রাজনৈতিক সংস্কৃতি, কবির বহুমাত্রিক জীবন ও বিরোধিতার রক্তবীজ - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯

রাজনৈতিক সংস্কৃতি, কবির বহুমাত্রিক জীবন ও বিরোধিতার রক্তবীজ

কবি যদি ডাকাত হয় তবে সে নিরপরাধী, যদি খুনিও হয় তবুও সে নিরপরাধী। কবি প্রতিনিয়ত নিজেকে শাস্তি দিতে দিতে গভীর ক্ষত তৈরি করে রাখেন, নিজেকে জেলবন্দী করে রাখেন, নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেকে হত্যা করে থাকেন। একারণে তিনি থাকেন সকল অপরাধের উর্দ্ধে। কবিরা ছুঁয়ে দিলে প্রেমে পড়ে মানুষ, কবিরা তাকিয়ে থাকলে কর্কট রোগও সেরে যায়, কবিরা খিস্তিখেউড় করলে ভারতমহাসাগর পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু কবি যখন কাঁদে পৃথিবী তখন বোবাঘাস হয়ে যায়...

ভূমিকার অন্তরালে: সরীসৃপের মতো জীবন কবির নয়

কবিদের অদৃশ্য থাকা উচিৎ, হাতের নাগালের বাইরে থাকা উচিৎ। কেউ যেনো ধরতে না পারে, ছুঁতে না পারে, ভালবাসতে এবং ঘৃণা করতে না পারে। পাঠক যেনো কবিকে না দেখতে পারে, খুঁজে না পায়। পাঠকেরা কবিকে না পাওয়ার বেদনায় অযুত বছর অপেক্ষা করবে, ছুঁতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করবে। কবির কাছে যেতে তুমুল মৃত্যুর আতিথিয়তা গ্রহণ করতে চাইবে, তবুও কবি নিরুদ্দেশ থেকে ফিরবে না। পাঠকেরা নিজের চুল ছিড়তে ছিড়তে কবির নাম যপ করবে, সূর্যের দিকে টানা তিনদিন চোখ রেখে বলবে কবি তোমাকেই ভালোবাসি। তারপরেও কবি থাকবে নিরুত্তর। কেননা স্রষ্টা চিরকালই অদৃশ্য থাকেন, নিরুত্তর থাকেন এবং অপ্রকাশিতও বটে!

ছদ্মবেশি ঘাতকের জীবন কবির নয়, সরীসৃপের মতো জীবন নয়, প্র্রাতিষ্ঠানিক সদর দরোজায় করাঘাত করা কবির কাজ শুধু নয়, তেমনি টয়লেট পেপারে কবিতা ছাপানোও কবির কাজ নয়। তাহলে কবির কাজ কি? কবিতো চিরকালই ক্ষুধার্ত থাকেন সুন্দরের, বিষয়ের ও বিষ্ময়ের, সময়ের কিংবা সংকটের। তিনি সবর্দা ক্ষুধার জন্য প্রকৃতিতে তাহার আহার খুঁজবেন, জীবনের নানান অনুষঙ্গে, তার দৃষ্টির গভীর উপলব্ধিতে। তিনি বিষয় থেকে বিষয়ে ঘুরপাক খাবেন। নিজের পথ হারিয়ে নতুন পথ খুঁজবেন। কখনো পথের ভেতরে নিজেকে হারিয়ে তুমুল হৈচৈ বাধিয়ে দিবেন।  দৈত্যদানবের মতো দাপিয়ে বেড়াবেন পুরো পৃথিবীজুড়ে, কখনো কখনো পৃথিবীকে এতো তুচ্ছ মনে করবেন তা যেনো শস্যদানার মতো হাতের তালুতে খেলা করে। কবি মাত্রই ঈশ্বরের প্রতিরূপ। ঈশ্বরের মতো কবিরা খেলা করে তার সৃষ্টি নিয়ে। শব্দগুলো দিয়ে সাজান বহুমাত্রিক অনুভূতির সরল রেখা। পাঠকেরা সেই সব অনুভূতিতে আক্রান্ত হতে থাকেন। তখন তাদের চিন্তার ভেতরে ঢুকে পড়ে এক নতুন জগত, নতুন বিষয়, নতুন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া, নতুন জীবনের গান। সেইসব মুহূর্তে কবি নিজেকে নির্মাণ করেন নতুন কোন সময়ের স্রষ্টা হিসাবে। তিনি প্রতিনিয়ত তার সৃষ্টির পদমূলে প্রার্থনা করতে করতে নিজেকেই তার সৃষ্টির ভেতরে বিণাশ করে হয়ে যান। এক অদৃশ্য শক্তিতে কবি নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকেন, পুড়িয়ে মারতে থাকেন, প্রতিনিয়ত নিজেকে শাস্তি দিতে দিতে গভীর ক্ষত তৈরি করে রাখেন, নিজেকে জেলবন্দী করে রাখেন, নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেকে হত্যা করে থাকেন। একারণে কবি থাকেন সকল অপরাধের উর্দ্ধে।

বহুমাত্রিক জীবন কিংবা পাঠকের প্রতি উপাসনা:

কবিদের কোনো চরিত্র থাকতে নেই। চরিত্র থাকাটাই অন্যায়। কবি তো একটি মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু কবিতা লিখেন না। বহু মুখ, বহু চরিত্র, বহু দর্শন, বহু মুহূর্ত তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এক জীবনানন্দ দাশই তো কেবল নারী আর বাংলার রূপে মুগ্ধ থাকতে পেরেছেন। এটা কেবল জীবননান্দ দাশ বলেই হয়তো সম্ভব। কবি মূলত বহুমুখি, বহুগামী। অবাঞ্চিত কিংবা অপ্রত্যাশিত চরিত্রগুলো কবির ভেতরে খেলা করবে। পাঠককে উপাস্য করে চরিত্রধারন করা কবির জন্য চরম অপমানের বিষয়। সেইসব পাঠককে তুচ্ছজ্ঞান করবেন যারা চকচকে এবং তরল ভাষায় জর্জরীত। সেইসব পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করে কবি থাকবেন ভয়ঙ্কর একাকী-একরোখা-বিচ্ছিন্ন। তিনি তার স্বভাব ও প্রকাশে থাকবেন এক উজ্জ্বল ও স্পষ্ট ধ্রুবতারার মতো। কোথায়, কিভাবে, কেনো তার প্রকাশ ঘটবে এটা কবিমাত্রই নির্ধারন করবেন। কবি তার পাঠককে চিনে থাকবেন, তাদের পাঠের রুচি মাপকাঠি তার কাছে থাকতে হবে। যে কবি বিশ্বাস রাখবেন লুতুপুতু বা সারল্যতা তার ভাষা নয়, চকচকে শরীর, যত্রতত্র প্রকাশের ঠিকানা তার নয়, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বেদনায় পুড়তে থাকে না যে কবি সে কবি নির্মোহ জীবনের উদাহরণ। তার পাঠকেরাও নির্মোহতাকে ধারন করেন, শুধু ভেসে যাবার জন্য এ পাঠকেরা আসে না, আহা-উহু সর্বস্ব ধারনা নিয়ে এই পাঠকেরা জন্মায় না।

বহুমাত্রিক জীবন, পরিবেশ ও ধারনা নিয়ে একজন কবি হেঁটে যায় তার নিজস্ব কক্ষপথে, তার শব্দের ব্রক্ষ্মান্ডে তিনি ওঁৎপেতে থেকে নির্মাণ করতে থাকেন অন্তর্গত উপলব্ধি। সেই বোধ বোধের বিষয়বস্তু পাঠক নিংড়ে বের করে তৃপ্ত থাকেন, সেখানেই কবি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পান। কবি টের পান তার প্রতিটি অক্ষরের চিৎকার, শব্দের আনন্দ-বেদনা, আর ভাষার সুনির্দিষ্ট অবস্থানের। শূন্য থেকে তুলে আনা উপলব্ধি পাঠকের ভেতরে ছুড়ে দিয়ে পাঠককেও নিয়ে যান অসীম এক শূন্যতার দিকে, জীবনের দিকে, কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন বিবর্ণ প্রশ্নের ভেতরে, কখনে সংকটে-সংগ্রামে পাঠককে নিয়ে যেতে বাধ্য করবেন একজন কবি। একজন কবির স্বভাবই উদ্বাস্তুর মতো। স্বদেশের স্বভূমে থেকে তার দৃষ্টি উড়ে বেড়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, জাগতিক চেতনারও অনেক বাইরে কিংবা তার থেকেও বহুদূরে। এই দূর দৃষ্টি দিয়ে পাঠকের জন্য তুলে আনেন কল্পনা-অকল্পনা ও চিন্তার যৌক্তিক বা অযৌক্তিক নানান যোগসূত্র। সংগত কারণে কবি খুব সহজে ঢুকে যান পাঠকের গভীরে-চিন্তায়-চেতনায়। কবি ও পাঠকের ভেতরে তৈরি হয় এক অদৃশ্য সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের সূত্রে যুগযুগ ধরে পাঠক তার ভেতরে গেঁথে রাখেন এইসব সম্পর্কের পরিণতি। কবি ও পাঠকের এই সম্পর্কের হয়তো কোনো নাম থাকে না, কিন্তু পরষ্পরের প্রতি জন্ম নেয়া অবিচ্ছিন্ন অনুভূতিগুলো জীবনের গতিপথ বদলে সৃষ্টি করে অচেনা অজানা পথ যা সৃষ্টি ও সুন্দরের প্রতি নিমগ্ন থাকে চিরকাল। যদিও কবিতার প্রতি পাঠকের এই তুমুল আগ্রহের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানাই আছে। তবুও বলা যেতে পারে কবির সৃষ্টির শক্তি এতোই প্রবল যে পাঠকের দরোজায় ভীষণ আঘাত করে ঢুকে যায় তার অন্দরে আর তছনছ করতে থাকে তার ধ্রুপদী জীবন, আর তখন কবি তার যথাযথ প্রপাককে ঠিকঠাক খুঁজে বের করে আনেন। অন্ধকার থেকে অন্ধকারে, আলো থেকে আলোয়, শূন্যতা থেকে শূন্যতায় যে কবির অভিযাত্রা সে কবি অন্ধকার-আলো-শূন্যতার ভেতরেও সমুজ্জ্বল জীবন ধারন করে থাকেন। পরিবর্তনশীল ভাষা ও সময়ের আয়ুরেখায়ও তিনি থাকেন অতি উজ্জ্বল গ্রহের মতো এবং চলমান ক্রিয়াকলাপের ভেতরে সংযুক্ত থাকেন। এই ক্রিয়াকলাপের ভেতরেও পাঠক খুঁজে পান তার প্রয়োজনীয় ভাষা, এই ভাষাপুঞ্জে পাঠকের অংশগ্রহণে কবি ও পাঠকের ভেতরে এক ঐশ্বরিক সম্পর্ক  স্থাপিত হয়।

অনিবার্য ভাবে বলা যায় যে, কবির যে নান্দনিক নির্মাণশৈলীতে পাঠক মুগ্ধ থাকেন, পাঠক যে ভাষাশিল্পের কাছে নতজানু হতে থাকেন এবং তা শুধু আনন্দ নয়, আহা-উহু করার কারণ নয়, চেয়ে থাকার বিষয় নয়, বিনিময়ও নয় বরং প্রয়োজনটাকেও খুঁজে নিতে সক্ষম হন, সেই কবির সাথে পাঠকের সম্পর্ক খন্ডকালীন নয়, তা চিরকালীন। এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই কালে কালে কবি তার লেখায় পরিবর্তন ঘটান, নিজেকে কখনো কখনো ভেঙে ফেলেন। আবেগ অনুভূতির নৈমত্তিক ঘরণা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ভাষার বহু ব্যবহার, শব্দের বহুমুখি ক্রীড়া, কখনো কখনো ভয়াল নিষ্প্রাণ অসুরের মতো আক্রমণ, আগ্রাসী স্বভাবে ব্যকারণকে তছনছ করে, প্রথাগত নির্মাণ ও জীবন ব্যবস্থাপনাকে টুকরোটুকরো করে, রাষ্ট্রিয় সংকটে রাজনীতির ঘেঁটি ধরে টান মারাসহ নানান বিষয়ের দিকে কবি ঝুঁকে পড়েন। আর পাঠককে তিনি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান এইসব যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন থেকে, তাদের ভেতরে বপন করতে থাকেন মুক্তি ও প্রয়োজনের রক্তবীজ। 

রাজনীতি, মুক্তি ও প্রয়োজনের রক্তবীজ

কবি কি শুধুই সুখসম্ভোগ উপভোগ করেন? কবি কি রাষ্ট্রিয় সকল চিন্তার উর্দ্ধে? রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে কবি কি নিজেকে কিংবা তার সৃষ্টিসত্ত্বাকে দূরে রাখেন? কবি মননের সঙ্গে চলমান সমাজবাস্তবতার দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত কবিকে নাড়া দেয়? তার চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়? সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়ে তার কবিতায়? এসব নানান প্রশ্নে একজন কবিকে জর্জরীত হতে হয়। আবার অনেক কবিই এইসব জটিলতা থেকে নিজেকে সর্বদা দূরে রেখে তার সৃষ্টির ভেতরেই নিমগ্ন থাকেন। তারা বাইরের অচ্ছুৎ কদাকার জীবনকে ঘরে টেনে আনতে চান না, বাইরের ঝড়ঝাপটায় ঘরের কপাট বন্ধ রাখেন। সে কারণে সমাজবোধ ও সচেতনতার বোধ তাদের ভেতরে খুব বেশি জেগে ওঠে না। গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষার দিকে নিজেদেরকে তারা ছুড়ে দেন না। যারা কবিতার রাজনীতির ভেতর দিয়ে কবির অবস্থান বা কবির রাজনীতিকে খুঁজে পেতে চান তারা কখনো জাতীয় সংকটে, সংগ্রামে, সত্যবস্থানের প্রশ্নে ও চরমমুহূর্তে এই ধারার কবিকে খুঁজে পাবেন না এটা এক প্রকার নিশ্চিত। কেননা তারা কেবল ফুল-পাখি-নদী-চন্দ্র-তারা-সূর্যের ভেতরেই নিজেদেরকে আটকে রেখেছেন। এ থেকে মুক্তির পথ তারা কখনো খোঁজে না এবং পাঠককেও কোন পথ দেখায় না এবং গণমুক্তির নুন্যতম আকাঙ্ক্ষা কখনো তাদের অমোঘ শক্তি হিসাবে কাজ করে না বিধায় তারা কেবল রোমান্টিসিজমে ভূগতে থাকেন। শুধুমাত্র নৈসর্গিক প্রেম ও প্রকৃতিকে পুঁজি করে খন্ডকালীন সময়ের জন্য পাঠকের হৃদয়ে বন্দী থাকেন। হাহাকার বেদনাক্লিষ্ট আর অপলক চেয়ে থাকার ভেতরেই তারা কবিতার উপকরণ খুঁজতে থাকেন আর স্পর্ধা হারিয়ে নিজেকে তরল কবিতার নির্মাতা হিসেবে নিজেদেরকে প্রকাশ করতে থাকেন। 

সর্বহারা মানুষের সাথে ঐক্য আর শোষন-বঞ্চনার বিরুদ্ধ অবস্থান প্রকৃত কবির সহজাত স্বভাব। দ্রোহ ও মুক্তির জন্য কবি বিচলিত থাকবেন, যন্ত্রণা-আর্তনাদ-সন্ত্রস্ততার বিপরীতে শিরদাঁড়া টানাটান করে কবি দাঁড়িয়ে থাকবেন জ¦লন্ত সূর্যের দিকে চোখ রেখে। কবিতার শরীরে যুক্ত করবেন বৈষম্যহীন ব্যবস্থাপনার সরূপ। নিপীড়িত জনগোষ্ঠির কান্না শব্দ, সাম্প্রদায়িক অনাচার, রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘটে যাওয়া সামঞ্জস্যহীন বিষয়, সম্প্রীতি বিনষ্টের চিত্রগাঁথা থেকে মানুষের মুক্তির জন্য কবি সর্বদা সক্রিয় থাকবেন। অধিকারবঞ্চিত মানুষের মিছিলে কবিতার শব্দরা হেঁটে বেড়াবে, কবিতার ভাষারা উচ্চারিত হতে থাকবে অগণন যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। আমাদের রূপহীন মধ্যবিত্ত চরিত্রের ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্যে যে দ্বান্দ্বিক রূপ, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার জন্ম হয় সেটা তো রাজনৈতিক বঞ্চনার কারণে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। আর এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের গতিপথ হারাতে হারাতে অন্তর্মূখি স্বভাব নিয়ে বিকশিত হতে থাকে, এ থেকে মুক্তির জন্য একজন কবিকে সময়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে হয়। ফলশ্রুতিতে কবিতার চরিত্র ও ভাষাও সম্পুর্ন রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদী বিশ্বের আগ্রাসন, মিডিয়ার দৌরাত্ম্য, বিজ্ঞাপনের কালো চশমার বিপরীতে কবিতাকে মুক্তি দেয়া জরুরী।  শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষ যখন বৈষম্যে আক্রান্ত, অর্থনীতির মুক্তি যখন কুক্ষিগত, মানবিক বোধ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে গণমানুষের অসহায়ত্বে প্রকৃত কবি কখনো নীরব থাকতে পারেন না বলেই তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নিরিখে তারাও শব্দশিল্পে প্রতি আক্রমণ করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তখন তাদের কবিতার ভাষা তরলের পরিবর্তে কঠিন শিলাখ-ের মতো, অলংকরণের পরিবর্তে প্রতিঘাত, সহজ ও প্রাণবন্ত ভাষা ছেড়ে প্রতিরোধ আর প্রতিজ্ঞায় তারা ধারন করেন বিচিত্র গভীর এক অনাড়াম্বর ভাষা। তখন তারা ফুলের ঘ্রাণ নিতে ভুলে যায়, পাখির ডানায় উড়ে যাওয়া থেকে আরো বেশি মাটিবর্তি হয়ে যান, নদীর কলকল স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার পরিবর্তে তুমুল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েন কূলে-উপকূলে আর আগ্রাসী জলের তোড়ে ভাঙতে থাকেন নদীবর্তি উপমা কিংবা সারল্য জীবন যাপন। মৃত্যুকেও তুচ্ছজ্ঞান করে কবি একাই লড়াই করতে থাকেন অন্যায়ের উত্থানের বিরুদ্ধে। সংকীর্ণতার সীমাবদ্ধতায় কবি কখনো নিজেটে আটকে রাখতে পারেন না বলেই তিনি হয়ে ওঠেন এক অপ্রতিরোধ্য ভাষার বিনির্মাতা। যেহেতু কবিতা বিনোদন নয় নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যাপার, সেহেতু মুক্তির পথরেখায় কবিতাও কখনো কখনো হয়ে ওঠে নির্মম এবং অনবদ্য থাপ্পড় মারতে থাকে সংকট সৃষ্টিকারীদের মুখ বরাবর। শুধু শৈল্পিক দায়বদ্ধতায় কবি নিজেকে নিমজ্জিত না রেখে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করাও জরুরী বিষয়।

কবি যখন এসব ছেড়ে শুধুমাত্র অরাজনৈতিক হয়ে ওঠেন তখন দেশাত্মবোধের সংকীর্ণতায় স্টাবলিশমেন্টের সুবিধাভোগীদের শক্তি যোগায়। সকল স্টাবলিশমেন্ট তখন শিল্পের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যেতে থাকে, আর গণমানুষের ভাষা, জীবনযাপন অর্থনীতির মুক্তির পথ ক্রমাগত কুক্ষিগত হতে থাকে। সময়ের প্রয়োজনে কবিকেও হয়ে উঠতে হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানসিকতাবোধ সম্পন্ন। বাংলা ভাষার কবিতা ইতিহাসের পরম্পরায় জীবনযুদ্ধ ও বাস্তবতার উপর ভর করে তার প্রতীক ও চিত্ররূপেও বারবার উচ্চকণ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় মুক্তির ও গণমানুষের অধিকার তাৎপর্যময় করে তুলতে সামাজিক রাজনীতি ও সাংস্কৃতির ভেতরে অমোঘ শক্তির সঞ্চারে প্রকৃত কবি তার সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তার অবস্থান নিশ্চিত করেন। কবিতাকে প্রচন্ড বাস্তবমুখি ও গণচেতনামুখর করে তোলা, রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি কবিতাকে টানটান করে দাঁড় করানো, অগ্নিবলয়ের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি, স্টাবলিশমেন্টের ভোগ্য পণ্যের মতো স্বীকৃতি ও প্রচারণার বিরোধিতায়, ধনতন্ত্রমুখি আস্ফালন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিপক্ষে, ক্ষমতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পনের বিরুদ্ধাচারণে, ভোগবাদী চেতনার মোহাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি দিতে একজন কবি অবশ্যই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতরে গড়ে তুলবেন তার নিবিড় বসবাস।     

বিরোধিতার ভয়াল স্পর্ধা অথবা বিচ্ছিন্নতার ভয়াল দংশন  

মানুষের উপর যে শক্তি তার ইচ্ছামাফিক প্রভাব বিস্তার করে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার ক্ষমতার বিস্তার ঘটায়, ক্ষমতার চাপে সেই মানুষগুলো যখন নিজেকে খুঁজে পায় না কিংবা নিজেকে মুক্ত করতে পারে না এই গ্রাস থেকে তখন সে নিজেই নিজের ভেতরে এক পরাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে থাকে। নিজের ভেতরে প্রচন্ড অসহায়ত্ব বোধ করে এবং সে খুঁজতে থাকে তার অনিবার্য মুক্তির পথ। নিজেকে নিজের ভেতরে স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে তিনিও পাল্টা প্রবল চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। বিরোধিতার স্পর্ধায় তিনি নিজেকে নতুন কোনো শক্তিরূপে প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু কেনো এই বিরোধিতার পাটাতনে একজন কবি নিজেকে প্রকাশ করবেন? কেননা, কবি এই সামাজিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে সে তার সৃষ্টিশীল ক্রিয়াকর্ম চালাতে থাকেন। কিন্তু সংষ্কৃতিক বিবেচনায় মিডিয়া ও অর্থনীতির কূটকৌশলে দূর্বৃত্তের যে অভ্যূত্থান ঘটেছে ধর্ম সামাজিক রীতিনীতি ব্যক্তিগত জীবন যাপনে তার আসু পরিবর্তনের জন্য কবিকে দৃঢ়চিত্তে এসব দূর্বৃত্তায়নের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। কেনোনা একজন কবি তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে নির্বিঘ্নে ঢুকে যেতে পারেন মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। আদর্শিক জায়গা থেকে তিনি নতুন পথের সন্ধান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সমাজের বৃহত্তর শ্রেণী হচ্ছে মধ্যবিত্ত যা অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বায় ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরিপোষণের মাধ্যমে এই শ্রেনীর সূত্রপাত ঘটেছে। সাংস্কৃতিক পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এই শ্রেণীর মননকে, ফলে সংকীর্ণ মানসিকতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পিছুটান, কিছু করতে না পারার আক্ষেপ, কিছু হয়ে উঠতে না পারার যন্ত্রণা, রুচির অধঃপতনের কারণ হয়ে উঠেছে। এই শ্রেণীর মননকে জাগ্রত ও তাদেরকে রুচির পরিবর্তনের জন্য কবি তার সৃজনীর মাধ্যমে তাদের মননে গেঁথে দিবেন নতুন কোন বীজমন্ত্র। ধনীক শ্রেণী তাদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য এবং মধ্যবিত্তের মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেবার জন্য বিভিন্নপন্থা অবলম্বন করে থাকেন। যারা বা যে সমস্ত কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মি মধ্যবিত্তের মননকে জাগ্রত ও সচল রাখার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুঁজিবাজার কর্তৃক বিভিন্ন পদক, সম্মাননা, সংবর্ধনা, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দপ্তর পরিচালনার ভার, সাহিত্যের মাফিয়া, বাজার উপযোগী লেখক সৃষ্টি, তরুণ লেখক প্রকল্প, প্রকাশনার সিন্ডিকেট, সাহিত্য বাজারজাতকরণের বিভিন্ন এজেন্সি সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন প্রকৃত কবি তার আদর্শিক জায়গা থেকে কখনোই এসব জননিয়ন্ত্রণহীন প্রতিষ্ঠানের কাছে দারস্থ, আত্মস্বীকৃতির জন্য পদক বা সম্মাননা গ্রহণ, বাজারের চাহিদা মোতাবেক পন্য উৎপাদন, কালোবাজারীদের হাতিয়ার দৈনিক পত্রিকা লেখা প্রকাশ, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া নিজেকে সস্তাদরে উপস্থাপন করতে পারেন না। প্রকৃত কবি সর্বদা এসবের বিরোধিতা করে সক্রিয় থাকবেন। কেননা পূর্বেই বলেছি কবির কোন মোহ থাকতে নেই। কবির কোনো মোহ থাকে না। কবি যখন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন তখন তিনি আর কবি থাকেন না শুধুমাত্র একজন ‘কাঠামোগত মানুষ’ কিংবা ‘বাজারী কবি’ হিসিবেই তিনি বিভিন্ন ভাবে চিহ্নিত হতে থাকবেন। এই বিরোধিতায় একটি শক্তিশালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি করা প্রয়োজনে কবি বা লেখকের ভাবনা-চিন্তায় পাঠকের মনোবৃত্তি বিকাশের সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করার যে দায়ভার তৈরি হয় তা তিনি কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। আমাদের দেশে বৃহৎ অংশের লেখকগণ সর্বদা এই দায় এড়াতে চান বা এড়িয়ে যান ফলে হয়তো তারা নিজেকে সমৃদ্ধি করে আত্মতুষ্ঠিতে ভূগে থাকেন, বাজার থেকে খরিদ করা বিভিন্ন পদক-সম্মাননা আর পদবীতে নিজেকে আলোকিত করে রাখেন। অপরদিকে এই আলোকিত হবার চেষ্টরত লেখকগণ নিজের অগোচরেই একটি বেগমান পরিবর্তনের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করতে থাকেন এবং আত্মসাৎ করতে থাকেন মধ্যবিত্তের মননের বিকশিত হবার প্রক্রিয়ার সমস্ত সৃজণশীলতাকে। প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব মেনে তারা হয়ে যান নির্বিকার সৃজণশীল মানুষ। তাদের কিছু করার থাকে না, তাদের কলম বধির হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, প্রথাবিরোধী লেখক চিরকাল শিরদাঁড়া টান করে তার সর্বোচ্চ অনুভূতির বিক্রিয়া ঘটাতে ঘটাতে এক সতেজ সচল রুচিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরিতে চুড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করেন এবং অনিবার্যভাবে তার পাঠককে প্রস্তুত করেন আধিপত্যবাদ, মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতার ভয়াল দংশন, সম্পর্কের বিশ্বাসহীনতা, প্রাণহীন সুন্দরের মতো জটিল প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। কবি বা লেখক যখন প্রতিষ্ঠানের আজ্ঞাবহ থাকেন তখন তিনি অনেক কিছু গিলতেও পারেন না, সহ্য করতেও পারেন না। এমন এক অদ্ভুত বিষয়ে নিজেকে অস্থিতিশীল করতে করতে একপর্যায়ে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েন। তিনি একবার পেছনে যাবার চেষ্টা করেন, একবার সামনে যাবার চেষ্টা করেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি কোথাও যেতে পারেন না, একই জায়গায় স্থির থেকে বছরের পর বছর খাবি খেতে থাকেন। নদের চাঁদের মতো ব্যাঙ খেয়ে তিনি আর কখনো কুমির থেকে মানুষ হতে পারেন না বলেই- প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি সেজে বিভিন্ন সংবর্ধনার মঞ্চে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। একপর্যায়ে আপদমস্তক কবি বা লেখক হবার জন্য চরম সংগ্রাম করতে থাকেন নিজের সাথে। 

এই অন্তঃসারশূন্য আপদমস্তক কবি-লেখক কেবল নন্দনশৈলিতে নিমজ্জিত থাকেন বলে খোলস ছেড়ে কখনো বিষয়ে-ভাবনায়-চিন্তায় বেরিয়ে আসতে পারেন না। তিনি সর্বদা রাষ্ট্র-সমাজ-জনগণের প্রতি দ্বিধাগ্রস্থ, শঙ্কা, অনগ্রসর, দায়িত্বহীনতা, বিশ্বাসহীনতায় ভূগে শুধুমাত্র আপদমস্তক কবি-লেখক পরিচয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। একজন কবি যখন দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন তার সৃষ্টির প্রতি এসব হীনমন্যতা, দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিপরীতে একধরনের বিরোধ তার ভেতরে জন্ম নিবে স্বাভাবিক। এই বিরোধিতার আশ্রয়ে তিনি যেমন নিজে পথ তৈরি করবেন তেমন তার দায়িত্বে প্রতি অবিচল থেকে মানুষের জন্য মসৃণ পথের নির্দেশনা তিনি রেখে যাবেন। প্রাতিষ্ঠানিক সেইসব ব্যবস্থাপনা যা মানুষের উপর তার আকাক্সক্ষা চাপিয়ে দেয়, সে শক্তিকে লেখক তার টেক্সট দিয়ে ক্রমাগত খর্ব করতে থাকবেন। যুগযুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রতিষ্ঠানের সকল শক্তি (পড়ুন অপশক্তি) বিরুদ্ধে এবং আপনি যখন এসব শক্তিকে টেনে মাটিতে নিয়ে আসবেন, ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক আঘাত করতে থাকবেন, নিঃসন্দেহে আপনি তখন ঐ সকল প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের লোকের চোখে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রধান লক্ষ্য যখন বিশ্লেষাত্মক মনোভঙ্গি, স্বত:স্ফুর্ত মোহত্যাগ, আত্মবিস্তৃতির শক্তির সক্রিয়তায় নিজেকে এবং নিজের সৃষ্টিকর্মকে সদা প্রস্তুত করে জনগোষ্টির জন্য সমক্ষেত্র তৈরি করা তখন একজন লেখক প্রাতিষ্ঠানিক আজ্ঞাবহতায় নিজেকে কোনোভাবেই সপে দিতে পারেন না। কেননা, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাই হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের প্লাটফর্ম। যা কোনো জনবিচ্ছিন্নতা নয়, অন্ত্যজশ্রেণীর বিষয় নয়, জীবন ঘণিষ্ঠ ও জনসম্পৃক্ততার বিষয়। সহজাত মধ্যবিত্তের জীবন ও মননের সমসাময়িক অবস্থানের আমুল পরিবর্তনের পক্ষে এই বিরোধিতা। একজন কবি বা লেখক মধ্যবিত্তের মননে বিরোধিতার যে বীজ ঢুকিয়ে দেন ক্রমশ তা সমষ্টিগত হয়ে পড়ে আর ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সদরে-অন্দরে।   

- শাফি সমুদ্র







Pages