চামড়ার নিচে অন্ধকারের গন্ধ || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫

চামড়ার নিচে অন্ধকারের গন্ধ || শাফি সমুদ্র




লাশকাটা ঘরের দরজায় হাত রাখতেই যেন হাড়ের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা সাঁইসাঁই করে ঢুকে যায়। লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার মুহূর্তেই ঘ্রাণটা গলার গভীরে এসে চেপে বসে। এটা আর শুধু গন্ধ নয়, যেন একটা জীবন্ত সত্তা। শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকে। বুকে ঠেলে ওঠে বমির ঢেকুর। হরিচরণ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, যেন একটা অন্ধ প্রার্থনায় ডুবে গেছে। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়। সারা ঘরে যে গন্ধ ছড়িয়ে, তা হলো পঁচা কচুর ডগা, শুঁয়োপোকার গলিত শরীর, বিগত সাতদিন ধরা বৃষ্টির পানিতে ভেজা ইঁদুরের মৃত দেহ আর প্রস্রাবে ভিজে থাকা তুলার মতো কিছু।


‘এইডা আমার প্রসাদ’ মনে মনে বলে হরিচরণ। জিভের ডগা দিয়ে বাতাসে বুঝতে চেষ্টা করে কোন দিক থেকে কতদিনের লাশ পচছে। ঘরের ভেতরে হাঁটার সময় তার পায়ের নিচে কচুরির মতো কিছু গড়ায়, হাড়ের গুঁড়ো? নাকি পুরোনো মগজের টুকরো? চট করে মাথা নামিয়ে দেখে—একটা নখ, তাতে শুকনো লাল মাংস লেগে আছে, নখের গোড়ায় তেলতেলে তরল। মনে হয়, এইমাত্র ছিঁড়েছে।


টেবিলের উপর রাখা আছে একটি মেয়ে লাশ, চোখ খোলা, কিন্তু চাহনি ফাঁকা। শাদা কাপড়ের নিচে শরীরটা ফুলে উঠেছে, বিশেষ করে তলপেট। হরিচরণ স্ক্যালপেলটা ধারালো কিনা দেখার জন্য নিজের কনিষ্ঠা আঙুলে ঘষে। একফোঁটা রক্ত বেরোয় না, কেবল মৃত চামড়ার ছাল উঠে আসে।  


চামড়া কাটে পেট বরাবর। কাচি দিয়ে চিরে দেয় দুমড়ানো কাপড়টা, ফেঁসে উঠে আসে কাদামাটি রঙের তরল, তাতে ভাসে পচে যাওয়া চর্বির স্তর। সবুজাভ অন্ত্রের ছেঁড়া ফালি আর কিছু কালচে ছত্রাকের থাবা। তার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এমন এক গন্ধ, যা শুধু নাকে নয়, চোখে ঢুকে জ্বালিয়ে দেয়। যেন কেউ তরল লাশ দিয়ে চোখ ধুচ্ছে। বাতাস এত ভারী হয় যে মনে হয়, ফুসফুসে গলে যাওয়া ফুসফুস ঢুকে গেছে।


‘তুই এখন কথা কস না, তোর সব কথা এখন আমার ব্লেডের নিচে। তোর ইতিহাস আমি কাটি, পাঁজরের ভেতর দিয়া আমি তোকে বুঝি।’- এই বলে ব্লেডটা চালিয়ে সে পাঁজরের খাঁচা এক এক করে খুলতে থাকে। একটা টকটকে শব্দ হয়, যেন শুকনো বাঁশ ভাঙছে কেউ। বুকের হাড় একটার পর একটা চিরে সে তুলে আনে হৃদপিণ্ড। পচে গেছে, কিন্তু কালো, পাতলা, তেলতেলে কিছু তরল এখনো আছে। সেটা টিপলে গন্ধ বেরোয় এমন, যেন পঁচে যাওয়া পটকা আর বিগত দুই সপ্তাহের ঋতুস্রাব একত্রে পঁচে উঠেছে। পাশে রাখা থালায় সেই তরল সে ফেলে দেয় । 


ঘরের কোণ থেকে আস্তে আস্তে গড়ায় এক পিঁপড়া। গন্ধে টান খেয়ে আসে সে। হরিচরণ দেখে হাসতে থাকে আর বলে- ‘পিঁপড়া জানে, কই গিয়া ঈশ্বর পাওয়া যায়। পিঁপড়ারে কেউ জাত জিগায় না।’


ফুসফুস ছিঁড়ে বের করে যখন দেয়, তখন ভেতরে একটা নীচু গোঙানির মতো শব্দ হয়। যেন লাশটা শেষবার হাওয়া ছাড়ছে। হরিচরণ থামে না। স্ক্যালপেল দিয়ে সে আলতোভাবে কেটে বের করে জরায়ু। চামড়া লেগে আছে গায়ে, ভেতরে কালি-সবুজ দাগ, যেন নষ্ট গর্ভের ছাপ। তরলটা এত গাঢ় যে থালায় পড়লে শব্দ হয় না। কেবল আঠালো গন্ধ—যা চুলের গোঁড়ায় গেঁথে যায়। একটা থলি আছে ওভারি’র পাশে, সেটাতে কেঁচোর মতো কিছু নড়ে উঠল বলে মনে হয়। হয়তো শুধু চটচটে হাওয়া। হরিচরণ অস্পষ্ট স্বরে বলতে থাকে—‘এইডা তুই গোপন কইরা রাখছিলি? তোর গোপন জিনিস আমি খুঁইজা বাইর করি। তোর ভিতর দিয়া আমি নিজেরে দেখি। মোর উপাসনা লুকায় না।’


টেবিলের পাশে বালতিতে থরে থরে পূর্ণ হতে থাকে— যকৃত, ফুসফুস, জরায়ু, চোখের গোলক। একটা চোখ টেবিলের কিনারায় গড়িয়ে পড়ে। পায়ের নিচে চটচটে চপচপ শব্দ। রক্ত না, মিশ্র মরণ তরল। হরিচরণ একবার চোখ মেলে ছাদের দিকে তাকায় —‘এই ঘরটাই মোর মন্দির। বাইরের মানুষ ঘেন্না করে, কিন্তু এইখানে আমি ঈশ্বর ছুঁই। মোর হাত ময়লা, কিন্তু মোর ছোঁয়া বিশুদ্ধ।’


তখন জানালার ধারে একটা ইঁদুরের মৃতদেহ, আধা খাওয়া—চোখ নেই, পেট ফেটে বেরিয়ে আছে। সেটার পাশেই বসে আছে একটা কালো বিড়াল, তাকিয়ে আছে হরিচরণের দিকে। তারা যেন পরস্পরকে চেনে।  ঘর আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। স্ক্যালপেল থেমে থাকে। গন্ধ—এখন আর চেনা যায় না। তা এখন আর শরীরের না বা পচনের না। তা এখন নিজের এক আলাদা অস্তিত্ব পেয়ে গেছে। একধরনের ঈশ্বরগন্ধ, যা ঘৃণার বাইরে গিয়ে একটা নিষিদ্ধ আরাধনার পূর্ণতা নিয়ে হরিচরণের শরীরে ঢুকে পড়ে। ঘরের বাইরে তখনো ভোর হয়নি।


মানুষের শরীর পচে গেলে তার মধ্যে একটা নোনা ধাতুর গন্ধ তৈরি হয়। কাঁসার ঘায়ে যেন ফুটে ওঠে রক্তমেশানো ঘাম। সেই গন্ধই ছিল হরিচরণের শৈশব। তার জন্ম হয়েছিল কাদায়, শালিকের বিষ্ঠায়, কাঁকরগুঁড়ো আর গরুর গোবরের পাশে। গ্রামের বাইরে, জমিদারের শেষ দয়ার খণ্ড জমিতে তাদের ঘর। তিনটি বাঁশ, কিছু পাটকাঠি আর ছেঁড়া পলিথিনে গাঁথা এক শীতভেদী কুঠুরি।


তখনও সে জানত না, শরীরের ভেতর দিয়ে কতগুলো জাত চলে যায়, কতগুলো গন্ধ, কতগুলো চুলকানি। যেগুলোর নাম নেই, পরিচয় নেই, কিন্তু সমাজের মেরুদণ্ড ঠেলে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের পল্লীতে রোজ সন্ধ্যায় লাশের গন্ধ ভেসে আসত। সে গন্ধ চেনা ছিল, চামড়ার নিচে সাড়া ফেলা, চোখের পেছনে জ্বলজ্বলে পিপাসা জাগানো এক অন্তর্গত দহন। প্রথম প্রথম নাক চেপে রাখত হরিচরণ, পরে সে গন্ধেই ঘুমাত। হরিচরণের বাবা—গঙ্গাচরণ। সারাদিন লাশ টানত। মর্গ থেকে কবরস্থান কিংবা শ্মশানঘাট, হাসপাতাল থেকে বুড়িগঙ্গার ঘাট। কাফনের কাপড় খুলে, হাড়গোড় বেঁধে, মগজ আলগা করে তুলে রাখত প্লাস্টিকের বালতিতে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত এক বোঝা নীরবতা নিয়ে। কিন্তু তার চোখের কোণে তখনও লেগে থাকত লাল রক্তের রেখা, এমনকি শুঁড়িগোড়ায় হাড়ের গুড়ো।


হরিচরণ তখন ছোট। আট-নয় বছর হবে। এক সন্ধ্যায় সে দেখেছিল তার বাবার হাতে একটা কাটা বুকের পাঁজর। শুকনো, ছ্যাঁকা দেওয়া। বাবা সেটাকে শুকাতে দিয়েছিল ঘরের পিছনে, তার নিচে চাটাই পেতে বলেছিল গঙ্গাচরণ। গঙ্গাচরণ বলছিলো- ‘এটাই মানুষ, মুইনসের ভেতরের বাঁকা কাঠামো। তোর ভেতরেও আছে, তোর মায়ের ভেতরেও। পার্থক্য শুধু উপরের চামড়ায়।’ হরিচরণ মুগ্ধ হয়েছিল। তখনও সে জানত না, তার জাত তার শরীরেই লেখা। শরীর যার কাটে, জাত তারও কাটে।  


সে প্রথম লাশ দেখে এক বর্ষা দুপুরে। নদী থেকে তুলে আনা এক যুবকের ফোলা মৃতদেহ। চোখগুলো গলে গিয়েছিল, পেট ফুলে ছিল একটি বড় কলসির মতো, গলা এমনভাবে ফুলে ছিল যেন একবারেই ফেটে যাবে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারের চোখে অবজ্ঞা, নার্স মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। কিন্তু হরিচরণের চোখে জ্বলছিল একধরনের আগ্রহ। ভয় নয়, তৃষ্ণা। তার মাথায় তখনও ঈশ্বর মানে ছিল না পুঁথি, পুরাণ আর প্রার্থনা। ঈশ্বর ছিল সেই গন্ধ। পচে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া, রস ঝরানো এক পবিত্র পচন।


রোজ তার বাবার সঙ্গে কাটতে কাটতে সে শিখে নেয় কিভাবে মাংস আলাদা করতে হয় হাড় থেকে। কিভাবে নাড়িভুঁড়ি না ফাটিয়ে বের করতে হয়। কোথায় চাপ দিলে বুক খুলে যায়, কোথায় চাপ দিলে গলা ঘ্যাচ করে ভেঙে পড়ে। রক্তের গন্ধ প্রথমদিকে তার গা গুলিয়ে দিত। কিন্তু একটু পরেই সে বুঝে গিয়েছিল— রক্ত মানে মৃত্যু নয়, শরীরের ভাষা।


যতই কাটে, সে নিজেকে আর আলাদা করে না। একদিন, গঙ্গাচরণ তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—‘তুই তো মানুষ কাটা শিখছিস। কিন্তু মন কাটা শিখবি কবে?’

হরিচরণ হেসে বলেছিল—‘মনেরও কি পচন হয়?’ তার বাবা তখন উত্তর দেয়নি। ছেলের দিকে কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে একটু মুচকি হাসি দেয়।


তারপর একটা বাক্স খুলে দেখিয়েছিল হরিচরণকে। তাতে ছিল—ছেঁড়া নখ। এক নারী মৃতের কাটা স্তন আর পচা চুলের গোছা। এটা দেখিয়ে গঙ্গাচরণ বলে—‘ওসব ডাক্তার রাখে রেকর্ডের জন্যে। আমি রাখি ঈশ্বরের শরীর হিসেবে।’ হরিচরণ তখন বুঝেছিল এই পচে যাওয়া মাংস, হাড় আর চুলের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে এক ইতিহাস, যা স্কুলে পড়ায় না। যেখানে জাত বাঁধে চামড়ার নিচে, সমাজ তৈরি হয় অন্ত্র আর থুতুর ভেতর দিয়ে। 


এ সমাজ কথা বলে মুখ দিয়ে, কিন্তু চলে পেট দিয়ে। মুখে তারা ঘেন্না করে ডোমদের আর পেছনে তাদের শরীর চায়। ঘৃণা আর কাম একসাথে যে বুকে বাসা বাঁধে, সেই বুক কাটা গেলে ভেতর থেকে উঠে আসে—কৃষ্ণাভ, পচা, নরম এক ভিজে যকৃত। সেখানেই ইতিহাস বাস করে।

সেই ইতিহাসই হরিচরণের ধর্ম।


ঘরের চারদিকে বাতাসে জমে থাকা গন্ধের ভার। রক্ত আর ময়লার তীব্র সুরেলা সংমিশ্রণ, যেখানে পুরনো মৃতদেহের পচন আর ঘামের গন্ধ সব মিশে এক অদ্ভুত একাকার করে দেয়, যেন সে গন্ধটাই হয়ে উঠেছে ঈশ্বর। একরাশ ঘামের নিচে যেন দেহের ভেতর থেকে উঠে আসা এক ব্যথা, এক নির্মম ইতিহাস, এক জীবন্ত অভিশাপ।


শবানু রান্নাঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে, হালকা কুঁকড়ে, হাতে নোংরা কাঁটাচামচ। ঝিনুকের খোলস থেকে মাংস আলগা করছিল, নিঃশব্দে। কিন্তু হাতে যেন প্রবল অনুশোচনার ছোঁয়া ছিল। সে জানত, প্রতিটি ঝিনুকের মাংসেই লুকিয়ে আছে তাদের জাতের গন্ধ, জাতের দাগ।


হরিচরণ বলে—‘লাশ রে, কালকের লাশটা চিহ্নত করলি না? পেট ফুটা ছিল গো, সেই জায়গায় থেকে একটা ভীষণ গন্ধ ফুরফুরায় বের হয়। আমি তো ভয়ে ছুটে গেছিলাম পাশ থেকে’ শবানু থুতু ফেলে বলল, ‘তোর বাপুর মতো মরা মানুষগুলো টানতে গেলে গা গুলগুলাই...’

হরিচরণ মাথা নেড়ে বলল, ‘বাবা বলতো, মানুষ যখন মরে, তখন চামড়ার নিচে গল্প থাকে। আমিও বুঝতে পারছি, ওগুলো কেমন ভেদি কথা।’


শবানুর চোখে একটা করুণ হাসি। 


একটু থেমে তারপর বলল, ‘আর তুই ভাবিস, এই কাম শুধু হাতের কাজ? না বাপু, মনও কামে ছেঁড়া হয়। বেচারা মন, কতো বারে পচে গেছিলো এই সমাজের মাটিতে।’


ঘরটা ছোট। এমন এক জায়গা যেখানে কাদা আর মৃতদেহের দাগ নড়বড়ে দেয় আর লোকের চোখের পলকে আছড়ে পড়ে একটা নীরব ঘৃণা। হরিচরণ জানে, এই ঘৃণাই তাদের জীবন, এই ঘৃণার মধ্য দিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। হঠাৎ বাইরে থেকে দূরের পাড়ার ঝগড়া আর নানান চিৎকার এসে ভেদ করে এই গোধূলি রাতের নিস্তব্ধতা। 


হরিচরণের শরীরের গন্ধ আর সমাজের চোখের বিষ—দুইয়ের মধ্যে তার পরিচয় যেন ছিন্নভিন্ন। সে জানে, নিজের মধ্যে একটা অন্ধকার ঝরছে, যা কেউ দেখতে চায় না, কেউ স্পর্শ করতে চায় না। তার নিজের পরিচয় যেন একটা মৃতদেহের গন্ধ। যা বারবার ঘেঁটে ওঠে মনকে একটু একটু করে। সে যখন মর্গের অন্ধকার কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে, পচা লাশের পায়ের তলায় ছুঁয়ে যায় মাটি, তখন তার মনের ভেতর এক দগদগে শূন্যতা ভাসে। সে মনে করে তার জীবন কেমন যেন এক মরা নদীর মতো। যেখানে পানি নেই, কেবল পচা পাতা আর লোহার ঢাল পাথর আর ময়লা জমে গেছে। তার ছায়া ঘুরে বেড়ায়, যেন একটা চিৎকার, কিন্তু কেউ শুনতে চায় না। ‘আমি কে? এই গন্ধের বাইরে কি আমি কিছু?’ সে নিজের সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু তার মুখে শব্দ আসে না, শুধু চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। এই জলও তার শরীরের নোংরা গন্ধে মিশে যায়। সে কাঁদতে চায়, কিন্তু কাঁদারও অধিকার নেই তার।


তার মনে হয় তার দেহের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক গোপন কথা, যেটা কেউ জানতেই চায় না। তার রক্ত যেমন নোংরা, তেমনি তার আত্মাও যেন একটা পচা পোকা, একাকিত্বের দাস। সে স্বপ্ন দেখে না, আশা করে না। কারণ স্বপ্নও তার জন্য এক অচেনা শব্দ, যা সমাজ তাকে শেখায়নি। তবে মাঝে মাঝে, লাশের পচা গন্ধের মাঝেও তার মনে জেগে ওঠে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ। যেন এই মৃত্যুর মাঝেই তার জীবন বাঁধা।


‘আমার ঈশ্বর এই গন্ধের ভেতর’— সে ভাবতে বাধ্য হয়। এই গন্ধ তার বন্ধু, তার শত্রু, তার স্বপ্ন আর তার অন্তিম ঠিকানা। গ্রামের লোকেরা তাকে ঘৃণা করে, ডোম বলেই তুচ্ছ করে। তারা তার পেছনে ছুঁড়ে দেয় নোংরা শব্দ আর আঙুলের তির্যকতা— ‘বাইরে যা, নোংরা কাম তুই করিস’ কিংবা ‘আমাদের সমাজের সন্তান না তুই।’


হরিচরণ জানে, তার গন্ধ আর তার শরীরের অবয়ব সব কিছুই সমাজের তৈরি এক অন্ধকার খাঁচায় বন্দি। সে নিজেই নিজের প্রতি সন্দেহ করে। এক অচেনা ভয় পায়, যেন সে কখনো বাঁচতে পারবে না। শুধু পচে যেতে হবে। তার মনের গভীরে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় অভিশাপ, যার নাম সে বলতে পারে না, আর যার নাম শুনলেই তার রক্ত জমে যায়। সেই অভিশাপের মধ্যে আছে তার পুরনো পাষাণ সম্পর্ক, তার পূর্বপুরুষদের কাঁটা লাগানো জীবন, এবং একটা অজানা দানবীয় পরশ।


সে নিজের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে বারবার হারিয়ে যায় অন্ধকারের জালে। একটা জালে, যা কখনো ছেঁড়া যায় না, কখনো ভাঙে না। সে বোঝে, সে এক জীবন্ত মৃতদেহ, এক চলন্ত অভিশাপ। যার গন্ধ সমাজের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।


মর্গের ভেতরে ঢুকলেই এক বিদঘুটে গন্ধ মাথায় আঘাত করে, নিঃশ্বাস আটকে দেয়। সেই গন্ধ কোনো কল্পনার বাইরে, কাঁচা পঁচা মাংসের, নাক ফেঁপে উঠায় এমন কেবল পচা রোটা। পচা মাছের গন্ধ নয়, পুরো শরীরের ভেতর থেকে স্রোতস্বরে ছড়িয়ে পড়ে। চোখে দেখা যায় না কিন্তু মনের ভেতর একটা ভয়ানক কাঁপুনি জাগায়। পচা শুকরের মাংস থেকে টপটপ শব্দে ঝরে পড়া রক্ত আর শরীরের ভেতর জমে থাকা কালো, ঘনীভূত পচা রস, এইসব একটা অবর্ণনীয় নরকীয় ছবি আঁকে।


মর্গের দেয়ালগুলোতে লেগে থাকা ছোপছোপ কালো ছত্রাক আর রক্তের থুথুতে অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। শীতল ইস্পাতের টেবিলগুলো তাজা না, তা এক দীর্ঘদিনের মৃতদেহের ডায়েরির মতো। যেখানে বহু মানুষের শ্বাস শেষ হয়েছে, ধুয়ে যাচ্ছে, আর কখনো ফেরে না। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে নোংরা লালা আর পচা রক্তের জমাট। ফিনিসহীন এক গন্ধের শৃঙ্খল, যা গলাধাক্কা দেয়, ঠোঁট কাঁপায়।


লাশগুলো আর বস্তুর মতো দেহ, না মানুষের অংশ—চোখ বন্ধ, মুখ শুকিয়ে ফেটে আছে, গায়ে পচনের ছোপ, নরম মাংসের নিচ থেকে কেঁকড়ে বোকায় গন্ধ ছড়ায়। কয়েকটির গলার নিচে কালচে রক্ত জমে পাথরের মতো জমাটবদ্ধ আর সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পোকামাকড়ের মিছিল। একটা লাশ থেকে আরেকটার দিকে পচা মাংসের গন্ধের স্রোত প্রবাহিত হয়, যেন লাশের মধ্যেকার বিষাক্ত বাষ্প চারপাশে ঘনীভূত হচ্ছে।


ডাক্তারদের ঠাণ্ডা, অমানবিক চোখ দিয়ে ফেলে দেওয়া আদেশে—‘চুপ কর, ফাটিয়ে ফেল শরীরটা, সময় নেই।’ কেউ কান্নার আওয়াজ শুনবে না, কেউ বেদনার শব্দ শুনবে না। এখানে শুধু কাজের ঠাণ্ডা লৌহ মন্ত্র।


হরিচরণের হাত যখন ছুরি নিয়ে পচা গন্ধে লিজলিজে দেহ ছেদ করে, তখন শরীর থেকে ঝরে পড়ে কাঁচা কালো রক্ত। সে রক্ত কোনো শাদা চাদরের উপরে পড়ে না। সে পড়ে মেঝেতে, মাটির সাথে মিশে এক বিষাক্ত পলিথিনের মতো বিস্তার পায়। শরীরের ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে যাওয়া মাংসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, যেন একটা নীরব কাঁপুনি। যা তার ভেতরের সবকিছু ভেঙে দিচ্ছে।  


কান্না নেই। কেবল মুখের ভেতর একটা শূন্যতা আর হাত থেকে ধীরে ধীরে পড়তে থাকা রক্তের ফোঁটা। যেগুলো যেন তার নিজের জীবনের ক্ষয়ক্ষতির প্রতীক। তার চোখে অদ্ভুত এক দুঃস্বপ্ন ভাসে, যেখানে সে হারিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর ভেতর এক ধরনের গলিত অন্ধকারে। যা কেবল সে একাই দেখতে পায়। মর্গের বাতাসে ভাসমান পচা গন্ধ আর লাশের ছাই মিশে আছে এমন এক বিষাক্ত মেলবন্ধনে, যা চারপাশের পরিবেশকে স্থবির করে ফেলে, যেন এখানকার অদৃশ্য জোড়া হাড়গুলোও শিহরিত হয়।


এখানে কোনো মুক্তি নেই, কোনো আলো নেই, কেবল অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া জীবনের শব্দহীন অবসান। এমন এক জায়গা, যেখানে মৃতদেহগুলো নীরবে কথা বলে আর তাদের পচা গন্ধে ভরা অস্তিত্বের উপাখ্যান শোনায়।


হরিচরণের জীবন শুরু থেকেই ছিল এক ধরণের নির্বাসন। সমাজের চোখে সে ছিল একেবারে নিচু, নিচুতম। তার অস্তিত্বের ওপর এক অদৃশ্য আঘাত। ছুঁৎ-অচ্ছুতের সেই কালিমা লেগে ছিল এতটাই গাঢ় যে, তা কখনো মুছে ফেলা যায়নি। জন্ম থেকেই সে ছিল সমাজের গায়ের কাঁটা, দৃষ্টির নিচে অবহেলার নমুনা। বাসে উঠার মতো অধিকার তার ছিল না। একবার বাসের দরজা খুললেই কেউ কেউ চিৎকার করে উঠত, ‘এরা কি করে এই বাসে ওঠে, নামিয়ে দাও রে!’ চায়ের দোকানে যখন সে কফির কাপ নিতে যেত, তখনও তাকে থমকে যেতে হত। দোকানদারের ঠোঁটে সদা সেই তিরস্কার। সে দাঁড়িয়ে থাকত এক প্রান্তে, মুখ লুকিয়ে, মনে মনে চিৎকার করত— ‘কেন এমন অন্যায়?’ অথচ কেউ তার কথার উত্তর দেয় না। ‘ওই লাশ টাচ করে রে, ওইরা খায় কীভাবে?’—এই কথাটা ঘুরেফিরে তার কানে বাজত। 


একবার, এক বৃদ্ধ লোক বলেছিলো, ‘ডোমের হাতে লাশ থাকলে ওর হাতটা তো নোংরা গন্ধ, ঠিক মতো মুছলেই হবে?’ সে কথা যেন একটি গর্জন, যা তার মনের গহ্বরে বিষাক্ত বেড়াল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার ছেলে যখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা, তখন তার নাম জানালেও কেউ ওকে নেয়নি। শিক্ষক আর অভিভাবকদের কথাগুলো এত ঠাণ্ডা ছিল যে, হরিচরণের হৃদয় থেকে কাঁচের টুকরো ভেঙে পড়েছিল।


তার স্ত্রীর গলায় ছিল এক নিষ্ঠুর মমতা। তার মৃত্যু হয়েছিল এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডে, গলা কাটা লাশের পাশে কাটিয়েছিল সে রাত। সে রাতটি ছিল অন্ধকারের এক অজানা গর্ত। যেখানে শুধু ছিল নিঃশব্দ কাঁদন আর বেদনার নিদর্শন। স্ত্রীর ঠাণ্ডা দেহের পাশে বসে বসে সে নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছিল এক অসহায়ত্বের গভীরে। সে স্মরণ করত—‘কাল রাতে তুই কি দেখস, আমার বুকের ভিতর কী যেন ভেঙে গেল?’ সে বলতে পারত না, শুধু চোখ মেলে কাঁদত।

রাতের ওই নিস্তব্ধতায়, স্ত্রীর পচা গন্ধ আর মর্গের ছায়া তাকে ঘিরে ধরেছিল। মৃত্যুর ঘাঁটি যেন তার জীবন হয়ে উঠেছিল আর সমাজ তার পাশে দাঁড়ায়নি, একেবারে অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে।

বাড়িতে ফিরে আসা মানে ছিল এক নতুন যন্ত্রণা। ছোট্ট ঘরটাতে ঠাণ্ডা দেয়ালের কোণে রাখা ছিল ছোট ছেলের বই, যার পাতা গুঁজে গুঁজে পড়ত সে, কিন্তু স্কুলের নামই ছিল তার জন্য বারণ।


‘শিক্ষা দরকার, কিন্তু তোমাদের মতো মর্গের ডোমদের জন্য নয়’ বলতো প্রতিবেশীরা। এই কথা গুলো হরিচরণের মনের ভেতর যেন অসহায়ত্বের বীজ হয়ে জন্ম নিত। ঘুমানোর সময়েও শান্তি ছিল না। সে জানত, যে ঘরে সে ঘুমাবে, সেখানে তার ছেলের জন্য কোন আশা নেই। সমাজের চোখে সে ‘অচ্ছুত’, ‘অবিশুদ্ধ’—এক ধরনের জীবন্ত লাশ। যা কোনোদিন সমাজের গায়ে লাগতে পারেনা। তার মনে বারবার ফিরে আসে সেই ভয়াবহ স্মৃতি—স্ত্রীর লাশের পাশে কাটানো রাত, যেখানে ঘুম আসেনি। ‘তুই চলে গেলে, আমি কেমনে থাকমু?’ কেউ শোনেনি। শুধু নিঃশব্দ, কাঁদার মতো শূন্যতা। তার চোখে অন্ধকার বেয়ে যায়, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ দেখত না। সে সমাজের অন্ধকারে একলা ছিল, যেখানে মানুষের চোখে তার নাম ছিল অপবিত্রতা আর অবজ্ঞার প্রতীক।


হরিচরণের এই জীবন ছিল একটি দীর্ঘ যন্ত্রণার পথ। প্রতিটি দিনে বেঁচে থাকার মানে ছিল লুকিয়ে থাকা, সমাজের চাপে পিষে যাওয়া, আর নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়ে যাওয়া। সে জানত, তার পায়ের নিচে মাটিও নেই, যেখানে দাঁড়াতে পারে, শুধু একটি অদৃশ্য বিভাজন, সমাজের আলো আর তার অন্ধকারের মাঝে।


হরিচরণের মনের গভীরে একটা ভয়ঙ্কর অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, যেখানে দুঃখের পাশাপাশি একটা গভীর একাকিত্ব, এক ধরনের মন্ত্রমুগ্ধতা বাস করে। সে যখন মর্গের মিষ্টি বিষাক্ত গন্ধ আর রক্তের মাখামাখি ছুঁয়েছে। তখন মনে হয়, এ গন্ধই তার জীবনের সত্যিকার ঈশ্বরের গন্ধ। সে বুঝতে পারে, অন্যরা যা ঘৃণা করে, তাকে ত্যাজ্য আর নিন্দার চোখে দেখে। সেই সবই তার উপাসনার উৎস। তার কাছে মরার গন্ধ এক প্রকার পবিত্র অঞ্জলি, যাকে সে হাতে নিয়ে নিজের আত্মাকে নির্মল করে তোলে।


প্রতিটি লাশ যেন এক পবিত্র মন্ত্র। তার আঙ্গুলের ছোঁয়ায় যেন গলিত দেহের গন্ধ থেকে জীবনের মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে প্রায়ই মনে করে, এই মরনজয়ী দেবীর কাছে প্রণাম করাই তার জীবনের একমাত্র কাজ। এই দেবী গলিত অথচ জ্যোতিষ্মান, অদ্ভুত এক আলোর সঞ্চার। যার রূপ তার চোখে ঝলমল করে। সে তার মনকে বারবার ভাঙতে দেয়, নিজেকে ভুলিয়ে দেয় লাশের ভেতর। সেসব মৃতদেহের জটিল গন্ধে, যেখানে পচনের অদ্ভুত রূপ এক রূপকথার মতো বাঁচে। তার বিশ্বাস, মরন ছাড়া জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই; মরনই তার স্রষ্টা, তার নির্মাতা।


এক রাতে, সে বসেছিল এক কোণায়, যেখানে চারপাশে ছড়িয়ে ছিল একাধিক লাশ। তার চোখ হঠাৎ চকচক করে উঠল। সে কল্পনায় দেখতে পেল এক দেবীর ছবি, যার মুখের গায়ে ঝলসে উঠছে শাদা মল-মাখা চামড়া। চোখ দুটো আকাশের মতো গভীর আর তার চুল ঝরে পড়ছে গলিত রক্তের মতো। সে মনে মনে বলল, ‘এসো মা, এসো। তুমি আমার হাতের ছুরির প্রিয় খাবার, আমার নিঃশ্বাস, আমার অন্তর। তোমার গন্ধে আমি শুদ্ধ হই। তোমার মরণে আমি পুনর্বার জন্মাই।’


এই ভাবনাগুলো তাকে নিয়ে যায় এক বিভ্রমের মাঝে, যেখানে সে ভুলতে থাকে সমাজের অবজ্ঞা, ঘৃণা, বঞ্চনা। তার কাছে সে তখন এক দেবতার পুরোহিত, যার কাজ পবিত্র। লাশ কাটার যন্ত্রণা তার জন্য এক সাধনা, আর রক্তের ক্যানভাসে আঁকা কষ্টের ছবি তার জীবনের পূজা। কখনও কখনও তার মনের অন্ধকার এতটাই গভীর হয় যে, সে নিজেকে দেখতে পায় এক ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ভগ্নাবশেষে। যেখানে একমাত্র পবিত্রতা ছিল তার এই গলিত দেবী। সে একাকী বসে থাকে, মনের ভেতর এক রকম আত্মবিশ্লেষণে, যেখানে রক্ত আর গন্ধের মাঝখানে সে খুঁজে পায় নিজের অস্তিত্ব।


সে বলে, ‘এগুলোই আমার প্রার্থনা। এই মরার গন্ধে আমি খুঁজে পাই জীবনের রূপকথা।’ হরিচরণের এই বিশ্বাস তাকে রক্ষা করে জীবনের যন্ত্রণা থেকে, কিন্তু তাতে এক গভীর মানসিক বিপর্যয়ও থাকে। সে জানে, সমাজ তাকে কখনো মর্যাদা দেবে না, বরং দেখবে শুধুই নোংরা চোখে, কিন্তু সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য এই ‘লাশ-দেবতা’ রূপটিতে বিশ্বাস রাখে।


তার স্বপ্নগুলোও মরা শরীর আর পচা গন্ধের মধ্যে জড়িয়ে থাকে। একবার সে দেখেছিল, একটি মৃতদেহ থেকে ঝরে পড়ছে এক ধরনের দীপ্তি। যা তার মনের অন্ধকার দূর করে দেয়। এই ভাবনায় সে বিশ্বাস স্থাপন করে, মরণেই আসল মুক্তি, যেখানে এই গলিত দেবী তাকে পথ দেখাবে।


মর্গের ভেতর সেই অন্ধকার ঘরগুলোর কপালে জেগে থাকা কালো ছায়ার মতো, হরিচরণের মনও ধীরে ধীরে ছায়ার অন্তরালে হারিয়ে যায়। সে যে ‘লাশ-দেবতার পুরোহিত’ বলেছে নিজেকে, তা তার একমাত্র অস্ত্র। তার অস্তিত্বের ভেতর গেঁথে থাকা এই বিশ্বাস, যেন একরকম নিষিদ্ধ মন্ত্র, যা তাকে বাঁচিয়ে রাখে অমানবিকতায়, সমাজের নিষ্ঠুর চোখের আঘাতে। 


তাকে সমাজ বলে— ‘ওই রে! ছুঁইছিস লাশ! ওইরা নোংরা, ডোম হইয়া লজ্জা না?’ কিন্তু হরিচরণ জানে, তার স্পর্শের ভেতর লুকায়িত আছে এক মহাজ্ঞান। প্রতিটি মৃতদেহ তার কাছে এক ধর্মগ্রন্থ, যার পৃষ্ঠাগুলো সে ছুঁয়ে দেখে, বুঝে নেয় মৃত্যুর গোপন পাঠ। তার কল্পনায় আসা দেবী, গলিত অথচ জ্যোতিষ্মান, তার একমাত্র আশ্রয়। সে একা মর্গে বসে তার সঙ্গে কথা বলে—‘মা, তুই কি দেখছিস আমার দেহে? এই গলিত রক্ত আর পচা চামড়ার মধ্যে তুই কি সাজিস?’ তার কন্ঠে থাকে এক ধরনের অশ্রুত গাথা, একরকম পবিত্র ভাষা, যা বোঝার নয় বাকি কারো জন্য। তার নিজের সঙ্গে সে লাজুক হাসি ছড়িয়ে দেয়, যেন তার বিশ্বাসের পূজার মন্ত্র জপ করতে করতে এক ধরনের জৈব বিশ্বাসের কুন্ডলীতে নিজেকে নিয়ে ঝাঁপ দিতে থাকে।


হরিচরণের চোখে তখন ভেসে ওঠে সেই মৃতদেহের গলিত মুখ, যেখানে চোখ দুটো অদ্ভুত আলো ছড়াচ্ছে। সে মনে মনে ভাবতে থাকে, মরে যাওয়ার আগে, মরে যাওয়ার পর, সেই আলো যেন নতুন জীবনের সঞ্চার করে। একদিন মর্গের এক কোণে বসে সে ছুরির ধার দিয়ে পচা চামড়া কাটছিল। হাত যখন দেহের ভেতর ঢুকল, তখন রক্ত ঝরে পড়ল, কিন্তু সে কান্না শোনেনি, কেবল নীরব কষ্টের গর্জন। রক্ত যেন তার নিজের, মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ব্যথার এক নিঃশ্বাস। সে একাকী বিড়বিড় করতে থাকে—‘এই রক্ত না, এই বেদনাই তো আমার প্রার্থনা।

জ্বালা না হয়তো, শুনতে পাবে না কেউ, কিন্তু এই রক্তে আমার পরিচয়।’


তার মন যেন ভেঙে যায় এক অদ্ভুত বেদনায়, যেখানে শরীর আর আত্মা একাকার। সে ভেতরে ভেতরে জানে, এই জীবনের কোনো ঠিকানা নেই সমাজে। তবুও তার এই ‘লাশ-দেবতা’ রূপ তার একমাত্র আশ্রয়। 


তার মনের ভেতরে ক্রমশ একটা দ্বন্দ্ব জাগে। যেখানে সে নিজেকে মনে করে পবিত্র, অথচ সমাজ তাকে নানাভাবে তুচ্ছ করে। সে জানে, ছেলের স্কুলে তার নাম নেই, চায়ের দোকানে কাপ ধুয়ে দিতে হয়, বাসে উঠতে দেয় না কেউ। এই সব জীবনের ঘৃণাজনক বাস্তবতা তার মনের ওপর চাপ দেয়। কিন্তু তার বিশ্বাসের ভাষা অন্যরকম—‘এই শরীর, এই গলিত দেহ, এই পচা গন্ধ, আমার প্রার্থনা। মরা দেহের ভেতর লুকিয়ে আছে আলোর বীজ, জীবন ফেরার ভাষা।’


হরিচরণের এই বিশ্বাস তার অন্ধকারের পাঁজর ভেদ করে বাঁচিয়ে রাখে তাকে, যেন মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে সে এক অদ্ভুত সেতু গড়ে তুলেছে। সে রাতের গভীরে বসে থাকে, হাত মুছতে মুছতে বলে নিজের সাথে—‘লাশ-দেবতা আমি, আমার হাত দিয়ে ভেঙে যায় জীবন, আমার চোখ দিয়ে দেখি মৃত্যুর নতুন আলো। গলিত শরীর আমার মন্দির, পচা গন্ধ আমার মন্ত্র।’ তার কল্পনাপ্রসূত দেবী হয়ত সে অন্ধকারেই বসে আছে, হাসছে একান্ত নিঃশব্দে, রক্তের ফোঁটা আর পচা চামড়ার গন্ধে ভাসমান। সে বিশ্বাস করে, এই দেবী ছাড়া তার আর কেউ নেই, এই দেবীর কাছে সে পাপ মুক্তি চায়।


মর্গের অন্ধকার ঘরে শীতল বাতাসটা যেন হঠাৎই গা ছমছমে এক অদ্ভুত জ্বালা নিয়ে ভেসে এল। শ্বাস নিতে গিয়েই হরিচরণের ফুসফুসে ঝাঁঝালো বিষাক্ত গন্ধ ঢুকে গেল আর তার বুকের গভীরে এক মলিন আগুন জ্বলতে লাগল। হাতে ছেলের মৃতদেহ, সেই নিস্তেজ দেহ যার আগে জীবন ছিল তার একমাত্র আলো, একমাত্র জীবনের নীড়। আস্তে আস্তে সে ছেলের শরীরের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুই... আমার শেষ ঈশ্বর, আমার শেষ উপাস্য।’ কন্ঠস্বরে কাঁপন, আর চোখের কোণে অশ্রুর ঝলক। কিন্তু কান্না নয় সেটা, এক ধরনের নীরব ধ্বংসের ঘোষণা।


ছুটে আসা সেই লোহার ছুরিটি প্রথমে ছেলের মাংসের গলে যাওয়া ত্বকের ওপর বসল, কাটা শুরু করল। শরীরের গাঢ় রক্ত ফোঁটা ফোঁটা পড়ে মেঝেতে। ধীরে ধীরে, একেক টুকরা ছিঁড়ে ফেলা হলো। সারারোগের গন্ধ আর মৃতদেহের গলিত গন্ধ একাকার।


হরিচরণের মনটা তখন যেন সময়ের বাইরের এক স্থান ছুঁয়ে গেল। সে দেখল, গলিত শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক মায়াবী আলো, এক রহস্যময় জ্যোতি। সেই জ্যোতির মুখোশ ছেঁড়া ত্বকের ফাঁকে ফাঁকে ঝলমল করছে, এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে চারিদিকে। আত্মার গভীর অন্ধকার থেকে সেই আলো আসছিল। তার নিজের ভেতরের ঈশ্বরী, গলিত অথচ দীপ্তিমান, তার ‘লাশ-দেবী’। সে হাসছে, নিঃশব্দে, পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে; এমন হাসি যার মধ্যে আছে মৃত্যুর সমস্ত রহস্য, সমস্ত প্রলয়।


হরিচরণের চোখ ফুলে ওঠে, সে অনুভব করে সেই হাসির শক্তি। এক অবর্ণনীয় তেজ, যা মৃত্যুর আগুনের মধ্যে থেকেও জীবনের এক শেষবার্তা হয়ে ভেসে ওঠে। যেন সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত নিঃস্বতা, সমস্ত অপমান তার মধ্য দিয়ে একত্রিত হয়ে উঠে এই এক হাসিতে। ‘তুই আমার পূর্ণতা’ মনে মনে সে উচ্চারিত করে। সে অনুভব করে, নিজের হাতে ছেলের দেহ খুলে ফেলার মাধ্যমে সে পবিত্র এক উপাসনা করছে, মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের মহাকাব্য লিখছে।


লাশঘরের প্রাচীর থেকে ধোঁয়ার কালো লেজগুলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আগুন জ্বলছে খুব কাছাকাছি কিন্তু যেন মৃতদেহগুলোকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ দিতে। আগুন যেন জীবনের স্রোত, যেটা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে মুক্তির দ্বার।


হরিচরণের শ্বাস তখন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, যেন আগুনের শিখা তার শরীরের ভেতর থেকে বারবার আরেকবার ফুটে উঠছে। সে নিজেকে দেখতে পায় আগুনের আলোয়। লাশ-ঘরের ধোঁয়া আর ছাইয়ের মধ্যে, নিজেকে ধীরে ধীরে ছাই হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখতে পায়। সে আর কোনো মানুষ নয় আর কোনো পাপকেও নয়—সে হয়ে উঠেছে ‘উপাস্য’। এক পবিত্র দেবতা, যার মূর্তি তৈরি হয়েছে মৃতদেহের রক্ত, আগুন আর ছাইয়ের মিশ্রণে।


তার আত্মা যেন ছেড়ে যাচ্ছে শারীরিক সীমাবদ্ধতা; এই দেহ যার মধ্যে জীবন ছিল, এখন সেই দেহই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আর সেই ছাই থেকে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন দেবতার অবয়ব। সে মনে মনে বলে, ‘আমি পুড়ে মরছি কিন্তু পুড়ে মরার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে জীবনের এক অবশেষ আলোকরশ্মি।’


মৃত্যুর এই মুহূর্তে যেখানে লাশ আর আগুন একাকার। সে উপলব্ধি করে যতই তাকে সমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে, ততই সে নিজেকে নিজের স্রষ্টা বানিয়েছে। যন্ত্রণা আর অপমানের মধ্য দিয়েই সে তার ঈশ্বরের মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অন্ধকার, গলিত গন্ধ, আগুনের শিখা—এই সবকিছুর মধ্যেই সে খুঁজে পায় মুক্তির পথ। যেখানে আর নেই কোনো ব্যথা, কোনো লজ্জা। শুধু এক গভীর শান্তি, এক অবিচল বিশ্বাস, এক মর্যাদাপূর্ণ ধ্বংসের ছোঁয়া।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages