কবির দুর্বৃত্তায়ন, আত্মবিস্ফোরণ ও নৈঃসঙ্গ্যবাদ || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

কবির দুর্বৃত্তায়ন, আত্মবিস্ফোরণ ও নৈঃসঙ্গ্যবাদ || শাফি সমুদ্র





কবি কোন একক বিষয় না। কবি এক দর্শনের প্রতিক এবং আসন্ন সময় ও চেতনার মূর্ত অবয়ব। এই চেতনা যখনই ইতিহাসের গর্ভে কিংবা সংস্কৃতির প্রবাহে বা জনসত্তার গভীরতম স্তরে আলোড়িত হয় তখনই কবির আগমন ঘটে। কবিকে বোঝার জন্য একক কোনো দার্শনিক কাঠামো যথেষ্ট নয়। তার চরিত্র বহুবিধ, স্তরিত, দ্বান্দ্বিক ও প্রান্তিক। কবি এক ভাষাগত দার্শনিক, সামাজিক ভবিষ্যদ্বক্তা এবং নৈতিক আত্মা, যিনি সময়ের উর্ধ্বে দাঁড়িয়ে যুগের আত্মকথা রচনা করেন।


কবির ঐতিহ্যগত রূপ কখনো একটি জাতির, কখনো একটি সভ্যতার, কখনোবা এক সমগ্র ভাবজগৎ ও নন্দনতত্ত্বের এক ধরনের অবয়ব নির্মাণ করে এসেছে। আদি হোমারিক কবি থেকে শুরু করে বৈদিক ঋষি, সুফি দরবেশ থেকে তন্ময় বাউল, মধ্যযুগের ধর্মভিত্তিক ভাবুকতা থেকে রোমান্টিক বিপ্লবী, সর্বত্রই কবি হয়ে উঠেছেন এক আত্মিক যোগফল। যিনি মনুষ্যচেতনার অতলস্পর্শ জলে নেমে ভাষার অলকানন্দা আবিষ্কার করেছেন। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে কবিকে ঋষি বলা হয়েছে ‘ঋষি দৃষ্টিপ্রাজ্ঞ’। যাঁর দৃষ্টি স্রষ্টার সমতুল্য। যিনি দেখতে পান যা এখনো দেখা হয়নি। ঋগে¦দ-এর মতো প্রাচীন গ্রন্থে কবিকে বলা হয়েছে এমন এক সত্তা যিনি দেবত্ব জ্ঞান ও রহস্য উপলব্ধি করতে সক্ষম। সেখানে কবি এক ঋষিসুলভ জ্ঞানপ্রাপ্ত সত্তা।। ইউরোপীয় ঐতিহ্যে হোরেস, ভার্জিলিয়াস, দান্তে, নিৎসে, বদলেয়ার বা রিলকে সকলেই কবির মধ্যে অতিকায় ভবিষ্যদ্বক্তার ছায়া আঁকেন। বেগবতী মিথে কবি যেন এক উন্মাদ সন্ন্যাসী। যার স্বপ্নে জেগে থাকে জাতির—ভাষার—ভবিতব্যের নিগূঢ় নির্দেশ।


কবি তাই কেবল এক দর্শনচর্চাকারী আত্মা। তার রচনার ভেতর একটি সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা থাকে, যা সাধারণ যুক্তির পরিধি ছাড়িয়ে নৈঃশব্দ্যের তাত্ত্বিক বৃত্ত নির্মাণ করে। কবিতা এই কারণে হয়ে ওঠে একটি তৃতীয় চোখের ভাষা। এই ভাবনার নির্যাসে কবি একমাত্র সেই ব্যক্তি যিনি ভাবকে ভাষায় রূপান্তর করার পবিত্র ব্রত আত্মায় ধারণ করেন।


কবিকে যদি ভাবি তপস্বী হিসেবে, তবে তার তপস্যা শব্দের ভেতর অর্থের ব্যঞ্জনা অন্বেষণ। শব্দ এখানে বস্তুনিষ্ঠ অন্তর্জাগতিক সংকেতমালা হিসেবে বিবেচিত। কবি কেবল রচনা করেন না, তিনি ভাষার মধ্যে স্থাপন করেন আত্মার ক্ষরণ, যন্ত্রণা ও সৌন্দর্যের আলোছায়া। একজন প্রকৃত কবি তাই অতৃপ্তির সাধক। তার কাছে শব্দগুলো হল আত্মার ব্যঞ্জনালিপি। একজন কবি যখন লেখেন, তখন তিনি এক অভ্যন্তরীণ দর্শনের ছায়ায় কাজ করেন। দ্রোহের অলৌকিক ব্যাখ্যায় কবি তার সময়কে ধারণ করেন এবং সময়কেও অতিক্রম করেন। কবিকে কেবল শিল্পী ভাবলে ভুল হবে। তিনি সময়ের আত্মার দ্রষ্টা, যিনি সমাজের ভেতরের স্তরগুলোতে সেই অদৃশ্য সংকেত পড়তে পারেন। যা রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা সমাজবিজ্ঞান ধরতে অক্ষম কিংবা একাডেমিক ধ্যান-ধারণা-জ্ঞানে তা পড়তে পারা অসম্ভব। তাই কবি এক গভীর দর্শনচিন্তার বাহক, যার কাছে সময়ের মৌলিক রূপটি ভাষার চাদরে ঢেকে আছে। কবির কাজ সেই চাদর উন্মোচন করা।


এই কারণেই বিপ্লবের সময়, সংকটের মুহূর্তে, মানবসভ্যতা কবিকে ডাকে। ভøাদিমির মায়াকোভস্কি, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, নাজিম হিকমত, শহীদ কাদরী বা শামসুর রাহমান তাঁদের লেখা যেন কালের মুখপত্র হয়ে ওঠে। তারা সময়কে অনুবাদ করেন ছন্দে, সময়ের ভাষ্য হয়ে ওঠেন কবিতায়। আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে কবিকে শাসন ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধ স্বর ভাবে, তা এই চেতনাদর্শী ভূমিকাই ব্যাখ্যা করে। কবি কোনো কাগুজে নাগরিক নন। তিনি রাষ্ট্রের অতিপাঠক। তার চোখে ইতিহাস এক নরকীয় পুনরাবৃত্তি আর তার ভাষা সেই রক্তাক্ত চেতনার সন্ন্যাস।


আজ যখন কবির এই পৌরাণিক রূপ, ঐতিহ্যিক গাম্ভীর্য ও সমাজ-চেতনার ভূমিকাগুলি ভাঙছে, তখন তা আমাদের শুধু শোকাতুর করে না, তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় এই ভাঙন এক নবভাষ্য রচনার সুযোগ তৈরি করছে। কবিকে এখন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে সে এক অস্তিত্বহীন আত্মার পরিত্যক্ত প্রতিচ্ছবি।


১.

সমাজ কবিকে যেমন সম্মান দেয়ার পাশপাশি একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অঙ্গীকারে বেঁধে ফেলে। এই বেঁধে ফেলা থেকেই জন্ম নেয় কবির পবিত্র মিথ। কবি ইতিহাসের নানা পর্বে সমাজের চেতনার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন একজন আলোকিত পুরোহিত বা শুদ্ধ স্বরের অধিকারী হিসেবে। এই ভূমিকা সাহিত্য বা সংস্কৃতির অন্তঃপ্রবাহে এবং সামগ্রিকভাবে মানব সভ্যতার মূল্যবোধ, স্বপ্ন ও অভিজ্ঞান নির্মাণের ক্ষেত্রেও এক পরমার্থবাদী বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। কবিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই পৌরাণিক চেহারা এই মিথ। আধুনিক পরিপ্রেক্ষিতে কেবল সংস্কৃতির নয় রাজনীতির, রাষ্ট্রচিন্তার এবং নৈতিকতারও অন্তঃসারধর্মী নির্ভরতা প্রকাশ করে। এই মিথ কীভাবে গড়ে উঠল? কে গড়ল এই মিথ? এবং এর অন্তরালের স্বর কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে? এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোই এখনকার সময়ের নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়োজন।


কবিকে নিয়ে যে পবিত্র মিথ তৈরি হয়েছে তার শিকড় মূলত আদিম গোষ্ঠী সমাজের সাধক-কবি রূপেই। সেই সময় কবিতা ছিল দেবতার কৃপা, ঋষির শ্রুতি কিংবা মুর্শীদের বাণী। কবিকে দেখা হতো একধরনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে, নৈঃশব্দ্য ও শব্দের মধ্যে, অসীম ও সসীমের মধ্যে। কবিতা তখন ছিল পূণ্যসংবেদ আর কবি এক আধ্যাত্মিক দূত। এইরূপ মিথের একটি সুস্পষ্ট রূপ আমরা দেখি বৈদিক ঋষিদের মধ্যে। যাঁরা ঋচা’র মাধ্যমে প্রকাশ করেন ঈশ্বরতত্ত্ব। একইভাবে গ্রিক সভ্যতায় হোমার ছিলেন একটি সাংস্কৃতিক পুরাণ। তাঁর মুখের ভাষা ছিল অলিম্পিয়ানদের বার্তা। মধ্যযুগে সুফি কবিরা বিশেষত রুমি বা হাফিজ হয়ে ওঠেন ঈশ্বরের ভাষার ফেরিওয়ালা। যাদের ভাষা প্রেমময়, আবেগময় এবং আত্মার মুক্তির পরাকাষ্ঠা। এই মিথে কবি এক অতিমানবিক ব্যাখ্যাবিদ। যিনি অনুভব করেন যা সাধারণ মানুষ পারে না। এইভাবে কবি হয়ে ওঠে একধরনের আদর্শ মানব, এক সামাজিক ও নৈতিক অবচেতনার কেন্দ্রবিন্দু।


তবে এই মিথ নির্মাণ কেবল নিষ্কলুষ চেতনা থেকে নয়। তাতে রয়েছে রাষ্ট্র, ধর্ম, জাতিসত্তা ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার গভীর ছায়া। যখন কোনো কবি সময়ের চেতনাকে প্রশ্ন করে তখন এই মিথকে ব্যবহার করা হয় তার কণ্ঠ রুদ্ধ করার অস্ত্র হিসেবে। এই মিথ কবিকে গৌরব দেয় অথচ তার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। যখন কবিকে একধরনের আত্মত্যাগী, নির্বিশেষ, মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তখন আসলে তাকে নিষ্ক্রিয় ও নিরীহ করে তোলার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কাজ করে। রাষ্ট্র বা মূলধারার সমাজ কাঠামো চায় এক পবিত্র কবি, কিন্তু সেই সমাজ আবার এক বিপজ্জনক কবি চায় না। এই দ্বৈত মনোভাবই কবি মিথের রাজনৈতিক অন্তঃসার।


আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বিদ্রোহী’ বলে একটি গৌরবময় ছাঁচে ফেলে পবিত্রীকরণ করা হলেও তাঁর সাম্যবাদী ও শ্রেণিসচেতন কবিতাগুলো দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তক ও জনপ্রিয় আলোচনার পরিধি থেকে বাদ রাখা হয়েছে। ‘ভাঙার গান’, ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর’, ‘সাম্যবাদী’ কিংবা ‘মানুষ’—এসব কবিতায় যে রাজনৈতিক অবস্থান তার সঙ্গে আপস না করার যে স্পষ্টতা, সেটি মূলত রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভে অস্বস্তিকর বলেই অদৃশ্য করা হয়েছে। একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘বিশ্বকবি’, ‘মানবতাবাদী’, ‘আদর্শ মনীষী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এক সচেতন প্রয়াস চলেছে অথচ তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কিংবা ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে যে উপনিবেশবিরোধী, শ্রেণিবৈষম্যবিরোধী সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চেতনা রয়েছে, তা প্রায়শই আড়াল করা হয়। অর্থাৎ কবিকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিথ একদিকে জাতীয় গর্ব নির্মাণের উপকরণ অন্যদিকে চিন্তার নিয়ন্ত্রণের প্রাচীন রাষ্ট্রকৌশলের অনুষঙ্গ।


এই প্রবণতা শুধু অতীতের কবিদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও এই মিথ নির্মাণ ও নির্বাচনপ্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল। উদাহরণস্বরূপ রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ যাঁকে ‘বিপ্লবী প্রেমিক কবি’ হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। তাঁর ‘ভালোবাসা তুমি’ জাতীয় আবেগী কবিতাগুলো সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু তাঁর ‘মানুষের মানচিত্র’ বা ‘এইসব মৃত্যুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই’ এর মতো কবিতায় যে রাষ্ট্রবিরোধী ক্ষোভ, রাজনৈতিক প্রশ্ন ও অস্তিত্ববাদী দ্রোহ আছে তা আলোচনা বা পাঠক্রমে ঠাঁই পায়নি। আবার হেলাল হাফিজ তাঁর ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ লাইনটি রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তাঁর কবিতায় যে রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা, রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ ও আশাহত নাগরিক অবস্থান রয়েছে তা সচেতনভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে।


আমাদের জাতীয় কবিকে যেমন ‘বিদ্রোহী’ অভিধায় পবিত্রীকরণ করা হয়েছে, তেমনি আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসেও কিছু কবিকে একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় কিংবা সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভেতরে ঢুকিয়ে নিরাপদ করে তোলার প্রয়াস দেখা যায়। শহীদ কাদরী এবং শামসুর রাহমান এই দু’জনই এর গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। শহীদ কাদরীকে নগরজীবনের কবি, নতুন নাগরিক আধুনিকতার প্রতিনিধি কিংবা স্নায়ুবিক কবিতা-ভাষার প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘কালো বরফ’ কিংবা ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ কবিতাগুলো যে রাজনৈতিক আলোড়ন, শারীরিক-অশরীরিক সত্তার দ্বন্দ্ব, আত্মসংকট ও রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের গভীরতাকে বহন কওে তা পাঠক্রম ও মূলধারার পাঠে প্রায়ই ঘোলাটে করা হয়। শহীদ কাদরীর নিঃসঙ্গতা, আত্মবিরোধিতা কিংবা রাষ্ট্রচ্যুতির অভিজ্ঞতা বিশেষ করে প্রবাস জীবনের প্রেক্ষাপটে যে আত্মিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন রয়েছে তা সচেতনভাবে আড়াল করা হয়েছে। ফলে তাঁর কবিতায় যে রাষ্ট্রনির্মাণের বিপরীতে নাগরিক ভগ্নতা আছে সেটি গৌরবময় বিবরণে জায়গা পায় না।


শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও একধরনের নির্বাচনী চর্চা পরিলক্ষিত। একদিকে তাঁকে ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কবি’, ‘জাগরণের কবি’ হিসেবে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, বিশেষ করে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার কারণে। অথচ তাঁর ‘উপমার জন্য কবিতা’, ‘বন্দী ভবিষ্যৎ’ কিংবা ‘গান্ধার সভা’ কবিতায় যে আত্মগত দ্বন্দ্ব সামরিক শাসন নিয়ে শঙ্কা, ব্যক্তিমানুষের ভীত সত্তা এবং রাষ্ট্রীয় জাঁদরেলতার প্রতি সন্দেহ তা পাঠ্যপুস্তকে বা রাষ্ট্রীয় উদযাপনে সচরাচর অনুপস্থিত। শামসুর রাহমানের কবিতা যখন ‘স্বাধীনতা’র অনুষঙ্গে গৌরবম, তখনই তাঁকে প্রশস্তির নায়ক করা হয়। ‘ তাঁর কবিতা যখন রাষ্ট্র, ধর্ম, সেনা কিংবা সমাজের কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন সেই অংশগুলো তলে ঠেলে দেওয়া হয়। ফলে বোঝা যায় এই দুই কবির ক্ষেত্রেও এমন এক মিথ নির্মাণ হয়েছে, যেখানে তাঁদের কাব্যিক পরিসরের একটি নির্বাচিত খণ্ডটুকু সামনে আনা হয়। আর বাকি অংশটিকে চাপা দেওয়া হয় এবং এই নির্বাচনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। এখানে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির মিলিত প্রয়াস একদিকে কবিকে গৌরবময় প্রতীকে পরিণত করে। অন্যদিকে তাঁর বিপন্নতা, সংশয়, বিক্ষোভ কিংবা নৈতিক প্রতিরোধের ভাষাকে চেপে রেখে একটি ‘নির্বিষ’ কবি তৈরি করে। আর এই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই আমরা কবির পছন্দমতো নির্মিত একটি প্রতিমূর্তিকে পাঠ করি, যা একধরনের সাংস্কৃতিক প্রপাগান্ডার রূপ।


পবিত্র কবি-মিথের ভেতরে একটি পরম নৈতিকতা চাপানো হয়। এই নৈতিকতা যেমন কবিকে সমাজচেতনার দর্পণে পরিণত করে তেমনি তার ভিন্নতা বা বিকারক স্বরকে সন্দেহের চোখে দেখে। কবির উচিত হবে না রাজনীতিতে নামা, যৌনতা নিয়ে লিখা, অশ্লীলতা প্রকাশ করা এইরকম বহু অপ্রকাশিত বিধিনিষেধ মিথের অন্তর্গত। তখন কবি হয়ে পড়েন একরকম মূর্ত প্রতীক যাকে ভাঙা যায় না, অনুভবও করা যায় না।


আধুনিক কবিতা যতই ব্যক্তিক হোক না কেন কবির দিকে সমাজের দৃষ্টিপাত এখনো সেই পুরনো সন্ন্যাসীর কাঠামোয় বাঁধা। যখন কোনো কবি স্বেচ্ছাচারিতা, উন্মত্ততা, বিকার বা আত্মনির্মূলতার দিকে এগোয় তখন সমাজের ভ্রু কুঁচকে ওঠে। অথচ ইতিহাসের প্রায় সব কবিই কখনো না কখনো এই মিথকে ভেঙেছেন। আর্তুর র‌্যাবো থেকে বদলেয়ার, জীবনানন্দ থেকে শামসুর রাহমান সবাই একদিকে এই মিথের ভেতর ছিলেন আবার অন্যদিকে তার ভাঙন ঘটিয়েছেন।


উনিশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত এই মিথ ক্রমাগত ধাক্কা খেতে শুরু করে। বিশ্বযুদ্ধ—উপনিবেশ—মার্কসবাদ—মনোবিশ্লেষণ—অস্তিত্ববাদ—পরাবাস্তববাদ সব মিলিয়ে কবি হয়ে ওঠেন এক ক্ষতচিহ্নিত অস্তিত্ব। কবির মধ্যেই তখন মিথ ও ভাঙনের দ্বৈরথ শুরু হয়। অবসাদ, বিভ্রান্তি, বিকার ও পরাজয়ের ভাষা কবিতার ভেতর ঢুকে পড়ে। পবিত্রতার ধারণা তখন হয়ে ওঠে একটি প্রশ্নবিদ্ধ গির্জা। যার ভেতরে ঈশ্বর নেই শুধু স্তব্ধতা আর বিষণ্নতা থাকে। এইখানে কবি ক্রমাগত নিজের মিথ কে ভাঙছেন আবার নতুন মিথ তৈরির মধ্যেও রয়েছেন।


তবে এই ভাঙনের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে নতুন কবিতা, নতুন কবি। যিনি স্বীকার করেন নিজের অপরিণতি, ক্ষরণ, আত্মবিভাজন। আজকের কবির মিথ এখন সে এক আত্মসমালোচনার রূপান্তর। কবি এখন একা, বিভ্রান্ত এবং সচেতন। হয়তো তার পবিত্রতা নেই, আছে এক জিজ্ঞাসা নৈঃশব্দ্য, যা মিথকে দর্শনের ঘুমঘর থেকে বের করে এনে কবিতার ভেতরে যুক্তির সংকট এবং অস্তিত্বের ক্ষরণ নিয়ে উপস্থিত করে। যে মিথ একদিন কবিকে সমাজের মরমী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, আজ সেই মিথের ভাঙনই কবিকে এক শূন্যতার বুকে ফেলে দিয়েছে। তিনি নির্মাণ করেন সন্দেহ ও আত্মধ্বংসের এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিচ্ছবি। আজকের কবি আর সেই আদি ঋষি বা তপস্বী নন। তিনি সময়ের মধ্যে নিজেকে সন্দেহ করছেন, আত্মনিবিষ্টভাবে ভেঙে পড়ছেন এবং নিজস্ব শৈল্পিক কর্তৃত্বের প্রতি নির্ভরতায় আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন। এর পেছনে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপট।


উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব, বিংশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তীতে উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রাম, পুঁজিবাদ ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ এই সবকিছুর সংমিশ্রণে সত্য বা মরাল অথরিটি বলে যে ধারণা ছিল তা বিদ্ধস্ত হয়েছে। কবি যিনি আগে সত্যের প্রতিভূ হিসেবে গণ্য হতেন এখন তিনিই প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত, এমনকি অনেকে তাঁকে প্রতারণার শিকার বলেও মনে করেন। 


২.

আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক কবিতা ভাষা সম্পর্কে এক প্রবল অনাস্থা থেকে জন্ম নেয়। কবিতা তখন হয়ে ওঠে ভাষার ভাঙন, ব্যর্থতা এবং অন্তর্গত ছেঁড়া স্বরের প্রকাশ। ফলে কবি আর সমাজের ভাষা দিয়ে কথা বলেন না। তিনি ভাষার চিহ্ন ভেঙে বিকারিত শব্দে অনুভূতির ছায়া আঁকেন। এই ভাষাভঙ্গই মূলত কবিকে সেই পুরাতন মিথ থেকে আলাদা করে ফেলে। তাঁর ভাষা আজ আর প্রার্থনার ভাষা নয়, প্রেমেরও নয়, তা একপ্রকার বিচ্ছিন্ন, আত্মপরিহাসময়, এমনকি কৌণিক নির্দয়তার বহিঃপ্রকাশ। এই নৈঃশব্দ্যপ্রবণ ও বাকচ্যুত ভাষা কবিকে আগের মতো সমাজ-চেতনাদ্রষ্টার ভূমিকায় আর রাখতে পারে না।


সমাজ যখন পবিত্র মিথ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় তখন কবির মনে জন্ম নেয় একধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কখনো আত্মবিরোধ, কখনো নির্মম আত্মসমালোচনা। ফলে কবির ভেতরেই শুরু হয় নিজের প্রতিকৃতি ভাঙার এক শিল্পচর্চা। যার মাধ্যমে তিনি কখনো নন্দনতাত্ত্বিক দুর্বৃত্ত, কখনো ভাষার অগ্নিকোষ আবার কখনো চুপ করে থাকা আত্মপ্রবঞ্চক। কবির এই দুর্বৃত্তায়ন অর্থাৎ নিজেকে সামাজিক নিয়মানুবর্তিতার বাইরে নিয়ে যাওয়া একধরনের বিকারগ্রস্ত আত্মপ্রক্ষেপণ। একদিকে তাকে নতুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে অন্যদিকে গড়ে তোলে একধরনের শূন্যতার ঐশ্বর্য। তিনি কোনো আদর্শের মুখপাত্র নন তিনি আদর্শের খণ্ডচিত্র। তিনি প্রতিধ্বনির অন্ধকারের গহ্বর। কবি যখন নিজের আত্মপ্রতিচ্ছবিকেই ভেঙে ফেলে তখন সেই ভাঙনের শব্দই হয়ে ওঠে কবিতা।  এ যেন এক ধ্বংসের মধ্য দিয়েই আত্মউৎপত্তির কাহিনি।


ঐতিহাসিকভাবে কবি একাধিক প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন—সাহিত্য প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, ধর্ম, শ্রেণি, সমাজ-নৈতিকতার কাঠামো, ভাষা, এমনকি শিল্পতত্ত্বের নিজস্ব অনুশাসন। কবি কখনো এদের মুখপাত্র ছিলেন কখনো সমালোচক আবার কখনো নীরব সাক্ষী। কিন্তু বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই সম্পর্ক কেবল জটিলই হয়নি, তা হয়ে উঠেছে একধরনের ঘৃণা-মিশ্রিত বিদ্রোহের সম্পর্ক। কবি ধীরে ধীরে প্রত্যাখ্যান করেছেন সকল প্রতিষ্ঠানিক উচ্চারণ এবং নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন এক অদৃশ্য চিরঘুর্ণিত বিরোধীতার কেন্দ্রে।


এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা রাজনৈতিকভাবেও এটি নন্দনতাত্ত্বিক এবং আত্মসাংস্কৃতিক। কবি বিশ্বাস হারান ভাষার স্বচ্ছতায়, শিল্পের শুদ্ধতায়, সমাজের জাগরণে, এমনকি নিজের কবিসত্তার চিরকালীন মহত্বেও। সেই বিশ্বাসহীনতার থেকে জন্ম নেয় একপ্রকার চেতনার দুর্বলতা যাকে আমরা বলি আত্মবিস্ফোরণ। কবি তখন নিজেরই সৃষ্টির পরোক্ষ বিরোধিতা করেন এবং সেই বিরোধিতার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় এক নতুন শৈল্পিক অনিয়ম যা একধরনের নান্দনিক দূর্বৃত্তায়ণ। দুর্বৃত্তায়ন এখানে এক ধরনের নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থান। যেখানে কবি সচেতনভাবে ভাষা, ফর্ম, ভাব, আখ্যান এবং সময়ের চর্চিত অভ্যস্ত রূপগুলোকে পরিত্যাগ করেন। এই পরিত্যাগ আসলে ক্ষমতার প্রথাগত কাঠামো থেকে সরে আসার কৌশল। যেখানে কবি নিজেকে ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে নয় তার অস্বীকারকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।


এমন কবি নিয়মিতভাবে তার চেনা কাঠামো ভাঙেন:

  • তিনি ছন্দ ছেড়ে যান—কারণ ছন্দ তাকে বাধ্য করে
  • তিনি ভাব প্রকাশকে ব্যঙ্গ করেন—কারণ তা এখন পণ্য হয়ে গেছে
  • তিনি ভাষা বিকৃত করেন—কারণ ভাষা আজ প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার।


এই দুর্বৃত্তায়ন একধরনের অ্যান্টি-আর্থোস। এতে কবি নিজেকেই অযোগ্য, অপ্রস্তুত, অনর্থক বলে উপস্থাপন করেন। যেন শুদ্ধতার জায়গায় তিনি নিজেকে দাঁড় করান এক নোংরা সৌন্দর্যর স্থপতি হিসেবে। এখানে কবিতা হয় বিস্ফোরণ, না বলা কথার নিকষ কালো ধোঁয়া অথবা এক অপার্থিব চিৎকার। যা প্রতিষ্ঠানের কোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায় না।


দুর্বৃত্তায়ন যে জায়গা থেকে জন্ম নেয় সেটি মূলত একাকিত্বের জায়গা। একটা গভীর নৈঃসঙ্গ্য, যেখানে কবির চারপাশে কেউ নেই, এমনকি কোনো ‘মিথ’ও নেই, যে তাকে ধারণ করতে পারে। এই আত্মবিচ্ছিন্নতা তাকে চালিত করে আত্মধ্বংসের দিকে। এই আত্মধ্বংসই আত্মবিস্ফোরণ। যেখানে কবি নিজের ঐতিহ্য, ভাষা, দর্শন এবং আত্মপরিচয় সব কিছুর বিরুদ্ধে নিজের ভেতরেই বিদ্রোহ করেন।


এই আত্মবিস্ফোরণ কেবল বোধের স্তরে ঘটে না। তা প্রকাশ পায় শব্দের স্তরে, শৈলীর স্তরে, এমনকি চেতনার স্তরেও। কবির কবিতা তখন আর পাঠযোগ্য থাকে না, হয়ে ওঠে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, এক ধরনের ভাঙনের শব্দ অথবা কেবলই মৌনতার অনুরণন। তিনি কখনো অতিশয় বলপ্রয়োগে নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করেন কখনো সম্পূর্ণ চুপ করে যান। উভয়ই কবির শৈল্পিক আত্মবিস্ফোরণের ভিন্ন রূপ। সবশেষে, কবি নিজেই নিজের কবিসত্তাকে প্রশ্ন করেন। কবির এই আত্মপরিচয় প্রত্যাখ্যান একটি আত্মপ্রতিষ্ঠাও। কারণ সেই প্রত্যাখ্যান থেকেই গড়ে ওঠে নতুন কবি। যিনি কোনো পুরস্কার, পাঠক, প্রতিষ্ঠান বা মহত্ত্ব চান না। তিনি চান বেঁচে থাকা, না বোঝার স্বাধীনতা, ভাষার অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার। এই অবস্থানই কবিকে দুর্বৃত্ত করে তোলে। কারণ তিনি প্রতিষ্ঠানিক না, তিনি নিজের তৈরি অনিয়মেই বেঁচে থাকেন।


আজকের কবির চরিত্র নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে মিডিয়া সংস্কৃতি ও ভোক্তাপুঁজিবাদের খরস্রোতা আগ্রাসণ। কবি এখন হয়ে উঠছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, উৎসবের অতিথি, পুরস্কারপ্রার্থী অথবা সামাজিক মিডিয়ার উপস্থিতি। পবিত্র মিথের বিপরীতে কবি হয়ে উঠেছেন বাজারের গায়ক—যিনি নিজের ভাষা, শরীর ও আবেগ পণ্যের মতো সাজিয়ে তুলে ধরেন।


এই নতুন বাস্তবতা কবিকে আর মিথিক কর্কশতায় জড়ায় না। তাকে ফেলে দেয় প্রতিযোগিতার, আত্মমার্কেটিং ও সমাজ-মাধ্যম নির্ভর জনপ্রিয়তার এক অদ্ভুত পরিণামে। ফলে কবিতা হয় বিক্ষিপ্ত, চটকদার আবেগ-আক্রান্ত আত্মপ্রকাশ। এই প্রবণতা মিথের ভাঙনের শেষ স্তম্ভ। কবি আর পৌরাণিক নন। তিনি এখন ব্র‍্যান্ড অথবা ট্রেন্ড। পোস্টমডার্ন দুনিয়ায় যেখানে প্রতিটি উচ্চারণই অনাস্থার, প্রতিটি বক্তব্যই প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে কবি নিজেই হয়ে উঠেছেন প্যারোডিক সত্তা। তিনি মিথের ছায়া নিয়ে খেলে বেড়ান, নিজের শূন্যতাকে ব্যঙ্গ করেন আর মেটা-কবিতার আড়ালে ঢেকে রাখেন নিজের অস্তিত্বসংকট। কবি তখন হয়ে ওঠেন লঘু ঠাট্টায় আত্ম-স্মৃতিচারণকারী সত্তা।


কবিকে নিয়ে গড়ে ওঠা সেই ‘পবিত্র মিথ’ এখন ছিন্নভিন্ন। সমাজ, ভাষা, রাজনীতি, প্রযুক্তি, এবং কবির নিজস্ব বোধের মধ্যেই এই ভাঙন ঘটেছে। এই ভাঙনই কবিকে নতুন করে আত্ম-অন্বেষণের পথে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি এখন একজন ক্ষয়ে যাওয়া তবু বেঁচে থাকা ভাষাশ্রমিক, যিনি শূন্যতার ভেতরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করছেন নিজের নতুন পরিভাষা।



৩.

কবিতা ও কবির মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে এক আত্মিক সাযুজ্য ছিল। কবির বাক্য, কবির অভিজ্ঞতা, ও কবিতার ভাষা যেন একই নৈতিক অক্ষরেখায় আবদ্ধ ছিল। কবি বলতেন, ‘আমি যা দেখেছি, তাই লিখছি।’ সেই দেখা ছিল অভিজ্ঞতালব্ধ, অস্তিত্বময়, প্রায় দার্শনিক। কিন্তু আধুনিকতায় পৌঁছে কবিতা আর কবির আত্মপরিচয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে একটি বিভাজন। যেখানে কবি নিজেই নিজের ভাষার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এই দূরত্বের উদ্ভব প্রধানত ঘটে পোস্ট-ওয়ার সাহিত্যে। যেখানে ভাষার স্বচ্ছতা আর সত্যনিষ্ঠতায় সন্দেহ দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় আদর্শের পতন এবং ভাষার উপনিবেশিক অনুবাদযোগ্যতা এই সব কিছু মিলিয়ে কবি তার উচ্চারণকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন। তখন কবিতা হয়ে ওঠে এক ধরনের ভাষাগত কৌশল যার ভেতরে কবির নৈতিক অবস্থান মিথ্যে হয়ে দাঁড়ায়।


আন্তঃপাঠ এবং আত্মবিরোধিতা কবিকে এক নতুন ভূমিতে দাঁড় করায়, যেখানে তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন না তাঁর বাক্যে । ফলে কবি ও কবিতা দুই ভিন্ন চেতনার ফর্ম হয়ে দাঁড়ায়। কবিতা তখন হৃদয়ের কথা থেকে কৌশলের ভাষায় রূপান্তরিত হয়। কবি তার চেতনার মৌলিকতায় বিপরীতে তার বিচ্ছিন্নতায় আত্মপরিচয় গড়তে থাকেন। শিল্পের ভাষা একসময় ছিল সরল না হলেও অর্থবহ। আজ কবিতার ভাষা যেন একটা অব্যবহারযোগ্য হস্তশিল্প, দৃশ্যত আভিজাত্যে পূর্ণ আর ব্যবহারহীন। কবিরা এখন উচ্চারণে ব্যবহার করেন এমন সব বিমূর্ততা যেগুলোর অর্থ তৈরি হয় পাঠকের ওপর নির্ভর করে অথবা হয়তো কোনো অর্থই নেই।


এই ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতা একধরনের ‘অর্থদ্বন্দ্ব’ সৃষ্টি করে। ভাষার অর্থ আর কবির নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কবি নিজেই ভাষাকে এমন এক গোলকধাঁধায় পরিণত করেন যেখানে পথ নেই কেবল পথের অনুকরণ আছে। প্রতীক ব্যবহারের নামে কবি এমন এক দ্ব্যর্থতা ও অস্পষ্টতার আশ্রয় নেন যার উদ্দেশ্য একধরনের অপরিচিতিকরণ। না বোঝার অভিজ্ঞান তৈরি করা। এই অপচয় অর্থ, চিন্তা ও পাঠকের আবেগেরও অপচয়। কবিতা হয়ে ওঠে ভাষার এক শীতল শৃঙ্গ। যেখানে নেমে আসার কোনো পথ নেই। সেখানে কেবল একাকিত্ব, শ্রেণিচ্যুতি ও বিমূর্ততার দম্ভ।


দুর্বোধ্যতা কেবল ভাষার এক অন্তর্গত সাংস্কৃতিক অবস্থান, এক চেতনার নির্মাণ যেখানে কবি সচেতনভাবে নিজেকে একটি উচ্চতর মেধা ও ভাবনার স্তরে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যাতে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এক অনুপবর্গীয় পাঠ। দুর্বোধ্যতা এইখানে আর ভাষার অনিবার্য ব্যতিক্রম নয়, এক কৌশলগত নির্মাণ, যা কবির আত্মপরিচয়ের অদৃশ্য ভৌগোলিক মানচিত্র আঁকে। যেখানে সাধারণ পাঠক প্রবেশ করতে পারে না, কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটরাই পা রাখতে পারেন এবং এর ফলে গড়ে ওঠে এক নৈঃশব্দ্যের অভিজাততা।


দুর্বোধ্যতা আধুনিক কবিতার এক অলিখিত কৌশল, এক নৈঃশব্দ্যের ছদ্ম-আত্মবিশ্বাস, যার উৎসে রয়েছে ভাষার সঙ্গে কবির আত্মসংঘর্ষ, ভাষার উপর কবির আস্থা হারানো এবং এই হারানো আস্থাকে আবৃত করার এক অদ্ভুত প্রতিরক্ষাবোধ। এখানে দুর্বোধ্যতা এক অস্তিত্ববাদী ব্যূহরচনা, এক সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা, যেখানে কবি ভাষাকে অবিশ্বাস করেন ঠিক যেমন তিনি বিশ্বাস করেন তার ব্যর্থতাকে আড়াল করার সম্ভাবনায়।


আধুনিকতার ভাষাতাত্ত্বিক সংকট যা দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে প্রগাঢ় চিন্তার, অস্তিত্ববাদের, নান্দনিক জটিলতার প্রেক্ষাপটে। তা কবিকে ঠেলে দিয়েছে এক দ্বৈত বাস্তবতায়। একদিকে ভাষা  প্রতীক ও বিমূর্ততার নির্মিত কাঠামো, অন্যদিকে কবির দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি মানসিক স্বাতন্ত্র‍্য রক্ষার। এমন এক ভাষা নির্মাণের, যা সকল ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে থেকে নিজেকে ‘অর্থের অভিজাত’ হিসেবে তুলে ধরবে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে কবির কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। তাঁর ভাষা হয়ে ওঠে অভিমুখহীন, অন্তর্প্রবাহিত এবং প্রতিটি শব্দ যেন পালিয়ে বেড়ায় নিজ অর্থের কাছ থেকে। এ এক অস্তিত্বচ্যুত ভাষা যার ভেতর কবি খোঁজেন তাঁর নিঃশব্দ আত্মরক্ষা।


এই জায়গায় দুর্বোধ্যতা পরিণত হয় আত্ম-প্রতিরক্ষার একটি ‘মেটাফোরিক শেল’-এ। কবি জানেন ভাষা দিয়ে যা বলা যায়, তা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনায় পূর্ণ। যা অস্পষ্ট, যা অর্ধ-উচ্চারণ, যা কেবল ইঙ্গিতমাত্র তাতেই লুকিয়ে থাকে আত্মার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আবরণ। এখানে দুর্বোধ্যতা হয়ে ওঠে আত্মরক্ষার কৌশল। একদিক থেকে পাঠকের জিজ্ঞাসাকে অবরুদ্ধ করার অস্ত্র, অন্যদিকে নিজের ভাষিক অক্ষমতাকে ঢেকে রাখার সাংস্কৃতিক চাতুর্য। এই প্রতিরক্ষা-ব্যূহের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এক গোপন শ্রেণি-চেতনাও। দুর্বোধ্যতার মাধ্যমে কবি আসলে নির্মাণ করেন এক বুদ্ধিবৃত্তিক উঁচু ভূমি। যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ভাষার সাধারণ বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেন, সাধারণ পাঠকের নাগালকে বর্জন করতে পারেন এবং এক চিহ্নভিত্তিক অথচ অর্থ-অসার জগত নির্মাণ করতে পারেন। এ যেন ভাষা ও মানসিক শ্রেণির এক সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া। যেখানে কবিরা তৈরি করেন একটি অন্তর্মুখী কবিতাজগৎ সুসজ্জিত, শব্দবহুল আর সাংস্কৃতিকভাবে একধরনের আত্ম-উপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতায় নিমজ্জিত।


এই বিচ্ছিন্নতাই কবিকে রক্ষা করে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন থেকে। দুর্বোধ্যতা হয়ে ওঠে একটি অন্তর্মুখী আত্মকেন্দ্রিকতার প্রাচীর। যেখানে কবিতা আত্মসমীক্ষার আড়ালে আত্ম-পরম্পরাহীনতায় বিলীন। এই বিলীনতা, যদিও বাহ্যত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশীলন বলেই প্রতীয়মান হয়, তা আসলে গভীর এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরক্ষাবোধ, যেখানে কবি আত্ম-নির্মিত এক পরিসরে নিজেকে রক্ষা করেন পাঠকের সম্ভাব্য প্রশ্ন, সমাজের প্রত্যাশিত দায় কিংবা ভাষার গর্ভগৃহে জন্ম নেওয়া অর্থের স্বচ্ছ অভিপ্রায় থেকে। এই পরিস্থিতিতে ভাষা আরভ সংযোগের বাহন হয়ে ওঠে না, তা পরিণত হয় আত্ম-প্রতিচ্ছায়ার এক বালিঘরে। যেখানে কবি দেখেন নিজ ভাষার ভগ্নরূপ এবং দুর্বোধ্যতার মধ্য দিয়ে সেই ভগ্নতা আড়াল করে রাখেন একরৈখিক পরিশীলনের ছায়ায়। এই দুর্বোধ্যতা, বাস্তবে, কবির গভীর এক ভয়—ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হওয়ার ভয়, ভুল বোঝা যাওয়ার ভয়, নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করলে অর্থের অভাবজনিত যে নগ্নতা প্রকাশ পাবে তার ভয়। তাই দুর্বোধ্যতা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের আর্তি, যা প্রতীকায়িত নিঃশব্দে আচ্ছাদিত।


এভাবে কবি এক ধরনের ‘আত্ম-শ্রেণি’ নির্মাণ করেন নিজের জন্য নিজে এবং এক নির্দিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীর স্বীকৃতির জন্য। এই গোষ্ঠী ভাষা নয়, অর্থ নয়, অভিজাত বিমূর্ততার অভ্যাসে মগ্ন এ এক কাব্যিক অভিজ্ঞান। যার প্রবেশদ্বার নির্ধারিত হয় দুর্বোধ্যতার কঠিন কোড দ্বারা। সাধারণ ভাষা ও অর্থ এই গোষ্ঠীতে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, কারণ তা স্পষ্ট, তা সর্বজনীন আর সর্বজনীন মানেই অভিজাত নয়। এই নির্মাণ কবিতাকে এক নীরব অথচ দৃষ্টিনন্দন লাবণ্যে রূপ দেয় বটে কিন্তু তা একইসঙ্গে কবিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, করে তোলে নিঃসঙ্গ এবং কবিতাকে পরিণত করে নৈঃশব্দ্যের এক উচ্চারণে। যেখানে অর্থ নেই—আছে শুধু অভিজ্ঞান আর প্রহেলিকা।


প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মতো সাহিত্যের মধ্যেও শ্রেণি গড়ে ওঠে। এই শ্রেণিবিভাজনের এক মোক্ষম কৌশল হলো দুর্বোধ্যতা। আধুনিক কবি বিশেষত লিটল ম্যাগ চর্চায় অভ্যস্ত কবি, যে কৌশলগত দুর্বোধ্যতা নির্মাণ করেন, তা যেন একধরনের শ্রেণিসচেতনতা তৈরি করে। এখানে দুর্বোধ্যতা একটি আত্মরক্ষার বর্ম। যাতে কবি নিজেকে চিন্তার ঐশ্বর্যে ভরপুর প্রমাণ করতে পারেন। এই বর্মই আবার তাঁকে পাঠকের চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। কবির দুর্বোধ্যতা একাধারে আত্মগৌরব ও আত্মপরাজয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এই মানসিক শ্রেণিবিভাজনের ফলে পাঠকও দুই ভাগে বিভক্ত হন। একদল ‘বোঝে’ বলে ভাবেন, অন্যদল ‘বোঝেন না’ বলে আত্মবর্জিত বোধ করেন। এমন কবিতা হয়ে পড়ে হিমবাহ যার সৌন্দর্য দূর থেকে দেখা যায় কিন্তু ছুঁতে গেলে জমে যায়। 


এই জিজ্ঞাসাগুলোর কোনো সহজ সমাধান নেই। এটুকু বলা যায়— যে কবিতা যত বেশি নিজের ভাষাকে দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন করে, ততই সে একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করে। কবি তখন মিথ মিথ ধ্বংস করে এক শূন্যতা দাঁড় করান। যেখানে পাঠক বিস্মিত হয়, বিভ্রান্ত হয় এবং অনেক সময় কবির কাছে আত্মসমর্পণও করে। তবে এই দুর্বৃত্তায়নের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে নতুন নন্দনতত্ত্বের জন্ম। একধরনের নেতিবাচক সক্ষমতা, যেখানে কবিতা হয় বিভ্রান্তিরও সৌন্দর্য, তার জন্য প্রয়োজন কবির আত্মজিজ্ঞাসা।


এক সময় ভাষা ছিল বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতীক। যেখানে শব্দ মানেই ছিল অর্থের সুনির্দিষ্ট ছায়া আর কবি ছিলেন সেই ছায়ার মধ্য দিয়ে সমাজের সত্যকে দৃশ্যমান করার দূত। পুরাণে কবি ছিলেন ঋষি, সুফিত্বের ঘোরে দ্রষ্টা। তাঁর ভাষা ছিল ‘মন্ত্র’—যার ব্যঞ্জনায় কাঁপত শূন্যতা, জেগে উঠত চৈতন্য। কিন্তু আধুনিকতা ভাষার সেই পৌরাণিক বিশ্বাসভঙ্গ ঘটায়। ভাষা আর সরল বা স্বচ্ছ থাকে না; সে হয়ে ওঠে প্রতীক-নির্ভর এবং প্রতীক হয়ে ওঠে অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন এক কৌশল। কবিতার পাঠ এখন একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পাজল যার মূলে অর্থ অনুপস্থিত। কবি আর ভাষাকে সত্যনিষ্ঠ বলেই ব্যবহার করেন না, তিনি ভাষার ‘প্রতারণা’ সম্পর্কে সচেতন এবং সেই প্রতারণাকেই তিনি শৈলী করে তোলেন।


আজকের কবিতায় মুখ্য হয়ে উঠেছে ছিন্ন অভিজ্ঞতা যার পেছনে নেই কোনো সুসংহত পরিকাঠামো। বিমূর্ততার নামে কবি ছিন্ন প্রতীকের মিছিল তৈরি করেন। এই প্রবণতা কবিকে সত্য থেকে সরিয়ে দেয়। কবি ক্রমশ নিজেকে এক ভাস্করের জায়গায় দাঁড় করান। যিনি ভাবনার নাড়ি কাটতে কাটতে কেবল একটি নিসর্গ রেখে যেতে চান, যার অর্থ নেই, আবহ আছে। ভাষা আর অর্থ বহন করে না, সে কেবল এক অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞান বহন করে। যার দর্শক আছেন, পাঠক নেই।


জ্যাক দেরিদার ভাষাতাত্ত্বিক উক্তি—‘টেক্সটের বাইরে কিছুই নেই’ আসলে কবির আধুনিক অবস্থানকে স্বীকার করার এক ভাষ্য। কবি বুঝে ফেলেছেন, যে-কোনো শব্দই পাঠের দ্বারা ভিন্ন ব্যাখ্যার জন্ম দেয় এবং সেই ব্যাখ্যাগুলো নিজে নিজেই বিপরীতমুখী। অর্থ, এই দৃষ্টিতে আর কোনো নির্দিষ্ট সত্য নয়। এক অবিরাম পিছলে পড়া, এক অনির্দিষ্ট ব্যুৎপত্তির খেলা। দেরিদা দেখালেন, ভাষার প্রতিটি চিহ্ন আসলে অন্য একটি চিহ্নের অবলম্বনে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো শব্দই একক অর্থ বহন করে না বরং এক চিরস্থায়ী প্রতিসরণ ঘটায়। এই তত্ত্ব যখন কবি আত্মস্থ করেন, তখন কবিতার ভাষা হয়ে পড়ে অনিশ্চয়তার কাব্য। কবির লক্ষ্য তখন অর্থের সম্ভাব্যতা ও অসম্পূর্ণতা তুলে ধরা।


বাংলা কবিতায় এই তাত্ত্বিক নির্জনতা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, নির্মলেন্দু গুণ, জয় গোস্বামী থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের হাতে। ‘চুলে রাখলে শর্ষের তেল, শব্দের গায়ে পোকা ধরে।’— উৎপলকুমার বসু। এই ধরনের কবিতা কল্পনার এক চূড়ান্ত রূপ তৈরি করে। যেখানে অর্থ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, শব্দের শরীর—তার সংঘাত, তার দ্যোতনা, তার বক্রতা—তা-ই মুখ্য হয়ে ওঠে। এই প্রবণতা কবিতাকে এক ‘অর্থচ্যুত ভাষা-অন্বেষা’-য় পরিণত করে। যেখানে পাঠক নয়, ভাষা-ই হয়ে ওঠে কবিতার মূল চরিত্র।


আজকের কবিতা কি সত্যিই এক অন্তর্মুখী রহস্য? যার ব্যাখ্যা কেবল ‘বোঝার’ মুহূর্তময় ঘোরে অবস্থান করে? কবির পৌরাণিক মিথ যেখানে সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সমাজের সঙ্গে এক নৈতিক সেতু তৈরি করত, সেখানে আজকের কবি তা নয়, তিনি নির্মাতা নন, তিনি প্রশ্নকারী। কবির আত্মরক্ষা হয়তো এই ভাষার জটিলতার মধ্যে। কিন্তু সেই আত্মরক্ষার মূল্য কী? যদি কবিতা পাঠকের অনুভূতিকে ছুঁয়ে না যায়। যদি কবি নিজেই নিজেকে নিরর্থক করে তোলেন ভাষার খেলায়, তবে এই মিথ আর থাকে কোথায়? সেই প্রাচীন মিথ কবির পবিত্রতা, দ্রষ্টার সত্যভাষণ আজ খণ্ডিত, ছিন্ন আর অর্থহীনতার অভিজ্ঞান দিয়ে মোড়া। মিথ ভাঙে শব্দের মধ্যে, বিমূর্ততার ভেতর এবং কবির নিজের তৈরি ছায়ামুখে।


৪.

কবিতা একটি সাংস্কৃতিক ক্ষমতা কেন্দ্রবিন্দু, একটি নান্দনিক কূটনীতি, একটি বোধ ও বাণীর প্রাতিষ্ঠানিক অনুবাদ। এই অনুবাদপর্বেই কবিতা হয়ে ওঠে রাজনীতি। একান্তভাবে না হলেও অন্তর্রুদ্ধভাবে। আধুনিক কবির দুর্বৃত্তায়নের একটি তীব্র অভিসন্ধান নিহিত থাকে এই প্রাতিষ্ঠানিক অনুবাদের ছদ্ম-নির্মাণে, যেখানে ‘কাব্যিক ক্যানন’ গঠনের মাধ্যমে এক বিশেষ গোষ্ঠী একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে ভাষার উপর। পরস্পরের উপযোগিতামূলক স্বীকৃতির আদান-প্রদানের ভেতর দিয়ে তারা নির্মাণ করে সৌন্দর্য, গম্ভীরতা এবং ‘প্রকৃত কবিতা’র সংজ্ঞা।


এই ক্যানন গঠনের প্রক্রিয়াই কবিতার অন্তর্গত দুর্বৃত্তায়নের কেন্দ্রীয় প্রপঞ্চ। এটি বাইরে থেকে যতই নিরপেক্ষ বা গুণগত বলে প্রতীয়মান হোক এর ভেতরে কাজ করে এক ধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেণি-যন্ত্রণা। যেখানে নতুন ও প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে ক্রমাগত দমন করা হয় তথাকথিত ‘রুচির মানদণ্ড’-এর নামে। কবি—যিনি নিজেকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলে ভাবেন, তিনিই তখন হয়ে ওঠেন অতীতের পুণঃসংহারে অভ্যস্ত এক রক্ষণশীল প্রহরী। যিনি নিজস্ব আসনটিকে অচল রাখতেই অপর আসনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেন। যিনি একদা কণ্ঠস্বর ছিলেন জনতার, ব্যথার, বিদ্রোহের—তিনি আজ পরিণত হয়েছেন এক নিঃশব্দ-নিঃসঙ্গ অভিজাতের রূপে। যাঁর কাব্যিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত শুধু চিহ্নিতকরণের রাজনীতিতে, অপবর্গায়নের চাতুর্যে। নতুন কবিকে তিনি স্বাগত জানান না, শোনেন না। তিনি নিপুণ কৌশলে তাকে নীরব করে দেন, যেন শব্দের আত্মা নয় তার শরীরই অশুচি। এই প্রক্রিয়া এটি এক গৃহগত অপমান, এক নৈঃশব্দিক গণহত্যা। যেখানে নবীন কবির স্বরকে চূর্ণ করা হয় স্বীকৃতির চাতালে অথবা আরও নিষ্ঠুরভাবে অতিরিক্ত প্রশংসার নির্জীব আলিঙ্গনে।


আধুনিক কবি এখন আর ভাষার দ্রোহে জন্মান না, তিনি জন্মান কাব্যিক কাঠামোর অন্তর্গত হয়ে। যা মূলত নির্মিত হয় প্রকাশনার বন্ধন, পুরস্কারপ্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ধারিত পাঠ্যক্রম এবং সাহিত্যজগতের অভ্যন্তরীণ শ্রেণিচ্যুত প্রথাগুলোর সম্মিলনে। এই কাঠামোর সীমানা গড়ে তোলা হয় উচ্চারণের ধরণ, শব্দের গম্ভীরতা কিংবা ভাষা কতটা অপ্রবেশ্য ও চিত্রকল্প-বোঝাই এইসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। এই চৌহদ্দিতে নবীন কবির প্রবেশ মানে সাহিত্যদ্রোহ। আর কবি সেই প্রথার পুরোহিত, নিজ হাতে নিক্ষেপ করেন অপরিণত তিরগুলো।


প্রতিষ্ঠানবদ্ধ কবি যিনি হয়ত এক সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেঁড়া কাগজে কবিতা লিখতেন, তিনিই আজ নতুন কবিকে বলেন—‘তোমার ভাষা পরিপক্ব নয়’, ‘তোমার ছন্দ অসংলগ্ন’, ‘তুমি কবিতার ইতিহাস জানো না।’ অথচ এই ইতিহাস তিনিই রচনা করেছেন এমনভাবে যেখানে প্রবেশের পূর্বশর্ত হলো—বিশেষ কাব্যিক শরণার্থীত্ব, এক আত্মবিস্মৃত নিরবতা এবং শ্রদ্ধার নামে এক আত্মবিক্রয়। নতুন কবির চোখে তাই কবিতা হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ এক ভূমি যেখানে প্রবেশের আগে তাকে পরিত্যাগ করতে হয় তার ভাষা, তার শহর, তার রক্তে জমে থাকা প্রতিরোধের অভ্যন্তরীণ গতি।


এই অপমান একটি চিহ্নবদ্ধ মানসিক রাজনীতি। পুরনো কবি তাঁর ছাত্রদের দিয়ে নতুন কবিদের বিরুদ্ধে সুক্ষ্ম মূল্যায়ন ছড়ান, সাহিত্য সভায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীরবতা সৃষ্টি করেন কিংবা তার কবিতা নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করেন যেন কোনো অদৃশ্য পরীক্ষা চলছে এবং পরীক্ষার্থীটির নাম কেউ উচ্চারণ করছে না, শুধু তার অযোগ্যতাই বারবার উল্লেখিত হচ্ছে। এটি এক ক্ষমতাসর্বস্ব চাতুরি। যার মধ্য দিয়ে কবি হয়ে ওঠেন সাম্রাজ্যের পাহারাদার, একধরনের রুচিনিরপেক্ষ সমালোচক, যিনি কাব্যিক মানদণ্ড রক্ষা করতে করতে নিজেই হয়ে উঠেছেন রুচির দূর্ভিক্ষের কারাগার।


এখানে কবির পাণ্ডিত্য, তার গ্রন্থাগারিক পরিচিতি কিংবা তার প্রভাবশালি লেখকবন্ধুদের সার্টিফিকেট। সবকিছু একসাথে পরিণত হয় এক প্রাচীন আমলার জেরক্সকৃত নিষেধাজ্ঞায়। নতুন কবি যেন বারবার ফিরে আসে সেই দরজায়, যেটি সসম্মানে বন্ধ রাখা হয়েছে। কবিতা যেন প্রাচীন ব্যাঙ্ক, যেখানে প্রবেশাধিকার মেলে কেবল উত্তরাধিকারীদের, বা তদ্বিরকারীদের। এই প্রক্রিয়াকে যদি গভীর মনস্তত্ত্ব দিয়ে পড়া যায়, তাহলে বোঝা যায় এটি একধরনের অস্তিত্বভীতির অভিব্যক্তি। পুরনো কবি জানেন, যে ভাষা এখন তার কবিতায় রয়েছে, তা আর জাগতিক নয়, তার ভাব একঘেয়ে হয়ে গেছে, তার চিত্রকল্প ম্লান। কিন্তু তার ভেতর যে মানসিক সামন্তবাদের চেতনা তৈরি হয়েছে তা তাকে বাধ্য করে নবীন কণ্ঠকে প্রতিনিয়ত অযোগ্য বলার জন্য, যেন নিজের ভেতরের ক্রমাগত শূন্যতাকে ঢেকে রাখা যায়। এই আত্মসুরক্ষামূলক অপমানই কবি-প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করে এক জঞ্জালভর্তি ময়দানে, যেখানে নতুন শব্দের স্থান নেই, আছে শুধু ধ্বনি-চক্রের পুনরাবৃত্তি।


নবীন কবির এই অভিজ্ঞতা আজ সর্বজনীন এক ধরণের অন্তর্বর্তী নিঃস্বতা। সে জানে কবিতা যদি আদৌ মুক্তির ভাষা হয়, তবে সে মুক্তি প্রকাশনার ভেতর নেই, পুরস্কারের ভেতর নেই, সাহিত্যের আড্ডার ভেতর নেই। কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্য, তাকে কবি হতে গেলে সেই কাঠামোতেই প্রবেশ করতে হবে, তাকে প্রকাশিত হতে হবে সেই সব কাগজে যাদের প্রকাশক সেই পুরনো কবির বন্ধু, তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে সেই সমাবেশে যেখানে নতুনকে বলা হয় ‘বেশ পরিক্ষিত’ কিন্তু প্রকাশ করা হয় না—ঠিক সময় আসেনি বলে। এই ‘ঠিক সময়’ আসবে না। কারণ কবিতার এই সময় নিয়ন্ত্রিত হয় একটি অলিখিত সংবিধানে। যেখানে প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হচ্ছে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাষা। কবি তাই হয়ে উঠেন এক অদৃশ্য সেনানায়ক, যিনি নতুন কবিদের তিক্ত আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মপ্রতিকৃতি—দুটোকেই ছিন্ন করে দেন এক মোহাবিষ্ট শব্দ-বাহিত ভদ্রতার তরবারি দিয়ে।


আজ কবিতা আর জন্মায় না নির্জনতার ব্যাকুল শুশ্রূষা থেকে, হৃদয়ের উৎকণ্ঠ দোলায় কিংবা ভাষার গোপন প্রবাহে। আজ কবিতা জন্মায় নির্ধারিত মঞ্চে, ব্র‍্যান্ডেড মাইক্রোফোনে, নিঃশব্দ এসি-সংলগ্ন কক্ষে, যেখানে প্রতিটি উচ্চারণকে ঘিরে থাকে বিজ্ঞাপনের সুবাস, স্বীকৃতির রঙিন আলো এবং ক্যামেরার চোখে মান্যতা প্রাপ্ত হওয়ার লোভনীয় হাহাকার। কবিতা, এক সময় যে ছিল স্বতন্ত্র আত্মার অনুপম ভিন্নতা, সে আজ পণ্যতন্ত্রের অনুগামী এবং কবি হয়ে উঠেছেন সেই পণ্য বিতরণের চতুর ব্যবসায়ী। তাঁর কলমের কালিতে নেই আর অস্বস্তি, আছে শুধু অভিজাত চুক্তি, সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা,এবং পুরস্কার প্রাপ্তির রক্ষণশীল গণতন্ত্র।


সাহিত্য পুরস্কার আজ কবিতার ভাষা নির্ধারণ করে, কাব্যের ধারা নির্ধারণ করে, এমনকি কবি কে হবেন—তাও নির্ধারণ করে। এখানে কবিতার সাবমিশন পলিসি গুরুত্বপূর্ণ; ভাষার ব্র‍্যান্ডিং জরুরি। এই পুরস্কার ব্যবস্থা কবির প্রতিভাকে বিচার করে না, তার প্রতিষ্ঠাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। কবিকে সম্মান দেওয়া হয় কারণ তিনি এক গ্রহণযোগ্য কাঠামোর মধ্যে আছেন। তিনি কখনোই এই কাঠামো ভাঙার কথা বলেন না। বললে পুরস্কার বাতিল হয়, আমন্ত্রণপত্র আসে না, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে নাম কেটে দেওয়া হয়। এই সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাই কবিকে পরিণত করে একধরনের নিরীহ অথচ নির্মম কাঠামোগত গুণপালের নেতৃত্বে, যাঁর কাজ হলো কবিতাকে কবিদের নয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদে রূপান্তর করা।


লিটফেস্ট—এই শব্দটি আজ একটি কবিতার মোড়ক। যেখানে মুখচ্ছবি মূল্যবান; অভিজ্ঞতা নয়, বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে কবি যিনি সবচেয়ে কম বলে সবচেয়ে বেশি দামী—তাঁকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে কবিতার ব্যাকরণ হয় না, হয় ড্রেসকোড, হয় প্যানেল সাজানো, হয় লাঞ্চের ভেন্যু নির্বাচন। কবিতা হয়ে ওঠে বাণিজ্যিক প্রদর্শনী, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো পাঠকের ভেতর কনজিউমারিজম তৈরি করা। কবি হয়ে যান একধরনের সাংস্কৃতিক পণ্য। যাঁর কবিতা মূল নয়—মূল হলো তাঁর উপস্থিতি, তাঁর বক্তব্য, তাঁর প্রোফাইল এবং তিনি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছেন বা কে তাঁকে প্রথম প্রশংসা করেছিলেন এইসব বাহ্যিক নিয়তিগুলি।


এই দৃশ্যপট নির্মাণের আড়ালে থাকে এক গভীর বাজারমুখী রাজনীতি। যা কবিতাকে একটি কনটেন্ট এ রূপান্তর করে। ভাষার পরিবর্তে অস্তিত্বের প্রকাশ, যা এখন কারেন্সিতে কনভঅর্ট করা হয়। যা দিয়ে কবি অগ্রসর হন আরও উচ্চতর প্রকাশনায়, আরও দামী মঞ্চে, আরও গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারের দিকে। কবিতা এখন লেখা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে, যেমন একটি বিজ্ঞাপন লেখা হয় নির্দিষ্ট ক্রেতাদের জন্য; কবিতা এখন অঙ্গুলি নির্দেশ করে ট্রেন্ড-এর দিকে—যাতে তাকে প্রকাশ করতে সুবিধা হয়, তাকে প্রচার করতে তৎপর হওয়া যায়।


কবির আত্মবিপ্লব আজ বন্ধ হয়ে গেছে কারণ কবি নিজেই এক সিস্টেমের অংশ। যিনি সাহিত্যের ভেতর থেকে সাহিত্যকে ভাঙেন না, সেই সাহিত্যকে আরও বাণিজ্যিক, আরও মিডিয়াবান্ধব, আরও আনুগত্যশীল করে তোলেন। কবিতা অভিজ্ঞতার শব্দে হয় না, তা এখন হয়ে উঠেছে এক আইটেম—যার ফর্ম্যাট নির্ধারিত, যার প্রতিক্রিয়া অনুমিত এবং যার ভবিষ্যৎ আগেই লেখা হয়ে গেছে ব্রডশীটে অথবা কোনো সাহিত্য ফাউন্ডেশনের রিজিওনাল এডিটরদের মেলচক্রে।


এই পণ্যায়ন কবিতাকে দেয় এক বিভ্রান্তিপূর্ণ সম্মান। যা আসলে কবিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কবি সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার, অনেক সময় প্রধান কারিগর। তিনি জানেন, তাঁর কবিতা কোথাও পৌঁছায় না, তিনি পৌঁছে যান পুরস্কার মঞ্চে। তাঁর চিত্রকল্প কোথাও আগুন জ্বালায় না কিন্তু তাঁর ছবি থাকে বেস্টসেলার পোস্টারে। এই দ্বিচারিতা, এই সাংস্কৃতিক প্রতারণা, এই রাজনৈতিক ছলনা সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে একটি বদ্ধ অথচ বহুল প্রচারিত সাহিত্যজগৎ। যেখানে কবিতা আসলে নেই, শুধু কবিতা নামের এক উচ্চারণযোগ্য প্রতীক আছে। যা বললে মনে হয় আমরা এখনো কবিতা নিয়ে ভাবছি। এভাবে কবিতা হারায় তার গভীরতা, হারায় তার প্রতিবাদী স্বর, হারায় তার তপস্যাজাত প্রতিসংস্কৃতি এবং কবি হয়ে ওঠেন এই পণ্যায়নের নির্লজ্জ মুখ, যিনি নিজেকে বিক্রি করেন এমন দক্ষতায়, যেন তিনিই কবিতার শেষ প্রতিনিধি—এবং তাঁকেই ভালোবাসা উচিত, মান্যতা দেওয়া উচিত, অনুসরণ করা উচিত। বাকিরা যেন কেবল পাণ্ডুলিপি। যা পড়ে দেখা হবে না, যা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এক স্যাঁতসেঁতে মৌনতার শিলালিপিতে।


সাহিত্য ছিল নির্জন এক চারণভূমি যেখানে শব্দের শিষ্যরা একমাত্র সত্য ও সৌন্দর্যের সন্ধানে আত্মার গভীরতায় ডুবে যেত। কিন্তু আজকের কবি সেই নির্জনতা ছেড়ে এসেছে গোষ্ঠীগত রাজনীতির ঝাঁঝে ঝাঁপিয়ে। তিনি আর একলা যোদ্ধা নন; তিনি এক পেশাদার কুচকাওয়াজ, এক সাংস্কৃতিক সেনানায়ক, যিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে গোষ্ঠীর স্বার্থে লিপ্ত হয়েই সাহিত্যকে এক অন্তর্মুখী লুটতরাজে পরিণত করেছেন। এই লুটতরাজ শুধুমাত্র সামগ্রিক সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বপক্ষে, সেই কাঠামোর ভেতরে জন্ম নেওয়া স্বল্পস্বার্থবোধ ও ক্ষমতার লোভের রাজত্ব। যা সাহিত্যের স্বাধীনতা, বেদনাদায়ক অন্তর্দৃষ্টি  এবং দৃষ্টির স্বচ্ছতা কে খর্ব করে, তাকে বাজারজাত করে, তাকে গোষ্ঠী স্বার্থের কারাগারে বন্দি করে রাখে।


কবি যখন সাহিত্যের ভেতর থেকে সাহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নষ্ট করে, সে মুহূর্তে কবিতা হারায় তার অস্তিত্বের স্বর। সে হয়ে ওঠে এক ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক এজেন্ট। যার কর্মক্ষেত্র শুধুমাত্র লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা গোষ্ঠীগত সমঝোতার একটি জটিল নেটওয়ার্কের বুননে রূপ নেয়। এখানে কবিতা গোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি ‘মালিকানাধীন সম্পদ’ হিসেবে গৃহীত হয়, যা একাধিক বার্ষিক সম্মেলন, প্রকাশনা এবং পুরস্কারের মাধ্যমে বিনিময় হয়। এই বিনিময় অবশ্যই নির্ভর করে সেই কবির গোষ্ঠীভিত্তিক আনুগত্যের ওপর। যার মূলে থাকে না কোনো শিল্পতাত্ত্বিক নিষ্ঠা বা আদর্শিক দীক্ষা, যা থাকে তা এক কূটনৈতিক বুদ্ধি ও নীতিমালা।


সাহিত্যের এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আজ কবিকে পরিণত করেছে এক সুশিক্ষিত লুটতরাজের কুচক্রীমহলে, যিনি নতুন কবিদের প্রতিভাকে নিজের গোষ্ঠীর বাইরে থেকে আসা কোনো বিপদস্বরূপ বিবেচনা করেন কারণ নতুন শব্দ নতুন চেতনার আভাস এনে দেয় যা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই তিনি বেছে নেন এক দীর্ঘসূত্রী নিস্তব্ধতা, এক অস্পষ্ট প্রতিবন্ধকতা, যাকে বলা যায় সাংগঠনিক একরাশ ভাবনা, যা নতুন সৃষ্টিকে গ্রাস করে পুরনো ও অচল কাঠামোর স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত। কবিতার এই অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় শাসক কবি নিজেকে এক সংস্কৃতির উচ্চবংশ হিসেবে স্থাপন করে। যার কর্তব্য পুরো কবিতাজগতকে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে সংগ্রাম করা।


এই লুটতরাজে কবিতার প্রকৃত অর্থ-আবিষ্কার, শব্দের শক্তি এবং ভাষার বিক্ষোভ স্থান পায় না। তারা কেবল থাকে সাংগঠনিক ও সামাজিক প্যাঁচে, যেখানে কবিতা মানেই হয়ে ওঠে ‘পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল’ এক ধরনের সাংস্কৃতিক অর্থ, যা বিনিময়ে দেয় সম্মেলনের আসন, প্রকাশনা স্বীকৃতি এবং বুদ্ধিজীবী সম্মেলনের ‘বেস্ট স্পিকার’ পদবী। কবি নিজেকে বিক্রি করে বসেন সেই পণ্য হিসেবে, যার মূল্য নির্ধারিত হয় গোষ্ঠীগত স্বীকৃতির বাজারে। আর এই বাজারের গোপন নিয়মের বাইরে গিয়ে কবিতা অর্থহীন, বর্জনীয় এবং এক ধরনের বিপ্লবী অবাধ্যতা হিসেবেই গণ্য হয়।


সাহিত্য এই দাপুটে রাজনীতির জালে জড়িয়ে পড়ার ফলে, সমাজের বহুমাত্রিক সত্যের বহিঃপ্রকাশও থেমে যায়। কবি যখন সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত লড়াইয়ের অংশ হয়ে ওঠেন, তিনি আসলে কবিতার বিপ্লবী ও নতুনত্ববোধকে হত্যার অংশীদার হন। কারণ এই লড়াইয়ে ভাষার মুক্ত চিন্তা স্থান পায় না, পংক্তির নবজন্ম কিংবা অর্থের বহুমাত্রিক সম্ভাবনা। অথচ পুষ্পিত হয় ক্ষমতার খেলা, তারকা কেন্দ্রিক প্রশংসা এবং বিদ্রোহের মুখোশে ঘেরা রাজনৈতিক মেরুকরণ। কবি এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রশাসক হয়ে ওঠেন, যিনি তার ‘কাব্যিক সাম্রাজ্য’ রক্ষায় প্রতিযোগী কবিদের একের পর এক অপসারণ করে থাকেন। 


এই অভ্যন্তরীণ লুটতরাজের দরুণ কবিতার স্রষ্টা থেকে কবি রূপান্তর ঘটে। কবি আর স্রষ্টা নেই, কবি হয়ে গেছে এক ‘সাংস্কৃতিক কার্যনির্বাহী’, যিনি তার গোষ্ঠীর স্বার্থে দমন-পীড়ন চালান। সাহিত্য আর চেতনার মঞ্চে এ এক ধরনের কর্পোরেট সভ্যতার কেন্দ্রীভূত আদালত, যেখানে কবিতা হয় শাসনের ভাষা এবং কবিরা হয়ে ওঠেন সেই শাসকের সৈনিক, যারা মুক্ত চিন্তার গলদ ঘষে মসৃণ করে তোলে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের জন্য।


এখানে কবির কর্ম ও শাস্ত্র দুইই সম্মিলিত হয় এক প্রতারণাময় চুক্তিতে। যা সাহিত্যকে করে তোলে এক ধরনের সামাজিক অবসান, যেখানে নতুন শক্তি ও অভিব্যক্তির বিকাশের অবকাশ থাকে না এবং কবিতার খেলা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় পুরনো গোষ্ঠী, পুরনো মতাদর্শ ও পুরনো স্বার্থ রক্ষার স্বল্পভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে। কবির গোষ্ঠীগত রাজনীতি তাই অজান্তেই বিকৃত করে কবিতার মৌলিক অর্থ ও আত্মবিশ্বাসকে এবং কবিকে পরিণত করে এক ‘দুর্বৃত্ত’—যিনি প্রকৃত শিল্পীর ভান করেন, কিন্তু সত্যিকারের বিদ্রোহী চেতনাকে হত্যা করেন।


কবি আর কবিতা শুধুমাত্র শিল্পের স্রষ্টা ও সৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়; তারা সমাজের নানান অস্পষ্ট, জটিল ও বিবর্ণ রাজনীতির খেলার অংশ। কবির ঐতিহ্যগত পৌরাণিক আবরণের ভেঙে পড়া, শৈল্পিক দুর্বৃত্তায়নের অধঃপতন এবং সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ লুটতরাজ—এসব মিলেমিশে আজকের কবিকে এক সংকটময় অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই সংকট সমগ্র কবিতাজগতের; যেখানে কবিতার স্বতন্ত্রতা, ভাষার সচ্ছলতা এবং শিল্পীর স্বাধীনতা আজ সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত ক্ষমতার পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে।


শৈল্পিক দুর্বৃত্তায়ন অর্থাৎ কবির একক ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে কবিতার বিকৃত অবয়ব ধারণ। আজ কবিকে এমন এক কালো আয়নায় মুখোমুখি করেছে যেখানে তার প্রকৃত সত্তা অস্পষ্ট, ভাষার মুক্তি বাধাগ্রস্ত এবং সমাজের জন্য সত্যিকারের প্রশ্ন তোলার শক্তি সংকুচিত। কবি যখন এই দুর্বৃত্তায়নের বর্ম পরে, তখন সে একদিকে যেমন নিজেকে শত্রুর মুখোমুখি থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে তার হাতে ধরা শিল্পের অস্ত্রটি বিপথগামী হয়—এক ধরনের মিথ্যা বর্ণনায় পরিণত হয়, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।


সাহিত্য পুরস্কার, লিটফেস্ট এবং বাজারায়নের শিকার হয়ে কবিতা আজ এক পণ্য; কবি তার সৃজনশীলতাকে বিক্রি করে তার স্থিতি ও মর্যাদা রক্ষা করেন, যা এককালে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের আঙ্গিনায় জন্ম নিয়েছিল। গোষ্ঠীগত রাজনীতির অন্তরালে, কবিতার স্বাধীনতা এক মঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং শিল্পী থেকে প্রশাসক হয়ে ওঠা কবি নিজেই হয়ে ওঠেন সেই লুটতরাজের অংশীদার, যা শিল্পকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে।


কবির এই অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংকটের সংকেত। এটি আমাদের সামনে এক সতর্কবার্তা বহন করে যে, যখন শিল্পী স্বয়ং শৃঙ্খলিত হয়, সে সময় সমাজের স্বাধীন চিন্তা ও সংবেদনশীলতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কবির এ ক্ষরণ, শৈল্পিক দুর্বৃত্তায়ন ও গোষ্ঠীগত লুটতরাজ একত্রে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সৃজনশীলতার স্বাধীনতা, নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের প্রতি কবির দায়বদ্ধতা ছাড়া কবিতা হয় নিস্প্রাণ, নিঃস্ব, এবং এক ধরনের নিঃশেষ।


এই সংকটের মধ্যে দিয়েই আজ আমাদের দাঁড়াতে হবে এক নতুন চিন্তার জন্মদানে, এক নতুন কবির প্রয়োজনীয়তায়, যিনি দুর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। যিনি গোষ্ঠীগত রাজনীতির বর্ম ছুড়ে ফেলতে সাহস পাবেন। যিনি ভাষার স্বচ্ছতা ও অর্থের গভীরতায় প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। যিনি কবিতাকে পুনরুজ্জীবিত করে তার প্রকৃত স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের স্পৃহা ফিরিয়ে আনবেন। কবির ক্ষরণ একটি সম্ভাবনার সূচনা, যেখানে শৈল্পিক সততা, মানবিক দৃষ্টি এবং সমাজের প্রতি নিবেদন পুনরুজ্জীবিত হবে।


কবির শৈল্পিক দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষরণ এক অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা হলেও, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুক্তির পথ ও পুনর্জাগরণের আহ্বান। কবির যাত্রা আজকের সংকট থেকে উত্তরণের দিকে হতে পারে এক নতুন সূর্যের সূচনা। যেখানে শিল্পী আবার সমাজের চেতনা ও মননের প্রকৃত প্রেরক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং কবিতা ফিরে পাবে তার পূর্ণতা, শ্রুতিমধুরতা ও জীবন্ত প্রজ্ঞা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages