১.
যে ভাষা নিজের গর্ভছিন্ন রক্তাক্ত উত্তরাধিকার স্বীকার করতে রাজি নয়, যে ভাষা শব্দের কঙ্কাল দিয়ে শৃঙ্খলার মিনার তোলে, সেই ভাষার শরীরে প্রথম আগুন ধরিয়েছিল যে বিদ্রোহ, তার নাম—লিটলম্যাগাজিন। সাহিত্যের কাঠামোগত মন্দিরে প্রাতিষ্ঠানিকতা নামক দেবতার পূজা যখন চরমে, তখন আঙুল উঁচিয়ে দাঁড়ায় একদল ভাষাগত নাস্তিক। তারা বলে, ‘তোমাদের চৌকো পাতার ঈশ্বরকে আমরা মানি না। শব্দের সত্য কোনো ক্লাসিকের কফিনে ঘুমিয়ে থাকে না। আমাদের দরকার নতুন ব্যাকরণ, নতুন গোলযোগ, নতুন ধ্বনি।’ এই ভাষাগত বিদ্রোহ মূলত ছিল একধরনের নির্মাণবিরোধী সৃষ্টি। এক ধ্বংসচেতনা, যা নির্জন দ্বীপে নয়—নগরীর কোলাহলের ভিতরেই চুপচাপ, ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে— ‘সাহিত্য এখনো বেঁচে আছে কারণ কিছু শব্দ মরে যেতে ভয় পায় না।’ এই শব্দেরা আসে না বুকের আর্কাইভ থেকে, আসে নিঃশ্বাসের ধোঁয়ার ভেতর থেকে—যেখানে শব্দ আর শরীর একাকার, যেখানে কবিতা আর গালি পাশাপাশি হাঁটে।
লিটলম্যাগাজিন তাই একটানা মুখের ভেতর থুতু জমিয়ে রাখা, অবজ্ঞার গড়ন। এটি কখনোই শুধু লেখা ছাপানো নয়, এটি এক ধরনের বিপ্লবের চর্চা—যেখানে ছাপাখানার কালি দিয়ে রাষ্ট্র, শ্রেণি আর সাহিত্যের নব্য সামন্ততন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। লিটলম্যাগাজিনে 'কবিতা' আসত না, সে আসত রক্তাক্ত শব্দের কোষাগার খুলে; ছোট গল্প মানে ছিল না কোনো ‘নাটকীয়’ মোড়, সে ছিল ছেঁড়া পাদটীকার নিচে এক প্রবল সন্ত্রাস; প্রবন্ধ মানে ছিল না তথ্যে সিঞ্চিত কাঠিন্য, সে ছিল যুক্তির মধ্যেও অস্থিরতার অভিষেক।
মূলধারার সাহিত্য তখন ছিল একধরনের ছাপাখানা—যেখানে অনুভূতির প্রেসক্রিপশন ছাপা হত, যেখানে বেঁধে দেওয়া যেত ব্যাকরণের বাঁধন, যেখানে লাল-কালো হরফের নিখুঁত অক্ষরে গদ্য বা পদ্যের জ্যামিতি বোঝানো যেত। আর এই সাহিত্যিক দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লিটলম্যাগ এর প্রতিপাতা ধুলো আবারণে উড়তে থাকতো। লিটলম্যাগাজিন এক অস্বীকৃতির নাম। অস্বীকার কেবল শৈলী নয়, অস্বীকার ছিল সাংস্কৃতিক যন্ত্রণার ঘোষণাপত্র। এই লেখকরা লিখতে বসত না কোনো স্বীকৃতি বা পুরস্কারের আশায়। তারা লিখত কারণ তারা থেমে গেলে শহরের অলিতে গুম হয়ে যেত একেকটা জীবন্ত অভিজ্ঞতা।
এই ঘৃণা যে জন্ম নিয়েছিল, তা কিন্তু ছিল চিন্তাশীল ঘৃণা—অন্ধ বিদ্বেষ নয়। এটি ছিল এক বিপরীত দর্শন, যেখানে ভাবা হতো—‘মূলধারার সাহিত্য যেহেতু বুর্জোয়া চেতনার প্রতিচ্ছবি, যেহেতু এটি পাঠকের অভিজাতত্ব ও সুকৌশল পছন্দে রঙিন, সেহেতু এই ধারার বিরুদ্ধেই রচনা করতে হবে নতুন শব্দতন্ত্র।’ এই ধারা বিশ্বাস করত, সাহিত্যে ‘ভালো লেখা’র ধারণাটাই অতিক্রান্ত; ভাষা, গঠন, বিষয়ের মধ্যে যে তথাকথিত ‘সৌন্দর্য’ প্রথা প্রতিষ্ঠিত, তাকে ভেঙে দিতে না পারলে সাহিত্য আর কিছুই নয়, শুধুই এক সাংস্কৃতিক শোষণের সহায়ক যন্ত্র।
মূলধারা—যা ছাপা হয় দৈনিকের পাতায়, আলোচনায় আসে বুক ফেয়ারে, যার লেখকেরা টিভি চ্যানেলে মুখ দেখান, যাদের বই রিভিউ পায় দৈনিক পত্রিকায়—তারা একধরনের মিথ্যার সুগন্ধি । তারা যেন শব্দের তামাশা করে, ভাব প্রকাশে কুশলী এক বৃত্ত তৈরি করে, যার বাইরে থাকা প্রতিটি শব্দই ‘ভুল’, ‘অপরিণত’ বা ‘অপরিকল্পিত’ হিসেবে বাতিল হয়। লিটলম্যাগাজিন এই বিভাজনের বিরুদ্ধে এক অপার যুদ্ধ। তার ভাষা কখনোই ঢ়ড়ষরংযবফ নয়, কখনো সেটি ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, কখনো রুক্ষ, অশ্লীল—কিন্তু ঠিক সেইখানেই তার বাস্তবতা।
একজন লিটলম্যাগ লেখকের কাছে ‘সাহিত্য’ মানে ছিল না পাঠকের মুগ্ধতা অর্জন, ছিল পাঠককে ঝাঁকুনি দেওয়া। তারা সাহিত্যকে শিল্পের কোঠা থেকে নামিয়ে আনত রাস্তায়, মদের বোতলের পাশে, নোংরা ট্রেনের কামরায়, চায়ের কাপে ডুবে থাকা দীর্ঘশ্বাসে। তার কবিতা হতো যেন গলায় আটকে থাকা কাশি, গদ্য হতো রাত্রির অস্থির নিঃশ্বাস, আর প্রবন্ধ হতো একরাশ ঝগড়ার মতো—যার মাথায় ছিল না কোনো খোঁপা, যার মুখে ছিল না কোনো লিপস্টিক। এই ঘৃণা, এই অস্বীকৃতি, এই ধ্বংসচেতনা—তাই কেবল এক অভিমান নয়, এটি ছিল অস্তিত্বের রণসংগীত। সাহিত্যের কর্পোরেটাইজড কর্পোরাল শরীর ভেদ করে তারা খুঁজে আনতে চেয়েছিল এক লঘু নয়, তা রক্তাক্ত সত্য। লিটলম্যাগাজিন কোনো সময়ের সন্তান নয়, তা সময়ের গর্ভছিন্ন প্রতিবাদ। যেখানে মূলধারার সাহিত্য ছিল প্রবাহমান এক নদী—নির্ধারিত তীর, পরিশ্রুত জল, সাজানো ঘাট; লিটলম্যাগাজিন ছিল সেই নদীর পাড়ে ছুঁড়ে দেওয়া এক উন্মাদ ঢেলা, যার ভেতর বিস্ফোরণ ছিল, যার শব্দে ছিল বাজ, যার অক্ষরে ছিল বেঁচে থাকার গোপন চিৎকার।
এই ছিল শুরু। এই ছিল জন্ম। অভিধান-বহির্ভূত, পুরস্কার-বিরোধী, রুচিবিরুদ্ধ, কিন্তু জীবনের ভয়াবহতাকে ভাষায় আনার এক গহীন সাধনা। মূলধারার সাহিত্য তখনও নায়ক সাজছিল—আর লিটলম্যাগাজিন হয়ে উঠছিল অ্যান্টি-হিরো, যাকে দেখে না কেউ, কিন্তু যার চোখে চেয়ে থাকলে চেনা পৃথিবী আর চেনা থাকে না। ‘লিটল’—এই শব্দটি যতটা নিরীহ দেখায়, তার শিকড় ততটাই আগ্নেয়। এই শব্দের ভেতরেই রয়েছে একধরনের সুদূরপ্রসারী প্রত্যাখ্যান। বাংলা ভাষায় বা ইংরেজি পরিসরে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলতে যা বোঝানো হয়, তার বাইরে গিয়ে এই ‘লিটল’ একটি আদর্শগত অবস্থান, একটি আত্মচেতনার সংক্ষিপ্ত মন্ত্র। ‘লিটল’ শব্দটি তাই কোনো বিনয়ের প্রতীক নয়, তা এক অমার্জনীয় স্পর্ধার চিহ্ন—একধরনের সাংস্কৃতিক কুবেরদের দিকে আঙুল তোলা। ‘বৃহৎ’ মানে যাকে আমরা ধরে নিই মূলধারা, পুঁজি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদ, পাঠকপ্রিয়তা—তার বিপরীতে ‘লিটল’ মানে—অনির্বাণ, অসমর্থিত, অপ্রস্তুত অথচ সত্য। এটি একটি অন্তর্গত ভঙ্গি।
এই শব্দের ভেতরে লুকানো আছে এক আদিম আত্মমর্যাদা—যা প্রতিটি অপমান, প্রত্যাখ্যান, অবহেলাকে পরিণত করে দাঁতালো অস্ত্রে। ‘লিটল’ মানে এখানে কোনো কম থাকা নয়, কম থাকতে পারার এক বিশাল ক্ষমতা। পুঁজির আশীর্বাদ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানের খয়রাতি ছাড়া, পাঠকের করতালির ফাঁদ ছাড়া বেঁচে থাকার সাহস। যে সাহস ‘লিটল’ শব্দকে একটি সাংস্কৃতিক ট্রিগার বানায়, একরকম বিস্ফোরক—যার স্পার্ক বহু ‘বৃহৎ’ নামধারী সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
আসলে এই লিটলম্যাগাজিন একটি অস্তিত্ববাদী অবস্থান—এটি বলে, আমি যেন যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই থাকি। আমার দেহের গঠন তুমি মেপে দেখো না, আমার ভাষার তীক্ষ্মতা দেখো। ‘লিটল’ হয়ে ওঠে সেই আত্মচেতনার আয়না যেখানে বড় না হয়ে, ক্ষুদ্র হয়ে থাকতে পারাও এক ধরনের প্রতিরোধ। যেন বলছে—আমি তোমার সংবর্ধনার দরজা দিয়ে ঢুকতে চাই না, আমি পেছনের গলিপথে ঢুকে ছুরি মারব বুর্জোয়া রুচির বুক ভেদ করে। এটি অনেকটা একজন অনাহারী অথচ উচ্চকণ্ঠ কবির মতো। সমাজ বলে, সে কিছুই নয়; পুঁজি বলে, সে অদৃশ্য; পাঠক বলে, সে কঠিন—তবু সে তার ‘কিছু না’ থাকার ভেতর দিয়েই বলে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি। এই নৈঃসঙ্গ্যই তাকে দেয় স্বাধীনতা, এই পরিত্যাগই তাকে দেয় স্বর।
লিটলম্যাগাজিন একটি ঘর নয়, একটি নৈবেদ্য নয়—এটি এক চলন্ত উপেক্ষা, এক অস্বীকারের চলমান তন্ত্রী। ‘লিটল’ শব্দের ভেতরে গেঁথে থাকে এক পঙ্কিল, বিদ্রুপময় হাসি, যা প্রথার নাকের ডগায় খ্যাপাটে গালি ছুঁড়ে দেয়। সাহিত্য যখন আড়ম্বরের পোশাক পরে আসে, তখন লিটলম্যাগাজিন তাকে নগ্ন করে প্রশ্ন করে—‘এই ভদ্রতা কি তোমার, না তোমার বিক্রয়যোগ্যতার?’ ‘লিটল’ শব্দটি কোনো অভিমান থেকে নয়, আসে অভিলাষহীন বোধ থেকে। এটি জন্মায় ওইসব ক্লান্ত দুপুরের কবির মুখে, যে জানে, তার কবিতা ছাপা হবে না, তবু সে লিখে যায় কারণ তা না লিখলে তার জিভে ঘা হবে। এই ঘা থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন ব্যাকরণ—‘লিটল ব্যাকরণ’, যা কোনো ছক বোঝে না, বোঝে ঘৃণা, যন্ত্রণার ছন্দ, সমাজবিরোধিতার অন্তর্জালা। এই ‘লিটল’ তাই এক প্রকার সাংস্কৃতিক শ্রমিকের পরিচয়পত্র। সে রাত্রে লিখে, দিনভর ফটোস্ট্যাট চালায়, বই বিক্রি করে, স্টলে বসে, বিনা সম্মানীতে পাঠ করে। কিন্তু তার ভেতরের গর্জন কখনো নিঃশব্দ নয়। সে জানে, তার লেখার গায়ে যতই ‘অপ্রকাশিত’ তকমা লাগুক, সে ভবিষ্যতের সাহিত্যে একটি নখদাঁতের মতো লেগে থাকবে—ক্ষুদ্র, কিন্তু ক্ষরণশীল।
এই শব্দের অস্থিমজ্জাগত দ্রোহ, এই যে বৃহতের প্রতি নাকচ—এটাই লিটলম্যাগাজিনের সত্যিকারের বিপ্লব। শব্দ দিয়ে লড়াই করার সাহসই তাকে দেয় তার আত্মমর্যাদার মেরুদণ্ড। ‘লিটল’ হতে পারার মধ্যে যে আত্মিক স্থৈর্য আছে, যে নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাস আছে, তা ‘বৃহৎ’ হতে চাওয়ার লালসায় থাকে না। এই ‘লিটল’ হয়ে ওঠে সাহিত্যের নোংরা জলভাগে একমাত্র সত্যিকার জাহাজ, যেখানে উঠতে গেলে পা ভিজে যায় ঠিকই, কিন্তু ডুবতে হয় না। ‘লিটল’ একটি অভিধান-বহির্ভূত নাম, যেখানে আত্মমর্যাদাই হয়ে ওঠে শেষ শব্দ।
২.
লিটলম্যাগাজিনের ভাষা যেন ভাষা নয়—এক ধরনের ধারালো ছুরি, যা শব্দের গায়ে গা ছমছমে বিদ্রোহের আঁচড় কাটে। তাদের বাক্যরীতি মূলধারার ভাষিক ভব্যতাকে একটানা অবজ্ঞা করে চলে। এখানে বাক্য কখনো ফেটে পড়ে চিৎকারে, কখনো নিজেকেই ছিঁড়ে ফেলে অর্থহীনতার স্বরে। এই ভাষা পাণ্ডিত্যে তৈরি নয়, এই ভাষা গলির মাথায়, শরীরের ঘামে, বিষাদের প্যাঁচালিতে, রাজনৈতিক পোস্টারে, রেললাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঠেলাগাড়িওয়ালার আর্তনাদে তৈরি। এখানে ভাষা যেন আত্মহত্যার আগের শেষ চিঠির মতো—অপরিষ্কার, আবেগস্নাত, বিক্ষিপ্ত, কিন্তু অসম্ভব সত্য।
লিটলম্যাগাজিনে ভাষা একা থাকে না। তার সঙ্গে থাকে লেআউটের বিপ্লব—যা শিল্পকলার রুচিবান আয়োজন নয়, একরকম দুঃস্বপ্ন। পৃষ্ঠা সাজানো হয় যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন আত্মচিৎকারে। কখনো লেখা থাকে হস্তাক্ষরে, কখনো বাম থেকে ডানে নয়, নিচ থেকে উপর, কখনো পাতার ঠিক মাঝখানে একটা শাদা শূন্যতা, যেন একফালি মৌনতা পাঠকের গলায় আটকে থাকে। এখানে ফন্ট নির্বাচনের সৌন্দর্য নান্দনিকতাকে নয়, তা দর্শনীয় অস্বস্তিকে চাঙা করে। টাইপোগ্রাফি এখানে বিভ্রান্তি, এখানেই লুকিয়ে থাকে প্রতিরোধ।
প্রথাগত ছাপাখানার নিখুঁত প্রুফ, পরিপাটি ডিজাইন, একরকম সাহিত্যিক সৌজন্যের মোড়ক—লিটলম্যাগাজিন তা ছিঁড়ে ফেলে। তারা ছাপাখানার ভুলকেও নিজেদের অস্তিত্বে টেনে নেয়—মুদ্রণদোষ এখানে পরিণত হয় ভাষাগত ব্যর্থতার দার্শনিক প্রতীক হিসেবে। এই ব্যর্থতাকে লালন করাই তাদের কৃতিত্ব। একধরনের অসম্পূর্ণতাকে সযত্নে ধারণ করে তারা বলে—‘এই ভুল, এই ছেঁড়াখোঁড়া, এই অসঙ্গতিই আমাদের অনিবার্য সত্য।’ লিটলম্যাগাজিনের ছাপাখানাগুলো যেন কোনো গোপন অস্ত্রাগার। কাঠের হরফ, লিনোটাইপের চাকা, সস্তা অফসেট, স্কেল দিয়ে কাটা পৃষ্ঠা—সবকিছুতেই থাকে একরকম কাঁচামাল-জাত বিদ্রোহ। এখানে যন্ত্র আর শব্দ একসঙ্গে রক্তপাত করে। একটা কবিতা ছাপা হতে গিয়ে কত প্রুফভুল, কত অক্ষর হোঁচট খায়—সেই ঠোকরগুলোও যেন হয়ে ওঠে কবিতার অংশ। যেন সাহিত্য নয়, সাহিত্যের গলির শব্দ শোনা যাচ্ছে সেখানে।
লিটলম্যাগাজিনের পৃষ্ঠায় কবিতা-প্রবন্ধ-গদ্য কেবল পাঠযোগ্য হয় না, তা হয়ে ওঠে একগুচ্ছ খসড়া—যা পাঠককে আহ্বান করে, কিন্তু আশ্রয় দেয় না। এই অনির্ধারিততা, এই খসড়ার সম্ভাবনা, এই প্রস্তুতিহীনতা তাদের অস্তিত্বের শিরা-উপশিরায় গাঁথা এবং এই অনড় প্রস্তুতি-মুক্ত অবস্থানই তার আসল কাব্যিকতা। লেআউট এখানে কোনো চারুকলা প্রদর্শনীর মতো বিন্যস্ত নয়, তার চেহারা চিৎকার করা দেয়ালের মতো। পত্রিকার শিরোনামে থাকে আঁকিবুঁকি, কখনো কালি ছড়িয়ে যায়, কখনো পৃষ্ঠা কেটে ফেলা, আবার কখনো হঠাৎ দুটি পাতার একদিকে নেই কোনো লেখা—এই অপূর্ণতা ইচ্ছাকৃত। লিটলম্যাগাজিনের প্রকাশনার দেহরচনাতেও থাকে বিক্ষোভ—একটি ম্যাগাজিন কখনো পুরো নোটবুকের ফর্মে, কখনো ভাঁজ করা পোস্টারের মতো, কখনোবা কাভারহীন। কাভারে থাকে না কোনো বিখ্যাত শিল্পীর ছবির পলিশ, শাদা পাতায় কলমের আঁচড়, ব্লকপ্রিন্ট, কাঠের ছাপে কাটা এক বীভৎস মুখ। এই কদর্যতাই তাদের রুচি, কারণ সে জানে, সত্য কখনো সুন্দর হয় না—তা হয় দগদগে, গন্ধময়, রক্তাক্ত।
এই ছাপাখানা—যার চাকার শব্দ অনেক সময় কাগজের চেয়ে বেশি উচ্চারণযোগ্য—তা হয়ে ওঠে আন্দোলনের এক অলক্ষ্য রণভূমি। প্রতিটি ম্যাগাজিন ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন বুলেট ছুটে যায় মূলধারার সৌন্দর্যবোধের বুকে। তারা শত্রুর ভাষায় নয়, নিজের রক্ত দিয়ে তৈরি করে এক নতুন মুদ্রণতন্ত্র। সেখানে সম্পাদকের নাম, প্রকাশকের ঠিকানা, কপিরাইটের তারিখ—সবই অনুপস্থিত বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত। এই চেহারা দেখে অনেকেই বলবে—এটা তো অপেশাদারিত্ব, এটা তো নৈরাজ্য। কিন্তু আসলে এটাই তো সেই সচেতন নৈরাজ্য, যেখানে প্রতিটি অসামঞ্জস্য, প্রতিটি ছাপার অসাবধানতা এক ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ। তারা আসলে গড়ার জন্য গুঁড়িয়ে ফেলে। তাদের কাঠামোবিরোধিতা রীতিমতো স্থাপত্যবিজ্ঞান। এই পত্রিকাগুলোর প্রতিটি অংশ—লেখা, লেআউট, ছাপা, গ্রাফিক্স, এমনকি ভুল বানান—সব একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে এক ধরনের রাজনৈতিক কোলাজ, যেখানে শিল্প শুধু রূপ নয়, একরকম গর্জন।
লিটলম্যাগাজিনে লেখার গায়ে থাকে তাজা ঘাম, পাতার গায়ে থাকে ছেঁড়া পকেটের গন্ধ, ছাপার নিচে চাপা থাকে এক অশ্রুত বিক্ষোভের দলিল। এটা কেবল পত্রিকা নয়, একধরনের ভাষাবাহিত প্রমাণ, যে সমাজে এখনও কেউ কেউ বাঁচতে চায় ভাষাকে খুঁড়ে, জ্বালিয়ে, আবার নতুন করে লেখার জন্য এবং এই বিক্ষোভ—শুধু রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক নয়, এটি এক জৈব প্রতিবাদ। এটি একটি অভ্যন্তরীণ বিকার। লিটলম্যাগাজিন কেবল সাহিত্য নয়, এটি এক আন্দোলন, এক স্থায়ী প্রতিবাদ, এক প্রকাশিত ব্যর্থতার সঙ্গীত। তার ভাষা অস্ত্র, তার লেআউট গোলযোগ, তার ছাপাখানা আগ্নেয়াস্ত্র। সবকিছু মিলিয়ে সে একটি বিস্ফোরণ—একটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দাউদাউ আগুন, যা সাহিত্যের ব্যবস্থাকে পোড়াতে পোড়াতে নতুন ভাষার ছাই তৈরি করে।
৩.
লিটলম্যাগাজিনে ব্যবহৃত ভাষা রাষ্ট্রের অনুমোদিত ব্যাকরণে লেখা হয় না। এর শব্দভান্ডার ছিন্ন, ব্যাকরণ বিকৃত, বাক্য গঠন অশোভন—কারণ এ ভাষা জন্ম নেয় রাজনীতির গোপনতম অসুখ থেকে। রাষ্ট্র তার নাগরিককে শুধু শাসন করে না, তার ভাষাকেও শাসন করে। অথচ প্রতিটি লিটলম্যাগাজিনই একটি চোরাগোপ্তা প্রতিরোধ—যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে একটি ছুরি, একটি পকেট-ছুরি, যেটা আপনি দেখতে পান না, কিন্তু একটি নির্ভুল মুহূর্তে সে ছিন্ন করতে পারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার ঘাড়ের ধমনী।
রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেনাবাহিনী দিয়ে, আদালত দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, আইন দিয়ে। কিন্তু আরও সূক্ষ্মভাবে তা করে ‘ভাষা’ দিয়ে। কাকে আপনি কবি বলবেন, কোন লেখা ছাপা হবে রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিকে, কোন কবিতা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে, কোন শব্দ নিষিদ্ধ, কোন বাক্য আপনার বিরুদ্ধতা নির্দেশ করে না—সবকিছুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এক সাংস্কৃতিক সেন্সরশিপ প্রতিষ্ঠা করে এবং এই সেন্সরশিপ রাষ্ট্রীয় চেহারা নিয়ে আসে সাহিত্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। সাহিত্য অ্যাকাডেমি, পুরস্কার কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস, সরকারি অনুদান, টিভি টকশোর, সাংষ্কৃতিক এজেন্সি, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি—সবই এক যৌথ ষড়যন্ত্র, যেখানে কবিকে কবি বানানো হয়, লেখককে লেখক বানানো হয় এবং সেই প্রক্রিয়ায় আসল লেখাগুলোকে অদৃশ্য করে ফেলা হয়।
লিটলম্যাগাজিন এই অদৃশ্যকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভাষাকে চোরাগোপ্তা মারণাস্ত্রে পরিণত করে। এখানে শব্দ আসে ছিন্ন পোশাক থেকে, পকেটবইয়ের পাতাঝরা থেকে, লুকিয়ে রাখা আত্মহত্যার চিঠি থেকে অথবা কারাগারে থাকা কবির স্মৃতি থেকে। লিটলম্যাগাজিনে লেখা হয় এমন ভাষায়, যা রাষ্ট্রের অভিধানে নেই, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় নেই, যা সাহিত্য সম্মেলনের টেবিলে অগ্রহণযোগ্য। এই ভাষা শালীন নয়, কারণ এটি জেগে থাকে। এটি ভদ্র নয়, কারণ এটি বিদ্রোহী। এটি পুরস্কারের জন্য লেখা হয়নি, বরং প্রতিটি বাক্য একটি অসমাপ্ত যুদ্ধঘোষণা পত্র।
লিটলম্যাগাজিনের কবি জানে তার লেখা কোনো রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারবে না। এই লেখাগুলো কখনো খালি গলায় আওড়ানো হয়, কখনো দেয়ালে লেখা হয়, কখনো মুদ্রিত হয় হাতে টাইপ করে, আবার কখনো শুধু এক কপি কাগজে থেকে যায় কোনো মৃত বন্ধুর বুকপকেটে। কারণ এই লেখাগুলো কেবল সাহিত্য নয়—এগুলো গোপন বার্তা। গোপন ছুরি। গোপন বিপ্লব। যখন একটি লিটলম্যাগাজিন সিদ্ধান্ত নেয়, সে লিখবে রাষ্ট্রীয় সীমার বাইরে, সে তখন মূলত একটি ভাষিক আত্মহত্যা করে। সে বুঝে নেয়, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, তাকে পাঠ্যপুস্তকে ঢোকানো হবে না, তার মৃত্যুর পর ‘জীবন ও সাহিত্য’ শিরোনামে কোনো আলোচনাসভা হবে না। তবু সে লেখে—কারণ তার ভাষা, তার বাক্য, তার চুপ করে থাকা—সবই রাষ্ট্রের মুখে একটি থুতু। একটি ঘৃণা।
এবং এই ঘৃণা আভিজাত্যহীন নয়। সেটা এক বিশুদ্ধ আত্মমর্যাদার কাঠামোতে দাঁড়িয়ে থাকে। যে ভাষা ‘ভালো কবিতা’ লেখার ফর্মুলা জানে না, কিন্তু জানে কোথায় রাষ্ট্র তার ইতিহাসকে বিকৃত করেছে, কোথায় তার পুলিশ একটি কবির কণ্ঠরোধ করেছে, কোথায় তার সাহিত্যের পুরস্কার নীতিহীন অনুগ্রহে পরিণত হয়েছে—এই ভাষা আর কাব্যিক থাকে না, সে হয়ে ওঠে একটি হিংস্রতা। এই হিংস্রতাই লিটলম্যাগাজিনের শক্তি।
রাষ্ট্র চায়—সাহিত্য হোক নীরব, ধোঁয়াটে, রূপক। তাই তাদের ভাষা রূপক ঠেলে ফেলে দেয়। এখানে নৈপুণ্য নয়, এখানে ব্যথা। এখানে অলঙ্কার নয়, এখানে গালি। একটি গালি, যা রাষ্ট্রের মুখে রক্ত তুলে দেয়। একটি বাক্য, যা সাহিত্যের ঘোমটা সরিয়ে তার নগ্নতা দেখিয়ে দেয়। এই ভাষার রাজনীতি কেবল লিংকন বা লেনিনের নাম ধরে চলে না। এটি লেখে গ্যারেজের দেয়ালে, একটি গ্যাংরেপের পর শহরের গেটের ওপর, এক হিজড়ার ঠোঁটের ফাটলে, এক ট্রান্সজেন্ডারের নামহীন কবিতায়। এই ভাষা রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে, কারণ রাষ্ট্র এইসব কণ্ঠকে অস্বীকার করেছে বহুদিন ধরে।
এখানেই লিটলম্যাগাজিন হয়ে ওঠে কেবল সাহিত্য নয়, এক গভীর রাজনৈতিক প্রয়াস। এটি একটি চোরাগলি দিয়ে প্রবেশ করে রাষ্ট্রের সাহিত্য রাজনীতিতে এবং বোমা পুঁতে দেয়। একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার একটি ক্ষুদ্র লেখাও হয়ে উঠতে পারে এক মহাপতনের সূচনা। কারণ পাঠক যখন একবার এই ভাষা স্পর্শ করে, তখন সে আর রাষ্ট্রীয় অভিধানে ফিরতে পারে না। সে নিজেও হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক।
লিটলম্যাগাজিন বোঝে—সাহিত্য যদি রাষ্ট্রের কাছে নিরাপদ হয়, তবে তা আর সাহিত্য থাকে না, তা হয়ে যায় সহযোগী দলিল। তাই তাদের কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্য—সবই হয় আগ্রাসী উচ্চারণে। তাদের লেখা রাষ্ট্র পড়লে ভয় পায়, সাহিত্যের গডফাদারগণ ঘৃণা করে, পুরস্কার কমিটি এড়িয়ে চলে, ইউনিভার্সিটি পাঠ্যতালিকা ‘নোট অ্যাপ্লিকেবল’ বলে বাদ দিয়ে দেয়। অথচ এটাই তাদের জয়। এটাই তাদের অস্তিত্ব।
রাষ্ট্র যখন নতুন আইন করে, সাহিত্য প্রতিষ্ঠান নতুন পুরস্কার ঘোষণা করে, মিডিয়া নতুন নায়ক বানায়—লিটলম্যাগাজিন তখন শুধু তাকিয়ে থাকে একধরনের ধিক্কার নিয়ে। তারা জানে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই একধরনের আত্মঘাতী নিরবতা আছে, যা শব্দকে ক্রমাগত দুর্বল করে দেয়। সেই দুর্বলতা প্রতিরোধ করতেই তারা রচনা করে অন্যরকম বাক্য, যেখানে যুক্তি নেই, ব্যাকরণ নেই, কিন্তু আছে রক্ত। আছে রাগ এবং সেই রাগই তাদের ভাষার ভিত্তি। সেই রাগ থেকেই তারা শব্দ বানায়। নতুন ভাষা বানায়। এমন ভাষা, যা রাষ্ট্র বোঝে না, সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত বোদ্ধারা বুঝতে চান না, কিন্তু মানুষ বুঝে ফেলে—অসুখের মতো, আগুনের মতো, বিদ্রোহের মতো। কারণ এই ভাষা ঘুমায় না। এই ভাষা হাসে না। এই ভাষা শুধু জ্বলে।
এইভাবে লিটলম্যাগাজিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করায় ভাষাকে। ছুরি না তুলে, বুলেট না ছুঁড়ে—শুধু একটি বাক্য লিখে, একটি কবিতা ছাপিয়ে, একটি সংখ্যাহীন পত্রিকা ছড়িয়ে দিয়ে তারা শুরু করে এক বিপ্লব, যার খবর কাগজে আসে না, কিন্তু যার শব্দ রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। লিটলম্যাগাজিন তাই কোনো দিনপঞ্জি নয়। এটি একটি মরচে ধরা ছুরি, যা সময়ের বুক চিরে দেয়। এটি রাষ্ট্রের মুখে ছুঁড়ে মারা একখানা থুতু-ভরা কবিতা। এটি কাফনের পকেটেও লুকিয়ে রাখা এক বাক্য, যা বলবে— ‘আমার মৃত্যু মানে শেষ নয়, তুমি এখনও আমার ভাষা থেকে মুক্ত হতে পারোনি।’
৪.
লিটলম্যাগাজিনগুলো কোনো রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো হাতে পথে নামে না, কিন্তু তাদের প্রতিটি অক্ষরেই থাকে রাজনৈতিক দ্যোতনা। তারা পার্লামেন্টে দাঁড়ায় না, কিন্তু তাদের প্রতিটি অনুচ্ছেদ হয়ে ওঠে বিপ্লবের এক নিষিদ্ধ মানচিত্র এবং এই বিপ্লব কেবল লাল পতাকার নয়, এটি কখনো লাল, কখনো কালো, কখনো একেবারে রঙহীন—কারণ লিটলম্যাগাজিনের রাজনীতি প্যারেড করে না, পঁচে না, জমে থাকে না; তা একটি বহমান অবচেতন, এক অস্থির প্রবাহ, যা কখনও সমাজতন্ত্রী, কখনও অস্তিত্ববাদী, কখনও নির্লজ্জ নৈরাজ্যবাদী হয়ে ওঠে এবং এই রাজনৈতিক অবচেতনই লিটলম্যাগাজিনকে করে তোলে একটি শিরদাঁড়াযুক্ত প্রাণী—যেখানে প্রতিটি বাক্য কোনো না কোনো আদর্শের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত, প্রতিটি অনুচ্ছেদ কোনো না কোনো নির্মাণকে অস্বীকার করে, প্রতিটি বিরামচিহ্ন একটি অভ্যুত্থানের আভাস দেয়।
লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি—যেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে শ্রমিকের ঘাম ছাপা হবে পাতায় পাতায়। তাদের সমাজতন্ত্রে কৃষকের কণ্ঠ, ঠেলাগাড়ি চালকের কান্না, কারখানার মেয়েটির আত্মহত্যা—সবকিছু ভাষার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে এক অনমনীয় অভিসারে। এই কবিতা চায় না পার্টি অফিসে ঝোলানো হোক, চায় না জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হোক—এ চায় রাষ্ট্রের অলিন্দে বিস্ফোরণ ঘটাতে এবং ঠিক তখনই এই সমাজতন্ত্রীয় মগ্নতা ধাক্কা খায় অস্তিত্ববাদের অন্ধকারে। কারণ লিটলম্যাগাজিনের লেখক জানে, সকল বিপ্লবই একদিন পরিণত হয় ব্যুরোক্রেসিতে, সকল কমিউন মঞ্চে একদিন হয়ে ওঠে লোভী ক্ষমতার গুহা। তাই সে নিজেকে সরিয়ে নেয় আদর্শের কেন্দ্র থেকে, সে চলে যায় অস্তিত্বের ধূসর প্রান্তে, যেখানে মানুষ শুধু তার ক্ষরণ, তার ক্লান্তি, তার অনর্থকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই অস্তিত্ববাদের ভাষা শীতল, নিরুদ্দীপ, যেন এক মৃতদেহ তার নিজের কবর লিখছে। এখানে কবি আর রাষ্ট্রবিরোধী না, পার্টিবিরোধীও না, সে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক ছায়া।
এই বিপরীত স্রোতের ভেতরই হঠাৎ জেগে ওঠে নৈরাজ্যবাদ—যেটা কোনো রঙ চেনে না, কোনো পতাকা তোলে না, কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে না। লিটলম্যাগাজিন যখন সত্যিই নিজের মুখ দেখে আয়নায়, তখন সে দেখে—তার ভাষা এক হিংস্র অস্বীকৃতি, তার মনোভঙ্গি এক নির্জন ধ্বংসের ঘোষণা। সে বিশ্বাস করে না কোনো সংবিধানে, কোনো প্রভুর আদেশে, কোনো পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যে। সে বিশ্বাস করে শুধু অনিশ্চয়তায়, শুধু ভাঙনের মধ্যে, শুধু সেই চূড়ান্ত অস্বস্তিতে, যা থেকে জন্ম নেয় কবিতা। এই নৈরাজ্য কোনো দার্শনিক ক্লাসরুমের নয়, এটি এক ট্রেন দুর্ঘটনার মতো, হঠাৎ, হিংস্র, এবং নির্ভুল।
এইভাবে লিটলম্যাগাজিনের রাজনৈতিক অবচেতন গড়ে ওঠে এক বহুমাত্রিক অস্থিরতায়; কোনো নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এক অনবরত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতায়নে। এটি এক গোপন থিসিসের বিপক্ষে লেখা অ্যান্টি-থিসিস, আবার সেই অ্যান্টি-থিসিসকেও পুড়িয়ে ফেলার প্রস্তুতি। তাদের ভাষা কখনো পোস্টমডার্ন, কখনো প্রাক-ইতিহাসিক। কখনো সে লেখে যেন মার্কসবাদী চেতনার একমাত্র উত্তরাধিকারী, আবার পরক্ষণেই সব আদর্শকে বিষাক্ত ঠাউরে আত্মা উলঙ্গ করে দেয়। তাদের ভাষা তীরন্দাজ, কখনো ধর্মবিরোধী, কখনো প্রগতি-বিরোধী, কখনো নিজের অস্তিত্বকেই ঘৃণা করে।
যারা বলে লিটলম্যাগাজিন কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তারা বোঝে না—এ এক বিকল্প রাজনীতি—যেখানে ভাষাই দল, বিক্ষোভই সংগঠন। যে দল কোনো ব্যালট চায় না, কিন্তু ভাষার প্রতিটি কণিকায় রেখে যায় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে অসমাপ্ত অভিশাপ। যাদের অফিস নেই, ফান্ড নেই, স্লোগান নেই, কিন্তু আছে এক ঘৃণার আত্মমর্যাদা। এই আত্মমর্যাদাই লিটলম্যাগাজিনের রাজনৈতিক অস্তিত্ব। ঠিক এইখানেই তারা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। কারণ তারা সংজ্ঞায়িত হতে চায় না। আপনি যদি তাদের বলার চেষ্টা করেন—‘তুমি কি সমাজতন্ত্রী?’—তারা হাসবে। আপনি যদি বলেন—‘তাহলে কি তুমি নৈরাজ্যবাদী?’—তারা আপনাকে চুপ করে দেবে এক অনুচ্ছেদে, যেখানে কোনো বর্ণ নেই, শুধু নিস্তব্ধতা। কারণ লিটলম্যাগাজিনের রাজনৈতিক ভাষা চিহ্নিতকরণকে অপমান মনে করে। তারা নিজেকে ভাবতে চায় এক ‘অসমাপ্ত চক্রান্ত’।
তারা জানে, সকল রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় লবিংয়ে, সমস্ত বিপ্লবই পরিণত হয় ব্যানারে, সমস্ত ব্যানারই পরিণত হয় প্লাস্টিকে এবং প্লাস্টিক কোনোদিন ভাষা হয়ে উঠতে পারে না। তাই তারা ভাষাকে রাখে বিপন্নতার মধ্যে। রাখে ফুসফুসের ঠিক পাশে, যেখানে ভয় জমা হয়, বিদ্রোহ জাগে। এই ভয়ই তাদের রাজনীতি। লিটলম্যাগাজিনের রাজনীতি এক অলিখিত আত্মঘাতী সংঘ, যেটা রোজ রাত্রে একেকটি শহরের ময়লায় জন্ম নেয়, গলির দেয়ালে লেগে থাকে, অথবা একটা পুরনো কাগজের ভাঁজে শুয়ে পড়ে। কোনো ঘোষণা নেই, কোনো পতাকা নেই, কেবল একটা বাক্য, যা রাষ্ট্রের বুক চিরে যেতে চায়। কখনো সাদা পাতায় কালো অক্ষরে, আবার কখনো রক্তের রেখায়।
তাদের রাজনীতি কখনো কবিতার নামে, কখনো গদ্যের ভেতরে, কখনো ভুল বানানে। তারা র্যাডিক্যাল, কিন্তু চিৎকার করে না। তারা পরাজিত, কিন্তু মাথা নিচু করে না। তাদের প্রতিটি সংখ্যা, প্রতিটি লেখা, প্রতিটি লেআউট এক রাষ্ট্রবিরোধী নকশা। আপনি যদি খুব ভালো করে তাকান, দেখবেন—প্রচ্ছদে থাকে না কোনো মুখ, সেখানে থাকে এক ছায়া এবং সেই ছায়াই বলে দেয়—‘আমি কোনো মতবাদে বিশ্বাস করি না, আমি কেবল তোমার পতনের প্রতীক্ষা করছি।’ এইভাবে লিটলম্যাগাজিন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অবচেতনের এক ভয়ানক তীর্থভূমি—যেখানে শব্দ শুধু শব্দ নয়, তা হয়ে ওঠে আগ্নেয়গিরির ছাই, লাশের চিরকুট, অথবা স্বাধীনতার অসমাপ্ত অঙ্গীকার। এখানেই তারা ভিন্ন, এখানেই তারা ভীতিকর, এখানেই তারা অবজ্ঞা করে সমস্ত চিন্তার মানদণ্ড। তাদের কাছে শুধু একটি লক্ষ্য—যেকোনো মূল্যেই রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি—সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এমনকি নিজেদেরও। এই প্রশ্ন করার ক্ষমতাই লিটলম্যাগাজিনের একমাত্র ধর্ম। এই ধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। শুধু আছে—অনিশ্চিত ভাষায় লেখা এক বিপ্লবের জার্নাল।
৫.
যদি সাহিত্যের প্রকৃতি কেবল ভাষার কারুকাজ নয়, একটি বহ্নিশিখার মতো আত্মবিসর্জন হয়—তবে লিটল ম্যাগাজিন নিছক কোনো সাহিত্যচর্চার অবলম্বন নয়, তা এক বিস্ফোরক, এক আত্মঘাতী সৌন্দর্যের সমাহার। এটি কোনো ফুলদানি নয়, যেখানে ভাষা সাজিয়ে রাখা যায়; এটি এক ছিন্নভিন্ন মাংসপিণ্ড, যেখানে শব্দরা রক্তাক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেয়ালে, চিন্তার গোপন অলিন্দে। লিটল ম্যাগাজিনের সৌন্দর্য ক্লাসিক্যাল নয়, রোমান্টিক নয়, এমনকি পরাবাস্তবও নয়—এ এক নগ্ন, ক্ষতবিক্ষত সৌন্দর্য, যেখানে প্রত্যেকটি বাক্য তারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সৌন্দর্য যেন একটি আত্মঘাতী কবি, যে প্রতিটি লাইনে নিজের কবিতাকে হত্যা করে এক নতুন কবিতার জন্ম দেয়। এটি এক অগ্নিস্নান, যেখানে শব্দ একে অপরকে ধ্বংস করে এবং সেই ধ্বংস থেকেই উঠে আসে একটি অনিবার্য সৌন্দর্যবোধ—নিষিদ্ধ, নির্জন, এবং অনিবার্য।
প্রতিষ্ঠান যখন ভাষাকে পণ্য বানিয়ে ফেলে, তখন লিটল ম্যাগাজিন সেই ভাষাকে চুরি করে নিয়ে যায় অন্ধকার গলিতে—সেখানে তারা বানায় এমন এক ভাষা, যা কোনো দোকানে বিক্রি হয় না, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় না, কোনো পুরস্কারে সম্মানিত হয় না। এ ভাষা মৃতদেহ কাঁধে করে ফেরে, রক্তে চিঠি লেখে, এবং নিজের অস্থি দিয়ে তৈরি করে অনুচ্ছেদ। সাহিত্য যদি কোনো ‘আলোচিত’ বিষয় হয়, তাহলে লিটল ম্যাগাজিন সেই আলোকে নিভিয়ে দিয়ে আঁধারের মধ্যে দিয়ে পড়ে—যেখানে চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়, কান্না নয়।
লিটল ম্যাগাজিন কখনোই সুন্দর হওয়ার চেষ্টা করেনি, সে চেষ্টা করেছে সত্য হওয়ার। কিন্তু সেই সত্য ছিল এতটাই বীভৎস, এতটাই উদ্গ্রীব, যে তা হয়ে উঠেছে এক প্রকার প্যাথেটিক সৌন্দর্য—এক এমন সৌন্দর্য, যা কেবল ক্ষত দেখাতে পারে, কেবল ভাঙা মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াতে পারে। এটি সেই সৌন্দর্য, যা কোনো মিউজিয়ামে রাখা যায় না, কারণ সে নিজেই নিজের মূর্তি ভেঙে দেয়। সে নিজেই বলে—‘আমি কবিতা নই, আমি বিস্ফোরণ।’
এই বিস্ফোরণের ভেতরেই বাস করে একধরনের সন্ত্রাস—যা রাষ্ট্রের ভাষাকে ধ্বংস করে দেয়, প্রতিষ্ঠানের ছাঁচকে বিকৃত করে তোলে এবং পাঠককে বাধ্য করে, শূন্যের দিকে তাকাতে। এই শূন্যতা কোনো নৈরাজ্যের নয়, এটি এক সুনির্মিত পরিত্যাগ—যেখানে পুরনো বিশ্বাস, নৈতিকতা, আচার—সব পুড়ে যায় এবং সেখানেই জন্ম নেয় সেই আত্মঘাতী সৌন্দর্যবোধ। কবিতা এখানে কোনো উপভোগ্যতা নয়, এটি এক ধ্বংসযজ্ঞের মানচিত্র। লিটল ম্যাগাজিন এমন এক আত্মপ্রতিবাদ, যেখানে লেখক নিজেই নিজের মুখ ঘষে ফেলে দেয়। সে চায় না ছবি, চায় না স্মৃতি, চায় না ইতিহাস। সে চায় এক নতুন শূন্যতা, যেটি থেকে উঠে আসবে এমন শব্দ—যা আগে কেউ বলেনি, কেউ শোনেনি, এবং কেউ বুঝবেও না। এই অনবধি অগ্রহণযোগ্যতাই তার লক্ষ্য। পাঠকের জন্য নয়, পাঠককে নস্যাৎ করতেই তার শব্দচয়ন। সে চায় পাঠকের শরীরে এক অনিচ্ছাকৃত শ্বাসরোধ হোক, চায় পাঠক তাকিয়ে থাকুক একটি অনুচ্ছেদের দিকে—যেখানে কোনো ক্রিয়াপদ নেই, কেবল একটি বিষাক্ত ব্যঞ্জনা।
এ সৌন্দর্য রাজনীতিক নয়, কিন্তু রাজনৈতিক; এ চিন্তাশীল নয়, কিন্তু চিন্তার ধ্বংসাবশেষ; এ সাহিত্য নয়, সাহিত্যের মৃত্যুর সনদ এবং এই মৃত্যুর মধ্যেই তার জীবনের দাবি। লিটল ম্যাগাজিন ঘোষণা দেয় না, ‘আমি সাহিত্য তৈরি করছি।’ সে বলে—‘আমি ভাষাকে হত্যা করছি, যাতে তুমি নতুন করে ভাষা ভাবো।’ এই ভাবনাই তার সৌন্দর্য। আত্মবিসর্জনের ভেতর দিয়ে সে নির্মাণ করে এক বেদনার নান্দনিকতা, যেটি কোনো নিটোল পংক্তিতে ধরা যায় না এবং ঠিক এইখানেই সে হয়ে ওঠে বোমা। কারণ সে কারো অনুমোদন চায় না, কারো প্রশংসাও না। সে চায় না পড়া হোক, চায় না প্রশংসা হোক, সে কেবল ছুড়ে দেয়—একটি পাতা, একটি বাক্য, একটি প্রতীক—যা সরাসরি পাঠকের বুকে গেঁথে যায়। কেউ বুঝে না, কিন্তু কাঁপে। এই কাঁপনই তার সৌন্দর্য। এই হিংস্রতা, এই একাকীত্ব, এই সমস্ত চেনা বৃত্তের ভাঙচুরই তার ভাষার শৈল্পিকতা। অন্য সাহিত্য যখন পাঠকের সঙ্গে প্রেম করে, তখন লিটল ম্যাগাজিন পাঠকের সঙ্গে সংঘর্ষে নামে। এ প্রেম নয়, যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধেই লিটল ম্যাগাজিনের সত্য সৌন্দর্য—যেখানে সাহিত্য এক শ্বেতশবদেহ, কিন্তু তার ভেতর থেকে ক্রমাগত উঠছে পচনের শব্দ। এই শব্দটাই কবিতা। এই পচনের মধ্যেই তার ব্যঞ্জনা।
লিটলম্যাগাজিন নিজেকে কখনোই অভিজাত করে তোলেনি, নিজেকে পরিত্যক্ত করেছে এবং এই পরিত্যক্ত অবস্থাতেই সে পেয়েছে একটি ভয়ংকর শৈল্পিক ঋজুতা। আপনি যদি একটি সংখ্যা হাতে নেন, দেখবেন—প্রচ্ছদ একদম কাঁচা, কাগজ নিম্নমানের, টাইপোগ্রাফি ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু ভিতরের ভাষা—আগুন। এখানেই লিটল ম্যাগাজিন ব্যতিক্রম। সে কোনো ব্র্যান্ড নয়, কোনো কফিশপ সংস্কৃতির অংশ নয়। সে একটি অপমানিত, অস্বীকৃত অস্তিত্ব এবং এই অস্তিত্বই—রক্তমাখা। সেই রক্ত কার? কবির নিজের, রাষ্ট্রের, নাকি পাঠকের? তার কোনো উত্তর নেই। কারণ লিটল ম্যাগাজিন প্রশ্ন রাখে, উত্তর নয়। সে চায়—আপনি কাঁদুন, আপনি রেগে যান, আপনি বই ছুঁড়ে ফেলুন, কিন্তু আপনি ‘নীরব’ না থাকুন। এই চেতনা, এই অভিসম্পাতই তার সত্যিকারের শিল্প।
লিটলম্যাগাজিন কোনোদিনই ইতিহাসে প্রবেশ করতে চায়নি, সে চেয়েছে ইতিহাসের বুক চিরে ফালি ফালি করতে। যে সাহিত্যে মঞ্জুরিপত্র আছে, তা তার নয়। যে ভাষায় সেন্সর নেই, সেটা সে গ্রহণ করে না। তার ভাষা নিজেই নিজের সেন্সর, নিজেই নিজের মরণদণ্ড এবং এই আত্মঘাতী শর্তেই সে স্থাপন করেছে এক অনন্য সৌন্দর্যবোধ, যেটি শ্রদ্ধার নয়, শিহরণের। এটি একটি রক্তাক্ত খেলা, নিজের রক্ত নিজেই পান করার মতো। এই রক্তই লিটল ম্যাগাজিনের শেষ ভাষা এবং সেই ভাষাই এক অমোচনীয় ব্যঞ্জনা—যা কোনোদিন বাজারে পাওয়া যাবে না, কোনোদিন ক্লাসে শেখানো যাবে না এবং কোনোদিন পুরস্কারে বন্দি করা যাবে না। কারণ সে নিজেই এক বিস্ফোরক। আর বিস্ফোরণ নিজেই একটি পরিপূর্ণ শিল্প।
যে ভাষার জন্ম হয় কান্না থেকে, রক্তক্ষরণ থেকে, প্রতিটি শব্দ যার অভিজ্ঞতা এবং প্রতিরোধে স্নাত—সেই ভাষা যখন ব্র্যান্ড হয়, তখন সাহিত্যের আত্মা মৃত হয়ে যায়। পুঁজিবাদ সাহিত্যকে আজ পণ্য করেছে, একটি নিরীহ বাণিজ্যিক গৃহপালিত পশু। এক সময় যে শব্দ ছিল বিদ্রোহের ছুরি, তা আজ কোমলপণ্য। কবিতা, গল্প, উপন্যাস আজ আর যুদ্ধের হুঙ্কার নয়— তারা আজ কাগজের মোড়কে মোড়া চকলেট, হাওয়ার মতো হালকা, বিজ্ঞাপনের মতো নিষ্প্রাণ। যেখানে প্রতিটি শব্দ এক সময় হতো অস্ত্র, আজ তা হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ডেড চিহ্ন। ভাষা, যা একসময় ধ্বংসের গান গাইত, এখন তা নিরাপদ ও সভ্য; কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় ভাষার মুখে আজ শুধুই স্নিগ্ধতা, প্রমোদ এবং মেনস্ট্রিম হিউম্যানিজমের জিরো ক্যালোরির পাণ্ডিত্য। সাহিত্যের এই হালকা হয়ে যাওয়া, এই ফুরফুরে হাওয়া হয়ে যাওয়া—একরকম সাংস্কৃতিক আত্মহত্যা এবং এই আত্মহত্যা ঘটেছে চূড়ান্ত ব্র্যান্ড অভিলাষে।
আজ লেখক জন্মায় না—তৈরি হয়। কবি আজ অস্তিত্ব নয়—সে প্রোডাক্ট। তার কভার ডিজাইন, বুক লঞ্চ, ইনস্টাগ্রাম পোস্ট, ফেসবুক পোস্ট আর বইমেলা স্টল—সবকিছু পরিকল্পিত, বিন্যাসিত এবং নিয়ন্ত্রিত। যেখানে ছিল আগুনের অক্ষর, সেখানে আজ ফন্টের মোহ। যেখানে ছিল রক্তমাখা ভাষার আর্তনাদ, সেখানে আজ ক্যাচফ্রেজ, স্লোগান, আর হ্যাশট্যাগ। সাহিত্যকে বলা হয় ‘পাঠকের জন্য’, অথচ পাঠক আজ স্রেফ এক সম্ভাব্য গ্রাহক— যার রেটিনায় লেগে থাকা চকচকে কভারের ভেতর খালি শব্দ, খালি শরীর।
সাহিত্য এখন লেখা হয় ‘বিক্রির জন্য’। মানে একটি নির্ধারিত চাহিদা পূরণের জন্য, একটি কাঙ্ক্ষিত পাঠকগোষ্ঠীর মানসিক গঠন বুঝে, ব্র্যান্ড কনসালটেন্টের মতো লেখা হয় ভাষা— যেন শব্দ নয়, বরং স্ট্র্যাটেজি। একটি গল্প বা কবিতা নয়, একটি প্যাকেজ। একটি অনুভূতি নয়, একটি মার্কেটিং ট্রিক এবং এইভাবে সাহিত্যের চর্চা নয়, সাহিত্যের উৎপাদন শুরু হয়েছে। ঠিক যেমন করে টুথপেস্ট তৈরি হয়, যেমন করে মোবাইল ফোন অ্যাড লেখা হয়— তেমনি করে লেখা হয় আজকের সাহিত্য।
এই বাজার-কেন্দ্রিক সাহিত্যবোধ, এই কর্পোরেট-সমর্থিত ভাষার সৌন্দর্যবোধ, আসলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ক্যান্সার। যেখানে নোংরা, খটখটে, কাঁটা দেওয়া শব্দের কোনো জায়গা নেই; যেখানে অনির্বচনীয় বেদনার কোনও ঠাঁই নেই। সেখানে কেবল বাকি থাকে ‘পাঠযোগ্যতা’, ‘মার্কেট রিচ’, আর ‘রিভিউ’। এইসব শব্দ— সাহিত্যকে টুকরো করে বিক্রি করে দেয়, বারকোড-আঁকা শবদেহে পরিণত করে। আর পুঁজিবাদ এই শবদেহকেই মোহময় করে তোলে— ফিচার করে পত্রিকায়, লাইভ করে ফেসবুকে, উৎসবে সম্মানিত করে। সাহিত্যের এই সমর্পণ— আত্মাকে বিলিয়ে দিয়ে কেবলমাত্র শরীর প্রদর্শনের মতোই। এই শরীর— ভাষার নয়, ব্র্যান্ডের। এই শিরদাঁড়া— কবিতার নয়, কর্পোরেটের এবং এইসব কর্পোরেট-শরীরে আত্মা নেই, কেবল টার্গেট মার্কেট আছে। সেখানেই হারিয়ে গেছে সেই ‘স্বর’— যা একদিন আগুনের মতো ছিল। আজ সেই স্বর নিষ্ক্রিয়, নীরব, নিঃসাড়— সে কেবল হাঁটে, হাসে, ছবি তোলে। কবিতা এখন ক্যাপশন, গল্প এখন স্ক্রিপ্ট, এবং সাহিত্য আজ মিটিংয়ের এজেন্ডা।
পুঁজিবাদের এই সাংস্কৃতিক ছাঁকনি—কোনো সরল কৌশল নয়, এটি এক দানবীয় পরিকাঠামো। যা লেখককে ব্র্যান্ড বানায়, সাহিত্যকে পণ্য বানায়, পাঠককে গ্রাহক বানায়। এটি ভাষাকে ক্রমাগত সাজিয়ে তোলে, ‘নির্বিষ’ করে তোলে—যেন কোনও প্রতিবাদ না ওঠে, যেন কোনো স্পার্ক না থাকে, যেন কেউ না কাঁদে, কেউ না জ্বলে। এই ভাষা—কর্পোরেট সভ্যতার শোভন মুখ। কিন্তু এই মুখ যে মুখোশ, তা বোঝা যায় না—কারণ সমস্ত মুখই আজ মুখোশ।
লিটলম্যাগাজিন, এই দানবীয় মুখোশে থুথু ছুঁড়ে দেয়। পুঁজিবাদ যেখানে ভাষাকে ‘অলংকার’ বানায়, লিটলম্যাগাজিন সেখানে ভাষাকে বানায় ‘অস্ত্র’। এটাই আজকের সবচেয়ে বিপজ্জনক বোধ—যে সাহিত্য বিক্রয়যোগ্য হওয়া চাই। যেন সাহিত্য কোনও সুগন্ধি, কোনও কসমেটিকস, কোনও লাইফস্টাইল প্রোডাক্ট। এর নাম 'সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ডিং', যেখানে ভাষা আর চিন্তা কোনওমতেই আদিম, কাঁচা, অস্বস্তিকর হতে পারবে না। সবকিছু সাজানো-গোছানো চাই—যেন জীবন নয়, লাইফস্টাইল। আর এই চাহিদা অনুযায়ী সাহিত্য তৈরি করাই হয়েছে পেশা।
এই পেশাদারি সাহিত্যবোধের ভেতর কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো না-বলা শব্দ নেই, কোনো মেটাফিজিকাল ছটফটানি নেই। আছে শুধু নির্ভরযোগ্যতা, নিয়মিততা এবং বাজারবান্ধবতা। কবিতা এখন প্রোডাক্ট ব্রিফ অনুযায়ী চলে, গল্প এখন মনিটাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী গঠিত হয় এবং এইখানেই হারিয়ে যায় সেই ভাষা—যার শরীরে আগুন ছিল, রক্ত ছিল, অভিশাপ ছিল।
সাহিত্য যে শিল্প, তা নয়—সাহিত্য আজ কর্পোরেট মিডিয়ার একটি কনটেন্ট সাবসেকশন। সেখানে সংবেদনশীলতা মানে নির্দিষ্ট ইভেন্টে পোস্ট দেওয়া, প্রতিবাদ মানে লাইক পাওয়া যায় এমন স্লোগান এবং ভাষা মানে ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের মূল শরীরটিই নিঃশেষ—কেবল রয়ে গেছে ছায়া, বিজ্ঞাপন, আর ব্র্যান্ড কালার। সাহিত্যের এই কর্পোরেটীকরণ প্রতিদিন যে ভাষাগুলোকে নিঃশেষ করছে, সেইসব ভাষার দিকে ফিরেই তাকাতে হবে। ফিরতে হবে সেই শব্দের কাছে, যেগুলোর মধ্যে দুর্গন্ধ আছে, রক্ত আছে এবং যন্ত্রণার শব্দ আছে। সেই ভাষা, যা বাজার চায় না—কারণ সে বাজারের বিরুদ্ধে। সেই ভাষা, যা পাঠক চায় না—কারণ সে পাঠককে পরিবর্তন করে দিতে চায়। সেই ভাষা, যা ব্র্যান্ড চায় না—কারণ সে ব্র্যান্ডকে পুড়িয়ে ফেলতে চায়।
লিটলম্যাগাজিন সেই ভাষাকেই খোঁজে, সেই শব্দকেই খুঁড়ে তোলে। সেই কবিতাকেই প্রকাশ করে, যা কেউ পড়তে চায় না। সেই গল্পকেই সামনে আনে, যা কোনো পুরস্কার পাবে না, কোনো আলোচনায় জায়গা পাবে না, কোনো কর্পোরেট স্পনসর নেবে না। কিন্তু সেই গল্পেই থাকে সময়ের ধ্বনি, সেই কবিতাতেই থাকে ভবিষ্যতের চিৎকার। এবং এই চিৎকারই আজকের সাহিত্যের শেষ আশা।
এই সময়, এই পরিসর, এই বাজার — সবকিছুই চাইছে সাহিত্য হোক নিরীহ, মার্জিত, চুমো খাওয়ার মতো নরম। কিন্তু সত্য সাহিত্যের স্বর—এখনও কাঁপে মাটির নাভিমূলে, যেখানে কোনো ব্র্যান্ড পৌঁছায় না, যেখানে কোনো ইনফ্লুয়েন্সার ঢুকে না, যেখানে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। সেই স্বরকে খুঁজে পেতেই লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্ব। সে নিজে অদৃশ্য হয়ে যায়—যাতে ভাষা দৃশ্যমান হয়। সে নিজের নাম ভুলে যায়—যাতে শব্দ নিজেকে মনে রাখে এবং এই নির্জন, অদৃশ্য, ব্র্যান্ডবর্জিত ভাষাই একমাত্র সত্য সাহিত্য। বাকিটুকু—কেবল বিক্রয়যোগ্য শব্দচালান।
৬.
এই লেখার শুরুতেই আমাদের মেনে নিতে হবে যে লিটলম্যাগাজিন কোনো ঐতিহাসিক কাগজপত্র নয়, কোনো অভিজাত সংকলন নয়, এমনকি কোনো সাহিত্যিক দস্তাবেজও নয়। লিটলম্যাগাজিন এক ধরনের বোধ—এক ধরনের গোপন, শারীরিক, অন্তঃস্রাবীয় প্রতিক্রিয়া। যেমন কেউ চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেকে দেখে ফেলল গর্তে পড়ে গেছে—এই পড়া একধরনের শারীরিক আত্ম-দর্শন, তেমনই লিটলম্যাগাজিন ছিল আত্মার মধ্যে পড়ে থাকা এক গর্ত—যার গভীরতা মাপে না কেউ, শুধু একেকজন কবি, একেকজন শিল্পী, একেকজন বিপ্লবী কখনও সেখানে পড়ে গিয়ে নিজের ভেতরকার চিৎকারকে শুনে ফেলেছে। সে চিৎকার কোনোদিন প্রকাশ্য রাজনীতির মিছিল হয়নি, কোনোদিন মঞ্চের লালসালোয়ার পরা নাট্যকর্মী হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সেই চিৎকারই ‘ছেঁড়াফাটা পোস্টার’ হয়ে শহরের দেয়ালে লেগে থেকেছে, ‘কাঁচা কালি’ হয়ে প্রুফ ভুল করে ছাপা হয়ে গেছে আর সেই ভুলটাই পরিণত হয়েছে সত্যে, আর মাত্র কয়েকজন লাজুক পাঠক—যাদের সাহস নেই বক্তৃতা দেবার, যাদের নাম নেই বরেণ্য পত্রিকার সম্পাদকের তালিকায়—তারা সেই ভুলের মাঝেই দেখে ফেলেছে ভবিষ্যৎ বিপ্লবের সংকেত।
লিটলম্যাগাজিন ছিল সেই জায়গা, যেখানে ভাষা নিয়ম মানেনি। যেমন করে সমাজ মানে না এক ব্যভিচারিণী প্রেমিকা, যেমন করে রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না পাগলের সত্যি বলা, তেমনি করে মূলধারার সাহিত্যের অবচেতনে লিটলম্যাগাজিন এক নিরবিচার হিংস্রতা হয়ে বেঁচে ছিল। ভাষা এখানে ছিল খোঁড়া, অকেজো, অক্ষত—যেন যুদ্ধশেষে বেঁচে-ফেরা একমাত্র সৈনিক, যে জানে ‘বিজয়’ শব্দটা কতটা লজ্জার, কতটা পরাজয়ের সঙ্গে মিশে থাকা বিষাক্ত রসায়ন। সে ভাষা কখনোই ‘বিশুদ্ধ’ ছিল না। সেখানে জড়ানো থাকত বস্তির গন্ধ, কোনো আড়ালে ফেলে দেওয়া ভ্রূণ-আবর্জনার হাহাকার, বা কোনো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসপ্রসূত গলি-মাথা ঘুরে আসা শব্দের কাঁপুনি। এই ভাষার ছিল নিজস্ব গতি—কখনও স্প্যাস্টিক, কখনও খ্যাপা, কখনও বা এত নিঃশব্দ যে, তাকে বোঝার জন্য পাঠকের আত্মাকে নিজের বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে হতো।
লিটলম্যাগাজিনের রাজনৈতিকতা ছিল নিঃশব্দ, ছিল ‘চিৎকার’ অথচ শব্দহীন। এমনই এক বিস্ফোরণ যা হাইড্রোজেন বোমার মতো গর্জে উঠে চারপাশে ধ্বংস সৃষ্টি করে না—বরং এমন এক নিউক্লিয়ার নিঃশব্দতা যা পাঠকের ভেতর ঢুকে পড়ে আত্মঘাতী করে তোলে তার দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, তার কষ্টার্জিত আদর্শ, তার প্রতিষ্ঠার পাথর গড়া আত্মপরিচয়। এই আত্মঘাতই লিটলম্যাগাজিনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা ক্রোধ। এটা কোনো বিশ্লেষণধর্মী তত্ত্ব নয়, কোনো ‘বামপন্থী’ বা ‘ডানপন্থী’ তকমা নয়—এটা এক ধরনের সত্তাগত ফাটল।
ছেঁড়াফাটা পোস্টার—একে আলোকিত ভাষায় অভিহিত করলে বলতে হয়, এগুলো ছিল শহরের দেয়ালে ঝুলে থাকা আত্মঘাতী ম্যানিফেস্টো। যে পোস্টারে কোনো নাম নেই, কোনো সম্পাদকীয় পরিচিতি নেই, শুধু কোনো এক কবির বা শিল্পীর আতঙ্কিত মুখের উচ্চারণ। এই পোস্টার মূলত লিটলম্যাগাজিনের দৃশ্যমান চিহ্ন নয়, তা তার অদৃশ্য ছায়াপাত। ছেঁড়া হয়ে থাকাটাই ছিল এর সৌন্দর্য। যেন ফ্যাশনের বাইরে থাকা কোনো পাগলের জামা, যাকে দেখে সমাজ লজ্জা পায়, অথচ তার ঠোঁটের কোণে জমে থাকা রক্ত দেখে বোঝা যায়—এই পাগলই একমাত্র সত্যিকারের অভিজ্ঞতাধারী।
কাঁচা কালি—এই শব্দটি যেন লিটলম্যাগাজিনের ভাষার ভিত। এতে শুদ্ধি নেই, প্রুফরিডার নেই, বাচ্যতা নেই, কেবলমাত্র একটা ‘তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস’ আছে। এই তাৎক্ষণিকতাই আবার হয়ে ওঠে অনন্তের বদলি। সময়ের হাত ধরে এগিয়ে না গিয়ে সময়কে ডিঙিয়ে ফেলা—এই হল কাঁচা কালি দিয়ে লেখা শব্দের রাজনৈতিক চেতনা। এখানে কবিতার চেয়ে ছাপা ভুলটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভুলটা ইচ্ছাকৃত নয়—এটা একধরনের অজানা ক্ষত, যার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে বিপ্লবের ব্যাকটেরিয়া।
আর পাঠক? গুটিকয় লাজুক পাঠক—তারা কী? তারা কোনো সমাবেশ নয়, কোনো অ্যাকাডেমির প্রতিনিধি নয়, তারা সেইসব মানুষ যারা চুপ করে কোনো দিন একা একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা পুরনো ম্যাগাজিন তুলে নেয় ফুটপাথ থেকে। পড়তে গিয়ে দেখে, এ তো ঠিক নিজের বুকের শব্দ! যে শব্দ সে কোনোদিন কারও কাছে বলেনি, যা তার গলার কাছে এসে আটকে ছিল বছরের পর বছর। এই পাঠকই ছিল লিটলম্যাগাজিনের ধ্বংসচেতনার অন্তঃসাক্ষী। সে চিৎকার করে না, সে লেখে না, সে শুধু পড়ে এবং নীরবে নিজের ভেতরকে কাঁপতে দেয়। এই কাঁপুনি কোনোদিন প্রকাশ্যে আসে না, তবুও সমাজের যাবতীয় শুদ্ধতার ভিত্তিকে ধরে ধরে ভেঙে দেয়।
এই লিটলম্যাগাজিনের যে বিস্ফোরণ, তা কোনো রাজপথে না, কোনো সাংস্কৃতিক সংলাপে না, আত্মার একেবারে গোপন কোনো অলিন্দে ঘটে। এই বিস্ফোরণের শব্দ নেই, আলো নেই, শুধু একধরনের গভীর নৈঃশব্দ্য। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্প যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে লিটলম্যাগাজিন ছিল আত্ম-ধ্বংস। এই আত্ম-ধ্বংসই আবার গড়ে তোলে নতুন সম্ভাবনা, নতুন ভাষা, নতুন পাঠক—যা কখনওই মেনে নিতে পারে না বাজার, প্রতিষ্ঠান, বা সামাজিক কাঠামো। লিটলম্যাগাজিন এইখানেই বিপজ্জনক, এইখানেই এক ধরনের—সত্তাগত সন্ত্রাস।
এইভাবে ছেঁড়াফাটা পোস্টার, কাঁচা কালি আর কয়েকজন নিঃশব্দ পাঠক মিলেই গড়ে তোলে লিটলম্যাগাজিন নামক সেই অদৃশ্য বিস্ফোরণ, যা আজও চলছে, আজও ঘুম ভাঙায় কিছু মানুষের, যারা এই যন্ত্র-সভ্যতার দম্ভ আর বাজারের পরিশীলিত ভাষা দেখে কাঁদতে চায়। এই লেখাটি যেন তার জন্যই—যারা এখনো মাঝরাতে অন্ধকারে হাঁটে আর দেয়ালে কোনো এক পুরনো পোস্টারের ছেঁড়া অংশ দেখে থেমে যায়। সেই পাঠকের ভেতরেই লিটলম্যাগাজিন নামক অন্তঃস্থলীয় চিৎকারটি আজও উচ্চারিত হয়। চুপচাপ, কিন্তু ধ্বংসাত্মক। যেখানে সাহিত্যের অ্যাক্টিভিজম রাষ্ট্রের পাতা খাতায় নিয়ন্ত্রিত আবেদন জমা দেয়, সেখানে লিটলম্যাগাজিন তার ব্যক্তিস্বরকে রেখে আসে রাস্তাঘাটের দেয়ালে, ঘুমহীন রাতের রক্তচাপমাপা আত্মকথায়, অথবা একটি ছেঁড়া খাতার পেছনের পাতায়। এটি কোনো সম্মিলিত ‘উন্নয়নের’ বার্তা বহন করে না, ব্যক্তিস্বাধীনতার, অবচেতন ধ্বংসচেতনার, এবং আত্মসংঘর্ষের একেকটি কাঁটা হয়ে ওঠে। অ্যাক্টিভিজম যেখানে প্ল্যাকার্ড, স্লোগান ও মিছিলের কাঠামোতে বন্দি, সেখানে লিটলম্যাগাজিন অনিয়ন্ত্রিত আত্মার হেঁয়ালিপূর্ণ বয়ান। অ্যাক্টিভিজম প্রায়শই জনসম্মতিতে ভরসা রাখে। সেখানে ‘আমরাই’ বলে এক কোলাজ-চেতনা জন্ম নেয়। কিন্তু লিটলম্যাগাজিন সেই ‘আমরা’ শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা স্বরবর্ণহীন ‘আমি’-কে খুঁজে ফেরে। ব্যক্তিস্বর এখানে একটি বর্জন, একটি নাকচ, একটি স্পষ্ট করে না বলা। এই না বলার মধ্যেই লিটলম্যাগ এক প্রকার ‘অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’ বা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’র আত্মপ্রকাশ ঘটায়।
লিটলম্যাগাজিন কখনো জনতার হর্ষধ্বনির অংশ নয়, কণ্ঠনালীর গভীর খাদ থেকে বেরিয়ে আসা সেই গূঢ় শব্দ, যা কোনো দিবসের পোস্টারে স্থান পায় না। এ কণ্ঠে জাতি, দল, মত নেই—আছে আত্মার অনুবীক্ষণ। লিটলম্যাগাজিন লেখে সেইসব বিষয়ে, যা নিয়ে কথাও বলা নিষেধ। যখন অ্যাক্টিভিজম কোনো আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠতে চায়, লিটলম্যাগ সেখানে অস্তিত্বের আন্দোলনের একাকী সারথি। লিটলম্যাগাজিন বিশ্বাস করে, ভাষা নিজেই একটি বিপ্লব। ভাষার দেহে যে বিষ মিশে আছে, যে অস্থিমজ্জাগত অভিশাপ—তা থেকেই জন্ম নেয় ব্যক্তিস্বর। এই স্বর নিজেরই বিরুদ্ধে, নিজের নির্ভারতা, নিজেকে লেখা, নিজেকে না লেখা—সবকিছুর বিরুদ্ধে। একটি নিঃশব্দ কবিতা, একটি ভেঙে-পড়া বাক্য, একটি অসমাপ্ত বাক্যবন্ধ—সবকিছুই এখানে বিস্ফোরণ। অ্যাক্টিভিজম যেখানে পোস্টারে স্পষ্ট বাক্য লিখে দেয়, লিটলম্যাগাজিন সেখানে রেখাপাত করে এক অস্পষ্ট, প্রলয়ঘন ছায়া।
এখানে লেখালেখি কোনো রণাঙ্গন নয়, কোনো পুরস্কারের প্রতিযোগিতা নয়, কোনো মনোনয়নের আশ্রয় নয়। এটি আত্মার নিকষ বালুকণা থেকে খুঁড়ে তোলা ধ্বনি—যা কোনো রাজনৈতিক রণকৌশলে বন্দি হয় না। লিটলম্যাগাজিন লেখে না পাঠকের জন্য, লেখে নিজেকেই তছনছ করতে। তার লেখার উদ্দেশ্য কখনো ‘অ্যাক্টিভিজম’ নয়, বরং এক অন্তর্জাগতিক শুদ্ধিবিপ্লব। লিটলম্যাগাজিনের ব্যক্তিস্বর সেই স্বর, যা রাষ্ট্র-সম্মত ইতিহাসের পাতায় জায়গা পায় না, কিন্তু ব্যক্তিগত ক্ষতের মতো থেকে যায়—সংক্রামক, বেদনাবহ, কিন্তু জীবন্ত। অ্যাক্টিভিজম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাঠামোতে কথা বলে, লিটলম্যাগাজিন সেখানে কোনো কাঠামোর ভাষা জানে না—সে নিজেই ভাষার কাঠামো হয়ে ওঠে। অ্যাক্টিভিজম চাই সাড়া, প্রতিক্রিয়া, জনসমর্থন। লিটলম্যাগাজিন চায় মৌনতা, একা হাঁটা, জটিল বাক্য। সে চায় এক কাব্যিক নিঃশ্বাস, যা রাষ্ট্রও টের পায় না, অথচ তার ভিত নাড়িয়ে দেয়। ব্যক্তিস্বর তাই এখানে আত্মপ্রকাশের অস্ত্র নয়, আত্মবিসর্জনের প্রস্তুতি এবং সেই কারণেই লিটলম্যাগাজিন, শেষ পর্যন্ত, হয়ে ওঠে এক ‘অ্যাক্ট অব সাইলেন্ট সাবভার্সন’।
এই পার্থক্য, এই দ্বন্দ্বই লিটলম্যাগাজিনকে দেয় তার চূড়ান্ত শৈল্পিক মর্যাদা, তার আত্মিক বিপ্লবের ভিত্তি। সে প্রশ্ন তোলে, ভাষা দিয়ে কী বদলায়—উত্তর দেয় না। সে ভাষাকে এমনভাবে ভেঙে তোলে, যে পাঠক নিজেই নিজের রাজনীতিকে দেখে আয়নার ভেতর, সন্দেহে, নৈরাশ্যে, সৌন্দর্যে, এবং অসমাপ্ত রক্তাক্ত বাক্যগুলোর ভেতর দিয়ে। সাহিত্যের অ্যাক্টিভিজম রাষ্ট্রের অনুমোদন চায়। লিটলম্যাগাজিন সে অনুমোদনের মুখে থুতু ছুঁড়ে দেয়।
৭.
লিটলম্যাগাজিন, সেই শব্দগুলোই যেন এক দীর্ঘশ্বাসের নিঃসরণ। যা মূলধারার সাহিত্যের আলোছায়ার বাইরে, শব্দের প্রথাগত বাঁধন ছাড়িয়ে, এক গভীর ব্যক্তিগত অন্ধকারের দলিল। দলিল, যেখানে কোনও কর্তৃত্ব নেই, কোনও সমঝোতা নেই, শুধু রয়েছে আত্মার একান্ত, নিঃস্ব ভাষা—সে ভাষা যা অনেক সময় নিজেই এক ধরনের বিদ্রোহী শব্দের সংগ্রহ, বিপ্লবী শব্দের সমাবেশ।
এই ‘অন্ধকার’ একাকীত্বের অন্ধকার নয়, সেই অন্ধকার যেখানে আত্মা নিজেকে খুঁজে পায়; যেখানে নীরবতার মধ্য দিয়ে আত্মচৈতন্যের সূচনা হয়। এটি নিঃসঙ্গতার বিপ্লবের দলিল; একরাশ ক্ষোভের সঙ্কলন, একরাশ আশা ও হতাশার গাঁথুনি, যা আলোকে অস্বীকার করে তার নিজের পথ তৈরি করে। লিটল ম্যাগাজিনের জন্মই ছিল সেই বিদ্রোহী ভাষার জন্ম, যা প্রধান ধারার সাহিত্য বা বুদ্ধিজীবী বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সেখানে থাকে শুধুমাত্র সত্যের খোঁজ, ব্যক্তিগত সত্তার সন্ধান। এই খোঁজ কখনো হয় বিদ্রোহাত্মক, কখনো হয় নির্জন আর কখনো হয় অন্তর্দাহের মতো। এখানে ভাষা হয় অস্ত্র, প্রতিরোধ এবং কখনো আত্মঘাতী এক বোমা।
লেখকের ব্যক্তিগত অন্ধকারের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ ঘটে লিটলম্যাগাজিনের পাতায়। এখানকার ভাষা নয় সামাজিক মঞ্চের আলোচিত শব্দ, নয় কোনো ভাবের বৃহৎ জনসাধারণের জন্য রচিত বাক্য, এটি একটি অন্তর্দৃষ্টি, একটি আভ্যন্তরীণ আর্তনাদ। এই ভাষা হয়তো ধ্বংসাত্মক, হয়তো কখনো খুবই নিঃসঙ্গ, কিন্তু এর মধ্যে নিহিত থাকে নিজের অস্তিত্বের দাবি। লিটল ম্যাগাজিনের ভাষা লড়াই করে মূলধারার ভাষার নিয়ম, রীতিনীতি এবং স্বীকৃত শব্দার্থের বিরুদ্ধে। এই ভাষা একধরনের অপরাধী, যিনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্রোহ চালিয়ে যায়। এখানে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি ও রাজনৈতিক বিদ্রোহের সীমানা অদৃশ্য হয়ে যায় এবং বোধের গভীরতা ভাষাকে বিশুদ্ধ অস্ত্র হিসেবে পরিণত করে।
এই ভাষার গভীরে আত্মার সেই দার্শনিক দুঃখ লুকিয়ে থাকে, যা নীরবতার সুরে কথা বলে, একাকীত্বের বাতাসে বাজে। যেখানে আত্মা স্বগতসিদ্ধির জন্য যুদ্ধ করে, নিজের অস্তিত্বকে ফের খুঁজে পায়। লিটলম্যাগাজিনের লেখক হয় একাকী বিদ্রোহী, একাকী সৈনিক, যিনি লিখে যাচ্ছেন নিঃসঙ্গতার বিপ্লবের দিনলিপি। লিটলম্যাগাজিনের ভাষা তৈরি হয় ক্ষতখণ্ড থেকে, হারানোর যন্ত্রণায়, ভাঙনের অভিজ্ঞতায়। এটি এমন একটি ভাষা যা বিরোধের মধ্য দিয়েই জন্মায়—বিরোধ প্রধান ধারা, বুর্জোয়া সংস্কৃতি, সরকারি আধিপত্য এবং প্রতিষ্ঠিত ভাষার বিরুদ্ধে। এই ভাষা হয় ফাটল, যেখান থেকে বেরিয়ে আসে নতুন অর্থের ঝর্ণাধারা।
লেখকের ব্যক্তিগত দুঃখ, তার একাকীত্ব, তার বিপ্লবী বোধ একত্রে গড়ে তোলে এমন ভাষা যা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সম্পূর্ণ অচেনা ধ্বনিতে। এই ধ্বনি বা ভাষা হয় ধ্বংসাত্মক, কিন্তু সেই ধ্বংসের মধ্য দিয়েই তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনার বিকাশ। লিটলম্যাগাজিনের ভাষা কখনো নির্মাণ নয়, ধ্বংসের মাধ্যমে নির্মাণের ভাষা। এটি ভাষার আত্মঘাতী রূপ, যাকে বলতেই হবে নিজের অস্তিত্বের শেষ জোরালো প্রতিবাদ। লিটলম্যাগাজিনের ভাষা কখনো নয় বৃহৎ জনতার সম্মোহন, না কোনো ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক, একটি ব্যক্তিগত বিপ্লবের ভাষা। একটি ভাষা যা হয় নিঃসঙ্গ, হয় একাকী, হয় প্রহারাত্মক। এটি সে ভাষা যা নিজের অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ করে, নিজের আত্বচেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ভাষার মধ্যে থেকে জন্ম নেয় একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সারগ্রাহী বোধ, যা কখনো আক্ষেপে ভরে ওঠে, কখনো বিস্মৃতির গভীরে নিমগ্ন হয়, আবার কখনো ক্ষিপ্ত ক্রোধের ধ্বনি বের করে। এই ভাষা লেখকের ব্যক্তিগত যন্ত্রণার দলিল, পাঠকের নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি।
লিটলম্যাগাজিনের ভাষা কখনো সামাজিক আদর্শের প্রতিনিধি নয়, সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, হারানো আত্মাদের কণ্ঠ। এই কণ্ঠ হয় আক্রমণাত্মক, কখনো স্বপক্ষ থেকে নির্ভিক, কখনো ভাঙনের মধ্য দিয়ে একরাশ আশা তৈরি করে। এটি ভাষার এক নৃতাত্ত্বিক খোঁজ, যেখানে প্রত্যেক শব্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকে লেখকের এবং পাঠকের অস্তিত্বের অবসান এবং পুনর্জন্মের দ্বন্দ্ব। যখন ভাষা হয়ে ওঠে নিঃশব্দ বিক্ষোভ, তখনই জন্ম নেয় লিটল ম্যাগাজিনের সেই অন্তরাত্মার ভাষা। মূলধারার সাহিত্যের অলংকার ও বিন্যাসের মধ্যে গৃহীত নিয়মগুলোকে অগ্রাহ্য করে, এখানে জন্ম নেয় একাকী ব্যক্তির ব্যক্তিগত আকাশছোঁয়া আর্তনাদ। ভাষার এমন অবয়ব, যা বোধের গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসে, যেখানে প্রতিটি শব্দ যেন অস্ত্র, প্রতিটি বাক্য যেন বিদ্রোহের মর্মর।
লিটলম্যাগাজিনের ভাষা কখনো কখনো নিভৃত নৈরাশ্যের ভাষা, যেখানে লেখকের আত্মার একান্ত যন্ত্রণা প্রকাশ পায়, কিন্তু সেই নৈরাশ্যের মাঝেও লুকিয়ে থাকে এক অদম্য স্পৃহা—নিজেকে প্রকাশের, নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার এক অবাধ্য ইচ্ছা। এই ভাষা সমাজের বহুবিধ দমন, কর্তৃত্ব, শোষণ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে এক অশ্রুত মিছিলের শিখর। লিটলম্যাগাজিন শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, এটি একটি ব্যাক্তিগত অন্ধকারের দলিল। লেখক এখানে নিজের ভেতরের অন্ধকার, নিজের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা, তার নিঃসঙ্গতা ও বিদ্রোহের রেকর্ড রাখে। প্রতিটি লেখা হয় এক ধরনের আত্মসমীক্ষা, আত্মার সঙ্গে একরাশ দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ভাষা কখনো হিংস্র, কখনো বিনয়ী, কখনো তীক্ষ্ম এবং কখনো গভীর দুঃখের আভা নিয়ে আসে। এক একটা শব্দ এক একটা জীবন্ত ক্ষত—ক্ষত যা মুক্তির দাবিতে ছিঁড়ে পড়ছে স্বয়ং লেখকের মনের আড়ালে। এই ক্ষতগুলো হয়তো পাঠকের জন্য অবরুদ্ধ, হয়তো কেউ এগুলোকে বোঝেন না, কিন্তু সেই ভাষার নৈরাশ্য ও বিদ্রোহের তেজ কোনওদিন নিভে যায় না। লেখকের এই নিঃসঙ্গ যাত্রা, একাকীত্বের বিপ্লব, তার নিজের আত্মচৈতন্যের সংগ্রাম; লিটলম্যাগাজিন এই নির্জন যাত্রার প্রামাণ্য দলিল। এটি কেবল সাহিত্য নয়, এক ব্যক্তির আত্মার মুক্তির ইতিহাস।
লিটল ম্যাগাজিনের ভাষা ছিল কখনোই স্বাভাবিক বা শান্তিপূর্ণ নয়। এটি জন্ম নিয়েছে বঞ্চনা, অবজ্ঞা ও আড়ালের ঘরে। এই ভাষার প্রতিটি শব্দে লুকানো থাকে সেই শিহরণ, যা সামাজিক স্তর থেকে বঞ্চিত মানুষের ক্রন্দন। এখানে লেখা হয় না রাজনীতি বা বাণিজ্যের জন্য, নয় কোনো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যসংগঠনের সম্মানের আশায় বরং একান্ত নিজের মুক্তির জন্য, নিজের অস্তিত্বের জন্য।
এই ভাষা কখনো সমাজের কড়া নিয়ম ভাঙে, কখনো নিজেকে ফাটিয়ে ছাড়ে। এটি এক আত্মঘাতী ভাষা, যেখানে লেখা হয় ক্ষত, লজ্জা, ক্ষোভ আর একরাশ বেদনার কথা। এই ভাষার শক্তি হল তার অস্থিরতা—অস্থিরতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক নতুন দিগন্তের সূচনা। লিটলম্যাগাজিনের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানে লেখকের ব্যক্তিগত অবস্থা প্রকাশ পায় নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে। নিঃসঙ্গতা শুধু ব্যক্তিগত একাকীত্ব নয়, এটি এক প্রকার রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান। এখানে একাকীত্ব বিপ্লবের জোরদার মাধ্যম, আত্মার নিজস্ব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার পথ। এই ভাষায় কখনো কাঁদে, কখনো চিৎকার করে, কখনো আত্মহত্যার মতো নিস্তব্ধ হয়, আবার কখনো বিষাদের মাঝে এক ঝলক আলো জ্বলে। সেই আলো কখনোই বাহ্যিক নয়, একেবারে অন্তর্মুখী। এই আলোয় আত্মা তার নিজস্ব অস্তিত্বকে টের পায়, তার ভাষা খুঁজে পায়।
লেখক এখানে কেবল নিজের কথা বলেন না, তিনি মূলধারার সমাজ, রাষ্ট্র, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক অন্ধকারের বিরুদ্ধে ভাষার মারণাস্ত্র তৈরি করেন। লিটলম্যাগাজিনের প্রতিটি সংখ্যা, প্রতিটি লেখা এমন এক অস্ত্র যা খুঁজে পায় তার লক্ষ্য এবং আঘাত করে প্রথাগত সাহিত্যের স্বকীয়তায়। লিটলম্যাগাজিনের ভাষা একরাশ রক্তাক্ত বেদনার দলিল, যা কখনো কখনো সুপ্ত, কখনো কখনো বিকট ধ্বনি। আত্মার নিঃশব্দ আর্তনাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সেই বিপ্লবী আত্মচৈতন্য, যা কখনো স্বীকার করে না পরাজয়। এই ভাষায় লেখক মিথ্যার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে, তিনি তার বাস্তবতাকে অক্ষত রাখেন, তাকে বিকৃত হতে দেন না। এই ভাষা, এই লিটল ম্যাগাজিন, লেখকের নিজের আত্মচৈতন্যের দিনলিপি; তার নিজের নিঃসঙ্গতা, তার নিজের বিপ্লবের দলিল। এক জ্বলন্ত ভাষা, যা কখনো শোষণের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিদ্রোহ, কখনো একান্ত ব্যক্তিগত বেদনার নিঃশব্দ দলিল।
লিটল ম্যাগাজিন একটি অন্তরাত্মার নিভৃত যাত্রাপথ, যেখানে লেখক তার অস্থির আত্মার গহীনতম কোণে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেখানে প্রতিটি শব্দ হলো তার নিজস্ব জীবনের ক্ষত, প্রতিটি বাক্য এক অস্পষ্ট ক্রন্দন। এখানে কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, অন্তর্মুখী বিপ্লবের ভাষা নির্মিত হয়—সেই ভাষা যা বিশাল সমাজের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে, নিঃসঙ্গতা এবং বিদ্রোহের একান্ত এক অনিন্দ্য মিশ্রণ। এই নিঃসঙ্গতা কোন সাধারণ বেদনা নয়; এটি একান্ত ব্যক্তি থেকে সমগ্র সমাজের দমন ও নিপীড়নের প্রতি এক মর্মর বিদ্রোহ। লিটলম্যাগাজিনের পাতাগুলোতে লুকিয়ে থাকে সেই বিদ্রোহী আত্মার ফুঁটা ফুঁটা রক্ত, যেটা কখনো প্রকাশ পায় মৃদু আক্ষেপে, কখনো কঠোর অভিমানে। নিঃসঙ্গতার এই বিপ্লব কবিতার মতোই মর্মস্পর্শী, একটি স্বর যার আওয়াজ সর্বদাই অস্পষ্ট, এক ধরণের গোপন সংকেত যা শুধুমাত্র নির্জন আত্মারা বুঝতে পারে।
লিটলম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ভাষার বহুমাত্রিকতা—এক সঙ্গে কাঁদতে পারে, চিৎকার করতে পারে, নিঃশব্দ থাকতে পারে এবং বিদ্রোহী হাসি ছড়াতে পারে। এটি একটি বহুধা ভাষা, যেখানে ব্যক্তিগত বেদনা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া একসঙ্গে সুর মিলিয়ে বাঁধা হয়। লেখকের অন্তরাত্মা এখানে একাধিক মঞ্চে বিভক্ত হয়; কখনো সে একাকী, কখনো সে সমাজের বিরোধী, কখনো সে অস্তিত্ববাদী, আবার কখনো নৈরাজ্যবাদী। এই বিভাজন থেকেই তৈরি হয় ভাষার এক অনবদ্য সুর, যা সহজাত বিদ্রোহ ও অমীমাংসিত দার্শনিক প্রশ্নের জটিলতার সঙ্গে লিপ্ত।
লিটলম্যাগাজিনের প্রতিটি সংখ্যা হলো এক আত্মবিশ্লেষণের দলিল। এখানে লেখা হয় এক নিবিড় আত্মসমীক্ষা, যেখানে লেখক নিজের মনের অন্ধকার, নিজের অন্তরজ্বালা, নিজের ভুল-ত্রুটি আর তার থেকে জন্ম নেওয়া নতুন আত্মবিশ্বাসের কথা জানায়। এই দলিলের পাতায় লুকিয়ে থাকে এক আত্মার জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাস, তার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা এবং পুনর্জন্মের সূচনা। এই দলিলের ভাষা কখনো সরল, কখনো জটিল, কখনো কবিতার মতো লয়বদ্ধ এবং কখনো তীক্ষ্ম আক্রমণাত্মক। এই ভাষার গভীরে কাজ করে এক প্রকার নীরব, কিন্তু জোরালো, আত্মবিশ্বাসী বিদ্রোহ। লিটল ম্যাগাজিনের ভাষা কখনো কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ নয়; এটি এক অস্ত্রোপচার, যা লেখকের নিজস্ব ক্ষত থেকে সমাজের বৃহত্তর অসত্য, শোষণ ও অধিকারহীনতার দহনস্থলে প্রবেশ করে। এই ভাষা কাটাকুটি করে প্রথাগত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক নিয়মকে, সে নিয়ম যা বাজারের স্বার্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা বলে, কিন্তু কখনো সত্যিকারের বিপ্লবী চেতনার কথা বলে না।
এই ভাষা তীব্র, কখনো নির্মম, কখনো কোমল এবং বেদনার সঙ্গে জুড়ে থাকে। তার মাধ্যমেই লিটল ম্যাগাজিন তার বিদ্রোহী আত্মাকে প্রকাশ করে, যা রাষ্ট্র, বাজার ও পুরাতন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চাপের বিরুদ্ধে এক অনন্য যুদ্ধে নামিয়ে দেয়। লিটল ম্যাগাজিনের নিঃসঙ্গতা কেবল ব্যক্তিগত বেদনা নয়, সে বেদনা থেকে জন্ম নেয় রাজনৈতিক এক বিপ্লবী শক্তি। একজন লেখকের একান্ত নিঃসঙ্গতা যখন ভাষায় রূপান্তরিত হয়, তখন সেটি শুধু তার নিজের জন্য নয়, সমাজের নিপীড়িত অন্য মানুষের জন্যও প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়। এই নিঃসঙ্গতা ও ব্যক্তিগত বেদনার মধ্য দিয়ে লিটল ম্যাগাজিন তৈরি করে এক নতুন রাজনীতির ভাষা—এক ভাষা যা মূলধারার রাজনীতির জাঁতাকলে আটকে থাকে না, তা নতুন এক পথিকৃতার মতো বেদনার, বিদ্রোহের আর অবজ্ঞার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যায়।
লিটলম্যাগাজিনের ভাষা নিছক লেখকের একক প্রতিবাদ নয়; এটি পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গেও সংলাপ স্থাপন করে। এখানে পাঠক নিজেকে খুঁজে পায়, তার নিজস্ব নিঃসঙ্গতা ও বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি। এই সংলাপ এক ধরণের অন্তর্মুখী বিপ্লব, যা লেখক ও পাঠককে একসঙ্গে বেঁধে দেয় এক বিদ্রোহী ভাষার জালিতে, যেখানে একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে সমাজ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক বৃহৎ প্রতিবাদ। লিটল ম্যাগাজিনের ভাষা নির্জনতার এক ধরনের গর্ব বহন করে। এটি সেই গর্ব, যা কোনো বাহ্যিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তায় বাঁধা নয়; এটি স্বাধীন, মুক্ত এবং নির্ভীক।
এই ভাষায় আত্মা খুঁজে পায় এক শূন্যস্থান, যেখানে সে নির্ধারিত নিয়ম ও প্রত্যাশার বাইরে যেতে পারে। এখানে আত্মার একমাত্র বিচারক সে নিজেই; অন্য কারও বিচার নেই, অন্য কারও বাধন নেই। এই নির্জনতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক নবজন্ম, এক অক্ষয় আত্মচৈতন্যের বিকাশ। লিটলম্যাগাজিন হল একান্ত ধ্যানমগ্ন অন্ধকারের খতিয়ান, যেখানে লেখকের আত্মা নিজের ভাষা খুঁজে পায়, নিজের নিঃসঙ্গতাকে বিপ্লবের রূপ দেয় এবং তার বিদ্রোহী অস্তিত্বকে এক অনন্য আত্মচৈতন্যের সুরে বাঁধে। এই খতিয়ান কেবল এক ব্যক্তির নয়, সমাজের সমস্ত নিপীড়িত আত্মার এক বিরল সংগৃহীত প্রতীক। লিটলম্যাগাজিনের ভাষা স্বপ্ন নয়, তা বাস্তবের ক্ষতচিহ্ন, তা ইতিহাস নয়, তা জীবনের দাগ। যেখানে প্রতিটি শব্দ বিদ্রোহী, প্রতিটি বাক্য বেদনার আহ্বান, আর প্রতিটি সংখ্যা এক নতুন সূচনা।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন