প্রাকযাত্রা
মঞ্চ অন্ধকার। কোরাস দল গানের নৃত্য করতে করতে মঞ্চে প্রবেশ করবে। কোরাস শেষে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত আঁধারে একটি কবরের মাটি ভিজতে থাকে। এক পর্যায়ে কবরের মাটি সরতে থাকে। মাটি সরতে সরতে একটি মানুষের লাশ বেরিয়ে আসে। গায়ে গুলির চিহ্ন। উদোম শরীর। বৃষ্টিতে মৃতদেহটি একসময় জেগে ওঠে। উঠে দাঁড়ায়। তার নাম সিরাজ সিকদার।
পর্ব ১: পুনর্জন্ম
(মঞ্চ অন্ধকার। দূর থেকে বৃষ্টির শব্দ, যেন গাছের পাতায় পড়ে। একটি রেডিও ভাঙা ভাঙা সুরে সংবাদ পাঠ করছে: ‘...সাবেক সমাজতান্ত্রিক নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যা মামলার বিচার স্থগিত...’ তারপর হঠাৎ থেমে যায়। অন্ধকারে ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠে মাঝমঞ্চে। একটি পুরনো কাঠের চেয়ার, ধূলিমলিন টেবিল, ট্রাংক, একটি ছেঁড়া লাল ব্যান্ড... চেয়ারে হঠাৎ বসে আছেন একজন বৃদ্ধ।)
সিরাজ সিকদার:
এই কাঠ... এই ধুলো... এই ট্রাংকের গায়ে এখনো আমার হাতের আঁচড়! কিন্তু আমি কি মৃত ছিলাম? না... ঠিক মৃত নয়, হয়তো ঘুমিয়ে ছিলাম—বিপ্লবের এক দীর্ঘ ঘুম। আজ এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঁধে আবার জেগে উঠলাম—(ধীরে, ঘন নিঃশ্বাসে) আমি... আবার ফিরে এসেছি?
না! এটা স্বপ্ন নয়। না-ই হবে বোধ হয় মৃত্যুর। তবে আমি কি বেঁচে আছি? নাকি ইতিহাসের ভুল পৃষ্ঠায় চাপা পড়া কোনো কবিতা? (চোখে হাত বুলিয়ে তাকান চারপাশে) এই দেয়ালগুলো আমার চেনা নয়। এই বাতাসে রক্ত নেই, কিন্তু গন্ধ আছে— ঘামের গন্ধ নয়, বাজারে বিক্রি হওয়া বাম রাজনীতির গন্ধ।
(হঠাৎ দাঁড়িয়ে যান, কাঁপা হাতে বুক চেপে ধরেন) আমি মরেছিলাম, এ কথা ঠিক। পহেলা জানুয়ারি, ১৯৭৫—গ্রেফতার, ২ জানুয়ারি, গভীর রাত—চারিদিকে শুনসান নিরবতা। একটি উদ্ধত রাইফেল আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আর তারপর একটি ট্রিগার টিপে খতম করে দেয়া হলো আমাকে। এ কথা আমার জানা, তবু আজ—এই দেশে, এই ভূমিতে, এই জন উপতক্যায় আমি ফিরে এসেছি!
কেন?
(একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস) কারণ, কেউ একজন আমাকে ভুলে যেতে পারেনি। না, কোনো নেতা নয়— না কোনো কবি, রাজনীতিবিদ নয়— আমাকে মনে রেখেছে “বিরোধ”। হ্যাঁ, এই সময়ের দ্বন্দ্ব— এই সময়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্ক, এই সমাজতন্ত্রের বেঁচে থাকার শেষ আর্তনাদ— সেই চিৎকার আমাকে ফিরিয়ে এনেছে! (দর্শকের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে) তোমরা জানো না, একটি আদর্শ কখনো শেষ হয়ে যায় না। ওটা গাছের বীজের মতো মাটির নিচে থেকে যায়, সময় হলে ফেটে বের হয়— নতুন জন্মে, নতুন শরীরে।
আমি সেই বীজ। এই মাটি—এই রাষ্ট্র—এই ভাঙা সমাজতন্ত্র— আমার নতুন জন্ম দিয়েছে। (একহাতে মাথা চেপে ধরে চেয়ারটিতে বসে) কিন্তু এই জন্ম অন্যরকম... আমার হাতে এখন নেই সেই কনিষ্ঠ বাম মুষ্টি— এই শরীর এখন অবসন্ন, এই পাঁজরের নিচে জ্বলে উঠছে দ্বিধার আগুন।
(আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ান, যেন নিজেকে চেনার চেষ্টা করছেন)
আমি সিরাজ সিকদার। যার থিসিস ছিল এই—‘পূর্ব বাংলা উপনিবেশ, শ্রেণি শত্রুদের শত্রু জেনো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ আমাদের শত্রু।’ আমি ছিলাম একথিসিসের সন্তান। গেরিলাদের নেতা, প্রলেতারিয়েতের স্বপ্নদ্রষ্টা। ‘বিপ্লব’ কখনো আলোচনার বস্তু নয়, ওটা ‘আগুন’! আমি সেই আগুনের সন্তান ছিলাম... আমি বিশ্বাস করতাম— গ্রামগুলো হবে আমাদের আর গেরিলারা হবে মাছ, জনগণ হবে জল।
আর আজ? আজ আমি এক বৃদ্ধ—যে বুঝে উঠতে পারছে না, ভোট আর বিপ্লব একজায়গায় কীভাবে দাঁড়ায়! (টেবিলের ওপরে রাখা একটি ছেঁড়া লাল ব্যান্ড নিয়ে বলেন) এই লাল, এখন আর রক্তে ভেজা নয়—এটা এখন পোস্টারে ছাপা এক নিঃস্ব রঙ।
(দর্শকদের দিকে চোখ মেলে কথা বলেন, যেন নিজেই নিজের পুনর্জন্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন)
আমার পুনর্জন্ম, এই সময়ের প্রয়োজন। কারণ, এই সময় হারিয়েছে তার কণ্ঠ। যেখানে বিপ্লব মানে রোমান্টিক গান, রাজনীতি মানে কর্পোরেট চুক্তি। আমি ফিরে এসেছি জানতে—তোমাদের ‘গণতন্ত্র’ কি আমার ‘শ্রেণি সংগ্রাম’কে হত্যা করেছে? তোমাদের সংসদ কি আমার বিপ্লবকে কবর দিয়েছে? যে গণতন্ত্রের নামে এই দেশ চলে, তা কি আমার বিপ্লবের বিকল্প?
(একটানা হাঁটেন মঞ্চজুড়ে, কণ্ঠে বিদ্রোহ, মুখে চরম হতাশা)
তোমরা আমাকে গুলি করে মেরেছিলে— তোমরা ভেবেছিলে আমি শেষ? কিন্তু আমি ফিরে এসেছি- না, প্রতিশোধ নিতে নয়, প্রশ্ন করতে!তোমাদের ভোটের বাক্সে কি কখনো শ্রমিকের স্বপ্ন ঢোকে? তোমাদের অর্থনীতির আলোচনায় কৃষকের হাড়ের ব্যথা জায়গা পায়?
(অন্ধকার ধীরে ঘন হয়ে আসে। আলো কেবল তার মুখে। সে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে বসে, চোখ বন্ধ করে বলে)
আমি জানি না, এই নতুন জন্মে আমি কী করব। আমি কেবল জানি— এই সমাজের এই দ্বিধা, এই ভাঙা আদর্শের মুখে আমি নীরব থাকতে পারি না। (চোখ মেলে তাকিয়ে চিৎকার করেন) আমি সিরাজ সিকদার— ফিরে এসেছি, কারণ তোমরা এখনো একটি আদর্শকে লালন করে সত্যের মতো বাঁচতে শেখো নি!
(আলো নিভে যায়। চারদিক থেকে গম্ভীর সুরে কোরাস শুরু হয়)
কোরাস: অতীতের গর্জন
(পেছন থেকে গলা আসে—পুরুষ ও নারী কণ্ঠে মিলিত)
যে থিসিস লিখেছিল আগুনে,
সে আজো পুড়ছে প্রশ্নের আগুনে।
ইতিহাস দাহ্য,
কিন্তু আদর্শ অগ্নি...
পর্ব ২: সেই লাল মাটি
সিরাজ সিকদার:
পঁচাত্তর সাল..
তারপর মৃত্যু...
তারপর নিস্তব্ধতা...
তারপর হঠাৎ—আবার এই জন্ম?
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে)
কে চেয়েছিল এই পুনর্জন্ম? আমি তো না। আমি তো মরে গিয়ে স্বস্তিতে ছিলাম, শরীরে আর রক্ত ছিল না, কিন্তু মন ছিলো বিশ্রামে। (দূরে তাকিয়ে) কিন্তু কেউ একজন ডেকেছে আমাকে...
হয়তো সেই লাল মাটি,
হয়তো একটা অপূরণীয় ভুল,
হয়তো ইতিহাসের অপরাধবোধ...
(হঠাৎ কণ্ঠে ঘনত্ব আসে) তুমি কি জানো, দর্শন কীভাবে গঠিত হয়? রক্তে... ঘামে... ভুলে, সংশয়ে, আত্মত্যাগে। একটি লাইন লেখার আগে একটি জীবন কাটাতে হয়।
(নিচু স্বরে) ‘পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ—জাতীয় মুক্তি সংগ্রামই শ্রেণিসংগ্রামের প্রথম ধাপ।’ এই ছিল আমার থিসিস। এই কাগজের প্রতিটি অক্ষর আমি লিখেছিলাম রক্ত দিয়ে। গভীর রাতে, মোমের আলোয়, হৃদয়ের মাঝে হাত রেখে বিশ্বাস করেছিলাম ‘পূর্ব বাংলা একটি উপনিবেশ। আমাদের বিপ্লব প্রয়োজন।’ আমি বিশ্বাস করেছিলাম, স্বশস্ত্র সংগ্রামই পারে পুঁজির লাল জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দিতে।
(এক মুহূর্ত থেমে ঘাড় নিচু করে) কিন্তু আজ? আজ যখন এই দর্শনকে আয়নায় দেখি, নিজেরই চোখে দেখতে পাই— অথচ চিনতে পারি না! (হঠাৎ উঠে দাঁড়ান) আমি কি সত্যি বুঝতে পেরেছিলাম ‘জনগণ’ মানে কী? আমার সেই ‘শ্রমিক’—আজকাল তারা লুঙ্গির বদলে জিন্স পরে, আমার সেই ‘কৃষক’—ফেসবুকে পোস্ট করে ভোট চাইছে।
এখন আমি দেখি, আমার মুখে সময়ের রেখা— এখনকার সমাজে... বিপ্লব মানে একটা টকশো। বিপ্লব মানে হ্যাশট্যাগ! বিপ্লব মানে স্মৃতিচারণে ভরা এক বিশ্রামযোগ্য অতীত।
(একটু জোরে) তবে কি আমি ভুল ছিলাম? আমার সে বিপ্লবী থিসিস—কতটুকু সময়ের মধ্যে পুরোনো হয়ে গেল? না, না! দর্শন কখনো পুরনো হয় না, পুরনো হয় তার প্রয়োগ। আমি মাও সেতুং এর কথা মনে করি— তিনি বলেছিলেন, ‘সঠিক পথ বেছে নিতে না পারলে বিপ্লবও প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে।’
(টেবিল থেকে একটি ছোট আয়না তুলে নেন, তাতে তাকিয়ে বলেন)
এই আমি—এই চেহারা— এটা কি সেই সিরাজ, যে রাইফেলের নল থেকে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল? না... এটা আর সেই মুখ নয়। এটা সময়ের পোড়া মুখ, এই চোয়ালে এখন আর বিদ্রোহ নেই, এই চোখে এখন দ্বিধার ছায়া। (কান পাতেন, যেন নিজেই নিজের থিসিস শুনতে পাচ্ছেন) ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ— এরা জনগণের প্রধান শত্রু...’ হ্যাঁ, আজও সত্য। কিন্তু এখন তো আর ওরা বন্দুক হাতে আসে না, ওরা আসে লগ্নি নিয়ে, নেতা কেনে, আদর্শ ভাড়া নেয়, সুদকষার হিসাব কষে গ্রামীন মানুষের দারিদ্রতা খরিদ করে।
(দর্শকের দিকে ফিরে বলেন)
তুমি বলো—আমার সেই আদর্শ কোথায়? তোমাদের গণতন্ত্র কি আমার সমাজতন্ত্রকে পিষে দিয়েছে? না! আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তবু আজ, গণতন্ত্রের নাম শুনলেই মনে হয় কেউ যেন মৃদু করে হাসে আমার মুখের ওপর। একদা যার জন্য প্রাণ দিয়েছি, আজ সে নিজেই রঙিন ব্যালট পেপারে ভুলে গেছে রক্তের মূল্য।
(আবার আয়নাটি হাতে নিয়ে বলেন)
এই আমি কি আমি? কে আমি? আমি কি সেই নেতা, না কি এক ক্লান্ত ভিখারি, যে নিজেই তার দর্শনের কাছে সাহায্য চাইছে? দর্শন এক সময় উত্তর দিত, এখন প্রশ্নই করে... এই আমি— আমি কি সেই নেতা, যার একডাকে জেগে উঠেছিলো তরুণেরা? তারা গেরিলা হয়েছিলো। তারা দেয়াল লিখেছিলো ‘শ্রেণিশত্রুকে খতম করো!’ তারা চিঠি লিখেছিলো আওয়ামী লীগকে—স্বাধীনতা চাই, স্বপ্ন চাই, সম্মান চাই। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ পোস্টারে বাঁধাই করা। সম্মান বিক্রি হয় টেন্ডারের নিচে। স্বাধীনতা দাঁড়ায় ডলারের লাইনে।
(টেবিল থেকে লাল স্কার্ফটি হাতে নেন, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন)
আমি... আমি এইসব দেখে আবার মরতে চাই। কিন্তু মৃত্যু এখন আর মুক্তি নয়, মৃত্যুও এখন পুঁজিবাদের অংশ। এখন তো মৃত্যুও বিক্রি হয় পত্রিকার হেডলাইনে! বলো! আমার দর্শন কি মিথ্যে ছিলো? না, মিথ্যে ছিলো এই সমাজ, যারা দর্শনকে পুড়িয়ে গরম করে তার ছাই দিয়ে নতুন সংবিধান লেখে! দর্শন আমাকে শক্তি দিয়েছিলো— এখন সে-ই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি এখনও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করো?’ হ্যাঁ... করি। তবে এই পৃথিবী কি তেমন? এই বাংলাদেশ কি আমার সেই পূর্ব বাংলা?
(আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়েন, চোখে জল)
আমি ক্লান্ত, আমি দ্বিধাগ্রস্ত, আমি একাকী। যে আদর্শ একা হয়ে পড়ে, সে কি আদর্শ থাকে?
পর্ব ৩: প্রেম, পেয়ারা বাগান ও গেরিলা যুদ্ধ
(আলো কিছুটা নরম। মঞ্চের এক পাশে চেয়ার। পাশে একটি পুরনো পেয়ারা রাখা ছোট ঝুড়ি। সময় যেনো আটকে আছে। নেপথ্যে দূর থেকে একটি লোকগান বা বাঁশির সুর ভেসে আসে। সিরাজ ধীরে হেঁটে আসেন।)
সিরাজ সিকদার:
(মৃদু হেসে, স্মৃতিময় সুরে)
তুমি কি জানো, আমি প্রেমেও পড়েছিলাম? হ্যাঁ, বিপ্লবীর হৃদয়েও ছিল কাঁপন। যদিও আমি বিশ্বাস করতাম— বিপ্লবীর কাছে প্রেম মানে জাতির মুক্তির প্রতি দায়।
তবু এক সন্ধ্যায়, পেয়ারা গাছের ছায়ায়—সে তাকিয়েছিলো আমার দিকে যেনো পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধ থেমে যায়। তার চোখে আমি দেখেছিলাম একটা জাতির আর্তনাদ—তৃষ্ণার্ত স্বাধীনতা, কাঁপতে থাকা সমানাধিকারের স্বপ্ন। আমি তার নাম ভুলে গেছি, কিন্তু তার চোখের ভাষা আজও আমার মনে—তুমি গেরিলা হও, সিরাজ। তুমি এই পেয়ারা বাগান বাঁচাও। এই মাটি, এই নদী, এই কৃষকের মুখ। এই বাগানে আমরা অস্ত্র লুকিয়ে রাখতাম—তপ্ত বিকেলে এখানে সভা করতাম, গোপনে পাঠ করতাম মাও-এর কথা, পড়তাম লেনিনের চিঠি। যেখানে প্রেম, সেখানেই ষড়যন্ত্র। যেখানে পেয়ারা, সেখানেই বোমা।
(হঠাৎ স্মৃতিতে ডুবে যান, কণ্ঠে উত্তেজনা)
একবার— রাতে হানা দিয়েছিলো পাকসেনা। আমরা তিনজন, পেয়ারা গাছের ছায়ায় গেরিলা! তারা এলো আগুন হয়ে, আমরা ছিলাম ছায়ার মতো। তারপর গোলাগুলি— একটা বুলেট চিরে ফেললো আমার পাশে দাঁড়ানো একজনের বুক। (চোখে জল এসে পড়ে, নিচু গলায় বলেন) সে প্রেম করেছিলো, আর তাই সে মরে গিয়েছিলো।
প্রেম কি শুধুই হৃদয়ের ব্যাপার ছিলো? নাকি ছিল এক বিপ্লবী সিদ্ধান্ত? (হঠাৎ থেমে দর্শকের দিকে) তোমরা যারা ভালোবাসা খোঁজো রোমান্টিক গানে— জানো না, ভালোবাসা আসলে বুলেটের গন্ধ! পেয়ারা বাগানের মতোই কোমল, তেমনি বিস্ফোরক।
আমি ভালোবেসেছিলাম। আর ভালোবাসা থেকেই আমি গেরিলা হয়েছিলাম। একটা দেশের মাটিকে ভালোবেসে, একটা ভাষাকে, একটা মুখকে...
তোমরা যখন প্রেমে পড়ো, একবার ভেবে নিও—তোমাদের প্রেম কি মুক্তির দিকে যায়, নাকি বন্দিত্বের দিকে? এই পেয়ারা আজো টিকে আছে। প্রেম নেই। গেরিলা নেই। শুধু একটা স্মৃতি— যা আজও বুকে পোড়ে, পুড়ে যায়... (আলো ধীরে নিভে আসে। হালকা বাঁশির সুর বাজে।)
পর্ব ৪: গেরিলা জীবন
(আলো আধো, যেন সময় থমকে আছে। মঞ্চে চেয়ার, পাশে ট্রাংক আর একটি ঝুড়িতে কিছু পাকা পেয়ারা। টেবিলে একখানা পুরনো নোটবই। মৃদু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। হঠাৎ করেই সিরাজ প্রবেশ করেন। চোখে কেমন যেনো স্থির পলক।)
সিরাজ সিকদার:
(স্বগতোক্তির মতো, তীব্র কণ্ঠে)
তোমরা আমাকে শুধু রক্ত আর বারুদের মানুষ মনে করো! ভাবো, আমি বুঝি শুধু বিপ্লবের অগ্নি জানি, প্রেম জানি না! হা হা হা... তবে শুনো— আমি পেয়ারা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের চোখে প্রথম বিপ্লব দেখেছিলাম।
(হাত বাড়িয়ে পেয়ারা তুলে নেন, গভীর করে তাকিয়ে থাকেন)
এই পেয়ারা একদিন ছিলো চুম্বনের মতো মিষ্টি, আর আজ—এই পেয়ারা গাছের নিচেই আমরা লুকিয়ে রেখেছিলাম ল্যান্ডমাইন। প্রেম আর যুদ্ধ—এই দুই আমার জীবনে কোনোদিন আলাদা ছিলো না। কারণ, আমি যখন ভালোবেসেছিলাম, তখনই ঠিক করেছিলাম—আমি বিপ্লবী হবো।
সে বলেছিলো— ‘তুমি যদি শুধু প্রেম করতে চাও, তবে শহরের দিকে চলে যাও। তুমি যদি আমার মাটি বাঁচাতে চাও—তবে এখানে থেকে যাও।’ আমি থেকে গেছি। তার ঠোঁট ছুঁইনি—কিন্তু তার কথায় গেরিলা হয়েছি!
সেই পেয়ারা বাগানে প্রথম গুলি ছুটেছিলো একজন পাকিস্তানি দালালের বুকে। সে ছিলো আমাদের গ্রামের শত্রু— কৃষকের ধান লুটে খেতো, হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি করতো, মেয়েদের গায়ে হাত দিতো! আমি এক মুহূর্ত থামিনি— আমার আঙুলে ছিল ট্রিগার, চোখে আগুন। তোমরা বলো প্রেম মানে কবিতা? না, সাথীরা—আমার প্রেম মানে ছিলো শত্রুর রক্তে লেখা একটি নতুন সমাজের কথা।
আমরা যখন দৌঁড়াতাম ধানের আড়ালে, বুলেট যখন ফুঁড়ে যেতো বুক— সেই সময়েও আমি ভাবতাম—‘সে কি আজও পেয়ারা বাগানে আসে?’ ‘সে কি জানে, আমি আজও বেঁচে আছি?’
(টেবিলের উপর রাখা নোটবই খুলে কিছু পাতায় চোখ বুলিয়ে)
এইখানে লেখা— ‘মাটি, প্রেম, মৃত্যু—তিনটাই বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এই লেখার সাক্ষী ছিলো সে। আমার প্রথম পাঠক। আমার বিপ্লবী প্রেম।
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে)
তোমরা যারা প্রেম করো শুধু শরীরের জন্য, তোমরা যারা ভালোবাসো শুধুই কবিতা পোস্ট করার জন্য—তোমরা জানো না প্রেম কী ভয়ংকর হতে পারে! আমরা ভালোবেসেছিলাম, তাই অস্ত্র ধরেছিলাম। আমরা প্রেম করেছিলাম—এই দেশের জন্য, এই মাটির জন্য। আজ সব পেয়ারা পঁচে গেছে। সে নেই। শত্রুরাও নেই। রয়ে গেছে শুধু—এই ফাঁকা বাগান, আর আমার কাঁধে শূন্য রাইফেলের ভার।
(আলো ধীরে ম্লান হয়। শেষ মুহূর্তে কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে)
আমি প্রেম করেছিলাম। আর সেই প্রেমেই একদিন মরে যেতে চেয়েছিলাম। তুমি যদি জানতে... আমি সত্যিই ভালোবেসেছিলাম!
পর্ব ৫: আধুনিকতার মুখোমুখি সমাজতন্ত্র
(আলো হঠাৎ উজ্জ্বল। মঞ্চের এক কোণে একটা এলইডি স্ক্রিন ঝলমল করছে—মেট্রো রেল, স্টার্টআপ, ব্রান্ড, মোবাইল অ্যাপ...। অন্য কোণে সিরাজ একা, পুরনো কোট গায়ে, হাতে একটা খবরের কাগজ। চেয়ার থেকে ধীরে উঠে দাঁড়ান। চিৎকারে ভরে ওঠে কণ্ঠ।)
সিরাজ সিকদার:
এই যে ‘উন্নয়ন’, এই যে চকচকে মোবাইল আর গালভরা স্বাধীনতা—এই সব দেখে কি আমি বিস্মিত হবো? তোমরা এখন ভোটে দাঁড়াও, টকশো করো, পুঁজিবাদের রঙিন মোড়কে সমাজতন্ত্রের নাটক খেলো। তোমরা এখন ‘কমরেড’ বলো— হ্যাশট্যাগ দিয়ে! তোমাদের রাস্তায় এখন স্লোগান নয়, সেলফি চলে! আমি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? যেখানে ব্যালট বাক্সে বিপ্লবের খুলি সাজিয়ে রাখা হয়?
(পত্রিকার পাতা ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেন)
অর্থনীতি উন্নতির পথে, নতুন চুক্তি চীনের সাথে, ব্যবসায়িক সফলতা, কমিউনিস্ট নেতা এখন শিল্পপতি! হা হা হা! কমিউনিস্ট? শিল্পপতি? এই আধুনিকতা যেনো এক উপহাস আমার রক্তাক্ত বিশ্বাসের উপর!
তোমাদের সমাজতন্ত্র এখন এসি অফিসে বসে লেখা যায়, দেয়ালে পোস্টার না লাগিয়ে ইনস্টাগ্রামে ক্যাপশন দেওয়া যায়। তোমরা ফেসবুক পোস্টে বিপ্লব করো, তোমরা ইউটিউবে মনটিাইজেশনের দূরভিসন্ধির পুঁজি তৈরি করো। আর আমার সাথীরা করেছিলো—জীবনের বিনিময়ে মুক্তি। আমি খুঁজতে এসেছি সমাজতন্ত্র, আর পেয়েছি ব্যবসা। আমি খুঁজতে এসেছি আদর্শ, পেয়েছি ব্রান্ড। এই আধুনিকতা, এই নগর সভ্যতা, এই তথাকথিত গণতন্ত্র— সব যেনো এক টেকসই পুঁজিবাদের লেজুড়বৃত্তি।
(দর্শকের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
তোমরা বলো, “দেখো দেশ বদলে গেছে!” আমি বলি— হ্যাঁ, শত্রুর মুখ বদলে গেছে, কিন্তু শোষণ আজও আগের মতোই আছে! শুধু এখন শোষণ হয় বিজ্ঞাপনে, অ্যাপে, ক্যামেরার ফ্রেমে— আন্দোলন হয় কফিশপে, আর বিপ্লব? বিপ্লব হয় টেলিভিশনের ডিবেটে—জামায়ত ইসলামিদের পাশে বসে— তোমরা মৌলবাদীদের ভাষায় কথা বলো হাস্যকর ভাবে! (হঠাৎ থেমে, শক্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন) এখন প্রশ্ন করি—এই আধুনিকতার মাঝে সমাজতন্ত্র কি শুধুই স্মৃতিচারণ? একটা ভুলে যাওয়া গানের মতো? নাকি সে এখনো সম্ভব—নতুন রূপে, নতুন উত্তাপে?
আমার আদর্শ কি এখন শুধুই ভুলে যাওয়া ইতিহাস? একটা মিউজিয়ামের পুরনো বই? না! যতদিন না মানুষ মানুষকে শোষণ করছে, ততদিন সমাজতন্ত্র নতুন হয়ে ফিরে আসবেই। আধুনিকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমি বিশ্বাস করি—বিপ্লব অসম্ভব নয়, শুধু সে এখন ভিন্ন মুখে আসবে।
(আলো ধীরে ম্লান। মঞ্চে শুধুই ঝলমলে স্ক্রিন জ্বলে, আর মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন সিরাজ, পেছনে রক্তের রঙের ছায়া পড়ছে তার শরীর জুড়ে। আলো এক ঝলক উজ্জ্বল। মঞ্চের এক কোণে বড় স্ক্রিনে চলছে আধুনিক বাংলাদেশের দৃশ্য—মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্পোরেট বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক র্যালি, সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ। অন্য কোণে একা দাঁড়িয়ে সিরাজ সিকদার, চোখে রাগ, গলায় বারুদের মতো আগুন। ধীরে শুরু করেন, ক্রমে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন।)
সিরাজ সিকদার :
কে বলেছে আমি মরে গেছি? কে বলেছে আমি ইতিহাস? ইতিহাস কী এত সহজে মুছে ফেলা যায়? আমি তো ফিরে এসেছি, এই আধুনিকতার মুখে থুথু ছুঁড়ে বলতে—তোমরা বিশ্বাসঘাতক! তোমরা বিপ্লবকে বিক্রি করেছো নীতির দামে, তোমরা স্বপ্নকে লিজ দিয়েছো করপোরেট বালখিল্যে!
এটাই কি মুক্তি? ডিজিটাল বাংলাদেশ, ফাইভ-জি, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আর ভোটযুদ্ধের হোল্ডিং? তোমরা কি জানো, গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদ এখন গলা টিপে ধরছে জনতার?
(চিৎকার করে প্রশ্ন ছুঁড়ে )
আমার সহযোদ্ধারা কি এই জন্য গুলি খেয়েছিল? তারা কি চেয়েছিল এমন এক সমাজ, যেখানে একটি শিশু না খেয়ে মরে আর পাশের বিলবোর্ডে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ঝলমল করে? তোমরা বলো, সমাজতন্ত্র এখন বাস্তববাদী নয়! আমি বলি—তোমরা সুবিধাবাদী! তোমরা হাল ছেড়েছো, তোমরা আপোষ শিখেছো, তোমরা শিখেছো কীভাবে লেনিনের মুখের কথা কোট করে একটি হুইস্কি হাতে করে রাত কাটানো যায়! কীভাবে সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলোতে সিগারেট হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভুল বকবক করে বাকোয়াজী করে সময় কাটানো যায়।
(আঙুল দর্শকের দিকে)
তোমরা যারা এখনো বলো— ‘আরে ভাই, দুনিয়া বদলে গেছে!’। তোমাদের জিজ্ঞাসা করি—মানুষ কি বদলে গেছে? ক্ষুধা কি বন্ধ হয়েছে? শোষণ কি থেমেছে? ধর্ষণ? খুন? নিরীহ কৃষকের ক্ষেত দখল কমেছে? গ্রামে গ্রামে সুদখোরদের এনজিওয়ালাদের বড়বড় কর্পোরেট এজেন্টদের দৌরাত্ম কমেছে? অন্যায় কি এখন আর অন্যায় নয়? তাহলে বিপ্লবের প্রয়োজন কেন মুছে ফেলেছো?
আমার সমাজতন্ত্র বইয়ের পাতায় নয়—গরিবের হাঁড়িতে, কৃষকের ঘামে, শ্রমিকের রক্তে। তোমরা এখন র্যাডিক্যাল হতে চাও, কিন্তু কফিশপের চেয়ারে বসে। তোমরা এখন লড়াই চাও, কিন্তু ‘ওয়াই-ফাই কানেকশন’ না থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে!
তোমরা কি জানো, কতটা নির্লজ্জ লাগে যখন দেখি এক সময়ের কমরেড এখন কোন কর্পোরেটের পাবলিক রিলেশন হেড? দাতাসংস্থার আর্শীবাদপুষ্ট কোনো ঘএঙ এর প্রকল্প পরিচালক। ‘স্মার্ট বিপ্লব;, ‘ভবিষ্যতের বামপন্থা’— এইসব কি বিপ্লবের নতুন বিজ্ঞাপন? ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিবর্তন আনুন’— এই হলো এখনকার আন্দোলনের নতুন স্লোগান? আমি মানবিকতাতে বিশ্বাস করি। তোমরা বিশ্বাস করো উন্নয়নের শুয়োরে চড়া মুক্তিতে। আমার শত্রু ছিল শোষক শ্রেণি, তোমাদের শত্রু—ভিউ কমে যাওয়া। ফেসবুক পোস্টের রিচ ডাউনে তোমাদের বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়ে।
(দর্শকের দিকে ধেয়ে আসে, যেনো চোখে চোখ সবার)
তোমরা কি আদৌ জানো বিপ্লব মানে কী? বিপ্লব মানে শুধু সরকার পতন নয়—বিপ্লব মানে নিজের মধ্যে আগুন ধরানো। তোমরা কি সেই আগুন জ্বালাতে পারো? নাকি তোমরা কেবল আগুনের গল্প শুনেই নিজেকে বিপ্লবী ভাবো? তোমরা এখন কথা বলো— ‘সম্ভাবনার রাজনীতি’ নিয়ে। আমি বলি— আদর্শহীন সম্ভাবনা হলো কর্পোরেট নেকাবের ভেতর এক ধূর্ত শয়তান।
তোমাদের উন্নয়ন আমি মানি না,
তোমাদের স্বাধীনতা আমি মানি না,
তোমাদের গণতন্ত্র আমি মানি না!
আমি এখনো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি।
আমি এখনো বলি—
জয় হোক শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের!
জয় হোক অন্তহীন অসমাপ্ত বিপ্লবের!
(আলো হঠাৎ নিভে যায়। কেবল স্ক্রিনে একটিমাত্র লাইন ভেসে ওঠে— ‘কতদূর গেলে মুক্তি মেলে?’)
পর্ব ৬: আত্মপরিচয়ের অন্বেষা
(মঞ্চে এক টুকরো আলো পড়ে। ট্রাংকটা খোলা—সেখানে পুরনো দলিল, কিছু লাল রঙের ব্যাজ, মাওয়ের মুখছবি দেওয়া একটা চিরকুট, আর তার পুরোনো খাতা। সিরাজ সিকদার বসে আছেন মেঝেতে। হালকা কাশছেন। চোখে একধরনের অদ্ভুত শূন্যতা, যেন এই শূন্যতা থেকেই তিনি কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ধীরে বলেন—)
সিরাজ সিকদার:
আমি কে? এই প্রশ্নের জবাব কি এত সহজে মেলে? (একটু চুপ থেকে) আমি ছিলাম একজন বিপ্লবী। না, ‘ছিলাম’ বলাটা ভুল—আমি হইনি কখনোই পুরোপুরি। বিপ্লব তো অসমাপ্তই ছিল, আমার মৃত্যুও ছিল অসম্পূর্ণ এক যাত্রার বিরতি। এই পাতাগুলোতে আমি নিজেকে খুঁজেছিলাম একসময়। ‘শোষণহীন সমাজ’, ‘জাতীয় মুক্তি’, কিন্তু আজ? আজ এই পাতাগুলো শুধু কালি আর গন্ধ হয়ে আছে, আর আমি হয়ে গেছি এক নামমাত্র কিংবদন্তি—তোমাদের পোস্টে, পেজে, বক্তৃতায়— একটা ‘ব্রান্ডেড বিপ্লব’!
আমি যদি এখন ভোটে দাঁড়াই, তোমরা কি আমায় ভোট দেবে? নাকি বলবে— ‘ও তো ওল্ড স্কুল’, ‘র্যাডিক্যাল’, ‘রিয়েলিস্ট না’?
আমি যখন বলতাম—‘পুঁজিবাদই শত্রু’—তোমরা বলো—‘ইকোনমিক গ্রোথ দরকার ভাই!’ আমি যখন বলতাম—‘ভূমি সংস্কার’, তোমরা বলো—‘এস্টেট নিয়ে ভাবি না, ইনফ্লুয়েন্সার হই!’ এই তোমরা আমাকে বদলে দিয়েছো! আমার পরিচয় ভেঙে ফেলেছো টুকরো টুকরো করে। তবু আজ এই আধুনিক পৃথিবীতে ফিরে এসে আমি প্রশ্ন করি—আমি কে? একটি ইতিহাসের পদচিহ্ন? একটি বামপন্থী ব্যর্থতা? নাকি এখনো এক সম্ভাবনা?
(ঘাড় উঁচু করে দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন)
তোমরা কি জানো, আমি আজও প্রতি রাতে ঘুমাতে গেলে একটি শব্দ শুনি—‘আদর্শ’। একটি শব্দ, যা আর কানে আসে না, এখন শুধু বাজে বিজ্ঞাপন আর নীতিকথা।
(উঠে দাঁড়ান, ঘর হেঁটে বেড়ান, যেন আত্মার ভেতরে হেঁটে চলেছেন)
আমি খুঁজি,
একটি নাম নয়—
একটি সত্তা।
একটি সংজ্ঞা।
একটি স্বর, যা বলে—
এই আমি! এই আমি! এই আমি!
এই সমাজের ছেঁড়া বুকে দাঁড়িয়ে
আমি এখনো বলতে চাই—
‘আমি শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস করি।’
(শেষে চেয়ারটায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন)
কিন্তু এই আমিকে—
তোমরা কি এখনো চেনো?
পর্ব ৭: স্মৃতি, শহীদ ও শূন্যতা
(মঞ্চে আলো নরম ও বিষণ্ন। হালকা ধোঁয়ার আবরণ। এক পাশে রাখা পুরনো পোস্টার—‘জাতীয় মুক্তি’, ‘সর্বহারা বিপ্লব’, ঝুলে আছে আধা ছেঁড়া হয়ে। মাঝখানে টেবিলে এক গ্লাস পানি, আর একটা ছোট্ট লণ্ঠন। সিরাজ সিকদার বসে আছেন মঞ্চের মেঝেতে, হেলান দিয়ে। চোখে ঝিম ধরা বিষাদ। তিনি ধীরে শুরু করেন।)
সিরাজ সিকদার:
তারা আমার সাথীরা ছিলো। শহীদ, শরীরে বারুদের ঘ্রাণ মাখা, চোখে আগামীর আগুন। তাদের অনেকেরই নাম মনে নেই আজ—কিন্তু তাদের রক্ত এখনো আমার নখের খাঁজে জমে আছে। তারা কেউ কবিতা লেখেনি, কিন্তু রক্তে লিখে গেছে ইতিহাস। তারা কেউ বীরোচিত মৃত্যু চায়নি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে হাসিমুখে। তাদের জন্যই আমি আজো বেঁচে—এই অসমাপ্ত, অপ্রাপ্ত পৃথিবীতে।
কিন্তু কোথায় তারা আজ? কোথায় সেই স্বপ্নের নাম—‘বিপ্লব’? কোনো যাদুঘরের কাচঘরে? নাকি ফেসবুকের টাইমলাইনে একদিনের পোস্ট হয়ে? বিপ্লব কি এখন নিছক একটি ইভেন্ট, না কি একটি অনুভূতির বিলুপ্তি?
(চোখ বন্ধ করে স্মৃতি চারণে)
আমরা এক পেয়ারা বাগানে, গোপনে শপথ নিয়েছিলাম, আমাদের কেউ থাকবে না, শুধু থাকবে স্বপ্নটা। কিন্তু স্বপ্ন কি শুধু হেরে যায়? স্বপ্ন কি শুধু শহীদের কবর চেনে, না কি জীবিতদের হতাশা চিনে নিতে শেখে? আজ আমি ক্লান্ত। প্রচণ্ড ক্লান্ত। একটি জীবন নষ্ট করেছি বলে নয়—একটি বিশ্বাসের মৃত্যু দেখেছি বলে। এই মৃত্যু আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রতিটি নির্বাচনের দিন, প্রতিটি পুঁজিবাদী বিজ্ঞাপনের শব্দে— আমি শুনি সেই শূন্যতা, বিপ্লব হয়নি, বিপ্লব হবে না।
(দর্শকের দিকে ফিরে, জোরালো স্বরে)
তোমরা যারা বলো—সমাজতন্ত্র একটা পুরনো কথা, তোমাদের বলি—পুরোনো হলে কি সত্য মিথ্যা হয়ে যায়? যে কৃষক এখনো দিন শেষে খালি থালা দেখে, যে শ্রমিক এখনো বুকে ব্যথা নিয়ে কারখানায় পড়ে, তাদের জন্য আমার শহীদ সাথীরা মরেনি?
(দীর্ঘ চুপ। চোখের জল লুকোতে লুকোতে বলে)
আমি যখন বন্দী ছিলাম, একটা রজনীগন্ধা গাছ ছিলো জানালার পাশে। সে গাছটা এখনো বেঁচে আছে কি না জানি না— কিন্তু আমি জানি, আমার বিশ্বাস...সে গাছটার মতোই, একদিন হয়তো আবার ফুল দেবে।
(আস্তে করে উঠে দাঁড়ান, দৃষ্টিতে একধরনের নিঃসঙ্গতা)
তবু, আজ আমি শুধু এক নাম, এক অতীত, এক শূন্যতা। আর আমার আশেপাশে—শুধু নীরবতা।
পর্ব ৮: নির্বাচন ও নির্বিকারতা
(মঞ্চে হালকা অন্ধকার। দূরে দূরে মাইকের আওয়াজ—‘উন্নয়নের মহাসড়ক’, ‘বিদেশি বিনিয়োগ’, ‘নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আসছে’... হঠাৎ থেমে যায়। আলো পড়ে কেবল সিরাজ সিকদারের মুখে। মুখে তীব্র বিস্ময়, ঘৃণা, কষ্ট।)
সিরাজ সিকদার :
এই তো ভোটের দেশ! এখানে জনগণ রাজার মতো ভোট দেয়, তারপর পাঁচ বছর ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আমি দেখি—নির্বাচন নামক এক অভিনয় যেখানে অভিনেতা চিরপরিচিত, স্ক্রিপ্টও বদলায় না, শুধু দর্শকের চোখে নতুন আলো লাগানো হয়, যাতে তারা ভুলে যায়, কে তাদের শত্রু, কে তাদের দালাল।
আমরা যখন বিপ্লবের কথা বলতাম, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলতো—এই অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়ছে। আর আজ? একটি পুঁজিবাদী শোডাউনে জাতিসংঘ থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত নজরদারি, পর্যবেক্ষক, রিপোর্ট—আই এম এফ, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন, সেন্টমার্টিনের ইজারা, মানবধীকার সংস্থা, ট্রান্সপেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সব হাজির! কার স্বার্থে এই নির্বাচন? জনগণের? না কি বিদেশি দাতা সংস্থার? যারা বাজেট বানায় আমাদের চেয়ে আগে...
বলে কী! সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া উন্নয়ন হয় না—এই কথাটা একবারও মনে হয়নি আমার, যখন গরিব শিশুটা ক্ষুধায় কাঁপে আর নির্বাচনী স্টেজে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢেলে মাইক বাজে!
জানেন? আজকের নির্বাচন একধরনের চিকিৎসা। ডাক্তার বসেছে আমেরিকায়, নির্দেশ দিচ্ছে লন্ডন থেকে, প্রেসক্রিপশন পড়ছে ঢাকায়: ‘গণতন্ত্র চাই, তবে তেল-গ্যাসে ছাড় দাও।’ ‘ভোট দাও, তবে কর্পোরেট ফাঁকফোকর রেখো।’ ‘সেন্টমার্টিন দিয়ে দাও, নয়তো মুরগীর লেজ কেটে দিবো’।
(পিছনে গিয়ে পুরনো ট্রাংক খুলে একটি কাগজ বের করেন—পুরনো ‘ভোটবিরোধী’ লিফলেট। তাকিয়ে থাকেন খানিকক্ষণ।)
এই কাগজটা একদিন স্লোগানে স্লোগানে উড়েছিলো—‘ভোট নয়, বিপ্লব চাই!’। কিন্তু আজকের ছেলেরা— তারা ‘ভোটার আইডি’ পায়, বিপ্লব ভুলে যায়।
ভোট এখন শুধুই এক মেকানিক্যাল প্রক্রিয়া। প্রচারণা মানে ‘সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন’, নির্বাচনী ওয়াদা মানে ‘জিপিটি জেনারেটেড’ ম্যানিফেস্টো, দেশি বিদেশি মিডিয়ার টিআরপি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ঋণ। কেউ আর নিজের চোখে দেখে না, কার চোখে আগুন, কার চোখে ধোঁকা। আমরা জীবন দিয়েছিলাম একদিন, যাতে জনগণের ইচ্ছা আইন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ? আইন হয় পুঁজির ডাকে, আর ইচ্ছা গুম হয়ে যায় মুদ্রাস্ফীতির অঙ্কে।
(আবার দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়েন)
তোমরা কি জানো, তোমাদের ভোট কীভাবে গোনা হয়? তোমরা জানো না— কার ইশারায় তোমার পছন্দ বেছে নেয়া হয়?
(তারস্বরে চিৎকার )
এই নির্বিকারতা! এই ঔদাসীন্য! এই সেই আত্মসমর্পণ, যার জন্য আমি অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম না! আমি চেয়েছিলাম পরিবর্তন, পেয়েছি প্যাকেটবন্দি ভোট।
তবে একটা কথা মনে রেখো—ভোট গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্র হলো— যেখানে কৃষক তার দামে খেতে পায়, শ্রমিক তার ঘামে সম্মান পায়, নারী তার রাস্তায় নিরাপদ থাকে, আর রাষ্ট্র জবাবদিহি করে জনতার কাছে। তা না হলে এই ভোট শুধুই একটি অশ্রুত গান— যার সুর জানে না কোনো শ্রোতা।
পর্ব ৯: সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ
(আলো নিঃশেষিত প্রায়। শুধু এক কোণায় বসে থাকা সিরাজ শিকদারের মুখে মৃদু আলো। তার চোখে ক্লান্তি, হালকা কাঁপা হাতে একটা পুরনো বই ধরে আছেন। বইয়ের পাতা ওল্টান, কিন্তু চোখ পড়ে না তাতে।)
সিরাজ সিকদার :
সময়—তুমি তো আমার চেয়ে ধূর্ত, আমার চেয়ে ধৈর্যশীল, আর, তুমি কখনো ভুল করো না। আমি ভেবেছিলাম, তুমি বদলাবে আমার ছুরির আঘাতে—তুমি বদলাওনি, বরং আমাকে বসিয়ে দিলে তোমারই তৈরি এক প্রদর্শনীঘরে। আমি বলতাম-আমরা ইতিহাস গড়বো। আজ ইতিহাস গড়ে আমাকে দেখায় এক ব্যর্থ বিপ্লবের ব্যাকরণ। আমার নাম আছে বইয়ের পাতায়, কিন্তু ভুল বানানে।
(কণ্ঠ ভাঙে কিন্তু ভাষা ছুরি হয়ে ওঠে)
সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ! এই বাক্যটা আমি একসময় তাচ্ছিল্য করতাম। ভেবেছিলাম—যুদ্ধ করলেই সময় হার মানে। না। সময় শত্রু নয়, সে শিক্ষক আর আমি শিখিনি কিছুই, শুধু যুদ্ধ আর জয়—এই দুইয়ের মাঝে মানবিকতার সূক্ষ্ম রেখাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আমার পাশে কেউ ছিল না, শেষ গেরিলা অপারেশনের পর, আমি একা ছিলাম ধরা পড়ার সময়ও। সময় শুধু চেয়ে ছিলো, এক চিৎকারে আমার কণ্ঠের শব্দ হজম করে নিয়েছিলো, গণতন্ত্রের নতুন ‘সম্ভাবনা’র নামে।
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে—প্রায় ধিক্কারে)
তোমরা যারা এখন স্মার্টফোনে বিপ্লব খোঁজো, তোমাদের জন্য সমাজতন্ত্র যেনো একটা পুরনো অ্যাপ—‘ডাউনলোড করে রেখে দাও, হয়তো কাজে লাগবে।’ আর আমরা? আমরা রক্তে লিখেছিলাম ইশতেহার, আমাদের পোস্টার ছিল দেয়াল, স্লোগান ছিল শ্বাস। তবু আমি বলবো না, আমি ভুল ছিলাম। আমার ভুল ছিল না—সময় ছিল অপ্রস্তুত। জনগণকে প্রস্তুত করতে সময়ের থেকেও বেশি সময় দরকার। আর সময়—সে তো ব্যস্ত, সে তো অস্থির। সে তো বাঁধা পড়তে চায় না কারও দর্শনে।
(হঠাৎ ঘাড় সোজা করে—আত্মসমালোচনার তীব্র আগুনে)
তবে, আমি কি প্রস্তুত ছিলাম? আমি কি কখনো বুঝেছিলাম, একটি বিপ্লব শুধু অস্ত্র দিয়ে হয় না? কবিতা লাগে, প্রশ্ন লাগে, মা-বোনদের কান্না লাগে, ভাঙা হৃদয়ের গল্প লাগে। আমি সেই গল্প শুনিনি, শুধু বুলেটের ভাষা শিখেছিলাম।
(দীর্ঘদৃষ্টি নিয়ে মঞ্চজুড়ে হাঁটেন, একের পর এক বাক্য যেন আত্মপ্রতিক্রিয়া)
আমার বিপ্লব কখনো নিজের ভুল দেখে কাঁদেনি। আমার বিপ্লব প্রশ্ন শুনে চুপ করে যায়নি। আমার বিপ্লব এখন আমার মতোই ক্লান্ত—সে হাঁপিয়ে উঠেছে সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে করতে। সময়ের কাছে হার মানা মানে শুধু পরাজয় নয়, স্মৃতির কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া এক পৃথিবীর মৃত্যু।
তবু আমি বিশ্বাস করি—সময়ের কাছে আত্মসমর্পণই যদি শর্ত হয়, তবে তা হবে দাঁতে দাঁত চেপে, কান্না নয়—এক ধরণের কবিতা হয়ে।
পর্ব ১০: ক. আমার নেতারা কোথায়?
সিরাজ সিকদার:
(স্বগত)
আমার নেতারা কোথায়? যারা বলেছিল, ‘সিরাজ, তুমিই আগুন’ যারা বলেছিল, ‘তোমার চোখে আমরা মুক্তির মানচিত্র দেখি’ তারা এখন কোথায়? আমার নেতারা কোথায়? জ্যোতি, মুজিব, রণেশ, কমরেড বাসু... কোথায়? আমরা তো একসাথে শপথ করেছিলাম—এই মাটি হবে শোষণমুক্ত, এই মানুষ হবে মুক্ত, এই পতাকা হবে লাল! আজ কোথায় সেই শপথের অক্ষর?
এখন শুধু দেখি...
ভোটের পোস্টার, টক শো’র ঠক ঠক শব্দ, আলোচনার টেবিলে বিপ্লব চড়া সুদে বিক্রি হয়। মার্কিন রিপোর্টে রাষ্ট্রের অবস্থা বোঝা হয়, গণতন্ত্রের নাম নিচ্ছে তারা যারা আগে আমার নাম নিতে ভয় পেতো। আমার নেতারা কি এই রূপান্তর চেয়েছিলো? যখন আকাশজুড়ে শকুন, জমিনে থাবা বসিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী, আমার সংস্কৃতিতে চোখ রাঙায় মৌলবাদ, তখন আমরা হাতে হাত রেখেছিলাম—বলেছিলাম, লড়াই হবে! রক্ত দিয়ে যদি প্রয়োজন হয়, ইতিহাস লেখা হবে।
কিন্তু আজ? আজ সবাই 'মানিয়ে নিয়েছে'— এই শব্দটা যেন একটা শোষণযোগ্য দার্শনিকতা। কমরেডরা এখন ঘএঙ চালায়, ইমেল করে বৈপ্লবিক চিঠি! ফেসবুকের প্রোফাইলে লাল তারকা যেনো বদরের উম্মত। একেকটা লালবদর। কিন্তু মনে একটুও আগুন নেই।
আমি কি ভুলেছিলাম সেই রাতগুলো—যখন রাতের আঁধারে লিফলেট ছাপতাম, মাটির নিচে সভা করতাম, রাত জেগে কবিতা লিখতাম আগুনের মতো জ্বলবে বলে! আজ তারা কোথায়? যারা বলেছিল, ‘তুমি একা নও, আমরা আছি।’ আজ এই বৃদ্ধ বয়সে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি এই মঞ্চে, এই বাংলাদেশে, এই মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মাঝখানে।
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন)
আমি কি একাই ছিলাম রক্তে ভেজা মাঠে? আমি কি একাই লিখেছিলাম ‘জাতীয় মুক্তির থিসিস’? আজ তারা কোথায়? এই ভোটের শহরে, বিলাসের কফিশপে, ডিপ্লোম্যাটিক পাড়ায়? আমার নেতারা কোথায়? ক্যান্টনমেন্টের সামরিক উদ্যানে? নাকি হৃদয় মঞ্জুরিত কোন রমণীর নৃত্যশালায়...
পর্ব ১০: খ. স্মৃতির মিছিল ও অনুরণন
সিরাজ শিকদার:
(চোখ বন্ধ, স্মৃতির ঝাঁপ খুলে)
স্মৃতির মিছিল নামে রাতের শরীরে... কোনো কোনো রাত এখনও কেঁদে ওঠে হঠাৎ— মনে পড়ে সেই মেয়েটার কথা, যে ‘লাল স্কার্ফ’ বেঁধে বলেছিল, ‘কমরেড, আমার শরীর নয়, আমার স্বপ্ন নিয়ে যান।’ সে ছিল রেশমা। মনে পড়ে—তোমাদের সবার হাসি, জলপাই রঙের সাইকেলে শহীদ করিম, মুনতাসিরের কবিতা—বিপ্লব শুধু পত্রিকার খবর নয়, বিপ্লব আমাদের ঘুম ভাঙানোর অ্যালার্ম। আজ সব নিঃশব্দ। শহরের শব্দও ক্লান্ত এখন—ট্রাফিক, হর্ণ, বিলবোর্ড, অচেনা ব্যস্ততা।
(হঠাৎ চিৎকার করে)
তোমরা কোথায় গেল রে? তোমাদের না বলার কথা ছিল, তোমাদের না কবিতার মত হেঁটে যাবার কথা ছিল না...
আজও আমি শুনি কানে কানে কোরাস— ‘কমরেড... কমরেড... ভুলে যেও না...’ কিন্তু ভোলা তো সহজ নয়! এই চামড়ায় এখনও দগদগে পোড়ার দাগ, এই গন্ধে এখনও বারুদের ঘ্রাণ।
আজ এই বয়সে, আমি যখন খুঁজি এক গ্লাস জল, তখনও আমার মগজে বাজে—‘আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের...’
(দৃঢ় স্বরে, চুপচাপ ভেতরে তোলপাড় করা)
আমার নেতারা নেই, কিন্তু তাদের ছায়া— এই দেয়ালে, এই ট্রাংকে, এই কণ্ঠে, এই চোখে। আমি এখনো হাঁটি... স্মৃতির মিছিল ধরে... তবু একা নই আমি... কারণ— স্মৃতি কখনো শূন্য হয় না, স্মৃতি অনুরণন তোলে... আবার।
পর্ব ১১: আপোসনামা
(মঞ্চে একটিমাত্র আলো, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। ধীর পদক্ষেপ। চোখ দুটি ক্ষীণ আলোয় ঝলসে ওঠে। ভাষার তীব্রতা আর আত্মস্বীকৃতির বিষম মুহূর্তে দৃশ্যাবলী ভারি হয়ে ওঠে।)
সিরাজ সিকদার:
আমার হাতেই ছিল লালপতাকা-আজ তার রং ধূসর কেন লাগে? আমি কি কোথাও থেমে গেছি? না কি সময়ই পিষে দিয়েছে আমার চিৎকার? সেই আমি... যে বলত— ‘সমঝোতা নয়, সংগ্রাম!’ আজ নিজের সাথেই কি সমঝোতা করে ফেলেছি? আমার চারপাশে এখন নবীন বিপ্লবীদের চোখে দেখি সন্দেহ, শ্লেষ, বা নিঃস্পৃহ নিরবতা।
(আবেগে গলা কাঁপে)
আমি কি তাদের চোখে এক পরাজিত পুরনো পোস্টার? একটি ব্যর্থ রণকৌশল? বল আজকের গণতন্ত্র—তুই কি আমার মতো লোকের জন্য একটা সরু কোনায় রাখা অতীতের জাদুঘর?
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন)
তোমরা যারা আজ ‘পরিবর্তন’ বলো—তোমরা কি জানো পরিবর্তনের মূলে কতটা রক্ত শুকায়, কতটা প্রেম ঝরে যায় পেয়ারা বাগানের মাটিতে? আমি ভেবেছিলাম, শ্রেণি সংগ্রামের রক্তধারা থামবে না কোনো আপসের খাতায়। কিন্তু এই যে... আজকাল আমিও ভাবি ‘ভোটে দাঁড়ানো’টা বোধহয় বিপ্লব নয়, ‘সমঝোতা’টা বোধহয় কৌশল?
(এক চিলতে হাসি, বিষাদময়)
আমি কি তাহলে... তাদের মতোই হয়ে গেলাম? যাদের বিপক্ষে আমি জীবন কাটালাম? আমিও কি আপস করে ফেলেছি? না না... আমি তো ভেঙে পড়িনি... আমি তো এখনও দাঁড়িয়ে আছি— হোক গাছশেকড়া কেটে ফেলা তবু মাটি ছেড়ে যাইনি... কিন্তু তবুও... মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে একটা প্রশ্ন তাড়া করে...আমি কি সত্যিই আপস করে ফেলেছি?
(মঞ্চে আলো ধীরে ধীরে নিভে আসে। কেবল দূরে একটি কোরাসের কণ্ঠ ভেসে আসে—)
কোরাস (দূর থেকে ধ্বনিত):
আলো জ্বালিয়ে যারা এসেছিল,
তাদের চোখেই এখন অন্ধকার—
আমরা কি তবে একে বলি ‘পূরণ’?
না কি নিঃশেষ হবার নামই ছিল তাদের পথ?
পর্ব ১২: গণতন্ত্র বনাম বিপ্লবের বাস্তবতা
(আলো ধীরে ধীরে পড়ে একজন বৃদ্ধ মানুষের মুখে। চেয়ার থেকে উঠে এসে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। পেছনে ছায়া বড় হতে থাকে। গলা ভারী, কিন্তু তীক্ষ্ণ।)
সিরাজ সিকদার :
(স্বগত)
গণতন্ত্র! এই শব্দটা এখন মিষ্টি, চকচকে, প্যাকেটবন্দি চকলেটের মতো নির্বাচনের আগে বিতরণ করা হয়, তারপর পাঁচ বছর ভুলে যায় মানুষ! কিন্তু আমি? আমি কি ভুলতে পেরেছি আমার ঝাঁঝালো বিপ্লবের স্বপ্ন? (দর্শকের দিকে ফিরে, তীক্ষ্ণ গলায়) তোমরা বলো, ভোট দাও, গণতন্ত্র বাঁচাও! তোমরা কি জানো, আমি কতগুলো জীবন উৎসর্গ করেছিলাম এই ‘গণ’-এর জন্য? তোমাদের এই সংসদীয় সার্কাসে আমি কোথায়? আমার গেরিলারা কোথায়? আমার স্বপ্নগুলো কোথায়?
(হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়)
তোমরা তো বলেছিলে—এই মাটি একদিন কৃষকের হবে, শ্রমিকের হাতে থাকবে কলকারখানার মালিকানা! এখন দেখি, সেই কৃষক শহরে এসে ‘উবার’ চালায়, ‘পাঠাও’ চালায়। শ্রমিক ইপিজেডে ১২ ঘন্টা কাজ করে, আর রাতে পলিথিনে শরীর ঢেকে ঘুমায়।
এই কি তোমাদের গণতন্ত্র? যেখানে মিডিয়ার পর্দা বিক্রি হয়ে যায়? সংসদ হয়ে যায় বাণিজ্যের গোয়াল ঘর? আর সমাজতন্ত্র? সে এখন জাদুঘরে রাখা লাল পতাকা—ধুলো জমা, স্মৃতির বোঝা, আর পদদলিত হয়ে থাকা ইতিহাসের খেরোখাতা।
(একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, চেয়ারটায় বসে পড়ে)
আমি যে স্বপ্ন দেখতাম—একটা সমাজ, যেখানে কেউ কারও উপর শোষণ করবে না, একটা রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি শিশু শুধু দুধভাত নয়, স্বপ্ন আর আত্মসম্মান নিয়ে বেড়ে উঠবে—সে স্বপ্ন আজ জেলখানার দেয়ালে আঁকা একটা মুখ, তোমরা জানো না, আমি এখনো কয়েদি হয়ে আছি! আমি জিজ্ঞেস করি—তোমরা আমার উত্তরাধিকারী? তবে কেনো আজ বিপ্লব মানে পোস্টার, আর আদর্শ মানে ফেসবুক স্ট্যাটাস? আমার বিপ্লব কি ভুল ছিল? নাকি এই সময়টাই ভ্রষ্ট?
(কিছুক্ষণ চুপ, তারপর ধীরে বলে)
গণতন্ত্র যদি হয় এলিটদের খেলা, তবে আমি সেই খেলার গোলরক্ষক নই, আমি সেই বোলার, যে প্রতিটি উইকেট উড়িয়ে দিতে চায়।
(আবার দর্শকের দিকে)
তোমরা বলো—গণতন্ত্র মানে ভোট, আমি বলি—গণতন্ত্র মানে পরিবর্তন। তুমি যদি শুধু শাসক পাল্টাও, শোষণ না পাল্টাও—তবে নাম পাল্টেও সাম্রাজ্য এক থাকে, শুধু পতাকা বদলায়।
পর্ব ১৩: লাল পতাকার পরিণতি
(মঞ্চ অন্ধকার। হালকা আলোয় ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয় লাল রঙের একটি পুরনো কাপড়, যা পতাকার মতোই। সিরাজ সিকদার এক কোণে বসে, তার চোখে স্মৃতি, হতাশা, এবং কিছুটা তাচ্ছিল্য। হালকা সুর বাজে দূর থেকে—আধা-বিপ্লবী, আধা-পার্টি কনভেনশন ঘরানার)
সিরাজ সিকদার:
(চোখ বন্ধ করে, নিচু স্বরে)
লাল... একটা সময় এই রঙ ছুঁলেই জনতা জেগে উঠতো—জ্বলতো মশাল, উঠে আসতো গর্জনে, এই পতাকা একদিন বিশ্বজয় করবে! আজও লাল আছে, কিন্তু আগুন নেই। সুন্দর পোস্টারে ছাপা, দেয়ালে ঝোলে— আর কিছুদিন পর হয়তো একে বলা হবে—‘একটি পলিটিক্যাল ব্রান্ড।’
আমরা কি স্বপ্ন দেখিনি? একটি সমাজ, যেখানে কেউ থাকবে না মালিক, কেউ নয় দাস। যেখানে শ্রম হবে গৌরব, না যে খেটে মরে, না যে শোষণ করে। কিন্তু এখন? কমরেড লাল পতাকা কোথায়? আসরে, মিছিলে, সভায়—হ্যাঁ, এখনো আসে, কিন্তু সাথেই থাকে—স্পন্সরের নাম, কৌশলের বুলেটিন, নরম লাফানো বুলি—যা বলে, ‘আমরাও বাস্তববাদী, আমরাও নির্বাচনমুখী!’
(দর্শকের দিকে)
তোমরা কি জানো, একটি আদর্শ কীভাবে মারা যায়? বন্দুকের গুলিতে নয়, চুপিসারে, ধীরে ধীরে, আত্মসমর্পণে। আমাদের পতাকা এখন—স্টিকার হয়ে গেছে, পোস্টার হয়ে গেছে, বিপ্লব নয়, স্যোশাল প্রোমোশন। তোমরা লাল দেখে চমকাও, কিন্তু আর আগুন ধরাও না। আমরা শিখিয়েছিলাম বিদ্রোহ—তোমরা শিখেছো আপস। আমরা চেয়েছিলাম শ্রেণিহীনতা, তোমরা চাও ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
কিন্তু বলো, এই তোদের গণতন্ত্রে—একজন মজুরের ছেলে কি আদৌ হয় নেতা? তোমাদের সংসদে ক’টা কৃষকের কণ্ঠ শোনা যায়? তোমাদের টকশোতে ক’জন গেরিলা কথা বলে? নতুন যুগে লাল পতাকা বেঁচে আছে, কিন্তু সে একা। তার শরীরে নেই শ্রমিকের ঘাম, তার বুকে নেই কৃষকের ধ্বনি।
আমি, সিরাজ সিকদার, এই পতাকার কাছে ক্ষমা চাই— কারণ তোমার জন্য তেমন কিছু রেখে যেতে পারিনি। তোমার আগুন আমি জ্বালাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজ, তোমার ছায়ায় আমি কাঁপছি।
(আলো ধীরে ধীরে কমে আসে। লাল কাপড়টা বাতাসে একটু দুলে উঠে। দূর থেকে শোনা যায় কোরাসের গলা—আধা গান, আধা শ্লোগান)
পর্ব ১৪: আমার বিপ্লব, আমার পরাজয়
(সিরাজ সিকদা অনেক বেশি ক্লান্ত, কিন্তু তার ভেতরে লাল আগুন এখনো জ্বলছে—নিভে গিয়ে মাঝে মাঝে হঠাৎ জ্বলে ওঠে। এই পর্বে যেনো তার আত্মা বারবার প্রশ্ন করে—এই বিপ্লব কি ব্যক্তিগত ছিলো? নাকি জনতার? যে পতাকা একদিন হাতে নিয়েছিলো, সেই পতাকাই আজ পরিহাস হয়ে উঠেছে কিনা? আলো ম্লান। একটিমাত্র ট্রাংকের পাশে বসে সিরাজ সিকদার। হাতে একটি পুরনো লাল কাপড়, হয়তো পতাকার টুকরো। কণ্ঠ গম্ভীর, ক্লান্ত, কিন্তু প্রত্যয়ী। মাঝে মাঝে উচ্চারণে জোর। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা দীর্ঘ।)
সিরাজ শিকদার:
(স্বগতোক্তি ও দর্শক-প্রত্যক্ষ)
লাল পতাকা... এই যে কাপড়খণ্ড, এর ছেঁড়া রং কি আজও রক্ত মনে করায়? না কি... কেউ ভাবে পুরনো ট্রেন্ডের ক্যানভাস, নস্টালজিয়ার ঘোরে হারানো এক লাল? তবে কী আমি— আমিই ভুল ছিলাম? বিপ্লব কি একদিন ক্লান্ত হয়ে পড়ে? তারও কি পেনশন হয়, তারও কি বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন আসে?
(দীর্ঘ দৃষ্টিতে কাপড়টির দিকে তাকিয়ে)
আমি যখন এই পথ ধরেছিলাম, পিছনে ছিল না কোনো প্রচার সংস্থা, না কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ক্যামেরা,শুধু ছিল—দুই পাটি ছেঁড়া জুতো, কিছু সাহসী কণ্ঠ, আর এই বুকভরা আগুন।কিন্তু আজ! যারা ভোট চায় সমাজতন্ত্রের নামে, যারা গলায় বাঁধে লাল স্কার্ফ, কিন্তু হাত মেলে পুঁজির দুয়ারে—তাদের দেখে কী ভাবি? ভুলে যাই কি, আমার সহযোদ্ধারা কোথায় নিখোঁজ? শহীদ? নাকি নির্বিকার?
একদিন পেয়ারা বাগানের ছায়ায় আমরা অস্ত্র লুকাতাম, আজ সেই বাগানে কিনা ক্যাফে! নাম—‘রেভোলিউশন রেস্টো’! গেলেই মেলে কফি, পেস্ট্রি আর স্মৃতিচারণ! হতেও পারে, এটাই জয়... আমরা যে সমাজ চেয়েছিলাম, সেই সমাজ হয়তো এখন পকেট ফ্রেন্ডলি... কিন্তু—কোথায় সেই আগুন? কোথায় সেই ভয়, সেই কাঁপুনি? মানুষ কি আজ আর শোষণকে চিনতে পারে না?
হয়তো আমি পরাজিত, হয়তো সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি, কিন্তু—এই পতাকা, এই বিশ্বাস—এখনো আমাকে ধরে রেখেছে, হয়তো আগুন ছোট, কিন্তু নিভে যায়নি।
(দীর্ঘ নীরবতা। একবার দর্শকদের দিকে তাকান, যেন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করেন।)
পর্ব ১৫: বিপ্লবের শেষ পেরেক
(আলো নিঃসঙ্গ, রঙিন নয়—একধরনের ধূসর স্যাচুরেশনে ভরা। ট্রাংকের পাশে তিনি হাঁটু মুড়ে বসে, হাতে একটি পুরনো চিঠি বা ছোট কাগজ। বাতাসে যেন ধুলো উড়ে—সময় থমকে গেছে।)
সিরাজ সিকদার:
এই চিঠি... যেটা লিখেছিলাম পাহাড়ের ভেতর এক গেরিলাকে— তুমি যদি না ফেরো, তাহলে এই বিপ্লবও ফিরবে না। (চিঠি হাতে ধরে থাকেন, চোখ সরান না) আজ আমি ফিরেছি, কিন্তু বিপ্লব কি ফিরেছে? না কি গোপনে কবর দেওয়া হয়েছে? একটা নিঃশব্দ সমাধি, যেখানে কোনো নীচু স্বরে বলা হয় না—‘সে একদিন লড়েছিলো।’
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সময়, তাকে প্রশ্ন করি—তুমি কি স্বপ্ন খেয়ে বাঁচো? না কি স্বপ্নকে খেয়ে ফেলো? আমি তো চেয়েছিলাম—একটা আগুনের মতো সমাজ, যেখানে শোষকের পায়ের নিচে থাকবে না কোনো মানুষ, কিন্তু আজ সব আগুন নিভে গেছে, শুধু আছে ধোঁয়া আর তার বিজ্ঞাপন।
(একটু থেমে, ঘাড় ঘুরিয়ে দর্শকের দিকে)
বলুন, আপনারা কেউ কি দেখেছেন লেলিনকে এই বাংলায় হাঁটতে? মাও-কে এই শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে? শেখ মুজিব কে রেসকোর্সে বুক চাপড়িয়ে চিৎকার দিতে? আপনারা কেউ কি গিয়েছেন সেই গেরিলা কবরস্থানে, যেখানে পুঁতে রাখা আছে একটি মাত্র নাম—‘স্বপ্ন’?
(চোখ দুটি স্থির, গলা বিষণ্ন অথচ কাঁপা কাঁপা)
এই চুপচাপ মৃত্যুই কি তাহলে বিপ্লবের পরিণতি? না কি এটা সময়ের নিয়ম? হয়তো ইতিহাস সবই মনে রাখে, কিন্তু গলা চেপে ধরে বলে—‘চুপ করো, বেশি কথা বলো না। তোমার সময়ে তুমি জ্বলে উঠেছিলে, এখন নিভে যাও।’
(আস্তে আস্তে নিজের বুকের দিকে তাকায়, যেনো সেখানেই শোকের পাথর বেঁধে আছে) তবু আমি জানি, এই নিঃসঙ্গতা, এই শূন্যতা, এই পরাজয়— সবই ইতিহাসের প্রস্তাবনা। একদিন কেউ হয়তো ফিরে আসবে, হয়তো আবার কাঁচা গলায় গেয়ে উঠবে— ‘এই পতাকা আমরা ছাড়বো না।’
(আলো ধীরে ধীরে নিভে আসে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা কোরাস ভেসে আসে—একটা করুণ বিপ্লবের সুর, যেখানে কথাগুলো ধোঁয়ায় মিশে যায়।)
পর্ব ১৬ : শেষ বিপ্লব, অথবা একটি অসমাপ্ত পরিচয়
সিরাজ সিকদার:
(ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন)
আমি... আমি কে? একজন যোদ্ধা? এক জনপদ? এক কাল্পনিক বিপ্লব? আমার পরিচয় কি যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়ে মৃত্যু দিয়ে শেষ? না কি মৃত্যুই আমার প্রকৃত জন্ম?
(দর্শকের দিকে তাকিয়ে, স্বর স্পষ্ট ও চাবুকের মতো)
তোমরা যারা এখন সভ্যতার আলোয় বসে গণতন্ত্রের সিলিং ফ্যানের নিচে নিঃশ্বাস নিচ্ছো—তোমরা কি জানো, কত লাশ পেরিয়ে এসেছো এখানে? আমি সেই লাশের একটি, যাকে বলা হয় ‘বিপথে যাওয়া,’ ‘চরমপন্থী,’ ‘অসামাজিক।’ কিন্তু এই সমাজটাই তো আমাকে জন্ম দিয়েছিলো তাহলে কে দায় নেবে?
(দেয়ালের গায়ে হাত রাখেন, যেনো অনুভব করতে চান ইতিহাসের স্পন্দন)
এটা কোনো আত্মজীবনী না, এটা এক সমষ্টিগত ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি। আমরা লড়েছি—কিন্তু কি পেলাম? একটা রাষ্ট্র যেটা শোষণ বদলে শোষণ, একটা পতাকা, যার রঙ ধুয়ে গেছে উন্নয়নের ফ্লেক্সে। আমি সিরাজ, আমি সেই মৃত বিপ্লবীর চিৎকার, যে আজও চায় না করতালিতে হারিয়ে যেতে।
(ধীরে ধীরে বসে পড়েন মাটিতে)
আমার কবরের উপর আজ দাঁড়িয়ে সভ্যতা, কিন্তু সেই কবরের নিচে একটা প্রশ্ন পঁচে যাচ্ছে—
‘মানুষ কি সত্যিই মুক্ত?’
(একটি দীর্ঘ নীরবতা। তারপর ধীরে ধীরে বলেন)
আমার উত্তর নেই। কেবল এইটুকু বলতে পারি— আমি চেয়েছিলাম, তোমরা যেন প্রশ্ন করতে শেখো।
(আলো নিভে আসে ধীরে ধীরে। কোরাস ভেসে আসে—একটা ধীর লয়ে বলা চরণ)
‘শুধু পতাকা নয়, মানুষ জাগাতে এসেছিলাম—আমার শূন্যতাকে ভয় কোরো না, সেখানে একদিন আবার জন্মাবে জ্যোতি।’ আমাকে মনে রাখো না। তোমাদের ইতিহাসের বইতে আমার নাম থাকলেও আমার চিৎকার কখনো ছিল না পাতার নিচে। সেই চিৎকার ছিল ধানক্ষেতে, আখের জমিতে, মাটির ভেতরে চাপা পড়ে থাকা ক্ষুধার গন্ধে।
(হঠাৎ গলা শক্ত করে তোলেন)
কিন্তু আজ... আজ আমি শেষ কথা বলতে এসেছি। আমি জন্মাইনি কোনো সামরিক ঘাঁটিতে, না কোনো মার্কসবাদী পাঠাগারে—আমি জন্মেছিলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা নির্লজ্জ বেদনায়। তোমরা যাদের ‘রাষ্ট্র’ বলো, তারা ছিল আমার শত্রু। তোমরা যাদের ‘বিপ্লবী’ বলো, তারা ছিল আমার সঙ্গী। কিন্তু এখন, এখন?
(হঠাৎ থেমে চোখ তুলে দর্শকের দিকে তাকিয়ে বলেন)
আমার বিপ্লব কোথায় গেল? গণতন্ত্রের বোতাম টিপে সব ভুলে গেলে? ভুলে গেলে সেই মেয়েটি যার বুকে বুলেট ঢুকে ছিলো, ভুলে গেলে সেই ছেলেটি যে রাতভর দেয়ালে লিখে ‘জয় পূর্ব বাংলা’? তোমরা সবাই কি আপস করেছো?
(তার গলা ধীরে ধীরে কেঁপে ওঠে)
আমি তো আপস করিনি। আমি তো লাশ হয়ে গেছি। তবু কেন আমার মৃত্যু এখনো অশান্ত করে তোমাদের?
(পাথরের ঢিবির কাছে গিয়ে বসে পড়েন। হাত দিয়ে লাল পতাকা ছুঁয়ে বলেন)
এই পতাকাটাই তো ছিল আমার শ্বাস। কিন্তু আজ... আজ এই পতাকাটাও ক্লান্ত। এখন শুধু রঙ আছে, আদর্শ নেই। শ্লোগান আছে, লড়াই নেই। আমি কি ভুল করেছিলাম? ভুল পথে গিয়েছিলাম? না কি সময়ই আমার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল?
(এক এক করে নাম উচ্চারণ করেন, যেন ডাকছেন)
কমরেড মাও...
আপনি বলেছিলেন জনগণই আসল শক্তি— কিন্তু এখন জনগণ নিজের ঘরে তালা দিয়ে বাঁচে।
লেলিন...আপনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণহীন সমাজ— কিন্তু এখন শোষণ শুধু উন্নয়নের মুখোশে লুকায়।
মার্কস...আপনি বলেছিলেন ইতিহাসই শ্রেণিসংগ্রামের মাঠ— এখন ইতিহাসও কর্পোরেট মিডিয়ার বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে।
শেখ মুজিব... তুমি বলেছিলে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—কিন্তু সেই স্বাধীনতা কি এখন বাজারের চুক্তিপত্রে লেখা?
(ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যান। হাতে নিজের নাম লেখা এক টুকরো কাপড় তুলে ধরেন)
আজ আমি আমার নাম রেখে যাচ্ছি এই পতাকার নিচে। এটাই আমার কবর। এটাই আমার শেষ বিপ্লব।
আমি, সিরাজ সিকদার, নিজেকে আজ মৃত ঘোষণা করছি।
আমার জন্য চোখের জল নয়। আমার জন্য শোক নয়। আমার জন্য প্রয়োজন— একটা সত্যিকারের জাগরণ। তোমরাা যারা আমার পূর্বসূরি— তোমরা যারা আগুন হাতে পথ দেখিয়েছিলে— এসো... আমার সৎকার করো।
কমরেড মাও...
কমরেড লেলিন...
কমরেড মার্কস...
কমরেড মুজিব...
এসো, আমার কাঁধে কাঁধ রাখো। আমার লাশটাকে তুলে নাও। আর যদি পারো—নতুন করে এক বিপ্লব শুরু করো।
(আলো ধীরে ধীরে নিভে যায়। দূর থেকে ধীরে ভেসে আসে একটি শ্লোগান—অস্পষ্ট, ঘোলাটে, যেন অতীত থেকে ফিরছে।)
‘জনগণ যেন জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়...’
-সমাপ্ত-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন