শব্দের ভেতরে শূন্যতায় কথানহর’র বহুমাত্রিকতা, নন্দন-রাজনীতির প্রতিসরণ || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

বুধবার, ৪ জুন, ২০২৫

শব্দের ভেতরে শূন্যতায় কথানহর’র বহুমাত্রিকতা, নন্দন-রাজনীতির প্রতিসরণ || শাফি সমুদ্র

১.

কবিতা শব্দের পরিক্রমায়র বাইরে কবি নৈঃশব্দ্যের অভ্যন্তরেও নিজের স্বর রচনা করে চলেন। যে সময় বর্ণমালার প্রতিটি ধ্বনি ক্ষমতার নানান বলয়ে বিবর্তিত। যে সময় ভাষা নিজের নিরীহত্ব হারিয়ে ফেলেছে আর হয়ে উঠেছে একেকটি দখলদার অস্ত্র। সে সময়েই কবিতা একটি পরিত্যক্ত নদীচরের মতো নীরব আর ন্যায্যতার দাবিতে ঋজু। রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ এই নির্জন প্রগাঢ় স্বরের সমগ্র। আধুনিক কাব্যতাত্ত্বিক ভাষ্যে বললে এটি একটি স্নায়বিক গদ্যচালিত প্রতিরোধের নদী। বাংলা কবিতায় যেখানে প্রায়শই অভ্যস্ত ‘কাব্যিকতা’ই চূড়ান্ত নান্দনিকতা বলে বিবেচিত হয়। সেখানে রশীদ হারুণ কবিতা নামক উচ্চারণকে এক নির্মম, মানবিক প্রতিধ্বনি হিসেবে গড়ে তুলে কবিতার স্পন্দন ব্যথার শিরা বেয়ে উঠে আসে।


সমকালীন কবিতার ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বারবার প্রশ্ন উঠে আসে কে কবি? কবি কী করে? কবির ভূমিকা কী? কবির দায় কী? উত্তরগুলো তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না। দেখা যায়, উত্তর খুঁজতে গিয়েই ধরা দেয় বিপন্নতা, ভাষাহীনতা, চেতনার ক্ষয়। কবি হয়ে ওঠা মানে পাঠকের হাত ধরে চাঁদের আলো দেখানো নয়; পাঠকের চোখেই চোখ রেখে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে— আলোরও মৃত্যু হয়। রক্তাক্ত হয় দীপ্তির অন্তঃস্বর এবং ভাষা কখনো কখনো অন্ধকারেরই ব্যাকরণ। রশীদ হারুণ সেইসব অন্ধকার ব্যাকরণের ভেতর কবিতা খোঁজেন। তাঁর কবিতা পাঠকের জন্য সুবিধাজনক পঠনশৈলী তৈরি করে না। প্রতিটি পংক্তি পাঠককে বাধ্য করে এক আত্মদহনমুখী রিডিং স্কিমে, যেখানে ভাষার প্রগাঢ়তা, প্রতীক, ছায়া ও নির্মোহ সংবেদনশীলতা প্রতিটি স্তবকে এক একটি দরজা খোলে। দরজাগুলোর ঠিকানাও থাকে, আবার অনিশ্চিতও।


এই অনিশ্চয়তা সময়ের সঙ্গেই সম্পর্কিত। কবিতা কেবল সময়ের দলিল নয়, তা সময়ের মুখোশ খোলাও। একদিকে যতই কবিতা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চাসনে বসে, অন্যদিকে কিছু কবিতা রয়ে যায় পাদপ্রদীপের আড়ালে। এক ধরনের অস্থায়ী, অসমাপ্ত, দ্রোহী নির্মাণে। এই দ্বিতীয় ধরনের কবিতা, যাকে আমরা লিটল ম্যাগাজিন ঘরানার কবিতা বলি, তারই অন্যতম প্রতিনিধি ‘কথানহর’। এখানে লিটল ম্যাগাজিন কোনো ছাপার মাধ্যম একমাত্র নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থান; এখানে কবিতা শুধুমাত্র অলঙ্করণের বাইরেও প্রতিরোধের ভাষা।


লিটলম্যাগাজিনের অভিঘাত বহুস্তরীয়। লিটল ম্যাগাজিন শব্দবন্ধটি যেমন একটি সীমিত পরিসরের, স্বল্প অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রকাশভঙ্গিকে নির্দেশ করে। তেমনই এটি নির্দেশ করে এক অপ্রতিষ্ঠানিক, বিকল্প শিল্পবোধের নান্দনিকতা। বাংলা সাহিত্যে ‘লিটলম্যাগাজিন’ কখনো কোনো বিচ্ছিন্ন প্রবণতা ছিল না। এটি ছিল মূলস্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহীরুহ। ‘কথানহর’-এর মতো একটি গ্রন্থ সেই ধারাবাহিকতাকে রক্ত আর মাংস দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটায় আত্মা ও ভূগোলের। রশীদ হারুণ জানেন, আত্মকথনে ‘শব্দ’ ছাপিয়ে ‘শব্দহীনতার’ও রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকে। তাঁর কবিতা এক ধরনের শব্দহীনতার ভেতর শব্দের পাথর বুনে দেয়। ‘কথানহর’ এর কবিতাগুলো আসলে সেই বোনা পাথরের জলস্রোত।


সমকালীন কবিতার সংকট যেনো এক ফাঁকা অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে শৈল্পিকতা আর শব্দের রঙিন আলখেল্লা মিশে এক নিস্তরঙ্গ প্রদর্শনী তৈরি করে। কবিতা পড়ে মুগ্ধ হওয়া যায়, কিন্তু কাঁপা যায় না। অথচ কবিতা মানেই তো অভ্যন্তরীণ কাঁপন। রশীদ হারুণ সেই কাঁপনকে পুনরুজ্জীবিত করেন কখনো ইতিহাস, কখনো পুরাণ, কখনো বা ভাষার নিজস্ব ঘূর্ণিবলয়ে। তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গ থাকে, তারচেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয় উচ্চারণের গঠন। এই গঠন বা আর্কিটেকচার লিটল ম্যাগাজিন পরিসরের বৈশিষ্ট্য। রশীদ হারণের লেখায় তার প্রকাশ প্রায় স্থাপত্যের মতোই। তাঁর কবিতার একটি চিহ্নও অপ্রয়োজনীয় নয়। যেনো ভাষার প্রতিটি ভাঁজ নিজস্ব স্তবক নিয়ে জন্ম নিয়েছে। সেগুলো একদিকে যেমন বিচিত্র, তেমনই সুষম। এই সুষমা বাণিজ্যিক বা রূপময় নন্দন ধারণা থেকে ভিন্ন; এটি এক ধরণের দেহ-মস্তিষ্ক-জিহ্বার ত্রিস্তরীয় সুষমা যেখানে দৃষ্টিও প্রয়োজন, ধ্বনিও আর চেতনা তো বটেই। 


লিটল ম্যাগাজিনে কবিতার জন্য পাঠক তৈরি করা হয় না। পাঠককেই পাঠযোগ্য করে তোলা হয় কবিতার জন্য। ‘কথানহর’ পাঠ করতে গিয়ে প্রথমেই যেটি পাঠক টের পান— তিনি প্রস্তুত নন। এই প্রস্তুতির অনুপস্থিতিই কবিতা ও কবিকণ্ঠের সমকালীন দুরবস্থার অনুপুঙ্খ ছবি। পাঠকের এই অপঠনের দায় ভাষার ভেতরে তৈরি করা সুরুচির কৃত্রিম চক্রব্যূহের। এই ব্যূহ ভেদ করে রশীদ হারুণ শব্দচিহ্নের অমোঘ ব্যবহারে আধুনিকতার একটি জাল বিছিয়ে রাখেন পাঠকের মননশীলতার জন্য।


আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার যুগান্তরের মধ্যে বাংলা কবিতা দাঁড়িয়ে আছে এক রক্তাক্ত অন্তর্বিপ্লবের ভেতর। রাষ্ট্রপন্থী ভাষার কাঁধে কবিতা, কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের হাত ধরে শব্দচর্চা, আর উৎসব-সংস্কৃতির পরম্পরায় কবিতার ঊর্দ্ধমুখী ‘স্টাইলাইজেশন’ এই সবকিছুর মাঝে কবি রশীদ হারুণ ফিরে যান সেই জায়গায়, যেখানে ভাষা ছিল অসম্পূর্ণ, অনস্তিত্বের গর্ভে প্রতিধ্বনি। তাঁর কবিতায় মুখ্য হয়ে ওঠে অনুচ্চারনীয় শব্দ, নির্যাতিত ব্যঞ্জনা এবং পরিসংখ্যানের বাইরে ছিটকে পড়া মানবজীবনের ক্ষতচিহ্ন।


‘কথানহর’-এর একটি অন্তঃপ্রবাহ রয়েছে যা কেবলমাত্র নন্দনতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি একটি সত্তা-চৈতন্যের বহমান ধারা। যেখানে সময়, ইতিহাস, ভূগোল ও রাজনীতির সংমিশ্রণে শব্দ হয়ে ওঠে আত্মজৈবনিক।, এখানে কবিতা কেবল বাস্তবতার বাইরেও আরেক বাস্তবতার পুনর্নির্মাণ। এই পুনর্নির্মাণ ‘লিটল’ বলেই শক্তিশালি। ক্ষুদ্র এক পরিধি থেকেই এই পুনর্গঠন শুরু হয়।


আমরা প্রায়শই দেখি, লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা কিছু নির্দিষ্ট পাঠকের জন্য রচিত। এর ভাষা, রীতি, দৃষ্টিভঙ্গি যেনো এলিটবাদে আক্রান্ত। রশীদ হারুণ এই প্রবণতা থেকে ভিন্ন। তাঁর কবিতা উচ্চমার্গীয়, যদিও তা তথাকথিত এলিটবাদী নয়। তার কবিতার অন্তঃস্বর দেহজ, বায়বীয়, কখনো কখনো কৃষিজ। ভাষা তাঁর কাছে কোনো নির্লিপ্ত রূপান্তর, ক্ষতবিক্ষত শরীরের মতো, যেখানে ঘ্রাণ, ঘাম, রক্ত এবং লালা একসঙ্গে মিশে যায়। এ ভাষা অস্তিত্বের প্রয়োজনেই বিকশিত হয়েছে।


সাম্প্রতিক কালে যেখানে কবিতা হয়ে উঠেছে সামাজিক মিডিয়ার চটকদার ‘কোটেবল’ স্ট্যাটাস বা সাহিত্য পুরস্কারের অলঙ্কার। সেখানে রশীদ হারুণ কবিতাকে নিয়ে আসেন একটি নির্জন প্রান্তিক ঘরের দরজায়। তাঁর কবিতা পড়ে কারো বাহবা পাওয়ার দায় নেই। এই কবিতা কোনো চুম্বন দাবি করে না, এটি একটি ঘোর দাবি করে পাঠকের মনে, রক্তে, শিরায় উপশিরায়।


লিটলম্যাগাজিনের অভিঘাত এখানে আরেকবার স্পষ্ট হয়। মূলধারার বর্ণনাপূর্ব ধারণায় কবিতা একটি বিনোদন বা চিন্তাশীলতার চর্চাস্থান। লিটল ম্যাগাজিন ঘরানার কবিতা হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক অনমনীয়তা, একটি তীব্র বোধের বহিঃপ্রকাশ। ‘কথানহর’-এর প্রতিটি কবিতা সেই অনমনীয়তার ঘোষণাপত্র। যা ইতিহাসের নব্য-লিপি। রশীদ হারুণ লিটলম্যাগাজিনের পরিসর থেকে উচ্চারিত এই কবিকণ্ঠকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেখানে ‘কথা’ নিজেই হয়ে উঠেছে নদী। এই নদী বয়ে চলে শব্দহীনতা ও বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে। সে নদীতে চেতনা ও সংবেদন— উভয়ই হারায় আবার ফিরে আসে। এই বয়ে চলা একবারে বহুপথে বিভক্ত, জ্যামিতির প্যাঁচে প্যাঁচে বোনা। এই বুননই ‘কথানহর’-এর প্রকৃত নান্দনিকতা।


লিটল ম্যাগাজিন-প্রবণ এই কাব্যগ্রন্থ আমাদের দেখিয়ে দেয়, কবিতা মূলস্রোতের বাহ্যিক অভিধানে এক অন্তর্স্রোতের অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধান শব্দে, ভাষায়, ভাষার বাহিরেও। কবিতা এখানে প্রতিবাদের ভাষা, অভিজ্ঞান।


কবিতার ভাষা ও নির্মাণভঙ্গি বাক্যবিন্যাসে নিরীক্ষা, প্রতীক ও ব্যঞ্জনার প্রয়োগ, অলঙ্কারিক বৈচিত্র‍্য ও অর্থ-অবমোচনের অন্তঃস্রোতে ‘কথানহর’ নামকরণেই একটি নান্দনিক দ্বন্দ্ব ও আন্তঃনির্ভরতা নিহিত। ‘কথা’ এখানে স্মৃতি ও অস্তিত্বের বহমানতা আর ‘নহর’ প্রতীক হয়ে ওঠে সেই বহমানতার স্পন্দমান শিরা। এই কবিতাগুচ্ছ গদ্য আর পদ্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে, নিজস্ব ছন্দে নিজস্ব বিরতিকে প্রতিভাত করে। রশীদ হারুণের কবিতায় ‘ভাষা’ নিজেই একটি চরিত্র, কখনো দ্রোহী, কখনো প্রার্থনাকারী আবার কখনো পুরোপুরি ছায়াভরা অশরীরী, যার শরীর হয় ধ্বনি, শ্বাস, ছায়া ও সংকেতের বিন্যাসে।


এই কবিতাভাষ্য মূলত এক দ্বৈতজাগতিক নির্মাণ। একদিকে বহুমাত্রিক শব্দবিন্যাস, অন্যদিকে চিন্তার গভীরে নিমজ্জিত এক ধরণের গুহাবাস। তাঁর কবিতার প্রতিটি স্তবক, প্রতিটি বাক্যাংশে রয়েছে আত্মার অনুবেশ। এখানে বাক্যকে নির্মাণ করা হয় মাটি ও বায়ুর মিশেলে, যার ফলে বাক্য হয়ে ওঠে ঘোরের এবং ঘামজ উপকরণে গড়া। কবিতার ভাষা কেবল অর্থবাহ নয়, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তার ‘অর্থের প্রত্যাখ্যান’ বা পুনর্নির্মাণ। রশীদ হারুণের বাক্য গঠিত হয় ভাঙা কাঠামো থেকে যেখানে প্রতিটি বাক্যই যেন এক অস্থায়ী ঘর, যে ঘরের দরজা-জানালা নেই, অথচ বাতাস আসে, আলো পড়ে।


তাঁর কবিতায় ভাষার একটি স্নায়বিক মুদ্রা রয়েছে। শব্দ এবং চিত্র, বাক্য এবং ছায়া এই চারটি উপাদানে মিশে একটি স্থাপত্যিক ভাষাভঙ্গি নির্মিত হয়, যা ঐতিহ্যগত কাব্যভাষা থেকে আলাদা। যেমন—‘চোখের ভেতর রাখি বিষণ্নের বাইনোকুলার!/ জল-পাতা ঝরে পড়ে প্রান্তরের গাল বেয়ে, ভাবি/ পৃথিবীর জলাভূমি নিদারুণ হামাগুড়ি দিচ্ছে...’ এই পঙ্‌ক্তিতে ‘বাইনোকুলার’ যেনো সময় ও অস্তিত্বের দূরত্ব পরিমাপক এক কল্পপ্রযুক্তি, যা ‘চোখের ভেতর’ অবস্থান করে। এখানে অন্তর্মুখিতা আর দূরভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়।


রশীদ হারুণের বাক্যবিন্যাস কখনো সংক্ষিপ্ত, কখনো জ্যামিতিক, কখনো ছায়াময়, কখনো রক্তাক্ত। তাঁর বাক্যের গঠনগত ভাঙন এবং ছন্দবিচ্যুতি এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ধারা সৃষ্টি করে। এই ধারা বহে না ধ্রুপদী ছন্দে, তা অস্বস্তি জাগায়, হঠাৎ ঝাঁকুনি দেয়, কখনো স্থবির করে তোলে। এই অভিজ্ঞতা কেবল ভাষাবাহিত ঘোর ও ধ্বনির অভ্যন্তরে একপ্রকার ইন্দ্রিয়চর্চার ন্যায়। যেমন, ‘ঘোড়াদর্শন’ কবিতায় ভাষার কৌতুক ও ব্যঞ্জনার এমনতরো সহাবস্থান দেখা যায়, যা বাংলা কবিতায় দুর্লভ: ‘ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে হাগে-মুতে—কি যে মনোহর লাগে।’  এই অবলোকন এক ট্যাবু-ভাঙা নজর। ঘোড়া এখানে এক প্রতিষ্ঠানিক দেহপ্রকল্প—যার পেছনের অবাধ্যতা, বর্জ্য ও মল মূত্র প্রতীকি হয়ে ওঠে। এ এক ধরণের ‘অন্তর্বিষয়ক রিয়ালিজম’ যেখানে ভাষা নিজের গায়ের পাঁক মেখে দাঁড়ায়।


অন্যদিকে, ‘কদম ফল ও বেহুলা’ কবিতায় রশীদ হারুণ ভাঙা পঙ্‌ক্তিতে নির্মাণ করেন নারী, মিথ, যৌনতা ও লৌকিকতার নতুন সংলাপ-‘শাড়ী বাহার    ঠোঁট রাঙি    স্নো-পাউডার    মিহি সাবান/ রূপ কুমার    শিবলিঙ্গ    কিল গোসাই    এসিড ছোঁড়া/ ধর্ষকানা    মডেল সাজা    শিশুর বাবা    শাসন মালি...’ এই ফর্মে বাক্য নেই, ছন্দ নেই, কিন্তু আছে জ্যামিতিক পুনরাবৃত্তি। এখানে প্রতিটি বস্তু হয়ে ওঠে প্রতীক, প্রতিটি উচ্চারণ একটি বর্জনীয় রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট।


রশীদ হারুণের কবিতায় প্রতীক ও ব্যঞ্জনার ব্যবহার নিয়ত বহুরৈখিক। একটি প্রতীক একটি অর্থে স্থির থাকে না। প্রতিটি পাঠে নতুন নতুন ব্যঞ্জনা মেলে। যেমন—‘আষাঢ়’ কবিতায় জল, বৃষ্টি, কদম—এই পুরাতন প্রতীকগুলো মিশে যায় যৌনতা, অপেক্ষা, মাতৃত্ব, মৃন্ময়তায়। কবি লিখছেন—‘ফুল্লরিত বৃষ্টির বাগান/ উল্লসিত বীজের বাহার/ প্রসবের সঙ্গীত শোনায়...’ বৃষ্টি এখানে নারী-শরীরের  প্রাণ-জৈবনিক উৎসার। এটি এক ধরণের গর্ভরূপক যেখানে আষাঢ়ের মৌসুমি জল স্পর্শ করে জীবনের গর্ভস্রোত। এই ব্যঞ্জনা আরও প্রসারিত হয় ‘ঘোর গাথা’-তে, যেখানে ম্যাজিক, পরী, বোরহেস, আশিফা, লিঙ্গ, ধর্ম, রাষ্ট্র—সব একসঙ্গে এক আখ্যানিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এ যেন এক মহাযজ্ঞ, যেখানে প্রতীক তার প্রচল-সংকেত হারিয়ে ফেলে এবং নতুন ভাষ্য নির্মাণ করে। ‘দাগ’, ‘খুন কিংবা গুড়ো কাঁচ’, ‘কর্পোরেট’, ‘রক্তজাত’—এইসব কবিতায় প্রতীক হয়ে ওঠে অস্তিত্বের চাপা-অভিজ্ঞতা। ‘দাগ’ মানে ইতিহাসের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অবিন্যস্ত মানবচিহ্ন। এই প্রতীকচর্চা কখনো কখনো মেটাফোর ছাড়িয়ে গিয়ে মেটান্যারেটিভ হয়ে ওঠে।


রশীদ হারুণ অলঙ্কারের প্রতি ঋদ্ধ, কিন্তু পরম্ভক্ত নন। তাঁর কবিতায় অলঙ্কার থাকে না একধরনের সজ্জারূপে; অলঙ্কার হয়ে ওঠে মূর্ছনার মতো—ধ্বনি ও ছায়ার মধ্যে এক ঘোরফেরা শব্দাত্মা। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, বক্রোক্তি—সবই আছে, তা সচেতনভাবে ব্যবহৃত হয়নি। এগুলো যেন ভাষার ভেতরে জন্মানো এক এক ধরনের ছায়াপাত, যা ব্যাখ্যা করা কঠিন, অনুভব করা সহজ। যেমন ‘চোখ-তত্ত্ব’ কবিতায়—‘কাঁটাতারে চোখ বসি। কাঁটায় কাঁটায় জুড়ি উড়ান দিনের ভষ্ম।/ দৃশ্যের বিবেকে, ঝরে পড়ে : মৃত্তিকার দ্বীপ। নির্জন প্রবেশ।’ এই অলঙ্করণ কোনো একরৈখিক নন্দনের দাসত্ব মানে না। এটি এক ধরণের যন্ত্রণাকেন্দ্রিক অলঙ্কারচর্চা। রশীদ হারুণের অলঙ্কারিকতা আরেকটি জায়গায় অনন্য তা হলো তাঁর ধ্বনি ও ছন্দ। এখানে ‘র‍্যাপ’-এর মতো এক ছন্দ থাকে কখনো, আবার কখনো গুরুভার ব্রহ্মবাক্যের মতো শ্রুতিময়। ‘ব্র‍্যান্ডিং’, ‘প্রফুল্ল দিগন্তে গেছে, তাকে ডাকো’ কবিতাগুলো যেন এক ধরণের কনসেপচুয়াল পারফরমেন্স, ভাষার অলঙ্কার এখানে শরীরী নয়, রাজনৈতিক।


তার কবিতা সেই বিরল কবিতাগুলোর একটি যেগুলো পাঠকের উপর অর্থ চাপিয়ে দেয় না। এর অর্থ উন্মোচন ঘটে ধীরে ধীরে অনুভব, উচ্চারণ, স্মৃতি এবং শরীরের মধ্য দিয়ে। অনেকসময় অর্থের উপস্থিতি থেকেই যায় এক ধরণের রহস্যরেখায়। এই রহস্যই কবিতার গভীরতা। ‘মৃত-অশ্বনামা’ কবিতায়-‘ হ্রেষা-সিক্ত নয়নের কিন্নর কেশর। বিষণ্নœ-মোটিফ, হায়/ মৃত্যুর সনদ কি রেখেছো লিখে? হ্রেষাহীন অশ্ব সকলেই দেখবার চায়?’ এখানে অশ্ব শুধু অশ্ব নয়। এটি ইতিহাসের দৌড়, পুরাণের বয়ান, রাজনৈতিক পালাবদল এবং সময়ের রক্তাক্ততা—সবকিছুর এক মহামেটাফোর।


‘বেওয়ারিশ’ কবিতার কুকুর যখন মিউনিসিপ্যালিটির চোখের সামনে ‘পা তুলে হিসু করে’, তখন তা প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক নিঃশব্দ চিৎকার—বিনাশের মহাকাব্য যেন এই হিসুতে রচিত হয়। এই অর্থের স্তরায়ন রশীদ হারুণ এমনভাবে গড়েন, যেন তা পাঠককে বাধ্য করে থেমে যেতে, ফিরে যেতে আর বারবার ভাবতে। 


এই ভাষা কোনো একরৈখিক গন্তব্যে পৌঁছায় না। জ্যামিতির বক্ররেখায় ভাসতে ভাসতে আমাদের চোখে এক আলোক-অবয়ব ফেলে। সে অবয়ব হয়তো তা শুধু ছায়া, সেই ছায়াই তো শেষমেশ ভাষারই এক অবয়ব।


২. 

নান্দনিকতা এটি এক ধরণের গভীর চৈতন্যের জ্যামিতিক উত্তরণ। ‘কথানহর’ কাব্যগ্রন্থে রশীদ হারুণ কবিতাকে ভাষার একটি অবয়বমাত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি; কবিতার প্রতিটি শরীর, ভাঁজ, ছায়া, ছিন্নাংশ ও সংহত বিন্দুর ভেতর এক অবিরাম গঠনতত্ত্ব রচনা করেছেন। এই গঠন রৈখিক নয়, স্তরায়িত; ব্যাকরণিক নয়, স্পন্দনাত্মক। কবিতার যে বহমানতা আমরা দেখি তা এক নদী-স্মৃতি, অথচ নদীর খাত নেই; এটি ভাষার শরীর, কোনো বাঁধা অঙ্গসংস্থান নয়। এভাবেই রশীদ হারুণ গড়ে তোলেন এক বিশেষধর্মী কাব্যিক নান্দনিকতা—যার উৎস আত্মিক, স্থাপত্যিক এবং শব্দগত বিকারে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে নান্দনিকতা প্রায়শই অর্থ বা চিত্রকল্পের সঙ্গেই সমার্থক হয়ে থেকেছে। এখানে ‘কথানহর’-এ নান্দনিকতা একপ্রকার চিন্তার নির্মাণ। তার ভেতর রয়েছে জ্যামিতির বৈপরীত্য, ব্যাকরণের অপচ্ছায়া এবং সময়ের অশরীরী ইশারা।


রশীদ হারুণের কবিতার শরীর অনিয়মিত, অসমমিতিক, গভীরভাবে পরিমিত। তাঁর কবিতাগুলোর গঠনে লক্ষ করা যায় শব্দের চিত্রায়ন, স্তবকের অঙ্গবিন্যাস, বাক্যছিন্নতা ও শূন্যস্থানকে তিনি ব্যবহার করেছেন এক বিশেষ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত উপাদান হিসেবে। এটি ভাষার ভেতরে থাকা নীরব গঠন। ‘ঘোর গাথা’ কবিতাটি একটি উন্মত্ত স্থাপত্য। এখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদ এক একটি ঘর; কেউ গান গায়, কেউ হাড় দিয়ে ম্যাজিক দেখায়, কেউ পরীকে ডাকে। এই মাল্টিলেয়ারড সংগঠন পাঠককে কোনো একরৈখিক আবেগ বা ভাবনায় স্থির থাকতে দেয় না। কবিতাটি পড়ে মনে হয় যেন এক গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি। প্রতিটি বাক্য এক দরজা খুলে দেয়, আবার আরেকটি বন্ধ করে। এটি এক নান্দনিক অবরোধ যা পাঠককে গ্রাস করে। এই ধরনের আর্কিটেকচারাল ফর্মের অনুপুঙ্খ উদাহরণ ‘কথা নহর’ শীর্ষক কবিতায় স্পষ্ট—‘কথার বলয় চক্রে, সময় হয়েছে চিন্তা... প্রান্তের তালাশ লিপি.../ আমাদের রক্ত, জল হয়ে, অশ্রুতে ঝরেছে শুরু কালে/ ছায়া পাঠ সরে সরে এসেছো সত্ত্বার শিল্প হছেষ্ট’। এখানে শব্দের বিন্যাসে একটি বৃত্ত গঠন করা হয়েছে—‘চক্র’, ‘তালাশ’, ‘লিপি’, ‘রক্ত’, ‘ছায়া’, ‘সত্ত্বা’। শব্দের মধ্যেকার সম্পর্ক এই পঙ্‌ক্তিগুলোকে গঠনে এক ধরণের প্রাচীন মন্ত্রোপম স্তবকে পরিণত করে। এই নির্মাণে কোনও আরাম নেই; এটি বোধ ও গঠন—দুইয়ের সংঘর্ষে গঠিত নান্দনিক সংকেত।


তিনি কবিতায় যে ছন্দ ব্যবহার করেন, তা প্রথাগত ছন্দ-পরিসরের বাইরে এক অন্তর্গত স্ট্রাকচারের মধ্যে নিজস্ব ছন্দ তৈরির প্রয়াস। এটি যেন এক ধরণের শব্দ-ভিত্তিক কম্পোজিশনাল রিদম। কোথাও কোথাও এটি জ্যামিতিক প্যাটার্নে বাঁধা, আবার কোথাও গদ্যের মতো ধরা পড়ে, আসলে তা না গদ্য, না পদ্য—বরং এক ধরণের ‘ছন্দিত ধ্বনি-গঠন’। ‘মরমী সনেট’ কবিতাগুচ্ছ এই স্ট্রাকচারাল ছন্দের উজ্জ্বল উদাহরণ। শারীরিকভাবে সনেটের ছাঁচ অনুসরণ করলেও তাতে রয়েছে ছন্দের বিকার, বাক্যের বিক্ষোভ এবং অলঙ্ঘনীয় আভ্যন্তরীণ সুর। ‘ঘড়িকাটা দীঘি জলে ঘড়িকাঁটা সাপে বাস শানে/কেউতো বলেনি কাঁটা, বিঁধেছে, মাথার মধ্যিখানে।’ এই ছন্দে আছে অশরীরী বিপন্নতা। ‘ঘড়িকাঁটা’ শব্দের পুনরাবৃত্তি সময়-ধ্বংসের দ্যোতনায় নান্দনিক গূঢ়তা তৈরি করে।


কোনো-কোনো কবিতা যেমন ‘ফেরা’, ‘শুন্য’, ‘বিরহ’, ‘আষাঢ়’—এই কবিতাগুলোর গঠন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে বাক্য নেই, কেবল ক্ষীণ উচ্চারণের শরীর আছে। এ এক অন্তরীক্ষিক নির্মাণ, যেখানে কবিতা হয়ে ওঠে নীরব স্তব। ‘ফেরা’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় যেন শব্দ নেই, কেবল শব্দের প্রতিধ্বনি আছে। সেখানে কবি লেখেন—‘মানুষ দেখতে পাই, নিজেকে দেখতে পাইনা/ যে পাতাটি খুব নড়ে, তাকেও দেখতে পাইনা...’ এই চিত্রকল্প গঠিত হয়েছে একটি অভাবের গভীরতা থেকে। কবিতার নান্দনিকতা এখানে অনুপস্থিতির ভেতর। না-দেখতে পাওয়া—এই অনুপুঙ্খতা থেকেই জন্ম নেয় ভাষার বিপরীত বাস্তবতা। 


রশীদ হারণের কবিতা আসলে সৌন্দর্যের নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে। এখানে নান্দনিকতা দাগ, বিকৃতি, ক্ষতচিহ্ন। এখানে নান্দনিকতা তীব্রভাবে কুৎসিত, তীব্রভাবে মানবিকও। কবিতা এমনকি দুর্গন্ধেও কবিতার সম্ভাবনা খোঁজে। এই নান্দনিক দর্শন একধরনের অ্যাবসার্ডতাকে মনে করায় আবার কখনো ঘোরে-ঢাকা মধ্যযুগীয় দেহতত্ত্বের চরম সাহসিকতাকেও। ‘কথানহর’ কবিতাগুলোতে ফাঁকা জায়গা বা শূন্যস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যময়। শূন্যতা নিজেই এক নির্মাণ। যেসব কবিতায় বাক্য ছিন্ন, পঙ্‌ক্তির মাঝখানে শূন্যতা বা স্পেসিং দেওয়া হয়েছে সেসব শূন্যতাই এক ধরণের ‘অচিহ্নিত উচ্চারণ’ তৈরি করে। ‘ইলিউশন’ কবিতায় যেমন—‘আকাশের মুঠো মুঠো শ্বাসনীল স্বর গিলে... জেনে গেছি,/ শব্দে-নিঃশব্দে শিল্পের স্তদ্ধ তার ভাঁজে অশ্রুর আঙুল’। এখানে পঙ্‌ক্তিভাগ ও বিরাম—দুটি মিলেই গঠন করে এক নীরব স্থাপত্য। পাঠক যেন হঠাৎ থেমে যায় এবং সেই থেমে যাওয়া শব্দের চেয়েও বেশি বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই ব্যবধানই কবিতাকে নির্মাণ করে এক অশরীরী ঘর।


‘কথানহর’-এর যে বৈশিষ্ট্য তা হলো তার আভ্যন্তরীণ শরীর। এ কারণে এই কবিতা—পাঠযোগ্য নয়, অনুভবযোগ্য। এর নান্দনিকতা পাঠককে অনুভবের জন্য প্রস্তুত হতে বলে; তাকে একটি নির্মোহ, নগ্ন আত্মসাক্ষাতে নিয়ে দাঁড় করায়।


৩. 

‘কথানহর’ এটি এক নিভৃত, অথচ সম্যক ধ্বনির প্রতিধ্বনি—যা প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা, রাষ্ট্র এবং বাজারের ভাষিক বলয়ের বিরুদ্ধে এক নির্মোহ প্রতিবাদ। রশীদ হারুণ তাঁর কবিতায় যে স্বরটি নির্মাণ করেন, তা শিল্পসৌকর্য এবং শিল্প-অস্বস্তির নিজস্ব গঠন। তাঁর কবিতা প্রতিষ্ঠানিক অভিধান ভেঙে ফেলে। ‘ভাষা’ তাঁর কাছে এক বেঁচে থাকার কৌশল। যেখানে প্রতিটি শব্দ এক একটি চোরাগলি, প্রতিটি স্তবক এক একটি মাটির ঘর, যা ঘূর্ণিপাকে নড়বড়ে হয়।


এই ‘অচ্যুত দোলাচলে’ কবি নিজেকে দাঁড় করান এমন এক সীমান্তে, যেখানে কবিতার প্রধান ভূমিকা হয়ে ওঠে প্রতিসংসারের উচ্চারণ। এই উচ্চারণ অনেকসময় চুপচাপ, নিঃশব্দ, অথচ ভয়াবহ রকম তীব্র। এই চুপচাপ উচ্চারণের বিপরীতে যে প্রতিষ্ঠানমুখহীন কবিতা দাঁড়িয়ে থাকে, তা প্রতীকী বা অলঙ্কৃত ছাড়াও নিপুণতা ও ক্ষমতারও স্বর-সম্পন্ন। রশীদ হারুণ সেই ক্ষমতা শব্দের স্বরকে অনুল্লিখিত রেখেই তাকে উপহাস করেন, প্রশ্ন করেন, বাতিল করেন।


‘ব্র‍্যান্ডিং’ শিরোনামে কবিতাটি এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী উচ্চারণের একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। এখানে কর্পোরেট-বাজার অর্থনীতির ভাষাকে কবি আয়ত্তে নেন এবং সেই ভাষাকেই কবিতার উপকরণে পরিণত করেন। কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের বাঁধা বুলি, ব্যবস্থাপনার ভাষা, কৃষি ও উৎপাদনের ভ্রান্ত ধারণা—সবকিছু মিশে একটি দৃষ্টিকটুভাবে সজ্জিত ভাষাবস্তু হয়ে ওঠে আর কবি এই ভাষাকে উদ্ধৃতির মধ্যে এনে, একধরনের নাটকীয় উচ্চারণে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। যাতে পাঠক বুঝতে পারেন, এই ভাষা আসলে নিজেই একটি নকল প্রতিষ্ঠান। ‘তোমাকে ব্র‍্যান্ডিং করো, নিজেই উপস্থাপিত হও.../ না হয় অন্যের ব্র‍্যান্ড হয়ে যাবে, এটা আমাদের.../ বা আমার.../তাদের দায়িত্ব ফসল ফলিয়ে যাওয়া.../ তাদের জন্যই আমরা উৎসর্কীকৃত...’ এই উচ্চারণ প্রতিষ্ঠানের নির্লজ্জ দখলবাদীতার এক ব্যঙ্গাত্মক বিবরণ। এখানে ‘তোমাকে ব্র‍্যান্ডিং করো’ এই নির্দেশ আসলে এক বিষাক্ত আদেশ। এটা রাষ্ট্র, কর্পোরেশন, বাজার কিংবা গণমাধ্যম যারাই মানুষকে পণ্যে পরিণত করে তাদের কণ্ঠস্বর।


‘কথানহর’-এ কবির প্রতিরোধচেতনার একটি মৌলিক দিক হলো তিনি বুঝতে পারেন ভাষাও এক প্রকার প্রতিষ্ঠান। ফলে, কেবল অর্থনীতি বা রাজনীতির বাইরে ভাষার ভেতরেও কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা জমা থাকে। তাই তাঁর কবিতা ভাষার ভেতরেই বিরুদ্ধতায় একটি বিকল্প ব্যাকরণ রচনা করেন, একটি দ্ব্যর্থময় বাক্য, একটি অনুপুঙ্খ সংগঠন গড়ে তুলে। ‘দাগ’ কবিতায় দেখা যায়, ভাষা দিয়ে কোনো ‘পরিচয়’ বানানো হচ্ছে না, সেই পরিচয় ঘোলা, মুছে দেওয়া, ক্ষতচিহ্নিত:

‘দাগ বলতে কিছু নেই/ আমরা যা কিছু জোড়াতালি তা-ই পরিধেয়’ এই উচ্চারণ কবিতাকে একটি ইতিহাসহীনতার মধ্যেও স্থাপন করে। যেখানে ভাষার সাথে সাথে মুছে যায় মানুষের পূর্বসূত্র।


রশীদ হারুণের কবিতায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘ভাষার স্থানচ্যুতি’। অর্থাৎ যে ভাষা মূলধারার প্রকাশমাধ্যমে প্রমিত, সাহিত্যমার্গে স্বীকৃত—সেই ভাষা তিনি ব্যবহার করেন না, তিনি গড়ে তোলেন ‘ঘরের ভাষা’, ‘গালিগালাজের ভাষা’, ‘মায়ের ভাষা’, এমনকি ‘শরীরের ভাষা’। ‘ব্যক্তিগত লবণ’ কবিতায় মা ও সন্তানের মধ্যকার স্মৃতির খণ্ডচিত্র একেবারে আর্থ দৈনন্দিন পরিসর থেকে উঠে এসেছে। এখানে ‘লবণ’ কেবল খাদ্য নয় এটি স্মৃতি, শ্রম, দারিদ্র‍্য, পরিচয় ও প্রতিরোধের চিহ্ন হয়ে ওঠে। ভাষার ঘর আর বাজারের ঘরের মধ্যে যে ব্যবধান রশীদ হারুণ তার প্রতিটি শব্দে সে ব্যবধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ‘লবণ নিয়ে ভাবছি অনেক দিন ধরে.../ মা আর আমি, নিজেদের ভেতর আর বাহিরের লবণ মুছতে থাকি...’ এই যে মুছতে থাকা এটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক ভাষাচর্চা, যেখানে চিহ্নিতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, উচ্চারণের বদলে নিঃশব্দতা এবং লেখার বদলে ঘর্ষণের কৌশল দেখা যায়।


‘মরমী সনেট’ চক্রে ধর্মীয় রূপক ও আখ্যানকে কবি ব্যবহার করেছেন প্রশ্নমুখী এক অলংকার হিসেবে। এখানে সনাতনের প্রতিষ্ঠিত ব্যাকরণকে না মেনে ঈশ্বর, রাধা-কৃষ্ণ, রাই, শাস্ত্র, সনাতন প্রেম—সবই ব্যবহৃত হয়েছে । প্রতিটি চিত্রকল্পের নিচে রয়েছে সংশয়, দ্বন্দ্ব, ব্যর্থতা। ‘কৃষ্ণপুর রাধাহীন। রাত জাগা প্রহরী দাপট/ অস্ত্র হাতে পাহারায়... তৈরী সমাজের বর্শা-গাঁই’ এখানে ‘রাধাহীন’ কৃষ্ণপুর আসলে প্রেমহীন সমাজ এবং সেই শূন্যতাকে পাহারা দিচ্ছে ‘সমাজের বর্শা-গাঁই’ একটি ব্যঙ্গাত্মক রাজনৈতিক ছবি, যেখানে প্রেম আর ঈশ্বর নেই, আছে কেবল প্রহরী ও অস্ত্র। একইসাথে ‘আগস্ট ১৯৭৫’, ‘মৃত্যুর পর কয়েক দিন’, ‘দহলিজে’—এই কবিতাগুলোতেও রাষ্ট্রের ইতিহাসবর্ণনার বিরুদ্ধে এক বিকল্প ভাষ্য রচনা করা হয়েছে। ইতিহাস এখানে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা চেতনার শব্দসাধনা।


রশীদ হারুণের কবিতা যন্ত্রণার সংগীত। এটি বেদনাবিলাসী নয়, গভীরভাবে রাজনৈতিক। কারণ, তিনি জানেন—ব্যথা, বঞ্চনা ও ঘৃণার অভিজ্ঞতাকে যদি ভাষায় রূপ দেওয়া না যায়, তবে কবিতা হয়ে পড়ে তুচ্ছ গদ্য, নিছক অলংকৃত বাক্য। এই যন্ত্রণাকে তিনি বহন করেন বিভিন্ন প্রতীকে, যেমন—‘মৃত অশ্ব’, ‘ছুরি শানা চোখ’, ‘মেঘদল’, ‘পাথরের আত্মা’, ‘ত্রিখণ্ড করা ভূমি’। এইসব প্রতীক রক্তাক্ত, অব্যবস্থিত, অস্থায়ী—কিন্তু তার মধ্যেই টিকে থাকে কবিতার অস্তিত্ব। ‘আমাদের রক্তগণ ঘরে আর টিউশনে ইউক্লিড ইউক্লিড পড়ে/ তার নাম শুনে লজ্জা হচ্ছে!’ (কথা নহর) এই উচ্চারণ এক নব্য-রাজনীতির ঘোষণা। ইউক্লিডের নাম শুনে ‘লজ্জা’ হয় কারণ প্রতিষ্ঠিত জ্যামিতির ভেতর নেই মানুষের মাটি, মায়ের দেহ, জ্যোৎস্না, ঘর। এখানেই কবিতার স্থাপত্য হয়ে ওঠে প্রতিরোধের অঙ্কন।


এই সব উচ্চারণের ভিত্তি যে তিনি লিটলম্যাগ চেতনায় দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করছে তা স্পষ্ট। কারণ, ‘কথানহর’-এর কবিতা কোনো পুরস্কারপ্রাপ্ত, পৃষ্ঠপোষকতায় ঘেরা আত্মবিশ্বাস ভেঙে এক অন্তর্গত নির্জনতা থেকে উঠে আসা কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বর তার বিরোধ তার ঘুরপাক তার ভাষাগত অস্বস্তি— সবই আসলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানের প্রতিফলন। রশীদ হারুণ নিজেকে একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ দেখান না। তাঁর আগ্রহ কবিতাকে জীবনের মতো করে লেখা, ভাষাকে চিরায়ত ব্যাকরণ থেকে উদ্ধার করা আর পাঠককে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া। তাঁর কবিতার কাঠামো, বিষয়, ভাষা সবই লিটলম্যাগ চেতনাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে।


‘কথানহর’ আসলে এক প্রকার কবিতা এক্টিভিজম। এখানে প্রতিটি কবিতা এক প্রতিরোধের দলিল। শব্দ প্রতিবাদের পাথর এবং সেই পাথর ছোঁড়া হয় ভাষার কাঠামোতে, ইতিহাসের প্রতীকে, রাষ্ট্রের নির্লজ্জ প্রণোদনায়। এই কবিতা আত্মশ্লাঘার নয়; এটি আত্মপ্রতিষ্ঠার নয়; এটি আত্মরক্ষা নয়; এটি আত্মদাহ এবং এই আত্মদাহেই জন্ম নেয় সেই ভাষা যা প্রাণ ও রাজনীতির সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করে নতুন বিধান।



৪. 

কবিতা যখন আত্মার একটি অতল বিন্যাস হয়ে ওঠে, তখনই তা শিল্প হয়ে ওঠে। সেই শিল্পত্ব কোনো চিহ্ন দিয়ে বোঝানো যায় না, কেবল অনুভবের ধারে, প্রতিধ্বনির ছায়ায় তার উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। ‘কথানহর’ গ্রন্থে রশীদ হারুণ যে কাব্যিক ভাষা নির্মাণ করেন, তা এমন এক শিল্পপ্রকল্প। যেখানে কবিতা নিজেই নিজেই নিজের প্রশ্ন হয়ে থাকে। এই প্রশ্নের উত্তর নেই, প্রশ্নটির নিজস্ব শৈলী আছে, নিজস্ব স্নায়বিক ছন্দ আছে, যা শিল্পকে কেবল বাহ্যিক নয়, অন্তঃস্থ এক অভিজ্ঞতা করে তোলে। এই অভিজ্ঞতা কোনো রঙিন পটে আঁকা সৌন্দর্যেও একটি ঘোর, একটি চৈতন্যের প্রান্তবর্তী দুর্বল আলোকবিন্দু। যেখান থেকে জন্ম নেয় ‘আলো’-এর তলদেশ, ‘অন্ধকার’-এর আত্মপ্রতিচ্ছবি। শিল্প এখানে ঘাম, ঘোর এবং মস্তিষ্কের অন্তর্গত স্নায়ুব্যবস্থার মতো এক রক্তচলাচলও বটে।


রশীদ হারুণের কবিতা শিল্প হয়, কারণ তা নিজেই আত্ম-অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধান কোনো ভাববাদী, দার্শনিক নির্বাকতায় প্রতিটি কবিতার ভেতরই এক নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী আত্মা দাঁড়িয়ে থাকে অবিশ্বাসের দোলায়। এই আত্মা আত্মবিশ্বাসে ভারী নয়। সংশয়ে, স্নায়ুচাপে, ক্লান্তিতে আক্রান্ত আর সেই ক্লান্তিই শিল্পের গভীরতম পরিণতি। ‘মৃত অশ্বনামা’ কবিতায় এক প্রকার অস্তিত্ববাদী মৃত্যুচেতনা ও মনোপর্যবেক্ষণের সম্মিলন দেখা যায়, যেখানে শব্দ হয় অশ্বের দেহ, তার কণ্ঠ হ্রেষার ধ্বনি  আর রক্তের ভেতর জন্মানো উচ্চারণহীনতা—‘হ্রেষা-সিক্ত নয়নের কিন্নর কেশর। বিষণ্নœ-মোটিফ, হায়/ মৃত্যুর সনদ কি রেখেছো লিখে? হ্রেষাহীন অশ্ব সকলেই দেখবার চায়?’ এইখানে শিল্প চিত্রায়নে আত্ম-আখ্যানে এক ধরণের হ্রাস। নিজের অস্তিত্ব নিয়েই কবি সন্দিহান এবং এই সন্দেহই কবিতার সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে শিল্পিত প্রকাশ।


ফ্রয়েডীয় ঘরানার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শিল্পমানস মনস্তাত্ত্বিক স্বল্পতা, বিকার, চেপে রাখা ইচ্ছা ও অবদমিত বেদনার এক সম্মিলন। রশীদ হারুণের কবিতাগুলোতে আমরা সেই অবদমিত স্বরকেই উথলে উঠতে দেখি। কখনো মায়ের প্রসববেদনায়, কখনো শহরের কুকুরের অনাহারে, কখনো রাষ্ট্রীয় ভাষার নিস্তরঙ্গ বাক্যদানে। ‘ব্যক্তিগত লবণ’ কবিতার যে উচ্চারণ—‘মা তার ভেতরের রক্ত মুছতো রোজ,/ আমি আমার প্রতিদিনের চিন্তাজাত লবণ মুছি রাতের চাদরে।’ এখানে ‘লবণ’ একাধিক স্তরে অবস্থান করে জৈবিক, আত্মীয়, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক। এ লবণ শুধুই শ্রাবণ পরবর্তী এক ধরনের অবচেতন অভিজ্ঞতা, যা কবির মনোজগতকে গ্লানি এবং শুদ্ধির যুগপৎ পরিসরে দাঁড় করায়।


এই যে নিজেকে খুঁড়ে দেখা, নিজেকে দেখে আতঙ্কিত হওয়া, নিজেকে না দেখতে পাওয়ার বেদনা এসবই আসলে মনোসমীক্ষার আধারে রচিত শিল্পের ভেতরকার নির্জনতা। ‘কথানহর’ এই নির্জনতার কবিতা। এখানে উচ্চারণ হয়, কিন্তু অনুচ্চার্য শব্দের গায়ে। ‘বেহুলা’, ‘ঘোড়াদর্শন’, ‘মৃত-অশ্বনামা’-য় আখ্যান ও অভ্যন্তর । রশীদ হারুণ অনেক কবিতায় আখ্যানের আবহে এক ধরণের স্বপ্রণোদিত প্রতীকমালা তৈরি করেন। বিশেষত ‘বেহুলা’, ‘ঘোড়াদর্শন’ এবং ‘মৃত-অশ্বনামা’—এই তিনটি কবিতা তার প্রতিরোধী শিল্পরূপের প্রতিনিধিত্ব করে।  


‘বেহুলা’ কবিতাটি নারী, পুরাণ, প্রসব, দেহ এবং রাষ্ট্রের অন্তর্বিন্যাসে রচিত। এখানে বেহুলা কেবল লখিন্দরের স্ত্রী নয়; তিনি হয়ে ওঠেন জ্যোৎস্নায় ভেজা একটি মানবভাষা, যাকে রাষ্ট্র অনুমোদন দেয় না। ‘ঘোড়াদর্শন’ কবিতাটি এক উচ্চারণমূলক গদ্য-কবিতা। এখানে ‘ঘোড়া’ প্রতীক হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের মেটাফোর আর সেই ঘোড়ার মলত্যাগ এক অভ্যন্তরীণ, আত্মবিরোধী হাস্যরস। এই কৌতুক নয়, বিদ্রূপ নয়—এটি এক শিল্পিত মনোবিদগ্ধতা। 


শিল্পের ঘাম এবং ভাষার আতঙ্কে রশীদ হারুণের কবিতা কখনো পরিষ্কার নয়। এটি পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টাও করে না। যে ভাষা পরিস্কার সেই ভাষার প্রতিকূলে গিয়ে কবি গড়ে তোলেন এক দুর্বোধ্য, কিন্তু রক্তাক্ত বাক্যবন্ধ। যেখানে চেতনা, ইতিহাস, ক্ষত ও অলীকতা একসঙ্গে বসবাস করে। এ বসবাস কবিতাকে করে তোলে অলংকারমুক্ত, কিন্তু অলঙ্কৃত। ‘অবৈধ’, ‘রক্তজাত’, ‘বেওয়ারিশ’—এই কবিতাগুলোতে প্রতিটি শব্দই যেন আতঙ্কিত। কবি শব্দ ব্যবহার করেন না; তিনি শব্দকে জাগান, ঘুম ভাঙান, কখনো গলা টিপে ধরেন। এই আতঙ্কই কবিতার শিল্পত্বের প্রারম্ভ। শিল্প যখন নির্জনতা এবং নির্যাতনের অন্তঃস্বও রশীদ হারুণের কবিতা শিল্প হয়, কারণ তা কোনো অর্থের দায় বহন করে না। এটি সজ্জার প্রয়োজনীয়তায় জন্মায় না, অপ্রয়োজনীয় শব্দ ও অর্থের মধ্যে এক ধরণের নতুন স্নায়বিক তাপ তৈরি করে। এই ‘তাপ’—এটিই শিল্পের মৌলিক চিহ্ন।


‘শূন্য’, ‘সময়’, ‘ইলিউশন’—এসব কবিতায় যেভাবে নির্জনতা কাজ করে, তা কেবল বৈষ্ণবিক বা অস্তিত্ববাদী নয় বরং এক ধরণের নির্যাতনের স্বরূপ। কবিতা এখানে যেন ভাষাহীনতার এক সংবেদন যেখানে শব্দ নেই, কিন্তু ব্যথা আছে। এই ব্যথা গঠিত হয়েছে জৈবিকতা, পরিত্যক্ততা এবং পুনরুজ্জীবনের অভ্যন্তরীন টানাপোড়েনে। রশীদ হারুণের কবিতায় শিল্পত্ব ও মনোসমীক্ষার যে অননুকরণীয় যোগসূত্র তৈরি হয়েছে, তা বাংলা কবিতার এক অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রার ইঙ্গিত দেয়। এই অভিযাত্রায় পাঠক স্বস্তি পায় না; সে যন্ত্রণা পায়, বিভ্রান্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে খুঁজে নিতে বাধ্য হয় এক অজানা গভীরতায়। সেই গভীরতা কবিতারও, পাঠকেরও এবং মানুষ হওয়ার অন্তঃপুরেরও।


যখন কোনো কবিতা তার বিষয় নির্বাচনকে শুধু ভাষিক অভিব্যক্তির পরিণাম হিসেবে রাখে না, বিষয় নিজেই হয়ে ওঠে ভাষার গভীর অভ্যন্তরে এক প্রকার সক্রিয় প্রতিরোধ, তখন সেই কবিতা আর কেবল কাব্যিক থাকে না—তখন তা ইতিহাসের, রাজনীতির, দর্শনের, শরীরের, মনস্তত্ত্বের ও অনুভবের এক যৌথ গর্ভে পরিণত হয়। ‘কথানহর’ এমন এক গ্রন্থ যেখানে বিষয়বস্তু কোনো একক ধারা, প্রতীক, সমাজ বা মিথে আবদ্ধ নয়। এই কাব্যগ্রন্থ নিজেই এক অতিকথনের উদাহরণ, যেখানে ‘বিষয়’ শব্দটি ভেঙে পড়ে নানা অভিঘাতে, বহু ভাষ্য ও অগণন ভুবনে। রশীদ হারুণ কোনো একক দৃষ্টিকোণ, একরৈখিক প্রস্তাব কিংবা একমাত্রিক অভিজ্ঞতার কবি নন। তিনি বিষয়ের পরিসরে সৃষ্টি করেছেন এক দুর্ভেদ্য ও প্রবহমান নক্সা, যেখানে পুরাণ ও যৌনতা, রাষ্ট্র ও প্রতিরোধ, নারী ও নিসর্গ, শরীর ও আত্মা, অলৌকিকতা ও বাস্তবতা একসঙ্গে উপস্থিত থাকে। এই বহুস্বর, বহুবর্ণ, বহুবিস্তারী বিষয়বস্তু ‘কথানহর’-কে কেবল লিটল ম্যাগাজিনের গভীর পাঠ্য করে তোলে না। বাংলা কবিতার পরম্পরায় একটি সৃষ্টিশীল বিচ্যুতির পরিণত দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে।


বাংলা কবিতায় পুরাণের ব্যবহার নতুন নয়। কিন্তু রশীদ হারুণ পুরাণকে প্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যার অনুসরণে ব্যবহার করেন না। তিনি পুরাণকে ব্যবহার করেন একটি প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে যেখানে প্রতিটি পৌরাণিক চরিত্রই অস্থির, আধুনিক এবং ভাষাহীন। ‘বেহুলা’ কবিতায় পুরাণ এবং সমকাল একসঙ্গে মিশে গেছে। বেহুলা এখানে একধরণের রাষ্ট্র-নির্ধারিত মিথ, একধরনের যৌন প্রতীক, একধরণের বিপন্ন বেঁচে থাকা। ‘রাষ্ট্র তাকে বেহুলা নাম দেয়,/ একদিন সে মৃত হয়ে জন্ম নেয়,/তারপর জন্ম নেয় তার উলটো শরীর।’ এই উলটো শরীর একটি পৌরাণিক নারীত্বের বিনির্মাণ। পুরাণ এখানে পুনরুদ্ধারে এটি পুনর্লিখন এবং সেই পুনর্লিখন কবিতাকে এক নতুন ঐতিহাসিক সংলাপে স্থাপন করে।


‘কদম ফল ও বেহুলা’ কবিতায় যৌনতা একটি অভ্যন্তরীণ ভাষায় রূপান্তরিত হয়। রশীদ হারুণ যৌনতাকে গোপন রাখেন না; তিনি সেটিকে পুনরায় ভাষায় টেনে আনেন এক ধরনের সংকেতের ছায়ায়। সেই সংকেতে আমরা দেখি ‘রূপ কুমার’, ‘কিল গোসাই’, ‘এসিড ছোড়া’, ‘মডেল সাজা’—এইসব ইমেজে যৌনতা, বিকৃতি, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ মিলেমিশে যায়। এটি রাষ্ট্র এবং বাজারের যৌন দৃষ্টিভঙ্গিকেও বহন করে। ফলে, যৌনতা এখানে আর কেবল শরীরের অভ্যন্তর নয়; এটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্র ও সমাজের চোখ।


‘কথানহর’ কাব্যগ্রন্থে যে বিষয়ের বৈচিত্র‍্য লক্ষ করা যায়, তা কোনো তালিকা বা শ্রেণিবিন্যাসে আটকানো যায় না। একটি কবিতা যেমন রাজনৈতিক, তেমনি তা দার্শনিক; একটি কবিতা যেমন নৈঃশব্দ্যের, তেমনি তা প্রতিবাদের। ‘বেওয়ারিশ’ কবিতায় শহরের কুকুর যে আত্মা বহন করে, তা কোনো জন্তুপ্রেম নয়, এটি এক প্রতীক—শুধু পশুর নয়, রাষ্ট্রচ্যুত মানুষেরও। ‘পা তুলে হিসু করা কুকুরটা/ মিউনিসিপ্যালিটির দালানের সামনে দাঁড়িয়ে.../... কেউ তাকে না জানলেও ক্ষতি নেই।’ এই ‘হিসু’ এখানে ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ প্রত্যাঘাত। কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে শহর, দেহ, মলমূত্র এবং প্রশাসনিক মাকড়সাজাল। যেখানে ‘অবহেলা’ একটি নীতির রূপ নেয়।

নারীবীক্ষণ ও দেহ-রাজনীতির ভাঙনে রশীদ হারুণ যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারী চরিত্র নির্মাণ করেন, তা কেবল পুরাণভিত্তিক বা আত্মজৈবনিক। তাঁর কবিতায় নারী হয়ে ওঠেন এক প্রকার ছিন্নভিন্ন ভাষা, ভগ্ন উচ্চারণ, যন্ত্রণা ও গৌরবের যুগপৎ শরীর। ‘বেহুলা’, ‘ঘোর গাথা’, ‘কদম ফল...’, ‘মরমী সনেট’—এসব কবিতায় নারীর অভ্যন্তরে মিশে আছে মাতৃত্ব, যৌনতা, রাষ্ট্রিক প্রতিপক্ষতা এবং অস্তিত্বচেতনার ধ্রুব সংকেত। নারীর শরীর এখানে ঈপ্সিত নয় সে শরীর হয়ে ওঠে দাগ, ধ্বংস, দহন এবং মুক্তির অনুচ্চ শব্দ।


এই দেহচেতনার ভাষায় এক ধরণের ‘জীবিত কবিতা’ লেখা হয়। নারীর অভিজ্ঞতা এক শব্দশরীর, যা ব্যথার মধ্য দিয়েই ভাষায় রূপ নেয়। নিসর্গ, আধ্যাত্মিকতা ও অস্তিত্ব। তার কবিতায় প্রকৃতি কখনো কখনো অলংকরণে প্রকৃতি হয়ে ওঠে অস্তিত্বের এক গোপন ভাষা। ‘আষাঢ়’, ‘জলের কারখানা’, ‘চোখ-তত্ত্ব’ কবিতাগুলোতে আমরা  ‘চোখ-তত্ত্ব’ কবিতায় চোখ যেন একটি অনুভবযোগ্য প্রাণীতে পরিণত হয়। এটি শুধু দেখার এক চেতনাপ্রবাহ যেখানে ‘দেখা’ মানে অস্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ‘চোখের ভেতর বসে থাকে/ একান্ত দর্শনের উপশম...’ এই দর্শন শেষমেশ দৃষ্টি ও চেতনার অন্তরঙ্গ গলন।


রশীদ হারুণের কাব্যিক প্রকল্পের অন্যতম স্বাতন্ত্র‍্য হলো—তিনি বাংলা কবিতার কথ্য পরম্পরা বা প্রমিত আধুনিকতা থেকে নিজেকে সচেতনভাবে সরিয়ে নেন। তাঁর কবিতা সংলাপবিচ্ছিন্ন, ব্যাকরণবিরোধী, ছন্দ-ধ্বনি-বাক্যরীতির এক নতুন ব্যাকরণ নির্মাণ করে। বাংলা কবিতায় যেখানে আখ্যান ভাবনার একটি প্রথাগত ধারাবাহিকতা দেখা যায় ‘উচ্চারণ, ধ্যান, শিল্প-ভাষ্য, পাঠ’ সেখানে তিনি সেই ধারাকে ভেঙে কবিতাকে করেন ‘দুর্বোধ্য’, ‘অস্থির’, ‘আঁধারপ্রবণ’। এই বৈচিত্র‍্য এবং বিচ্যুতি—তার কবিতার গভীর শক্তি। তিনি ছন্দ বা অলংকার ব্যবহার করেন, কিন্তু তা অলংকারের স্বরূপে নয়; অলঙ্কারের পতন ঘটিয়ে এক অশরীরী বাক্যরীতি নির্মাণে এবং এখানেই তাঁর কবিতা রূপ নেয় ব্যতিক্রমী ঐতিহ্যবিচ্যুতি হিসেবে। যা বাংলা কবিতার মূলস্রোতের ব্যাকরণে জায়গা খুঁজে পায় না, অথচ এক অনিবার্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়।


এই কবির ‘কথানহর’ কাব্যগ্রন্থে অলঙ্কার একটি অন্তঃস্থ বিন্যাস। এ অলঙ্কার আবরণ নয়, আবেগ নয়, শুধু সৌন্দর্যের পরিপাটি নির্মাণ নয় তা ধ্বংস, অসঙ্গতি, ক্ষরণ, লজ্জা ও শূন্যতার এক সংগীতময় রূপান্তর। এখানে অলঙ্করণ একরৈখিক উপমা বা রীতিবদ্ধ প্রতীক নয়; এটি শরীরী, বিমূর্ত, বহুমাত্রিক ও ধ্বনিমগ্ন অভ্যন্তর। তদ্রূপ, চিত্রকল্পরাও তার কবিতায় আর শুধু বর্ণনামূলক চিত্র নয়। তারা অদৃশ্যের দেখা, প্রতিধ্বনির নির্মাণ, অনুভবের গন্ধ, নৈঃশব্দ্যের ঘোর। এইসব চিত্রকল্পে নেই দৃষ্টির আবশ্যকতা এরা আত্মা ও অবচেতনের অনুভব থেকে উঠে আসে, গড়ে তোলে সেই কবিতাশরীর, যা প্রকাশে নয়, প্রতিধ্বনিতে বেঁচে থাকে।


রশীদ হারুণ তাঁর অলঙ্করণে কোনো শ্রুতিমধুর উপমা বা প্রথাগত অনুপ্রাস নিয়ে আসেন না। তিনি ভাষার ভেতরে প্রবেশ করেন সেখানে লুকিয়ে থাকা টানাপোড়েন, অস্পষ্টতা, ফাটল, ক্লেদ। এইসব উপাদানকে নিজের কবিতায় পরিণত করেন অলঙ্কার। তাঁর চিত্রকল্প নেইমিত্তিক নয়, নির্দেশবিহীন; তীব্রভাবে সংবেদনশীল ও বিমূর্ত। একটি বাক্য, একটি ছায়া, একটি চুপচাপ থাকা এসবই তাঁর কবিতায় হয়ে ওঠে অলঙ্কার ও চিত্রের বিকল্প অবয়ব। এভাবেই ‘কথানহর’ হয়ে ওঠে বিমূর্ত অলঙ্করণ ও অনির্দেশ্য চিত্রকল্পের এক মহাসংকলন।


৫.

রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ কাব্যগ্রন্থে সময়, স্থান ও চেতনার বিন্যাস ও ভাঙচুর এক অন্তর্লীন অভিজ্ঞতার জটিল বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কবিতার মধ্যে সময় শুধু একটি ক্রমিক ধারা ছাড়া চেতনার ভেতরকার রক্তক্ষরণ, যা ব্যক্তি থেকে সমাজ, ইতিহাস থেকে স্মৃতি এবং বাস্তব থেকে স্বপ্নের মধ্যে অবিরাম চলাচল করে। বিশেষ করে ‘সময়’, ‘ফেরা’ এবং ‘অবৈধ’ কবিতাগুলোতে এই প্রবাহিত-সময় ও স্থানান্তরিত চেতনার বিচিত্র পরিসর অনন্যভাবে ধরা পড়ে।


‘কালের রেখায় চেতনার স্থানান্তর’—এই ধারণা রশীদ হারুণের কবিতায় এক অন্তর্লীন সূত্রবিন্দু। তিনি সময়কে কোনো ধ্রুব বিন্দু বা ইতিহাসের বন্ধনে এক প্রহেলিকাময়, তরল এবং প্রায়শই বিপরীতমুখী অভিজ্ঞতার ধারা হিসেবে দেখেন। ‘সময়’ কবিতায় (পৃথিবীর বস্তুজগতের সঙ্গে সংলগ্ন) উড়াল ব্রীজ, বটগাছ, বনভবন এবং বটফল এসব চিহ্ন হয়ে ওঠে এক অন্তঃস্থ চেতনার রূপক। কবিতার কয়েকটি পঙক্তি যেমন ‘উড়াল ব্রীজের ছিদ্রে বটফল টুপ করে বসে পড়ে পাখিটি তাকিয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ...’ এই পাখিটি যেন কবির চেতনার সাক্ষী, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে, এক অভিজ্ঞতা থেকে আরেক অভিজ্ঞতায়, এক উপলব্ধি থেকে আরেক উপলব্ধিতে স্থানান্তরিত হয়। আবার ‘বটের পাতাগুলো হাসে ঝুরঝুর করে’—এই হাসি কালের স্রোতে ক্ষয়িষ্ণুতা, যা সময়ের ভেতর থেকেও উঠে আসে।


চেতনার স্থানান্তর রশীদ হারুণের কবিতায় ‘স্থানের’ ধারণাকেও অস্থির করে তোলে। যেমন ‘ফেরা’ কবিতায় বাড়ির অচেনা হয়ে যাওয়া, মানুষের অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক উপাদানের (ধানক্ষেত, তুলো, হাওয়া) এক অদ্ভুত প্রাধান্য এই স্থানান্তরকে আরও জটিল করে তোলে—‘কোন পথে বাড়ি ফিরি?/ কয়জন লোক নড়েচড়ে হাওয়ায় সাথে বকে যাচ্ছে/ দেখতে পাচ্ছিনা ঠিক...’ এই অদৃশ্যমানতাই চেতনাগত স্থানান্তরের মূল। স্থান আর ধ্রুব স্মৃতির আঘাতে ফেটে গিয়ে কালের রেখায় বয়ে যায়, আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।


‘ফেরা’ কবিতায় সময়ের অনুভূতি এক স্রোতহীন, দিকবিহীন বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়। এখানে ফেরা মানে এক প্রকার অচেনা বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ। কবি যখন বলেন-‘নিজেকে নিজের মধ্যে দাঁড় করে দেই/ সারি সারি/ মানুষ দেখতে পাই, নিজেকে দেখতে পাইনা...’ তখন সময়ের সরলরেখা ভেঙে যায়, আত্মপরিচয়ও ভেঙে যায়। ধানের সেদ্ধ গন্ধ, ধানের তাফালে ভাপ, শিমুল তুলোর ওড়া—এই সব উপাদান মিলেমিশে এক অস্তিত্বহীন পরিচিতি নির্মাণ করে। চেতনা আর শরীর এক হয়ে যায় না; সময়ও কোনো সুসংহত ছিন্ন ও প্রবাহিত। ‘ফেরা’ কবিতার শেষদিকে যে অস্থিরতা ও বিলয়বোধ, তা চেতনার ভাঙচুরের চূড়ান্ত প্রকাশ। মনে হয়, এই ফেরার যাত্রা আসলে একটি আত্মিক ‘অফসেট’, যেখানে ফেরা মানে আর ফিরে আসা নয় তা এক স্থায়ী বেদনা।


‘সময়’ কবিতায় সময়ের প্রতীকী উপাদানগুলো (উড়াল ব্রীজ, বটফল, বনভবন, দারোয়ান, লাল বাঁশি) এক অস্থির, পরিবর্তনশীল বাস্তবের দ্যোতক। কবিতায় সময় যেন এক দৃশ্য-নির্মাণ—যা বারবার গড়ে উঠে এবং ভেঙে পড়ে—‘এখন দেখছি বন ভবনটি নেই/ উড়াল ব্রীজও নেই/ বটের পাগুলো হাসে ঝুরঝুর করে...’ এই বিনাশ ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবির সময়ের বোধ জন্ম নেয়। স্থির কোনো ‘সময়’ নেই; সময় চলমান ধ্বংস ও সৃষ্টির পালা। এইভাবে রশীদ হারুণের কবিতায় ‘সময়’ হয়ে ওঠে এক পলিফোনিক প্রক্রিয়া। যেখানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একসঙ্গে মিশে যায়, গলে যায়, আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে।


এই কবিতার ভাষা দৃশ্য ও বিমূর্ততার মধ্যবর্তী এক অন্তর্বর্তী সেতু। তিনি চলমান দৃশ্যের ভাষা ব্যবহার করেন—উড়াল ব্রীজ, বটফল, তুলো, ভ্রুণ, বাতিল বগি—এইসব উপাদান দিয়ে সময়ের অনুভব নির্মাণ করেন। তাঁর কবিতার চিত্রকল্পসমূহ প্রথাগত বর্ণনার বাইরে গিয়ে দেহ-চেতনা ও বস্তুর মিলনক্ষেত্র তৈরি করে।


সময়, স্থান ও চেতনার ভাঙচুরের চূড়ান্ত বোধে রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ কবিতার বইয়ে ‘সময়’ ও ‘ফেরা’ কবিতায় সময়-অভিজ্ঞতা এক বৈচিত্র‍্যপূর্ণ, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং মর্মভেদী স্পন্দন হিসেবে দেখা দেয়। স্থান একটি বিলীন পটভূমি; চেতনা এক অবিরাম আন্দোলনের রেখা; আর সময় এক বিস্মরণ ও বেদনার অন্তরালে খেলা করা ছায়া। এই ধারা আমাদের শেখায়—সময় কখনোই স্থির নয়, স্থান কখনোই নিখুঁত নয় আর চেতনা কখনোই একমাত্রিক নয়। এগুলো সবই এক অস্তিত্বের জার্নাল। যেখানে কবি আমাদের অদৃশ্যমানের ভেতর দিয়ে দৃশ্যমানের দিকে টেনে নেন।


৬.

লিটলম্যাগাজিন মানে শুধু ক্ষুদ্রাকারে প্রকাশিত কোনো সাহিত্যপত্র নয় এটি এক প্রকার প্রতিরোধী চেতনার ক্ষেত্র। যেখানে প্রতিষ্ঠিত কাব্যপ্রবাহের বাইরে এক বিকল্প সাহিত্যপ্রবাহ গড়ে ওঠে। এই প্রবাহে স্থান পায় প্রথাবিরোধিতা, ভাষার নতুনতা, রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি এবং অস্তিত্ব ও চেতনার অন্তঃসংকট। রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ এমনই এক কাব্যগ্রন্থ, যা লিটলম্যাগাজিন প্রজন্মের স্পিরিট ধারণ করে; যেখানে কাব্যিক ভাষার আভিজাত্য ও রাজনৈতিক সচেতনতা এক অপরিহার্য ধ্রুবতারা।


‘কথানহর’-এর কবিতাগুলো মূলত মূলস্রোতের বাইরে এক গহীন ভাষাজগতের খনন। বাংলা সাহিত্যে প্রধান ধারার কাব্যপ্রবাহ, যেমন রোমান্টিক ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও প্রেমের কাব্যধারা, বাঙালি আত্মপরিচয়ের সরলীকৃত বয়ান এসবের বাইরে গিয়ে রশীদ হারুণ এক ধরনের ভাষাতাত্ত্বিক ও দর্শনবীক্ষার কাব্য নির্মাণ করেন। ‘কথানহর’-এর কবিতায় আমরা পাই ভাঙা, ছিন্ন, অসম্পূর্ণ বাক্যগঠন, চিত্রকল্পের রহস্যময়তা এবং অভিজ্ঞতার জটিল সুত্রবদ্ধতা।  কবিতা প্রতিস্পর্ধার মিথ তৈরি করে প্রথাগত ছন্দ, ব্যাকরণ, ভাবগত স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রত্যাখ্যান করে। এইভাবেই রশীদ হারুণ লিটলম্যাগাজিন সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। কবিতা অভিজাত শুদ্ধতার জায়গা থেকে নেমে আসে স্ববিরোধী, স্ববিস্ফোরী ভাষার ভেতর।


রশীদ হারুণের কবিতায় শব্দ একটি ক্রিয়াশীল সত্তা। শব্দ একটি জীবন্ত, সংবেদনশীল সত্তা, যা প্রতিটি কবিতায় মহাবিশ্বের অংশবিশেষ হয়ে ওঠে। যেমন ‘সময়’ কবিতায় বটফল, উড়ালব্রীজ, বনভবন—এসব শব্দ শুধু বস্তু নয়, অস্তিত্বের প্রতীক। কবিতা যেন শব্দের অভ্যন্তরস্থ রক্তক্ষরণ যেখানে শব্দ বস্তুর মতো, আবার চেতনার ধ্বনিময় অংশও বটে। লিটলম্যাগাজিন ধারায় শব্দের আত্মপ্রতিষ্ঠা হলো প্রথাবিরোধী ভাষাচর্চার মূলে থাকা। এখানে শব্দকে ধারণা বা ধারণাগত অর্থের বাহক হিসেবে দেখার পরিবর্তে শব্দকে নিজেই এক অস্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ‘কথানহর’-এ এই শব্দ-অস্তিত্ব স্পষ্ট। কবিতা হয়ে ওঠে নিভৃত ভুবনের সম্ভাবনা, যেখানে শব্দেরা মিলে যায় অদৃশ্য বাস্তবতার ভেতরে যেমন ‘অবৈধ’ কবিতায় জংশন, বাতিল বগি, ভ্রুণ—সবই এক অদৃশ্য ভাষার ভেতর কেটে যায়।


‘কথানহর’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী কাব্যিক কাঠামো। এটি এক অর্থে ভাষার শৃঙ্খল ভাঙার কবিতা, অন্য অর্থে রাজনৈতিক উচ্চারণের প্রতীক। রশীদ হারুণ কোনো একক ধ্রুপদী কাঠামো মানেন না—ছন্দ, ব্যাকরণ, বাক্যগঠন, পঙক্তির দৈর্ঘ্য, স্তবকবিন্যাস—সবকিছুই এখানে একপ্রকার আস্তুত নিয়ত ভাঙচুর। এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা শুধু ভাষার কাঠামোতে নয়; কবিতার বিষয়বস্তুতেও স্পষ্ট। যেমন ‘অবৈধ’ কবিতায় শহরের প্রান্তিকতা, বাতিল জীবনের নিঃসঙ্গতা, সমাজের অনুচ্চার্য বেদনা উঠে আসে। এটি নিয়মতান্ত্রিক কাব্যিকতার বাইরে গড়ে ওঠা এক প্রান্তিক চেতনার গদ্য-গানের মতো।


তার কবিতা প্রথাগত রাজনৈতিক স্লোগানধর্মী এখানে রাজনীতি জীবনের ক্ষুদ্রতম অনুভূতির ভেতরে গাঁথা। ‘কথানহর’-এ সময়-অভিজ্ঞতা যেমন অস্তিত্বের হুমকি, মৃত্যু-স্মৃতি-শহরের ধ্বংসাবশেষ—এসবের মধ্যে দিয়ে এক অন্তঃরাজনৈতিক কণ্ঠস্বর উঠে আসে। যেমন ‘অবৈধ’ কবিতায় ‘কান্না পড়ে আছে, পড়ে আছে কয়েকটি ভ্রুণ, ইতস্ততঃ।’ এই ভ্রুণ-এর উপস্থিতি সরাসরি রাজনৈতিক নিপীড়ন, অস্তিত্ব সংকট, প্রান্তিক জীবনবোধ-এর চিহ্ন। একইভাবে ‘ফেরা’ কবিতার অচেনা বাস্তবতা, পরিচয়ের সঙ্কট এবং উৎখাত হওয়ার অভিজ্ঞতা সরাসরি রাজনৈতিক প্রতীকী বাস্তবতার প্রতিফলন।


রশীদ হারুণের কবিতা একটি বৃহত্তর রাষ্ট্রিক কাঠামোর ছায়ার নিচে ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সঙ্কটকে তুলে ধরে। এটি প্রতিরোধী শিল্পচেতনা, যা রাষ্ট্রযন্ত্র, বুর্জোয়া সংস্কৃতি, মিডিয়ার মিথ্যা আখ্যান—সবকিছুর বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ। ‘কথানহর’ লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের একটি সাংস্কৃতিক দলিল। এখানে ভাষা, চেতনা, অনুভব এবং প্রতিরোধ এক সজীব, বহুমাত্রিক বাস্তবতার সাথে মিশে যায়। এই কখনো কখনো শব্দের অলংকারে রাজনৈতিক ও নন্দন-দর্শনের ভেতর দিয়ে জীবনের জটিল বাস্তবতা বুঝবার এক প্রয়াস।


কবিতা পড়া মানে কি শুধুই লেখা শব্দগুলোর উচ্চারণ করা? নাকি তা এক ধরনের অদৃশ্য রক্তস্রোতে শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়া, যেখানে শব্দের অবয়ব, বাক্যের সংলগ্নতা। স্তবকের আকার শুধু বাহ্যিক কাঠামো, কিন্তু প্রকৃত কবিতা লুকিয়ে থাকে ওই কাঠামোর ছিন্ন ও অস্পষ্ট রেখার ভেতরে? রশীদ হারুণের কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়, কবিতার পাঠ কোনো একমুখী যাত্রা নয়, এক ধরনের বিভ্রমী অভিযান। যেখানে পাঠককে নিজের অবস্থান হারাতে হয়, নিজের চেতনা থেকে ছিটকে গিয়ে অন্য কোনো অজানা, অস্পষ্ট এবং প্রায়শই বিপজ্জনক ভূগোলে পা রাখতে হয়। এখানে কবিতা এক জীবন্ত, স্পন্দিত এবং ক্রমাগত রূপান্তরিত বাস্তবতা। যা পাঠকের চেতনার পরিধি ভেঙে দিয়ে তাকে এক অস্থির, অসমাপ্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত অনুভূতিতে নিক্ষেপ করে।


এই কবিতাগুলোতে কোনো একক অর্থ নেই, কোনো সরলরেখা নেই, কোনো স্পষ্ট অবগাহন নেই; একপ্রকার অনির্ধারিত ধ্বনির বিস্তার, যেখানে প্রতিটি শব্দ তার নিজস্ব অর্থ-গর্ভ থেকে জন্ম নেয়, আবার সেই অর্থকে নিজের ভেতরেই গলিয়ে দেয়। কবিতা এখানে একধরনের ভাষাগত প্রতিসরণ। যেখানে এক অর্থ আরেক অর্থের মধ্যে গলে যায়, এক ধ্বনি আরেক ধ্বনিকে আঘাত করে, এক ছবি আরেক ছবির গায়ে চূর্ণ হয়। পাঠক যখন এই কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে, তখন সে আর কেবল পাঠক থাকে না, একজন অংশগ্রহণকারী যাকে ধ্বনি, শব্দ, অব্যক্ত বেদনা, এবং ভাষার অসম্পূর্ণতা টেনে নিয়ে যায় অচেনা গহ্বরে।


এই অচেনা গহ্বর-এর ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে পাঠক তার নিজের পরিচিত বোধকে হারায়। ‘কথানহর’ কোনো সান্ত্বনাজনক পাঠের অভিজ্ঞতা দেয় না। পাঠকের মনে হয়, প্রতিটি কবিতা একটি অসম্পূর্ণ মানচিত্র, যা কোনো পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায় না। তাকে ঘুরপাক খাওয়ায়, তাকে ফেলে রাখে ধ্বনির ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, যেখানে কোনো মানচিত্রের রেখা নেই, নেই কোনো নির্দেশাবলী, নেই কোনো চূড়ান্ত সমাধান। পাঠকের অবস্থান এখানে অস্থির; সে কখনো কেন্দ্রে থাকে না, কবিতার প্রান্তিকতায় দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো ঢুকে পড়ে ভেতরে, কখনো ছিটকে পড়ে বাইরে, আবার কখনো অদৃশ্য কোনো স্তর-এর সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়।


এই অস্থিরতাই রশীদ হারুণের কবিতার মূল স্পন্দন। ‘কথানহর’-এর প্রতিটি কবিতা যেন ধ্বনির অন্ধকার নদী যেখানে শব্দেরা জলস্রোতের মতো বয়ে যায়, আবার কখনো তাতে মৃত্তিকার স্তর, ছেঁড়া তুলো, কৃষ্ণ রেণু, মরিচার ধূলিকণা মিশে গিয়ে তৈরি করে এক অস্বচ্ছ, তলানিবিহীন স্রোত। পাঠক এই স্রোতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখতে পায় প্রতিটি পঙক্তি একধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ দেহভঙ্গি গ্রহণ করে। কোনো একটি স্থির বিন্দুতে স্থিত হয় না, প্রতিটি শব্দ তার অর্থ থেকে সরে যায়, প্রতিটি বাক্য তার সংলগ্নতা হারায়, প্রতিটি স্তবক একটি সম্ভাব্য বীক্ষণ মাত্র হয়ে থাকে। পাঠকের এই অস্থিরতা কেবল অর্থের অনিশ্চয়তা থেকে নয় বরং ভাষার সঙ্ঘাত থেকে জন্ম নেয়। এই কবিতাগুলোতে ভাষা কোনো সুশৃঙ্খল বাহন নয়; ভাষা এখানে দ্রোহের উপাদান। যা নিজেকে নিজেই ধ্বংস করে, পুনর্গঠন করে, আবার ভেঙে ফেলে। 


কবিতা এখানে আবিষ্কৃত হয় প্রচলিত পাঠের মাধ্যমে অস্পষ্ট ইঙ্গিতের ভেতর দিয়ে। ‘আবিষ্কৃত কবিতা’ মানে এখানে সেই কবিতা, যা লেখকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, যা পাঠকের চেতনায় আলাদা অর্থ ও অভিজ্ঞতা তৈরি করে, যা প্রতিটি পাঠে নতুন হয়ে জন্মায়। তাই প্রতিবার পড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি করে; একটি পঙক্তি যা প্রথম পাঠে মনে হয় নিছক বিমূর্ততা, পরের পাঠে তা হয়ে ওঠে অদৃশ্য কোনো বেদনার দাগ। এই বহুমাত্রিক পাঠ-সম্ভাবনা ‘কথানহর’-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। একটি কবিতার একটিমাত্র অর্থ নেই; প্রতিটি পাঠকের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, মানসিক অবস্থা অনুযায়ী কবিতা তৈরি করে নতুন একটি সম্ভাব্যতাবিশ্ব। 


তখন তার মনে হতে পারে এটি কোনো শহুরে নিঃসঙ্গতার ছবি, আবার আরেক পাঠকের মনে হতে পারে এটি অধর্মিতার প্রতীক, কারও কাছে হতে পারে প্রান্তিক জীবনের স্বরলিপি, আবার কারও কাছে হতে পারে অস্তিত্বের গভীর ক্ষয়চিহ্ন। অর্থাৎ অর্থের অবস্থান একরৈখিক নয়, প্রতিটি পাঠে তা স্ফীত ও প্রসারিত হয়, প্রতিটি পাঠের সাথে সাথে তা আলাদা সুর ও ধ্বনি তৈরি করে।

এই ধ্বনি আসলে শব্দের বাইরে থাকা কবিতার অশরীরী অংশ, যা পাঠকের ভেতরে তৈরি হওয়া স্পন্দন, প্রতিক্রিয়া, অস্ফুট ধ্বনি। ‘কথানহর’-এর কবিতাগুলো তাই শব্দের চেয়ে বেশি মুহূর্তের ভেতরে জেগে ওঠা শূন্যতার ধ্বনি। প্রতিটি কবিতা যেন অস্পষ্ট কোনো যন্ত্রের কম্পন। যা কেবল অনুভব করা যায়, বলা যায় না, লেখা যায় না, মাপা যায় না।


এই পাঠ-অভিজ্ঞতা পাঠককে স্থানচ্যুত করে—তার পরিচিত বোধ থেকে, তার তর্কযোগ্য যুক্তি থেকে, তার নিজস্ব অর্থ-নির্মাণের অভ্যাস থেকে। এখানে কবিতা একটি চূড়ান্ত ভাঙা আয়নার টুকরো, যার প্রতিটি খণ্ড আলাদা অর্থে দীপ্ত, আবার প্রতিটি খণ্ডের মধ্যে অর্থের অসম্পূর্ণতাও লুকিয়ে থাকে। তার কবিতার পাঠ মানে তাই অস্থির হয়ে থাকা একধরনের অস্থায়ী আশ্রয়, যা ঠিকমতো ধরতে গেলে ফসকে যায়, যা অর্থ ধরতে গেলে অর্থ হারায়, যা ব্যাখ্যা করতে গেলে ব্যাখ্যা থেকে পালিয়ে যায়। কবিতা এখানে কোনো তাত্ত্বিক বন্ধন নয়; প্রত্যেক পাঠকের ব্যক্তিগত ক্ষরণ, দ্বিধা, অস্পষ্টতা, স্বপ্ন এবং স্ববিরোধের ভেতর দিয়ে জন্মানো এক অন্তর্লীন স্পন্দন। এই অন্তর্লীন স্পন্দন-এর মধ্যে থাকে অস্থিরতা—পাঠকের চেতনায় অস্থিরতা আসে, কারণ সে বুঝতে পারে না, সে ঠিক কী পড়ছে, কোথায় পৌঁছাবে, কোন অর্থকে চূড়ান্ত ধরে নেবে। আর এখানেই ‘কথানহর’-এর কবিতা মুক্তির শিল্প হয়ে ওঠে।


কারণ অস্থিরতা মানে সম্ভাবনা অর্থ যখন চূড়ান্ত নয়, তখন প্রতিটি পাঠ এক নতুন কবিতা তৈরি করে। এখানে কবিতা লেখকের থেকে ছিটকে গিয়ে পাঠকের হাতে এসে ধ্বনির নতুন শরীর গড়ে। লেখক-পাঠক সম্পর্ক এখানে আর একমুখী থাকে না; কবিতা তখন একটি উন্মুক্ত আকাশ হয়ে ওঠে, যার প্রতিটি তারার আলো আলাদা, প্রতিটি জ্যোৎস্না আলাদা, প্রতিটি ছায়া আলাদা।

এই উন্মুক্ততার মধ্য দিয়ে পাঠকও একধরনের কবি হয়ে ওঠে। সে আর প্রথাগত পাঠক না হয়ে তিনি এক সহ-উৎপাদক, যার চেতনার মধ্য দিয়ে কবিতার নতুন অর্থ তৈরি হয়। ‘কথানহর’ এর কবিতা তাই লিখিত শব্দের মধ্যে আটকে থাকে না, প্রতিটি পাঠকের ভেতরে নতুন কবিতা হয়ে জন্ম নেয়। যা হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম, যা হয়তো লেখকের কল্পনাকেও অতিক্রম করে যায়।


এই আবিষ্কৃত কবিতা আসলে পাঠকের অন্তর্লোক থেকে জন্ম নেয়। যেখানে কবিতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ইঙ্গিত, একধরনের অস্থায়ী স্পন্দন হয়ে মিশে যায় তার ব্যক্তিগত স্মৃতি, বেদনা, স্বপ্ন, ভয়, আনন্দ এবং শূন্যতার সাথে। তাই কবিতা একধরনের অনন্ত সম্ভাবনার ক্ষেত্র। যা প্রতিটি পাঠকের ভেতরে নতুনভাবে পুনর্জন্ম নেয়।  রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ তাই কবিতা-পাঠের ধারনাকে উল্টে দেয়। এটি পাঠককে শিখিয়ে দেয়—কবিতা কেবল লেখা নয়, কবিতা হলো প্রতিটি পাঠকের অন্তরাল স্পন্দনের এক অদৃশ্য ধ্বনি। এই ধ্বনি কোনোদিন শেষ হয় না; প্রতিটি পাঠে, প্রতিটি উচ্চারণে, প্রতিটি নীরবতায় নতুন করে জাগ্রত হয়, নতুন করে হারিয়ে যায়, আবার নতুন করে ফিরে আসে।


এই কবিতাগুলি পড়া মানে কোনো অর্থ-শৃঙ্খলায় প্রবেশ করা নয়। অর্থের বাইরে থাকা এক মুক্ত প্রান্তরে নেমে পড়া, যেখানে শব্দেরা শুধু শব্দ নয়, ধ্বনি শুধু ধ্বনি নয়, অর্থ শুধু অর্থ নয় সবকিছু মিলে তৈরি হয় অস্পষ্ট অথচ গভীর এক অনুভূতি। যা শেষ পর্যন্ত কোনো কাঠামোতে বন্দি হয় না, কোনো সংজ্ঞায় ধরা পড়ে না, কোনো শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। এটাই ‘কথানহর’ এর কবিতা-পাঠের অমোঘ শর্ত। অস্থির হও, স্থির অর্থের প্রলোভন থেকে দূরে থাকো, অর্থের ভাঙন ও স্পন্দনের মধ্য দিয়ে হাঁটো, কারণ প্রকৃত কবিতা সেই অস্পষ্ট ধ্বনি, যা একমাত্র পাঠকের হৃদয়ের অন্ধকার ঘরে জাগে, শব্দের চেয়েও গভীরে, বাক্যের চেয়েও গাঢ়ে, ব্যাখ্যার বাইরে, অর্থের বাইরে।


৭.

নন্দনচেতনা অতিক্রম করে এমন এক অদৃশ্য মানচিত্র হয়ে ওঠে, যা বারবার নতুন পাঠের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। রশীদ হারুণের ‘কথানহর’ ঠিক তেমনই এক পাঠ-অভিজ্ঞতা, যা সমকালীন বাংলা কবিতার ভেতরকার নন্দন-রাজনীতির ভাঙনরেখা ধরে চুপিচুপি হাঁটে। আবার কোথাও তা নিজেকে শিকড়বিহীন, শূন্য অথচ প্রগাঢ় অর্থবহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এই কবিতাগুলি একদিকে প্রতিষ্ঠিত কবিতার নন্দনশৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের পাঠপ্রবাহে এক বুননতন্ত্র রচনা করে। যা আগামী প্রজন্মের কবিতা-পাঠকে নতুন এক অভিজ্ঞতার দিকে ঠেলে দেয়।


‘কথানহর’ এর কবিতা সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতি এই বৃহৎ কাঠামোসমূহের সাথে এক নির্বিকার, নীরব অথচ প্রতিবাদী সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সম্পর্ক কখনো প্রকাশ্য কোনো ঘৃণা নয়, আবার কখনো কোনো উল্লসিত বিদ্রোহও নয়; এটি এক ধরনের আলগা, ভাসমান, অথচ গভীর রাজনৈতিক স্পর্শ। যা কবিতার প্রতিটি শব্দের ভেতরে, বাক্যের ভাঙনের ভেতরে, স্তবকের ফাঁকে-ফাঁকে লুকিয়ে থাকে। সমকালীন বাংলা কবিতার বেশিরভাগ প্রবাহ যেখানে আবেগের সরলীকরণ, নিয়মতান্ত্রিক ছন্দে বন্দিত্ব, অথবা সনাতন ভাবের পুনরাবৃত্তি। সেখানে ‘কথানহর’  যেন একটি বৈদ্যুতিক বিভাজনরেখা হয়ে দাঁড়ায়। এই বিভাজনরেখা কোনো সরলরৈখিক অবস্থানে এক ধরনের ভাষাগত প্রতিসরন, যা পাঠককে কখনো টেনে নেয় ভাষার অন্ধকারতম গহ্বরে, আবার কখনো ছুঁড়ে ফেলে উজ্জ্বল অথচ শূন্য আকাশের নিচে।


রশীদ হারুণের কবিতা কোনো কেন্দ্রীভূত নন্দনতত্ত্ব-কে অনুসরণ করে না। সে নিজেই ভাঙন, বিপর্যয় এবং নতুন ভাষার সম্ভাবনা নিয়ে আসে। এখানে অসঙ্গতি কোনো ব্যর্থতা নয়; একটি অস্তিত্ববাদী সত্য। এই কবিতাগুলোতে অর্ধবাক্য, অসমাপ্ত বাক্যগঠন, শব্দের ধ্বংসাবশেষ এবং ছিন্ন বাক্যবিন্যাস মিলেমিশে তৈরি করে এক ধরনের অসম্পূর্ণ নন্দন। যা আসলে অপূর্ণতার ভেতরকার পূর্ণতা। অর্থাৎ, এই কবিতাগুলো আমাদের শিখিয়ে দেয় যে নন্দনশিল্পের সৌন্দর্য কেবলমাত্র ব্যাকরণের সুশৃঙ্খলতাহীন তার ভাঙনের মধ্যে, তার অসম্পূর্ণতায়, তার বিনির্মাণেও থাকে।


এই বিনির্মাণই কবিতার রাজনৈতিকতা। কারণ, যেকোনো শৃঙ্খল তা ভাষার হোক, রাষ্ট্রের হোক, সমাজের হোক। যখন তাকে প্রশ্নহীন, অবিরত এবং অমোঘ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তখন তা ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। ‘কথানহর’  সেই একচ্ছত্রতার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিস্পর্ধার ভাষা। এখানে কোনো সরাসরি স্লোগান নেই, কোনো সুস্পষ্ট শত্রু নেই, কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক মতবাদ নেই। আছে শুধু ভাষার ভেতরে গড়ে ওঠা এক অন্তর্গত ক্ষোভ। যা কখনো বাতিল বগির মতন জং ধরা জরায়ু হয়ে দাঁড়ায়, কখনো ধানের ভাপে ওঠা স্মৃতি হয়ে মিশে যায় বাতাসে, আবার কখনো পকেটের মার্বেল চেতনা হয়ে গড়িয়ে পড়ে পথের পিচঢালা সড়কে।


এই নন্দন-রাজনীতি একদিকে ভাষার অব্যবস্থাপনার মধ্যে সম্ভাবনা খোঁজে, অন্যদিকে কবিতাকে ব্যক্তিগত অস্তিত্ব থেকে রাষ্ট্রের গলিপথ পর্যন্ত বিস্তৃত এক প্রতিবাদের শরীর করে তোলে। ‘কথানহর’ -এর কবিতা কোনো সম্পূর্ণতা দাবি করে না, কোনো ফলিত অর্থ দান করে না, কোনো মুক্তির বার্তা দেয় না। এই কবিতা নিজেই একটি দ্বিধাবিদ্ধ স্পন্দন। যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পঙক্তি, প্রতিটি স্তবক একধরনের অর্ধচেতনার পরিসর তৈরি করে। এই অর্ধচেতনা হলো সেই অঞ্চল, যেখানে পাঠক একদিকে অর্থের শূন্যতা অনুভব করে। অন্যদিকে অর্থের আভাস পায়, একদিকে ভাষার অসম্পূর্ণতা টের পায়, অন্যদিকে অপূর্ণতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অর্থের সম্ভাবনাকে স্পর্শ করে। তার কবিতাগুলো তাই এক ধরনের অবকাশ। যেখানে কবিতা পাঠকের সাথে এক যৌথ অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। এই অভিযাত্রা কোনো প্রাক-নির্ধারিত মানচিত্রে আঁকা নেই; প্রতিটি পাঠক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, বেদনা, স্বপ্ন এবং ভাষার ভেতরকার ভাঙনের আলো-অন্ধকারে নিজের মানচিত্র তৈরি করে। এই মানচিত্র কোনো স্থির ভূগোল নয়; তা এক প্রবহমান ভাষার জ্যোৎস্নাময় নদী। প্রতিটি পাঠক নতুন করে স্রোতের আকার অনুভব করে, নতুন করে অর্থের ঢেউ শুনতে পায়, নতুন করে অস্পষ্টতার ভেতর দিয়ে স্পষ্টতার আভাস পায়।


কিন্তু এই মানচিত্র কি কেবল আমাদের এই সময়ের জন্য? নাকি ‘কথানহর’  ভবিষ্যতের জন্যও একটি সম্ভাব্য পাঠের নকশা রেখে যায়? এখানেই আসে ‘কথানহর’ -এর ভবিষ্যৎ পাঠের মানচিত্র নিয়ে গভীর ভাবনা। ভবিষ্যতের পাঠে এই কবিতাগুলো কেবল অতীতের সাহিত্যচর্চার নিদর্শন হয়ে থাকবে না; নতুন প্রজন্মের কবিতা-পাঠের কাছে একটি উন্মুক্ত ধ্বনির জ্যামিতি হয়ে উঠবে। কারণ, এই কবিতা কোনো সময়নির্ভর নিদর্শন নয়। একটি অতলসন্ধি, যা প্রতিটি প্রজন্মের পাঠককে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব ব্যথা এবং নিজস্ব রাজনৈতিক বাস্তবতার ভেতর থেকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করবে। একজন ভবিষ্যৎ পাঠক যখন ‘ফেরা’ কবিতার সেই পঙক্তি পড়বে—‘কোন পথে বাড়ি ফিরি?’ তখন হয়তো সে ভাববে, এই বাড়ি কি কেবল কোনো স্থাপত্যিক স্থান? নাকি এক ধরনের হারানো স্বপ্ন, যা ধানের ভাপে মিলিয়ে গেছে? হয়তো সে ভাববে, এই ‘ফেরা’ মানে নিজের ভেতর ফেরা নয়, একটি সময়চিহ্নের বাইরে ফেরা। সেখানে কোনো বাড়ি নেই, কোনো ঠিকানা নেই, আছে শুধু ভাষার ভগ্নাংশ আর অর্ধদ্যুতির কল্পনা।


একজন ভবিষ্যৎ পাঠক ‘অবৈধ’ কবিতার পঙক্তি পড়ে হয়তো রাজনৈতিক নিপীড়নের অন্য কোনো প্রেক্ষাপট কল্পনা করবে, হয়তো মনে করবে ভ্রুণগুলোর কান্না আসলে রাষ্ট্রদেহের ভ্রষ্ট সন্তানের কান্না কিংবা কোনো অদেখা প্রান্তিকতার আঘাত। অর্থাৎ, ‘কথানহর’ -এর কবিতা কোনো একক অর্থের সীমা নিয়ে আসে না, প্রতিটি পাঠে, প্রতিটি প্রজন্মের পাঠকের কাছে নতুন নতুন মানচিত্র খুলে দেয়। রশীদ হারুণের ‘কথানহর’  এটি একটি চলমান শব্দপ্রবাহ, একটি ভাসমান প্রতিস্বর, একটি অসম্পূর্ণ মানচিত্র, যা কখনোই সম্পূর্ণ হয় না, যা প্রতিটি পাঠকের কাছে নতুন করে জন্ম নেয়, নতুন করে হারায়, আবার নতুন করে জেগে ওঠে। এটি একধরনের প্রতিসরনশীল শিল্প, যা সময়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। প্রতিটি প্রজন্মের হাত ধরে একটি নতুন উচ্চারণ তৈরি করে। এই উচ্চারণ কখনো স্পষ্ট কখনো অস্পষ্ট; কখনো তা হয়ে যায় একটি নিঃশব্দ কান্না, কখনো তা হয়ে যায় একটি উচ্চকিত চিৎকার আবার কখনো তা শুধু অমোঘ শূন্যতার প্রতিধ্বনি।


এই শূন্যতার ভেতরেই ‘কথানহর’ -এর কবিতার ভবিষ্যৎ পাঠের মানচিত্র লুকিয়ে থাকে। এই মানচিত্র কোনো একক নির্দেশনা দেয় না, কোনো চূড়ান্ত অর্থের বন্দোবস্ত করে না; প্রতিটি নতুন পাঠকের জন্য খুলে দেয় অর্থের সম্ভাব্যতার এক অদৃশ্য দ্বার। সেখানে শব্দের ছায়া-আলোর খেলা চলতে থাকে, অধরা অর্থের দোলাচল থাকে, থাকে অস্তিত্বের অন্বেষণ ও রাজনৈতিক বোধের অগোচর স্পন্দন। এই কবিতা তাই কোনো একক কবির সম্পত্তি নয়; তা ভাষার, সময়ের এবং পাঠকের যৌথ নির্মাণ। ‘কথানহর’  শেষ হয় না; প্রতিটি পাঠে তা নতুন করে শুরু হয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages