অন্তর্গত শরীরের ভূমিকায় ঋষি এস্তেবানের ‘গোত্রের শিলালিপি’ পাঠ
কবিতার বইয়ে প্রথাগত ‘ভূমিকা’ পাঠককে প্রস্তুত করে তোলে—একটি মানসিক মানচিত্র দেয়, যেখানে কবির অবস্থান, ভাষার প্রয়োগ, নন্দনের ভাবনা, কিংবা ইতিহাসের অনুবর্তী টানাপোড়েনগুলোর এক ধরণের স্পষ্ট পাঠসূচী পাওয়া যায়। কিন্তু যখন কবিতার ভাষাই হয়ে ওঠে এক নিজস্ব ভূমিকাত্মক প্রক্রিয়া, যখন কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে এক ধ্রুপদী, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকা—তখন সেই কাব্যগ্রন্থের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। ঋষি এস্তেবানের ‘গোত্রের শিলালিপি’ সেই ধরনের এক কবিতাগ্রন্থ—যেখানে আলাদা করে কোনো ‘ভূমিকা’ নেই, কিন্তু পুরো বইটির শরীর জুড়েই এক অন্তর্গত, তীব্র সংবেদনশীল ভূমিকা ক্রমাগত গঠিত হয়েছে। এই অন্তর্গত ভূমিকা পাঠককে শুধুই কবিতার সৌন্দর্যবিলাসে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় না, বরং তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর সময়, বিপন্ন রাজনীতি, ক্ষতচিহ্নিত ইতিহাস এবং সর্বোপরি এক দগ্ধ, কুহকময় জীবনের দিকে, যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের একমাত্র আশ্রয়।
ঋষি এস্তেবান-এর কবিতার ভাষা উচ্চারণে আভিজাত্য বহন করে না—কিন্তু তার আভিজাত্য নিহিত রয়েছে সেই গভীর জৈব উপলব্ধিতে, যা সমকালীনতা, স্মৃতি, দ্রোহ এবং প্রেমকে একই দেহতন্তুর ভেতরে সংযুক্ত করে তোলে। ঋষি এস্তেবানের কবিতায় বুদ্ধি এবং হৃদয়ের দ্বৈত সংগীত বাজে—কখনও তা কণ্ঠে উচ্চারিত নয়, বরং অন্তঃশ্বাসের মতো, যা টের পাওয়া যায় শব্দের ব্যবহারে, স্তবকের গঠনে, চিত্রকল্পের সংহতিতে এবং সবচাইতে বেশি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চারণে।
এই গ্রন্থের অন্তর্গত ভূমিকা নির্মিত হয়েছে এক বহুবর্ণ জটিল বুননে—যেখানে তামারঙ মেয়েটি এক পুনরাবৃত্ত প্রতীক হয়ে হাজির, যিনি কখনও নদী, কখনও প্রেম, কখনও বিপ্লব, কখনও স্মৃতির প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি যেন এক প্রেতাত্মা—কখনও পুরাকাব্যের অপ্সরা, কখনও অরণ্যদেবী আবার কখনও যুদ্ধাহত মানুষের ক্রন্দনের কণ্ঠস্বর। তিনি স্পার্টাকাসের চিহ্ন ধারণ করেন, আবার চিত্রা নদীতে ভেসে যাওয়া মনজিলার আত্মিক আহ্বানেও তার রূপ পাওয়া যায়। এই বহুমাত্রিক প্রতীকের মাধ্যমে কবি পাঠককে শুধু ভাবনায় নয়, ইতিহাস ও শরীরের সজীব চেতনাতেও যুক্ত করেন। ‘তামারঙ মেয়ে তুমি রোদ্দুর ভাঁজ করে তুলে রাখো...’ কিংবা ‘রাতের গল্প’ কবিতায় ‘সে স্বপ্ন বুনেছিলো হাওয়ার ভেতরে আগুন আর জলের/ তামারঙ হাওয়া স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিলো পাথুরে ভূমিতে’—এই আহ্বান দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এবং সেই যাত্রাই হয়ে ওঠে কবিতাগ্রন্থের মৌলিক স্বর ও শরীর।
এই গ্রন্থের কবিতাগুলো সরাসরি কোনো দার্শনিক সিস্টেম বা তাত্ত্বিক পরিভাষা মেনে চলে না, কিন্তু প্রতিটি কবিতার ভেতরেই রয়েছে গভীর দার্শনিক সংকেত। কবির দৃষ্টিভঙ্গি অস্তিত্ববাদী চেতনায় আক্রান্ত, কিন্তু তা নৈরাশ্যের নয়, বরং হাড়ে-হাড়ে লেগে থাকা প্রতিরোধের আত্মায় স্নাত। কবিতার শিরোনাম ‘মানুষ লাইন’ যখন বলে—‘আমি এক ভুল বানানের শব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি লাইন ছাড়া’, তখন কবি তার অস্তিত্ব ও চেতনার ভুলভালতা নিয়েই নতুন এক নৈতিক বিন্যাস রচনা করছেন। এই লাইন—মানুষ লাইন—হল অন্তর্গত ভূমিকার এক নির্মীয়মাণ দেহ, যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে সংগঠন, ভুল বানান হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, এবং কাঁধে বোঝা হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের মুখ।
ঋষি এস্তেবানের কবিতা এক অদ্ভুত দ্বৈততাকে ধারণ করে—প্রেম ও মৃত্যু, স্মৃতি ও ভবিষ্যৎ, ভাষা ও ভাষাহীনতা, ঈশ্বর ও তার শূন্যতা। ‘আমাদের গান’, ‘মরে যাচ্ছে উনুনের গান’, ‘বৃষ্টিতে আমরা’, ‘আত্মহত্যার আগের মুহূর্তে’—এইসব কবিতাগুলোতে কবি নিঃসঙ্গতা ও বিরোধ, জীবন ও হতাশার সংবেদকে সমান্তরালে গেঁথেছেন। তার কবিতায় ধর্মীয় নিদর্শন যেমন ঘনঘন ফিরে আসে (টেম্পল অফ সলোমন, কুমারী মা, যিশু, গসপেল), তেমনি ইতিহাসের লাল রক্তমাখা বাঁকে বাঁকে ফিরে আসে শ্রমিক, বিপ্লব, বিদ্রোহ, ক্ষুধার্ত শরীর। এখানেই গড়ে ওঠে কবির কাব্যিক দর্শন—তিনি বিশ্বাস করেন যে ভাষা, প্রতীক, ইতিহাস এবং প্রেম—সব মিলিয়ে মানুষের আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনের অস্ত্র হতে পারে।
‘গোত্রের শিলালিপি’ নামেই এই কাব্যগ্রন্থ এক অভ্যন্তরীণ চিহ্নগত দৃঢ়তা ঘোষণা করে। ‘শিলালিপি’ ইতিহাসের পাথরে খোদাই করা স্মৃতি—যা মুছে ফেলা যায় না। ‘গোত্র’ শুধু বংশগত পরিচয় নয়, বরং এক সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সমষ্টি। ফলে এই কাব্যগ্রন্থ, নাম থেকেই, ঘোষণা দেয় যে এটি কোনো একক সত্তার অভিজ্ঞান নয়, বরং সমবেত যন্ত্রণার, দ্রোহের, স্মৃতির ও স্বপ্নের খোদাই। এই খোদাই, এই শিলালিপি—কখনও ট্র্যাজেডির চিহ্ন, কখনও প্রতিরোধের চিৎকার। সেই চিৎকারে ‘ছোট কাগজ’-এর বর্ণনা আসে—যেখানে দোকান আর বাড়ির পার্থক্য ঘুচে যায়, শরীরও এক মালমাল পণ্য, অথচ ঘুঙুর পড়ে করুণার নর্তকী জেগে ওঠে। সেখানেই কবিতাগ্রন্থের অন্তর্গত ভূমিকা তার সবচাইতে স্পষ্ট দ্যোতনাটি প্রদান করে—এই কাব্য কেবল ভাষার জন্য নয়, বরং স্বপ্ন-স্মৃতি-সত্তার পুনরুদ্ধারের জন্য লেখা।
এই অন্তর্গত ভূমিকা কখনও ভাষায় উচ্চারিত নয়, বরং চিত্রকল্পে গাঁথা—যেমন ‘ঘাসফুলের গান’ কবিতায় তিনটি খরগোশ, এক শেয়াল ও এক সাদা নেকড়ে—এরা যেন সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার উপাখ্যান; কিন্তু এই রাজনৈতিক উপমা কখনও সরল বামপন্থার প্রচারপত্রে পর্যবসিত হয় না, বরং এক ঐন্দ্রজালিক, শীতল স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে সেই দংশন পাঠকের আত্মায় ঢুকে পড়ে। ‘আর কোথায় শান্তির শাদা কাছিম ভ্যাটিকানের পোপ’, ‘আসলে সব মার্কিন বিড়াল, ধর্মের নামাবলি গায়’, ‘ঢোলক বাজায় শান্তি-শান্তি ওম’— যখন মৃতপ্রায় প্রজন্মের চোখে ঘুরে বেড়ান, তখন বুঝে নিতে হয়—এই কবি ইতিহাসের পাশাপাশি মিথ-রাজনীতিকেও নতুন করে লিখছেন, এবং এই পুনর্লিখনই তার অন্তর্গত ভূমিকার মহত্তম প্রয়াস।
এই গ্রন্থের অন্তর্গত ভূমিকা শুধু কাব্যিক উচ্চারণে নয়, তার কাঠামোতেও গাঁথা। এই বইয়ের কবিতাগুলোর বিন্যাস, শিরোনামের পুনরাবৃত্তি, কিছু শব্দ ও প্রতীকের বারংবার আগমন—সবই এক কৌশলময় বিনির্মাণ। পাঠক এই গ্রন্থে প্রবেশ করে এক ধরনের মন্ত্রোচ্চারণের ভেতর দিয়ে, এবং ক্রমে, সেই মন্ত্র—যা বিদ্রোহের, যা আত্মদর্শনের, যা সমবেত মানবতার, তা হয়ে ওঠে বইটির ভেতরের ভূমিকা—যার প্রয়োজন নেই কোনো ভূমিকালেখকের, কারণ কবিতা নিজেই নিজের পুরোহিত।
ঋষি এস্তেবানের ‘গোত্রের শিলালিপি’ বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিরল গ্রন্থ—যার ভূমিকা কোনো একটি পৃষ্ঠায় লেখা নেই, বরং গ্রন্থটির প্রতিটি পৃষ্ঠার হাড়-মাংসে তা গেঁথে আছে। এই অন্তর্গত ভূমিকা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে কবিতা যদি সত্যিই তাড়িত হয় ইতিহাস, রক্ত এবং প্রেমের চেতনায়—তবে তার ভূমিকা কখনও লেখা হয় না, বরং জন্মায়। এই ভূমিকা জন্ম নিয়েছে এ গ্রন্থে, এবং আমাদের চিন্তাজগতে তা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবে।
স্মৃতির রাজনীতি ও প্রতিরোধের ব্যাকণে সাম্রাজ্যবাদ-নিগৃহীত ইতিহাসের প্রতিফলন
ঋষি এস্তেবানের ‘গোত্রের শিলালিপি’ কাব্যগ্রন্থটি শুধু ‘করাতকল’ থেকে প্রকাশিত একটি কবিতার গ্রন্থই নয়—বরং এটি এক সংবেদী ঐতিহাসিক দৃষ্টি, এক অন্তর্দাহগ্রস্ত আত্মার জার্নাল, যেখানে ইতিহাস তার প্রাতিষ্ঠানিক মুখোশ খুলে ফেলেছে এবং নগ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে শোষণ, প্রতারিত স্মৃতি, আর অপরিচিত কান্নার প্রতিধ্বনি হয়ে। এখানে ইতিহাস কোনো বিজয়ীর ঘোষণা নয়, বরং তার ছিটকে পড়া ছায়া—নামহীন সেই সব মানুষের রক্তাক্ত পায়ের ছাপ, যাদের জীবন সাম্রাজ্যবাদের রণতরীতে বেয়ে বয়ে গেছে অব্যক্ত শোক এবং অদৃশ্য যন্ত্রণার দিকে। ঋষি এস্তেবানের কবিতাগুলো পাঠ করলে মনে হয়, তিনি যেন এক জাতিস্মর: তিনি দেখেছেন, ভুগেছেন, বহন করেছেন ইতিহাসের প্রতিটি খুঁটি—কখনো গোলামজাহাজের অন্ধকার গুহায়, কখনো খনিশ্রমিকের ভাঙা নখে, আবার কখনো ধর্ষিতা নারীর নাকফুলের অভাববোধে।
সাম্রাজ্যবাদ-নিগৃহীত ইতিহাস বলতে আমরা শুধু ভূখণ্ডের দখল বুঝি না, বোঝা উচিত সেই জৈব ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসের দীর্ঘ সময়কাল—যেখানে একটি গোত্র, একটি জনতা, এমনকি একটি ভাষাও নেমে যায় অন্ধকারে, হারিয়ে ফেলে নিজেদের ইতিহাস বলার অধিকার। এস্তেবানের কবিতা এই অধিকার পুনরুদ্ধারের এক নীরব অথচ নির্ভুল সংগ্রাম। ‘ভোরের গল্প’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে এই ইতিহাস এক অন্ধকার নৌবহরের চিত্র হয়ে ফুটে ওঠে—যেখানে ‘শেকল বাধা কালো-বাদামি-তামাটে মানুষ’ প্রার্থনা করে পাহাড় ও অরণ্যের দেবতার কাছে, যেন এই অনন্ত রাত বিদীর্ণ করে এখনই ভোর আসুক। এখানে ‘ভোর’ কেবল একটি দিনবদলের রূপক নয়—এটি হল স্বাধীনতার, আত্মপরিচয়ের, মানসিক মুক্তির এক প্রতীক, যা বহুবর্ষব্যাপী শাসনের ও শোষণের বিরুদ্ধে এক দ্রোহী উচ্চারণ।
কবিতার একাধিক স্তরে ঋষি এস্তেবান ‘শোষিত ইতিহাস’ ধারণ করেছেন এমন এক ভাষায়, যা কখনও করুণ, কখনও তীক্ষ্ণ, আবার কখনও সংযমী শ্লেষে ভরপুর। ‘ছোট কাগজ’ কবিতাটি একটি প্রতীকী পটভূমি, যেখানে শাসনব্যবস্থার নীলনক্সা ও মানবদেহের পণ্যায়ন পাশাপাশি চলে—‘শরীরও দোকান বটে’—এই উচ্চারণ শুধু সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক বৃত্তান্ত নয়, বরং এই সময়ের এক অন্তরগভীর বিকার, যেখানে আত্মাও মুদ্রায় বিনিমেয়। এইসব কবিতা—‘বন্যা’, ‘প্রিয় নাকফুল’, ‘আত্মহত্যার আগের মুহূর্তে’—তাদের মধ্য দিয়ে কবি এক ঐতিহাসিক নৈতিকতা গড়ে তোলেন, যেখানে প্রশ্ন আসে, ‘কারা কাঁদে—আর কেনইবা, বন্ধ খাদ্যগুদামের বাইরে?’ এই প্রশ্ন কোনো উত্তরের প্রত্যাশায় জন্মায় না, বরং প্রতিটি নীরব পাঠকের কাছে এক অন্তর্গত রুদ্ধশ্বাস অভিঘাতের অনুরণন সৃষ্টি করে।
‘প্রিয় নাকফুল’ নামক কবিতাটি এই গ্রন্থের মধ্যে এক উচ্চমাত্রিক ইতিহাসবোধে পর্যবসিত হয়। সেখানে রাজাকার ক্যাম্পে ধর্ষিতা মনজিলার আত্মিক স্মৃতি ‘নাকফুল’-এর অনুপস্থিতিতে প্রতিভাত হয়। সাম্রাজ্যবাদ কেবল বিদেশি শক্তির নয়—এই কবিতায় সে স্থানীয় ছায়া-প্রভুরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এস্তেবান বুঝিয়ে দেন যে ইতিহাস শুধু ‘পলাশী থেকে প্যারিস’ নয়, ‘হবখালি থেকে ঘোড়াখালি’র মধ্যেও বাস করে, এবং তা গণ-মননের ভিতরে তামারঙ ক্ষত হয়ে রয়ে যায়। এই ইতিহাস ভাষাহীন হলে, তা আর ইতিহাস নয়—তা অস্তিত্বহীনতায় গলে যাওয়া সময়, যা কবির ভাষার মধ্যে ফিরে আসে ‘স্মৃতির ভরে কুঁজো হয়ে আমরা অপেক্ষা করি / কোনো শোকহরা সংগীতের...’
ঋষি এস্তেবানের কবিতা ইতিহাসকে কোনো ক্যাননের ভাষায় বলেন না—তিনি ইতিহাসকে আহ্বান করেন শবযাত্রার গান, শেকলে বাঁধা থুথু, জ্বলন্ত ফসলের গন্ধ দিয়ে। ‘যুদ্ধ’ কবিতায় একটি প্রশ্ন উঠে আসে—‘আমরা কি জিতেছি?’ নদী উত্তর দেয় ‘না’, অরণ্য বলে ‘না’, ক্ষেত-গান-মাটি—সবাই বলে ‘না’। এবং তখন কবি বুঝিয়ে দেন, যে পরাজয় ও বিজয়ের বাইরের যে অব্যক্ত, ধূসর অঞ্চল—সেটাই আমাদের সময়, সেটাই আমাদের সত্য, সেটাই কবিতার ভূমি। এই ইতিহাস কোনো পাঠ্যপুস্তকের নয়, বরং কবরের গায়ে জন্মানো ঘাসফুলের, রেললাইনের পাশে জমে থাকা স্বপ্নের, অথবা ফেলে আসা নৌকার কিলবিল শব্দের মধ্যে নিহিত।
এস্তেবানের কবিতা সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প ব্যাখ্যা নয়, বরং তার নৈঃশব্দ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা শব্দের শরীর। ‘ঘাসফুলের গান’ কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের সাম্রাজ্যবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির এক সংহত রূপ, যেখানে ‘ধর্মের নামাবলি গায় মার্কিন বিড়াল’—এই স্যাটায়ার শুধু রসিকতা নয়, এটি একটি গভীর ঐতিহাসিক উপলব্ধি, যা ব্যঙ্গের মুখোশ পরে আবিষ্কার করে শোষণের মুখ। এখানেই কবি স্পষ্ট করে জানান যে ‘আমরা শতাব্দির তলদেশ আগাম খুঁড়ে / দেখতে পাচ্ছি আগামীর ফুল ও ফসল’—এ যেন কবিতার মাধ্যমে ইতিহাসের পুনরুদ্ধার, আর একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের আহ্বান।
এইভাবে, ‘গোত্রের শিলালিপি’ আমাদের সামনে এক সাম্রাজ্যবাদ-নিগৃহীত ইতিহাসের নিরাবরণ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। কবিতাগুলো কোনো মনোগ্রাফ নয়, তবু তারা একেকটি স্বাক্ষরচিহ্ন, একেকটি শিলালিপি হয়ে ইতিহাসের তলায়-তলায় জমা হওয়া শোক ও স্বপ্নের কোলাহল থেকে জন্ম নেয়। ঋষি এস্তেবানের কবিতা এই ইতিহাসকে রোমান্টিসাইজ করে না, বরং তা পাঠকের চোখে তামারঙ ক্ষতচিহ্নের মতো ফুটে ওঠে—প্রতিটি পঙ্ক্তি যেন ইতিহাসের মুদ্রালিপি, যার উচ্চারণে লুকিয়ে থাকে একটি গোত্রের, একটি জনতার, একটি ভাষার অনুচ্চারিত গান। এই গান—যা স্বীকৃতির জন্য নয়, বরং পুনর্গঠনের জন্য; স্মৃতির জাদুঘরের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের জীবন্ত মঞ্চের জন্য। এখানেই এস্তেবানের কবিতা আমাদের ইতিহাসচর্চার সামনে এক নতুন দৃষ্টিকোণ খুলে দেয়—যেখানে ভাষা ও ইতিহাস, স্মৃতি ও প্রতিরোধ, প্রেম ও সাম্য এক অভ্যন্তরীণ চেতনায় মিলেমিশে তৈরি করে এক সম্পূর্ণ মানবিক ব্যাকরণ।
ভাঙা বর্ণমালায় উচ্চারিত জনতার গানে বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর
ঋষি এস্তেবানের গোত্রের শিলালিপি কাব্যগ্রন্থ সমকালীন বাংলা কবিতার শরীরে এক দগ্ধ শিলালিপির মতো এসে দাঁড়িয়েছে—এমন এক কবিতার নৈঃশব্দ যা চিৎকার হয়ে উঠতে চায়, এবং এমন এক চিৎকার যা ভেতরে-ভেতরে নিঃসঙ্গ অথচ দুর্দমনীয় জনতার মুখ হয়ে উঠতে চায়। এই গ্রন্থে কোনো জনপদের নাম নেই, নেই কোনো ঘোষিত ইস্তেহার, নেই কনভেনশনাল শ্রেণি-বিশ্লেষণ; কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিংবা বলা ভালো, সে কারণেই, এই কবিতাগুচ্ছ হয়ে উঠেছে এক অনাহূত, অথচ অপরিহার্য জনমানুষের আত্মপ্রকাশের স্পেস। এস্তেবানের কবিতা শাসকের ভাষায় কথা বলে না—তবে সেই ভাষার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী ছন্দের জন্ম দেয়, যা প্রতিটি বঞ্চিত, প্রান্তিক, অদৃশ্যমান মানুষের কণ্ঠে এক উচ্চারণযোগ্য প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি স্তবক যেন কোনো এক হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠের জবানবন্দি। সেই কণ্ঠ নির্ধারিত শ্রেণির নয়, নিদিষ্ট ভূগোলের নয়, কিন্তু তার মধ্যেই আছে নদীতীরের মৃতপ্রায় মা, শ্রমজীবী বাবা, বর্ষাতিগ্রস্ত শরীর, ছোট ছেলেটির ‘মা-মা-মা’ ডাক। ‘বাড়ি’ কবিতায় আমরা দেখি ছেলেটির কান্না আর বাবার ব্যাকুলতা—একটি ক্ষুদ্র পারিবারিক ঘটনাবলি, অথচ তার অন্তর্নিহিত শূন্যতা যেন গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ছিন্ন অথচ টেকসই প্রতিচ্ছবি। এই মা-অনুপস্থিতি কেবল ব্যক্তিগত নয়—এটি রা’্রহীনতা, আশ্রয়হীনতা, পরিচয়হীনতা, এমনকি ভাষাহীনতার গভীর ব্যঞ্জনায় প্রতীক হয়ে ওঠে।
কবি জানেন, ‘বঞ্চিত’ শব্দটি একটি রাষ্ট্রিয় পরিভাষা নয়—বরং এটি একটি বোধ, যা জন্মায় ক্রমাগত অস্বীকৃতি, অদৃশ্যায়ন, ও পিছু হঠিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে। ‘মানুষ লাইন’ কবিতায় যখন তিনি বলেন—‘নগরটা এক খোলা খাতা / লাইনটানা মানুষ, লাইন টানা শব্দ দিয়ে ভরা / তার ভেতরে আমি এক ভুল বানানের শব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি লাইন ছাড়া’—তখন কবি একটি আত্মসত্তার আত্মপৃথকীকরণ চিহ্নিত করছেন। ‘ভুল বানান’—এই অভাব বা বিকৃতি হয়ে ওঠে একটি পরিপূর্ণ প্রতিবাদী চিহ্ন, একটি রাজনৈতিক অবস্থান, যা নিজেকে ভাষার নিখুঁততা থেকে ছিন্ন করে, শুধু নয়—নতুন ভাষার দাবি তোলে, যেখানে জনমানুষের অপমান, ক্ষুধা, ও অদৃশ্য অস্তিত্ব প্রতিধ্বনিত হতে পারে।
‘বন্যা’ নামক কবিতাটি বঞ্চিত মানুষের আর্থিক, রাজনৈতিক ও শ্রেণিগত বিলুপ্তির ইতিহাসকে একটি ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্যপট হিসেবে তুলে ধরে। সেখানে ‘বহু-বহু গর্ভবতী ধানক্ষেত খুন হলো বৃষ্টি বাতাসের এনকাউন্টারে’—এই বাক্যটি একটি প্রকৃতির ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় হিংসার ভাষা। যেসব মানুষের নাম নেই, কণ্ঠ নেই, গৃহ নেই—তাদের পক্ষে কবি দাঁড়ান না, তিনি তাদের হয়ে কথা বলেন। অথচ তার ভাষায় নেই প্রচলিত ‘মার্ক্সীয়’ উত্তেজনা, নেই চেনা লড়াইয়ের ব্যাকরণ। তার ভাষা দারিদ্র্যরে নয়, বরং অসহায়তার অভিজ্ঞান; তার শব্দভাণ্ডার রাজপথের বুলেটবিদ্ধ ঘোষণা নয়, বরং গুম হয়ে যাওয়া রক্তের মৃদু উদ্ধতা।
‘প্রিয় নাকফুল’ কিংবা ‘ঘাসফুলের গান’ুএই কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে এস্তেবান এমন এক কাব্যিক কৌশল নির্মাণ করেন, যা শোক ও স্বপ্ন, অভিশাপ ও আশীর্বাদ, পরাজয় ও সম্ভাবনার জটিল দ্বৈরথে বেঁধে ফেলে জনতার ইতিহাস। এখানে একটি খরগোশ যখন ‘জাতীয় সংগীত’ গায়, তখন তা নিছক কৌতুক নয়, বরং এক তীব্র তিরস্কার—কোনো এক সময় যারা বাঁচার জন্য গান গেয়েছিল, তারা আজ তাদের শিকারীর নামে গাইছে উৎসবের গীত। এ এক সাংস্কৃতিক আত্মঘাত, যার জবাব কবি উচ্চারণ করেন এই বইয়ের পরতে পরতে—প্রতিবাদ না করে নয়, বরং ইতিহাসের নৈঃশব্দ্যেই দ্রোহ গেঁথে দিয়ে।
এই বইয়ের ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো—সে মুখোশ পরেনি। তা আভিজাত্যহীন নয়, বরং অন্যরকম অভিজাত। শব্দের নির্মাণে আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ, এবং চিত্রকল্পে আছে দৈনন্দিনতার জাদু। ‘যাত্রী ছাউনি’ কবিতায় মধ্যরাতের চা, সঙ্গ, কিংবা নিজস্ব নিঃসঙ্গতা—এইসব অনুচ্চারিত বাস্তবতা এক বঞ্চিত শ্রেণির যাপনচিত্র। তারা কোনো রোমান্টিক শ্রেণি-চরিত্র নয়, বরং সমকালের কর্কশ শহরের মৃদু সুরে ক্ষয়ে যেতে থাকা মানুষ—যাদের উচ্চারণই ইতিহাসের বিকল্প ভাষ্য।
‘গোত্রের শিলালিপি’ শুধুমাত্র বঞ্চিত মানুষের কথা বলছে না—এটি তাদের কণ্ঠ, যার কাছে ভাষার নিজস্ব কাঠামো পর্যন্ত সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। ‘আমরা গুঙ্গিয়েছি / পূর্বপুরুষের হাড়ে-হাড় বাজিয়ে’—এই ঘোষণার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গোপন অতীত, যা ধ্বংসের মধ্যেও সংগীতকে আশ্রয় দিয়েছে। এই সংগীত কোনো ব্রাহ্মণিক রাগ নয়—এটি শোষিতের হাঁপানি, কৃষকের মাটি চিবিয়ে বেঁচে থাকার ভাষা, কিংবা অনাহারী শিশুর দীর্ঘশ্বাসের ছন্দ। এই সব শব্দ, স্তবক ও ভাবনা—সব মিলিয়ে গড়ে তোলে এমন এক কাব্যভাষা, যা আত্মীয় হয় না রাষ্ট্রীয় শুদ্ধতার, কিন্তু আত্মীয় হয়ে ওঠে বঞ্চিত মানুষের একান্ত উচ্চারণের।
শেষ পর্যন্ত, গোত্রের শিলালিপি একটি কাব্যগ্রন্থ মাত্র নয়—এটি এক সমষ্টির কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়ায়। তার কবিতা চিৎকার করে না, তবে ঘুম ভেঙে দেয়। এই ঘুম থেকে উঠে কেউ যদি নিজেকে খুঁজে না পায় রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রে, জনপদের মানচিত্রে, কিংবা ইতিহাসের পাঠ্যে—তবে তারা বুঝে যাবে, ঋষি এস্তেবানের কবিতাগুলো আসলে তাদের হয়ে লেখা। এই কবিতা স্বীকৃতি দেয় না, বরং সত্তা দেয়। এই সত্তা এক অদৃশ্য বহুতর তরঙ্গ, যা আমাদের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ, ভালোবাসা, শোক ও পুনর্গঠনের তৃ‘াকে ভাষা দেয় এবং সেই ভাষার নামই ‘বঞ্চিত জনমানুষের কণ্ঠস্বর’।
ভাষার ভাঙনে উচ্চারণের বিদ্রোহ এবং ছন্দ ও ভাষার পুনর্গঠন
বাংলা কবিতা দীর্ঘদিন ধরেই ভাষা ও ছন্দের শৃঙ্খলার ভেতর এক ধরণের অলৌকিক স্থিতি খুঁজে এসেছে। আধুনিকতার বিস্ফোরণোত্তর কাব্যেও ছন্দভঙ্গিও ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক সংগঠিত রীতিনিষ্ঠ বোধ, যেখানে ভাষার প্রবাহ ছিল শৈল্পিক, কিন্তু অনেক সময়েই তা আর্তনাদের ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। ঋষি এস্তেবানের গোত্রের শিলালিপি এই প্রবাহের মধ্যে এসে যেন আচমকাই এক ব্যত্যয় সৃষ্টি করে। এখানে ভাষা আর শুধু সৌন্দর্যের বাহন নয়—এখানে ভাষা হল জবানবন্দি, ছিন্ন উচ্চারণ, পথ হারানো মানুষের আর্ত শব্দ, অথবা এমনকি ভুল বানানের একটি স্তবক। এস্তেবানের কবিতা আমাদের এমন এক অনভ্যস্ত উচ্চারণে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে চেনা ছন্দ ভেঙে পড়ে, আর তার ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে আসে এক নতুন ভাষার সম্ভাবনা—যা নিছক কবিতা নয়, বরং এক সামাজিক অনুশীলন, এক মানসিক শরণার্থী শিবির।
এই কবির কাছে ভাষা কোনো গঠিত কাঠামো নয়—বরং ভাঙনের ক্ষেত্র। ‘মানুষ লাইন’ কবিতায় যে উচ্চারণ আমরা পাই—‘নগরটা এক খোলা খাতা / লাইনটানা মানুষ, লাইন টানা শব্দ দিয়ে ভরা / তার ভেতরে আমি এক ভুল বানানের শব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি লাইন ছাড়া’—সেখানে ‘ভুল বানান’ হয়ে ওঠে চেনা ভাষার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক সজীব প্রতিবাদ। এখানে কাব্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং ভাষার কাঠামোতেই অন্তর্গত রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা নিহিত। ঋষিএস্তেবানের কবিতা উচ্চারণের নিরীক্ষায় প্রবল সাহসী। তাঁর কবিতায় বাক্য অসম্পূর্ণ, ভাবের টানাপোড়েন রয়েছে, গদ্যলিখন, ছন্দহীনতা, হঠাৎ সংলাপ, হঠাৎ নিঃশব্দতা—সব মিলে গড়ে তোলে এমন একটি ভাষাভুবন, যা ভাষার আদিম চরিত্রের দিকে ফিরে যায়।
এই কাব্যগ্রন্থে ছন্দ কোনো একক অক্ষরের সংগীত নয়, বরং সমবেত গুঞ্জনের নিরবিচ্ছিন্ন বিস্তার। ‘ভ্রমণবিদ্যা’, ‘বৃষ্টি’, কিংবা ‘ফাগুনের বৃষ্টি’ কবিতাগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়, এই কবিতা শব্দের দৃশ্য নির্মাণ করতে চায় না, বরং শব্দের মধ্যে গন্ধ, ঘাম, চিৎকার, নিরবতা—সব কিছু মিশিয়ে এমন একটি আভ্যন্তরীণ ছন্দ নির্মাণ করতে চায় যা বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে বাজে। এই ছন্দ কোনো মাত্রাবৃত্ত নয়, এটি সময়ের ধুকপুকানি। যেমন ‘ঘাসফুলের গান’-এ কবি যখন বলেন, ‘শান্ত জলের গভীরে থাকে ঘূর্ণিঝড়ের ভ্রূণ’—এই বাক্য শুধু একটি চিত্র নয়, এটি একটি ছন্দ, একটি হুমকির মতো ধীরে ধীরে ঘনীভূত হওয়া শব্দ-ভয়, যা চেনা কাব্যভাষার বাইরেই বিস্ফোরিত হয়।
ঋষি এস্তেবানের কবিতার ভাষায় এমন বহু সংজ্ঞা পাওয়া যায় যা প্রচলিত কাব্যবোধ থেকে ভিন্ন। ‘তামারঙ মেয়ে’ তার এক প্রতীক, যার মধ্য দিয়ে ভাষার এক নারীবাদী, সাংস্কৃতিক ও প্রতিরোধী অভিজ্ঞান জন্ম নেয়। তাকে ঘিরে যেমন চিত্রকল্প নির্মিত হয়—‘তুমি রোদ্দুর ভাঁজ করে তুলে রাখো’, অথবা ‘তার আঙুলে সুর’—এই সব বাক্য চেনা অলংকার নয়, বরং ভাষার অনুভব-অভ্যন্তরের এক অপরিচিত নান্দনিকতা। এ ভাষা উজ্জ্বল নয়, বরং সজল; এই ভাষা শব্দের মাধ্যমে নয়, শব্দের আড়ালে উচ্চারিত হয়।
এস্তেবানের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য, যা তাকে ভাষার পরীক্ষক করে তোলে, তা হলো তার স্বীকারোক্তির ঢঙ। কবিতা জুড়ে একটা সচেতন সাবলীলতা দেখা যায়, যেখানে কবি জানেন যে ভাষা কখনও সম্পূর্ণ নয়, কখনও যথে’ নয়। তাই কখনও তিনি বলেন—‘আমি যারে গুরু মানি সে আমারে কয় অনাদি গুসাই’, কখনও বলেন—‘সবাই আগে যেতে চায়, আমিও, কিন্তু কার আগে / আমার আগে যে, সেও তো আমি।’ এই আত্মবিভ্রান্তিমূলক ভাষা কাব্যিক শুদ্ধতার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়—কেননা কবির বিশ্বাস, শুদ্ধতা মানেই এক ধরণের দখল। তিনি সেই দখলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভাষার নতুন বিন্যাস, নতুন গতি, এমনকি নতুন ব্যাকরণ নির্মাণ করতে চান।
এস্তেবানের ভাষা আভিজাত্যহীন নয়, কিন্তু তা কোনো আনুষ্ঠানিক সাহিত্যিক অনুশীলন থেকে আসেনি। তার ভাষা আসে পথ থেকে, শ্রমের ঘাম থেকে, দুঃখের ঘ্রাণ থেকে। ‘ছোট কাগজ’ কবিতায় তিনি লেখেন—‘তবুও নীরবতা চূর্ণ করে কালো নর্তকীর পায়ে বেজে ওঠে তুমুল ঘুঙুর’—এই শব্দচয়নে এক অলৌকিক অভিঘাত রয়েছে, যেখানে 'নীরবতা চূর্ণ' হওয়া মানে শুধু বাকপ্রতিষ্ঠা নয়, বরং ক্ষমতার কাঠামোতে একটি ছিদ্র। এই ঘুঙুরের শব্দ আসলে ভাষার নতুন ছন্দ, যা পুরনো বর্ণমালাকে চূর্ণ করে নতুন উচ্চারণের জনপদ তৈরি করে।
সুতরাং, গোত্রের শিলালিপি কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ নয়—এটি এক ভাষাগত অস্থিরতা ও পুনর্গঠনের প্রকল্প। এখানে চেনা ছন্দ ভেঙে যায়, ভাষা তার ব্যবহৃত অঙ্গসৌষ্ঠব হারায়, আর সেই ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে জন্ম নেয় নতুন উচ্চারণ—যা ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক; যা শিল্প নয়, অস্তিত্ব। ঋষি এস্তেবানের কবিতা বুঝিয়ে দেয়, যে কবিতা সত্যিই বাঁচতে চায়, তাকে ভাষার বাইরে যেতে হবে—ভাঙতে হবে ছন্দ, প্রশ্ন তুলতে হবে ব্যাকরণে, উচ্চারণে, উচ্চারণহীনতায়। এবং সেই ভাঙনই হবে ভবিষ্যতের কণ্ঠস্বর। এমন উচ্চারণই কেবল আমাদের আজকের সময়কে পাঠ করতে সক্ষম, যেখানে পুরনো ভাষায় শুধু শোকের অনুবাদ হয়, কিন্তু নতুন ভাষায় জন্ম নিতে পারে এক বিপ্লবী, সংবেদনশীল ও সংহত ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যতের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে গোত্রের শিলালিপি—ভাষাহীনদের ভাষা, ছন্দহীনদের সংগীত, এবং কবিতার ভবিষ্যতের এক পূর্বাভাস।
প্রেম, মৃত্যু ও বিদ্রোহী নৈতিকতায় কাব্যিক বোধের বিপ্লব
ঋষি এস্তেবানের গোত্রের শিলালিপি কাব্যগ্রন্থটি এমন এক কাব্যপ্রবাহ, যেখানে প্রেম, মৃত্যু ও জীবন দর্শন কেবল কাব্যিক বিষয় নয়—তারা একত্রে গড়ে তোলে এক আত্মদ্রোহী, রাজনৈতিক ও নৈতিক বাস্তবতা। এস্তেবানের কবিতা আমাদের নিছক রোমান্টিক ভালোবাসা কিংবা অস্তিত্ববাদী বেদনার বৃত্তে আটকে রাখে না। বরং কবিতার প্রতিটি অনুচ্ছেদে, প্রতিটি প্রতীকে, এমনকি প্রতিটি স্তবকে প্রকাশ পায় একটি গভীর নৈতিক চিন্তা, যা জন্ম নিয়েছে প্রেম ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতা থেকে, এবং যা শেষপর্যন্ত এক বিদ্রোহী কাব্যবোধে রূপান্তরিত হয়।
প্রেম, এই কাব্যগ্রন্থে, কোনো সংবেদনশীল আবেগের রোমান্টিক অনুষঙ্গ নয়; বরং তা এক নিঃস্ব, বিপন্ন, এবং প্রায়শই নিষিদ্ধ অভিজ্ঞতা। ‘নাকফুলের মায়া’ কবিতায় আমরা পাই এক শুদ্ধ অথচ বিপন্ন প্রেমের অভিজ্ঞান—‘চুমু নিষেধ এ শহরে, ভালোবাসা পাপ / হা’ঘরের জন্য কোনো আড়াল নেই’—এই উচ্চারণ কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক শুদ্ধতার নামে চলা রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর রাজনৈতিক কবিতা। এই নিষেধাজ্ঞা ও পাপবোধের ভেতরেই গড়ে ওঠে এক বিকল্প নৈতিক বোধ, যেখানে প্রেমই হল মানুষের প্রতিরোধের ভাষা।
মৃত্যু, এ কবিতায়, শুধু একটি জীবনের অবসান নয়—বরং একটি ন্যায়হীনতার ফলাফল, একটি সমাজতাত্ত্বিক পরিণতি, এমনকি একটি দার্শনিক প্রশ্ন। ‘আত্মহত্যার আগের মুহূর্তে’ কবিতায় যে ব্যক্তি দেয়ালের ফাঁটল দিয়ে আলো দেখছে, তার চারপাশে ঘুরছে ‘তৃপ্ত পুরোহিত’, ‘তামারঙ মেয়ের বিন্দু অশ্রু’, ‘বহু-বহু নটিক্যাল মাইল নির্জনতায় জেগে থাকা একাকিত্ব’—এইসব উপাদানগুলোকে একত্রে দেখলে বোঝা যায়, কবির কাছে মৃত্যু হলো এক নৈতিক প্রশ্নের কেন্দ্র: ‘কে কাঁদে আর কেনই-বা, বন্ধ খাদ্যগুদামের বাইরে?’—এই একটি প্রশ্ন যেন কবিতাটির হৃদয়বিন্দু, যেখানে কবি জীবনের অবসানকে নৈতিক অবিচারের বিচারে দাঁড় করান।
এই প্রেম ও মৃত্যু বারবার এসে মিলিত হয় জীবনের এক বিকল্প দর্শনের সঙ্গে। এখানে জীবন মানে নিছক শ্বাস-প্রশ্বাস নয়—এখানে জীবন হল শ্রেণিকাঠামোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা নৈতিক দ্বন্দ্বের একটি সক্রিয় মঞ্চ। ‘মরে যাচ্ছে উনুনের গান’ কবিতায় বলা হয়—‘যার মরা একা-একাই মরতে হবে, বাঁচাও সেমত’—এই বাক্যটি নিছক বর্ণনা নয়, এটি একটি উপসংহার, যেখানে কবি ঘোষণা করেন, যে সমাজে সহমরণ নেই, যেখানে দুঃখ সমবায় নয়, সেই সমাজে জীবন ও মৃত্যু উভয়ই একা একা ঘটে। এই একাকিত্বের বিপরীতে যে সংগীত, যে প্রেম, যে মায়া—তাই হয়ে ওঠে কবির মূল অস্ত্র।
এই অস্ত্র, অর্থাৎ কাব্য, এখানে আত্মরক্ষার ভাষা নয়, বরং এক নৈতিক বিপ্লবের হাতিয়ার। কবিতাগুলোতে বারবার উঠে আসে মৃত্যুপথযাত্রী এক অস্তিত্বের সুর—যেখানে নিহত হয় পাখিরা, নিশ্চিহ্ন হয় নদী, আর ‘নির্বাচিত হয় মহাসমারোহে’ সেইসব প্রতিক্রিয়াশীল প্রতীক, যারা আমাদের চিহ্নিত করে নীরবে। কিন্তু এই নিরবতার মধ্যেই কবির উচ্চারণ জন্ম নেয়। তাঁর নৈতিকতা আসে না কোনো বিধানে, বরং তা গড়ে ওঠে প্রেমিকের আর্তনাদে, বিপন্ন নারীর নিরব প্রতিরোধে, ক্ষুধার্ত সন্তানের নীরব চাহনিতে।
প্রেম, মৃত্যু, ও জীবনের এই অন্তঃসারভূত পরস্পর সম্পর্ক ‘ক্ষণ ও প্রেমে’ কবিতায় এক মহৎ দার্শনিক উচ্চারণ পায়—‘নদী উপাসক বাংলার চেনাপথ-রথ-জল যাত্রা শেষে / যেখানে আসার কথা ছিলো সেখানেই আসা হলো’—এই বক্তব্যে জীবন একটি উদ্দেশ্য নয়, বরং একটি স্বীকারোক্তি, এবং সেই স্বীকারোক্তির মধ্যে কবি যে মূল্যবোধকে রচনা করেন, তা তথাকথিত ধার্মিক শুদ্ধতা বা আধ্যাত্মিকতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বরং তার নৈতিকতা জাগে বিদ্রোহে, প্রণয়ে, এবং অন্তর্জগতে ছড়িয়ে থাকা ক্ষতের রক্তস্রোতে।
এই কাব্যগ্রন্থে তাই প্রেম কখনো বাঁচায়, আবার মৃত্যুও মুমূর্ষু প্রেমকে উচ্চারিত করে। ‘বৃষ্টিতে আমরা’ কবিতার শেষ স্তবকে কবি বলেন—‘আমরা পাশাপাশি বসে থাকি / অথচ আমরা পাশাপাশি থাকি না’—এই ব্যাখ্যাহীন বোধ এক নিঃসঙ্গ প্রেমের উপলব্ধি নয়, বরং সমগ্র মানব সভ্যতার ভেতরকার আত্মবিচ্ছিন্নতার প্রতীক। এটি এক জীবনের দর্শন—যেখানে পাশাপাশি থাকা মানেই আত্মিক সংযোগ নয়, বরং একটি অন্তর্গত ব্যবচ্ছেদ—যা শুধুমাত্র প্রেম ও মৃত্যুই একসঙ্গে এনে মিটিয়ে দিতে পারে।
ঋষি এস্তেবানের কবিতা যে বিদ্রোহী নৈতিক কাব্যবোধ নির্মাণ করে, তা জন্ম নেয় প্রেমের প্রতীক, মৃত্যুর আর্তি এবং জীবনের প্রতি এক বেদনাদীর্ণ সহমর্মিতা থেকে। এই কাব্যিক বোধ কোনো দার্শনিক তত্ত্বের অনুবাদ নয়, বরং অভিজ্ঞতালব্ধ এক চিন্তা, যা ভাষা ও উপলব্ধির ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। এই চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ—প্রতিনিয়ত বঞ্চিত, অপমানিত, একাকী মানুষ, যার পাশে দাঁড়ায় না রাষ্ট্র, ধর্ম বা ইতিহাস—কিন্তু দাঁড়ায় কবিতা। এবং সেই কবিতা, প্রেম, মৃত্যু ও জীবনের অন্বয়ে যে নৈতিকতা গড়ে তোলে, তার নামই গোত্রের শিলালিপি—এক অদৃশ্য গোত্রের পক্ষ থেকে লেখা এক বিদ্রোহী দলিল।
কবিতার শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ এক বিপন্ন চেতনা
ঋষি এস্তেবানের গোত্রের শিলালিপি কাব্যগ্রন্থ কোনো একক অভিজ্ঞতার স্বরলিপি নয়; এটি এক বহুরৈখিক, বহুস্তরীয়, বহুবিধ অর্থবহ কাব্যিক গুহাচিত্র, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি স্তবক এবং প্রতিটি স্তব আসলে একটি ভিন্ন গোত্রের যন্ত্রণার চিহ্ন, এক একটি নিঃশব্দ প্রতিবাদের কঙ্কাল, অথবা এমনকি প্রজন্মান্তরের দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা এক গণচেতনামূলক কাব্য-আখ্যান। ঋষি এস্তেবানের কবিতা একটি দিক থেকে ঐতিহাসিক, আবার অপর দিক থেকে সমকালীন, কখনও ব্যক্তি, আবার সর্বদা সমষ্টির প্রতিনিধি; এবং তার সবচেয়ে মৌলিক সৃজনক্ষমতা নিহিত রয়েছে এই দ্বৈত ও দ্বন্দ্বময় অবস্থানের মধ্যে, যা তাকে কেবল কবি নয়—একজন দার্শনিক, নৈতিক নিরীক্ষক ও ভাষার পুনর্গঠক করে তোলে।
এই গ্রন্থের অন্তর্গত ভূমিকাটি কোনো প্রচলিত মুখবন্ধ নয়—বরং কবিতার শরীরেই এক গভীর আত্মপ্রকাশের ধারা হিসেবে প্রবাহিত। ভাষা এখানে তথ্যের বাহক নয়, বরং ভাষা নিজেই হয়ে ওঠে ইতিহাসের সমান্তরাল শরীর, যেখানে রক্ত ঝরে, যেখানে স্বপ্ন থরথর করে কাঁপে এবং যেখানে মৃত নামগুলোর প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে জীবনের দহনে সক্রিয়। ‘ভুল বানানের শব্দ’ হোক কিংবা ‘তামারঙ মেয়ের শরীরী আযান’, ‘ভোর চাইতে থাকা সন্তানের হাত’ হোক অথবা ‘নামহীন শহীদের নামতা’—প্রতিটি অনুষঙ্গেই কবি গড়ে তুলেছেন এমন এক কাব্যিক নৈতিকতা, যা ভাষার সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে তৈরি করেছে এক নীরব অথচ শ্বাস-প্রশ্বাসে মোড়ানো দ্রোহের অঞ্চল।
ঋষি এস্তেবান চেনা ছন্দ ও ভাষার নির্মাণ ভেঙেছেন, কিন্তু তা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নয়—বরং নতুন এক উচ্চারণযোগ্য মানবিক সত্যের খোঁজে। তার কাব্যিক ভাঙচুর কোনো ভাষাবিনাশ নয়, বরং ভাষার পুনরুদ্ধার, যেখানে শব্দগুলির মধ্যে আবার ফিরে আসে সেই মানুষের কণ্ঠস্বর, যাকে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পাণ্ডিত্য—সবই একযোগে অদৃশ্য করে দিতে চেয়েছে। তার কবিতায় আমরা দেখি ইতিহাসের বিজয়গাথা নয়, বরং পরাজিত মানুষের স্বপ্ন ও স্মৃতির নতুন ব্যাকরণ; দেখি এমন প্রেম, যা প্রতিপক্ষ; দেখি এমন মৃত্যু, যা জীবনের অনুপস্থিতিকে অনুবাদ করে; এবং দেখি এমন জীবনদর্শন, যা প্রচলিত যুক্তি ও ধর্মতত্ত্বকে অতিক্রম করে স্পর্শ করে শুদ্ধ অনুভবের গভীরতম অঞ্চল।
এই কাব্যগ্রন্থে বারবার ফিরে আসে বঞ্চিত, নিগৃহীত, নিঃস্ব জনমানুষের কণ্ঠস্বর—যারা ভাষাহীন, নামহীন, ঠাঁইহীন। ঋষি এস্তেবান সেই কণ্ঠগুলোকে শ্রুতিযোগ্য করে তোলেন না কোনও শ্রেণি-আত্মশ্লাঘার ভাষায়, বরং তাদের কণ্ঠকে তিনি শব্দের ভেতরে আত্মস্থ করে তোলেন, যেন তারা নিজেরাই ভাষা হয়ে উঠতে পারে। এই কবিতা কাউকে কেবল বোঝাতে চায় না—এই কবিতা জ্বালিয়ে দিতে চায় এক নিঃশব্দ অরণ্য, যাতে নতুন বৃক্ষ, নতুন পাখি, নতুন ভাষা জন্ম নিতে পারে। এই শিলালিপিতে খোদিত থাকে প্রেম, মৃত্যু ও দ্রোহের প্রতিটি সংজ্ঞা—যার ভেতর দিয়ে তৈরি হয় এক বিদ্রোহী নৈতিকতা, যা ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক; তা রাজনৈতিক নয়, মানবিক; তা আধুনিক নয়, অনন্ত।
গোত্রের শিলালিপি এই অর্থে এক আত্মিক ও সাংস্কৃতিক নথি, যেখানে ব্যক্তিগত শোক সমবেত অভিজ্ঞতায় পরিণত হয় এবং প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে এক প্রতিরোধের প্রস্তাবনা। এটি কোনো ছায়াসঙ্গীত নয়—এটি এক নির্দিষ্ট তীব্রতা, যেখানে শব্দ গর্জে উঠে বলে, ‘আমার আগে যে সেও তো আমি’, কিংবা ‘শ্রদ্ধেয় গুরু বলে তুমি অনাদি গুসাই’—এইসব উচ্চারণে ধরা পড়ে এক জীবনের চূড়ান্ত বিস্ময়, এক মানুষের চূড়ান্ত বোধ এবং এক কবির চূড়ান্ত ঋজুতা।
এই সব মিলিয়ে, গোত্রের শিলালিপি শুধু বাংলা কবিতার একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস নয়—এটি বাংলা চেতনার এক নতুন ভূমিকা। এই কাব্যগ্রন্থ আমাদের সাহিত্যে যুক্ত করে এক আলগা হয়নি-যাওয়া দাগ, এক তাম্ররঙ স্মৃতি, যা একইসাথে কবিতা, ইতিহাস ও নৈতিক প্রতিরোধের কাব্যচিহ্ন হয়ে আমাদের সামনে বহমান থাকবে—ভবিষ্যতের সমস্ত দুর্যোগে, সমস্ত বিপন্নতায়, সমস্ত নিরবতায়—আমাদেও ভেতরে জেগে থাকবে এক শুদ্ধ ও জটিল কণ্ঠস্বর হয়ে। সেই কণ্ঠস্বরই আজকের বাংলা কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রাপ্তি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন