ভোরের বয়ান: কাওসার মাসুম এর কবিতার প্রেক্ষিত প্রতিক্রিয়া এবং একটি আত্মিক অনুধ্যান || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

রবিবার, ১১ মে, ২০২৫

ভোরের বয়ান: কাওসার মাসুম এর কবিতার প্রেক্ষিত প্রতিক্রিয়া এবং একটি আত্মিক অনুধ্যান || শাফি সমুদ্র



আধুনিক বাংলা কবিতা আত্মনিষ্ঠ চেতনার পরিস্ফুটন এবং ভাষার স্বনির্বাচিত ও বহুস্বরিক প্রকাশের এক দীর্ঘ ও বিবর্তিত ঐতিহ্য। রবীন্দ্রোত্তর কাব্যবীক্ষা, জীবনানন্দের অন্তর্মুখীনতা, শক্তি-সুনীলের নগর-নিবিড় ভাষ্য, শঙ্খ ঘোষের দার্শনিক ব্যঞ্জনা কিংবা নিরীহ গৃহস্থ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উৎপলকুমার বসুর নিরীক্ষা—সব মিলিয়ে বাংলা কবিতা আজ ভাষা, বিষয় ও রূপবোধে এক বহুত্বময় পরিসরে অবস্থান করছে। এই প্রেক্ষিতেই কাওসার মাসুম-এর কাব্যগ্রন্থ ভোরের বয়ান নতুন কণ্ঠস্বরের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন, যা পাঠককে কেবলমাত্র সাহিত্যিক তৃপ্তি দেয় না; বরং চিন্তা ও অনুভবের বোধজগৎকে নাড়া দিয়ে যায়।


এই গ্রন্থে কাওসার মাসুম যে অভিজ্ঞতার নান্দনিক বিন্যাস রচনা করেছেন, তা একাধারে আত্মচেতনা, নাগরিক ক্লান্তি, স্মৃতি, প্রেম, ভাষা-সংকট ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে গঠিত। কবির ভাষা বিমূর্ত হলেও অনুভবের গভীরতায় সুগভীর; কোথাও কোথাও তিনি উচ্চারণ করেছেন একান্ত বেসুরো অথচ দার্শনিক বোধে মণ্ডিত বয়ান। এটি নিছক একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, বরং এক মনোজাগতিক ভূগোলের কবিতাময় রূপরেখা।


নিভৃতচারী ও ধ্যানমগ্ন কবি কাওসার মাসুম  যিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় লিটলম্যাগাজিন দ্রষ্টব্য ও করাতকল এ নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। দীর্ঘকাল কবিতার ভেতরে বসবাস করলেও করাতকল থেকে তার এই প্রথম কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘ভোরের বয়ান’। বেনিয়াবৃত্তি, পুঁজির দাসত্ব আর মিডিয়ার অগ্রাসনের বিরোধিতায় ছোটকাগজ আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা কবির প্রথম প্রকাশিতগ্রন্থ পাঠকের মনন গহ্বরে নাড়া দিয়ে যাবে।


কবির আত্মা থেকে উৎসারিত ভাষার আধিপত্যে কবিতার গতিমুখ পরিবর্তন করে পাঠকের সামনে বারবার তুলে এনেছেন সুতীব্র যন্ত্রণার বৈচিত্র‍্যময় আখ্যান। তার কবিতার মূল উপজিব্য হিসাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয় সাধারণ মানুষের আত্মিক সংকট কিংবা যন্ত্রণার সুরোতহাল, হতাশা-ক্লান্তি-শূন্যতা ও ব্যক্তিসত্তার নৈর্ব্যাক্তিক অনুসন্ধান। চিরাচরিত ধারনা থেকে বেরিয়ে কবি খুঁজতে থাকেন এক প্রবাহমান জীবনের গতি প্রকৃতি, ফলশ্রুতিতে তিনি শুধু সুন্দরের প্রতি মোহগ্রস্থ না থেকে অসুন্দরের প্রতিও দূরদৃষ্টি রেখেছেন তার নির্মানকৌশলে। ভাষা ও স্থাপত্যে শুধু নয়, শব্দ প্রয়োগ, বাঁকরীতি, অলঙ্করণ ও চিত্রকল্পে নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন। পূর্ববর্তি ঘরাণা থেকে বেরিয়ে এক স্বতন্ত্রবোধের স্থান অর্জন করেছেন ‘ভোরের বয়ান’ কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়।


বাংলা কবিতায় আধুনিকতার প্রবাহ শুরু হয়েছে মূলত বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা এই আধুনিকতার এক নিঃশব্দ বিপ্লব। পরবর্তী কালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার প্রমুখ কবির হাতে নাগরিক যাপনের নতুন ভাষ্য জন্ম নিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের কবিতার ভেতরে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে সমসাময়িক কাব্যপ্রবাহে আমরা দেখতে পাই একটি আত্মসন্ধানী, বিষণ্ন, কখনো দ্রোহী আবার কখনো গীতল স্বর। এই পরম্পরায় কাওসার মাসুম এক নতুন বয়ানের কারিগর।


তার কবিতায় আধুনিকতার ছাপ রয়েছে গভীর দার্শনিক সংকেতের ভেতর দিয়ে। তিনি 'নতুন' হতে চান না কেবলমাত্র চমক দিয়ে; বরং পরিচিত ভাবনার অচেনা গলিতে প্রবেশ করান পাঠককে। তাঁর কবিতার ভাষা যেন আত্মার ছায়া; অবয়বহীন অথচ অনুভবযোগ্য।


কবি কাওসার মাসুমের কবিতাগ্রন্থ ভোরের বয়ান (প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০২৩) বাংলা আধুনিক কবিতার সাম্প্রতিক পরিসরে এক গম্ভীর, দুঃখপ্রবণ, এবং আত্মানুসন্ধানী কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কালের স্রোতে পাল্টে যাওয়া সমাজ, সময়, এবং ব্যক্তিগত ও সাময়িক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে মাসুমের কবিতা একাধারে আত্মজৈবনিক, আবার গভীরভাবে রাজনৈতিক। এ গ্রন্থকে মূল্যায়ন করতে হলে সমকালীন বাংলা কবিতার গতিপথ ও কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কবির অভিপ্রায়, ভাষার ব্যবহার, এবং প্রতীকের নির্মাণ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে হয়।


বাংলা আধুনিক কবিতা একান্তভাবে নাগরিক অভিজ্ঞতা, বিষণ্ণতা, আত্মবিভক্তি ও চেতনার বহুস্তরীয় দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশ-পরবর্তী সময়ে যে অন্তর্মুখী, বিমূর্ত, এবং চিত্রকল্পনির্ভর কাব্যভাষার চর্চা হয়েছে, তারই উত্তরসূরী হয়ে ওঠে কাওসার মাসুমের কবিতার কণ্ঠস্বর।


তাঁর কবিতা যেন এক প্রকার প্রাত্যহিক বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা শৈল্পিক প্রতিবাদ। ভোরের বয়ান-এ দেখা যায় ভোর, নদী, ঘাস, কুয়াশা, চিল, দাঁড়কাক, ও হিজল গাছের পুনরাবৃত্ত উপমা ও প্রতীক—যা কেবল প্রকৃতিচিত্র নয়, বরং ব্যক্তি ও সমাজের অন্তর্গত ভাঙনের চিহ্নমাত্র। আধুনিকতার মধ্যে এখানেই রয়েছে ব্যতিক্রম: প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে, অস্তিত্বগত বিষণ্ণতা ও প্রান্তিকতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে।


কাওসার মাসুমের কবিতায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে উপাদানটি চোখে পড়ে, তা হলো—এক গভীর আত্মপীড়ন ও আত্মসমালোচনার কণ্ঠস্বর। কবি কখনো ব্যক্তিগত যন্ত্রণার অনুভবকে বৃহত্তর সামাজিক ব্যর্থতার সঙ্গে যুক্ত করেন, কখনো আবার চেতনার পলাতক ও বিচ্ছিন্ন অবস্থা তুলে ধরেন।


উদাহরণস্বরূপ, ‘সিঁড়ি’ কবিতায় দেখা যায় একটি অস্তিত্বগত পতনের চিত্র, যেখানে কবি নিজেই ‘প্রত্যাখ্যাত খণ্ডিত প্রস্তর’ হয়ে রয়ে যান নিচে পড়ে। সিঁড়ির চিত্রকল্পটি এখানে সমাজবিন্যাসের গতিশীলতাকে নির্দেশ করে, যার উপর 'উঠে' যাওয়ার আশা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।


অন্যদিকে ‘আত্মহত্যার আমলনামা’ এক বিশেষ কবিতা যা সরাসরি আত্মহননের বিষয়বস্তু ছুঁয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে উঠে আসে সমাজবিরোধী এক প্রতিবাদী আত্মা—যার মধ্যে জীবনের অর্থহীনতা, বৈষম্য, এবং নৈঃসঙ্গ্যের স্বর প্রতিধ্বনিত হয়। এখানে ‘ঋষি এস্তেবান’ নামের কাল্পনিক অথবা বাস্তব চরিত্রের আশ্রয়ে কবি নিজের দ্বন্দ্ব ও আত্মদ্বিধার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এই কৌশল বাংলা কবিতায় এক নতুন প্রবণতা—কাব্যিক 'ছায়া চরিত্র' নির্মাণের মাধ্যমে আত্মপাঠের একাধিক স্তর তৈরি করা।


কাওসার মাসুমের কবিতা ভাষার অলঙ্কারিক সৌন্দর্যের চেয়ে ধ্বংসের পরিণত ভাষার পুনর্নির্মাণে আগ্রহী। ‘বর্গাকার বিড়ম্বনা’ বা ‘নিষ্পাপ এইসব’ কবিতায় ব্যবহৃত বাক্য কাঠামো খণ্ডিত, শব্দচয়ন সংকেতময়, এবং চিত্রকল্প জটিল। আধুনিক কবিতায় যেখানে জটিলতা সৌন্দর্যকে ব্যর্থ করে না, বরং তার প্রয়োজনীয়তা হয়ে ওঠে, সেখানে মাসুমের কণ্ঠস্বর ধ্বস্ত রূপকে নতুন অর্থ দেয়।


তাঁর কবিতায় প্রচুর ব্যবহৃত হয় বৈজ্ঞানিক শব্দ (যেমন ‘জারণ-বিজারণ’, ‘নিউরোট্রান্সমিটার’), যা বাংলা কবিতায় তুলনামূলকভাবে কম সচর। এসব ব্যবহার শুধু মাত্র শব্দের আধুনিকতাকে যুক্ত করে না, বরং চেতনাগত বিকারের গভীর রূপক হিসেবেও পাঠ করা যায়।


কাওসার মাসুমের কবিতা নগর ও গ্রামীণ অভিজ্ঞতার মধ্যবর্তী এক উত্তরণের ভাষা নির্মাণ করে। ‘ল্যান্ডস্কেপে মোড়া ভোর’, ‘ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির’, ‘পথের বিকল্প পথ’—এইসব কবিতার শিরোনাম ও গদ্যাংশে দেখা যায় এমন এক ভোর যার অর্থ প্রথাগত শুভ সূচনার বিপরীত। ভোর সেখানে আতঙ্কিত, বিমূঢ়, অথবা আত্মপ্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত সময়কাল। তার ভাষায় ‘ভোর এসে খুলে দোর খালি পায়ে একা চলে যায়’—এই চিত্রকল্প সময়ের নির্লিপ্ততা ও মানব অস্তিত্বের অস্থিরতাকে এক অভূতপূর্ব সরলতায় উপস্থাপন করে। এধরনের কালানুভব বাংলা আধুনিক কবিতার 'সময়ের দর্শন'-এর অংশবিশেষ।


যদিও কাওসার মাসুমের কবিতা অন্তর্মুখী, তবুও কিছু নির্দিষ্ট কবিতায় তিনি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য হাজির করেন, যেমন ‘তোমাদের রাজনীতি’, ‘দশ দিগন্ত’, ‘রোদ র‌্যালি’। তাঁর কবিতা রাজনৈতিক দলাদলি বা মতবাদের অনুসরণ করে না; বরং নৈরাশ্যবাদী ও প্রত্যাখ্যানমুখী রাজনৈতিক কাব্যভাষা নির্মাণ করে।


এখানে প্রকৃতির নিধনকে রাজনৈতিক অন্যায়ের চিত্ররূপে দেখানো হয়। ফলে, কাওসার মাসুম রাজনীতির নামে ধ্বংস ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তবে তা একান্ত ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে।


ভোরের বয়ান- এর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এর অন্তর্নিহিত মৃত্যুবোধ। পুরো গ্রন্থে এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করে মৃত্যু, অবসাদ, আত্মহননের প্রতি—জাগতিক চেতনা নয় বরং একপ্রকার সামাজিক নৈরাশ্য ও ব্যক্তিগত ব্যর্থতার প্রতিবিম্ব। ‘আত্মহত্যার আমলনামা’ ছাড়াও ‘বৃষ্টি বিউগল’, ‘নদী মধুমতি’, ‘রোদ র‌্যালি’, ‘চুপচাপ’, ‘অতল’—এইসব কবিতায় মৃত্যুবোধ একধরনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। কখনো এটি বিমূর্ত, কখনো ভৌতিক বাস্তবতায় দৃশ্যমান। মৃত্যু এখানে একটি পরিণতি নয়, বরং অস্তিত্ববাদী প্রশ্নের একটি উত্তরহীন আয়োজন।


একাধিক কবিতায় ‘রেহানা’ নামটি উঠে আসে, যা প্রেমিকা, প্রিয়জন, বা এক বিমূর্ত নারীর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ‘রেহানা, এ শহরে এখন’—এইরূপ বাক্যবন্ধ স্মৃতিচিহ্নে আচ্ছন্ন এক অতীতকে আবিষ্কার করে, যা বর্তমানের অনুপস্থিতি দ্বারা দগ্ধ। নারীর এই অনুপস্থিত উপস্থাপনা, স্মৃতি-আবিষ্ট বাস্তবতারই অংশ হয়ে দাঁড়ায়।


কাওসার মাসুমের ভোরের বয়ান আধুনিক বাংলা কবিতায় এক অন্তর্মুখী, দার্শনিক, এবং আত্ম-অন্বেষণধর্মী কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করে। কবির ভাষা অভিজাত নয়, তবে চিহ্নময়; তাঁর প্রতীক বাস্তব নয়, তবে বাস্তবতাকে ছাপিয়ে ওঠে। আধুনিক কবিতার বিচিত্র প্রবাহে কাওসার মাসুমের এই গ্রন্থ ‘পথের বিকল্প পথ’ হিসেবে নিজেকে হাজির করে, যেখানে ভোর আসে, তবে তা শুধুই আলো নয়—তীব্র আত্মদহন, সামাজিক বিবমিষা, এবং বিপন্ন ব্যক্তিত্বের রূপও বহন করে। এই কণ্ঠস্বর বাংলা কবিতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যদি পাঠক এর অভ্যন্তরে প্রবেশের সংকল্প রাখেন।


‘ভোরের বয়ান’-এর কবিতাগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, কবি ভাষাকে কেবল বাহন মনে করেননি, বরং সেটিকে আত্মপ্রকাশের অস্তিত্বগত পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করেছেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন শব্দতত্ত্বের পরিপার্শ্ব গঠন করে এক একটি অনুভূতির ইন্দ্রিয়ে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘সিঁড়ি’, ‘রেনুবালা’, ‘বর্গাকার বিড়ম্বনা’—এ ধরনের কবিতার শিরোনাম ও উপস্থাপনায় যে ধ্বনিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিলক্ষিত হয়, তা ভাষা-নির্মাণের ক্ষেত্রে কবির সাহসী মনোভঙ্গিরই পরিচায়ক।


তিনি কখনো গদ্যছন্দের সংলগ্নতা নিয়ে আসেন, কখনো আবার ধ্বনিরূপে শব্দের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে এক অলৌকিক কবিত্বজাল বিস্তার করেন। অলঙ্কারের বাহুল্য পরিহার করে তিনি নির্মাণ করেছেন অনুভব ও ভাষার অন্তর্মিলন। এখানে ভাষা অলঙ্কার নয়, ভাষা-ই ভাব।


কবিতার ভাষা ও গঠনতত্ত্ব সেই অন্তঃস্থ কাঠামো যা একে নিকট থেকে চেনার, অনুভবের, ও মূল্যায়নের সুযোগ দেয়। কাওসার মাসুমের ভোরের বয়ান কাব্যগ্রন্থ পাঠকের কাছে শুধুমাত্র বক্তব্য বা বিষয়প্রবাহ নয়, এক নতুন ভাষা-আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা হিসেবেও হাজির হয়। গ্রন্থটি বাংলা কবিতায় এমন এক কণ্ঠস্বর রচনা করে যা অন্তর্মুখী, প্রতীকসমৃদ্ধ, খণ্ডিত অথচ অনিবার্য ভাষার বিস্তার এবং স্তরিত নির্মাণপ্রবণতায় পরিপূর্ণ। এই আলোচনায় আমরা গ্রন্থটির ভাষা ও গঠনতত্ত্ব বিশ্লেষণ করব তিনটি প্রধান স্তরে—ভাষার প্রকৃতি ও কাব্যবিন্যাস, চিত্রকল্প ও প্রতীকায়ন, এবং গঠনগত অভ্যন্তরীণ রূপবিন্যাস।


‘ভোরের বয়ান’-এর ভাষা তত্ত্বগতভাবে ‘নিষ্ক্রান্ত ভাষা’—এমন ভাষা যা নিজেকে বলেই নিজেকে অতিক্রম করতে চায়। এটি পোস্টমডার্ন কাব্যরীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে ভাষা নিজস্ব কাঠামোর মধ্যেই আপেক্ষিকতা সৃষ্টি করে। মাসুমের ভাষা কখনো সম্পূর্ণ, কখনো অসম্পূর্ণ বাক্যে দাঁড়ায়; 

‘চুপচাপ ভাঙে নদী

সাড়া নেই শব্দ নেই

চুপচাপ অপরূপ ক্ষয়!’ — চুপচাপ

এই ভাষা আবেগনির্ভর নয়, বরং প্রতীকনির্ভর, বিমূর্ত ও ধ্বংসপ্রবণ। শব্দের ঐতিহ্যগত গঠন ভেঙে দিয়ে কবি গড়েন এক বিভ্রান্তিময় অথচ আশ্চর্য বোধের জগৎ।


কাওসার মাসুম প্রায়ই বাক্যকে ভেঙে ক্ষুদ্র খণ্ডে পরিণত করেন। তার ফলে বাক্য একা থাকে, অথচ বহুবর্ণ চিন্তার দ্যোতক হয়ে ওঠে। 

‘পড়ে থাকি আমি

প্রত্যাখ্যাত খণ্ডিত প্রস্তর’ — সিঁড়ি

এখানে দ্বিতীয় বাক্যটি শুধুই এক বর্ণনামূলক বাক্য নয়, বরং এক আত্মপরিচয়ের কাব্যিক নির্যাস।


ভোর, নদী, ঘাস—প্রকৃতিপুঞ্জের প্রতীকত্ব ভোরের বয়ানুএর শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট, ‘ভোর’ এখানে শুধু একটি সময় নয়, বরং একটি অবস্থান, চেতনার দিকবদল, ও সম্ভাবনার প্রতীক। কবিতায় বারবার ফিরে আসে ভোরের উপস্থিতি:

‘ভোর এসে খুলে দোর

খালি পায়ে একা চলে যায়’ — ভোরের বয়ান

 

এই ‘ভোর’ এক রহস্যময় অনুপস্থিতির রূপ, যা যেন সমাজ-অভিজ্ঞতার অনভিপ্রেত রূপান্তর। একইভাবে ‘নদী’, ‘ঘাস’, ‘কাশফুল’, ‘শিশির’, ‘ছায়া’—এইসব চিত্র প্রকৃতির নির্জীব নয়, বরং চৈতন্যপূর্ণ প্রতীক। এগুলো দিয়ে কবি নির্মাণ করেন দুঃখ, বিষাদ, এবং বোধিবৃক্ষের দিকে অভিযাত্রা। প্রতীক ও পরাবাস্তব দৃশ্যরচনা কখনো কখনো মাসুম তাঁর কবিতায় দৃশ্য নির্মাণ করেন যা বাস্তবজগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন, অথচ অভ্যন্তরীণ সত্যের প্রতিচ্ছবি:

‘নিরব নরম স্মৃতির মায়ায় ঝাউছায়ায় পাখিটি একা

দমকা হাওয়া

বৃন্তচ্যুত ঝরাপাতা

বজ্রবৃষ্টি’ — অস্ফুট স্ফটিক

এই চিত্রকল্প পরাবাস্তব কাব্যপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত, যেখানে বাস্তব ও অবাস্তবের সংমিশ্রণে এক অন্তর্বয়ান তৈরি হয়। এই কৌশল আত্মবিশ্লেষণ ও অস্তিত্ববাদী চেতনার আধার হিসেবে কাজ করে।


গদ্যছন্দ ও মুক্তকবিতার আধিপত্যে ভোরের বয়ানুএর প্রায় সমস্ত কবিতাই মুক্তকবিতা। প্রচলিত ছন্দ, অন্ত্যমিল কিংবা পঙক্তিগঠনের সংবিধানকে নাকচ করে মাসুম গড়েছেন মুক্ত গঠন, যেখানে পঙক্তি দীর্ঘতর অথবা হঠাৎ খণ্ডিত। এতে সৃ’ি হয় এক ধ্বংসের নান্দনিকতা—যা শুধু ভাবনায় নয়, গঠনে আসে:

‘যা তা প্রলাপ বিলাপ অ-সুর আক্ষেপ

নলখাগড়া কচুরিপানা চিত্রিত মুদ্রিত’ — ভুলের সন্তাপ

এখানে বিষয়বস্তু ও গঠন একইসঙ্গে দুর্বোধ্যতা ও বিমূর্ততায় একাত্ম হয়েছে।


পুনরাবৃত্তির প্রয়োগ একটি উল্লেযোগ্য কৌশল হলো—পুনরাবৃত্তি। বিভিন্ন শব্দ বা চিত্র বারবার ফিরে আসে, যেমন ‘ভোর’, ‘নদী’, ‘রেহানা’, ‘দূরত্ব’, ‘সিঁড়ি’, ‘বৃষ্টি’’, ‘শোক’, ‘নিষেধ’ ইত্যাদি। এই পুনরাবৃত্তি কেবল অলঙ্কারিক নয়, বরং তা পাঠকের ভেতরে একটি কাব্য’র মোহাচ্ছন্ন গঠন করে।


উদাহরণস্বরূপ ‘রেহানা’ একাধিক কবিতায় (যেমন: রোদ র‌্যালি, ল্যান্ডস্কেপে মোড়া ভোর) দেখা যায়—সে এক ব্যক্তি না হয়ে ওঠে এক কল্পপ্রতিমা, যা স্মৃতি ও অবসাদকে প্রতিনিধিত্ব করে।


গদ্য-সংলগ্ন কিছু কবিতা প্রায় গদ্য-কবিতার আকারে রচিত। যেমন আত্মহত্যার আমলনামা, দুই জানুয়ারি: মা, কিংবা তেরো নভেম্বর: বাবা। এগুলোতে ছন্দ নেই, আছে অবিরাম বাক্যধারা ও ভাষার কনফেশনাল প্রবাহ। এটি পাঠকের কাছে আত্মপ্রকাশের ঘনত্ব বাড়ায় এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা তৈরি করে।


অন্তর্মুখী গঠন ও ধ্বংসের নান্দনিকতায় ভোরের বয়ানুএ ‘গঠন’ কথাটি শুধুই ছন্দ বা ছন্দভঙ্গ নয়; বরং কবিতার ধ্যানমগ্ন প্রবাহ, অবসাদের বিন্যাস, এবং দার্শনিক বোধের বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি কবিতা যেন একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে নিজেকে জোড়া লাগানোর প্রয়াস।


কবি বারবার আত্মানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যান, যেমন: ‘আকাশ আমাকে মিথ্যেটুকু ছাড়া কিছুই দিলো না’ — পাথর। এই বাক্যটি গঠনে সরল, অথচ এক দার্শনিক টান রয়েছে, যা গঠনের গূঢ় স্তর হিসেবে কাজ করে।


শব্দচয়নের একান্ততা ও ধ্বনিগত ভাবনাচিন্তা কাওসার মাসুমের শব্দচয়ন দুর্বোধ্য নয়, তবে সাংকেতিক। তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত শব্দভাণ্ডার ভেঙে আনেন এমন সব শব্দ যা একে এক অনন্য ভঙ্গিতে বিশি’ করে তোলে: ‘জারণ-বিজারণ’, ‘সিমেট্রি রোড’, ‘আত্মমগরব’, ‘নিউরোট্রান্সমিটার’, ‘আলাপ প্রপঞ্চ’ ইত্যাদি।


এ ধরনের শব্দ ব্যবহারে বাংলা কবিতায় প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান, জৈব-সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার স্পর্শ এসে যায়, যা ইঙ্গিত করে কবির এক বহুমাত্রিক গঠনভাবনা।


ভোরের বয়ানুএর ভাষা ও গঠনতত্ত্ব একাধারে বিমূর্ত ও দৃশ্যমান, আড়ালিত এবং স্প’। কাওসার মাসুম কবিতার পরিসরে যে গঠন নির্মাণ করেছেন তা বাংলা আধুনিক কবিতার বহমান স্রোতের মধ্যে ব্যতিক্রমী। তাঁর কবিতায় ভাষা শুধুই বাহন নয়, নিজেই হয়ে ওঠে বার্তা—যেখানে প্রতীক, পুনরাবৃত্তি, গদ্য-কবিতার সীমান্ত, এবং অলংকারবর্জিত নির্মোহতা মিলেমিশে এক বহুবাচনিক, স্তরিত, এবং প্রলেপবিহীন কাব্যভাষা তৈরি করে।


এই কাব্যভাষা, এই গঠন—শুধু পাঠ নয়, পাঠকের আত্মমগ্নতারও এক অন্তরালে অভিযান।


থিম্যাটিক বিন্যাস ও অন্তর্গত দর্শন এই কাব্যগ্রন্থে একাধিক থিম সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়েছে:

১. আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বচিন্তা: কবির কবিতায় একটি অনিবার্য অন্বেষা কাজ করে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘আমি কে?’ এই প্রশ্ন। ‘রেনুবালা’ কিংবা ‘রোদ র‌্যালি’ কবিতায় স্পষ্ট এই চেতনা—জীবন কোনো নির্মিত বাস্তবতা নয়, বরং বহুমাত্রিক বিভ্রম।

 

২. স্মৃতি ও প্রেম: ‘নদী’, ‘পাথর বিশ্বাস’—এই কবিতাগুলোতে প্রেম এসেছে এক গভীর সংবেদনশীলতায়, যা কেবল আবেগ নয়, এক প্রকার আত্মার সহাবস্থান।

 

৩. নাগরিক বিপন্নতা ও সময়বোধ: ‘বাড়ি’,  ‘নদীর নির্মাণ’ ইত্যাদি কবিতায় নাগরিক যন্ত্রণা ও অস্তিত্বের ভারে নুয়ে পড়া এক কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয়েছে। কবি যেন বলছেন—নগর আমাদের গিলে খায়, তবুও আমরা বেঁচে থাকি, কবিতা লিখি।

 

৪. রাজনীতি ও প্রতিবাদ: কোথাও কোথাও কবি প্রতিবাদী, তবে স্লোগানে নয়, অন্তরশব্দে। ‘বর্গাকার বিড়ম্বনা’ বা ‘আগস্ট’ কবিতায় ব্যক্তিগত বিষাদের আড়ালে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতা উন্মোচিত হয়েছে।

 

ভোরের বয়ানের একটি অন্যতম শক্তি এর রচনাশৈলী। কাওসার মাসুম নিরীক্ষাধর্মী আঙ্গিকে অনন্য। তিনি প্রচলিত গঠন ভেঙে দিয়েছেন, নির্মাণ করেছেন এক ব্যক্তিগত ভাষা। প্রতিটি কবিতায় শব্দের বিন্যাস, লাইনের ছাঁদ, শিরোনামের ভঙ্গি কিংবা অব্যবহৃত চিহ্নাবলীর ব্যবহার—সব কিছুতেই একটি বিপরীতধর্মী মেজাজ বর্তমান।


তিনি কখনো প্রচলিত নান্দনিকতাকে বিদ্রুপ করেন, আবার কখনো তার রীতিকেই ভেঙে নতুন গঠনে পৌঁছে দেন। এই ভাঙচুর নিছক স্টাইল নয়, বরং কবির ভাবনার কৌশল।


এই গ্রন্থের কবিতাগুলোর মধ্যে কিছু উৎসর্গপত্র, প্রারম্ভিক বিবৃতি ও গদ্যভাষ্য রয়েছে, যা গ্রন্থটিকে একটি বহুবর্ণ ও বহুস্বরিক পাঠ্যবস্তুর রূপ দেয়। এসব অংশ পাঠককে কবিতার বাইরের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে সাহায্য করে।


কবিতার উৎসর্গ, বিন্যাস এবং গদ্যাংশ—এই তিনটি উপাদান অনেক সময় অবহেলিত হয়, অথচ একটি কাব্যগ্রন্থের আভ্যন্তরীণ সংগঠন ও নান্দনিক বোধ নির্ধারণে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। কাওসার মাসুমের ভোরের বয়ান কাব্যগ্রন্থে এই তিনটি দিক অত্যন্ত চিন্তাপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। উৎসর্গ-কবিতাগুলোর আবেগঘন প্রেক্ষাপট, কবিতার সার্বিক বিন্যাসগত গঠন এবং মধ্যবর্তী গদ্যাংশসমূহের আত্মজৈবনিক, দর্শনগত, ও সামাজিক পাঠ—সমস্তই একে কেবল কবিতার সংকলন নয়, বরং একটি সামগ্রিক সাহিত্যিক দলিলরূপে প্রতিষ্ঠা করেছে।


এই আলোচনায় আমরা ধারাবাহিকভাবে তিনটি দিক বিশ্লেষণ করব: উৎসর্গ-সম্পর্ক, কবিতাগুলোর বিন্যাস ও বৌদ্ধিক ক্রম, এবং অন্তর্ভুক্ত গদ্যাংশগুলোর প্রকৃতি ও তাৎপর্য।


ভোরের বয়ানুএর একটি বিশেষ বৈশি’্য হলো এর শেষভাগে অন্তর্ভুক্ত ‘উৎসর্গসমূহ’—যা আসলে আত্মজৈবনিক গদ্য-কবিতার রূপে রচিত কবিতা। এগুলো সরাসরি নির্দি’ ব্যক্তিদের নামে উৎসর্গকৃত—যেমন: ঋষি এস্তেবান, সরদার ফারুক, বেনজীর আহম্মদ টিপু, কামরুল হুদা পথিক, সৈয়দ আব্দুস সাদিক, রশীদ হারুণ প্রমুখ।


এই উৎসর্গগুলোর ভাষা আবেগঘন, নিরাবরণ, ও দার্শনিক সুরভিত। কিন্তু এগুলো নিছক শোক-গাথা নয়—বরং তীব্র আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপ্রতিক্রিয়ার ঘোষণা। উদাহরণস্বরূপ: ‘ঋষি এস্তেবান! ওস্তাদ, বাঁচাতে পারবে না, মানে ছাড়া এই বেঁচেবর্তে থাকা।’ — আত্মহত্যার আমলনামা। এখানে একটি অস্তিত্ববাদী হতাশা কাজ করছে, যা ব্যক্তিগত স্মৃতিকে কেবল শোক নয়, এক দার্শনিক ভাষ্যে রূপান্তর করে।


উৎসর্গে কাব্য ও গদ্য-ভঙ্গির সংমিশ্রণে এই লেখাগুলোতে গদ্য ও পদ্য ভঙ্গির মিশ্রণ দেখা যায়। কখনো দীর্ঘ বাক্য, কখনো খণ্ডিত লাইন, কখনো বক্তার ভেতরের ক্ষোভ-আক্ষেপ-কবিত্ব একাকার হয়ে যায়। এতে উৎসর্গিত ব্যক্তিটি হয়ে ওঠেন কবির আত্মস্বরের প্রতিবিম্ব।


উৎসর্গের অন্তর্নিহিত টোনে কখনো কখনো এইসব উৎসর্গে বারবার ফিরে আসে আত্মহত্যা, বেঁচে থাকার অবসাদ, সামাজিক নিঃসঙ্গতা, এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া। ফলে এগুলো কোনো একক ব্যক্তির উদ্দেশে নয়, বরং এক প্রজন্মের প্রতি আত্মদর্শনের নিবেদন।


সূচিপত্র ও ধারাবাহিকতায় গ্রন্থের সূচিপত্রে মোট ৫৪টিরও অধিক কবিতা সন্নিবেশিত, যা সূক্ষ্মভাবে বিভাজিত হয়নি অধ্যায়ে, কিন্তু কিছু কিছু বিন্যাসগত প্যাটার্ন দৃশ্যমান:


প্রথম পর্যায়: ‘ভোরের বয়ান’ থেকে ‘নদী’—প্রকৃতি ও অস্তিত্বচেতনার এক সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ।

দ্বিতীয় পর্যায়: ‘আত্মহত্যার আমলনামা’ থেকে ‘নীরবতা’—একটি আত্মসমালোচনামূলক, মৃত্যুমগ্ন, আত্মবীক্ষণী কাব্যপ্রবাহ।

তৃতীয় পর্যায়: ‘আগস্ট’, ‘বৃ’ির বিউগল’, ‘নদী মধুমতি’—রাজনৈতিক ইতিহাস ও ব্যক্তিগত শোকের সম্মিলন।

চতুর্থ পর্যায়: উৎসর্গসমূহ—গদ্যধর্মী এবং আত্ম-আখ্যানমূলক কাব্যপ্রবাহ।

 

কবিতাগুলোর ক্রমে লক্ষ্য করা যায় শব্দ ও প্রতীকের পুনরাবৃত্তি ও পর্যায়ক্রমিক বিকাশ। যেমন ‘ভোর’ প্রথম কবিতায় যেমন দেখা যায়, পরবর্তী কবিতাগুলোতেও বিভিন্নভাবে ‘ভোর’, ‘নদী’, ‘শিশির’, ‘দূরত্ব’ ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু প্রতিবারই ভিন্ন অনুভবে—কখনো বিশ্বাসঘাতক, কখনো আশার অনুপস্থিত প্রতিশ্রুতি। 


যদিও গ্রন্থটি কবিতার, তবুও এর বিন্যাসে রয়েছে উপন্যাসিক পরিপ্রেক্ষিত—শুরুর কবিতা পাঠককে নিয়ে যায় এক প্রত্যাশিত ভোরে, মধ্যভাগে আসে বিপন্নতা, আত্মহনন প্রবণতা, সামাজিক অস্থিরতা, এবং শেষে আত্মানুসন্ধান ও শোকস্মারকের অন্বয়। ভোরের বয়ানুএ গদ্যাংশ রয়েছে তিনটি মূল রূপে: উৎসর্গনামা (যা উপরে বিশ্লেষিত), আত্মচরিতধর্মী কবিতা: যেমন আত্মচরিত, যাইনি, স্মৃতিচিহ্ন ও নির্ভরযোগ্য আত্মপ্রতিকৃতি।


কাওসার মাসুমের গদ্যাংশও কাব্যিক। তাঁর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ সবকিছুই গদ্যের কাঠামোয় থেকেও কাব্যের শক্তিকে ধারণ করে: ‘চিনিনি। চাষাভুষা বেশভূষা। ঠিকানা পাইনি। ঠাটবাট শিখিনি। নির্লোভ তৃণজীবি।’ — যাইনি


এখানে প্রতিটি বাক্য ছোট, ছিন্ন, অথচ উচ্চারণে প্রবল আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংবেদনের নির্যাস। এই অংশগুলোতে উঠে আসে মধ্যবিত্তের অবসাদ, শৈশব স্মৃতি, শহুরে নিঃসঙ্গতা, এবং আত্মপরিচয়ের সংকট। ‘যাইনি’, ‘দুই জানুয়ারি: মা’, ‘তেরো নভেম্বর: বাবা’—এসব গদ্যাংশ পারিবারিক আবহে রচিত হলেও তা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি প্রজন্মের অন্ধকার যৌথস্মৃতি।


ভোরের বয়ান কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ, কবিতার বিন্যাস এবং অন্তর্ভুক্ত গদ্যাংশগুলো কেবল ঐচ্ছিক সংযোজন নয়, বরং কাব্যিক নির্মাণের মূল ভিত্তি। এই তিন উপাদানের সম্মিলনে কাওসার মাসুম তৈরি করেছেন এক অভ্যন্তরীণ কাব্যবিশ্ব—যেখানে আত্মজৈবনিক শোক, সমকালীন হতাশা, এবং শৈল্পিক পরিমার্জনার এক ঘন সত্তা একত্রে অবস্থান করে। উৎসর্গগুলো কবির চিন্তার গভীরতা ও সহমর্মিতার পরিধি প্রসারিত করে; কবিতার বিন্যাস পাঠে গতি, ধ্বনি, ও অর্থের প্রবাহ নির্ধারণ করে; এবং গদ্যাংশগুলো কাব্যগ্রন্থটিকে আত্মপ্রতিকৃতির এক রচনাপত্রে রূপ দেয়। 


এই তিন উপাদান ছাড়া ভোরের বয়ান কেবল কবিতার সংকলন হতো—তবে এই নির্মাণেই তা হয়ে উঠেছে একটি আত্মবিশ্লেষণমুখী, সাংস্কৃতিক আত্মজিজ্ঞাসার সাহিত্যিক নথি।


কাওসার মাসুম যে উত্তরাধিকার বহন করছেন তা দ্বিমুখী—একদিকে বাংলা সাহিত্যের মহান ঐতিহ্য, অপরদিকে নাগরিক কবিতার উত্তরাধুনিক চেতনা। তিনি এই দুই ধারাকে সমন্বিত করেছেন এক অন্তর্মুখী গীতিধারায়।


তার কবিতায় কোথাও কোথাও জীবনানন্দের প্রভাব, নগরপটভূমিতে শক্তির ছায়া বা আবুল হাসানের আত্মস্বীকার দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু কাওসার মাসুম তাদের অনুকরণ করেননি। বরং তাদের পাঠ থেকে নিজেকে আলাদা করে তিনি নিজস্ব এক শৈলী নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন।


সাহিত্য কখনোই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না; প্রতিটি কবি আগের কবিদের কোনো না কোনোভাবে ধারণ করেন—কখনো অনুসরণে, কখনো প্রতিক্রিয়ায়, আবার কখনো ভাঙনের মধ্য দিয়ে নিজস্বতা নির্মাণে। কাওসার মাসুমের ভোরের বয়ান কাব্যগ্রন্থ এই ধারাবাহিকতা ও বিচ্যুতির সৃষ্টিশীল দ্বৈততায় নিজেকে স্থাপন করেছে। তাঁর কবিতা বাংলা আধুনিক কবিতার এক গভীর রূপান্তরের অনুরণন, যেখানে পূর্বসূরি কবিদের দর্শন, ভাষা ও আঙ্গিকিক চর্চার ছায়া আছে, আবার রয়েছে এক স্বতন্ত্র ও নিরীক্ষাপ্রবণ ভিন্নতা।


এই আলোচনায় আমরা অনুসন্ধান করব—কীভাবে মাসুম বাংলা কবিতার সাহিত্যিক উত্তরাধিকার বহন করেছেন, এবং কীভাবে তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে তার থেকে সরে গিয়ে একটি নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন।


জীবনানন্দ দাশের উত্তরসূরিতা ও অন্ত্যমনস্কতা: বাংলা আধুনিক কবিতার প্রেক্ষাপটে কাওসার মাসুমের সবচেয়ে সুস্প’ উত্তরসূরি মনে হয় জীবনানন্দ দাশকে। মাসুমের কবিতায় প্রকৃতি ও অস্তিত্ব, সময় ও স্মৃতি, নিঃসঙ্গতা ও মৃত্যুবোধ, এবং চিত্রকল্পের ধীর অথচ অমোঘ প্রবাহে যে কবিত্ব জন্ম নেয়, তা জীবনানন্দের কবিসত্তার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে।


জীবনানন্দ যেমন তাঁর কবিতায় প্রকৃতিকে সময়ের উত্থান-পতনের সজীব রূপ হিসেবে দেখেছেন, মাসুমও তেমন ‘ভোর’, ‘ঘাস’, ‘ঝাউপাতা’, ‘শিশির’, ‘কাশফুল’ ইত্যাদি উপমায় গড়ে তোলেন এক অন্তর্মুখী, অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি। উদাহরণস্বরূপ: ‘ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির ফোঁটায় ফোঁটায়’ — ভোরের বয়ান । এখানে জীবনানন্দীয় প্রকৃতিসচেতনতা বিদ্যমান, তবে মাসুম তা প্রয়োগ করেন গভীরতর অস্তিত্বগত সংকটের ভাষা হিসেবে।


জীবনানন্দের কবিতায় অতীত প্রায়শ নস্টালজিয়া হয়ে ওঠে, অথচ বর্তমান ছায়ায়াচ্ছন্ন। মাসুমের ‘রেহানা’ নামের প্রতীক বা ‘তেরো নভেম্বর: বাবা’, ‘দুই জানুয়ারি: মা’ কবিতাগুলো এই অতীতঘন বিষাদ ও অভাবিত অনুপস্থিতির কাব্যিক সংজ্ঞায়ন। তবে মাসুমের স্মৃতি কোনো রোমান্টিক বেদনা নয়, বরং ট্রমা ও বাস্তবতাবিরোধী এক প্রতিধ্বনি।


শঙ্খ ঘোষ, আবুল হাসান ও নিরঙ্কুশ বাস্তবতায় কাওসার মাসুমের কবিতায় সংবেদনশীলতা যেমন সূক্ষ্ম, তেমনি রয়েছে প্রতিবাদী মনন—যা তাঁকে শঙ্খ ঘোষ ও আবুল হাসানের সঙ্গে সংযোগ করে। ভাষার তীব্রতা ও রাজনৈতিক উপলদ্ধিতে শঙ্খ ঘোষের কবিতার রাজনৈতিক চেতনা ছিল শৈল্পিক, রূপকধর্মী ও নৈতিক। কাওসার মাসুম সেই ধারার উত্তরাধিকার বহন করলেও তার কণ্ঠস্বর আরও তীক্ষ্ণ, দুর্বিনীত এবং প্রায় দ্রোহাত্মক: ‘তোমাদের রাজনীতি’—এই কবিতায় তিনি দেবদারুর নিধনকে দেখেন রাষ্ট্রীয় নির্লজ্জতার নিদর্শন হিসেবে। এই রাজনৈতিক ভাষ্য শঙ্খ ঘোষের শ্লীলতার তুলনায় অনেক বেশি প্রান্তিক ও ছিন্নভাষিক, অনেকটা আবুল হাসানের ‘‘আমি বিষণ্ণ হে রাষ্ট্র” উচ্চারণের ঘরানায়।


আত্মবিনাশ ও বিষণ্নতার কাব্যরীতির বিশ্লিষনে আবুল হাসানের কবিতা যেমন আত্মবিনাশ ও মৃত্যুপ্রেমে আকুল ছিল, মাসুমও বারবার ‘মৃত্যু’, ‘আত্মহত্যা’, ‘নৈঃশব্দ্য’ ও ‘অতল’ ইত্যাদি প্রতীকের মধ্য দিয়ে আত্মচিহ্ন মুছে ফেলার এক আকুতি তৈরি করেন। ‘ঘুম, আহ!/ বড় সাধ ছিলো দীর্ঘ জনম ঘুমিয়ে যাবো মেঘের ছায়ায়।’ — পাথর। এটি আত্মবিস্মৃতির শৈল্পিক আবেদন, যা আবুল হাসানের ‘বিষণ্ণ’ আত্মা থেকে জন্ম নেয় কিন্তু কাওসার মাসুমের হাতে আরও জৈবিক ও ট্রমাটিক রূপ পায়।


হেলাল হাফিজ, নির্মলেন্দু গুণ, ও নাগরিক বাস্তবতায় নির্মলেন্দু গুণ বা হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম ও রাজনীতি সমান্তরালে চলেছে। কাওমার মাসুমের কবিতাতেও ‘রেহানা’ নামটি একদিকে প্রেমিকার স্মৃতি, আবার অন্যদিকে এক ব্যক্তিগত নাগরিক শোকের প্রতীক। প্রেমের এই অন্তরঙ্গতা প্রেম নয়—এ এক ‘প্রিয় কিছু হারানোর দীর্ঘ প্রতীক্ষা’।


নগর ও লিটল ম্যাগ চেতনার সংমিশ্রণে মাসুম নগরবাসী, কিন্তু তাঁর কবিতা নিছক নাগরিক কাব্য নয়। ‘সিমেট্রি রোড’, ‘বৃষ্টির বিউগল’, ‘নিউরোট্রান্সমিটার’—এইসব চিহ্নে নাগরিক ব্যস্ততা ফুটে উঠলেও, কবিতা যেন অনায়াসে ফিরে যায় গ্রামীণ শৈশবে, ‘ডাঙা’, ‘পাথর’, ‘তালপাতা’ আর ‘ঘাস’-এর শৈলীতে। এমন সংমিশ্রণ লিটল ম্যাগ চিন্তার উত্তরাধিকার ধারণ করে।


নিজের পথ নির্মাণের কৌশল ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষা ও ব্যতিক্রমী গঠনে কাওসার মাসুম তাঁর কবিতার ভাষাকে ছন্দের অনুগামী রাখেন না। তিনি প্রায়শই বাক্যকে ভাঙেন, অর্থের শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেন, বা পূর্ণতা এড়িয়ে যান। এতে কবিতায় তৈরি হয় এক প্রকার ভাঙনের নান্দনিকতা—যা তাঁকে আলাদা করে তোলে। কাওসার মাসুমের ভোরের বয়ান একদিকে বাংলা আধুনিক কবিতার গভীরতম শিকড়ে প্রোথিত, অন্যদিকে তার নিজস্ব নিরীক্ষা, ভঙ্গিমা ও আত্মবীক্ষণ তাঁকে ভিন্ন একটি কাব্যভাষার নির্মাতা করে তোলে। তিনি জীবনানন্দের সংবেদনশীলতা, আবুল হাসানের বিষণ্ণতা এবং শঙ্খ ঘোষের সামাজিক চেতনার উত্তরাধিকার বহন করলেও, ভাষা ও নির্মাণে তৈরি করেছেন এক পৃথক আত্মপ্রতিকৃতি—যেখানে প্রেম আছে, কিন্তু অনুপস্থিত; মৃত্যু আছে, কিন্তু নির্লিপ্ত; সময় আছে, কিন্তু বিপরীতগামী। এই দ্বৈততা থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন সমকালীন বাংলা কবিতার এক অন্তর্লীন অথচ গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর।


ভোরের বয়ানের কবিতায় নারী কখনো প্রেমিকা, কখনো মা, আবার কখনো রাষ্ট্র বা প্রতিকী অসীমতা। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এখানে কেবল রোমান্টিক নয়; বরং একটি গভীর শ্রদ্ধাশীলতা ও সমানুভবের প্রকাশ।


ভোরের বয়ান কেবল কাব্যগ্রন্থ নয়; এটি একটি কাব্যিক জার্নাল, একান্ত পরিসরে ব্যক্তিগত এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক। এটি বয়ান, কিন্তু উচ্চারণ নয়; এটি প্রকাশ, কিন্তু চিৎকার নয়।


কাওসার মাসুম যে সাহস নিয়ে ভাষা ও ছন্দের পরীক্ষা করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতাকে নতুন একটি সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। এই গ্রন্থের স্থান বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার অভ্যন্তরে এক স্বাতন্ত্র‍্যসূচক অবস্থানে। এটি পড়ে পাঠক ভাবেন, উপলব্ধি করেন এবং অনেক সময় শব্দের কাছে চুপ করে বসে থাকেন—এটাই একজন কবির সার্থকতা।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages