আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে রাষ্ট্র কেবল সংবিধান আর নির্বাচনের কাঠামো নয়; বরং এক ধরনের ‘দৈনন্দিন নিরীক্ষণ যন্ত্র’—যা নাগরিকের চেতনার ভেতর গেঁথে দেয় ভয়, নিয়ন্ত্রণ আর নিস্পৃহতা। আমরা জানি না কে আমাদের শত্রু, কে আমাদের মিত্র আর কে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু টের পাই—কিছু একটা আছে, যা সবকিছুই জানে, কিন্তু নিজেই অধরা হয়ে থাকে মানুষের কাছ থেকে। এই অবস্থানটাই ‘প্রতিষ্ঠানের অস্পষ্টতা’—যেখানে প্রতিষ্ঠান নিজেই নিজেকে নিরীহ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রূপে তুলে ধরে, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে জটিল ও আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতা-কাঠামো। এই অস্পষ্টতাই প্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে বিপজ্জনক করে তোলে, কারণ এটি নিজের অস্তিত্বকে ন্যায্যতা দেয় কিন্তু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না।
রাজনৈতিক আলোচনায় ‘ডিপ স্টেট’ শব্দটি একটি বহুল ব্যবহৃত অথচ বিভ্রান্তিকর ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই একে সামরিক বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার একচেটিয়া ক্ষমতা হিসেবে দেখেন। কিন্তু বাস্তবতা আরও গভীর। ডিপ স্টেট হল সেই অবচেতন কাঠামো, যা জনগণের চোখের আড়ালে থেকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। এর অস্তিত্ব দৃশ্যমান নয়, কিন্তু তার ক্ষমতা স্পষ্ট। মিডিয়ায় সংবাদ বেছে দেওয়া, আদালতের রায়কে নিরপেক্ষতার মুখোশ পরিয়ে দেওয়া, কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে ‘নির্বাচিত ইতিহাস’ ঢুকিয়ে দেওয়া। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একধরনের স্ক্রিপ্টটেড তৈরি করে জনগনের ররুচির পবির্তন করা। এনজিও দ্বারা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
এই অদৃশ্য শিকড়গুলো রাষ্ট্রের ‘দায়বদ্ধ’ কাঠামোকে বাইপাস করে। যখন ভোট হয়, তখন যারা জেতে তারা শাসন করে না—শাসন করে তারাই, যারা ভোটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে অদৃশ্য হয়ে। উববঢ় Deep State শব্দটির প্রথম দিককার ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায় তুরস্কে, যেখানে রাষ্ট্রের নির্বাচিত অংশের বাইরে সামরিক, গোয়েন্দা ও বিচার বিভাগ মিলে একটি ছায়া সরকার চালু রেখেছিল। পরবর্তীতে আমেরিকা, পাকিস্তান, মিসর বা বাংলাদেশেও এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ডিপ স্টেট কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা অফিস নয়। এটি হল এক ধরনের ‘গভীর কাঠামো’— যেটি নির্বাচন বা জনসমর্থনের তোয়াক্কা না করে বাস্তবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার কোনও পতাকা নেই, মুখ নেই, অথচ সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যুদ্ধ, বাজেট বা গুমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।
‘প্রতিষ্ঠান’ বলতে আমরা সচরাচর বুঝি প্রশাসনিক ভবন, সংবিধান, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তার চেয়েও বেশি কিছু। এটি একটি জীবনব্যবস্থা, একটি চেতনার কাঠামো। এটি ঠিক করে দেয়—কোনো খবর শোনা উচিত, কোন কবিতা সাহসী নয়, কোন বয়ান ‘উগ্র’ আর কোনটা ‘নিরপেক্ষ’। এই নীরব নিয়ন্ত্রণই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এটি এমন এক শক্তি যা শরীর, আচরণ এবং চেতনার ওপর নিঃশব্দ দখল প্রতিষ্ঠা করে। ফলে নাগরিক একসময় নিজেই নিজের উপর নজরদারি শুরু করে। মিশেল ফুকোর ভাষায়— ‘স্বাধীনতা তখন একটি সাজানো বাগান—যেখানে প্রতিটি গাছ নির্দিষ্ট অনুপাতে কাটা।’
প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে কেবল সরকারের সমালোচনা নয়। এর মানে হচ্ছে— সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতরকার ভণ্ডামি উন্মোচন, মিডিয়ার মুখোশ খুলে ফেলা, এমনকি নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্ক ও সুবিধাবাদকে চিহ্নিত করা। প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান মানেই সাহসী হওয়া নয়, বরং নিজেকে বিপন্ন করার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী কণ্ঠগুলো প্রায়শই ‘বিপথগামী’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘অসামাজিক’ তকমা পায়। এ দেশে সাহিত্যের মঞ্চেও প্রাতিষ্ঠানিক নীরবতা বিরাজমান, যেখানে চর্চার মূল প্রবাহ হয়ে ওঠে তোষামোদ, আত্মরক্ষা এবং নিরুত্তাপ উদযাপন।
বর্তমান সময়ে তথাকথিত প্রধানধারার গণমাধ্যম আর মুক্তির হাতিয়ার নয়; বরং তা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার সবচেয়ে সফল উপকরণ। সত্য এখানে আর খোঁজার বিষয় নয়, বরং নির্মাণযোগ্য বস্তু। যে সত্য প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে, তা ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ হিসেবে ছুঁড়ে ফেলা হয়; আর যে সত্য শাসকের মুখের সাথে মিলে যায়, তা হয় ‘জাতীয় স্বার্থ’ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মিডিয়ার এই ভূমিকা, যেখানে সংবাদে নেই ভাষার ভিন্নতা বা প্রতিরোধ, তা এক ধরনের নীরব মেনেই নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করে। মিডিয়া যখন কবির কণ্ঠস্বর নিঃশব্দ করে, তখন প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্র এক হয়ে যায়।
এই পটভূমিতে ‘লিটলম্যাগাজিন’ শুধুমাত্র সাহিত্য পত্রিকা নয়; এটি হয়ে ওঠে একধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। বড় প্রতিষ্ঠান যখন সাহিত্যের ‘আদর্শ মডেল’ নির্ধারণ করে দেয়, তখন ছোট পত্রিকাগুলোই সেই মডেলের বাইরে ভিন্নতা ও বিক্ষোভ তুলে ধরে। লিটলম্যাগ চর্চা মানে বিপরীতে দাঁড়ানো। ভাষাকে সাবলীল ও সাহসী করে তোলা, যা ক্ষমতার চোখে খাটো কিন্তু সত্যের কাছে স্পষ্ট। এই চর্চায় ‘ভুল’ কবিতা থাকে, ‘রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক’ গল্প থাকে, কিন্তু সবকিছুর ভেতরে থাকে এক ধরনের নৈতিক ঝুঁকি—যেখানে লেখক নিজেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। আমি কি প্রতিষ্ঠানভুক্ত? আমি কি চুপ করে আছি?
এই দীর্ঘ রচনায় ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানের ছায়াময়তা বিশ্লেষণ করব। প্রথমে দেখা হবে—কীভাবে প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্বকে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখে, কীভাবে ডিপ স্টেট কৌশলে রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র তৈরি করে। এরপর বোঝার চেষ্টা করব—কোন অদৃশ্য শক্তি সংস্কৃতি, ভাষা, ও চেতনায় বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে। সবশেষে আমরা ফিরব আমাদের লেখার দায়ে। কীভাবে লিটলম্যাগ চর্চা আজও বিকল্প প্রতিরোধের জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে গেলে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়াতে হবে। সেটি কোনো একাডেমিক তত্ত্ব দিয়ে নয়—ভাষা, সংস্কৃতি, এবং নাগরিক সচেতনতাকে সঙ্গে নিয়েই। এই রচনার উদ্দেশ্য সেই দূরত্ব তৈরি করা—যেখানে প্রশ্ন জাগবে, দ্বিধা আসবে, এবং হয়তো কিছু সাহসও।
১.
প্রতিষ্ঠান একটি কাঠামো নয়, বরং একধরনের ‘বিশ্বাসযোগ্য ন্যারেটিভ’ যা সামাজিক নিয়ম, সংস্কৃতি ও আইন দিয়ে জর্জরিত। প্রতিষ্ঠান—এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল এক দালান, ছাঁটাই করা লন, স্যুট-পরা আমলা, অথবা গম্ভীর মুখের বিচারপতি। কিন্তু এগুলো কেবল তার মুখোশ কিংবা পোষাকমাত্র। প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত রূপ কোনো দালান বা ফাইলঘেরা অফিস নয়—এটি আসলে একটি পরম বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি, যা সমাজ দীর্ঘদিন ধরে শুনে এসেছে দেখে এসেছে, বিশ্বাস করেছে এবং এমনকি আপন করে নিয়েছে। এই বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি কেবল বর্ণনায় সীমিত থাকে না; এটি প্রতিদিন আমাদের আচরণ—সিদ্ধান্ত—ভয়—নীরবতা—আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে নিজের একটা শরীর তৈরি করে। এটি একটি সামাজিক আত্মা, যা আমাদের না জেনেই নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রতিষ্ঠান নিজেকে একটি ‘সত্য’ হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু এটি আসলে ‘কল্পনার অভ্যাস’— যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তৈরি হয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা। রাষ্ট্র বলে, ‘আমি তোমার অভিভাবক’, ধর্ম বলে, ‘আমিই নৈতিকতার শেষ কথা’, আদালত বলে, ‘ন্যায় আমার হাতে নিরাপদ’—আর আমরা সেই কাহিনি শুনে বড় হই। আমরা প্রশ্ন করি না, কারণ কাহিনির সৌন্দর্যই তাকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলে আনে। বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি যখন দীর্ঘ সময় ধরে পুনরাবৃত্ত হয়, তখন তা আর ‘কাহিনি’ থাকে না, তা হয়ে ওঠে বাস্তবতার কাঠামো। আর এইভাবেই প্রতিষ্ঠান নিজেকে স্থায়ী করে তোলে—অদৃশ্য এবং অপরিবর্তনীয় বলে প্রতিভাত হয়ে।
প্রতিষ্ঠান কখনোই নিজেকে ‘ক্ষমতা’ হিসেবে উপস্থাপন করে না। সে বরং বলে—‘আমি নিয়ম’, ‘আমি নৈতিকতা’, ‘আমি স্বাভাবিকতা’—এইভাবে সে নিজেকে প্রশ্নাতীত করে তোলে। অথচ এই প্রশ্নহীনতা থেকেই উৎপত্তি হয় সামাজিক কর্তৃত্বের। বিচারালয় যেখানে আইন প্রয়োগের জায়গা, সেখানে সে হয়ে ওঠে ক্ষমতার একতরফা প্রয়োগের হাতিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় যা হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানচর্চার মুক্ত প্রাঙ্গণ, তা হয়ে যায় পরীক্ষা-নির্ভর পুঁথিপাঠের কারাগার। সংবাদমাধ্যম যেখান থেকে উঠে আসার কথা ছিল জনস্বার্থ, সেখানেও প্রতিষ্ঠানের কাহিনি চলে আসে সম্পাদকীয় পাতায়, ব্রেকিং নিউজের শ্লটে। এবং এই বিশ্বাসযোগ্যতার নির্মাণ কেবল আইনের দ্বারা হয় না। এটি সংস্কৃতি দিয়ে বোনা হয় গল্পে—ছড়া-কবিতায়, শিশুর খেলায়, লাল-সবুজ পতাকার গান দিয়ে। প্রতিষ্ঠান ছায়ার মতো গায়ে জড়িয়ে থাকে, তাকে ঠেকানো যায় না, তাকে ধরাও যায় না। কারণ সে চোখে দেখা দেয় না, সে থাকে চিন্তার ভাষায়, সামাজিক নিয়মে, আনুষ্ঠানিক উদযাপনের মধ্যে। একজন শিক্ষক, যে তার ছাত্রকে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে, সে-ও প্রতিষ্ঠানের কাহিনি বাঁচিয়ে রাখে। একজন অফিসার, যে নিয়মের নামে অন্যায়ের আদেশ দেয়, সেই-ও সেই কাহিনির চরিত্র।
সুতরাং, প্রতিষ্ঠান আসলে একটি গভীর কাঠামো, যা ধরা দেয় বস্তুরূপে, কিন্তু জন্ম নেয় ধারণারূপে। এটি তৈরি হয় ইতিহাসের জমাট বাঁধা স্তরে, যেখানে কিছু নীতিবাক্য, কিছু শাসনব্যবস্থা এবং কিছু সাংস্কৃতিক অনুশাসন একত্রিত হয়ে নির্মাণ করে এক ধরনের ‘অনিবার্যতা’র অনুভূতি— যেন এই যে নিয়ম, এই যে রাষ্ট্র, এই যে ধর্মীয় কর্তৃত্ব, এগুলো ছাড়া সমাজ চলবে না। কিন্তু এই অনিবার্যতাই প্রতিষ্ঠানকে ভয়াবহ করে তোলে। কারণ, তাতে প্রশ্ন করাকে অস্বাভাবিক মনে হয়। সন্দেহ করাকে ‘বিপজ্জনক’ ভাবা হয়।
এই জায়গায় এসে প্রতিষ্ঠান আর কেবল কাঠামো থাকে না, সে হয়ে ওঠে ‘ব্যাখ্যাহীন গ্রহণযোগ্যতা’র শরীর। আমরা অনেকেই জানি না, কোন নিয়ম কে বানিয়েছে, কখন বানিয়েছে, কারা চ্যালেঞ্জ করেছে—তবুও তা মানি, কারণ প্রতিষ্ঠানের গল্পে শিখেছি, ‘ভাল ছেলেরা নিয়ম ভাঙে না’। এইভাবে প্রতিষ্ঠান কেবল শাসন করে না, সে মানসিক সাম্রাজ্য তৈরি করে, যেখানে দমনকে মনে হয় শৃঙ্খলা, অন্যায়কে বলা হয় নিয়ম, ভয়কে রূপান্তর করা হয় কর্তব্যে।
প্রতিষ্ঠান তাই কখনোই একক নয়—এটি বহুরূপী, বহুমুখী, এবং সর্বব্যাপী। এটি আইন দিয়ে যেমন চলে, তেমনি নীরব সম্মতি দিয়েও চলে। এটি আদালত যেমন ধারণ করে, তেমনি ক্লাসরুম, সংসার, এমনকি ভালোবাসার ভাষাও ধারণ করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মানে তাই কেবল ফর্ম ভাঙা নয়, গল্পের ছাঁচ ভাঙা—একটি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনির বিপরীতে আরেকটি সাহসী, র্যাডিকাল ও অপ্রচলিত কাহিনি তৈরি করা। এবং এই প্রতিকাহিনি নির্মাণের দায়টাই পড়ে কবি, শিল্পী, লেখক এবং লিটলম্যাগ চর্চার ওপর। কারণ মূলধারার প্রতিষ্ঠানে বসে কোনোদিন প্রতিষ্ঠানের মুখোশ খোলা যায় না। প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দাঁড়াতে হলে, আগে সেই গল্পকে শনাক্ত করতে হয়, জানতে হয় তার উৎস, তার পুনরাবৃত্তির কৌশল, এবং তার নিঃশব্দ প্রভাব। প্রতিষ্ঠান কোনো কংক্রিট নয়, কোনো নিয়ন্ত্রক কার্যালয় নয়, কোনো মন্ত্রিপরিষদও নয়। প্রতিষ্ঠান হলো আমাদের চেতনার সেই সুদৃঢ় অনুশাসন, যা আমরা প্রতিদিন শুনি, শিখি এবং বহন করি—কখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, কখনো মাথা নিচু করে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠান নিজেকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত ও আত্মরক্ষামূলকভাবে সাজিয়ে তোলে। এর ফলে জনগণ তার আচরণ প্রশ্ন করতে শেখে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, প্রতিষ্ঠান নিজেকে এমনভাবে সাজায় যেন তা শুধুমাত্র একটিমাত্র শক্তির প্রতীক নয়, বরং একটি অদৃশ্য অথচ দৃঢ় সুরক্ষা বলয় হয়ে ওঠে—একটি অস্বীকারযোগ্য বাস্তবতা। এই প্রতিষ্ঠান এমন এক শক্তি, যা মানুষের অজ্ঞতা এবং ভয়ের উপর নির্ভর করে টিকে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র একটি কাঠামো নয়, বরং এক অনভিপ্রেত, অভেদ্য কাহিনী। জনগণের কাছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি নিয়ম—অথবা তার প্রতি অনুগত আচরণ—হয় একটি প্রাকৃতিক এবং অপরিবর্তনীয় অবস্থান।
রাষ্ট্র যতটা না একটি শক্তির উৎস, তার চেয়ে বেশি একটি বিশ্বাসযোগ্য কাহিনি, যা সবার চেতনায় স্থায়ীভাবে প্রোথিত। এই কাহিনির মাঝে জনগণ প্রতিনিয়ত তার আচরণ, বিশ্বাস, এবং অস্তিত্বের স্বাভাবিকতা প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করে চলে। এই প্রক্রিয়াটি এমনভাবে পরিচালিত হয় যে জনগণ কোনো প্রশ্ন না করেই রাষ্ট্রের কার্যকলাপ মেনে নেয়। এই জাতীয় আচরণকে ‘স্বাভাবিকতা’ হিসেবে দেখানো হয়, এবং এই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতা রাষ্ট্রের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করে।
এমনকি জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণ গড়ে ওঠে—যেখানে তারা কোনো প্রতিবাদ বা প্রশ্নের স্থান পায় না। একে বলে রাষ্ট্রের আত্মরক্ষামূলক প্রকৃতি। রাষ্ট্র নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, এর বিরুদ্ধাচরণ করাটা যেন অস্বাভাবিক, বরং রাষ্ট্রের প্রতি অটুট আনুগত্যই নৈতিকভাবে সঠিক হিসেবে গৃহীত হয়।
যখন একটি রাষ্ট্র এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করে, যেখানে মানুষের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে এক ধরনের শাস্তিমূলক পুরস্কৃত হওয়ার অনুভূতি থেকে উঠে আসে, তখন জনগণের নিজস্ব ইচ্ছা, তাদের চিন্তাধারা, তাদের ভয়—সবকিছুই রাষ্ট্রের নিয়মে বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্র এমনভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যে তার প্রতি প্রশ্ন কিংবা অস্বীকারের কোনো শর্তই থাকে না।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আত্মপ্রতিষ্ঠার গোপন কৌশল একটিই—তারা নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে এক শূন্যতা তৈরি করে, যেখানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা কিংবা সন্দেহের স্থান কমে যায়। রাষ্ট্র জানে, মানুষ যতটুকু না পরিবর্তন আনতে সক্ষম, ততটুকু তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে অনুসরণ করেই নিজেদের অস্তিত্ব অব্যাহত রাখবে। তারা জানে না, তাদের আচরণের মধ্যে কোথাও এক ধরনের প্রশ্নোত্তরের অবকাশ আছে, যেখানে তারা প্রশ্ন করতে পারবে।
প্রতিষ্ঠানের এই চতুর বাস্তবতা বোঝানো হয় সমাজের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনি কাঠামোর মাধ্যমে। তাই রাষ্ট্র একদিকে যেমন দৃষ্টির আড়ালে শক্তি প্রতিস্থাপন করে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এক ধরনের সচেতন অনুপস্থিতি তৈরি করে, যাতে জনগণ কোনো প্রশ্ন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানের শাসনের মধ্যে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলে।
এইভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মরক্ষামূলক প্রকৃতি, জনগণের চিন্তার স্বাধিকার বা তাদের প্রতিবাদী মনোভাবকে খর্ব করে দেয়। রাষ্ট্র তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে জনগণের মনে এমন এক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে, যা কখনো প্রশ্ন ওঠার সুযোগই দেয় না—একটি ধারাবাহিক বিশ্বাসের মত, যেখানে জনগণ একে নিজের মতন গ্রহণ করে এবং নিজস্ব আত্মমর্যাদার ধারণাকেও ভুলে যায়। এভাবেই রাষ্ট্র তার শক্তিকে দীর্ঘায়িত করে এবং জনগণের আচরণকে অস্বাভাবিক কিছু না মনে করিয়ে স্বাভাবিক করে তোলে। জনগণের নীরবতা কখনো কখনো রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়ে দাঁড়ায়।
ফুকো, গ্রামসি ও আলথুসার-প্রভাবিত চিন্তায় প্রতিষ্ঠান একধরনের ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারাটাস’ হিসেবে কাজ করে। ফুকো, গ্রামসি ও আলথুসার-প্রভাবিত চিন্তায় প্রতিষ্ঠান কেবল বাহ্যিক শাসন ব্যবস্থার প্রতীক নয়, বরং একটি আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারাটাস (Ideological Apparatus), যা জনগণের চেতনা এবং আচরণকে প্রভাবিত করে এবং সেগুলিকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান তখনই কার্যকরী হয়ে ওঠে যখন সে নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, জনগণ তা ‘স্বাভাবিক’ এবং অপরিহার্য বলে মনে করে। ফুকোর ভাষায়, শক্তি শুধুমাত্র দমন নয়, বরং এটি এমন এক ধারণা তৈরি করে যা জনগণের অন্তর্দৃষ্টি ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
গ্রামসি বলেছিলেন, ক্ষমতা কেবল সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা জনগণের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এটি একটি ধারণা-নির্মাণ প্রক্রিয়া, যা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার মধ্য দিয়ে জনগণের চিন্তা-ভাবনা এবং আচরণের গতিপথ নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠান নিজে একটি রাজনৈতিক শক্তির একধরনের পাত্র হয়ে ওঠে, যা সংস্কৃতি, শিক্ষা, গণমাধ্যম, পরিবার ইত্যাদি মাধ্যমের মাধ্যমে জনগণের মনস্তত্ত্বে প্রবাহিত হয়।
আলথুসার, তার ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারাটাস’ তত্ত্বে, এই ধারণাটিকেই আরও স্পষ্ট করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্র শুধু বাহ্যিকভাবে শাসন করে না, বরং এটি জনগণের ‘মনস্তত্ত্ব’ এবং ‘ভাবনা’ নিয়ন্ত্রণ করে—এটি ঘটায় শিল্প, শিক্ষা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে। মানুষের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আচরণ রাষ্ট্রের শাসনের সাথে জড়িয়ে থাকে, যা তাকে কখনোই প্রশ্নহীন বা প্রতিবাদমুখী হতে দেয় না।
এই তিন চিন্তাবিদ একত্রে দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র শুধু বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং একটি সুক্ষ্ম, আদি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র কাঠামোগত নয়, বরং এটি একটি অন্তর্গত শক্তি ক্ষেত্র, যা জনগণের চেতনায় প্রবাহিত হয়ে তাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব এমনভাবে কাজ করে যে, জনগণ নিজেদের স্বাধীনতায়ও ভ্রান্তি বোধ করে না—এমনকি তারা নিজেদের ভিন্ন চিন্তা বা বিরোধিতার স্বাদও পায় না।
প্রতিষ্ঠান তখনই কার্যকরী হয়, যখন জনগণ এই কাহিনির অংশ হয়ে যায় এবং নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠানের ধারায় ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে যে ধারণা দিয়ে জনগণ চিনতে শেখে, তা তখন ‘প্রকৃত সত্য’ হয়ে ওঠে, এবং তারা নিজেদের অনুভূতি, অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ বা বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না, কারণ তারা ভাবতে শুরু করে, ‘এটাই তো সঠিক, এটা তো স্বাভাবিক’। এইভাবে, ফুকো, গ্রামসি ও আলথুসারের চিন্তায়, প্রতিষ্ঠান কেবল একটি বাহ্যিক শাসনমূলক শক্তি নয়, বরং একটি আইডিওলজিক্যাল যন্ত্র, যা জনগণের চেতনা, বিশ্বাস এবং কার্যকলাপের ধারাকে এক ধরনের নির্দিষ্ট ‘স্বাভাবিকতা’তে পরিণত করে—যা একে অপরিহার্য এবং অপরিবর্তনীয় হিসেবে গৃহীত হয়।
২.
প্রতিষ্ঠান স্বয়ং কোনো একক দানব নয়, বরং এক ধরণের ছায়া-চরিত্র যা নীরবে কাজ করে। প্রতিষ্ঠান, তার মূলতত্ত্বে, কোনো একক সত্তা নয়—এটি কোনো শারীরিক রূপধারী ক্ষমতার অবয়ব নয় যাকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যায়। বরং প্রতিষ্ঠান হলো এক প্রকার অদৃশ্য কাঠামোগত ছায়া, এক অন্তর্জাগতিক চরিত্র, যার ক্ষমতা নিহিত থাকে তার অনুপস্থিতির মধ্যেই। এটি গড়ে ওঠে বহুস্তরীয় সামাজিক চুক্তি, চেতনার পুনরুৎপাদন, এবং প্রতিদিনকার সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মাধ্যমে—যা দৃশ্যত নিরপেক্ষ, অথচ আদতে প্রভূত ক্ষমতার ধারক।
এই ছায়া-চরিত্রের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, এটি কখনো নিজেকে ‘প্রতিষ্ঠান’ বলে ঘোষণা করে না। বরং এটি আত্মীকৃত হয়ে ওঠে ব্যক্তির আত্মপরিচয়ে, তার নৈতিক সংজ্ঞায়, এমনকি তার উপলব্ধির ভাষাতেও। একজন নাগরিক যখন রাষ্ট্রকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করে, শিক্ষক যখন পাঠ্যবইকে ‘চূড়ান্ত জ্ঞান’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, অথবা পরিবার যখন লিঙ্গভিত্তিক আচরণকে ‘সাধারণ নিয়ম’ বলে গৃহীত করে—সেই প্রতিটি মুহূর্তেই প্রতিষ্ঠান তার ছায়া বিস্তার করে। এই নীরবতা, এই অভ্যাস, এই স্বীকৃতি—সব মিলেই প্রতিষ্ঠানকে এক অভেদ্য ছায়ামূর্তিতে রূপান্তরিত করে।
ফুকো-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, আধুনিক শক্তি আর আগ্রাসী নয়—এটি সূক্ষ্ম, শৃঙ্খলাবদ্ধ, এবং আত্মীয়; গ্রামসি দেখান, সংস্কৃতি কেবল আত্মরক্ষণ নয়, বরং মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশের একটি বলিষ্ঠ ক্ষেত্র; আর আলথুসার দেখান, ব্যক্তি ও ক্ষমতার মিথষ্ক্রিয়ায় গঠিত হয় একটি ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারাটাস’। এই ত্রিমাত্রিক বিশ্লেষণেই স্পষ্ট হয় যে, প্রতিষ্ঠান আর কোনো দানব নয়—এটি ছায়া, যা অস্তিত্বের মজ্জাগত স্তরে বিরাজ কওে এবং এই ছায়া, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে এমন এক যুক্তিগত পরিসরে, যেখানে প্রশ্ন, প্রতিরোধ, কিংবা পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনাও আদতে দমন হয়ে যায়। জনগণ প্রশ্ন করতে শেখে না, কারণ প্রতিষ্ঠান প্রশ্নের ভাষাকেই প্রান্তিক করে দেয়। জনগণ বিরোধিতা করতে সাহস পায় না, কারণ বিরোধিতাকেও শৃঙ্খলা-বিরোধী অস্থিরতা হিসেবে সমাজের মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এইভাবেই প্রতিষ্ঠান একটি মেটা-চরিত্রে পরিণত হয়—নাট্যশালার সেই নির্দেশকের মতো, ব্যাকস্টেজে থাকেন। যার কণ্ঠস্বর নেই, মুখ নেই, অথচ সে নিয়ন্ত্রণ করে দৃষ্টির দিক, সংলাপের মাত্রা, মঞ্চের আলো-আঁধারি। আমরা যখন মনে করি ‘সব ঠিক আছে’—তখনই প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে সফলভাবে কাজ করে। কারণ তখন তা আর বাহ্যিক চাপ নয়, বরং একটি অন্তর্নিহিত প্রোগ্রাম, যা নাগরিক আচরণ, সামাজিক নীতিমালা এবং ভাষার কাঠামোর ভেতর অনায়াসে কাজ করে যায়।
এ কারণেই প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করা শুধু বাহ্যিক কাঠামো ভাঙা নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক নিরীক্ষার বিষয়। এই ছায়া ভেদ করতে হলে আমাদের প্রতিদিনের স্বাভাবিকতার ভেতর প্রশ্ন তুলতে হবে, প্রতিটি ‘সাধারণ’কে অসাধারণ করে দেখতে হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানের আসল মুখ ঠিক তখনই ধরা পড়ে, যখন আমরা তার অদৃশ্য ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আলো ধরতে শিখি।
বুদ্ধিজীবী সমাজের মেরুদণ্ডহীনতা, মিডিয়ার বিক্রি হওয়া শিরোনাম, ও সাংস্কৃতিক কুশীলবদের নির্লিপ্ততা—সবই এর উপাদান। যে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্নপত্র নতমুখী হয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের দিকে, যেখানে বাণিজ্যিক মিডিয়া তথ্য নয়, বরং মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, এবং যেখানে সাংস্কৃতিক কর্মীরা আত্মা নয়, শুধুমাত্র অনুদানের ট্যাবলয়েড হয়ে ওঠে—সেই সমাজে সংকট আর ঘটনাকেন্দ্রিক থাকে না; তা হয়ে ওঠে গঠনগত ও কাঠামোগত।
বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ডহীনতা এখানে শুধু ব্যক্তিক দুর্বলতা নয়, বরং একটি সুগঠিত নিও-লিবারাল উৎপাদন কাঠামোর অংশ। এক ধরনের জ্ঞান-অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, যেখানে বুদ্ধিজীবী হওয়া মানে এখন আর অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলা নয়, বরং পলিসি উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। মিশেল ফুকো তার ‘Society Must Be Defended’ এ বলেন, আধুনিক ক্ষমতা নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। সেই নিয়ন্ত্রিত জ্ঞান যিনি তৈরি করেন—অর্থাৎ তথাকথিত বুদ্ধিজীবী—তাঁর অবস্থান তখন আর চ্যালেঞ্জিং নয়, বরং ব্যবস্থাগত।
আন্তোনিও গ্রামসি 'Traditional Intellectuals' ও 'Organic Intellectuals' পার্থক্য করে বলেন, প্রথম দলটি ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিয়োজিত, দ্বিতীয় দলটি সমাজ পরিবর্তনের মুখপত্র। কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপটে যেটি দেখা যায়, তা হলো ‘প্যারাসাইটিক ইন্টেলেকচুয়াল’—যারা প্রতিষ্ঠানীয় পুষ্টি গ্রহণ করেন, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দায় এড়িয়ে যান। এদের চিন্তার জগৎটি শীতল, তাঁদের নীরবতা তীব্র, এবং তাঁদের উপস্থিতি একধরনের আত্মসমর্পণ।
এই আত্মসমর্পণের অন্যতম কোল্যাবোরেটর হলো গণমাধ্যম। মিডিয়া আধুনিক সময়ের সবচেয়ে কার্যকরী ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারাটাস’—যার কথা আলথুসার বিশ্লেষণ করেন। সংবাদমাধ্যমের ক্ষমতা আজ আর সত্য প্রকাশে নেই, বরং তারা দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। তারা ‘ঘটনা’ নয়, ‘অভিপ্রায়’ পরিবেশন করে। নিউজ এখন আর রিপোর্ট নয়, বরং একধরনের ডিসকার্সিভ ফিকশন—যেখানে শব্দের বুননে বাস্তবতাকে আরোপিত করা হয়।
আলথুসারের আইডিওলজির ধারণা অনুযায়ী, ব্যক্তি নিজেকে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘নিরপেক্ষ’ বলে ভাবলেও, সে আসলে একধরনের প্রতিষ্ঠিত গঠন কাঠামোর প্রতি আত্মবশ্যতা স্বীকার করে। মিডিয়া এই আত্মবশ্যতাকে সূক্ষ্মভাবে পুনরুৎপাদন করে। দর্শক বিশ্বাস করে যে সে স্বাধীনভাবে চিন্তা করছে, কিন্তু সেই চিন্তা-পরিসরকে ‘শিরোনাম’ গঠনের প্রক্রিয়ায় আগে থেকেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
আর যে শিল্প-সংস্কৃতি একসময় প্রতিরোধের ভাষা রচনা করত, ‘চেতনার খণ্ডচিত্র’ হয়ে উঠত, তার একটি বড় অংশ আজ আনন্দ-সাংস্কৃতিক নন্দনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো, ডেইলী স্টারদের মতো কর্পোরেড মিডিয়া হাউস গুলোর প্রেসক্রিপশনে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের পায়ে একধরনের শেকল পরানো হয়। তাদের নির্লিপ্ততা অনায়াসে চলে যায় স্বতঃসিদ্ধতার ছায়ায়। এই কুশীলবেরা প্রতিষ্ঠানের ছায়ায় গড়ে ওঠা উৎসব, পুরস্কার, বিদেশযাত্রা এবং ‘মঞ্চস্থ প্রতিরোধ’-এর ভেতর নিজেদের বাঁচিয়ে রাখেন—কিন্তু সেখানে বিপ্লবের কোনো ভাষা নেই, আছে কেবল একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ম্যানেজমেন্ট। ফলে আজ শিল্পী বা লেখক কবি সাহিত্যিক এর শৈল্পিক প্রতিবিম্বন চাপা পড়ে যায় কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকের চাহিদার নিচে।
এই ব্যর্থতা—বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মসমর্পণ, মিডিয়ার নিয়ন্ত্রিত ভাষ্য এবং সাংস্কৃতিক নিষ্ক্রিয়তা— একটি রাষ্ট্রকে এমন এক সামাজিক ঘুমের মধ্যে ফেলে দেয়, যেখানে মানুষ কেবল বেঁচে থাকে, কিন্তু নাগরিক হয়ে ওঠে না। মানুষ প্রশ্ন তোলে না, কারণ সে শিখে গেছে, প্রশ্ন তোলা ‘অসভ্যতা’। মানুষ আর প্রতিবাদ করে না, কারণ প্রতিবাদ ‘অস্থিরতা’ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রক্রিয়া এক ধরনের সাংস্কৃতিক নিরস্ত্রীকরণ, যা প্রশ্নহীন, প্রতিরোধহীন, এবং ভবিষ্যতহীন এক অবচেতনের জন্ম দেয়।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, তা নৈতিক অবস্থান ও সাহসিকতারও প্রতিচ্ছবি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক উচ্চারণ নয়—এটি এক ধরনের অস্তিত্বগত অস্বস্তির ভাষ্য, এক নির্ভীক আত্মঘোষণা, যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং আত্মপ্রত্যয়ের কেন্দ্রে স্থাপন করে। এটি সেই বিরোধিতা, যা পেশাদার বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর নয় বরং একজন সচেতন, নৈতিক, এবং যুক্তিনিষ্ঠ নাগরিকের নৈঃশব্দ্য ভাঙার প্রয়াস। এখানে প্রতিরোধ জন্ম নেয় নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে—যেখানে প্রশ্ন করাটাই কর্তব্য, এবং নিঃশব্দ থাকার অর্থই সমর্থন করার সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা মানে কেবল শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়—বরং সত্যের পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক সংকল্প। আরেন্ট তাঁর বিখ্যাত থিওরিতে বোঝান, কিভাবে সাধারণ মানুষও অশুভতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, কেবল তখনই, যখন সে নিজেকে প্রশ্নহীন ও আনুগত্যশীল ভাবে। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সেই বানালিটি ভেঙে এক আত্মসচেতনতার অনুশীলন— যেখানে ‘না’ বলাটা হয়ে ওঠে মানবিকতা রক্ষার শেষ আশ্রয়। তবে এই ‘না’ উচ্চারণ সহজ নয়। কারণ আধুনিক প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্ব গড়ে তোলে একধরনের আইডিওলজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার দিয়ে, যেখানে অনুগত্য পুরস্কৃত হয় এবং প্রশ্নবোধ নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু হাস্যকর করে তোলা হয়।
এই ছদ্মস্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করাই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ। আর এখানেই যুক্ত হয় সাহসিকতা। কারণ প্রতিরোধ মানে কেবল সংগ্রাম নয়—এটি বিরূপ বাস্তবতায় থেকেও নিজের বোধ ও নৈতিক বৃত্তিকে অক্ষুণ্ন রাখা। এই সাহসিকতা হচ্ছে সেই ধরনের নৈতিক ক্রোধ, যা স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে একজন প্রান্তিক মানুষের উচ্চারণ পর্যন্ত বিস্তৃত। সাহস এখানে শুধু শক্তির বিপরীতে রুখে দাঁড়ানো নয়—বরং সামাজিক নিস্তব্ধতার দেয়াল ভেঙে সত্য উচ্চারণের দায় স্বীকার।
গ্রামসি বলেন, প্রতিষ্ঠান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখে সাংস্কৃতিক হেজেমনির মাধ্যমে—যেখানে জনগণ নিজের অবস্থানকে প্রাকৃতিকভাবে মেনে নেয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সেই হেজেমনি ভাঙার ভাষা। এটি হচ্ছে এক ধরনের ‘কাউন্টার-ন্যারেটিভ’, যেখানে ব্যক্তি ও সমাজ মিলে রাষ্ট্রীয় বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে এক নতুন ভাষা, নতুন দৃষ্টিকোণ, নতুন সামাজিক ব্যাকরণ নির্মাণ করে। এ নির্মাণ স্বপ্নে নয়, যুক্তিতে, সাহসে, ও নৈতিক স্থিতিতে বিকশিত হয়।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সেই জায়গা, যেখানে সাহসিকতা এবং নৈতিকতা একে অপরকে শাণিত করে। কারণ সেখানে ব্যক্তি জানে—সচেতন নীরবতাও অনেক সময় অন্যায়ের অংশীদার হয়ে ওঠে। তাই সে উচ্চারণ করে, প্রশ্ন তোলে, এবং প্রতিষ্ঠানের সর্বগ্রাসী চেনাশোনার বাইরে এক বিকল্প বোধ গড়ে তোলে।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা রাজনৈতিক মত নয় কেবল, এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অভ্যুত্থান, একটি নৈতিক সাহসিকতা, একটি আত্মনির্মাণের ভাষা, যার মধ্যে নিহিত থাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। যখন কেউ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সে কেবল অতীতের একঘেয়েমি ভেঙে দেয় না, বরং সম্ভাব্য সত্য ও সম্ভাব্য ন্যায়বিচারের পথে একটি দরজা খুলে দেয়—সেই দরজা, যার মুখে সাহসিকতার বাতি জ্বলে, এবং নৈতিকতার ছায়া দীর্ঘতর হয়ে ওঠে।
৩.
লিটলম্যাগাজিন কেবল সাহিত্য নয়, বরং একটি প্রতিসংস্কৃতি। এটি মূলধারার চামড়া ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের পুঁজ উন্মোচনের একটি রূপ। এটি শুধু রূপক নয়, এটি একটি অন্তর্নিহিত নৈতিক ও রাজনৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, যা আজকের বৈশ্বিক ও প্রাদেশিক ক্ষমতার ব্যাকরণে অনুধাবনের দাবি রাখে। লিটলম্যাগাজিনের চর্চা যখন শুরু হয়, তখন তা কেবলমাত্র সাহিত্য প্রকাশের সীমিত ক্ষেত্র ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রত্যাবর্তন—এক ধরনের অস্তিত্বগত বিক্ষোভ, যা প্রাতিষ্ঠানিক জড়তাকে অস্বীকার করে।
প্রথমেই স্পষ্ট করা প্রয়োজন, "প্রতিসংস্কৃতি" (counterculture) কোনো সাময়িক আবেগ নয়। এটি একটি সাংগঠনিক বোধ, যা মূলধারার চিন্তাকে প্রশ্ন করে, তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং বিকল্প ভাষা ও ভাবপ্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি নতুন নান্দনিক ও রাজনৈতিক জায়গা নির্মাণ করে। লিটলম্যাগাজিনের উৎপত্তি সেই প্রতিসংস্কৃতিরই একটি সাহিত্যের ছায়াপাত।
মূলধারার সাহিত্য যখন সাময়িকপত্র, বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট মিডিয়া কিংবা প্রতিষ্ঠাননির্ভর শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গির কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন লিটলম্যাগাজিন তার প্রতিবাদী অনুরণন হয়ে ওঠে। মূলধারার কাঠামোতে চিন্তা ও ভাষার যে ঊর্ধ্বগতি ঘটে, তা নিছক বাজার, পৃষ্ঠপোষকতা, অথবা রাষ্ট্রীয় চাহিদার অনুবর্তী হয়ে পড়ে। লিটলম্যাগ সেই জায়গায় সাহস করে প্রবেশ করে এবং সেই ‘চামড়া’ ছিঁড়ে ভেতরের ‘পুঁজ’—অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানিক মেকানিজম, বিকৃত নৈতিকতা ও চেতনার সংকটকে উন্মোচিত করে।
লিটলম্যাগাজিনকে বোঝার জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি গহিন সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পাঠ। কিভাবে সংস্কৃতি নিজেই একটি ক্ষমতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে প্রধান ধারা সবসময় নিজস্ব পুঁজি রক্ষা করে এবং বিকল্প কণ্ঠগুলিকে প্রান্তে ঠেলে দেয়। লিটলম্যাগাজিন এই প্রান্তিকতার মধ্যেই অবস্থান করে এবং তার প্রতিবাদের ভাষা নির্মাণ করে। এ যেন একধরনের সুস্পষ্ট ইচ্ছা, যাতে প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে অবস্থান না নিয়েও প্রভাব বিস্তার করা যায়।
ফুকোর ডিসকোর্স থিওরির আলোকে যদি বিচার করি, তাহলে দেখা যায়, লিটলম্যাগাজিন একধরনের 'counter-discursive space'। এখানে প্রতিটি লেখা, প্রতিটি কবিতা, প্রবন্ধ, অথবা কথাসাহিত্য নিজেই একটি মাইক্রো-প্রতিরোধ—একটি প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা ভেঙে বেরিয়ে আসার নিরন্তর প্রয়াস। ফুকো যেভাবে জ্ঞান ও ক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন, ঠিক তেমনভাবেই লিটলম্যাগাজিন চর্চা দেখিয়ে দেয়, কীভাবে জ্ঞান উৎপাদন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নয়, প্রান্তিক ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে।
আলথুসারের ভাষায়, রাষ্ট্র কেবল রেপ্রেসিভ অ্যাপারাটাসের মাধ্যমে কাজ করে না, বরং আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারাটাসের মাধ্যমেও চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সাহিত্য—সবই এই আইডিওলজিক্যাল পুনরুৎপাদনের হাতিয়ার। লিটলম্যাগাজিন সেখানে একটি ''ideological disobedience'—যা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর আদর্শিক পুনর্নির্মাণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
লিটলম্যাগাজিন চর্চা কখনোই সহজ নয়। এটি অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়, এটি সামাজিকভাবে সম্মানিতও নয়, কিন্তু এটি সাংস্কৃতিকভাবে অপরিহার্য। কারণ এটি মূলধারার ভেতরে জমে থাকা অনুচ্চারিত অভিমত, বিকল্প চিন্তা এবং প্রান্তিক চেতনার জন্য একমাত্র মুক্ত পরিসর। এই মুক্ত পরিসরকে বাঁচিয়ে রাখার দায় একটি দৃষ্টিভঙ্গির, একটি আদর্শিক সাহসিকতার।
এখানে এসে লিটল ম্যাগাজিন হয়ে ওঠে একটি নৈতিক অবস্থান। এর সম্পাদকের শ্রম, লেখকের অনাগ্রহহীন উৎসর্গ, পাঠকের নীরব প্রতীক্ষা—সবকিছু মিলে এই প্রতিসংস্কৃতির পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়। এটি শিল্প নয় কেবল, এটি একধরনের ইতিহাস-নির্মাণ। একটি পৃষ্ঠা ছাপা হওয়া মানে কেবল মুদ্রণ নয়, বরং তা এক ধরনের সভ্যতা-বিরোধী আখ্যানের জন্ম দেওয়া। লিটল ম্যাগাজিন তাই প্রতিরোধের পাঠশালা। তত্ত্ব, অভিজ্ঞতা, প্রতিবাদ ও শিল্প—এই চারটি উপাদানে মিলে লিটল ম্যাগাজিন হয়ে ওঠে একধরনের সাংস্কৃতিক সাবভার্সন। এটি প্রশ্ন তোলে, ভাষার গভীরে গিয়ে শব্দের অস্বস্তি খোঁজে এবং পাঠকের অন্তর্গত নীরবতাকে তুমুল ঝাঁকিয়ে দেয়। এক কথায়, এটি কেবল সাহিত্য নয়—এটি নিজেই একটি আন্দোলন।
লিটলম্যাগাজিন আন্দোলন শুধুমাত্র সাহিত্য বা শিল্পের একটি সাধারণ মাধ্যম নয়, বরং একটি সংস্কৃতি এবং প্রতিবাদের প্রকাশ। এই আন্দোলন মূলধারা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, এক বিপরীত গতি তৈরি করেছে, যেখানে স্বতন্ত্র চিন্তা, অস্পষ্টতা, এবং প্রশ্নবিদ্ধতার মধ্যে নতুন এক ভাষা এবং সমাজের চিত্র আঁকা হয়েছে। এই চিন্তাধারা ও আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য ফুকো, গ্রামসি, আলথুসার, এবং বুরদিয়ুর মত দার্শনিকরা বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের তত্ত্বগুলির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক শক্তির কাঠামো তৈরি করে এবং সেই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এসব সাহিত্যিক কাজের মধ্যে।
ফুকো দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্রের শক্তি কেবল শাসনব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রতিটি সামাজিক স্তরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব শুধু বাহ্যিক ব্যবস্থায় নয়, সাংস্কৃতিক এবং ভাষিকভাবে গভীরভাবে উপস্থিত এবং লিটলম্যাগাজিন এই শক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী আন্দোলন হিসেবে উত্থিত হয়, যেখানে লেখকেরা মূলধারার সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক ধারার নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নিজেদের কণ্ঠস্বর তৈরি করতে চায়। এই আন্দোলন, বা প্রতিসংস্কৃতি, রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই নয়, বরং এই প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি ও চিন্তা পদ্ধতিরও বিরুদ্ধ।
গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্ব আমাদের জানায়, যে সমাজের শাসক শ্রেণি তাদের মতাদর্শকে একাধিকার প্রতিষ্ঠিত করে রাখে, তবে লিটলম্যাগাজিন সেই শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন ভাষা তৈরি করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছে। লেখকরা তাদের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করে, যা কোনও একক শ্রেণির আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। তারা যে ভাষা ব্যবহার করে, তা মূলধারা ভাষার সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে এবং সেই ভাষায় আন্দোলনের এবং এক স্বাধীন চিন্তার আবেদন রাখা হয়।
আলথুসারের ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারাটাস’ তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, রাষ্ট্রের শক্তি একমাত্র আইন ও শাসনব্যবস্থায় নয়, বরং রাষ্ট্রের সংস্কৃতির, শিক্ষার, এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের চিন্তা এবং আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারাটাসের মধ্যে লিটলম্যাগাজিন একটি ভাষিক বিপ্লবের মত কাজ করে, যা সংজ্ঞাবদ্ধ নয়, বরং অগোছালো, শক্তিশালি, এবং প্রভাবশালি। এই পত্রিকাগুলি মূলধারা মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ব্যবহৃত শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাষার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে।
বুরদিয়ুর ‘প্রতীকী পুঁজি’ তত্ত্বকে কেন্দ্র করে, সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্র বা ফিল্ড (যেমন সাহিত্য, শিল্প, মিডিয়া) তার নিজস্ব প্রতীকী মূল্য এবং পুঁজি তৈরি করে। লিটলম্যাগাজিন সেই ক্ষেত্রেই কাজ করে, যেখানকার প্রতীকী পুঁজি শুধুমাত্র মূলধারার শিল্প বা সাহিত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বরং একটি নতুন চিন্তা পদ্ধতি গড়ে তোলে, যা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করে। এখানে, লেখকের কাজ শুধুমাত্র একটি সৃজনশীল চর্চা নয়, বরং সেই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই যা সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে।
লিটলম্যাগাজিনের ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সমাজের প্রচলিত ভাষা, যেটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এই ভাষা তার বিপরীতে দাঁড়ায়। এখানে শব্দ, বাক্য এবং চিন্তা-ভঙ্গির মধ্যে অনেক অনিশ্চয়তা থাকে এবং এই ভাষা প্রায়ই প্রতীকীভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি শুধুমাত্র একটি সৃজনশীল ভাষা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ভাষা, যা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজস্ব এক বাস্তবতা নির্মাণ করে।
‘দ্রষ্টব্য’, ‘প্রতিশিল্প’, ‘গাণ্ডীব’, ‘দুয়েন্দে’, ‘চালচ্চিত্র’, ‘শ্লোক’ ‘শাব্দিক;, ‘শিং’, ‘ডানার করাত’, ‘যশোর রোড’, ‘সূর্যঘড়ি’ এবং ‘করাতকল’ আধুনিক লিটলম্যাগাজিনের প্রতিনিধিত্বকারী পত্রিকা। এগুলির বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শুধু সাহিত্যিক শুদ্ধতা বা শিল্পের চর্চা নয়, বরং এক শক্তিশালি প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাগুলির লেখকরা তাদের কণ্ঠস্বরকে এক নতুন ভাষায় প্রকাশ করতে চান, যা মূলধারা সংস্কৃতির, শিল্পের এবং সাহিত্যচর্চার নিয়মের বিরুদ্ধে। তারা নতুন ভাষায়, নতুন চিন্তায়, এবং নতুন বাস্তবতায় প্রভাব ফেলতে চান। ‘দ্রষ্টব্য’ যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক উন্মাদনার এক প্রকাশ, ‘প্রতিশিল্প’ সেভাবে শিল্পের শুদ্ধতায় বিশ্বাস রেখে, কিন্তু সেই শিল্পকে সমাজের অনিশ্চিত পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, এবং ‘করাতকল’ তার সৃজনশীল চেতনার মাধ্যমে একটি বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনার উন্মোচন ঘটাতে চায়।
এই লিটলম্যাগাজিন আন্দোলন ভবিষ্যতে একটি বড় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানের প্রতিফলন হতে পারে। ডিজিটাল যুগে, যখন মিডিয়া এবং সাহিত্য প্রথাগত মাধ্যমগুলির মাধ্যমে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, লিটলম্যাগাজিন এক নতুন শক্তির প্রতিনিধিত্ব হতে পারে। যদি এটি সত্যিই রাজনৈতিক চেতনার সাথে একীভূত হতে পারে, তবে এটি জনগণের কণ্ঠস্বর, তাদের ভাষা, এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনঃনির্মাণ করতে পারে।
এই আন্দোলন আসলে কোনো সাধারণ সাহিত্যিক প্রচেষ্টা নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ যা ভাষা, চিন্তা এবং সমাজের কাঠামো পরিবর্তনের জন্য লড়াই করছে। ‘কবিতা পত্রিকা’ থেকে শুরু করে ‘দ্রষ্টব্য’, ‘প্রতিশিল্প’, ‘করাতকল’, ‘ডানার করাত’ এবং ‘শিং’ পর্যন্ত, এই ধারাবাহিক চর্চা রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধেই এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গড়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতের চর্চাকে আরও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকিত করবে।
প্রতিষ্ঠানের অস্পষ্টতা এই সমাজে এক গভীর নীরব সহিংসতা তৈরি করেছে। এই সহিংসতা বন্দুকের গুলিতে নয়, বরং নিঃশব্দ নিয়ন্ত্রণে, বিশ্বাসের ভিত ভেঙে, স্বপ্নের ঘরে আগুন দিয়ে কাজ করে। এর বিপরীতে দাঁড়াবার শক্তি লিটলম্যাগ চর্চার মতো বিকল্প কাঠামোর ভেতরেই নিহিত। আমাদের লেখনী হতে হবে ধারালো, অপ্রিয়, এবং সাহসী। কারণ প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন না করলে সে প্রশ্নকর্তাকেই নিশ্চিহ্ন করে।
৪.
লেখক কখনোই কোনো প্রতিষ্ঠানের বা ক্ষমতার ক্রীতদাস হন না। এমনকি তার রচনাবলীর প্রেক্ষাপটও তাকে কখনোই নির্ধারিত হয়ে উঠতে দিতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেখকের বিরোধ, এক রকমের একক যাত্রা, যেখানে লেখক নিজের স্বাধীনতা, সত্য এবং ব্যক্তি সত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতি ধারণ করেন। এটি শুধু একটি সাহিত্যিক বিরোধ নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক চুক্তি, যেখানে এক নৈরাজ্য, এক দ্বন্দ্ব এবং এক নতুন চিন্তা সৃষ্টির জন্ম হয়।
প্রতিষ্ঠান এবং লেখক, এদের মধ্যে সম্পর্ক কোনো সরল রেখায় চলে না। লেখকের পক্ষে, এটি মূলত একটি টানাপোড়েন—একটি অনিবার্য দ্বন্দ্ব, যেখানে ব্যক্তি তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর শোনার জন্য প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্যে একটি বিদ্রোহী আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে থাকে। এই আত্মবিশ্বাস অটল এবং দৃঢ় এবং এতে কোনো আপস নেই। লেখক যে শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তা শুধু ব্যক্তি স্বার্থ নয়, বরং বৃহত্তর মানবিকতাবোধের জন্য একটি আন্দোলন। এটি যেমন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, তেমনি এটি একটি নৈতিক অবস্থানও গ্রহণ করা।
একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন তাকে শুধু ব্যক্তিগত অভ্যন্তরীণ সত্তার সঙ্গে লড়াই করতে হয় না, বরং তাকে লড়াই করতে হয় প্রতিষ্ঠানের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠান মূলত ক্ষমতার কেন্দ্র, যেখানে একটি সামাজিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক নীতি এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থাপিত থাকে। প্রতিষ্ঠান চায়, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানীয় কাঠামো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলি একবিংশ শতকের প্রয়োজনীয়তা বা দর্শনের আড়ালে এক পরাবাস্তব শাসক হিসেবে কাজ করবে। লেখক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজের এই শৃঙ্খলা ও কাঠামোকে প্রশ্ন করে। তিনি নিশ্চিত করেন যে সমাজ কখনোই শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও নির্দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং, ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তার মুক্ততা এবং মানবিক অনুভূতির জয়লাভ হবে।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র সাহিত্যের ভাষা নয়, বরং এটি একটি প্রতিরোধের ভাষা, যা নীতি, রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। এই ভাষা কেবল শুদ্ধতা বা সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং এটি বাস্তবতার এক শক্তিশালি প্রতিবাদ।
একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন তার মধ্যে একটি গভীর অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে সে এক বৃহত্তর সমাজের জন্য কিছু অর্জন করতে চায়, যেখানে তার নিজের অস্তিত্ব একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম। এটি তার নৈতিক অবস্থান, সাহসিকতা এবং বিশ্বাসের প্রকাশ। তবে, এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাহ্যিক বিরোধিতা নয়, বরং লেখকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তার আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতার জন্য বুঝে যাওয়ার প্রবৃত্তি একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই অবস্থান এক ধরনের বিদ্রোহী চিন্তা জন্ম দেয়, যা সমাজের প্রতিষ্ঠিত চেতনাকে ব্যর্থ করে। লেখক বুঝতে পারেন যে, প্রতিষ্ঠানের গড়পরতা ধ্রুবকতার মধ্যে সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, তাই তাকে এক অনিশ্চিত কিন্তু বিপ্লবী পথে হাঁটতে হবে। এভাবেই এক নতুন ভাবনা জন্ম নেয়, যা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
এখানে যে প্রশ্নটি আসে তা হলো—লেখকের এই বিরোধিতা কতটা নৈতিক, কতটা সাহিত্যিক? এটি কেবল একটি রাজনৈতিক অবস্থান নেবার পন্থা নাকি সাহিত্যের গভীরতা এবং প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা? একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করেন, তিনি শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা সামাজিক শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করেন না, তিনি একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে চেষ্টাও করেন। এটি একটি নতুন ধারা, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি নতুন আখ্যান রচনার প্রয়াস।
এভাবে, লেখক নিজের কাজের মধ্য দিয়ে এক নতুন পথ তৈরি করেন, যা সম্ভবত মূলধারা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই বিরোধিতা এক নতুন সাহিত্যিক ভাষা সৃষ্টি করে, যা মানবিকতার প্রকৃত চিত্র এবং সমাজের অবস্থা নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন করতে সহায়ক।
লেখক যখন প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়ে ওঠেন, এটি কোনো সহজ সিদ্ধান্ত নয়। এটি তার জীবনের এক সংকটময় সিদ্ধান্ত, যেখানে তাকে না শুধু প্রতিষ্ঠানের শক্তি এবং নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, বরং তাকে তার সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে সেই প্রতিবাদী ভাষা সৃষ্টি করতে হয়, যা মানুষকে না শুধু সচেতন করে, বরং একটি নতুন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একজন লেখক তখন সত্যিকার অর্থে সমাজের জন্য এক প্রকার বিপ্লবী শক্তি হয়ে ওঠেন, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সৃষ্টির দিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করেন।
৫.
একমাত্র একজন লেখকই প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করতে পারেন, একমাত্র তার সৃজনশীল জগতের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা এবং সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়। তবে, এটি একটি দ্বৈত পরিস্থিতি— যেখানে লেখক যেমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তেমনি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস এবং সৃষ্টিশীলতার দিকে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রতিফলন ঘটে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে লুকানো থাকে কেবল একটি রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বিরোধী অবস্থান নয়, বরং এটি একটি মানবিক তর্ক—এটি এক গভীর বোধের, এক বিক্ষোভের এবং এক অতুলনীয় সৃষ্টির প্রক্রিয়া, যা প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়।
প্রতিষ্ঠান কখনোই শুধুমাত্র বাহ্যিক শক্তি নয়, বরং এটি একটি সমাজের অন্তর্নিহিত কাঠামো, যার মাধ্যামে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং সাংস্কৃতিক নীতি প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা এমন একটি শক্তি যা সমাজের প্রতিটি স্তরে বিরাজমান এবং এটি সাধারণত এক ধরনের নিয়ম এবং বিধির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। এই শৃঙ্খলা সমাজের প্রত্যেকটি নাগরিককে একটি বিশেষ কাঠামোতে বন্দী করে রাখে, যেখানে তাদের আচরণ, চিন্তা, এবং অনুভূতি প্রতিষ্ঠানের নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এটি সমাজের ভেতরে এক ধরনের সামাজিক কোড তৈরি করে, যা জনগণের চিন্তা-চেতনা ও অনুভূতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই কাঠামোর মূল উদ্দেশ্য থাকে একটি স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, যা সুশাসন, শৃঙ্খলা এবং সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাজের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। তবে, এই একই শৃঙ্খলা কখনও কখনও লেখকদের কাছে শৃঙ্খলিত হয়ে ওঠে। যখন একজন লেখক এই প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করেন, তখন তা সমাজের ভেতরের অদৃশ্য শক্তি এবং চিন্তা-চেতনার অস্বচ্ছতা উন্মোচন করে।
লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাকে প্রশ্ন করেন, তখন তিনি শুধু রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে মুখর হন না, বরং তিনি এক নতুন ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। এই প্রতিবাদ শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান নয়, বরং এটি একটি অন্তর্নিহিত বিরোধ, একটি নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। প্রতিষ্ঠানের যে-কোনো শক্তিশালি কাঠামো সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে নিজের শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ করতে চায়, কিন্তু লেখক তার সৃষ্টির মাধ্যমে এই শৃঙ্খলকে ভাঙতে চান। সাহিত্য তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদ ও সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের এক শক্তিশালি হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
এই প্রতিবাদের মধ্যে লেখক শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে না গিয়ে, বরং তার সমাজের অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে এক তাত্ত্বিক অবস্থান তৈরি করেন। ফুকো, গ্রামসি, আলথুসার এবং বুরদিয়ুরের তত্ত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা এবং এক ব্যক্তি বা লেখকের বিপরীতে যে সংঘর্ষ ঘটে, তা অনেক দিক থেকে গভীর এবং কার্যকরী। ফুকো তার ‘পাওয়ার’ তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোর গভীর নিয়ন্ত্রণকে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে লেখক তার সৃষ্টির মাধ্যমে সেই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এই দাঁড়ানো কেবল প্রতিবাদ নয়, বরং এটি এক নতুন আদর্শের, নতুন চিন্তার অভিব্যক্তি।
একজন লেখকের জন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কেবল তার সাহিত্যের ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি নয়, বরং এটি এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের অংশ। এখানে, লেখক সমাজের সাংস্কৃতিক নির্ধারণের বিপরীতে দাঁড়ান, যেখানে শাসক শক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের শক্তি একে অপরকে সাহায্য করে। সাংস্কৃতিক দর্শনে লেখক তখন প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে নতুন অর্থ ও নতুন অভ্যস্ততা তৈরির চেষ্টা করেন। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে লেখক এক নতুন সাংস্কৃতিক ভাষা সৃষ্টি করেন—যা নিজেই একটি শৃঙ্খলা, কিন্তু সেই শৃঙ্খলার ভিতর বিদ্যমান থাকে অস্থিরতা, বিপ্লব এবং চিন্তার মুক্তি।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব কখনোই নিছক প্রতিরোধ নয়। এটি এক সৃজনশীল ভাষার উদ্ভবের সূচনা, যেখানে লেখক তার সাহিত্যিক প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ভাষা, ধারা এবং গোষ্ঠীকে প্রশ্ন করতে পারেন। সাহিত্য তখন এক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু তার এই শৃঙ্খলা ভাঙতে এবং নতুন ধারণা তৈরি করতে লেখক কেবল শব্দের ব্যবহারেই পরিবর্তন আনেন না, বরং পুরো সাংস্কৃতিক কাঠামোর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
লেখক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভাঙার মাধ্যমে কেবল বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতকে নষ্ট করেন না, বরং এক নতুন সাংস্কৃতিক রূপের জন্ম দেন। এখানে তিনি জনগণের চিন্তা ও সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে, নিজস্ব এক পথ খুঁজে নেন, যা এক স্বাধীন, বৈচিত্র্যময় এবং প্রকৃত সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয়।
একজন লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তিনি শুধু নিজেকে, তার সাহিত্যকে বা সমাজকে প্রশ্ন করেন না, বরং তিনি মানবিকতার প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য এক আন্দোলনের সূচনা করেন। তার সাহিত্য কেবল একটি প্রতিবাদী আওয়াজ নয়, বরং এটি এক নতুন রূপের সৃষ্টির উন্মোচন। প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা, সংস্কৃতির একাত্মতা, এবং সামাজিক কাঠামোর ভিতর এক বিশাল দ্বন্দ্ব চলে, যেখানে লেখক তার সৃষ্টির মাধ্যমে এক নতুন ভাষার, নতুন চিন্তার পথ তৈরি করে।
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা কোনো হঠকারী উন্মাদনা নয়—এ এক গভীর নৈতিক দায়, এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ অবস্থান, যা ক্ষমতার অদৃশ্য ও দৃশ্য কৌশলের বিরুদ্ধে লেখককে সতত সজাগ রাখে। প্রতিষ্ঠান যখন নিজেকে স্বাভাবিক, অপরিবর্তনীয় ও অপ্রশ্নযোগ্য বলে দাবি করে, তখন লেখকের ভূমিকা হয়ে ওঠে সেই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, ভেঙে ফেলা তার ছদ্ম-নিরপেক্ষতার মুখোশ। এই দায় কেবল লেখার ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এ এক জীবনযাপনের শৈলী, এক চিন্তার রাজনীতি, যা প্রতিষ্ঠানের প্রলোভন, দমন, অথবা আত্মসাৎ—সবকিছুর বিরুদ্ধেই এক অনমনীয় প্রত্যাখ্যান।
লেখকের দায় এই জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে, তিনি যেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে কেবল প্রতিবাদের ছলে, বা রোমান্টিক বিপ্লবের আবহে না দেখেন। বরং লেখকের কর্তব্য, সেই প্রতিষ্ঠানিক অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থতা ও ছলনাগুলিকে চিনে নেওয়া, বিশ্লেষণ করা এবং ভাষার মাধ্যমে তাকে ভেঙে দেওয়া। লেখকের কাজ তখন হয়ে দাঁড়ায় নতুন পাঠ-সীমার নির্মাণ, বিকল্প নৈতিক মানচিত্রের প্রস্তাব এবং পাঠকের অনুভব ও বোধকে নতুন এক আত্মসচেতনতার দিকে চালিত করা।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের দায় এই কারণেই গভীর এবং জটিল—তাঁকে একই সঙ্গে ভাষার, ইতিহাসের, রাজনীতির এবং নৈতিকতার মুখোমুখি হতে হয়। নিজের অবস্থানকে প্রশ্ন করে, ক্ষতিগ্রস্তদের ভাষা ধারণ করে, তিনি একটি সামাজিক চেতনার বিকল্প জগৎ নির্মাণে আত্মনিয়োজিত থাকেন। এই দায় কোনো শেষ গন্তব্য নয়, বরং এটি এক নিরন্তর অভিযাত্রা—এক প্রতিবাদী, সন্দেহপ্রবণ, তবুও নির্মাণমুখী চেতনার রূপ, যা প্রতিষ্ঠান নামক অনুকরণীয় ক্ষমতার প্রতিমূর্তিকে ভেঙে গড়ে নতুন অর্থ ও মানবিকতার দিগন্ত প্রসারিত করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন