ধানক্ষেতে ছড়ানো রক্তযোনির ফসল || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

সোমবার, ২৬ মে, ২০২৫

ধানক্ষেতে ছড়ানো রক্তযোনির ফসল || শাফি সমুদ্র




একটা গন্ধ লেগে আছে মেয়েটির শরীরে—রক্তের গন্ধ নয়, গভীর স্তরে নেমে যাওয়া এক আধপচা, লালা মেশানো, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা গন্ধ। সেই গন্ধ পুরুষের, কোনো একজন নির্দিষ্ট পুরুষ। এক সম্মিলিত, লোমশ, গা-জড়ানো, শাদা কামরসভর্তি আদিম গোষ্ঠীর মুখগহ্বর থেকে আসা এক স্যাঁতস্যাতে অসভ্যতার গন্ধ। এটা এমন এক গন্ধ, যা বাষ্প হয়ে তার যোনির ভেতরে ঢুকে আত্মজীবিত চিৎকারকে কফের মতো আটকে রেখেছে। তার শরীর এখন এক দগ্ধ মাংসের থালা, জমে থাকা ঘামের স্তরে স্তরে লেগে আছে কুকুরের প্রস্রাবের মতন দুর্গন্ধ। যেমন একটা পুরোনো কারাগারের মেঝেতে পচে যাওয়া বীর্যের গন্ধ লেগে থাকে।


তার যৌনাঙ্গ এখন আর অঙ্গ নয়, সেটা একটা গলিত বাঁশি—না বাজে, না থামে, শুধু ঘর্মাক্ত উষ্ণতায় ফুঁয়ের ঘোঁৎঘোঁৎ ধ্বনি তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। ওই বাঁশির ভেতর জমে আছে কামুক  পুরুষদের শ্বাস। ধর্ষকের চুপ থাকা প্রেতের মতো পিতার হি-হি হাসি। রাষ্ট্রের ভেতরে মুখোশ পরা দেশদরোদী আর ধর্মের মুখোশপরা পুরোহিত—সবাই মিলে এক কুৎসিত কোরাস হয়ে বাজায় সেই বাঁশি।


সে হাঁটে আর প্রতিটি হাঁটার সাথে তার যোনি থেকে গলে পড়ে এক চিলতে বাজনার মতো শব্দ। বিকৃত ব্যথার গুঞ্জন, যেমন একটা মৃত শিশুর কান্না মিশে যায় ড্রেনের ফেনার সাথে। সে নিজেই টের পায়, এই গন্ধ এখন তার চুলে লেগে আছে। নখের নিচে ঢুকে গেছে। যোনিপথে রক্তের ধারে ধারে জমে আছে দাঁতের আঁচড়ের কফ। কামরস আর দগদগে পুঁজের নোনতা কুৎসা। সে স্নান করে, গায়ে ঘষে সাবান, কিন্তু সাবান গলে গিয়ে তার যোনি চুলকায়—যেন একধরনের অদৃশ্য ফাঙ্গাস, যা শুধু পুরুষের লালা চেনে। এই গন্ধ, এই বাঁশি, এই বাজনার ভেতর সে আর নিজের শরীরকে চিনতে পারে না। সে শুধু জানে এই ঘিনঘিনে গন্ধটাই এখন তার চিহ্ন, যার সামনে দাঁড়িয়ে সুশীল সমাজ হেচকি তোলে আর ঈশ্বর মুখ ফিরিয়ে নেয়।


রক্ত। হ্যাঁ, রক্ত। না, ওটা পিরিয়ডের না, না কোনো কাটা-ছেঁড়ার পরিণতি। ওটা অন্য রক্ত—একটা ছিঁড়ে যাওয়া কণ্যা-কেন্দ্র থেকে গড়িয়ে পড়া ঘন, লাল, তাপময়, হু-হু শব্দে নেমে আসা তরল। চোঁ-চোঁ শব্দ করে। কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে—‘এইটা তোর শরীর না, একটা নর্দমায় প্রবেশের নালা।’


সে তাকিয়ে থাকে— না, বিছানায় না। না, রাস্তার ধারে না। না, ঘাসে না। ওটা গড়িয়ে পড়ছে তার দুই পায়ের মাঝখানে তৈরি হওয়া একটা ক্ষীণ খালে। ছোট কিন্তু গভীর। যেন কোনো অদৃশ্য করাত দিয়ে তার ভেতরে একটি খাল কেটে দেওয়া হয়েছে, যেখান দিয়ে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে জমছে।


জমছে মানে? থেমে থেমে না, একটা স্তর তৈরি হচ্ছে। গাঢ় লাল থকথকে স্তর। একসময় তার মনে হলো—‘এইটা তো ধানের জমির মতো হয়ে উঠছে!’ সে ভেবে ওঠে—‘এই রক্ত দিয়ে কি ধান ফলবে?’ সে ভাবে— ‘লাল জলচাষ হবে, মাটি যদি রক্ত চুষে নেয়, তবে সেই জমিতে বীজ গজাবে কি? না কি, জমিতে ফাটল ধরে উর্বরতা হারাবে?’


সে দেখে রক্তের ফোঁটা ছোট ছোট গোল হয়ে জমছে—একটা নিঃশব্দ বীজ, যাকে কেউ কোনোদিন ছুঁতে চাইবে না। সে ভাবে—‘এই বীজ কার? ধর্ষকের? রাষ্ট্রের? ধর্মের? না কি সেই মানুষগুলোর যারা ভালো মেয়ে হতে বলত?’ তার ত্বকে চুলকানি উঠছে—না বাহিরে না, ভেতরে। একটা অচেনা লতানে গাছ যেন ভেতরে ঢুকে পাতার মতো ফুঁড়ে ফেলছে যোনির দেওয়াল। সে ভাবে—‘এই জমিতে কেউ কি সত্যি ধান বুনবে? কে বুনবে? কে?’ 


সে ভাবতে ভাবতে দেখতে পায়—একটা কল্পিত কৃষক নেমে পড়েছে তার ভেতরে, হাতে ধানের বীজ—তাকে ডাকে না, জিজ্ঞেস করে না, শুধু ছুঁড়ে দেয়। কিছু বীজ—বীজ মানে ধানের মতন কিছু। জমির ওপরে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে। সে চিৎকার করতে চায়—এই জমি নিষিদ্ধ। এই জমির খাজনা মাফ করা হয়নি। এই জমি ধর্ষণকৃত, জিজ্ঞাসাবিহীন, পরিচয়হীন। 


রক্ত এখন গড়াতে গড়াতে একটা স্লোগানের মতো হয়ে উঠছে তার মাথার ভেতরে— ‘এই শরীর রাষ্ট্রের নয়। এই জমি তোমার জমি নয়। এই রক্ত দিয়ে খাদ্য নয়, কেবল হিসেব চাওয়া যাবে।’

মেয়েটির মা কাঁদছে। চুপচাপ, গলা টিপে ধরে, যেন কান্নাও শুনলে কেউ না বলে—‘এটা তো নাটক।’ মুখ ঢেকে রেখেছে আঁচলে, যেন দোষ লুকোতে চাইছে—দোষ? কার দোষ? কিসের? জন্ম দেওয়ার? না কি কন্যা জন্মানোর?


ওর পিতা কোথায়? বাউলদের সঙ্গে গেছে বহুদিন। দূরের কোন নদীপারের গ্রামে। আজ হয়তো এক তাল বাঁশি হাতে গান ধরেছে—‘আমি এক গাঙের তীরে দাঁড়াইয়া ভাবি, সংসার কোনখানে, আর মায়া কোনখানে?’ কিন্তু মেয়ে যে তার রক্ত, তার হাড়ের ভেতর থেকে গড়া, সে কি পড়ে আছে কোন শ্মশানের কোণে, তা কি কখনো জানা হবে পিতার? অথবা আদৌ জানার আগ্রহ আছে?


তারা ভেবেছিল, ও গান গাইবে। মায়ের কণ্ঠের মতো করে। নরম। সরল। নিরীহ। তারা ভেবেছিল, ও কোন উৎসবে হারমোনিয়ামের পাটে বসে গাইবে বৃষ্টির গান, বাউলের ভাষা, প্রেমের মধুমাখা তান। কিন্তু এখন? ওর যোনি হয়ে গেছে এক রক্তাক্ত বাদ্যযন্ত্র।


হ্যাঁ, ঠিক একখানা যন্ত্র। বাদ্যযন্ত্র, যেখানে ছন্দ নেই, সুর নেই—আছে শুধু কষ্টের রগড়ানি, শব্দের ঘষা, রক্ত আর কান্নার টান। প্রতিবার কেউ তার শরীর ছিঁড়ে ঢোকে, প্রতিবার একটি অনাহুত অক্ষর তার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে শব্দ গজায়, অজস্র শব্দ—কিন্তু তারা কবিতা নয়। তারা হিংসা, আতঙ্ক, ঘৃণা।


প্রতিটি শব্দ তার শরীরের ভেতরে ঘষে, আঁচড় কাটে। ব্যথা দেয় না—ব্যথাকে ছাড়িয়ে যায়। শব্দেরা পড়ে—‘যৌনতা কি যুদ্ধ ছিল?’ না, কেউ ওকে জিজ্ঞেস করেনি। শুধু নিয়ে গেছে। হাত, দাঁত, তর্জনী, কোমর—সব একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যেন শিকার! 


ও প্রশ্ন করে—‘রাষ্ট্র কোথায় ছিল?’ ঘরে ঘরে পতাকা ওড়ে, মাইকে ঘোষণা বাজে, কাগজে ছবি ছাপে। কিন্তু যে রাতে তার শরীর ভেঙে দেওয়া হলো, সেই রাতে তো কোন রাষ্ট্র ছিল না। রাত্রির কান্না কেউ শুনতে পায় না, রাষ্ট্র তো নয়ই। রাষ্ট্র ব্যস্ত ছিল উন্নয়ন প্রকল্পে, মন্ত্রী বদলে, ধর্ষণকে ব্যতিক্রম প্রমাণে।


ও ভাবে, ‘আমি কি কোনো ফসল ছিলাম?’ ফসল তো কাউকে খেতে হয়। কাউকে কাটতে হয়। ওর শরীরের ওপর দিয়ে বহু কামান গড়িয়েছে। যারা গড়িয়েছে, তারা কি ছিল শত্রু? না বন্ধু? না প্রেমিক? না কেবলমাত্র মালিক? ও ফসল ছিল। ক্ষেতে ছিল। দখলে ছিল।


তার শরীরে এখনো বাজে সেই রক্তাক্ত বাদ্যযন্ত্র। যোনিতে বাজে ভাঙা বাঁশির মতো কাঁপা। কোনো শুদ্ধতা আর নেই। কোন সাধনা নেই। ওর শরীর এখন দলা হয়ে আছে। একটা ভাষাহীন আর্ত বুকফাটা আর্তনাদ—যে আর্তনাদে গান নয়, ধ্বংসের ছন্দ উঠে আসে। মা দেখে, মেয়ের চোখে আগুন। না, সেই আগুন কাঁদে না। কেবল জ্বলতে থাকে।


তিনজন পুরুষ ঢুকেছিল ওর শরীরে। প্রথমজনটা ছিল যেন একটা ফ্যানের কটকট শব্দ। ঠাণ্ডা, ঝাপসা, ছুরির মতো গিলে নেওয়া। দ্রুত। সে এত দ্রুত ঢুকেছিল, ওর শরীর বুঝতেই পারেনি। একটা ঝাপটা, একটা ঝাঁকুনি। তারপর সে গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু পিছনে রেখে গেছে একটা ঠাণ্ডা ছাপ, যেন বরফ ছুঁয়ে গেছে সরাসরি ওর গায়ের মাংসে। কেন যেন, ওর চোখ এখনও ফ্যানের সেই নির্জীব ঘূর্ণনের গর্জন শুনতে পায়। যে ঘোর লাগিয়ে দেয়, কিন্তু কোনকিছুই শোধরায় না। ওর শরীর জমে আছে—রক্ত জমে, স্বপ্ন জমে, শিহরণ জমে।


দ্বিতীয়জন ঢুকেছিল বৃষ্টির মতো। অন্ধকার বৃষ্টি। ভারি, গাঢ়, বোবা। বৃষ্টি যা গাছের কাণ্ড ভাঙে না, কিন্তু মাটিতে হুড়মুড় করে ধ্বংস করে দেয়। ওর শরীরে ঢুকে পড়েছিল যেন বিষাক্ত বৃষ্টি। একটু একটু করে গা ঘেঁষে, ঠোঁটের কাছে, বুকের ভেতর, নাভির ঠিক ওপরে। ঘনঘন ঝমঝম করে পড়ছিল, কিন্তু কোন শব্দ ছিল না—শুধু ঘোর আর গলদ। শরীরের ভেতর থেকে ওর নিজের রক্তও ভিজে যাচ্ছিল, এ যেন এক অচেনা ভেজা সুনামি। দুধের মতো শাদা হাতে ওর গায়ের নরম অংশে টানা টানা বৃষ্টি পড়েছিল। একেকটা ফোঁটা যেন বিষ দিয়ে ঢাকা। কেউ বলেছিল বৃষ্টি পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু এই বৃষ্টি? এই বৃষ্টি কালো, বিষাক্ত আর কোনো কিছু পরিষ্কার করে না। আরো গভীর গর্ত গর্ত করে কেটে দেয়।


তৃতীয়জন ঢুকেছিল হাসি নিয়ে। হাসি নাকি হাহাকার। সেই হাসির মধ্যে ছিল থুথু, বিষ আর ঘৃণা। একসাথে কনকনে ঠান্ডা। হাসতে হাসতে সে বলেছিল, ‘তোর রক্ত দিয়ে লাল ধান ফলবে, মেয়েমানুষ!’ ওর গলায় যেন ধাতুর একটা গুঁড়ি গড়িয়ে পড়ল। শব্দগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল গলা থেকে, হৃদয়ের মাংসের ওপর, একরাশ ছুরি নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। ‘মেয়েমানুষ’—যে শব্দটা ওকে বারবার হত্যা করে, বারবার মাটি চাপা দেয়, যেন ওকে কোনো মানুষই না মনে করে। ওর শরীর জড়িয়ে পড়ল যেন বিষের জালে। সে হাসি ছিল বদমেজাজি, নোংরা, প্রাচীন কালের ঘটিবাটির মতো। একটি হাসি, যা জন্ম দেয় এক অন্ধকার যন্ত্রের গর্জন।


তারপর—স্তব্ধতা। একটু থেমে যাওয়া। যেন পৃথিবী ভেঙে পড়ছে। ঘুম। ঘুম শান্তিময় ছিল না। ঘুম ছিল ওর জিহ্বার নিচে এক বিষাক্ত ঝিল্লি। ঘুম ছিল একটা নোংরা নদীর ঢেউয়ের মতো বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে সব স্মৃতি, সে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যা চায়নি কেউ দেখুক, অন্তত ছুঁয়ে দেখুক।


এখনো মনে পড়ে, সেই তিন জনের গন্ধ। ময়লার গন্ধ, বয়লার গ্যাসের গন্ধ, ময়লার বস্তার গন্ধ। ওর চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেই ছায়া, যখন সে নিজেকে দেখতে পেয়েছিল অচেনা, নোঙরা, এক জীবন্ত কবরের মতো। কেউ বলেছিল, এটা যুদ্ধ। কেউ বলেছিল, এটা সমাজের নিয়ম। কেউ বলেছিল, এটা রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ। কিন্তু আসলে? এটা ছিল এক নির্মম অপবিত্র নাচ। তিন জন পুরুষ নাচিয়েছিল ওর শরীরের ওপর। আর সে ছিল তাদের পুতুল, তাদের লাঠি, তাদের নোঙরা খেলার সরঞ্জাম। 


সে আজ মুখ খুলেছে। শুধু মুখ নয়, তার যোনিও কথা বলছে। শুধু গলা নয়, তার ঊরু, তার বুক, তার রক্তাক্ত অন্তর্বাস, তার ছেঁড়া গলা— সব একসাথে কথা বলছে। সে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন রাষ্ট্রের গালে থুতু দেওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে।


সে বলছে—‘আমি সেই জমি, যেখানে রাষ্ট্র তার ধর্মীয় ধর্ষকতা চাষ করে। এটা কোনো কৃষিকাজ নয়, এটা কামকাজ। একটা রক্তমাখা রাষ্ট্রের পুজো, যেখানে মেয়েদের শরীরই সবচেয়ে পবিত্র জমি। সেই জমি রক্তে ভেজে, ঘামে নয়। সেই জমি থেকে ফসল ওঠে না—ওঠে শাদা রশি, ওঠে গর্ভপাত, ওঠে জন্মনিবন্ধনে লুকিয়ে রাখা নাম। ওঠে ধর্ষিতার নীরবতা আর তার ছেঁড়া জঙ্ঘার জ্যামিতি।’ তার চোখ যেন আগুনের স্তূপ—তাতে সোনা গলে না, রাষ্ট্র গলে।


সে বলে—‘আমি সেই শরীর, যেখানে পতাকার লাল রঙ আসলে রক্ত নয়। আমার যোনি থেকে চুঁইয়ে পড়া এক ইতিহাস, যেখানে সব স্বাধীনতা দিবস আসলে এক একটা গণধর্ষণের স্মারক। তোমরা পতাকা ওড়াও তো? সেই পতাকার কাপড়ে আমার রক্ত লেগে আছে। তোমরা তা দেখো না কারণ তোমাদের চোখে পবিত্রতা বলে একটা পর্দা পড়ানো আছে। যা আসলে পুরুষতন্ত্রের কনডম।’


সে থামে না। তার জিভে এখন বিদ্রোহ আছে। তার দাঁতের ফাঁকে থুতুর মতো জমে আছে ঘৃণা।

আরো বলতে থাকে-‘আমি সেই লাশ,যাকে রাষ্ট্র কবরে শোয়ায় না। তাকে প্রতিদিন শুইয়ে নেয় রাষ্ট্রের বিছানায়। ধর্ম এসে বলে, এটা পাপ না, পুরুষের অধিকার। রাজনীতি এসে বলে, শান্তি বজায় রাখো, বিচার চলবে। আইন এসে বলে, তুমি তো চুপ ছিলে? আর সাংবাদিকেরা আসে ক্যামেরা নিয়ে, আমার কান্না ধরার জন্য না। আমার বুক, আমার ঊরু, আমার ছেঁড়া অন্তর্বাস ধরার মতো করে আসে। তোমরা ব্রেকিং নিউজ চাও? আমি সেই হেডলাইন, যার নিচে থাকে অজস্র কমেন্ট—বাচ্চা ছিল না তো? এত রাতে বাইরে কী করছিল?’


সে ক্রমাগত বলতেই থাকে—‘আমি সেই জাতি, যার ইতিহাস গড়া হয়েছে রক্ত দিয়ে। সেই রক্ত সবসময় পুরুষের ছিল না। তোমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া গলায় আমার যোনির ঘা থেকে রক্ত ঝরে। তোমরা যখন পতাকা হাতে নাচো, আমি তখন ধর্ষকের স্পার্ম লুকিয়ে ধুয়ে ফেলি, কারণ দেশদ্রোহী হতে নেই, তাই না?’


তার শরীর দাঁড়িয়ে নেই। তার শরীর রুখে দাঁড়িয়েছে। যেনো নিজের বিরুদ্ধে নিজেকেই শাসন করছে। সে হুংকার দিয়ে বলতে থাকে—‘আমি সেই নারী, যার শরীরে ঢুকে বীর্য রেখে যায় শাসক, সন্ন্যাসী, শিক্ষক, প্রগতিশীল আর ধর্মপ্রচারক! সবাই আমাকে নিজের বলে, কেউ জিজ্ঞেস করে না— আমি নিজেকে চাই কি না। আমি কি মানুষ? নাকি একটা সিস্টেমের শ্বাসরোধক যন্ত্র?’


সে এবার প্রশ্ন করে, প্রশ্ন নয়, ছুরির মতো বিদ্ধ করে আমার বুকে। মেয়েটি বলে—‘রাষ্ট্র কি ত্রাতা ছিল? যৌনতা কি যুদ্ধ ছিল? আমি কি কোনো ফসল? তবে কেন আমার শরীর এতবার কাটাছেঁড়া হলো? কেন রাষ্ট্রের আইন আমার যোনির রক্তকে প্রমাণ বলে না? কেন আমার চিৎকার প্রমাণ নয়, কিন্তু ধর্ষকের নীরবতা কে তোমরা সন্দেহাতীত বলে চিহ্নিত করছো?’


সে চুপ করে না। সে আর ভিকটিম নয়। সে এখন প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে। আরো ক্ষিপ্রতা নিয়ে বলতেই থাকে—‘এই রাষ্ট্র, এই পতাকা, এই সংবিধান—সবাই আমার রক্ত চুষে বেঁচে আছে। সবাই আমার শরীর ব্যবহার করে পবিত্রতা বানায়। সবাই চায় আমি চুপ থাকি। কিন্তু এবার আমি থুতু ফেলেছি— এই সংবিধানে, এই পতাকায়, এই রাষ্ট্রের গালে। তোমরা যা পবিত্র বলো,আমি তা নোংরা বলি। তোমরা যা রক্ষা করো, আমি তা ছিঁড়ে ফেলি।’


ও এখন হাঁটে না—চাষ করে। নিজের শরীরের ভেতরে। যেখানে এক সময় যোনি ছিল, এখন সেখানে মাটি—পিচ্ছিল, রক্তমাখা,ছিন্নবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার নিচে চাপা এক কৃষিভূমি। সে প্রতি রাতে তার ঠোঁট কামড়ে ধরে—একটি একটি করে স্মৃতি বোনে। বীজ নয়, পচে যাওয়া স্পার্ম, রক্তমাখা নখ, থেঁতলে যাওয়া বুকের চামড়া, আর সেই হাসির শব্দ যেটা আজও পেছন থেকে বলে—‘এই দেহ তো রাষ্ট্রের বর্গা দেওয়া জমি।’


সে হাঁটে না—তার চলার শব্দ হয়—চপ্‌ চপ্‌ একটা স্যাঁতস্যাঁতে শব্দ, যেন কেউ একখান ধানগাছের গোড়া ধরে ছিঁড়ে তুলছে। প্রতি পা ফেলতেই শরীরটা কেঁপে ওঠে—হাড় ভাঙা ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘামের গন্ধ আর রক্তের কাঁচা দুর্গন্ধ মিশে আসে। সে ভাবে—এই জমি কি এখন বিক্রি হবে? যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল—সেই তিনজন, নয়জন, তেরোজন টোটাল গ্যাং। তারা কি এখন ভূমি অফিসার হয়ে এসেছে? সে কি একখান খতিয়ান? যার ওপর নাম উঠছে ধর্ষকের, রাষ্ট্রের, ধর্মগুরুর, প্রগতিশীলদের?


উপজেলা থেকে লোক আসে—তার স্তন টিপে দেখে—‘এখানে গর্ভ হবে তো?’ যোনির গভীরে ঢুকিয়ে দেয় ধাতব স্কেল— ‘গভীরতা কত?’ লিখে রাখে রিপোর্টে— ‘উরুতে আর্দ্রতা কমে গেছে, তবে জন্মদানের উপযোগী।’ তাকে জিজ্ঞেস করে—‘এই জমিতে ধান হবে তো?’


সে চুপ করে থাকে। কিন্তু তার চোখে শাদা বর্ণের স্পার্মের দাগ। রক্তের সঙ্গে মিশে কাদামাটি তৈরি করেছে। তারা আবার জিজ্ঞেস করে— ‘রক্ত কতটুকু আছে এখানে? এই জমি কি নিষিক্ত?’ সে ভাবে, রক্ত তো ছিল, তিন রাত, নয় রাত, মাসের পর মাস ধরে... কিন্তু তোমরা তো তখন বলেছিলে—‘চুপ করো, দেশপ্রেম দেখাও।’


এই দেহের উপর জরিপ হয়েছে। নতুন করে আঁকা হচ্ছে ম্যাপ, ড্রোন উড়েছে তার উরুর উপর দিয়ে, জিপিএস বসেছে তার বুকে। এইখানে স্বাধীনতা দিবসের র‍্যালি করা যাবে, এইখানে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেম শেখানো যাবে।


তার যোনি এখন দলিল অফিসের নথিপত্র, যেখানে রাষ্ট্র ও পুরুষতন্ত্র যৌথভাবে মালিকানা দাবি করেছে। সে চিৎকার করে না আর—সে শুধু নিজের চুল ছিঁড়ে মাটিতে পুঁতে দেয়। তার ভাষা এখন— ‘আমি পতিত নই, আমি পতিতাভূমি। তোমরা চাষ করো, কিন্তু ফসল তো তাতে পচে যাবে।’ ও এখন আর জমি না। ও এখন আগুন। হ্যাঁ, আগুন— যে আগুন ঠোঁটে নয়, যোনিতে জ্বলে।


একদিন রাতে, সব আলো নিভিয়ে, সে তার ভেতরের চাষ বন্ধ করে দেয়। সব বীজ ফেলে দেয় পুকুরে, যেখানে মৃত ডিম ভাসে। তারপর—একটা কেরোসিনের শিশি, একটা দেশি দেশলাই,আর একখান গান—‘এই দেহ আমার, এই জ্বালা আমার!’ 


সে পায়ের মাঝে দেশলাই জ্বালায়। একবার, দুইবার, তৃতীয়বারে আগুন ধরে। শুরুতে শুধু গন্ধ—

পোড়া লজ্জা, পোড়া স্বপ্ন, পোড়া নরম পেটিকোট। তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে—উরু থেকে বুক, বুক থেকে চোখ, চোখ থেকে আঙুল। সে হাঁসে। প্রথমবারের মতো খাঁটি হাসি—যেন আগুনের রঙ লাল না, ওটা শ্লেষের রঙ।


চারপাশ থেকে রাষ্ট্র দৌঁড়ায় আসে—‘জল আনো!’ ধর্মগুরু এসে ধর্ম তোলে—‘এই শরীর পবিত্র ছিল!’ উপজেলার কর্মকর্তা জরিপপত্র পুড়তে দেখে—‘এইখানে তো রাস্তা হবার কথা ছিল!’ তিনজন ধর্ষক পেছন থেকে বলে—‘এইখানে তো আমাদের উত্তরাধিকার ছিল!’ কিন্তু সে কিচ্ছু শোনে না। সে পোড়ায়। তার যোনি এখন একখানা রাজনীতির শ্মশান। জন্ম হয় এক নতুন মেয়ের। তার কোলে। নগ্ন, কিন্তু চোখে লোহার উত্ত্বাপ। সে মেয়েকে দুধ খাওয়ায় না—সে মেয়েকে শেখায় ‘ধর্ম আসলে এক ধরণের চুপ করিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্র একধরণের রেপ কোর্ট, আর মা হওয়া মানে আত্মহত্যার লিপি শেখা নয়— যুদ্ধ শেখা।’


তারপর সে বলে—‘আমি আর কোনো ফসল না। আমি এখন আগুন। আমার দেহের ওপর আর কেউ চাষ করতে পারবে না। কারণ, এখানে এখন কিছুই বাঁচে না— যা জন্মায়, তা শুধু বিপ্লব।’ 

সেই রাতে, তারা তার যোনিতে তিনটে পেরেক ঢুকিয়েছিল। না, সোনা-রুপোর না—জং ধরা লোহা। একটার গায়ে খোদাই ছিল ধর্মের নামাবলি, আরেকটার গায়ে গণপ্রজাতন্ত্রের অধ্যাদেশ, তৃতীয়টার গায়ে লেখা ছিল—ধর্ষকের প্রেমের পৈতা। তিনটে পেরেক, তিনটে চিহ্ন, তিনটে ছিন্নমূল ঈশ্বর।


ও তখন বুঝতে পারেনি—ধর্ম আসলে ওর চিৎকার ঢেকে দিচ্ছে ধর্মীয় সভা-সমাবেশের শব্দে, রাষ্ট্র তার রক্ত গুনছে খতিয়ান ধরে আর প্রেম— প্রেম তো সবচেয়ে পাকা ধর্ষক! সে চোখে চোখ রেখে চুদে দিয়ে বলে- ‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো-তোমার, মনের মন্দিরে...’


সে ভালোবাসি বলে, তারপর গিলে খায়।


এখন, যখন ও হাসপাতালের শাদা টেবিলে ফাঁসানো, পা দুটো ছড়িয়ে আছে কাঁটার মতো— তখন একজন নার্স বলে, ‘তোরটা তো ছিঁড়ে গেছে একেবারে! রক্ত থামবে না।’


আরেকজন ফিসফিসায়, ‘উপরে থেকে ফোন গেছে—এই কেসটা নাকি বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।’

ও কাঁদে না। ও শুধু কাঁটার মতো হাসে। ওর চোখ এখন বুলেটের মতো ধাতব। রাষ্ট্র ওর গায়ে মলম লাগাতে চায়—প্রেস বিজ্ঞপ্তির মলম। ধর্ম একটা পবিত্র গেরুয়া চাদর টেনে ধরতে চায় ওর উরুর ওপর আর প্রেম—প্রেম নতুন কাউকে চুমু খাচ্ছে ঠিক তখনই টেলিভিশনে স্ক্রল চলে—


‘মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল’।

‘ঘটনা তেমন কিছু নয়, প্রেমঘটিত’

‘মেয়েটি উস্কানি দিয়েছিল হয়তো’

‘রাষ্ট্র নিরপেক্ষ তদন্ত করবে’

‘ধর্ম অবমাননা হয়ে থাকলে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে’


আর মেয়েটি, ফাঁসানো অবস্থায়, চোখ তুলে বলে— ‘এই যে আমার ছিঁড়ে যাওয়া যোনি, তোমরা কি এর ওপর পতাকা লাগাবে এবার?’ কেউ জবাব দেয় না। সার্জারির ছুরি শুধু গলায় উঠে আসে। হাসপাতালের বাতাসে ওর রক্তের গন্ধ না—পুরো একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার পচে যাওয়া গন্ধ।

মেয়েটির মনে পড়ে, এক শিক্ষক বলেছিলেন—‘নারীর শরীর হলো জাতীয়তাবাদের পবিত্র প্রতীক।’ তখন ক্লাসরুমে সবাই চুপ করে ছিল। কেউ জিজ্ঞেস করেনি—‘কে ঠিক করে দিয়েছে এই পবিত্রতা? কারা বানিয়েছে এই প্রতীকতত্ত্ব? একটি মেয়ের যৌনাঙ্গ কি সত্যিই রাষ্ট্রের পাণ্ডুলিপি হতে পারে?’


শিক্ষক বলেছিলেন ঠাণ্ডা গলায়— ‘যেখানে পতাকা উড়ে, সেখানে ধর্ষণের গল্প থাকতেই পারে না। কারণ পতাকা মানে তো গর্ব। নারী মানে তো মর্যাদা।’


আজ সেই মেয়েটি শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়, পায়ের ফাঁকে তুলা, সেলাই ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত—যেন লাল সবুজ পতাকার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পুরো ইতিহাস। সে চোখ তুলে প্রশ্ন করে— ‘এই পতাকা কী দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল? এই লালটা কি রণক্ষেত্রের কোন বীরের রক্ত? না আমার যোনি থেকে বেরোনো তাজা স্রাব? এই সবুজটা কি শস্যের রঙ? না হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের ঘূর্ণয়মান লাল আলো?’


সে আরও প্রশ্ন করে—‘এই জাতীয়তাবাদ কি পুরুষতন্ত্রের সুন্দর মুখোশ নয়? যেখানে মেয়েদের শরীর কেবল জমি—চাষ হবে, দখল হবে, পরীক্ষা হবে, তবেই কী হবে পবিত্র পতাকার যোগ্য।’

কেউ জবাব দেয় না। শিক্ষকও না, রাষ্ট্রও না, ধর্ম তো কেবল মুখ ঘুরিয়ে নেয়। শুধু মাটির গন্ধ ভেসে আসে। না, উর্বর মাটির না। সেই মাটির, যেখানে নারী আর রক্ত একসাথে পচে। রাত গভীর হয়, তবু ওর প্রশ্ন জেগে থাকে মেয়েটির মনের গভীরে—এই দেশ কি আমার যোনির ওপর দাঁড়ানো? এই পতাকার লাল, কতজন নারীর চিতার ছাই মিশে তৈরি হয়েছিল? এটা কি স্বাধীনতা? না এক নতুন দাসত্ব, যেখানে ধর্ষণ শব্দটা মুছে দিয়ে লেখা হয়— রাষ্ট্রীয় দুর্ভাগ্য?


তারপর—ও হাসে না, কাঁদেও না। শুধু চোখের ভেতর থেকে গলে বেরোয় একটা অবাধ্য শব্দ—‘জয় হোক তোমাদের রাষ্ট্রধর্মের! আমার শরীরেই তো বানানো হয়েছিল সেই অলিন্দ।’

আজ সে দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাশে। নদীটি লাল। কারা যেন রং ঢেলে দিয়েছে। না, রং নয়। রক্ত। তার নিজের রক্ত, আর তার মতো আরও অনেকের। পেছনে পুলিশ। জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছো?’ সে উত্তর দেয় না। চোখে তাকায় নদীর দিকে। তার চোখে জল নেই, আছে আগুন।


সে বলে—‘আমি এখন কথা বলি না, আমি রক্ত চাষ করি। আমি যোনির উপর মিথ তৈরি করি। আমি রাষ্ট্রের গোপন কৃষক।’ পুলিশ চুপ করে থাকে। তারা জানে না কী বলবে। এই মেয়েটি ভিন্ন। সে ভাঙা, কিন্তু ভীত নয়। সে জ্বলছে, কিন্তু নিঃশেষ হয়নি। সে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। পা রাখে লাল জলে। জল গরম, যেন সদ্য রক্তপাত হয়েছে। সে হাঁটে, ধীরে ধীরে। প্রতিটি পা ফেলতেই শব্দ হয়—চপ্‌ চপ্‌। তার মনে পড়ে সেই রাতের কথা। তিনজন পুরুষ, তিনটি পেরেক। একটি ধর্মের নামে, একটি রাষ্ট্রের, আরেকটি প্রেমের। তারা বলেছিল, ‘তোর রক্ত দিয়ে লাল ধান ফলবে, মেয়েমানুষ!’ সে তখন বুঝতে পারেনি—প্রেমও ধর্ষণের ছদ্মবেশ নিতে পারে।


আজ সে বুঝেছে। তার শরীর একটি যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি আঘাত একটি রাষ্ট্রীয় নীতি, প্রতিটি ক্ষত একটি ধর্মীয় আদেশ। সে নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, ‘এই পতাকা কী দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল? আমার রক্ত কি তার সুতোর অংশ?’ কেউ জবাব দেয় না। শুধু নদী বয়ে চলে, লাল জল নিয়ে।


সে জানে, এই রাষ্ট্র তার মতো নারীদের রক্ত দিয়ে নিজের গর্ব তৈরি করে। তারা বলে, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যেন রক্ত থেমে যাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে। সে হাসে, তিক্তভাবে।  আর ভাবে- আমি সেই জমি, যেখানে রাষ্ট্র তার ধর্মীয় ধর্ষকতা বুনে দেয়। আমি সেই শরীর, যেখানে পতাকার লাল রঙটা আসলে রক্ত নয়, আমার যোনি থেকে চুঁইয়ে পড়া ইতিহাস।


পুলিশরা পেছনে সরে যায়। তারা ভয় পায় এই মেয়েটিকে, তার সত্যকে। সে নদী থেকে উঠে আসে। পায়ের নিচে লাল কাদা। সে হাঁটে, মাথা উঁচু করে। তার মনে পড়ে, এক শিক্ষক বলেছিলেন—‘নারীর শরীর হলো জাতীয়তাবাদের পবিত্র প্রতীক।’ আজ সেই প্রতীক ছিঁড়ে গেছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পতাকার নিচে।


সে বারবার প্রশ্ন করে, ‘এই পতাকা কী দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল? আমার রক্ত কি তার সুতোর অংশ?’ কেউ জবাব দেয় না। শুধু মাটির গন্ধ আসে, যেখানে নারী ও রক্ত একসাথে পচে। সে জানে, এই রাষ্ট্র তার শরীরকে ব্যবহার করেছে, তার যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেছে। কিন্তু সে আর চুপ থাকবে না। সে তার রক্ত দিয়ে লিখবে নতুন ইতিহাস, যেখানে সত্য লুকানো থাকবে না।

সে হাঁটে, প্রতিটি পা ফেলতেই শব্দ হয়—চপ্‌ চপ্‌। মনে হয়, কেউ একজন ধানগাছ ছিঁড়ে নিচ্ছে। সে জানে, সেই পুরুষরা, যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল, তারা এখন এই মাটি কিনে নিচ্ছে। জমির দাগ ঘেঁটে যাচ্ছে রাষ্ট্রের এক নম্বর জরিপে। উপজেলা থেকে লোকে আসে—মাপে তার দেহ। জিজ্ঞেস করে, ‘এইটুকু জমিতে ধান হবে তো? রক্ত কতটুকু আছে এখানে?’


সে চুপ করে থাকে। তার চোখে আগুন, তার শরীরে বিদ্রোহ। সে জানে, এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এই ধর্ম—সবকিছুই তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সে হার মানবে না। সে তার যোনি থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত দিয়ে লিখবে নতুন ইতিহাস, যেখানে প্রতিটি শব্দ হবে প্রতিরোধ, প্রতিটি বাক্য হবে বিদ্রোহ।

সে হাঁটে, নদীর পাশে, লাল জলের ধারে। তার পায়ের নিচে কাদা, তার চোখে আগুন। সে জানে, তার যাত্রা শুরু হয়েছে। রাত গভীর। ও শুয়ে আছে এক ফাঁকা ঘরে। জানালা নেই, দরজা বন্ধ। বাতাসও যেন ঢুকতে ভয় পায়। এই ঘরটা যেন কোনও কনস্টিটিউশনাল কুঠুরি, যেখানে নারীকে নিরাপত্তার নামে বন্দি করা হয়, বিচারের নামে অবরুদ্ধ করা হয়। অন্ধকার গিলে খাচ্ছে সমস্ত দেয়াল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও শব্দ আসে। চারপাশে শুধু শব্দ: ‘চাষ’, ‘ফসল’, ‘রক্ত’, ‘ধর্ষণ’, ‘ঈশ্বর’, ‘সংবিধান’...


এই শব্দগুলো ওর শরীরের ভেতরে ঢোকে। ঢোকে প্রতিটি ছিদ্রপথে। রক্তকণিকার ভেতর দিয়ে বয়ে যায় শব্দের তরঙ্গ আর প্রতিবার ঢোকার সময়, একটা করে প্রশ্ন ফেঁসে যায় ভেতরে— শব্দগুলোকে কি বীজ বলা যায়? না কি এই শব্দগুলোই আসলে ধর্ষক?


ও ভাবে, চাষ শব্দটা কী চায়? সে তো ধর্ষণের সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। ভূমির উপর একতরফা মালিকানা দাবি করে, জমি জোর করে চাষ করে, বীজ ঢুকিয়ে দেয়—পরে বলে, ফসল আমার! নারীর শরীরকেও তো এমনই ভূমি ভেবে তারা চাষ করতে চায়। তফাত একটাই, এখানে ফসল ফলানোর নামে প্রমাণ চাওয়া হয়। মেডিকেল রিপোর্ট, শারীরিক পরীক্ষা, চরিত্রের পর্যালোচনা—যেন শরীর শুধু জমি নয়, সরকারের নথিভুক্ত জমি!


ফসল শব্দটা আসে। ফসল মানে ফল। ফল মানে ভোগ। যে নারী গর্ভধারণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তার শরীর অনুৎপাদনশীল ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্র তাকে অকেজো করে তোলে। সামাজিক আঙ্গিনায় তার দাম নেই। আর যে নারী সন্তান জন্ম দেয়, সে হয়ে যায় জাতির জননী। যেন তার যোনি কোনো সোনার খনি। তার রক্ত হীরের মতো। কিন্তু সেই হীরের মূল্য রাষ্ট্র নির্ধারণ করে, নারী নয়। সন্তান রাষ্ট্রের সম্পত্তি, নারীর নয়।


রক্ত শব্দটা তীক্ষ্ণ ছুরি হয়ে ঢুকে যায় ওর পাঁজরের ফাঁকে। সে রক্ত দিয়েছে—শরীর থেকে, অস্তিত্ব থেকে। সেই রক্ত এখন রাষ্ট্রের পতাকার লাল রঙ। কিন্তু পতাকার নিচে সেই রক্ত পচে যায়, কাদায় মেশে, সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় টপটপ করে পড়ে। কিন্তু কেউ তা মুছে না। কারণ এ রক্ত নারী শরীরের—এই রক্ত নিয়ে কেউ গর্ব করে না, কেউ শহীদ মিনার বানায় না। শুধু একটা রিপোর্ট বানানো হয়—অভিযোগ তদন্তাধীন


ধর্ষণ শব্দটা ঢোকে হঠাৎ, গর্জে ওঠা ট্রাকের মতো। তার শব্দে কান ফেটে যায়। ও ভাবে—ধর্ষণ কী শুধু যৌনতার অপব্যবহার? না কি এটি রাষ্ট্রের ভাষা? রাষ্ট্র কি প্রতিনিয়ত নারীকে ধর্ষণ করছে না, তার মৌলিক অধিকার, তার পছন্দ, তার শরীর—সবকিছুকে উপেক্ষা করে? ওর মনে পড়ে, তার কেস যখন কোর্টে উঠেছিল, জজ জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি কী পরেছিলে সেই রাতে? যেন কাপড়ই সম্মতির মানদণ্ড!


ঈশ্বর শব্দটা ঢোকে নরমভাবে। যেন স্নেহের ছায়া। কিন্তু সেই ছায়ায় বিষ। ঈশ্বর নাকি ক্ষমাশীল। কিন্তু ক্ষমা কে পায়? ধর্ষক, যদি সে ভক্ত হয়। ধর্ষক, যদি সে মসজিদের হাফেজ হয়, মন্দিরের পুরোহিত হয়, গির্জার পাদ্রি হয়। ঈশ্বর তখন নীরব দর্শক, বা তার ওকালতি করে রাষ্ট্র। আর নারী? তাকে বলা হয়, তুমি পবিত্র নও, তুমি অভিযোগ করে ঈশ্বরের অপমান করছো। ঈশ্বর কি ধর্ষকের অজুহাত নয়?


সংবিধান শব্দটা আসে ঠাণ্ডা ধাতব ধ্বনিতে। যেন সলিড আইরন। ও ভাবে, এই সংবিধান কি কখনও তার শরীর ছুঁয়েছে? সংবিধান কি জানে, যোনির ভেতরে কেমন লাগে তিনটা পেরেক একসঙ্গে ঢুকলে? সংবিধান কি ব্যথা বোঝে? না কি সে কেবল ব্যবস্থা বোঝে? সে ভাবে, এই সংবিধান যে তাকে সমানাধিকার দেয়ার কথা বলে, সেই সংবিধানই আবার ব্যাখ্যার ভার দেয় পুরুষদের হাতে। আইন হয় পুরুষতন্ত্রের অলিন্দে, বিচার হয় পুরুষতন্ত্রের চোখে। নারী সেখানে কেবল একটি কেস নাম্বার, একটি ক্ষয়িষ্ণু শরীর।


ও শুয়ে থাকে। তার যোনি যেন শব্দের কনটেইনার। শব্দগুলো ঢোকে, ফেটে পড়ে। শরীর রক্তাক্ত নয়—ভাষাগতভাবে ছিন্নভিন্ন। প্রতিটি শব্দ তাকে আঘাত করে, ধ্বংস করে, আবার গড়ে। এই শব্দগুলো ভাষার নয়, অস্তিত্বের; এই শব্দগুলো কোনও ব্যাকরণ মানে না, কোনও নিয়ম মানে না—শুধু আক্রমণ করে।


তার মনে হয়, সে একটা গুদামঘর, যেখানে পুরুষতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র মিলে শব্দগুলো ঢুকিয়ে যায়। দিনের পর দিন, বছর বছরের পর। প্রতিবারেই তারা নতুন করে বোঝাতে চায়, তুমি ভূমি, তুমি জননী, তুমি প্রতীক। ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘আমি ভূমি নই, আমি কোনও চাষযোগ্য জমি নই, আমি জাতির মা হতে চাই না, আমি পতাকার রং দিতে চাই না—আমি শুধু আমার শরীর ফেরত চাই, আমার ভাষা ফেরত চাই, আমার নীরবতার অধিকার ফেরত চাই।’

কিন্তু কেউ শুনে না। ও ভাবে, এই শব্দগুলোর ভেতরে থেকে যেতে চায় না সে। সে শব্দগুলোকে আবার শব্দ করাতে চায়। নতুন অর্থে। সে চায়, ‘রক্ত’ মানে হোক প্রতিরোধ, ‘চাষ’ মানে হোক স্মৃতি পুনর্গঠন, ‘ঈশ্বর’ মানে হোক প্রশ্নবিদ্ধ কর্তৃত্ব, ‘সংবিধান’ মানে হোক তার শরীরের সংবেদন, ‘ধর্ষণ’ মানে হোক রাষ্ট্রের খণ্ডচিত্র।


সে উঠে বসে। ঘরের অন্ধকারে একটা অদৃশ্য আলো জ্বলে ওঠে। সে ভাবে, তার শরীরটাই হবে এক নতুন ডিকশনারি। যেখানে প্রতিটি শব্দ নতুন সংজ্ঞা পাবে। যেখানে ভাষা ভীত হবে না, রক্তাক্ত হবে। কিন্তু সেই রক্ত হবে প্রতিশোধের, পরিবর্তনের। সে জানে, সে একা নয়। সে জানে, হাজার হাজার নারী, যারা ঘর ছেড়ে আসেনি, যারা মিডিয়ায় কথা বলেনি, তারাও এই শব্দের ভিতর প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে। সে জানে, শব্দই অস্ত্র, শব্দই বিদ্রোহ। আর এই শব্দ দিয়ে সে ছিন্নভিন্ন করবে মধ্যবিত্তের নকল শালীনতাকে, কুঁচকে দেয়া সুশীলতার মুখোশকে।


রাত এখনো গভীর। কিন্তু শব্দ এখন তার শরীরে নয়, তার কণ্ঠে। সে এখন উচ্চারণ করে— আমিই ঈশ্বর,

আমিই সংবিধান

আমিই রক্ত

আমিই চাষ

আমিই ফসল

ও ভাবে, এই শব্দগুলো কি বীজ? না কি, এই শব্দগুলোই আসলে ধর্ষক?


শব্দেরা এখন ওর পেটের মধ্যে রক্তাক্ত খোঁচা দেয়। তারা ভেতরে ঢুকে গর্ত করে। সে বুঝতে পারে, এই শব্দগুলো শুধু শব্দ নয়—তারা প্রকল্প, তারা রাষ্ট্রের অস্ত্র, তারা পুরুষের ভাষা। তারা ওর দেহে ‘নির্মাণ’ করতে চায়, ‘উন্নয়ন’ করতে চায়, ‘পুনর্বাসন’ করতে চায়। যেন ওর রক্তাক্ত শরীর এখন কোনো সরকারি টেন্ডারের মাঠ।

এমন সময় ঈশ্বর আবার আসে। হাতে শ্লোক, মুখে নীতিশিক্ষা। তার চেহারা নির্বিকার। তার পায়ের নিচে—একটা রক্তাক্ত নারীদেহের মানচিত্র। ঈশ্বর বলে, ‘তোমার যন্ত্রণা আমার পরীক্ষার অংশ। নারী তো সৃষ্টির পাত্র, তাকে তো সইতেই হবে।’


ও চিৎকার করে বলে, ‘তোমার সৃষ্টি আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। তোমার পরীক্ষায় আমি বসবো না। তোমার ঈশ্বরত্ব আমি মানি না। আমার যোনিই আমার সংবিধান। আমার রক্তই আমার ধর্ম। আমার ফেটে যাওয়া শরীরই আমার ইতিহাস। তোমার পুরুষতন্ত্রের আঙুল আমি পুড়িয়ে দেবো।’ ঈশ্বর কাঁধ ঝাঁকে। যেন বলেন, ‘যা হয়, তা তো শুদ্ধির প্রক্রিয়া। তুমি তো নারী—পবিত্র হতেই হবে!’ ও থেমে যায় না। বলে, ‘আমি এখন রক্ত চাষ করি। আমি যোনির উপর মিথ তৈরি করি। আমি রাষ্ট্রের গোপন কৃষক।’ শব্দেরা এবার থেমে যায় না, গর্জে ওঠে। চাষ, ফসল, রক্ত, ধর্ষণ, ঈশ্বর, সংবিধান—সব একসাথে জেগে ওঠে, এক ভয়ঙ্কর সুরে, যেন শবদেহের জাতীয় সংগীত।


ও তখন উঠে দাঁড়ায়। তার যোনি থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে, মেঝের ফাঁকে সরে যায়, নতুন একটা মানচিত্র আঁকে। যে মানচিত্রে আর কোনো সীমান্ত নেই, কোনো পতাকা নেই, কোনো ঈশ্বর নেই। আছে শুধু এক উন্মুক্ত নারী, যে নিজের শরীরের রক্তে লিখে দিচ্ছে—‘এই শরীর, এই ইতিহাস, এই ধ্বংসাবশেষ—কোনো রাষ্ট্রের নয়। এই আমার। এই আমি। এই বিদ্রোহ।’


সে আজ আদালতের কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে—শাদা শাড়ি পরা, স্নিগ্ধ মুখে কিন্তু চোখে আগুন। চারপাশে যেন একটা ঝাঁজালো ছায়া ঘোরে—বিচারকের সাদা টগ, রাষ্ট্রের থাবা, মিডিয়ার ক্যামেরার ঝলকানি, আর কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাঠকের নিষ্ঠুর চোখ। সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু কেউ তার চোখে দেখার সাহস পায় না।


‘মেয়ে এত রাতে রাস্তায় কেন?’—বিচারকের মতোই ঠান্ডা, নির্লিপ্ত কণ্ঠে কেউ বলে, যেন এটা কোনো অপরাধের জবাব চাইছে, অথচ প্রশ্নটার ভেতর লুকিয়ে আছে অভিযোগ আর অবজ্ঞা। সেই প্রশ্ন যেন একটা থুথু ফেলে দেয় ওর মুখে, আর সেই থুথু থেকে ঝরতে থাকে জীবনের সব কালো, নোংরা গল্প।


‘এটা ওর সাজানো গল্প,’ মিডিয়ার এক সাংবাদিক মুখ ছুঁড়ে বলে, ‘ও তো লেখে! গল্প লেখে, গান করে, হয়তো এই সবও তার একটা ফ্যান্টাসি।’ যেন এই কথাগুলো দিয়ে তারা ওর যন্ত্রণাকে মিথ্যা, ওর রক্তকে জলাঞ্জলি দিতে চায়। তাদের ভাষায় নারী স্বাধীনতা, প্রতিবাদের শব্দগুলো ফিকে হয়ে যায়, হারিয়ে যায় ধোঁয়ায়।


‘যদি সত্যি ধর্ষিত হতো, এত চুপ কেন?’—তৃতীয়জন প্রশ্ন করে, যেন নীরবতা কোনো অপরাধ, চুপ থাকা কোনো অপরাধের প্রমাণ। তাদের প্রশ্নে যেন লুকিয়ে থাকে একটা অদৃশ্য হাত, যা বেঁধে রাখে ওর মুখ, ওর গলা। ও হাসে। হাসি ছেঁড়া যোনির মতো—কাটা, পুড়ানো, ফেটে যাওয়া হাসি। সেই হাসির ভেতর লুকিয়ে থাকে এক দীর্ঘশ্বাস, এক ক্রন্দন, এক বিদ্রূপ। সে বলে, ‘তোমরাই তো আমার চরিত্র লিখেছো। আমি শুধু সেই স্ক্রিপ্টে অভিনয় করছি।’

সে জানে, এই স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে অন্য কারো হাতে—রাষ্ট্রের হাতে, সমাজের হাতে, তাদের হাতে যারা নারীর দেহকে তাদের মঞ্চ বানিয়েছে। সে জানে, এই মঞ্চে তার কষ্ট, তার বেদনা, তার রক্ত সবকিছুই এক বেচারা নাটকের অংশ মাত্র। কিন্তু সে চায়, এই নাটক শেষ হোক, যেন সে আর পাত্রের মতো খেলনা না হয় কারো হাতে। তার শব্দগুলো কানে লাগে যেন এক তীব্র ঝাঁজালো বাতাস, যা পড়ে পড়ে ছিঁড়ে দেয় মননের পর্দা। এই ভাষা পাঠককে ধাক্কা দেয়, বাঁচতে দেয় না—বেদনার জোয়ার, বিদ্রুপের তীব্রতায় মনকে ময়লা ছাপায়, আর বুকে চেপে বসে এক অজানা গর্জন।


‘তুমি যা বিশ্বাস করতে চাও, করো’ সে বলে, ‘আমি জানি, এই বিচার তো আমার নয়, আমার দেহের নয়, আমার জীবনের নয়। এটা তাদের বিচার, যারা আমার জীবনকে খেলনা বানিয়েছে, যারা আমার যন্ত্রণার ওপর হাসি ঠাট্টা করেছে। আর আমি? আমি শুধু সেই খেলোয়াড়, যার কোনো ইচ্ছে নেই, শুধু অবাক হয়ে দেখি কিভাবে তারা আমাকে ভাঙে, কিভাবে তারা আমার রক্ত দিয়ে তাদের নাটক সাজায়।’ তার চোখ ভরা জল আর মুখের ভাঁজে ঘৃণার আগুন—এই অস্থিরতা, এই বিপর্যয় যেন একঝলক আকাশ, যা ভেঙে পড়ে মাটিতে। বিচারক, রাষ্ট্র, মিডিয়া, পাঠক—তাদের কেউ পারে না এই দহনের আগুন থামাতে।


তাই সে দাঁড়িয়ে থাকে, শাদা শাড়িতে, তার হাসি নিয়ে—একজন নারী যিনি শুধু বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছেন, তার নাম না জানানো এই লড়াইয়ের সেরা অভিনেত্রী। বিচার চলছে, কিন্তু সে কোন বিচার নয়—এটি এক ধ্বংসাত্মক মঞ্চ, যেখানে রক্ত আর শ্লেষের খেলা চলে রাষ্ট্রের অধীন। ওর রক্ত-প্রমাণগুলো গুলো গৃহীত হয় না, পুড়িয়ে ফেলা হয় যেন আসমান থেকে নেমে আসা সত্যকে। ডিএনএ রিপোর্ট? হারিয়ে গেছে, গা ঢাকা দিয়েছে কোনো গভীর গর্তে—যেন এই দেশের আইন ব্যবস্থা এক বিরল নাটকের অংশ। আইন বলে, ‘ধর্ষণের সময় যদি চিৎকার না করে, তবে সেটা ধর্ষণ নয়।’ কথাগুলো কানে লাগে যেন ভাঙা কাঁচের মতো, ঝনঝন করে রক্তের ভেতর দিয়ে। কিন্তু ওর মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না, তবুও রক্ত ঝরছে—প্রবাহিত, ঝরঝরে, যেন শব্দের বদলে রক্ত চিৎকার করছে। সেই রক্ত আদালতের দেয়ালে ছিটকে পড়ে, যেমন বৃষ্টি পড়ে শুকিয়ে যায়, কিন্তু তার নিদর্শন হয়ে থেকে যায় ছায়ার মতো এক দাগ। ও চিৎকার করতে চায়, গলা ফাটিয়ে, গর্জন করতে চায়, কিন্তু শব্দগুলো গলাধঃকরণের প্রাচীরে আটকে যায়, আটকে যায় এক অসীম নিস্তব্ধতায়। তার চিৎকার হয়ে ওঠে রক্ত—যা লেগে থাকে আদালতের দেয়ালে, বিচারকের চোখে, রাষ্ট্রের বুকের উপর, আর সবাই তাকিয়ে থাকে—শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না।


তারপর আসে রায়— ‘অভিযোগ খারিজ। নারী নিজেই দায়ী।’ এই চার শব্দে ভেঙে যায় তার পৃথিবী, ছিঁড়ে যায় তার অস্তিত্ব। যেন তার শরীর আর মন একসাথে বাষ্প হয়ে উঠে বাতাসে মিলিয়ে যায়।


এই রায় একটা বিষাক্ত শিখা জ্বালায়—একটা ভয়ানক সত্যকে চেপে ধরার কসরত। এই রায়ে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রের নির্মম অবজ্ঞা, সমাজের বর্ণিল পর্দার নিচে নারীর যন্ত্রণা পীড়নের গভীর এক ছায়া। ওর চোখ থেকে ঝরে পড়ে রক্ত আর অশ্রু, সে দাঁড়িয়ে থাকে বিচারকের সামনে, রাষ্ট্রের সামনে, মিডিয়ার সামনে—কিন্তু তার নাম, তার ব্যথা কেউ স্বীকার করে না। কেউ শুনতে চায় না তার চিৎকার। এই দৃশ্য শেষ হয় না। এটি শুরু মাত্র। কারণ সেই রক্ত যখন বিচারকের দেয়ালে ছিটকে পড়ে, তখন থেকে শুরু হয় সত্যের বঞ্চনার নিরব বিদ্রোহ। 


রায় পেয়ে মেয়েটি ফিরে যায় না। আদালতের হালকা বাতাসের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে দেয়ালের ছায়া তার শরীরকে স্পর্শ করে না, কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট—ধর্ম নেই, বিচার নেই, নেই কোনো ন্যায়ের ছোঁয়া। শুধু একটা অন্ধ, গভীর হিংসা, যা যেন সমাজের বুক ফুঁড়ে ঢুকে পড়েছে, ধ্বংস করতে চায় এই কাঠামোকে, যেটা তার পায়ে পায়ের নিচে চেপে বসেছে।


তার চোখে এখন আর কোনো স্বপ্নের আলো নেই; সে দেখছে শুধু ধ্বংসস্তূপ, যেখানে গড়মিল এক অন্যায়ের জাল বিছানো। সে ভাবছে, এই সমাজকে পচিয়ে দিতে হলে, এই খাঁড়া অন্ধকারকে ভেদ করে আলো এনে দিতে হলে কত রক্ত দিতে হবে, কত নারীকে নিজ শরীর দিয়ে চাষ করতে হবে, যেন তাদের যোনি হয়ে উঠে বিষাক্ত জমি—জমি যেখানে শুধু নির্যাতনের বীজ বোনা হয়। এই অন্ধকারে তার হৃদয় চিৎকার করছে, এক প্রশ্নের তীব্রতায় সারা শরীর কাঁপছে: এই কি আমার পুনর্জন্ম? সেই রক্তের, সেই যন্ত্রণার, সেই পীড়নের পুনর্জন্ম? কি এই নতুন জীবনে তার অস্তিত্ব হতে হবে শুধুই ধ্বংস আর প্রতিশোধের আগুন?


তার মস্তিষ্কে বাজছে আগুনের টকটকানি, মগজে জ্বলছে ক্ষোভের ছাই। সে দেখছে—কতটা নিষ্ঠুর এই সমাজ, কতটা মিথ্যা এই স্বপ্নের ফাঁদ, যেখানে নারীর শরীর আর কষ্ট শুধু ব্যবহৃত হয় ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে। তার বুকের মধ্যে গড়ে উঠছে এক নতুন হিংস্র ভূমি, যেখানে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে নতুন শাসক হিসেবে—কিন্তু এই শাসন হবে পুরানো বন্ধন ভাঙার, পুরানো শৃঙ্খল ছিন্ন করার।


সে জানে, তার শরীর আর মন একে আর তার মনের দাসত্ব নয়; সে হবে সেই আগুন, যা রাষ্ট্রের কুৎসিত মুখোমুখি দাঁড়াবে, যেখানে পুরোনো ন্যায়ের কাঠামো গুঁড়িয়ে ফেলবে, যেখানে তার রক্তের ফসল জন্মাবে বিদ্রোহ, জন্মাবে নতুন এক সমাজের বীজ।


তার চোখের অন্ধকার, তার মুখের কঠিন ভঙ্গি, আর তার হৃদয়ের গভীর ক্ষোভ—এসব একাকার হয়ে উঠে এক প্রলয়স্বরূপ বার্তা, যা শব্দের বাইরে, যা ভাষার গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে। যেন এই সমস্ত নিষ্ঠুরতা, অন্যায় আর অবজ্ঞার বিরুদ্ধে এক গভীর বিদ্রোহের ডাক, যা মাটি থেকে উঠে আসছে, যা নেমে আসছে তার রক্তের ফসল হয়ে।


আর এই মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে—এই প্রশ্নই তার আত্মার পুনর্জন্মের আহ্বান, এই প্রশ্নই তার জীবনের ধ্বংসাত্মক কবিতার সূচনা। এই প্রশ্ন তার অস্তিত্বের সর্বশেষ সীমানা, যার বাইরে আর কোনো পথ নেই, শুধু অন্ধকার আর অগ্নিকুন্ড।


সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই আদালতের বাইরে, যেখানে তার কণ্ঠ নেই, কিন্তু তার চোখের অগ্নি পুরো সমাজকে পোড়াতে পারে। সে জানে, তার নতুন জীবনের শুরুটা এই হিংসার প্রশ্ন থেকেই, যেখানে সে নিজেকে স্বীকার করবে, নিজের যন্ত্রণাকে নিজের অস্ত্র বানাবে, আর পুরোনো সমাজের কাঠামোকে ধ্বংস করে নতুন একটা পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার করবে।


সে এখন ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে। চারদিক ঘেরা জল আর কাদা, আকাশে ফেনা তুলছে দুর্বল বাতাস, গাছেরা যেন নীরব নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছে। তার পায়ের তলায়, যে মাটি এতকাল ছিল নিশ্চল, আজ রক্তাক্ত, পুড়ে জ্বলছে তার স্মৃতির আগুনে। সে ঠাণ্ডা বাতাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজেকে অবরুদ্ধ মনে করে—এই জমি, এই মাটি, এই ধানক্ষেত কি শুধুই ধানের জন্য? না, তার রক্ত আর স্মৃতির জন্য, যেগুলো এখন মাটির গহ্বরে মিশে গেছে।


সে ভাবছে—যদি এই জমিতে ধান হয়, তবে কি তার ভাত কখনো ন্যায় হবে? যে ভাত তার গলাগল রবিত চুষে নেয়, সেই ভাত কি কখনো তার যন্ত্রণার স্বাদ বোঝবে? ধান যদি বুনতে হয়, তবে কি তার রক্তের ফোঁটা প্রতিশোধ হয়ে উঠবে? এই রক্তে, এই যোনির বেদনায় বোনা প্রতিটি চরণ কি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ছিদ্র করবে? তার হাঁটা ধীরে ধীরে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক একবার ক্ষতের উপর নতুন করে আঘাত। সে পেরিয়ে যাচ্ছে কাদামাটির উপর, যেখানে তার রক্তমাখা পা স্পর্শ করছে ধানের ছোট ছোট চারা। এই ধানচারা এখন তার যোনির ক্ষরণ থেকে জন্মানো বীজতলা, তার শরীরের সেই অশ্রু আর যন্ত্রণা যে মাটিকে পুষ্ট করেছে, সে পুষ্টিই এখন নতুন জীবনের সোপান।


তার জঠরের লোহিত তরল, সেই অবর্ণনীয় বেদনার স্রোত, এখন আন্দোলনের জল হয়ে বয়ে চলেছে; যেভাবে তার শরীরের প্রতিটি ক্ষত আর কষ্ট একাকার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের জলে, যে জলের প্রতিটা ফোঁটা হলো আগুনের শিখা, যার আগুন ঝলসিয়ে দেবে নির্মম সমাজের মুখ। সে অনুভব করছে, তার শরীর আর তার আত্মা আর পৃথক নয়; প্রতিটি দুঃখ আর প্রতিটি ক্ষত মাটির সাথে গাঁথা, আর তার রক্তই এখন সেই বীজ যা ইতিহাসের গহ্বরে থেকে উঠে আসবে এক নতুন অধ্যায়ের জন্য। সে একা নয়—তার প্রতিটি পদক্ষেপে গুঞ্জরিত হচ্ছে অন্য নারীদের কণ্ঠস্বর, যারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে, যারাও এই জমিতে তাদের রক্ত চাষ করছে, যাদের প্রত্যেকের যোনি আর আত্মা গড়ে তুলছে এক সংগ্রামের নতুন ভুবন।


এই লোহিত জল পার হয়ে সে হাঁটে, সে চাষ করে, সে বুনে যায় তার স্মৃতির নতুন ধানক্ষেত। আর সেই ধানক্ষেতে প্রতিটি পাতা, প্রতিটি শাখা হবে তার প্রতিশোধের ছন্দ, যা গর্জন তুলবে—একবার হলেও এই জমি যেন বলে ওঠে, ‘আমি তোমার রক্তে জন্মেছি, আমি তোমার যন্ত্রণায় এক জ্বলজ্বলে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা।’


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages