবে?
তৃতীয় পণ্ডিত : (বেদজ্ঞ ও ন্যায়শাস্ত্র বিশারদ, গভীর জ্ঞানগর্ভ স্বরে, দার্শনিক নিরীক্ষণে) এখানে দ্বন্দ্ব নয়, বিপরীতের মিলন আছে। ধর্ম ও বিধান পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। একে অপরকে শুদ্ধ করে। রাজনীতি হইতে পারে ধর্মবিচ্যুত, কিন্তু রাজনীতিকে ধর্মবর্জিত বলিলে রাষ্ট্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দ্রৌপদীর অবমাননায় শাস্ত্র লঙ্ঘিত হইয়াছে— এ সত্য, কিন্তু সেই লঙ্ঘনের বিচার কেবল রাজনীতির দ্বারা সম্ভব নয়, ধর্মই সেখানে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। বিধান যদি ধর্মহীন হয়, তবে সে এক নির্যাতনের শৃঙ্খল মাত্র।
প্রথম পণ্ডিত : (অগ্নিবর্ণ উচ্চারণে, বেদপাঠের ছায়ায়) যখন সভায় নারী লাঞ্ছিত হয়, তখন দেবতারা লজ্জায় মুখ ঢাকে। হে সভাসদগণ, ‘অধর্ম’ শুধু একটি শব্দ নয়। এটি এক দহনশক্তি, যা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। দ্রৌপদী কেবল এক নারী নয়, সে আর্যের চেতনার প্রতীক। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’—এই যে আমাদের ধর্মবোধ, সেখানে নারীকে বস্তুরূপে বিবেচনা কিভাবে হয়? বিধান যদি ধর্মের দাস না হয়, তবে রাজসভা পিশাচসভার সমান।
দ্বিতীয় পণ্ডিত : (শান্ত গাম্ভীর্যে, কৌশলী ভঙ্গিতে) আপনার আবেগ শ্রদ্ধেয়, কিন্তু রাজনীতি চলে নীতির বিধানে, আবেগে নয়। দ্রৌপদী হারিয়েছেন— কিন্তু পণ খেলা অনুমোদিত ছিল, সকলেই তাতে সম্মত ছিলেন। রাজ্য পরিচালনা করতে হলে অনুভব নয়, বিচার প্রয়োজন। আপনারা বলছেন ধর্ম, কিন্তু ধর্ম কাহার? প্রভুর? প্রজার? নারীর? নাকি পুরুষের? যদি ধর্ম হয় ব্যক্তিগত অনুভব, তবে তা দিয়ে রাষ্ট্র চলে না। রাষ্ট্র চলতে পারে কেবল সেই বিধানে, যা সকলের উপরে সমানভাবে প্রয়োগ হয়।
তৃতীয় পণ্ডিত : (শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে, চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে) শাস্ত্র বলে— ‘ধর্মঃ ত্র্যশনঃ, বিধিঃ প্রদীপঃ’ ধর্ম আমাদের অভ্যন্তরের আলো, বিধান সেই আলোর বাহ্যিক রূপ। কিন্তু যখন প্রদীপটিই নিভে যায়, তখন শাস্ত্র নির্জন ধ্বনি মাত্র। আমি জিজ্ঞাসা করি— যদি একজন রাজা দাসত্বে পতিত হয়, তবে সে কি তার স্ত্রীকে অধিকার করে পণ রাখিতে পারে? ন্যায়ের ভিত্তি যদি শূন্য হয়, তবে ন্যায় কি শূন্য হয় না? নারী কেবল সংসারধর্মের আধার নয়, সে ধর্ম নিজেই।
চতুর্থ পণ্ডিত : (ধর্মশাস্ত্র বিশারদ, বিতর্কপ্রবণ, তীব্র বাচনভঙ্গিতে, যুক্তির তীক্ষ্মতায়) হে বেদজ্ঞ! আপনি বলিলেন ‘ধর্ম স্ত্রী’— কিন্তু ধর্ম কি কেবল নারীত্বে নিহিত? শাস্ত্র কি বলে নাই— ‘স্ত্রীধনং পতিসংযুক্তং’— অর্থাৎ স্ত্রীর দানও স্বামীর অধীন। আপনি কি ভ্রান্ত মায়ায় ধর্মকে আবৃত করছেন না? যদি ধর্ম হয় অনুভব, তবে তা হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খলা। রাষ্ট্রে চাই দৃঢ়তা— নির্দিষ্ট বিধান, যেখানে ব্যক্তি নয়, নীতি প্রাধান্য পায়। অন্যথায়, প্রতিটি ব্যথা একেকটি আইন হইয়া উঠিবে। আমরা কি চাই এক প্রতিশোধপ্রবণ সমাজ? নাকি একটি সুবিন্যস্ত ন্যায়ের সমাজ?
পঞ্চম পণ্ডিত : (দার্শনিক স্বভাবের, মৃদু সুরে, অথচ চরম তত্ত্ববোধে ভরপুর) যদি নারী হারায় তার মর্যাদা, তবে সমাজ হারায় তার আত্মা। রাজনীতি হোক না প্রথানুগত, কিন্তু সে যেন না হয় হৃদয়বিমুখ। পাণ্ডবদের মৌনতা, সভার নীরবতা— এগুলিই প্রমাণ যে ধর্ম কোথাও হেঁটেছে। বিধান যদি অধর্মকে বৈধতা দেয়, তবে সেই বিধানকেও প্রশ্ন করা উচিত। শাস্ত্র কেবল শ্লোক নয়—শাস্ত্র এক জীবন্ত দর্শন। ওহে সভাসদগণ! আমাদের নীরবতা ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করতে পারে— তাই সময় এসেছে মুখ খুলবার, যুক্তির নামে নয়, ধর্মের নামে।
ধর্মরাজ :(অন্তর্দ্বন্দ্বে ভরা, পীড়িত কিন্তু উচ্চ মেজাজে) যে শ্লোক ধর্মকে জায়, সেই শ্লোকই যদি ধর্মকে গিলে খায়, তবে আমরা আর্য নই, ছদ্মবেশী। আমি তো ধর্মরাজ— অথচ আজ অনুভব করি এক বেদনার রাজ্য। কি করিব আমি? বিধান শুনিব? না অন্তরের ধর্ম? বলুন পণ্ডিতগণ— এক নারী লাঞ্ছিত, সকলেই দেখিলন, কেহ বলিলেন না। ধর্ম কী? মূক থাকিবার নিয়ম? নাকি জ্বালামুখী হয়ে উঠিবার দাহ?
দৃশ্য - ৯: দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা ও সভার স্তব্ধতা
মঞ্চমধ্যে আলোক একমাত্র দ্রৌপদীর মুখে। বাকিরা স্তব্ধ।
দ্রৌপদী : (সমগ্র সভার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বলেন) ওহে সভার পণ্ডিতগণ, রাজপুরুষগণ, ধর্মবিধির ধারকগণ! উত্তর দিন— কে লিখে দেয় নারীর মর্যাদা? কে স্থির করে দেয় কোন মানবীকে সভায় টেনে আনতে পারেন আর কোনটিকে পূজা করবেন? যদি ধর্ম হয় এক পাণ্ডুলিপি, তবে তা কেন আজ অধর্মের হাতিয়ার? যদি রাজ্য হয় জনসম্মতির প্রতিচ্ছবি, তবে তার ন্যায় আজ নিঃশব্দ কেন? আমি জিজ্ঞাসা করি— বিধান কি সেই, যা ন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে? যেখানে পুরুষ সভায় নারীর বস্ত্র হরণ করে আর পণ্ডিতেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই সভা আর্যসভা নয়, সেই সভা পাপসম্ভবের নরককুন্ড। যে রাজ্য নারীর সম্মান রক্ষা করতে পারে না, সে রাজ্য শাসন করে কিসের ভিত্তিতে? ধর্ম যদি চোখ বুজে থাকে, রাজনীতি যদি অন্যায়ের পাশে বসে— তবে আমি সেই ধর্মের শত্রু, আমি সেই বিধির ভাঙন।
আজ আমি ধ্বংস চাই না— আমি চাই বিবেকের জন্ম। আমি চাই, রাজ্যের প্রতিটি প্রাচীর থেকে সত্যের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হোক। শুনে রাখুন! আমি দ্রৌপদী— কেবল স্ত্রী নই, আমি প্রশ্ন। আমি সেই প্রশ্ন, যা ধ্রুবতারা হয়ে সভার মাথায় চিরকাল জ্বলবে। আর যদি আজও ন্যায় না জাগে— তবে আমি, এক লাঞ্ছিতা নারী, আর্যভূমির গর্ভে অধর্মের মৃত্যু লিখে দেব। আজ নয়, কাল নয়, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী থাকবে— দ্রৌপদী একবার লাঞ্ছিত হয়েছিল, আর সভ্যতা শপথ নিয়েছিল তাকে জবাব দিতে।
কোরাস (ধীরে ধীরে গম্ভীর সুরে)
‘ধর্মের পৃষ্ঠা আজ রক্তাক্ত,
বিধানের পংক্তি ধূসর।
এক নারী জেগে ওঠে,
সভ্যতার দিকচক্রবাল কাঁপে।
ন্যায় যদি নিঃশব্দ হয়,
প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় দ্রৌপদী।
শ্রুতি, স্মৃতি, বেদ—
সবাই তার মুখে প্রতিফলিত হয়—
একা নয় সে,
সে একটি কালচক্র।’
দৃশ্য- ১০ (১): রাজনীতি ও বিধানের মুখোশ
স্থান: একটি উজ্জ্বল ও পূর্ণাঙ্গ আদালত কক্ষ, যেখানে বিচারকগণ, আইনজ্ঞরা, পণ্ডিতরা, এবং সাধারণ দর্শকরা উপস্থিত। সকলেই নিশ্চুপ এবং গভীর মনোযোগী। দ্রৌপদী এবং দূর্যোধন দুটি প্রধান চরিত্র, একে অপরকে শক্তির সাথে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে।
দূর্যোধন : (একটু কটাক্ষপূর্ণ ও বিজয়ের আনন্দ নিয়ে) প্রিয় রাজনন্দীনী দ্রৌপদী, আপনি যদি মনে করেন, এ পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি আছে যা আমাদের শাসনকে, আমাদের রাজনীতি এবং বিধান কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তবে আপনার সেই ধারণা মিথ্যা। এখানে, রাজনীতি ও বিধান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, একই সরণির অন্তর্গত। (দূর্যোধনের চোখে এক ধরনের হাস্যরসিকতা, যেন তার ক্ষমতা ও রাজনীতির প্রতি অদৃশ্য আত্মবিশ্বাস রয়েছে।)
দ্রৌপদী : (অত্যন্ত দৃঢ়, গভীর আক্রোশ নিয়ে, মুখে এক সানন্দ রাগ) রাজনীতি, বিধান, শাসন—এগুলি শুধু পুরুষদের খেলা, যেখানে ন্যায় এবং সাম্যের কোনো স্থান নেই। আপনারা, এই যে আপনারা ক্ষমতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, এ সব মুখোশ পরে একে অপরকে মিষ্টি কথায় ফাঁসিয়ে চলেন। (একটু থেমে, গভীর দৃষ্টিতে) আপনাদের এই শক্তির পেছনে কী থাকে, কৌরবরাজ দূর্যোধন? এটা কি বিধান, না কি শুধুই আপনাদের দম্ভ?
দূর্যোধন : (অসহিষ্ণু হয়ে, ক্রোধে ভরা) আপনি ভুল বুঝেছেন পাঞ্চালী। এটি কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর খেলা নয়— এটা জীবন এবং মৃত্যুর খেলা। যেখানে শক্তি বিরাজমান, সেখানে তার শাসন প্রয়োজন। এটা তো আপনারা নারীরা কখনো বুঝবে না— আপনাদের সমানাধিকার কেবল পরিপূরক, ক্ষমতা যখন বাস্তবতা, তখন বিধানই হলো রাজা!
(দূর্যোধনের এই কথায় মঞ্চে কিছু সময়ের জন্য অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে। শ্রোতারা চুপ করে শোনে।)
দ্রৌপদী : (চোখে কঠোরতা, এক কঠিন স্মৃতির মতো) রাজনীতি, বিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা— এগুলি কোথায় ছিল তখন যখন নারীর অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাদের বস্ত্রহরণ হয়েছে, তাদের সম্মান চুরমার হয়েছে? এই বিধান কি শুধু তখনই কাজ করে, যখন শাসকের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু না হয়? না, এই বিধান অসার। এটা শুধুমাত্র শক্তির মুখোশ, যা আপানাদের মুখে স্থাপন করা হয়েছে!
বিদুর : (মঞ্চে উদিত হয়ে, শান্ত ও প্রজ্ঞাময় কণ্ঠে) দ্রৌপদী, তোমার এই বাণী হল সত্য, রাজনীতি এবং বিধান। যদি শক্তির হাতে বন্দি হয়ে যায়, তবে তাদের উদ্দেশ্য থাকে শুধু ক্ষমতা এবং দুর্বিপাকের লাভ। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে— প্রকৃত রাজনীতি এবং বিধান আসে ন্যায়ের সঙ্গে। এটা যদি শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তার কোনো ধর্ম থাকে না। তোমাদের কাছে যা ‘অস্ত্র’, তা আমাদের কাছে অধিকার। (বিদুরের এই কথা মঞ্চে গম্ভীর ভাবনা সৃষ্টি করে, তার বক্তব্যে গভীর উপলব্ধি শোনা যায়।)
দূর্যোধন : (খুবই আক্রোশ নিয়ে, গর্জনময় কণ্ঠে) বিদুর, আপনি যখন নীতির কথা বলেন, তখন মনে রাখা প্রয়োজন, আপনি সেই নীতির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। যেখানে আমাদের শাসন রয়েছে। কোথায় ছিল আপনাদের নীতি, যখন তারা আমার মাটি নিয়েছিল? কোথায় ছিলেন আপনারা, যখন আমাদের রাজ্যকে ছোট করা হয়েছিল? এটা আমাদের রাজনীতি—এটা আমাদের বিধান!
দ্রৌপদী : (নির্ধারিত, গভীর অথচ শান্ত কণ্ঠে) কিন্তু, কৌরবপূত্র দূর্যোধন, আপনি কী জানেন, যখন মিথ্যা রাজনীতি এবং দুর্বিনীত বিধান মানুষের উপর চাপানো হয়, তখন সেই রাজনীতি আত্মসাৎ হয়ে যায় এবং বিধান অপরাধী হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যদি তা মেনে নিই, তবে আমরা হারিয়ে যাবো— আমরা আমাদের মর্যাদা হারিয়ে ফেলবো।
(দ্রৌপদী তার কথাগুলিকে শ্রোতাদের মাঝে প্রবাহিত করতে থাকেন।)
কৃষ্ণ : (বিচারক হিসেবে উদিত হয়ে, এক গভীর প্রজ্ঞাময় কণ্ঠে) এখন আমরা দেখছি, কীভাবে রাজনীতি এবং বিধান একে অপরকে খোঁজে। এদের মাঝে তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে, তবে শেষ পর্যন্ত, একটাই সত্য থাকবে— এটা মানুষকে ন্যায় দিতে হবে, এটা মানুষের জন্য থাকতে হবে।
কোরাস সংগীত-
বিধান যাকে আড়াল করে রেখেছে,
সে যদি প্রমাণিত হয়,
রাজনীতি তার পক্ষে থাকবে না,
তখন সেই বিধান হারাবে,
এবং ন্যায়ই জয়ী হবে।
রাজনীতি শুধু তাস নয়,
বিধান এক খেলার ঝুলি,
কিন্তু সত্যের যুদ্ধে,
ন্যায়ই শেষ অবধি বলবে।
দৃশ্য ১০ (২): রাজনীতি ও বিধানের মুখোশ
(পঞ্চপাণ্ডব মঞ্চমধ্যে। চারদিকে হালকা ধোঁয়া, দূরে দ্রৌপদীর ছায়া। আলো পড়ে একে একে সকলের মুখে।)
যুধিষ্ঠির : (মাথা নিচু, চোখে অন্তর্দ্বন্দ্বের দাবানল) আমি রাজর্ষি! আমি কুরুরাজ্যের শ্রুতিধর নীতিনিপুণ ধারক— অথচ আজ,
এক নারীর ত্রস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আমি এক আত্মপরিত্যক্ত পুরুষ। পাশার খেলায় আমি খেলেছিলাম বিধান নিয়ে, কিন্তু বিধান কি কখনো বিবেকহীন হয়? আমি নিজ হাতে বাজি রেখেছি সেই নারীকে, যিনি আমার ভ্রাতাদের সম্মান, আমার রাজার শিরস্ত্রাণের অমোঘ মুকুট।
আজ সেই নারী আমাকে দৃষ্টিবাণে পোড়ায়। আজ ধর্ম আমাকে নির্দয় প্রশ্নে বিদ্ধ করে। আমি কি তবে কেবল এক পাণ্ডব? না কি আমি সেই দুর্বল পুরুষ, যার নীরবতা এক জাতির দুর্ভাগ্য জন্ম দেয়? হে রাজসভা, হে শাস্ত্রপুথি! যুধিষ্ঠিরের আজ আর কোনও গৌরব নেই— আছে কেবল দ্রৌপদীর অশ্রুজলে ভেজা গীতার শপথ। আমি শপথ করি, যে ধর্ম আজ দ্রৌপদীর পক্ষে নয়, আমি তার ধারক নই, তার বিরোধী।
ভীম : (প্রচণ্ড রোষে, কণ্ঠে বজ্রস্বর) আমি ভীম—অজেয় অঙ্গরাজ্যের মহাবলশালী। কিন্তু আজ দ্রৌপদীর চোখে আমি এক বলহীন পুতুল মাত্র! আমি কেবল দেখি, দূঃশাসনের রক্তাক্ত হাত তাকে ছুঁয়েছে আর আমার মুষ্টি মাটিতে থমকে গেছে বিধানের দোহাইয়ে! বিধান? বিধান যদি অরণ্যের পশুর মতো নারীর গায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে বিধান ধ্বংসযোগ্য। আমি গদা ধারণ করেছি রাজ্যের রক্ষায়, কিন্তু আজ, এক নারীর চোখের জলকে আমি রক্ষা করতে পারিনি। আমি ব্যর্থ, আমি কলঙ্কিত। আমি বলছি, হে ধর্ম, হে আর্যধর্ম! যদি আজ এই নারী নিঃসহায়, তবে আমি তোমার শ্রাদ্ধ করবো আমার হাতে। দ্রৌপদী আমার সম্মান, আমার শপথ। আমি শপথ করি—এই অপমানের রক্ত আমি গদায় ধুয়ে দেবো।
অর্জুন : (স্বরে নিঃশব্দ বিদ্রোহ, চক্ষু অশ্রুসিক্ত) আমি অর্জুন— ধর্মপুত্রের কনিষ্ঠ, শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়, গাণ্ডীবধারী বীর। আমি এক নিমিষে যুদ্ধের রণরথ ঘুরিয়ে দিতে পারি। অথচ আজ, এক অবলা নারীর বস্ত্ররক্ষায় আমি নীরব দর্শক! আমি গাণ্ডীব না তুলেছি, কারণ শাসনের বিধানে সে নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি সে বিধান দ্রৌপদীর অশ্রু দেখে না, তবে আমি তার শত্রু। হে সভ্যতা, যদি নারীকে হারিয়ে তুমিই গৌরবের দাবি করো, তবে সে সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্য। আমি শপথ করি, এই দ্রৌপদীর চোখের কান্না থেকে একদিন বারুদ বের হবে— মহাভারতের আগুন।
নকুল ও সহদেব : (দুজন একত্রে, রাজকীয় শোক ও কঠিন অভিমান) আমরা রাজপরিষদের নীচতম দুই স্তম্ভ, কিন্তু আজ মাথা তুলে দাড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছি। আমরা বলেছিলাম, ‘দ্রৌপদী আমাদের আত্মা’— অথচ আত্মাকে আমরা বাজি হতে দিয়েছি। হে সম্মান, হে বিবেক, হে পুরুষত্ব— আমরা কি সত্যিই পুরুষ? নাকি বিধানের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কিছু কাপুরুষের কঙ্কাল? আজ দ্রৌপদী আমাদের দিকে তাকায় না, তাকায় ইতিহাসের দিকে, যাকে সে নিজ হাতে লিখে যাবে। আমরা তার পাশে নই, আমরা তার পিছনে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছি। এই ইতিহাস আমাদের লজ্জা, আর দ্রৌপদী আমাদের অনন্ত প্রায়শ্চিত্ত। (আলো নিভে আসে ধীরে। সভার স্তব্ধতা বজায় থাকে। দূরে দ্রৌপদী মঞ্চের ধারে দাঁড়িয়ে। মৃদু বাতাসে ওড়না উড়ে যায়।)
দৃশ্য- ১০ (পর্ব- ৩): দ্রৌপদীর প্রতিউত্তর ও ন্যায়যুদ্ধের আহ্বান
(আলো গাঢ়। পঞ্চপাণ্ডবের বক্তব্য শেষে দ্রৌপদী মঞ্চের একেবারে কেন্দ্রে উঠে দাঁড়ান। মাথা উঁচু, চোখ জ্বলজ্বল করছে। সুর গম্ভীর।)
দ্রৌপদী : (স্বরে বজ্রের মতো গম্ভীরতা, বুকে এক গভীর অভিমান) সতীর পথ পাথরের মত— তারে পেরোনো চিতার মতোই কঠিন। আমি দ্রৌপদী— পাঞ্চাল রাজকন্যা, পাণ্ডবপত্নী আর আজ, অপমানের অলিন্দে দাঁড়িয়ে এক নির্মম ন্যায়দেবীর আবেদনকারিণী।
হে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, আপনি যাঁকে ধর্ম বলেন, তিনি যদি এক নারীর সম্মানকে খেলায় বাজি রাখতে দেন, তবে সেই ধর্ম এক নির্জীব বিধানমাত্র। আপনি নীরব ছিলেন— কারণ আপনি বিধি মানেন। আমি জিজ্ঞাসি— যে বিধি অপমান জানে না, সেই বিধিকে মান্যতা দেওয়ার অধিকার আপনাদের কে দিলো?
হে ভীম, আপনি বলের গর্বে বলেছিলেন, ‘আমার রক্ত গদায় চূর্ণ করিবে দুঃশাসনের শির।’ কিন্তু আমি বলি— বীরত্ব তখনই সত্য, যখন তা রক্ষায় ব্যবহৃত হয়— বদলার প্রতীক্ষায় নয়। হে অর্জুন, গাণ্ডীবধারী, আপনি ধর্মসংকটে নিঃশব্দ ছিলেন— কিন্তু যে ধ্যান সত্যের চেয়ে শক্তিশালী নয়, সে ধ্যান এক স্বার্থপর নিস্তব্ধতা। আপনি আমাকে ‘সহধর্মিণী’ বলেন— সহধর্মিণী কি কেবল গৃহে? রাজসভায় নয়? যুদ্ধক্ষেত্রে নয়?
হে সহদেব, হে নকুল— আপনাদের আত্মগ্লানিতে আমি মুক্তি পাই না। আমি চাই না আপনাদের চোখের জল— আমি চাই ন্যায়, চাই যুদ্ধ, চাই প্রতিশোধ।
হে বিচারপতি, আজ আপনি যিনি ধর্মের আসনে বসে আছেন— আমি আপনার প্রতি এক প্রশ্ন রেখে যাবো— যে সভা এক রাজনারীর অপমান দেখেও নীরব, সেখানে কি ন্যায় জন্মায়? না কি সে সভা কেবল রাজনীতির তামাশা? আমি আজ যুদ্ধ ডাকি— এই নিস্তব্ধতা, এই বিধানের মুখোশ, এই পাণ্ডবদের লজ্জা আর কৌরবদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে।
আর হে শ্রীকৃষ্ণ...(চোখ সরু করে দৃষ্টিপাত, স্বরে এক ধ্রুব আশ্রয় ও অপার শ্রদ্ধা) আপনি ছিলেন, আপনি আছেন, আপনি থাকবেনই। আমি আপনার শরণাগত নই, আমি আপনার সাহসের সহচরিণী। আপনি যদি ন্যায়-অগ্নি জ্বালাতে মনস্থির করেন, তবে আমিই সেই অগ্নির ঘৃতাহুতি। মাধব, আমাকে শক্তি দিন— যাতে আমি কাঁদতে না শিখি, যুদ্ধ করতে শিখি।
দৃশ্য- ১১: বিধির ব্যাখ্যা
(মঞ্চজুড়ে নিঃশব্দ গম্ভীরতা। সভার প্রাচীন সদস্যেরা বসে আছেন—গম্ভীর, অবিচল, মনোযোগী। মধ্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে ধর্মরাজ বিচারক আসন গ্রহণ করেন। সভাসদ বিদুর, দ্রোণ, ভীষ্ম এবং কিছু রাজপুরুষ ও পণ্ডিত সম্মানজনক দূরত্বে অবস্থান করেন।)
ভীষ্ম : (গভীর কণ্ঠে, উচ্চ মার্গীয় ভাষায়) বিধি কি? সে কি শাস্ত্রে লিখিত যে বর্ণ ও বর্ণাশ্রমের সীমারেখা অতিক্রম করিলে লাঘব ঘটে ন্যায়ের? আমি ভীষ্ম, গঙ্গাপুত্র, আজ স্পষ্ট উচ্চারণে বলি— এই সভায় বিধান বলেছে দ্রৌপদী পত্নী নহে, দাসী। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসি— বিধি কি হৃদয়কে জানে? বিধি কি বিবেককে স্পর্শ করে? এক নারীকে নগ্ন করার অধিকার কাহার? এক সভা যদি মৌন থাকে, তবে সে সভা মৃত। এক রাজা যদি অন্যায়ের পাশে দাঁড়ায়, তবে সে রাজ্য পচে। আমি দেখিয়াছি রাজনীতি— সে এক বিষধর সর্প, যার ফণার নাম ‘ধার্মিক মুখোশ’। আর বিষ—লোভ, ক্ষমতা, অহংকার।
বিদুর : (দার্শনিক যুক্তিতে গাঁথা, স্পষ্ট ও তীব্র উচ্চারণ) হে সভাসদগণ, বিধান শব্দের অন্তরে যে বিষ গোপনে সঞ্চিত, তাহা ছুঁয়ে আজ রাজনীতি ঢেকেছে ধর্মের মুখ। রাজনীতি—সে এক জটিল চাতুরী। সে ন্যায়কে সাজায়, অন্যায়কে চাপায় বিধির চাদরে। আমি বিদুর— রাজপরিবারের প্রতিপালক, কিন্তু আজ আমি কাঁদি। আমি দেখিয়াছি কীভাবে ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব, দুর্যোধনের উন্মত্ততা এবং সভার নীরবতা। এই ত্রিফলা সম্মিলনে রচিত হয়েছে এক ইতিহাস, যেখানে দ্রৌপদী শুধু নারী নহে, সে এক বিবেকের প্রতিচ্ছবি। আমি জিজ্ঞাসা করি— যদি ধর্মরাজ নিজে স্ত্রীকে বাজি ধরিতে পারেন, তবে সেই ধর্মের সংজ্ঞা কোথায়? বিধি কি তার ন্যায়িক মৌলবোধ হারাইয়াছে?
দ্রোণাচার্য : (বিষণ্ণ কিন্তু সুসংবদ্ধ ভাষায়) আমার শিক্ষা ছিল অস্ত্রের, কিন্তু আজ প্রয়োজন শাস্ত্রের। হে সভার ধর্মপ্রাণগণ, শাস্ত্রে বলা আছে— ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা’। কিন্তু আজ আমরা এক নারীর অসম্মানে মৌন থেকেছি, যে নারী নয়—তিনি এক জাতির আত্মা। বিধান কি তবে সেই দণ্ড, যার আড়ালে রাজা নিজ দোষ ঢাকে? আমি দ্রোণ, কিন্তু আজ আমি শিক্ষক নই। আমি এক ব্যর্থ দর্শক, যে ধর্মের নামে পাপের নৃত্য প্রত্যক্ষ করিতেছি।
ধর্মরাজ : (মৃদুস্বরে, অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন সহকারে) এ তো এক কালো আয়না। যেখানে আমাদের মুখ নয়, প্রতিফলিত হচ্ছে সভ্যতার পরাজয়। বিধির মুখোশ খুলে গেলে যা দেখা যায়— তা এক রক্তাক্ত নারী, এক অপমানিত আত্মা। আজ এই আদালতে ধর্ম, বিধান, রাজনীতি— সবকিছু একে অপরকে ছায়া দিচ্ছে, অথচ সূর্য কেউ নয়। আজকের রায় একদিন ইতিহাসে দগদগে দাগ হয়ে থাকবে। (নেপথ্য সুর ু ধ্রুপদী ও করুণ রাগে মিশ্রিত, নীরবতা গাঢ় হয়)
দৃশ্য - ১২: দুঃশাসনের জবানবন্দি
(মঞ্চের এক কোণে আলো পড়ে—দুঃশাসন বসে আছে একা, নিচু গলায় তার নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। সভা স্তব্ধ। কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না। বিচারপতি ইশারায় তাকে বলতে দেন। তাকে ঘিরে এক বিষণ্ন অন্ধকার ছায়া, মাঝে মাঝে আলো পড়ে তার মুখে।)
দুঃশাসন : (স্বগতোক্তি, ধ্বংসাত্মক আত্মপীড়ায় উচ্চমার্গীয় ভাষায়) আমি দুঃশাসন...নামেই বুঝি দানব। কিন্তু আমি জন্মেছিলাম এক রাজপ্রাসাদে, ধর্মশাস্ত্রের স্তব পাঠ করে, রাজনীতি শিখে— আদেশ পালন করতে। আমি কি অপরাধী? না কি এক অন্ধ আনুগত্যের যন্ত্র? হে সভার সম্মানিত পণ্ডিতগণ, আমি যে দ্রৌপদীর কেশ টেনেছিলাম— তা কি আমার ইচ্ছায়? না কি ছিল এক ক্ষমতার প্রদর্শন, এক রাজনৈতিক নাট্যাভিনয়ের অংশ? (হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, রাগ ও কাঁপুনি) আমি দেখেছিলাম— সভা মৌন, পিতা অন্ধ, গুরু নিশ্চুপ এবং ধর্মরাজ— তিনি নিজের পত্নীকে এক নিঃশব্দ নিঃস্বতা উপহার দিলেন। সেই নিরবতার মাঝে, আমি—এক রাজপুরুষ— হয়ে উঠলাম এক নরপিশাচ!
(একটি দীর্ঘ বিরতি, কণ্ঠে আতঙ্ক)
প্রতিদিন রাতে—আমি শুনি তার চিৎকার, তার চোখের অপমান, তার সাদা শাড়িতে লেগে থাকা সভার নীরব রক্ত। হে ধর্মরাজ, হে বিচারপতি, আজ আমি নিজেকে ক্ষমা চাই না। আমি চাই—এই সভা নিজেকে প্রশ্ন করুক। আমার হাত যে কেশে টেনেছিল— সে কেশ ছিল সমস্ত নারীজাতির সম্মান, যার প্রতিটি সুতোর মাঝে ছিল অগ্নি, গঙ্গা, হিমালয়, বেদ ও গীতার স্তবক।
ধর্মরাজ : (নিচু কণ্ঠে, চঞ্চল চোখে) এক রাজকুমার অপরাধ স্বীকার করলে সভা স্তব্ধ হয় না, সভা ব্যবস্থা-কে দেখতে পায়। তুমি এক ব্যক্তি নও, দুঃশাসন— তুমি একটি ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, যেখান থেকে জন্ম নেয় অন্যায় এবং যেখানে মৌনতা জন্ম দেয় চিরন্তন অভিশাপ।
দ্রৌপদী : (দূর থেকে, কিন্তু বজ্রের মতো ভাষায় উচ্চারণ) দুঃশাসন, তোমার জবানবন্দি কাঁদায় না— স ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সাবধান করে। আজ তুমি একা দাঁড়াও, কাল ইতিহাস তোমার পাশে দাঁড়াবে না। ক্ষমা এক ঈশ্বরের গুণ, কিন্তু আমি নারী— আমার গর্ভে জন্মাবে প্রলয়। (দুঃশাসন নিচু হয়ে পড়ে, মুখ ঢেকে। আলো নিভে আসে। মঞ্চ স্তব্ধ।)
(সংগীতহীন নীরবতা। অন্তরীক্ষে যেন বজ্র নেমে আসে।)
দৃশ্য - ১৩: আদালতে দূর্যোধনের প্রতিকার
স্থান: মঞ্চের আলো আধো আলো, এক তীব্র গম্ভীর পরিবেশ। আদালত কক্ষটি বিশাল, যেখানে প্রতিটি কোণায় উচ্চতর আভিজ্ঞান ও সম্মান জড়িত। বিচারকরা, পণ্ডিতরা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত। দ্রৌপদী তার অভিশাপের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন, এক গভীর ন্যায়বোধে অধিকারী। তার চোখে এক অবিচলিত জেদের ঝিলিক। সামনে দাঁড়িয়ে দূর্যোধন, অপরাধের ভারী বোঝা নিয়ে। মঞ্চের বাতাসে এক অদৃশ্য উত্তাপ বিরাজ করছে।
দূর্যোধন : (গম্ভীর কণ্ঠে, এক নিষ্কলঙ্ক আক্ষেপ নিয়ে) হে মহাপরমেশ্বর, অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অধিকারী এই মহামান্য বিচারকগণ, আমি আজ অগ্রাহ্য করছি আমার সমস্ত অহঙ্কার, অভিশাপবিদ্ধ সেই পাপের শিকার হিসেবে। যে পাপটি আমি রচনা করেছি, সারা পৃথিবী তা জানে। যে ভয়াবহতর দুঃখ আমি একজন স্ত্রীর সম্মানহানির মাধ্যমে সৃষ্টি করেছি। হে পাঞ্চালকন্যা দ্রৌপদী, আমার দৃষ্টি সেদিন আপনার প্রতি ছিল এক ভয়ানক সঙ্কটে, যখন আমি আপনার বস্ত্র হরণ করেছিলাম, আপনার মর্যাদার সর্বনাশ করেছিলাম। আপনার নিষ্পাপ দেহ, আপনি যাকে অগ্নিরূপে জ্বালিয়েছিলে, আমিই সেই দোষী, আমিই সেই অপরাধী।
বিচারক : (অথর্ব এবং উচ্চকিত গম্ভীরতা) অহংকারের বাঁধন ভেঙে, এক অভিশপ্ত যুদ্ধে তোমার আত্মজ্ঞান জাগ্রত হলো।
তবে এ বিচার শুধু তোমার আত্মশুদ্ধির পথে নয়, এই পৃথিবী, এই সমাজের প্রতি এক অত্যন্ত প্রগাঢ় দায়বদ্ধতার পরিচায়ক। তোমার যে অপরাধ, সেটা ক্ষুদ্র নয়, তা সর্বজনীন পাপ। তুমি, দূর্যোধন, তোমার শাসনক্ষমতার পুঞ্জীভূত অক্ষমতায়, পৃথিবীজুড়ে তোমার অশুভ রাষ্ট্র ক্ষমতা বিস্তারিত করেছিলে। যে পাপ তোমার শাসনে ঘটেছে, তা সমস্ত মানবজাতির প্রতি অবমাননা।
দ্রৌপদী : (গম্ভীর, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে, এক আধ্যাত্মিক আভিজ্ঞান নিয়ে) হে শ্রদ্ধেয় বিচারকগণ, যে এক তীব্র যন্ত্রণা আমাকে আজীবন ভোগাবে, সে শুধু দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষত নয়, এটি আমার আত্মার খন্ডিত অবস্থা। এটি আমার জীবনপ্রবাহের এক অবাধ অন্ধকার। যে অন্ধকারের মাঝে আপনি আমাকে ফেলে দিয়েছিলেন, সে অন্ধকারের ঔজ্জ্বল্য এখন পৃথিবীজুড়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু আমি জানি, সে অন্ধকারই একদিন আলোর উৎস হবে, এবং আপনি দূর্যোধন, আপনার সেই অশুভ শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়বে। আপনি যে আমাকে দুঃখ দিয়েছিলেন, তার প্রতিফলন এখন দৃশ্যমান—শাস্তি, অমঙ্গল এবং কলঙ্ক।
দূর্যোধন : (অহংকারের অন্তরালে, এক নিরুত্তাপ চিত্তে) হে ন্যায়বিচারীগণ, আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যে সমস্ত পৃথিবীজুড়ে একপ্রকার অভিশাপ হিসেবে জ্বলছে, তা আমি জানি। আমি, দূর্যোধন, এখন ন্যায়ের পথে হাঁটতে বাধ্য। আমার পাপের কুণ্ডলী রক্ষা করতে পারব না। কিন্তু মনে রাখুন, আমি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত। এই শাস্তি আমার শরীরের নয়, আমার আত্মার। এখানে কোন যাত্রা নেই, শুধুমাত্র ধ্বংসের স্রোত।
বিদুর : (প্রাচীন শাস্ত্রের তত্ত্ব এবং নীতির মধ্যে, গভীর বুদ্ধির সঞ্চালনে) যে বিষের কষ্ট সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়, সে বিষ তুমি একসাথে পান করেছ, দূর্যোধন। তোমার মনোবলের এই গম্ভীর মন্দিরে অন্ধকারের অবকাশ ঘটেছে, যা একসময় অসীম আলোকের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে মনে রেখো, তুমি শুধুমাত্র একজন দোষী শাসক নও, তুমি একটি পরিপূর্ণ রাজ্যের প্রতীক, এক দুঃশাসনের আধার। যে রাজত্বকে তুমি তোমার অন্ধকারে পরিপূর্ণ করেছিলে, সে রাজত্ব একদিন শুধুমাত্র শুদ্ধতায় পরিণত হবে।
কৃষ্ণ : (মুখ থেকে বের হয়ে, দ্যুতিময়ী ভাষায়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার সূচনা) এটি সেই শুদ্ধ বিচার, যে বিচার একসময় অমৃতের মতো সৃষ্টিকে পুষ্টি দেয়। দূর্যোধন, আপনি যেহেতু দোষী, আপনাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে, আপনার শাস্তি শুধুমাত্র আপনার জন্য নয়, এই পৃথিবী ও মানবতার জন্য উপকারে আসবে। যে শাস্তি আপনার ওপর হবে, তা অগ্নিপথের মতো কঠিন, কিন্তু এটি একদিন শান্তির পাথেয় হবে।
দূর্যোধন : (গহীন অনুশোচনায়, এক দীর্ঘ নীরবতার পরে) আমি যা করেছি, তার পরিণতি অগ্রহণযোগ্য। আমার তিক্ততাটুকু এখন আমার আত্মায় এক অগ্নিসংযোগের মতো পুড়ছে। তবে, আমি জানি, আমার পাপের শাস্তি এক অবশ্যম্ভাবী সত্য।
কোরাস (ঐতিহ্য ও শাস্ত্র অনুযায়ী, গভীর শাস্ত্রীয় গান)
অগ্নিরূপে পাপের শাস্তি,
শুদ্ধির পথ অবলম্বনে,
সারা পৃথিবী দেখুক সত্যের রূপ,
যেটি একদিন জ্বলে উঠবে।
ধর্মরাজ : (শেষ সিদ্ধান্ত ঘোষণা, গম্ভীর ও নিরুত্তাপ) দূর্যোধন, তোমার অপরাধের জন্য শাস্তি অবধারিত, তবে সে শাস্তি শুধু শারীরিক নয়, এটি তোমার আত্মার পরিশোধন হবে। আমরা আজ সিদ্ধান্ত নেব এবং তোমার পাপের যন্ত্রণা নিশ্চিত হবে। তবে, মনে রেখো, এই শাস্তি সমাজের প্রতি ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সদগুণের প্রচার ঘটাবে। এখন থেকে, এই শাস্তির মাধ্যমে পৃথিবী জানবে— ন্যায় কখনো পরাভূত হয় না, এটি সবার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
দৃশ্য- ১৪: দ্রৌপদীর প্রতিশোধ ও ক্ষমার দ্বন্দ্ব
স্থান: মঞ্চে অসীম শূন্যতায় দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে আছেন, তার চারপাশে এক অদৃশ্য উত্তেজনা ভর করছে। রূপমাধুরী এবং শাস্ত্রীয় গুণাবলীর চরণগতি যেন মঞ্চের পরিবেশকে এক অনন্য গম্ভীরতায় পূর্ণ করেছে। দ্রৌপদীর মুখাবয়বে দৃষ্টির তীব্রতা এবং কণ্ঠে একটি গুমোট অতীতের ছায়া— সে একটি বিপ্লবের মাঝে অবস্থিত। মঞ্চে আলো মিশে গেছে অন্ধকারের মধ্যে, একটি লাল-সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ে, যেন প্রতিশোধ এবং ক্ষমার দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করার জন্য।
দ্রৌপদী : (গম্ভীর, নিবিড় কণ্ঠে, এক গভীর স্তব্ধতার পর) অধর্মের রূপরেখায় আমি যেন বেঁচে আছি। তবে সেই রূপরেখা কি হবে, যখন দুরাচারের অগ্নিসংযোগে আমার বস্ত্রহরণ করা হয়েছে, যার সমগ্র পৃথিবী এক নির্জন সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে? কিন্তু, হে ব্রহ্মা, আপনিই বলেছিলেন— ক্ষমাই সর্বশক্তিমান। কিন্তু আমার হৃদয়ে কি সেই শক্তির অগ্নিসংযোগ হবে? প্রতিশোধের বিভ্রমে আমি কি এক অস্থিরতার শিকার হবো, নাকি সেই শান্তির দিকে চলব, যেখানেই সর্বদা শান্তির অমৃত প্রবাহিত হয়?
বিদুর : (ঋষির মত উচ্চমার্গীয়, আদি ব্রাহ্মণের সুরে) হে দ্রৌপদী! তুমি যে পথের সন্ধান চাও, সেই পথ এক চিরন্তন ধারা, যার মধ্যে রয়েছে এক অমরত্বের রস। তুমি যেভাবে প্রতিশোধের অগ্নিতে দগ্ধ হতে চাও, সে শাস্তির পথ কেবল পাপের সৃষ্টির জন্য। হে মহারাজী, মনে রেখো, প্রতিশোধ কেবল জীবনের ক্ষয়, এটি তোমাকে কেবল অন্ধকারে নিয়ে যাবে। অথবা তুমি যদি ক্ষমার পথে পা বাড়াও, তবে সেই পথ তোমার আত্মাকে শুদ্ধ করে তুলবে। শাস্ত্রের শিক্ষা—‘ক্ষমাশক্তি পারিজাতের মতো, যা সকল আঘাত এবং পাপকে নিজের মধ্যে শোষণ করে।’ তোমার হৃদয়ে সে শক্তি প্রবাহিত হোক।
দ্রৌপদী : (এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের মধ্যে, হৃদয়ের কণ্ঠে উঁকি দিয়ে) কিন্তু, মহামতি বিদুর! আমি যে পাপের শিকার, যে অপমান আমাকে বয়ে নিয়ে চলেছে— আপনি বলুন, আমার হৃদয়ে সে শক্তি আসবে? নাকি আমি সেই আলোছায়ায় এক মর্মান্তিক অন্ধকারে নির্বিশেষে চলে যাব, যখন আমার মাতৃভূমি, আমার নারীত্বের আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে? (এক বিরক্তি ও গভীর যন্ত্রণায়) প্রতিশোধের অতল গহ্বরে আমি কি এক নতুন উদ্যমে তাকে পরাভূত করতে পারব?
কৃষ্ণ : (ঋষিপুত্রের অমর বাণী, শাস্ত্রের শক্তি দিয়ে) হে পাঞ্চালী, হে আমার প্রিয় সখি, রাজসভায় আপনার লাঞ্ছনা আমার হৃদয় বিদীর্ণ করেছে! পৃথিবী কখনো প্রতিশোধে শুদ্ধতা লাভ করতে পারে না। যত দীর্ঘ হোক না কেন, বিপথগামী পথের শেষ— আপনি জানেন, সে পথ অতল গহ্বরে চলে যায়, যেখানে আত্মার পরিসমাপ্তি হয় না। তবে আপনার হৃদয়ের পথে ‘ক্ষমা’ এক অমৃতের রস। এটি আপনার শরীরের ক্ষতকে শুদ্ধ করবে এবং সেই পথের শেষে আপনি নিজে জয়ী হয়ে উঠবে। আপনি যা চান, তা কখনোই অন্যের ক্ষতির মধ্য দিয়ে আসে না। শাস্ত্রের সুক্ষ্মতা অনুসরণ কর, আপনি নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করুন, সখি। আপনি যদি জয়ের দিকে তাকান, তবে প্রতিশোধের সিঁড়ি কখনোই আপনার আত্মাকে শুদ্ধি দিতে পারবে না।
দ্রৌপদী : (কঠোরভাবে, সমগ্র বিশ্বের উদ্দেশ্যে, শীতল কণ্ঠে) যদি প্রতিশোধে না পাই, তবে কী আমি নিঃশেষিত হব? তবে, আমার প্রিয় মহাদেব, আপনি যেদিন শুদ্ধতার পথে বলেছিলেন— আপনার প্রতিজ্ঞা থেকেই আমি যেন এক ভরসার পথে হাঁটতে পারি, যেখানে আমার দেহ পুড়ে না, শুধু আত্মা শুদ্ধ হয়। তবে শাস্ত্রের আদর্শ কখনো মিথ্যা হয় না এবং ক্ষমাই চূড়ান্ত বিজয়। আমি জানি, প্রতিশোধে কোনো অর্জন নেই— এটি কেবল অন্তহীন যন্ত্রণার সৃষ্টি।
বিদুর : (আধ্যাত্মিক গম্ভীরতায়, ব্রাহ্মণীয় মহিমায়) হে দ্রৌপদী, ক্ষমার পথে যখন তুমি পা রাখো, তবে তুমি সেই ধ্রুবতারা হয়ে ওঠো, যে দ্যুতি পৃথিবীর অন্ধকারে ছড়িয়ে দেয়। তোমার হৃদয়ের শান্তি হবে শাস্ত্রের মতো অথবা তুমি এই বিশ্বের কল্যাণে এক নবযুগের সূচনা করবে। অতীতের ক্ষত তোমাকে কখনোই দখল করতে পারবে না, যদি তুমি আধ্যাত্মিক শান্তির পথে চলো।
দ্রৌপদী : (এক সৃষ্টির অবস্থা, দৃঢ়তার সঙ্গে, শুদ্ধ মনোভাব) হ্যাঁ, আমি সেই পথে হাঁটব। আমি জানি, এই পৃথিবী থেকে আমার যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি শুধু ক্ষমায় আসবে। কেবলমাত্র সেই মহাশক্তির আশ্রয়ে। আমিই ক্ষমা করি এবং সেই পথেই আজ আমি চলব। আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ পৃথিবী যতোই আমাকে লাঞ্ছিত করুক না কেন, যতই আমাকে নিঃশেষিত করার চেষ্টা করুক না কেন, আমার আত্মাকে আর কোনো দুঃখ, কোনো ক্ষত ছুঁতে পারবে না। এ পৃথিবী আমাকে যা কিছু দিয়েছে, আমি তা গ্রহণ করেছি। তবে সে যে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমি তাকে কখনো অঙ্গীকার করব না। আমি জানি, প্রতিশোধ কেবল এক নকল শান্তির প্রলেপ। প্রতিশোধ কোনো অক্ষয় সত্যের দিকে পথ দেখায় না, এটি কেবল অন্ধকারের গহ্বরে আরও গভীর করে ফেলে। আমি যখন শাস্ত্রের দিকে চোখ ফিরিয়েছি, তখন আমি দেখেছি— ক্ষমাই একমাত্র শক্তি। যা সত্য, শান্তি এবং জয়কে চিরকাল অটুট রাখে। আমি যদি প্রতিশোধের পথেই চলি, তবে সেই পথে চলতে চলতে আমি কখনোই অক্ষুণ্ন থাকতে পারব না। হ্যাঁ, আমি শত্রুর প্রতি কোনো শত্রুতা রাখব না, আমি তাকে প্রতিশোধের আগুনে পোড়াব না, কারণ সে আগুনে নিজে পুড়তে পুড়তে, একদিন, আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাব। কিন্তু, আমি যদি ক্ষমার পথে হাঁটতে পারি, তবে সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে, আমি একদিন অক্ষুণ্ন, শুদ্ধ এবং পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠব।
আজ আমি এক নতুন পথ বেছে নিলাম, এ পথটি কেবল আমার আত্মাকে শুদ্ধ করবে না, এটি পৃথিবীকে শান্তির আলো দেখাবে। আমি জানি, পৃথিবীর শাসকরা কখনোই অধিকারী হতে পারবে না— এদিকে ক্ষমা একমাত্র শক্তি, যা রাজ্যগুলোও অক্ষত রাখে।
কোরাস (ঐতিহ্যগত সুরে, মহাকাব্যিক, উচ্চ শাস্ত্রীয়)
‘ক্ষমা এক চিরন্তন শক্তি,
যেখানেই প্রবাহিত হোক, সে শান্তির দান।
শাস্ত্রের পথে চলে, যেখানেই সত্য রয়েছে,
অন্ধকারের মাঝে অমৃতের রঙ।’
দৃশ্য- ১৫: ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও নাটকের সমাপ্তি
স্থান: মঞ্চে একটি আলোকিত স্থান, যেখানে দ্রৌপদী এক উজ্জ্বল রৌদ্রের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তার চারপাশে এক পবিত্র আভা, যেন তার নিরন্তর সংগ্রামের শেষে, শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চারিদিকে এক গভীর স্তব্ধতা বিরাজ করছে—সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং আধ্যাত্মিক বিচারের অন্তর্গত এক মহৎ মুহূর্ত। সকল চরিত্র এক গভীর শ্রদ্ধায় নিঃশব্দ, যেন ন্যায় কেবল পৃথিবীতে নয়, অন্তরাত্মাতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্রৌপদী : (ধীরে ধীরে, দৃষ্টিতে এক শান্তি) হ্যাঁ, আজ আমি জানি, যত বড়ই হতে থাকুক অশুভ শক্তি, সে কখনোই ন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। যতই সমূহ অন্ধকারে ঢাকা পড়ুক মানবতা, তবুও ন্যায় নিজ আলোয় উদিত হয়, এটি শুদ্ধতার চূড়ান্ত জয়। আজ, মহাশক্তির আশীর্বাদে, আজকের এই বিচারের পরিণতি হচ্ছে একটি নতুন উন্মোচন। কেবল ক্ষমা নয়, আজ ন্যায় প্রতিষ্ঠিত। কেবল প্রতিশোধ নয়, আজ সঠিক পথ এবং শাস্ত্রের জয়।
কৃষ্ণ :(মহাজ্ঞানী, এক আধ্যাত্মিক মাধুর্যে) হে দ্রৌপদী! আপনি যা চেয়েছিলেন, তা তো শুধুমাত্র ন্যায় নয়, আপনি চেয়েছিলেন সত্য প্রতিষ্ঠা। আপনি চেয়েছিলে সেই অমৃতধারাকে, যা সকল পাপের শেকল ভাঙে এবং আজ, এই পৃথিবীতে আপনার সত্য— আপনার ন্যায়— এটি শাশ্বত হয়ে উঠবে। এটি কেবল আপনার জন্য নয়, এটি সকল ন্যায়ের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।
বিদুর : (ঋষির ভঙ্গি, গম্ভীর কণ্ঠে) হে দ্রৌপদী, তোমার পথ নির্ধারণই তো ছিল এই পৃথিবীকে সত্যের পথে পরিচালনা করা। আজ তোমার বিজয় কেবল এক মেধার সৃষ্টি নয়, এটি হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিষ্ঠা। প্রতিশোধের পথ কখনোই পৃথিবীকে শান্তি দেয় না, তবে তুমি যে শান্তির আলো দেখালে, তাহলে পৃথিবীও সেই আলোয় ভরে উঠবে।
দ্রৌপদী : (একটি সাহসী অনুভূতি, ধীরে ধীরে) আমি জানি, আজ থেকে পৃথিবী সেই পথে চলবে যেখানে প্রতিশোধের অতল গহ্বর আর জায়গা পাবে না। আমি জানি, এই পৃথিবী, যার মধ্যে এক সময় বিধি ও ধর্মের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, আজ সেই পৃথিবী শুদ্ধ হতে চলেছে এবং সত্যই বিজয়ী হবে। আজ আমি জানি— আমি সঠিক পথে আছি এবং আমার এই পথ সকলের জন্য, এটি হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক মহাকাব্য। (উজ্জ্বলভাবে, দৃঢ় আস্থা সহ) আজ আমার হৃদয়ে শুধু এক কথা— এ পৃথিবী কোথাও না কোথাও শুদ্ধ হবে। আজ ন্যায় কেবল আমার নিজের নয়, এটি সকলের, সমগ্র মানবজাতির জন্য। (এক মুহূর্তের জন্য থামেন) আজ, আমি জানি— আমি কেবল আমার শত্রুর বিরুদ্ধে জিতিনি, আমি জয়ী হয়েছি নিজের আত্মার বিরুদ্ধে আর সেই জয়ই সকলের জয়। আমাদের সত্য ও ন্যায় কখনোই শেষ হবে না, এটি চিরকাল অটুট থাকবে।
কৃষ্ণ : (নিঃশব্দে, এক অনন্ত মাধুর্যে) আপনি জানেন দ্রৌপদী, এই বিজয় শুধুমাত্র এক বিচারের ফল নয়, এটি হচ্ছে সেই শাশ্বত সত্যের প্রকাশ, যে সত্য আমাদের অন্তরাত্মাকে উজ্জ্বল করে।
ধর্মরাজ : (বিচারক, গভীর প্রজ্ঞা ও আভিজাত্যে) অহং সত্যবাদিনী, মানবসত্তার অস্তিত্বের অনন্ত সত্যের পরিচায়ক, এহি আমার হস্তে এই মহান দায়িত্ব— এই পৃথিবী এবং দেবতাদের ন্যায়ের রক্ষা। এই বিচারসভা কেবল এক তর্কের প্রসঙ্গ নয়, এটি পৃথিবীজুড়ে সে অমোঘ শাস্ত্রের এক অবিচল সংকেত, যেখানে শাসনব্যবস্থার পাথেয় শুধুমাত্র শাস্ত্রের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং যেখানে প্রতিটি আত্মার উদ্দেশ্য শুদ্ধির অন্বেষণ। যেখানে মানুষের প্রকৃত ধর্মের পরিসীমা ন্যায়ের সংজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে সেই সমাজই স্থায়ী। আজ, এই সভায় উপস্থিত সকল মহাপুরুষ, এই মহান বিচারকালে, এ সত্যের ঘোষণা যে, দ্রৌপদী মহিষী, যার বস্ত্রহরণ প্রক্রিয়ায় ন্যায়কে চূর্ণ করা হয়েছিল, তাকে অধিকারী করে, আমরা জানাচ্ছি— শাস্ত্রের বিধান সর্বদাই এক, অথচ কিছু তথাকথিত রাজনীতির কুৎসিত মায়ায় এই মঙ্গলময় পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চেয়েছিল। এ বিশ্বে যেখানে বিধান এবং রাজার মাঝে একটি অমোঘ সম্পর্ক থাকে, যেখানে রাজা, শাসক, সেইসব যোদ্ধা যাঁরা ধর্মের রক্ষক, তারা যদি এক মুহূর্তের জন্যও ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে এ পৃথিবী তন্মধ্যে সর্বগ্রাসী অন্ধকারের আবির্ভাব ঘটে। আজ, দ্রৌপদী, তুমি যে অপরাধের সম্মুখীন হয়েছিলে, সে অপরাধ কোনো এক রাজপুত্র বা রাজন্যের অধিকারীতা নয়, এটি এক মহাজ্ঞানী, পৃথিবী ও সমাজের প্রকৃত শাসকের প্রতি এক আঘাত। এটি একটি ন্যায়ের পাথেয়, যাকে চূর্ণ করেছিল দূর্যোধনের মত শাসক। কিন্তু— এই পৃথিবীর পবিত্র ধর্ম ও দেবতাদের সংকল্পে, এখন সেই সমগ্র বস্ত্রহরণের ঘটনা হবে, শাস্ত্রের জ্যোতির মাধ্যমে, এক পূর্ণ সত্যের প্রকাশ। প্রতিটি নীচু কাজের পরিণতি অমঙ্গলের দিকে চলে যায়, কিন্তু যে ব্যক্তি বা জাতি তার অন্তরের কলুষতায় বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে, সে পূর্ণ সত্যের কাছে সমর্পিত হয়ে, এক নতুন পথের সূচনা করে। আজ থেকে, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, ধর্মের আলো বয়ে যাবে। এ পৃথিবীতে কোনও অন্যায় থাকবে না। এই সভার মঞ্চে আমি ঘোষণা করছি— ধর্মরাজ্যের অমোঘ নিয়ম, নেতৃত্বের ভূমিকা কেবল শাস্ত্রের, কোনও শাসকের হাতে নয়। তবে শাসকের কর্তব্য— ন্যায়বিচারের সমর্থন করা, যেখানে ধর্মের পথে অনমনীয়, একচ্ছত্র শাসন প্রবাহিত হবে। এখন, পৃথিবী থেকে সব অপরাধের কালিমা ধুয়ে যাবে, এ অন্ধকার থেকে রোশনি উদিত হবে এবং দ্রৌপদীর কষ্ট, দুঃখ এবং অপমান আমাদের সমাজের শিরে এক নতুন অহংকারে পরিণত হবে— অর্থাৎ, মানবতার জয়, ন্যায়ের জয়!
-সমাপ্ত-
🎶 লোকগান: ুরাজসভা রে! ও রাজসভা!”
(দ্রৌপদীর মুখে)
ছন্দ: দাদরা/চৌতাল মিশ্রিত লোকছন্দ
ধরন: বাউল-ভাটিয়ালি মিলন
(১)
রাজসভা রে! ও রাজসভা!
তোমার ন্যায় কি আজ ঘুমায়?
দুর্যোধন হাসে, দুঃশাসন টানে,
নারীর লাজ কি কেউ চিনে না হায়?
(২)
পাঁচ পতি আমার, হারে জুয়া খেল,
কে বললো আমি তাদের দাসী?
ধর্ম, সত্য, সভা-সভ্যতা সব,
লুটায়ে পড়ে শুধু অলস হাসি!
(৩)
বিদুর চুপ, ভীষ্ম নীরব,
দ্রোণাচার্য মুখ ফেরায়।
কর্ণের তীরে জ্বলে চিত্কারে,
ক্ষমা কেবল নীরবে কাঁদায়।
(৪)
হে কৃষ্ণ রে! হে মাধব রে!
তুমি কি তবে দেখো না কিছু?
তোমার নাম আমি হৃদয়ে ডাকি,
এসো এবার, দাও স্নেহ-আলিঘু।
(৫)
দ্রৌপদী আজ রাজমাতা নয়,
নয় পাণ্ডবগৃহে রাজরানী।
আজ সে শুধু এক নারী রে ভাই,
যার শরীর আজ সভার বাণী!
(৬)
লজ্জা দিলেম নদীর ধারে,
আকাশ দিলো ছায়া।
বায়ু রে বায়ু, ঢেকে দাও আমায়,
এই সভার নাই তো মায়া।
(৭)
কৃষ্ণ এলেন, বস্ত্র ঝরিল,
সিন্ধুর ঢেউয়ে ঢাকল গা।
দুঃশাসনের হাতে শক্তি রইল না,
লজ্জা জাগে, মাথা নত সভা।
(৮)
রাজসভা রে! ও রাজসভা!
নারীর লজ্জা কি খেল না বাজি?
দ্রৌপদী বলে—আজকের লাঞ্ছনা,
ধর্মের খণ্ডবোধের রাজনীতি আজ কাঁদি।
(শেষ সুরে ধ্বনি)
লজ্জা লজ্জা! সভার মাঝে,
শঙ্খ বাজে দূর গগনে।
যেখানে নারী অপমানিত হয়,
সেখানে ধর্ম পড়ে পতনে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন