আধুনিক বাংলা কবিতার পরিসরে কবি আউয়াল আহমদের আগমন যেনো এক অন্তর্ভেদী, নির্জন আত্মসমীক্ষার হঠাৎ-সচেনতা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’ একটি ব্যক্তিগত আবহ, এক নিভৃত উপনিষদ, যেখানে বৃষ্টি শুধু একটি প্রাকৃতিক উপাদান নয়, বরং এক ধ্রুপদী প্রতীক—স্মৃতি ও বিস্মৃতির, প্রত্যয় ও প্রতিস্মরণের, বিচ্ছেদ ও বুননের দ্বৈতজীবনের এক অনুচ্চারিত প্রতিস্বপ্ন। এই কাব্যগ্রন্থে কবির একান্ততা একা নয়, তা পাঠকের আত্মবিশ্লেষণকেও সমান্তরালে টেনে আনে, যেখানে পাঠক নিজেই বৃষ্টির মধ্যে ‘ভিজে’ গিয়ে হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।
আউয়াল আহমদের কবিতার স্বর মূলত আত্মালাপিক, একাধারে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক, অথচ উন্মোচনহীন। তিনি আমাদের সামনে এক স্বরের নৈঃশব্দ্য এনে দেন, এক দুর্বোধ্য অথচ তীব্র ভাষিক ব্যাকরণবিরোধের মধ্য দিয়ে, যা একান্ত অভিজ্ঞতার একান্ত ভাষা হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে। তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে আমরা একটি কাব্যভাষার ভেতরে আটকে পড়ি—যা কখনো বৃষ্টির মতো পলিফোনিক, কখনো তার অনুপস্থিতির মতোই নির্বাক। এই অবস্থানেই তাঁর কবিতা বাংলা আধুনিকতাবাদী কবিতার প্রবাহ থেকে সরে এসে গড়ে তোলে এক নিজস্ব অ-প্রবাহ, যেখানে মূর্ছনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছায়া।
বাংলা কবিতার আধুনিকতাবাদী প্রবাহ উনিশ শতকের উত্তরভাগে যে শহরভিত্তিক নগরসচেতন, বুদ্ধিবৃত্তিক, আত্মপীড়িত এবং ভাষাবীক্ষণনির্ভর ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিল—তার আত্মার অভ্যুদয় ঘটে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে। কবিতার শরীর তখন ভাষা ও ব্যঞ্জনার পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। এই প্রবাহে যখন একদিকে জার্মান এক্সপ্রেশনিজম, ফরাসি স্যুররিয়ালিজম এবং লাতিন আমেরিকান পরাবাস্তবতার প্রতিধ্বনি, তখন অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশীয় নিজস্ব ভাষিক ও ঐতিহ্যচেতনার আলো-আঁধারিও ধরা পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমবঙ্গের শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, দীপেন ভট্টাচার্য, বিনয় মজুমদার এবং বাংলাদেশের মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরীয়ার, শান্তনু চৌধুরী, সুহৃদ শহীদুল্লাহ, কামরুল হুদা পথিক, প্রমুখ ৭০ থেকে ৯০ দশকে তাঁদের নিজ নিজ কাব্যশৈলীতে প্রতিষ্ঠিত হন।
এই পর্যায়ে, কবিতায় স্পষ্ট হয় দুটি ভিন্ন অভিঘাত—একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, আরেকটি ভাষার আভ্যন্তরীণ ব্যাকরণ ভাঙার প্রয়াস। পশ্চিমবঙ্গে জয় গোস্বামীর ‘ঘুমিয়ে পড়ো, শহর’ কাব্যে কিংবা ‘নকশালবাড়ি ফিরে যাও’ ধাঁচের আত্মউন্মোচনে যেভাবে শহুরে পাগলাটে চেতনার সঙ্গে প্রেমিক-মূর্ছনার সংমিশ্রণ ঘটে, কিংবা বাংলাদেশের কামরুল হুদা পথিকের ‘মাতাল শহরের গল্প’—এ যে রাজনৈতিক দ্রোহী প্রেমিকের ভঙ্গি, তা ছিল দৃশ্যমান, সরলরৈখিক এবং তীব্র উচ্চারণে পূর্ণ।
এই তুলনায় আউয়াল আহমদের কবিতা গভীরভাবে পরিস্ফুট হয় এক ‘প্রতিস্বরের কবি’ হিসেবে। তিনি ‘একান্ত’ শব্দটির অভিধানে আশ্রয় নিয়ে যে-জগত রচনা করেন, তা কোনো সমাবর্তনের কিংবা বিপ্লবের চিৎকার নয়—বরং এক বিষণ্ন সুর, এক নিঃশব্দ সন্ত্রাস, যা পাঠকের ভেতরে থেকে শব্দের প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক অভিঘাত সরাসরি আসে না, বরং তা ‘সামাজিক দূরত্ব’, ‘সঙ্গনিরোধ’ কিংবা ‘প্যানডামিক ধারাপাত’-এর মতো পরোক্ষ, প্রতীকায়িত এবং পরাবাস্তব এক প্রেক্ষিতে নেমে আসে। এখানেই তিনি ৮০/৯০ দশকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবির চেয়ে আলাদা; কারণ তাঁর কবিতায় আত্মানুসন্ধান, ভাষাবিন্যাস এবং নিঃশব্দ উচ্চারণের সুনিপুণ কারুকাজ এক অ-ঐতিহাসিক এবং সময়সচেতন ভূগোল তৈরি করে।
বিনয় মজুমদার যেখানে ‘আমি পৃথিবীর প্রতি অনন্ত ঋণী’ বলে নিঃশব্দ নির্জনতার গণিত করতেন, আউয়াল আহমদের কবিতায় আমরা দেখি এক নিরন্তর ভিজে থাকার, অথবা না-ভিজে থাকার মৌন আকুতি—যেখানে ‘ভেজা’ একটি অস্তিত্বগত প্রতীক। তাঁর কবিতা নির্ধারিত ব্যাকরণের বাইরে গিয়ে গড়ে তোলে এক নব্যব্যাকরণ, যেখানে খণ্ডিত বাক্য, অসমাপ্ত উচ্চারণ, সংকেত-ভাষা ও আঙুলের গতি—সব মিলিয়ে তৈরি করে একটি নান্দনিক ভাষাচিত্র। এই ভাষার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে অনুব্রত বসু বা রণজিৎ দাশের পরাবাস্তবতা অথবা কলকাতার ‘শূন্য দশক’এর কয়েকজন কবির অন্তর্মুখী, ব্যক্তিমানসভিত্তিক কবিতার নির্মাণচেতনা।
তবে এখানে একটি মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়—যেখানে অনুব্রত বা রণজিৎ দাশ উচ্চাঙ্গ রূপবাদিতায় আকৃষ্ট হন, সেখানে আউয়াল আহমদ আত্মজৈবনিক বিপর্যয়, স্মৃতি এবং বৈরাগ্যমূলক দর্শনে কবিতার শরীর নির্মাণ করেন। তিনি নির্মাণ করেন একটি ‘আমি’ যা ভেঙে পড়ে, আবার গড়ে ওঠে, আবারও ভাঙে, আর ভেঙে গিয়ে যে নিরুপায় আত্মসংলাপে লিপ্ত হয়, তা যেন পোস্টমডার্ন দার্শনিক আত্মস্মৃতির প্রতিচ্ছবি। কবিতায় এই ‘আমি’ একমাত্র নয়, বরং বিভক্ত, অসম্পূর্ণ, প্রলাপগ্রস্ত এবং স্মৃতিবিদ্ধ—যা সমকালীন কবিতার এক গভীর অন্তরস্বর।
তাঁর কবিতা পূর্ববর্তী কালের জাতকবিদ্যার বদলে এক মেটাফিজিক্যাল ‘রেনকোট’, ‘চায়ের দোকানের কুয়াশা’, অথবা ‘ভেজা না-ভেজার উপাখ্যান’ নির্মাণ করে। সে তুলনায় জয় গোস্বামীর প্রেমে যে উন্মত্ততা, মহাদেব সাহার রোমান্টিক দ্রোহ কিংবা রফিক আজাদের বিপ্লবী ক্ষোভ—এসবই আউয়াল আহমদের কবিতায় এক ধরনের অন্তর্লীন প্রতিবাদ হয়ে আসে, যার ভাষা নীরব, সংকেতময়, অথচ গভীরভাবে ছোঁয়ায়। এখানে বলা চলে, আউয়াল আহমদ তাঁর প্রজন্মের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি তথাকথিত কাব্যিক ‘আয়োজনে’ নেই, নেই অলঙ্কারময় তীব্রতা বা বিপ্লবমুখর স্লোগানে; তাঁর কবিতা এক আত্মনির্মিত ‘ঘরবন্দি স্বর’, যা মহাকাব্যিকতা নয়, মৃদু অন্তঃস্বর—একান্তের নিজস্ব এক শ্রুতি।
১.
আধুনিক কবিতায় বৃষ্টি প্রায়শই ব্যবহৃত হয়েছে রোমান্টিক কিংবা আবহ বিষয়ক ব্যঞ্জনায়। কিন্তু আউয়াল আহমদের কবিতায় বৃষ্টি এক ফেনোমেনোলজিকাল বিন্যাস। এখানে বৃষ্টি মানে এক নিষিদ্ধতার ভেতরে প্রবেশ, এক অভ্যন্তরীণ যাত্রা। ‘বৃষ্টিপুরাণ’, ‘ভেজা, না-ভেজার উপাখ্যান’, ‘ইতি, আপনার একান্ত’—এইসব কবিতায় বৃষ্টি কেবল স্মৃতির লেন্স নয়, এক গভীর পারস্পারিকতা, যেখানে ‘ভেজা’ হওয়া আর ‘ভিজে না-হওয়া’র মধ্যে বসে আছে এক অন্তর্লীন মানসিক ঘূর্ণিপাক। বৃষ্টি এখানে প্রতিবার একটি অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় সৃষ্টি করে, এবং পাঠকও সেই বিপর্যয়ের মধ্যে অনুধ্যান করে নিজের মনের জার্নাল। এক ধরনের জলীয়-সম্মোহন ঘটে, যেখানে শব্দও সজল হয়ে ওঠে, অলীক হলেও অমোঘ।
বৃষ্টি, সাধারণত, বাংলা কবিতায় একটি বহুলচর্চিত চিত্রকল্প; তার রূপক ব্যবহার, আবেগপ্রবণতা ও ঐন্দ্রজালিক ত্রিভুজে আবদ্ধ অনেক কবির কল্পনাজগৎ। কিন্তু আউয়াল আহমদের ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’ গ্রন্থে ‘বৃষ্টি’ একটি আলঙ্কারিক প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; তা হয়ে ওঠে এক জটিল অস্তিত্বচেতনার প্রতিসংকেত—এক পারিপার্শ্বিক ছায়া এবং অন্তর্জাগতিক প্রতীক। এখানে বৃষ্টি শুধু বৃষ্টিই নয়—এ এক ভিজে যাওয়ার অনুমতি এবং নিষেধের দ্বান্দ্বিক উপাখ্যান; এক ধরনের স্মৃতিমেদুর বিকার, আবার কখনো এক পলিফোনিক আত্মপ্রবাহ, যা বয়ে যায় কবি ও পাঠকের গভীর ভেতর দিয়ে। কবি যখন বলেন, ‘বৃষ্টির কোরাসে যদি শুনতে না পাও তবে / মাথা নেড়ে জানিয়ো, একান্ত, আমাকে অন্তত / নিঃসংকোচে, হ্যাঁ অথবা না এর ইঙ্গিতে’—তখন বৃষ্টির ধ্বনি হয়ে ওঠে আত্মনির্ভর ভাষার প্রতীক। এ যেনো শব্দ নয়, বরং ভাষা-চেতনার ঘননীরব সুর। এই ‘কোরাস’ অর্থাৎ বহুবাচনিক বৃষ্টি একটি দলীয়সঙ্গীত নয়—এটি একটি একান্ত সংগীত, যার সুর নিজেকে গোপন রাখে।
আধুনিক সময়ের বাংলা কবিতায় বৃষ্টিকে এত সূক্ষ্ম আত্মপ্রতিসরণ হিসেবে দেখানোর দৃষ্টান্ত বিরল। এখানে বৃষ্টি যেন আত্মগত শব্দহীনতার এক ভাষ্য তৈরি করে। আউয়ালের বৃষ্টি চুপ করে থাকে না, জলের ফোঁটার মতো নিজেকে উচ্চারণ করেন নিঃশব্দে। এই বৃষ্টি কখনো মাতৃস্মৃতির, কখনো প্রিয়জনের, কখনো অনুপ্রবিষ্ট শৈশবের প্রতিচ্ছবি। ‘বৃষ্টিপুরাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘এখনো বৃষ্টির স্বরে মা’র ডাক শুনি যেন’—এই একটি পংক্তিতে কবি মাতৃস্বর ও বৃষ্টির ধ্বনিকে একত্র করেন, যা এক নিরন্তর অভিপ্রায়, যা কখনো উপস্থিত নয়, বরং সর্বদাই অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে অনুরণিত। আবার ‘ভেজা, না-ভেজার উপাখ্যান’-এ আমরা দেখি, ভিজে যাওয়া ও না-ভেজে থাকা যেন দুটি বিপরীত রাজনৈতিক চেতনার অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়। ‘তবু পরস্পর অদূর দূরত্বে থাকে, যেন / মিলিত হয় না তারা মিলিয়ে যাবার ভয়ে’ —এখানে বৃষ্টি ফিজিক্যাল ইভেন্ট নয়, মেটাফোরিকাল ব্যবধানের প্রতিবিম্ব। এ এক সত্তাগত দ্বন্দ্ব —ভিজে গেলে আত্মপ্রকাশ ঘটে, না ভিজে থাকলে লুকোনো যায়। এই দ্বিধা কবির কণ্ঠকে দ্বৈত করে, যেখানে প্রতিটি ছত্র নিজেকেই প্রশ্ন করে, নিজের জবাবে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ওঠে।
একইভাবে, ‘ইতি, আপনার একান্ত’ কবিতায় বৃষ্টি হয়ে দাঁড়ায় চিঠির মতো—অপ্রেরিত, অসমাপ্ত এবং সর্বদা শূন্যে ঝুলন্ত: ‘রেনকোট পরে তাই ঘুরি রোদের বর্ষণে/ বোবাজল খোঁজে ফুলতোলা রুমাল তোমার’—এখানে বৃষ্টি আর জল শব্দ দুটি প্রত্যক্ষত নিষ্পাপ মনে হলেও, পাঠকের মনে এক স্তব্ধ, অবচেতনে জমে থাকা জলীয় ঘুম, এক পুরোনো চুমুর নোনা ঘ্রাণ হয়ে ফিরে আসে। এই কবিতাগুলোর বৃষ্টিব্যঞ্জনায় কোথাও কোথাও আমরা শুনতে পাই এক হালকা ‘হাস্যরসের ভেতরে ছায়া’—একটু বোহেমিয়ান, একটু স্বপ্নদোষগ্রস্ত, আবার খানিকটা শিশুসুলভ। কিন্তু এই চেহারার আড়ালে কবি বস্তুত গড়ে তুলছেন এক বৃষ্টি-অন্তর্লীন দর্শন। যেমন, ‘পুনশ্চ’ কবিতায় তিনি বলেন— ‘আমি আর কতভাবে আমাকে বোঝাই বলো/ একান্ত, আরও কথা আছে তোমাকে বলার।’—এখানে বৃষ্টি একজন নিঃশব্দ শ্রোতা। এক দার্শনিক ‘তুমি’ যার সামনে কবি নিজেকে প্রতিদিন ভেঙে গড়েন।
আউয়াল আহমদের কবিতায় বৃষ্টির সংজ্ঞা কখনো মনোজৈবনিক, কখনো কালাতিপাতী। তাঁর বৃষ্টি সমকালকে ধারণ করে, আবার সময়কে বিলীন করে দেয়। ‘ছাদবাগান’ কবিতায় যেমন নাগরিক উদ্ভিদ ও ছাদের ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টির অনুপস্থিতি একধরনের মৃত্যুচিহ্ন হয়ে ওঠে। সেখানে জলের অভাব মানেই এক বোধের মরুভূমি।
তাঁর বৃষ্টি এইরকম—
* স্মৃতির উন্মোচন করে
* প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে
* প্রেম ও অভিমানের সীমান্তে দাঁড়ায়
* মৃত্যুবোধের বিনির্মাণে সহায়তা করে
এত বিচিত্র বৃষ্টি আর কোথাও দেখা যায় না—না সুবোধ সরকারের রাজনৈতিক রেন্ডিশনে, না জয় গোস্বামীর মদির রোমান্টিক ভিজে-পতাকায়। আউয়াল আহমদের বৃষ্টি ‘ঘটনা’ নয়, এক অন্তঃজলীয় অস্তিত্ব; পাঠকের চেতনার মধ্যে তার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। এখানে উল্লেখযোগ্য, কবির বৃষ্টিচেতনা কোনো আবহাওয়া বিষয়ক বাস্তবতা নয়। এই বৃষ্টির মধ্যে বসবাস করাই একমাত্র সত্তাগত সত্য। একান্ত হয়ে ওঠা মানেই—এই বৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে চিনতে শেখা এবং ঠিক এইখানে বৃষ্টির ব্যঞ্জনা গিয়ে মেশে কবিতার শারীরবৃত্তিক স্তরে। শব্দের গঠন, লাইনবিন্যাস, উচ্চারণহীনতা, হাইফেন, গ্লটাল স্টপ—সব কিছুতেই আমরা বৃষ্টির উপস্থিতি টের পাই। একেকটি কবিতা যেন একেকটি ছোটো মৌসুমি ঘূর্ণাবর্ত।
এই পর্বের আলোচনায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কবির বৃষ্টিমিথের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দ্বান্দ্বিকতা। বৃষ্টি কখনো ভিজিয়ে দেয়—তরান্বিত করে শরীর ও চেতনার পারস্পারিক বিনিময়। আবার কখনো সে নিষেধ—রেনকোট, ছাতা, প্রটেকশন, মনোড্রামার শিলালিপি। ‘মাঝখানে টেনে দেই স্বপ্নের লক্ষণ-রেখা’ —এই পংক্তি তাঁর একটি ‘ইতি, আপনার একান্ত’ থেকে নেওয়া, যেখানে মেঘ ও মনের সীমান্তরেখা টানাটানির দ্বিধা নিয়ে প্রতিটি ‘ভিজে যাওয়া’ হয় এক নৈতিক সিদ্ধান্ত।
এমন বৃষ্টিসংস্কৃতি বাংলা কবিতায় এই প্রথম; এমনকি বৃষ্টিকে যে এক ‘সামাজিক প্রপ’ থেকে উত্তীর্ণ করে ‘অস্তিত্বগত ধ্বনি’ করে তোলা যায়, তা আউয়াল আহমদের কবিতায় না পড়লে পাঠকের অনুমানও হতো না।
এই ‘বৃষ্টি’ মূলত নিজের দিকে ফিরে তাকানো এক আয়না—যেখানে শব্দ, অনুভব, ভাষা ও মৌনতা মিলেমিশে তৈরি করে এক ব্যক্তিগত প্রতিস্বপ্ন। আউয়াল আহমদের কবিতায় এই বৃষ্টি চূড়ান্তভাবে হয়ে ওঠে পাঠকের আত্মপ্রতিফলনের ক্ষেত্র। প্রতিটি ভিজে পঙক্তি পাঠকের মনে জলীয় প্রতিসরণ তৈরি করে, যেখানে সে নিজের ‘আমি’-কে ভেজা অবস্থায় দেখে। আর ঠিক এইখানে এই বৃষ্টিগুচ্ছ আর কেবল কাব্যচিত্র থাকে না—তারা হয়ে ওঠে পাঠকের পুনর্জন্ম।
২.
আউয়াল আহমদের ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’ কাব্যগ্রন্থের গঠনরীতি একান্তই ব্যতিক্রমী, এমনকি প্রায় অপ্রচলিত। এখানে কাব্যগ্রন্থ কোনো একরৈখিক সংকলন নয়; একটি জটিল, বহুস্তরীয়, আত্মমুখী কাব্যিক কথোপকথন, যেখানে কবিতা শুধু একক পঙক্তির সুর বা অন্তর্বয়নের ফর্ম নয়—বরং কবিতার বিন্যাসও নিজেই এক দার্শনিক ভাষ্য। পুরো বইটি যেন এক অভ্যন্তরীণ ‘স্বগোক্তির ভেতরেও স্বগোক্তি’—একান্ত চেতনার একান্ত প্রতিবিম্ব।
প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয় যে, গ্রন্থটি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত নয় শুধুমাত্র বিষয়গত সুবিধার্থে, প্রতিটি পর্ব একটি নির্দিষ্ট অনুভব-স্বর বা মনোভাষার নিজস্ব পরিসর নির্মাণ করে। এই পর্ববিন্যাস কেবল কাঠামোগত সংগঠন নয়, এক কাব্যিক স্বরের স্নায়ুবিন্যাস। এখানে ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতা’, ‘প্যানডামিক ধারাপাত’, ‘কনভোকেশন ও অন্যান্য কবিতা’, ‘আমি বিষয়ক’, ‘একান্তনামা’—এই প্রতিটি পর্ব একেকটি অন্তর্গত ‘ক্লাইমেট জোন’, যেখানে ভাষার জলবায়ু, মেঘমালার দিক এবং ভিজে ওঠার ছায়া—সব বদলে যায়।
শিরোনামগুলোর মধ্যেই রয়েছে এক বহুমাত্রিক সংকেত। যেমন, গ্রন্থের মূল শিরোনাম ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’। এখানে ‘একান্ত’ শব্দটি একটি নাম নয় কেবল, একটি স্বরবর্ণ, একটি সম্বোধন এবং একটি একান্ততা—যা ধীরে ধীরে কবিতার নিজস্ব লয় এবং পাঠকের অনুভবজগতকে সংলগ্ন করে। আবার ‘আটকে পড়া’—এক গতির বিরুদ্ধে স্থবিরতা, এক প্রবাহের বিরুদ্ধে ত্রস্ততা; ‘কবিতারা’—একবচন নয়, বহুবচন; অর্থাৎ কবি এখানে নিজেকে নয়, কবিতার সম্প্রদায়কে আটকে যাওয়ার দায়ে যুক্ত করেছেন। কেবল এটুকুই নয়, ‘বৃষ্টি’ এখানে একটি প্রকৃতি নয়—এক মনোলগ। তাই এই শিরোনামকে এক কাব্যিক প্রতীকী খোলস হিসেবেও পড়া যায়, যেটি পুরো বইটির অন্তর্গত ভাষ্যধর্মীতার ছাঁচ গড়ে তোলে।
এই পর্বটির নিচে যখন আমরা দেখি ‘ভেজা না ভেজার উপাখ্যান’, ‘ইতি, আপনার একান্ত’, ‘বৃষ্টিপুরাণ’, তখন পাঠক বুঝতে পারেন—প্রতিটি কবিতা যেন এক একটি চিঠি, একাধিক একান্ত আত্মান্বেষণের ছায়াবর্ত, যেখানে বৃষ্টি ও ভাষা মিলেমিশে এক অনুভববিশ্ব নির্মাণ করছে।
‘প্যানডামিক ধারাপাত’ নামক পর্বটি ভাষিক ব্যঞ্জনায় দ্ব্যর্থবহ: এখানে একদিকে আছে কোভিড মহামারির প্রেক্ষাপট, যার বাস্তবতা বিশ্বব্যাপী আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল; অন্যদিকে আছে ‘ধারাপাত’—যা একসময়কার প্রাথমিক গাণিতিক পাঠ্যবইয়ের নাম। এই দুয়ের মিলনে কবি নির্মাণ করেছেন এক বিমূর্ত ভয়-সংকেত, যা রৈখিক নয়, বরং আবর্তিত। এই পর্বে ‘সামাজিক দূরত্ব’ ‘সঙ্গনিরোধ’, ‘হস্তনামা’, ‘ঘরমুখো দিন’, ‘বন্ধু মরে গেলে’, ‘নব্য স্বাভাবিক’—প্রতিটি কবিতা এক একটি নিঃশব্দ স্মৃতিসৌধ।
এই শিরোনামগুলো থেকে বোঝা যায়, কবি সময়কে ধরে রাখছেন—না কোনো ইতিহাসের নথিরূপে, না কোনো প্রতিবাদী ভাষণে—বরং এক পরস্পরবিচ্ছিন্ন নিঃশ্বাসের মতো। এখানে শিরোনামই কবিতার প্রথম ইঙ্গিত। যেমন—‘বন্ধু মরে গেলে’—একটি সরল বাক্য, অথচ তার ব্যাকরণ বেদনাজর্জরিত। এই পর্ব যেন পলিফোনিক মৃত্যুর কাব্যিক রেজিস্টার, যেখানে সুরগুলো বিচ্ছিন্ন, কিন্তু স্পন্দনের ভাষা অভিন্ন।
‘কনভোকেশন ও অন্যান্য কবিতা’ পর্বে আমরা দেখতে পাই এক বহুরৈখিক নাগরিক চেতনা। ‘কনভোকেশন’, ‘হাসপাতালে’, ‘জলের গান’, ‘গল্প’, ‘অভিমান’, ‘আইসোলেশন: ৮৫/৭৪ সেরি থাই রোড’—এই কবিতাগুলোর মাধ্যমে এক ‘স্মৃতিগর্ভ নগর’ গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে ‘কনভোকেশন’ মানে গ্র্যাজুয়েশন নয়, বরং এক তামসিক উদযাপন—এক বেকার আপেল-ছেঁড়া মোহছায়া। এই পর্বের শিরোনামগুলো কবিতার পূর্বভাষ্য—যেখানে পাঠক নিজের নাগরিক অভিজ্ঞতার মধ্যে কবির চেতনার ছায়া খুঁজে পান।
এই কবিতাগুলোর শিরোনামে দৃশ্যমানতা ও অন্তরস্বর একসঙ্গে গড়ে ওঠে। ‘আইসোলেশন’, ‘অভিমান’, ‘জলের গান’—এগুলো শব্দ নয়, অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত প্রতিরূপ। এই পর্বে সময় আর বাস্তবতা জড়াজড়ি করে একরকম ‘পোস্ট-ট্রুথ লিরিক’ তৈরি করে, যেখানে কল্পনার শোক এবং বাস্তবের বিভ্রান্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে।
‘আমি বিষয়ক’ পর্বে কবি যেন নিজেই পাঠকের সামনে আয়না হয়ে দাঁড়ান। এই পর্ব একটি সুনির্মিত আত্মমিথ্যাকাব্য। শিরোনামটাই প্রশ্ন তোলে—‘আমি’ কি সত্যিই একটি বিষয় হতে পারে? নাকি ‘আমি’ নিজেই বহুবিধ প্রতিস্মরণের ফসিল? এই পর্বের প্রতিটি কবিতা এক একটি ভাঙনের মুহূর্ত। ভাষা এখানে আর একরৈখিক নয়, কুয়াশাচ্ছন্ন, খণ্ডিত এবং কখনো-কখনো শারীরবৃত্তিক। কবি তাঁর নিজের চেহারা, নাম, শ্বাসপ্রবাহ এবং স্মৃতিকে বিশ্লেষণ করে লেখেন—‘আমি অলীক পুণ্যের দামে তাই পণ্য কিনি / বাঁচার তাগিদে’। এই কবিতাগুলোর শিরোনাম না থাকলেও চলত, কিন্তু ‘আমি বিষয়ক’ নামক এই উপপর্ব তার নিজস্ব কণ্ঠ তৈরি করেছে। যেন আত্মজীবনী নয়, বরং আত্ম-ভেঙে-পড়া। এই পর্বটিকে পোস্ট-আধুনিক আত্মসত্তা বিনির্মাণের একটি কবিতামালা বলা যেতে পারে, যেখানে পাঠক নিজেকে খুঁজে পান, আবার হারান।
গ্রন্থের শেষাংশ ‘একান্তনামা’ যেন এক পরিশ্রান্ত স্বগতোক্তির কাঠামো। এটি এক অন্তর্জগত, যেখানে ‘একান্ত’ নামটি হয়ে ওঠে মুখোমুখি না থেকেও এক অবিরাম উপস্থিতি। এই পর্বটি মূলত একটি আধ্যাত্মিক চিহ্নপট—‘আমি এখনো ভালো আছি বলে দিতে পারি, একটুও না ভেবেই’—এই এক পংক্তি দিয়েই এই পর্বের নির্যাস ধরা যায়।
এটি ‘ডায়ালগ অব অ্যাবসেন্স’—একটি অস্তিত্ব যেখানে আত্মপ্রকাশ আর আত্মসংবরণ একসঙ্গে চলতে থাকে। পর্বের নামেই ‘নামা’ শব্দটি মধ্যযুগীয় প্রভৃতি নামাযপত্র ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের স্মরণ আনয়ন করে, কিন্তু কবি তাকে একদম প্রাইভেট লিরিকে পরিণত করেন। যেন এক গোপন ‘স্মৃতি-ইশতেহার’।
আউয়াল আহমদের এই কাব্যগ্রন্থটি কাঠামোতাত্ত্বিকভাবে একটি বহুরৈখিক স্বরগ্রন্থ। এটি কোনো আবহাওয়া-নির্ভর কবিতার সংকলন নয়, এটি এক পাঠযোগ্য ভাষাসংবেদনার গ্রন্থ। এর প্রতিটি পর্ব স্বনির্ভর, কিন্তু আন্তঃসংলাপিক। এখানে ‘বৃষ্টি’, ‘আমি’, ‘একান্ত’, ‘ভিজে না ভেজার দ্বিধা’, ‘বন্ধু’—এই শব্দগুলো বইয়ের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ফিরে আসে, যেন এক যৌগিক প্রতিস্মরণ।
‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’ কাব্যগ্রন্থের এই উপপর্ব বিভাজন পাঠকের জন্য শুধুমাত্র একটি আয়োজিত বিন্যাস নয়, একটি অন্তর্গত অনুভবের ম্যাপ, যেখানে কবি নিজেই পথপ্রদর্শক, আবার সহযাত্রীও। এই গঠন ও পর্বভাগ একটি উচ্চতর চেতনা, ভাষা-মনোলগ এবং পাঠ-সমঝোতার জন্ম দেয়, যা বাংলা কবিতার সমকালীন প্রবাহে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
৩.
আউয়াল আহমদের কবিতা পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি পাঠককে গভীরভাবে নাড়িয়ে তোলে, তা হলো ভাষার অভ্যন্তরীণ ছন্দবিচ্যুতি, বাক্যগঠনের অসম্পূর্ণতা এবং একটি ক্রমাগত বিলম্বিত উচ্চারণ। এই ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা কবিতার অধিকাংশ ধারাকে (বিশেষত অলঙ্কারপ্রবণ নব্যরোমান্টিক ও রাজনৈতিক গদ্যরীতিকে) প্রত্যাখ্যান করে গড়ে তোলে এক বিপরীত ব্যাকরণ, যেখানে বাক্য আর অর্থবাহী নয়, একটি অনিশ্চিত ও পারিপার্শ্বিক ধ্বনি-পরিসর।
এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাই বাক্য-সম্পূর্ণতার প্রতি উদাসীন। ‘আমি বিষয়ক’ পর্বে, কিংবা ‘আইসোলেশন: ৮৫/৭৪ সেরি থাই রোড’, অথবা ‘প্যানডামিক ধারাপাত’-এ আমরা দেখি, কবি হঠাৎ করেই বিরতি দেন বা অসমাপ্ত রেখেই বাক্য ছেড়ে দেন। উদাহরণত, ‘আমি / ভা / ঙ / ছি’—এই বিভাজন যে কেবলমাত্র ‘ভাঙা’ শব্দটির শ্রুতিধ্বনি নয়, বরং নিজস্ব একটি নাটকীয় স্থাপত্য। প্রতিটি খণ্ড এখানে এক একটি ‘সম্ভাব্য বাক্য’, যা তার ভাষাবিন্যাসকে সম্পূর্ণ করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে স্থগিত করে দেয়।
এভাবে কবি ভাষাকে একটি দোলায়মান বস্তুতে পরিণত করেন, যেখানে বাক্য শেষ হয় না—শুরু হয় বারবার, কিংবা নিজের ভেতরেই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। পাঠকের জন্য এই ধারা কখনো দুর্বোধ্য, কখনো আশ্চর্য রকমের আত্মগত। এই ভাষা কোনো নিশ্চয়তা দেয় না, বরং এক ‘সাসপেন্স অব সেন্স’ তৈরি করে, যেখানে পাঠককে প্রতিনিয়ত অর্থ এবং অনুভবের মধ্যে দোল খেতে হয়। যেমন—‘আমার নিরবতা/ ভাবাচ্ছে অনেককে/ অনেক কিছু/ ভাবতেও ভালো লাগছে’—এই উচ্চারণ স্বীকারোক্তিও নয়, প্রতিবাদও নয়; এক ধূসর স্থগিততা, যেটি আধুনিক সময়ের ভাষাহীনতা কিংবা ভাষার ভেতরে লুকিয়ে থাকা নিরবতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
অনুল্লিখিত ভাবপ্রবাহের নান্দনিকতা এই কবিতাগুলোর ভাষায় রয়েছে এক অনুল্লিখিত প্রবাহ—যা যে ভাষা দিয়ে বলে না কেনো, সেই ভাষাই সবচেয়ে গম্ভীর হয়ে ওঠে। আউয়াল আহমদের কবিতায় অনেক বাক্য আছে যেগুলো ‘শুরু’ হয় না—কেবল ইঙ্গিত করে দেয়:‘—আলোটা মুখের কাছে ধরো / ভালো করে দেখতে পাই না।’—এখানে আলো ও মুখ—দুইটি অনির্ধারিত প্রতীক। আলো কী? মুখ কার? আলো যদি জ্ঞান হয়, তবে মুখ হয়ত সময়। কিন্তু কবি এই ব্যাখ্যাগুলো আমাদের দেন না—দেন শুধু তার ছায়া। এইভাবেই কবির অনুল্লিখিত কথন এক ‘ছায়া-ভাবনার নন্দন’ তৈরি করে। ভাষার শরীরে তিনি তৈরি করেন সংক্ষিপ্ত ঢেউ, যেখানে প্রতিটি বাক্য নিজেই নিজের ছায়া হয়ে যায়।
আউয়াল আহমদের ব্যাকরণচ্যুতি কোনও অলঙ্কার নয়, একটি আত্মগত প্রতিবাদ—ভাষার ওপরে, ইতিহাসের ওপরে, ‘আমি’র ওপরে। যেখানে অন্যান্য কবি ব্যাকরণ ভাঙেন ছন্দের স্বাধীনতার জন্য, তিনি ভাঙেন উচ্চারণের নিঃশব্দতাকে চিহ্নিত করার জন্য। উদাহরণত, ‘ছাদবাগান’, ‘জলের গান’, বা ‘রাশিচক্র’ কবিতাগুলোতে আমরা পাই—ধ্বনিগ্রস্ত, অথচ অভ্যন্তরীণ যুক্তির ভেতরে স্থাপিত গঠনের দৃষ্টান্ত। ব্যাকরণ না মেনে কবি নির্মাণ করেন নিজের ব্যাকরণ, যা আরোপিত নয়, অন্তর্জাগতিক।
‘জলের জালে আটকা পড়ে / ভাসি চোখের জলসাগরে’—এখানে শব্দ ও শব্দের ঘনত্ব এমনভাবে পরস্পরের সাথে জড়ায়, যেখানে বাগধারা আর বাইরের নয়—ভেতরের শ্বাসবিন্যাস। ‘ভিজে, না ভেজার মাঝখানে যেন / যতিচিহ্ন বসে’—এই ‘যতিচিহ্ন’ আর কেবল ভাষার নয়, তা অস্তিত্বেরও। এই ব্যাকরণচ্যুতি কবির এক অন্তর্মুখী পদ্ধতি, ভাষাকে ভাঙতে ভাঙতেই সে প্রকাশ করে তার নিজস্ব মৌলিক অর্থবোধ।
পার্সোনাল ও ইম্পার্সোনাল ভয়ের ভেতর শব্দের বুননে ভয় আউয়াল আহমদের কবিতায় একটি নান্দনিক উপাদান। কিন্তু এই ভয় সরাসরি হুমকি নয়—তা ব্যক্তিগত অস্পষ্টতা ও অব্যক্ত দূরত্বে লুকিয়ে থাকে। ‘সঙ্গনিরোধ, বন্ধু মরে গেলে, নুসরাত, আয়াত’—এই কবিতাগুলোয় ‘ভয়’ এক নির্মিত বাস্তবতা। পার্সোনাল ভয় এখানে হচ্ছে স্মৃতির ক্ষয়, মৃত বন্ধুর প্রতিধ্বনি, নিজের ‘আমি’র ছিঁড়ে যাওয়া চামড়া। আর ইম্পার্সোনাল ভয় হচ্ছে রাষ্ট্রের, মহামারির, হত্যার, অথবা প্রাতিষ্ঠানিক নীরবতার। যেমন ‘নুসরাত’ কবিতায়: ‘পোড়ো / অথবা পোড়াও / তুমি আর আমি ছাড়া অমায়িক দাহ্য বলে / যেন আর কিছু নেই’—এখানে ভাষার ঠান্ডা সংযম ভয়কে করে তোলে আরো অনাবিষ্কৃত, আরো নৈঃশব্দ্যময়। আগুনের ভেতর এখানে চিৎকার নেই, আছে কাঠিন্য। আবার, ‘বন্ধু মরে গেলে’ কবিতায়—‘আয় তোকে জায়নামাযের মতো মাটিতে বিছিয়ে দেই / অলৌকিক বৃক্ষ হয়ে জন্ম নিস যদি’—এখানে মৃত বন্ধুকে নিয়ে কথা বলা মানে কেবল এক শোক নয়, নিজেকেও মৃত ভাবা। শব্দগুলো হয়ে ওঠে আত্মপ্রতিস্মরণের ছুরি। এই সমস্ত ভয় এক ব্যক্তিগত উপলব্ধি, কিন্তু তার ভাষা ইম্পার্সোনাল—সে রাষ্ট্র্র, সমাজ বা সময়কে মুখোমুখি দাঁড় করায় না, দাঁড়া করায় নিজের সত্তাকে।
আউয়াল আহমদের কবিতা আসলে এক দীর্ঘ, আত্মজৈবনিক মনোলগ, যেখানে ভাষা তার কাঠামোগত ছন্দ খুঁজে পায় না; ছন্দের ভেতর থেকে উঠে আসে এক চেতনা—যা সমকালীন, কিন্তু অতীতবাহী; যা অন্তর্মুখী, কিন্তু বহুবাচনিক। তাঁর কবিতার ভাষা কোনো মুখের ভাষা নয়, তা চোখের, হাতের, নিঃশ্বাসের ভাষা—যা ব্যাকরণবিরুদ্ধ অথচ অর্থগর্ভ। ভাষা এখানে শ্বাসপ্রবাহের মতো, ঠিক সেই কারণেই এই কবিতা এক আত্মিক পাঠককে আহ্বান করে, যিনি প্রতিটি ব্যত্যয়ে খুঁজে নেবেন নিজের ‘ভয়’, নিজের ‘আমি’। আউয়াল আহমদের কবিতাভাষা এক ব্যতিক্রমী গঠনচেতনার ফল। এই ভাষা গঠন করে তার ভাঙনের মধ্য দিয়ে, অর্থ দেয় তার অর্থহীনতাকে কেন্দ্র করেই। এই কবিতা পড়া মানে একটি নতুন ব্যাকরণ শেখা নয়—পূর্বব্যাকরণ ভুলে গিয়ে শব্দের ছায়া এবং চেতনার নৈঃশব্দ্যে প্রবেশ করা। পাঠক এই কবিতায় ভাষাকে কেবল পড়ে না, শোনে, অনুভব করে এবং ভুলে যেতে শেখে।
আউয়াল আহমদের কবিতায় পরাবাস্তবতা কখনোই নিছক এক স্বপ্নচিত্র নয়, এক জেগে ওঠা দুঃস্বপ্ন—যেখানে বাস্তবতার তীক্ষ্ণতা ও কল্পনার রহস্য একে অপরকে বিদ্ধ করে। তাঁর কবিতা কোনো দৃষ্টিনন্দন বিভ্রম নয়, নির্মম বাস্তবের উপরে পেঁচিয়ে ওঠা এক প্রলেপ, যা চোখে পড়লেও হাত দিয়ে ধরা যায় না। ‘আয়াত’, ‘নুসরাত’, ‘বন্ধুদের কবরের পাশে এসে’, ‘বন্ধু মরে গেলে’ কবিতাগুলোতে এই অনন্য মিশ্রণের নিখুঁত প্রকাশ পাওয়া যায়।
‘আয়াত’ কবিতাটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক প্রবেশ করেন এক ভয়ানক বাস্তবের মুখোমুখি—এক বিভক্ত দেহ, ছিন্ন অঙ্গ, খণ্ডিত পরিচয়। কিন্তু এই বিভাজন কেবল একটি মেয়েশিশুর মৃতদেহ নয়—এ যেন সমাজের মানবিক নৈতিকতার খণ্ডায়ন, একটি সভ্যতার আত্ম-ধ্বংসের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। কবি লিখছেন— ‘স্লুইসগেটে পাওয়া গেল পলিথিনে মোড়ানো পা দু’টি/ যেন খেলাচ্ছলে খুলে গেছে কোন বার্বি ডলের শরীর থেকে’ এই তুলনাটি নিষ্ঠুর, কিন্তু অসামান্য। একটি মেয়েশিশুর পা, ‘খেলাচ্ছলে খোলা’ বার্বি ডলের শরীরের অংশ হয়ে ওঠে—এখানে বাস্তবতার নির্মমতা এক শিশুমনস্ক কল্পনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। এটি পরাবাস্তবতায় প্রোথিত, কারণ বার্বি ডল, খেলনা, শিশুর নির্দোষতা ও মৃতদেহ—সব মিলে যায় এক দুর্বোধ্য অথচ ব্যঞ্জনাময় ভিশনে। কবিতা শেষ হয় এক চরম আত্মস্বীকৃতিতে—‘আমরা কিছুই খুঁজছি না/ আমাদের খণ্ডিত মস্তকে এসবের দায়ভার নেই’ এটি একটি গণ-অপরাধের নৈঃশব্দ্যময় স্বীকারোক্তি। এখানে কবি প্রতীক ব্যবহার করেন না অলংকার হিসেবে, প্রতীকই হয়ে ওঠে কাঠামো-ভাঙা সত্য। ‘আয়াত’ নামটি এখানে দ্ব্যর্থবহ: একদিকে মেয়েটির নাম, অন্যদিকে ধর্মগ্রন্থের ছিন্ন পংক্তির প্রতীক, যা একটি জাতির খণ্ডিত ঈশ্বরচেতনার ইঙ্গিতও হতে পারে।
‘নুসরাত’ কবিতায় আমরা দেখি, আগুন একটি দৃশ্যমান ঘটনা, ধীরে ধীরে গঠন করা এক মহাসংলগ্ন মেটাফর। কবি বলেন: ‘পোড়ো/ অথবা পোড়াও/ তুমি আর আমি ছাড়া অমায়িক দাহ্য বলে/ যেন আর কিছু নেই’ এই পংক্তিতে অগ্নি শুধু দেহ পোড়ায় না—তা মানব সম্পর্ক, রাষ্ট্র, ধর্ম, প্রেম, সামাজিক দায় সব কিছুকে দাহ্য করে তোলে। এখানে আমরা এক ভয়ংকর বৈশিষ্টতা দেখতে পাই, যেখানে সহিংসতার উৎস নেই—তবু দহন আছে। এ যেন ব্ল্যাক-হোলের মতো এক নিঃশব্দ বিস্ফারণ।
নুসরাত এখানে কেবল একজন মাদ্রাসাছাত্রী নন—তিনি প্রতিটি পুড়ে যাওয়া কণ্ঠের প্রতিনিধি। তাঁর শরীর একটি প্রতীক, এবং সেই প্রতীক ‘অক্ষর’ হয়ে ওঠে। কবি এই দহনকে ‘শোকবার্তা’র মতো সংরক্ষিত করতে চান— ‘এসো, বর্ণিল অক্ষরে লিখি/ লিখে রাখি/ আরো কিছু শোকবার্তা’ এই ‘লেখা’ কেবল প্রতিবাদ নয়, কবিতার জন্মও বটে। কবি এখানে দগ্ধ নারীকণ্ঠকে পরিণত করেন ভাষার রক্তাক্ত শরীরে।
এই কবিতাটি ভয়ংকর রকমের করুণ, আবার অসম্ভব রকমের মানবিক। আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে রচিত এই কবিতায় কবি যে অভিমানী সুর তুলে আনেন, তা একাধারে ব্যক্তিগত শোক এবং সমষ্টিগত স্মৃতিচিত্র— ‘বন্ধু, আয় তোকে জায়নামাযের মতো মাটিতে বিছিয়ে দেই/ অলৌকিক বৃক্ষ হয়ে জন্ম নিস যদি, আরো একবার!’ এখানে কবিতার ভাষা কোনো ধর্মীয় অভিব্যক্তি নয়—এটি হয়ে ওঠে এক আধ্যাত্মিক কামনা। কবিতার শুরুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ‘তসবির পুঁতি’, শেষে বন্ধু হয়ে ওঠে এক অলৌকিক বৃক্ষ—এই যে অন্তর্জাগতিক বাস্তবতা, সেটিই কবিতাটিকে পরাবাস্তব করে তোলে।
পাশাপাশি, কাব্যিক দুঃখ এখানে আত্মবিদ্রূপে পরিণত হয়— ‘চায়ের দোকানে লুকিয়ে চা খাবো/ লকড ডাউন ভেঙে আড্ডা দেবো শাটার নামিয়ে’ এই ব্যঙ্গাত্মক স্বাভাবিকতা, মৃত্যুর সাথে অসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবহার, সব মিলে এক ‘অলীক জীবন’-এর ভেতরে মৃত্যুকে স্থান দেয়—যা আসলে পরাবাস্তবতার শীর্ষ বিন্দু। এই কবিতায় কবি একটি মুহূর্তকে ধরে রাখেন—বন্ধুদের কবরে গিয়ে দাঁড়ানো এক অন্তর্জগতের যাত্রা। সেখানে পিটি স্যারের হুইসেল বাজে, ঘাসের ক্লান্তি অনুভব হয়, বন্ধুর কাঁধ খোঁজা যায়, অথচ কোনো কাঁধ থাকে না। ‘বন্ধুদের কবরের পাশে এসে সব অভিমান/ দুপুর রোদের ঘাস হয়ে যায়’ এই অভিমান, রোদ, এবং ঘাস—এরা সকলেই বাস্তবচিহ্নিত বস্তু, কিন্তু এই উপস্থাপনায় তারা পরাবাস্তব স্তরে উত্তীর্ণ হয়। কারণ তারা আর দৃষ্টির বস্তু নয়, তা চেতনার ছায়া।
আউয়াল আহমদের কবিতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, সম্ভবত, তার শব্দচয়ন এবং প্রতীকচিন্তার অন্তর্জাগতিক পরিসর। তাঁর শব্দগুলো অর্থ বহন করে না; তারা অর্থ-উৎপাদন করে। ‘জায়নামায’, ‘পুঁতির মালা’, ‘জ্বেলে দেই পিদিম আরতি’, ‘ভুল ঠিকানা’, ‘পালক ঝরার আনন্দ’—এসব প্রতীক যেন জাগতিক বস্তু হয়েও চেতনাগত এক বৃত্ত নির্মাণ করে। এই প্রতীকগুলো কখনো রিলিজিয়াস, কখনো অলৌকিক, কখনো স্মৃতিসংকেত, আবার কখনো নিছক খেয়ালি। কিন্তু সবসময়ই তারা কবিতার ভাষাকে ছাপিয়ে এক অন্তর্দৃষ্টির পটচিত্র এঁকে যায়। যেমন, ‘পালক ঝরার আনন্দে গা-ঝাড়া দিন আসে’—এখানে ‘পালক’ কোনো পাখির চিহ্ন নয়, তা এক ক্লান্তি-পরবর্তী পুনর্জন্ম।
এইসব কবিতায় যে বাস্তবতা আমরা দেখি, তা নিছক কাগজে লেখা সত্য নয়, একরকম ‘অন্তঃবাস্তবতা’—যেখানে চেতনা ও শরীর, শব্দ ও নিঃশব্দতা, মৃত্যু ও স্মৃতি একসঙ্গে অবস্থান করে। আউয়াল আহমদের পরাবাস্তবতা কোনো সুররিয়াল চিত্রকলার মতো নয়, এ এমন এক শব্দভাষা, যা পাঠকের ভেতরের ‘নিশ্চুপ অভ্যন্তর’কে নাড়া দেয়। তাঁর কবিতা শেষ হয় না, তারা চিত্র হয় না, তারা নিঃশব্দ এক পটভূমির মতো আমাদের চোখের পেছনে, বুকের নিচে, মস্তিষ্কের স্তব্ধ কোণে রয়ে যায়।
৪.
আউয়াল আহমদের একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা কাব্যগ্রন্থের পঙ্ক্তিমালায় বৃষ্টির ধারা যেমন মাটি ভিজিয়ে তোলে, তেমনি কবিতার অন্তর্জ গঠন ও আবেগপ্রবাহ পাঠকের অন্তঃস্থলে এক অনির্বচনীয় জাগরণ সৃষ্টি করে। কবিতাগুলি শুধু ভাষার সংগীত নয়, তারা এক এক নিঃশব্দ বৃষ্টিপতনের মতো হৃদয়ের গূঢ়তম প্রকোষ্ঠে ধ্বনিত হয়। এ কাব্যের অনুভব কাঠামো এমনভাবে নির্মিত, যাতে পাঠক চেতনা থেকে অচেতনার তলায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হতে থাকে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চিত্রকল্প, প্রতিটি অন্তর্বয়নের রেখায় যেন এক অন্তর্জাল রচিত হয়েছে, যেখানে পাঠকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত স্মৃতি ও আবিষ্কৃত ব্যথা এসে ধরা দেয় প্রতিফলিত আলোর মতো। এই আলো বাহ্যিক নয়—এ আলো অন্তর্জাত, যাকে কবি উপলব্ধির স্তর থেকে টেনে এনেছেন শব্দের ভেতরস্থ স্নায়বিন্যাসে।
এই কাব্যের ভাবপ্রবাহ কোনো সরল রেখায় অগ্রসর হয় না, এটি আবর্তনের পথে পথিক, নদীর মতো ধৈর্যশীল ও বৃষ্টির মতো হঠাৎ আবেগময়। এই আকারবর্জিত প্রবাহ পাঠকের মনে এক অস্থির প্রশান্তি আনে—যেখানে স্মৃতি ও বিস্মৃতির সীমান্তরেখা মুছে যেতে থাকে। ‘বৃষ্টিপুরাণ’ কবিতায় যেমন বলা হয়—‘এখনো বৃষ্টির স্বরে মা’র ডাক শুনি যেন’—এই অনুচ্চারিত শোকের মধ্যেই প্রতিসৃত হয় পাঠকের নিজের মা, নিজের ভেজা উঠোন, অথবা হারানো শৈশবের কোনো স্নিগ্ধ দিন, যে দিনটির দিকে আমাদের মন সর্বদা পিছন ফিরে তাকায় কিন্তু ঠিক খুঁজে পায় না।
এই প্রতিসরণ একরৈখিক নয়, বহুস্তরীয়—প্রতিটি পাঠে পাঠক নতুন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, কখনো নিজের ভাষা হারায়, আবার কখনো নিজেরই ভাষায় নিজেকে নতুন করে চিনে নেয়। কবিতা যখন বলে—‘আমি তো না-ওড়া বেলুন-এর মতো / শুধু বর্ণিল বাহারে ফুলে ফেঁপে পড়ে থাকি’—তখন সে বেলুন কেবল কবির নিঃশ্বাসে স্ফীত কোনো অভ্যন্তরীণ আর্তি নয়, পাঠকেরও এক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা—যে আকাঙ্ক্ষা ডানাভাঙা পাখির মতো উড়তে চায়। এভাবেই কবিতার ভাব প্রবাহ পাঠকের অন্তর্জগতে এক প্রগাঢ় অনুরণন সৃষ্টি করে—এক অদৃশ্য দোলাচল, যার নাম হয়তো সংজ্ঞায়নের অতীত।
এই গ্রন্থে বৃষ্টিকে একটি পুনরাবৃত্ত প্রতীক হিসেবে দেখা যায়, কিন্তু তা কেবল আবহাওয়া নয়—এ বৃষ্টি হয়ে ওঠে সময়, স্মৃতি, শরীর, ভাষা, অভিমান, প্রেম, শোক, কিংবা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। পাঠক যখন কবিতার সঙ্গে একান্ত সময় কাটায়, তখন তার নিজের ভেতরেও ঝরতে থাকে এক অদৃশ্য বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টিপাতে তৈরি হয় প্রতিসরণ—যেখানে কবির দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের অন্তরলোকে পরস্পর প্রতিবিম্বিত হয়। কবিতা ‘ইতি, আপনার একান্ত’-এ যখন কবি বলেন, ‘রেনকোট পরে তাই ঘুরি রোদের বর্ষণে’—তখন পাঠকের হৃদয়ে এক অদ্ভুত অনুরণন হয়—আমরাও কি আজকাল রোদে ঘুরি না বৃষ্টির ভয় নিয়ে? আমরাও কি প্রতিদিন সুরক্ষা, সন্দেহ ও অস্পষ্ট আত্মরক্ষার কৌশলে বৃষ্টিকে, অর্থাৎ আবেগকে, নির্লজ্জভাবে এড়িয়ে যাই না? এমন কবিতায় পাঠকের অভ্যন্তরীণ আত্মরক্ষার প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত নির্জনতা ও প্রেমের ভঙ্গুরতা ধরা দেয় নতুন ভাষায়।
এই প্রতিসরণ-প্রক্রিয়া যে কেবল স্মৃতিচারণের পরিসরে সীমাবদ্ধ তা নয়, এটি পাঠকের উপস্থিত মানসিক অবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাকে চিন্তায়, নিঃসঙ্গতায়, কখনো বা অন্তর্মুখিতায় নিমজ্জিত করে তোলে। ‘আমি বিষয়ক’ কবিতাগুলিতে আত্মপরিচয়ের যে ছিন্নভিন্ন মানচিত্র আঁকা হয়, তা পাঠকের নিজের অভ্যন্তরকে উন্মোচিত করতে থাকে। এই খণ্ডে কবি বলেন—‘আমি যেই স্বপ্নে বাড়িতে ফেরার টিকিট হারাই / সেই স্বপ্ন বারবার দেখি’—এই পুনরাবৃত্তিময় হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন পাঠকের ভেতরের এক প্রগাঢ় অভিজ্ঞতাকে উদঘাটন করে। অনেকেই হয়তো এমন এক স্বপ্নে বাস করে যেখানে কোনো গন্তব্য নেই, আছে কেবল ঘরের স্মৃতি—ঘর যা কখনো ছিল, কিন্তু এখন নেই।
পাঠকের অন্তর্জগতের প্রতিসরণ এখানে শুধু অভিজ্ঞতার নয়, সেটি একপ্রকার স্পন্দিত আবেশের। ‘আয়াত’ কবিতায়, এক শিশুকন্যার খণ্ডিত দেহাবশেষ যখন কবিতার অবয়ব ধারণ করে, তখন পাঠকের ভেতর থেকে কেবল শোক নয়, রাগ, অসহায়তা ও সামাজিক হতাশার অনুভব জেগে ওঠে। এখানে কবিতা আর আবেগকে আলাদা করা যায় না, কারণ তা পাঠকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে অপরাধবোধের এক কালো তরলে। এই তরলতা কেবল চোখের জলে নয়, তা চিন্তার ভিতরে জমে থাকা এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরির মতো।
এই কাব্যের ভাষা যখন কবিতায় রূপ নেয়, তখন তা আর শুধু অনুভব নয়, তা হয়ে ওঠে এক ধরণের ভাষা-প্রত্নতত্ত্ব—যেখানে পাঠক নিজের ভাষার ইতিহাস খুঁজে পেতে থাকে। ‘ভাষা-বন্দনা’ কবিতায় কবি বলেন—‘বৃষ্টির ফোঁটার শব্দে রচিত জলের ভাষা/ শিখে নেবো বেদনার মাতৃভাষা মনে করে’— এখানে ‘বেদনার মাতৃভাষা’ আসলে পাঠকের নিজস্ব করে বর্ণমালা। এটি এক গভীর আবিষ্কার—ভাষা কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়, ভাষা নিজেই একটি স্বতন্ত্র যন্ত্রণার প্রতিমা, একেকটি উচ্চারণ পাঠকের বুকে আঘাতের মতো লাগে।
এই প্রতিসরণ শুধু আত্মপরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রলম্বিত হয় সমাজ, ইতিহাস ও সমসাময়িক যন্ত্রণার দিগন্তে। ‘বন্ধু মরে গেলে’ কবিতায় করোনা-শহিদ বন্ধুর জন্য শোকগাঁথা একাকী পাঠকের কাছে কেবল কবির ব্যক্তিগত হাহাকার হয়ে থাকে না, তা হয়ে ওঠে হাজারো হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের প্রতীক। এই প্রতীকের অনুরণনে পাঠকের মনে প্রতিধ্বনিত হয় তার নিজের ক্ষতি, নিজের ক্ষরণ। সেখানে কবিতার আর ব্যক্তিগত কোনও গহ্বর থাকে না, তা হয়ে ওঠে এক নৈর্ব্যক্তিক নৈঃশব্দ্য—যা সকল পাঠকের।
আউয়াল আহমদের কবিতার নির্মিতি পাঠককে প্রশ্ন করে, অন্তর্দৃষ্টির দরজায় নক করে। পাঠকের চোখে ধরা দেয় এক ভিন্ন ফ্রেম, এক ভিন্ন ফোকাস। ‘ফোকাস’ কবিতায় যখন বলা হয়—‘নিউরনে এঁকে রাখি সেই ছবিখানা/ ব্লার হয় বারবার আমার ফোকাস’—তখন মনে হয়, কবির ফোকাস তো আসলে পাঠকের ফোকাস। এই ব্লার হবার অভিজ্ঞতা, এই স্পষ্ট হয়ে উঠবার আকাঙ্ক্ষা পাঠকের নিজের জীবনের অনুভবের ছবি।
এইভাবে ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’ নামক এই অনবদ্য কাব্যগ্রন্থের ভাবপ্রবাহে পাঠক খুঁজে পান নিজেরই প্রতিবিম্ব, নিজের হারানো বৃষ্টি, নিজের চেনা কুয়াশা, নিজের অপ্রকাশিত দুঃখ। কবিতাগুলি একদিকে যেমন ব্যক্তিগত, অন্যদিকে তেমনি বহুব্যক্তিক এবং সেই বহুর অভ্যন্তরে পাঠক খুঁজে পান নিজের একান্ত অভিজ্ঞতার প্রতিসরণ। এই প্রতিসরণ কোনো বাহ্যিক প্রতিচ্ছায়া নয়, অন্তর্জালের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক অন্তর্দর্শনের অভিধান।
সেই অভিধান পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেই এক প্রকার কবিতায় রূপান্তরিত হন—শব্দহীন, অথচ শব্দসমৃদ্ধ। তিনি নিজের ভিতরে আবিষ্কার করেন এক নতুন পাঠককে, যিনি শুধু পাঠ করেন না, কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে পাঠ করেন। এই আত্মপাঠই ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা’-র চূড়ান্ত গুণ। কারণ এই কবিতাগুলি কেবল লেখা হয়নি, বৃষ্টি দিয়ে গড়া হয়েছে; এবং বৃষ্টিতে, পাঠকের নিজের চেতনায়, বারবার ধুয়ে গিয়ে নতুন করে জন্ম নেয়।
আমি যখন একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা কবিতাগ্রন্থটি প্রথম হাতে নিই, তখন গ্রন্থের নামের মধ্যেই যেন এক প্রকার মানসিক কোমলতার পূর্বাভাষ পাই—একটানা বৃষ্টিপাতে আটকে যাওয়া মুহূর্তের মতো জীবনের অস্পষ্টতার মাঝে থেমে থাকা এক চেতনার নিমগ্ন অনুবৃত্তি। পৃষ্ঠা উল্টাতেই যে-প্রথম অভিজ্ঞতা হয়, তা কেবল কবিতা পাঠের নয়, এক ধরণের মৃদু আর্দ্রতায় স্নান করে আসা অন্তরবীক্ষণের। কবিতাগুলোর মধ্যকার শব্দগুলো যেন স্পষ্ট কোনও উচ্চারণ নয়, ধোঁয়াটে কাচে ঘনিয়ে ওঠা সংলাপ, যা আমি শুধু পড়ি না—আমি শুনি, আমি গন্ধ পাই, আমি অনুভব করি। এই কাব্যগ্রন্থ তাই আমার কাছে হয়ে ওঠে পাঠের নয়, অংশগ্রহণের এক অন্তর্লীন আয়োজনে শরিক হবার প্রক্রিয়া।
আমার পাঠ শুরু হয়েছিল ‘একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতা’ দিয়েই—শিরোনামের ভেতরে যে-প্রগাঢ় একান্ততা, তা যেন নিজেকে ডেকে নেয় অন্তঃস্থ আত্মস্বরূপে। কবিতার পঙ্ক্তিগুলি যখন বলছে—‘বিকেলের টংঘরে উদ্বৃত্ত স্মৃতির ভিড়ে/ এসো, পাঠ করি বৃষ্টি-বন্দি-মুখর কবিতা’—
তখন আমি নিজেকে দেখতে পাই এক দমবন্ধ বিকেলে, মফস্বলের একটি নির্জন চায়ের দোকানে বসে, চায়ের কাপের ভাপে উবে যাওয়া সময়ের মতো ভেসে যেতে যেতে। কবিতার এই অনুরণন কেবল ভাবানুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত দিনলিপির পাতা উল্টে দেয়। সেই পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে এক প্রিয়জনের অবর্তমানতা, এক বন্ধুর দূরত্ব, কিংবা হয়তো এক ব্যর্থ প্রেমের বৃষ্টিমগ্ন বৃত্তান্ত—যা আমি প্রকাশ করিনি, তবু কবিতার ভেতর সে কথা বলা হয়ে যায়।
এই কবিতাগ্রন্থ পাঠককে বাহ্যিক দৃশ্যের চেয়ে অভ্যন্তরীন অনুভবের দিকে টেনে নেয়। যেমন, ‘ভেজা, না-ভেজার উপাখ্যান’ পড়ার সময় আমি গভীরভাবে অনুভব করি, ‘ডোবানো বিস্কুট গলে পড়ে যাওয়া বিকেলে’ যে অনুচ্চারিত অনুভব জন্ম নেয়, তা একধরনের দৈনন্দিন ক্লান্তির রূপক, যা আমি নিজে দিনের শেষে অনুভব করি। এই অবসাদ, যা স্বপ্ন ও যাপনের মধ্যবর্তী একটি ধূসর অঞ্চল, সেখানে কবির অভিব্যক্তি আমাকে নতুন করে উপলব্ধির প্রশিক্ষণ দেয়। সে বিকেলের ভেতর চায়ের ভাপ আর চোখের কোণে জমে থাকা জল যেন একাকার হয়ে যায়, আর আমি টের পাই, এই গলন আসলে বেঁচে থাকারই অন্য নাম।
আরও স্পষ্টভাবে বললে, ‘বৃষ্টিপুরাণ’ কবিতাটি পাঠের সময় যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়, তা প্রায় আত্ম-অভিষেকের মতো। ‘নক্সাকাগজের ভাঁজে জমে থাকা দিনগুলি/ ছেঁড়া নকশিকাঁথায় জড়াজড়ি ভাই-বোন’—এই দুই পঙ্ক্তি আমাকে প্রায়শই ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমার নিজস্ব শৈশবের বারান্দায়, যেখানে বৃষ্টির দিন মানেই ছিল ভেজা জামা, ছিন্ন ছাতা আর হারিয়ে যাওয়া কোনও খেলনার কষ্ট। এ এক ভিজে-যাওয়া মায়া, যার স্পর্শে আমার চোখ অনায়াসেই ভিজে ওঠে। আর এই ভিজে ওঠার মধ্যেই রয়েছে কবিতার সত্যকার পাঠরসাস্বাদন—যেখানে ভাষা, অনুভব ও ব্যক্তিগত স্মৃতি এক অনির্বচনীয় সুরে গেঁথে যায়।
এই কাব্যগ্রন্থটি শুধু পাঠের নয়, নিঃশব্দ উচ্চারণের এক সমবেত আয়োজন। ‘আমি বিষয়ক’ খণ্ডের দ্বিতীয় কবিতায় যখন বলা হয়—‘আমি/ ভা/ ঙ/ ছি/ নিজেকে/ ক্র/ মা/ গ/ ত/ কিন্তু ভেঙে পড়ছি না’—তখন এই বিচ্ছিন্নতা, এই গৃহপলায়ন, এই শৈথিল্যের অনুরণন আমাকে আমার এক বিষণ্ন সন্ধ্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। তখনও আমি ঠিক ঠিক জানতাম না—আমি কী হারিয়েছি, কাকে হারিয়েছি, কিংবা আদৌ কিছু হারিয়েছি কিনা। তবু ওই ‘ক্র’ অক্ষরের একা দাঁড়িয়ে থাকা, তার পাশে ভাষার গড়নে এক নির্জনতা—সেই ভাষা আমাকে বলে দেয়, আমি একা নই। কবিতা তখন আর বহির্দেশ নয়, সে হয়ে ওঠে আমার আত্মস্বরূপের ভাষাবিশিষ্ট মুখচ্ছবি।
আবার, ‘ফোকাস’ কবিতায় যে দৃশ্যরচনার বিভ্রম, তা আমার বর্তমান দৃষ্টির অব্যবস্থিতি এবং স্মৃতিচারণের প্রতিফলন হয়ে ওঠে। ‘নিউরনে এঁকে রাখি সেই ছবিখানা / ব্লার হয় বারবার আমার ফোকাস’— এই ফোকাস-বিকৃতি শুধু চশমার গ্লাস নয়, এটি আমার অতীতকে দেখার চেষ্টারও প্রতীক—যেখানে কিছু কিছু স্মৃতি এতটা ঝাপসা যে, আমি নিশ্চিত নই, তা আদৌ আমার জীবনেই ঘটেছিল কি না। কবিতার মাধ্যমে যখন নিজেকে পুনরাবিষ্কার করি, তখন দেখি, স্মৃতির সেই অস্পষ্টতা আসলে আমার অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষভাবে ‘বন্ধু মরে গেলে’ কবিতার অভ্যন্তরে আমার যে অনুরণন জন্ম নেয়, তা প্রায়শই আমাকে থমকে দেয়। ‘কেন এত তাড়া ছিলো তোর?’এই একটি পঙ্ক্তি একবার পড়লে আর পিছু ছাড়ে না। এই কবিতাটি তাই শুধু মৃত্যু নয়, বন্ধু হারানোর অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে—এখানে কবির শোক আমার হয়ে পড়ে, আমি কবিতার পঙ্ক্তিতে গলিয়ে দেই নিজের বেদনার অক্ষর।
এই কবিতাগুলি পাঠের সময় আমার বারবার মনে হয়েছে, এ কাব্যগ্রন্থ যেন এক সজীব অথচ নিরুত্তাপ ডায়েরি—যার প্রতিটি পাতায় আমার নিজের ছায়া পড়ে থাকে। ‘আঙুল কাব্য’ কবিতায় যেমন বলা হয়—‘আঙুলের ভাষা দোভাষীও বোঝে না রে’—এই আত্মভাষার অবোধ্যতা, এই নির্ভুল অথচ অনুবাদ-অযোগ্য অনুভব আমার নিজের ভেতরকার রাগ, প্রেম, অতৃপ্তি ও হতাশার রূপান্তরিত ভাষায় রূপ পায়। আমি নিজেই অনুভব করি, আমার আঙুলে জড়ো হয়েছে বহুদিনের অব্যক্ত বাক্য—যা আমি কাউকে বলতে পারিনি, কিন্তু এই কবিতাগুলিতে তার উচ্চারণ ঘটে।
এমনকি ‘আয়াত’ কবিতাটি, যা রাজনৈতিক শোক ও সামাজিক নির্মমতার এক মূর্ত ভাষ্য, সেটিও আমার ব্যক্তিগত পাঠরসায়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সেই পলিথিনে মোড়ানো দেহ, সেই উড়ন্ত চুল, সেই নিখোঁজ চার খণ্ডের কথা পড়তে পড়তে আমি কেবল ভয় পাই না, আমি অনুতপ্ত হই—যে সমাজে বাস করি, সেই সমাজের কাছে আমি দায়মুক্ত নই। কবিতার প্রতিটি লাইন আমাকে আমার নির্লিপ্ততা মনে করিয়ে দেয় এবং এই স্মরণ-প্রক্রিয়াই হয়ে ওঠে এক ধরণের মৌলিক পাঠ অভিজ্ঞতা—যা শুধু শোক নয়, বরং আত্মপরীক্ষার এক কঠিন আয়না।
এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আমি প্রায়শই অনুভব করি, আমি কেবল একজন পাঠক নই—আমি এই বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতাদের একান্ত সাক্ষী। আমার প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গে, আমার ছোট ছোট অনুভবের সঙ্গে, এই কবিতাগুলি এমনভাবে মিশে যায় যে, তাদের এবং আমার মাঝে আর কোনো সীমারেখা থাকে না। সেই মুছে যাওয়া সীমারেখার মধ্যেই আমি আবিষ্কার করি কবিতার মৌলিকতা—এরা কোনো আদর্শের অনুবর্তী নয়, এরা কোনো নির্দিষ্ট দর্শনের অনুসারী নয়, তারা প্রতিটি পাঠকের নিজস্ব অনুভবকেন্দ্রিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের নতুন করে রচনা করে।
পাঠ হিসেবে একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা আমার কাছে শুধু কাব্যগ্রন্থ নয়, এক প্রকার আত্মপাঠ। এই কবিতাগুলি আমার জন্য হয়ে ওঠে অব্যক্ত যন্ত্রণার ব্যাকরণ, অবোধ্য আনন্দের সংগীত এবং অপূর্ণ সংলাপের ভাষিক বর্ণনচিত্র। প্রতিটি কবিতা পড়া মানে একধরণের নীরব আত্মদর্শনের প্রক্রিয়া, যা কখনো ব্যথায়, কখনো বৃষ্টির ধ্বনিতে, কখনো বা নিছক চুপ করে থাকার মধ্যে ফুটে ওঠে। এভাবেই কবিতাগুলোর ভেতরে আমি নিজের জীবন, যাপন এবং যন্ত্রণা খুঁজে পাই—এবং এই খোঁজার মধ্যেই নিহিত থাকে আমার পাঠের সত্য, আমার পাঠরসাস্বাদনের মৌলিকতা।
৫.
আউয়াল আহমদের একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা কাব্যগ্রন্থটি আধুনিক বাংলা কবিতার বিস্তৃত ভূদৃশ্যে এক অপার নির্জনতার মত আবির্ভূত হয়, যেখানে শব্দেরা কেবল অর্থ নয়, আঘ্রাণ, অন্ধকার, অনুরণন এবং আনত প্রতিচ্ছবির প্রতিস্থাপন হিসেবে কাজ করে। এর নন্দনতত্ত্ব কোনো জড় কাঠামোতে আবদ্ধ নয়; এক প্রকার চলমান অন্তর্মুখী ও বহুমাত্রিক সৌন্দর্যবোধ, যার মধ্যে রয়েছে স্থবিরতা ও স্পন্দনের সহাবস্থান। এই কাব্যের নান্দনিকতা নির্ভর করে দৃশ্যকল্পের প্রগাঢ়তা, ধ্বনিসংবেদনের অভ্যন্তর এবং ভাষার লঘু কিন্তু অপ্রতিরোধ্য প্রবাহের ওপর, যা বাংলা কবিতায় দুর্লভ হয়ে উঠছে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় উত্তরবঙ্গীয়, মফস্বলীয় ও কেন্দ্রহীন ভাষিক স্বরকে আত্মস্থ করে এই কবিতাগুলি যে ধরনের অস্তিত্ববাদী বাস্তবতা নির্মাণ করে, তা একদিকে নাগরিক বিষণ্নতা ও অন্যদিকে সামাজিক অবসাদকে চিহ্নিত করে। এটি বাঙালি কবিতার ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান, কারণ এ গ্রন্থে না আছে মহান পুরাণচেতনার ভার, না আছে দার্শনিক অন্তর্ঘাতের প্রদর্শনবাদিতা—আছে শুধুমাত্র এক নিঃশব্দ, বৃষ্টিতে গলে যাওয়া মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া।
এই গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য এই যে, তা আধুনিক কবিতাচর্চার বাহ্য আড়ম্বর থেকে বেরিয়ে এসে এক অন্তরঙ্গ সংলাপের জন্ম দেয়—যেখানে কবিতা কেবল মঞ্চ নয়, কবিতা আড়ালের ভাষা, যেখানে কথন নয়, তা নীরবতা কাব্যিক হয়ে ওঠে। কবিতা এখানে চিৎকারের নয়, কান্নারও নয়, কবিতা এখানে নিঃশব্দে গলে যাওয়া আহ্বানের, যাকে পাঠক নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভেতরে প্রতিধ্বনিত করতে পারেন।
এই কাব্যগ্রন্থের ভবিষ্যৎ পাঠ একাধিক মনোভঙ্গি থেকে নতুন আলোচনার জন্ম দিতে সক্ষম। প্রথমত, এটি একান্ত ব্যক্তিক, অন্তর্লীন ও ‘আধা-সংসারিক’ অস্তিত্বচর্চার যে অভ্যন্তর গড়ে তোলে, তা বাংলা কবিতায় নারীর দৈনন্দিনতা ও পুরুষের শোকসন্ধানের সীমানায় সংলগ্ন। এই সীমানায় দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ পাঠে উঠে আসতে পারে মনস্তাত্ত্বিক পাঠ, যেখানে ‘ভেজা না-ভেজার উপাখ্যান’ হয়ে উঠবে যৌন-সামাজিক দ্বিধার পাঠ্যপুস্তক।
দ্বিতীয়ত, ভাষা ও চিত্রকল্পের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এখানে যতটা সরল মনে হয়, পাঠ যত গভীরে প্রবেশ করে, তা তত জটিলতায় ধরা দেয়। তাই কবিতার মধ্যে গৃহ-প্রতীক, বৃষ্টি-প্রতীক, বন্ধুত্ব, মৃত্যু ও মায়ার চিহ্নায়নভিত্তিক সাংকেতিক পাঠ বিশ্লেষণেরও বিশাল সুযোগ রয়েছে। এই কবিতা রচনায় ব্যবহৃত অলংকারের স্তরবিন্যাসও ভবিষ্যতে কবি আউয়াল আহমদের কাব্যভাষার উপর আলাদা গদ্যভিত্তিক আলোকপাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
তৃতীয়ত, কাব্যগ্রন্থটিকে নগর ও গ্রাম—এই দুই পরিসরের ছায়াময় সহাবস্থানের পাঠেও দেখা যেতে পারে, যেখানে ‘রুফটপ চিড়িয়াখানা’ কিংবা ‘শিশুপার্ক বঞ্চিত শিশু’ এক নতুন ধরণের নাগরিক সমালোচনার পথ উন্মোচন করে, যা ফ্রেমওয়ার্কহীন প্রতিরোধ হিসেবে আবির্ভূত। এই গ্রন্থ ভবিষ্যতে পাঠকের মনে নির্বিচারে দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব সঞ্চার করবে—কারণ এখানকার প্রতিটি কবিতা নিজের অর্থ নিয়ে অনড় থাকে না, পাঠকের চেতনায় গলে গিয়ে একটি নতুন অর্থ নির্মাণ করে। এই রূপান্তরপরায়ণতা গ্রন্থটিকে শুধু কাব্যগ্রন্থ নয়, ভবিষ্যতের অনুধ্যানের ক্ষেত্রেও এক জটিল ‘রিডিং ফিল্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবে।
আউয়াল আহমদের কবিতায় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কখনো সরাসরি স্লোগানধর্মী নয়, তা নির্মিত হয় এক সাংগঠনিক নৈঃশব্দ্যে, যেখানে প্রতিপক্ষকে উচ্চারণ না করেও অস্বীকার করা হয়। এই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে যে-বিশ্বাসহীনতা, অনাস্থা এবং বিদ্রুপ জেগে থাকে—তা পাঠকের কাছে শুধু রাজনৈতিক-সামাজিক পরিসরে নয়, ভাষার ভেতরেই এক কর্তৃত্বহীন অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়।
‘কনভোকেশন’ কবিতায় যে নবীন গ্রাজুয়েটের সজ্জা, যে ক্যারিকেচার-রূপক, তার মধ্যেই ফুটে ওঠে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রহসন ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রূপতাড়িত নাগরিক সত্তার অদ্ভুত রূপান্তর। আবার ‘মোড়ক উন্মোচন’ কবিতায় দেখা যায় এক প্রকার লুকোনো জীবন, লুকোনো সত্যের নির্লজ্জ উন্মোচনের আহ্বান—এ যেন কোনো প্রচলিত সামাজিক আদর্শ বা পরিচয় কাঠামোর বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ।
কবির প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা শুধুমাত্র সামাজিক পরিসরে নয়, কাব্যিক পরিসরেও স্পষ্ট। তিনি পরম্পরাগত শব্দচয়ন, ছন্দ ও অলংকার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এক হাল্কা, টানা অথচ তীক্ষ্ণ ভাষা নির্মাণ করেন—যা প্রতিষ্ঠানপ্রসূত সাহিত্যপ্রতিষ্ঠার কাঠামোয় বসতে চায় না। তার কবিতা আত্মজৈবনিক, পরাবাস্তব ও নিঃসঙ্গতা-নিবিষ্ট এবং এই নিঃসঙ্গতাই এক প্রতিরোধী কাব্যরীতি হয়ে ওঠে—যেখানে ‘আমি বিষয়ক’ কবিতার নিজস্ব টুকরো স্ববর্ণনাগুলি এক প্রতিস্বর-রূপ নেয় প্রধান ধারার বিপরীতে। এইভাবে, আউয়াল আহমদের কাব্যভুবন একটি নৈরাজ্যিক অথচ গভীর সংগঠিত স্থাপত্য—যেখানে প্রতিষ্ঠান মানেই পর্দা এবং কবিতা মানেই সেই পর্দা ছিঁড়ে ফেলার নৈঃশব্দ্য।
৬.
‘একান্ত’—এই শব্দটি কোনো কেবলমাত্রিক সম্বোধন নয়, এটি এক আত্মস্বরচিত চেতনা, এক শব্দচিহ্নে গাঁথা আভ্যন্তরীণ অস্তিত্ববোধ, যার প্রতিধ্বনি শুধু কবিতার শরীরে নয়, পাঠকের চেতনার নিগূঢ় প্রদেশেও প্রবাহিত। একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা কাব্যগ্রন্থে এই ‘একান্ত’ ক্রমশ রূপান্তরিত হয় একটি অস্তিত্ববাদী বোধে, যেখানে ব্যক্তি হয়ে ওঠে এক নিভৃত উচ্চারণের পরিসর—নিজেকে নিংড়ে, ছেঁকে, পুনর্গঠনের নিরবধি প্রয়াসে প্রবেশ করে এক অনুচ্চারিত আলাপে। এই আলাপ কারো সঙ্গে নয়—এ যেন এক আরাধ্য নৈঃশব্দ্যের ভেতরে নিজেরই এক ছায়াসত্তার সঙ্গে গোপন বাক্যালাপ।
একান্ততা, এই কাব্যগ্রন্থের প্রেক্ষিতে, নিছক একাকীত্বের অনুবাদ নয়—বরং এটি এক পরিশ্রুত শ্রবণপ্রক্রিয়া, যা আত্মশ্রুতি ও আন্তর্যাত্রার সূক্ষ্মতম স্তরে জেগে ওঠে। একাকীত্ব যেখানে বহির্জগতের অনুপস্থিতিতে জন্ম নেয়, সেখানে একান্ততা গড়ে ওঠে অন্তর্জগতের নিবিড় উন্মোচনে। আউয়াল আহমদের কবিতার ‘একান্ত’ কোনো নাম, ব্যক্তি, বা উপমার ঘরানায় আবদ্ধ নয়—সে এক চলমান উপলব্ধি, এক ধ্যানসঞ্চারিত প্রতিচ্ছবি, যেখানে পাঠক নিজেই হয়ে ওঠে নিজস্বতম পাঠ। এই ‘একান্ত’ এক ধরণের আত্মঅভিসার, যেখানে কবিতার পঙ্ক্তি আর পাঠকের অভিজ্ঞতা একে অপরকে প্রতিসৃত করে।
বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে-কবি আটকে পড়েন, তিনি আসলে থেমে যান না। তিনি প্রবেশ করেন এক মৃদু ধ্বনিসমৃদ্ধ অবসরে—যেখানে জল শব্দ হয়ে ওঠে, আর শব্দ হয়ে ওঠে আত্মবিচ্ছেদের অন্বয়। এই ‘আটকে পড়া’ তাই সময়ের প্রতিক্রিয়া নয়, সেটা অন্তঃপ্রবাহের এক আলস্যমগ্ন ধ্যান। এই ধ্যানে পাঠকের অন্তর্জগতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এক মন্থর, কিন্তু নিবিড় ভাষাবিস্তার—যেখানে স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা, শোক, প্রেম, অনুশোচনা—সব একাকার হয়ে গিয়ে নিজের জন্য এক অন্তর্লীন অভিধান রচনা করে। এই অভিধানে নেই কোনো বাক্যতালিকা, নেই সংজ্ঞার কঠোরতা—আছে শুধু প্রতিধ্বনির রেশ, অনুভবের ছায়া, আর চেতনার মৃদু আলোছায়া।
এই বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা পাঠকের হৃদয়ে এসে পুনর্জন্ম নেয়। তারা কবির শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাঠকের অনুভবময় ঘরে আশ্রয় খোঁজে, সেখানে তারা অনুরণনের দীর্ঘ প্রশ্বাসে আবাস গড়ে তোলে। পাঠের অভিজ্ঞতায় এই কবিতাগুলি আর লেখকের থাকে না, তারা হয়ে ওঠে পাঠকের ব্যক্তিগত উন্মোচন। প্রত্যেক পাঠ এক নতুন জন্ম, এক নতুন প্রতিচ্ছবি, যেখানে কবিতার চিত্রকল্প ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় পাঠকের অন্তর্বাস্তব চিত্ররূপ—যা বহির্জগৎ নয়, তা অন্তর্জাগতিক।
‘একান্ত’ হয়ে ওঠা আসলে এক ধরণের নৈঃসঙ্গ্যবিলাস—যেখানে পাঠক নিজের নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে রাখে না, তাকে রূপ দেয় এক শিল্পরূপে। এই নিঃসঙ্গতা কোনো অসহায়তার স্বাক্ষর নয়, এক আত্মবদ্ধ নান্দনিকতার অনুশাসন। এই কাব্যগ্রন্থ পাঠকের সেই সক্ষমতাকে উসকে দেয়—সে যেন নিজের নীরবতা, নিজের গোপন ক্ষরণ, নিজের ভুলে যাওয়া অপেক্ষাগুলিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। ‘একান্ত’ হয়ে ওঠা মানে তাই শুধু কোনো এক চরিত্রে ঢুকে পড়া নয়, নিজের চরিত্রকে কবিতার শরীরে—তার ভাষার কাঠামোয় প্রতিস্থাপন করা।
কবি আউয়াল আহমদ নিজেকে গোপন করে রেখে গেছেন তার শব্দসমূহের ছায়াতলে, যেন পাঠকের জন্য অনাবিষ্কৃত একটি পথ ফাঁকা রাখেন। সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাঠক যখন তার নিজের অভ্যন্তরের কাচভাঙা শব্দগুলিকে চিনতে শুরু করে, তখন সে-ও এক একান্ত পাঠকের জন্ম দেয় এবং নিজেই হয়ে ওঠে একান্ত এক পাঠ। বৃষ্টি এখানে কেবল বাহ্যিক প্রকৃতির কোনো ঘটনা নয়, এটি হয়ে দাঁড়ায় স্মৃতির সংবেদী আচ্ছাদন, যা প্রতিটি পাঠে আরেকবার নতুনভাবে সিক্ত করে পাঠকের অবচেতন মনস্তর।
এইভাবে ‘একান্ত’ হয়ে ওঠার গল্প আসলে একান্ততা ও পাঠের অভ্যন্তরীণ সখ্যের গল্প—যেখানে পাঠক আর কবি আলাদা থাকে না, ভাষা আর ভাব পৃথক থাকে না, তারা মিলিত হয় এক অনুভবজাত গভীরতায়। এই গভীরতা শব্দের নয়, এটি চেতনার; এটি ভাষার নয়, এটি স্পন্দনের। একান্ত বৃষ্টিতে আটকে পড়া কবিতারা পাঠ মানে শুধুমাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ নয়, এটি এক বৃষ্টিস্নাত আত্মঅভিসারের দিগন্তে এসে দাঁড়ানো। পাঠক সেই দিগন্তে তাকিয়ে দেখে, তার নিজের ছায়া ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে কবিতার জলে, আর সেই গলনেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভাষা—এক একান্ত ভাষা, যা শুধুই তার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন