ত্রিকোণান্তরে অযোনি, নিষ্ক্রিয়ধী আর আমি || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০২৫

ত্রিকোণান্তরে অযোনি, নিষ্ক্রিয়ধী আর আমি || শাফি সমুদ্র


আমাকে তুমি অপরাধী ভাববে না। আমি নই এবং তুমিই সেই লোক, যাকে এমন অনুরোধ জানানো হাস্যকর। কারণ তুমি নিজেই এক রাষ্ট্রের প্রতিভূ অথবা তার নিঃশব্দ সমর্থক অথবা হয়তো কৌতূহলী এক শ্রোতা। তবুও বলি, আমি অপরাধী নই। আমার কোনও মামলা নেই, কোনো অভিযোগনামা নেই, এমনকি কোনও সাক্ষীও নেই। তবু আমি এই প্রকাণ্ড থেমে থাকা সময়ের ভেতরে একটি  সন্দেহের জগদ্দল শিলার নিচে চাপা পড়ে আছি। আমার এখানে আসার ইতিহাসের চেয়ে আমার এখানে থাকার বাস্তবতা অধিক গভীর, অধিক মৌলিক। আমাকে যারা নিয়ে এসেছিল, তাদের চোখে আমি ছিলাম অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এ সম্ভাবনা একটি হুমকির, একজন হয়ে ওঠার, যার ভাবনায় কাঁপতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্র। আমি কোনো মিছিল করিনি, কোনো অস্ত্র ধরিনি, কোনো ঘোষণা দিইনি। আমি কেবল কিছু ভাবতাম, মাঝে মাঝে লিখে রাখতাম, মাঝে মাঝে কারও সঙ্গে বিতর্ক করতাম নীরবভাবে, সঙ্গোপনে, ভেতর থেকে। সেই ভাবনাই কারও কানে গিয়েছিল অথবা হয়তো কানে যাওয়ার দরকারই ছিল না। রাষ্ট্র অনেক সময় জানে না কাকে ভয় পায়। অথচ সে ভয়কে বন্দি করে এটাই রাষ্ট্রের অঘোষিত ধর্ম।


‘জেলখানা’ এই শব্দটি বহন করে একধরনের প্রচলিত ভয়। তুচ্ছ মানুষদের কাছে তা এক ঘৃণার স্থান। কিন্তু আমি এই স্থানকে একেকদিন একেকভাবে উপলব্ধি করি। প্রথম দিন, যখন আমাকে ভিতরে ঢোকানো হচ্ছিলো, আমি অনুভব করেছিলাম একটি প্রকোষ্ঠ আমাকে গ্রাস করছে, সেই গ্রাস হিংস্র ছিল না । তার চোয়াল কঠিন হলেও তা কামড়ায়নি, কেবল ঘিরে ধরেছিল। আমি হাঁটছিলাম এবং আমার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন জমে থাকা সময়ের স্তরে বসে যাচ্ছিলো। ভেতরে ঢুকে প্রথম যে শব্দটি আমাকে স্তব্ধ করেছিল, তা ছিল নিস্তব্ধতা। হ্যাঁ, এক বীভৎস নিস্তব্ধতা, যা দিনের ভেতরেও অন্ধকারের মতো প্রগাঢ়।


আমার সেলটি এক কোণায়, দেয়ালের গায়ে স্যাঁতসেঁতে চুনকাম খসে পড়া। প্রথম দু-তিন দিন গন্ধ আলাদা ছিল। বিষাক্ত, ধাতব, ট্যাঙ্কির জলের মতো গন্ধ। কয়েকদিন পর সেই গন্ধ মিলিয়ে গেল বা আমি তার অংশ হয়ে গেলাম। এখানে সময় নেই, আবার সময়ই সবকিছু। ঘণ্টা বেজে ওঠে, কড়া নড়ে, প্রহরীরা হাঁকে, গুনে গুনে নাম ধরে ডাকে। প্রতিটি নাম এখানে একটি সংখ্যা, প্রতিটি সংখ্যা একটি ছাপ। আমি নিজেকে কখনো কখনো ‘আটত্রিশ নং’ বলে ভাবি, আবার কখনো ভাবি ‘আমি সেই, যার কোনো সংখ্যা নেই।’ আমি একা নই, এই জেলখানায় আরও শত শত, হাজারো মানুষের নিঃশ্বাস জমে আছে। তারা কেউ আমার মতো নয়। তাদের কেউ এসেছে ক্ষুধার দায়ে, কেউ রক্তের ইচ্ছায়, কেউ প্রতিশোধের গলায় বাঁধা পড়ে। আমি এসেছি নিছক একটা চিন্তার অভিঘাতে।


প্রতিদিন সকালে সেলের ভেতর সূর্য আসে না, কেবল একটা বিবর্ণ আলো দেয়ালের ওপর পড়ে। সেই আলো চিরদিন একই রকম। আমি জানি না এটি সকাল, দুপুর না বিকেল। এখানে ঋতু নেই, রং নেই, কেবল ছায়া। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটি দীর্ঘ, স্থির দন্ডবাঁধা সময়ের ভেতরে প্রবেশ করেছি একটি তীর্থ যাত্রার মতো। এই সেলটা এক উপাসনালয়, আমার ধ্যানস্থান, আমার তীর্থ। প্রতিটি দেয়ালের গায়ে লেগে থাকা কারুর আঁচড়। তাকে আমি পাঠ করি যেন বেদমন্ত্রের মতো। একেকটি দাগ যেন নিঃশব্দ আর্তি অথবা পাপের স্মৃতিচিহ্ন।


প্রহরীরা আমাকে ভয় পায় না। তবে আমার দিকে তাদের দৃষ্টিতে থাকে একধরনের অস্বস্তি। আমি খুব কম কথা বলি, প্রয়োজন হলে শুধু হ্যাঁ অথবা না বলি। আমি ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি না থাকার ভেতর থাকার অভিজ্ঞতায়। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় আমি এই জেলখানার পাথর হয়ে গেছি। যে পাথরে কেউ বসে, কেউ থুথু ফেলে, কেউ নাম কেটে রাখে, কিন্তু কেউ জানে না সেই পাথরও একদিন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আমি মাঝে মাঝে রাতের নির্জনতায় চোখ বন্ধ করে শুনি আকাশের ভেতরে একটা শব্দ উঠছে কি না কিংবা দূরের রেললাইন কাঁপে কি না। আমি জানি বাইরে কিছু নেই। আমার বাইরে নেই। আমার চারপাশে কেবল একটা স্তব্ধ ঘূর্ণিপাক। তার ভেতরে আমি ঘুরছি আর অনুভব করছি জেলখানাকে কেন আমি পবিত্র বলি। কারণ এখানে সবাই নগ্ন। কোনো মুখোশ নেই, কোনো সাজ নেই, কোনো বক্তৃতা নেই। এখানে মানুষ নিজেকে আর চেনাতে পারে না, কেবল নিজেকে চিনে ফেলে।


এখানে আমার পরিচয় বলে কিছু নেই। নেই কোনো ট্যাগ, নেই কোনো বক্তব্য। এখানে আমি কেবল একটি অস্তিত্ব, একটা স্পর্শযোগ্য নিরবতা। আর সেই নিরবতার মধ্যেই আমি বুঝতে পারি, বাইরে যা আছে, তা প্রকৃত নয়। সত্যটা হলো আসলে এই ঘরে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের নিঃশ্বাসের ওঠানামা। আমি ভাবি  এই অবস্থার মধ্যেই যদি কিছু সত্য জন্ম নেয়, তবে তা নির্জনতার ভেতরেই সম্ভব। সন্দেহকে যদি এক পবিত্র শুদ্ধির প্রবাহ বলা হয়, তবে আমিই তার প্রধান পুরোহিত। আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। এমনকি আমিও না, এই অবিশ্বাসের মধ্যেই জেগে আছে এক আশ্চর্য বোধ। জেলখানা আমার জন্য প্রায় এক সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। যেখানে আমি জন্ম নিয়েছি নতুন করে, সবকিছু ভেঙে গড়ে ওঠার এক নির্মম প্রকল্পে।


তবে এই একাকিত্ব বেশি দিন থাকে না। শীঘ্রই তাদের আগমন ঘটে। তাদের, যাদের আগমনে আমার নিঃসঙ্গতাকে কাঁপিয়ে তোলে আরেকটি গভীর সত্তা। তারা আসবে, কিন্তু একদিনে নয়, তারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে। তাদের অস্তিত্বকে টানবে জেলখানার পাথরের গায়ে। তারা আসবে—অযোনি আর নিষ্ক্রিয়ধী। তবে সেই আগমনের আগে আমাকে নিজের সত্তা প্রস্তুত করতে হয়।একটি স্রোতধারার মতো। যা এই দুই বিপরীতের মাঝে দাঁড়িয়ে নিরবতা রচনা করবে। এই আমি একদম নিরীহ নই, ভয়ানক নই, জ্ঞানী নই, মূর্খ নই । আমি কেবল একটি পক্ষ। এক শূন্যের মধ্যে শুদ্ধতা খোঁজার পক্ষ।


সে এসেছিল এক পূর্ণিমার আগে রাতে, যখন চারদিকে হঠাৎ জেগে উঠেছিল এক অদৃশ্য শব্দ। কোনো ঘুঙুর, না কোনো গুরুভার নুপুর, না কোনো প্রাচীন প্রহরের উচ্চারণে তা বলা মুশকিল। সে এসেছিল ধীরে, তবে অনিবার্যভাবে। তার আগমনের আগে আমার কারাগার চুপচাপ নয়, কেমন এক অলক্ষ্মী খচখচ করছিল। যেন বাতাস তীব্র হচ্ছে, দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আচমকা ধাতব তেজে পরিণত হচ্ছে, যেন জল নয়, রক্ত জমছে নর্দমায়, অথচ কেউ জানে না কোথা থেকে। এমন সময়ই তাকে আনা হয় হাতকড়া ও পায়ের শিকলসহ, তবুও সে হাসছিল।


তাকে বলা হলো, ‘অযোনি’। নামটি তার আসল কি না, কেউ জানে না এবং সে তা স্পষ্ট করেনি। নামটি শুনে আমি মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলাম। অ-যোনি—অর্থাৎ যে জন্ম নেয়নি কোনো জননদ্বার দিয়ে। যে এসেছে এক অন্ধকার চিড় ধরানো স্থান থেকে, যার উৎস নেই, ফলে যার দায়ও নেই। আমি জানি না, এই নাম তাকে দেওয়া হয়েছে নাকি সে নিজেই বেছে নিয়েছে। নামটি যেন তার শরীর থেকে ঘরে ঢুকে পড়া এক পুরোনো আগুনের ধোঁয়ার মতো ঘূর্ণায়মান হয়ে উঠেছিল। তার গায়ে ছিল এক প্রাচীন কাশ্মীরী চাদর। তবে তা আর চেনা রং ধারণ করত না। হলুদের ভেতর লেগে ছিল রঙচটা, রক্তের পুরোনো দাগ, ধূপের ধোঁয়া ও পচা গরুর মাংসের গন্ধ। তার কপালে ছিল এক উলম্ব শিবচিহ্ন। যা পাথর দিয়ে আঁকা মনে হয়, আলোর তলায় সে যেন হালকা নড়ে উঠত, স্পন্দিত হতো। তার চোখদুটি ছিল লাল নয়, অদ্ভুত ধূসর। সে চোখ এমন নয় যে ভয় দেখায়, কেমন এক বিরক্তি এবং বিরহ একসাথে ফুটিয়ে তোলে। যেন চেয়ে আছে এক নিষ্পাপ শিশুর দিকে যে তার অতীতের ভ্রষ্টতা বুঝে উঠতে পারেনি।


অযোনিকে আমার সেলের পাশের ঘরে রাখা হয়। একটি পুরোনো অন্ধকূপ, যাকে কয়েদিরা ডাকে তান্ত্রিক সিন্দুক বলে। কেননা সেখানে যারা থাকে তারা হয় পাগল নয় আত্মম্ভরিত জাদুকর, নয়তো ধর্মান্ধ হত্যাকারী। অযোনি এই তিনটি চরিত্রকেই একসঙ্গে ধারণ করত আবার একটিও নয়। প্রথম রাতে সে কোনো শব্দ করেনি। কিন্তু পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি শুনতে পাই এক অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ।  সংস্কৃত নয়, আরবি নয়, এমনকি বাংলাও নয়। যেন ভাষাহীন কোনো ভাষা। যার উচ্চারণ শুধু ধ্বনি, যার অর্থ নেই কিন্তু অভিঘাত রয়েছে। তার মন্ত্রের শব্দ গলে গলে আমার সেলের দেয়াল বেয়ে নেমে আসছিল। আমার গায়ে যেন কাঁটা দিচ্ছিলো না শুধু হিমে জমে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো কারা যেন ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না।


অযোনি মাংস খেত। রান্না নয়, কাঁচা, হাড়সহ, রক্তসহ। সে বলত, ‘রক্তে শুদ্ধি, হাড়ে শক্তি, চর্বিতে পূর্বজ।’ তার খাওয়ার সময়, কারাগারে যেন পশুদের হাঁকডাক শোনা যেত। যদিও চারপাশে কোনো গরু, ছাগল কিংবা কুকুর ছিল না। তার খাওয়া দেখলে মনে হতো সে খাচ্ছে  কোনো অভিশাপ বা পুণ্যের অংশ চিবিয়ে নিচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভীতিকর ছিল তার চোখের অনুপস্থিতি। আমি যতই তাকাতাম, ততই বুঝতাম, সে চেয়ে আছে কিন্তু কিছুই দেখছে না। সে যেন ‘দেখা’ শব্দটিকে ত্যাগ করেছে। তার দৃষ্টি ছায়া ছুঁতো না, আলোও না। মনে হতো সেই দৃষ্টিই পৃথিবী গড়ে নিচ্ছে নিজের মতো করে।


আমার সঙ্গে তার প্রথম কথোপকথন হয়েছিল দ্বিতীয় রাতে। আমি ছিলাম নির্জনে, তখনই দেয়ালের ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বরে ভেসে এলো—‘তুমি কি জন্মেছ?’

আমি থমকে গেলাম। উত্তর দিলাম না। প্রশ্নটা ছিল সরাসরি, অথচ আপাত অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু তাতে ছিল এক ধাক্কা। সে আবার বলল—‘আমি জন্মাইনি। আমাকে ডাকা হয়েছিলো এই পৃথিবীতে। পূর্ণিমার আগের রাতে। যেহেতু আমি জন্মাইনি, তাই মৃত্যুও আমার প্রযোজ্য নয়।’

আমি তখন বলেছিলাম—‘তাহলে তুমি কি ধ্বংসযোগ্য?’ সে হাসলো। সেই হাসি ছিল না রক্তচাপ বাড়ানো এক বেদনার বিকৃত ছায়া। সে বলল—‘আমি যখন বলি মন্ত্র, তখন সময় থেমে থাকে। যখন বলি ‘তৃ’, তখন আত্মা নিজের শরীর ছাড়ে। যখন বলি ‘ঘ্র’, তখন গন্ধ নিজেই জেগে ওঠে এবং আমাকে পথ দেখায়।’


তার এই অস্বাভাবিক ভাবনার পরতে পরতে ছিল এক পৈশাচিক নৈতিকতা। সে বলত—‘ন্যায় ও অন্যায় মানুষের তৈরি। কিন্তু যিনি জন্মাননি, তার কাছে সমস্তই সম্ভাব্য। আমি একজন রাজনীতিককে খুন করেছি। কারণ তার মুখ ছিলো ছদ্ম, তার হৃদয় ছিলো কল্পনা, তার হাত ছিলো প্রণামীতে ভেজা। আমি তাকে শাস্তি দিইনি, আমি শুধু তার ‘চিহ্ন’ মুছে দিয়েছি।’

অযোনির উপস্থিতিতে সময় আর নিয়ম একতাল হত। পাহারাদাররা তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিত। অন্য বন্দিরা তাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটত, যেন সে কোনো চিহ্নহীন প্রেত। শুধু আমিই মাঝে মাঝে তাকাতাম তার দিকে, নজরে নয়, ধ্যান দিয়ে।

সে বলত—‘তুমি এখানে আছো, কারণ তুমি বিশুদ্ধ। কিন্তু বিশুদ্ধতা যতক্ষণ না নিজেকে মলিন করে, ততক্ষণ সে বোঝে না শুদ্ধির প্রকৃত মুখ।’

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—‘তুমি কী বোঝো বিশুদ্ধতা বলতে?’

সে বলেছিল—‘যা নিজের ছায়াকে খেয়ে ফেলে, সে-ই বিশুদ্ধ। তোমার ছায়া এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু আমি জানি, পূর্ণিমার রাতে তুমি ছায়াহীন হবে।’


তার এই বাক্য ছিল আমার অন্তরে ছুরির মতো। অযোনির অস্তিত্ব আমার নিজের চিন্তাজগতে দ্বিধা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। সে ছিল না শত্রু, না বন্ধু। সে যেন এক দৈব অস্তিত্ব, যাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তবু সে এসে পড়েছে এবং ছায়া ছাড়িয়ে অনুপ্রবেশ করেছে আমার নির্জন সাধনায়। তার কাছে মন্ত্র ছিল অস্ত্র, মাংস ছিল আত্মা, পূর্ণিমা ছিল চূড়ান্ত পরিণতি। আমি তখনও জানতাম না, এই মানুষ নয়। এই অযোনি আমার ব্যক্তিত্বে এক অদ্ভুত দ্ধবিধা ছড়িয়ে দেবে, যা আর কোনো রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার নয়। এক পূর্ণিমা-নির্ভর নৈর্ব্যক্তিক যাত্রা।


আরেকজন এসেছিল এক বৃষ্টির সন্ধ্যায়, যখন আকাশের রং ছিল নীল নয়, ছাই নয়। কেমন এক কাঁচ-ফাটা আলোর মতো। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকেছিল এক মানুষ। যার শরীর ছিল অদ্ভুতভাবে শুদ্ধ। না রুগ্ন, না বলিষ্ঠ। এক নিরব উত্তাপ যেন তার শরীর ঘিরে রেখেছিল, অথচ কোনো সংবেদ তৈরি করত না। তার নাম ঘোষণা করা হয়নি। জেলখানার রেজিস্টারে তাকে লেখা হয় নিষ্ক্রিয়ধী। কেউ জানে না এ নাম তার প্রকৃত না রাজনৈতিক আত্মনাম।


আমি তখনও জানতাম না যে এই লোকটি, যাকে সামনে থেকে দেখে বোঝা যায় না তার বয়স পঁচিশ না পঁচাত্তর। সে হবে আমার স্বরহীন প্রতিবিম্ব। সে যে কথা বলে না, তার অর্থ এই নয় যে সে চুপ। তার চুপ থাকা এক ধরনের যুক্তি, এক ধরনের অপরাধবোধের নিঃশ্বাসহীন প্রতিবাদ। প্রথম সন্ধ্যায় আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সে তখন নিজের বিছানায় বসে, এক পাতলা খাতা খুলে রেখেছে কোলের উপর। সেটি ছিল না কোনো পাণ্ডুলিপি, না ডায়েরি। কেমন এক অপরিচিত ভবিষ্যৎকে লেখা গোপন চিঠির মতো। সে প্রতিটি পাতায় টানা আঁকতো কিছু চিহ্ন গোল, রেখা, অসম্ভব ক্ষুদ্র গণনা, আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন শব্দ।


রাষ্ট্রব্যর্থতা = জনতার অপ্রত্যাশিত অভ্যাস + নীতিহীন সহনশীলতা

যেখানে মুদ্রা চলে, সেখানে ঈশ্বর নিঃসঙ্গ

গণতন্ত্র একধরনের অ্যালজাইমার: প্রথমে ভুলে যায় কেন জন্মেছিল, পরে ভুলে যায় নিজের নাম


আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি কি দার্শনিক?’ সে বলেছিল, ‘না আমি একজন ভাঙা যন্ত্রের প্রযুক্তিবিদ। সমাজের সবচেয়ে পুরনো মডেলের রাষ্ট্রগুলো এখনো মানুষের বিবেক দিয়ে চালাতে চায়, তাতে শর্টসার্কিট হয়। আমি শুধু তাপ মাপি। কোথায় গন্ধ জমে, কোথায় প্রতিশ্রুতি পচে। আমি চিৎকার করি না, আমি শুধুই লক্ষ করি।’ তার কণ্ঠস্বর ছিল একধরনের ব্যস্ত নির্লিপ্তি। যেন সে আমার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে কথা বলছে না, নিজেকেই ব্যাখ্যা করছে, অজানা কোনো বিচারকের সামনে।


সে বলত—‘রাষ্ট্র’ কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই আমি তার ফলাফল জানতাম। তাই আমায় ধরেছে। বলেছে, আমি গোপন তথ্য পাচার করি। আসলে আমি ভবিষ্যৎ পড়ি এবং ভবিষ্যৎ কোনো তথ্য নয়, তা এক ধরনের অভিশাপ। তার ঘরে কোনো পবিত্রতা ছিল না, কোনো অশুচিও না। সে ছুঁত না জল, না ধূপ, না জপ। সে নীরবতা দিয়ে প্রতিদিনের চিৎকার মোচন করত।


তার কথা ছিল তীক্ষ্ণ, ঠান্ডা এবং প্রমাণের ঊর্ধ্বে—‘যে রাষ্ট্র নিজেকে দণ্ড দিতে পারে না, সে অপরাধী নয়, পুতুল। আর যারা সেই রাষ্ট্র চালায় তারা পুতুল সরকার’ কারাগারে সে ভয়ংকরও নয়, সে ছিল অস্বস্তির মতো, চামড়ার নিচে জমে থাকা প্রশ্নের মতো। রাত্রির গভীরে, যখন অযোনির মন্ত্র নিঃশব্দে ঘরে সরে আসে, তখন নিষ্ক্রিয়ধী তাকিয়ে থাকে পলকহীন চোখে। তাকে কেবল অনুসন্ধান করে যেন। অযোনির তান্ত্রিকতা আর নিষ্ক্রিয়ধীর ভবিষ্যদ্বাণী এই দুই স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি কাঁপতে কাঁপতে বুঝি, সময় একটি বৃত্ত নয়, সময় একটি দংশন।


তার দর্শন ছিল জৈব-নৈরাজ্যবাদী। সে বলত—‘মানুষের সমাজব্যবস্থা কোনোদিনই সামাজিক ছিল না। তাকে সামাজিক করতে চাওয়াই পুঁজিবাদের ছলনা। যে নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবে, সে-ই সমাজের মূল ভবিষ্যৎপাঠক।’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তুমি কি রাজনীতিকে ঘৃণা করো?’ সে বলেছিল—‘রাজনীতি কোনো ঘৃণার বিষয় নয়। এটা একটি ভাইরাস। যা প্রতিটি যুক্তি ও প্রত্যয়ের কোষে ঢুকে পড়ে। আমি ঘৃণা করি সংক্রমণটিকে। ব্যক্তিকে নয়,  যে স্বেচ্ছায় রোগ বহন করে তাকে।’


তার শোবার পাশে ছিল একটি ছোটো পাথর। আমি কখনো জানিনি তার অর্থ। একদিন জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল—‘এই পাথর আমার স্তব্ধতা। যখনই আমার মনে হয় আমি অতিরিক্ত বুঝে ফেলছি, আমি এই পাথরে হাত রাখি। একে জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগে না জানার অনুভূতি?’ নিষ্ক্রিয়ধী কথা কম বলত কিন্তু প্রতি বাক্য ছিল কাঁটার মুকুট। তার সঙ্গ আমাকে নিরস্ত করে না। মনে হয় আমি ধীরে ধীরে জেগে উঠছি, আর সেটা ঘুমের ভেতরে থেকেই।


কারাগার তার চেহারা বদলাতে শুরু করে। আগে এই স্থানকে আমি ভাবতাম পবিত্র, কারণ বাইরে ছিল অপবিত্র রাষ্ট্র। এখন বুঝতে শুরু করি পবিত্রতা আর অশুচি একই কক্ষপথে আবর্তিত। অন্তর্গত সংঘাতের বাইরে তাদের আর কোনো সত্তা নেই। নিষ্ক্রিয়ধীর সাথেই একদিন অযোনির প্রথম মৌলিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। মন্ত্রের বিপরীতে যুক্তি, তাবিজের বিপরীতে নোটবুক, আগুনের বিপরীতে চুপচাপ পাথর। সেই দ্বন্দ্ব আমার ভেতরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল কোনো শব্দ ছাড়া।


কারাগারের ভেতরে নেমে আসে এমন এক আলোকচ্ছটা, এই আলোকচ্ছটা অন্ধকারের সংজ্ঞাকে পুনরায় সংহত করে। আমাদের তিনজনের চারপাশে সময় যেন নিজের চামড়া খুলে রেখে চলে যায়। রেখে যায় নাড়িভুঁড়ির নিচে একটি স্পন্দন, হাড়ের গহ্বরে, দৃষ্টি ও শব্দের সংযোগবিন্দুতে।  ত্রিমুখী সেই সংবেদ কখনো উচ্চারিত হয় না। তা প্রকাশহীন থাকে। উপস্থিতির অভিঘাতে দেহে যেন গেঁথে যায় শীতল শ্বাস, প্রতিধ্বনি ছাড়া উচ্চারিত কোনও নীরব সংলাপ। আমরা তিনজন—আমি, অযোনি, নিষ্ক্রিয়ধী। তিনটি ভাষার মতো পাশাপাশি বসবাস করি আর আমাদের অর্থগুলো একে অপরকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে যত্রতত্র দিকহীনতার ভেতর।


একদিন সকালে আমি জেগে উঠি এমন এক অনুভবে, যেন আমার শরীর থেকে ছায়া উঠে গিয়ে নিষ্ক্রিয়ধীর শ্বাসে মিশে গেছে। আর অযোনির দৃষ্টিতে আমি নিজেকে দেখি। যেমন পিঞ্জরের ভেতরে একটি অতীত দাঁড়িয়ে থাকে, আলোকিত না, তবু দৃশ্যমান। সেই দিনের সকালে জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা আলো আমাদের মধ্যে বিভাজন আনেনি। আমাদের এক জ্যামিতিক বিন্যাসে স্থাপন করেছিল, যেখানে আমি ছিলাম কেন্দ্র। নিষ্ক্রিয়ধী তখন মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে চিন্তা ছিল না, ছিল প্রত্যাহার। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, সে আজ নিজেকে উঠিয়ে ফেলেছে নিজস্ব যুক্তিপথ থেকে, হয়তো তার দর্শন আজ বিশ্রামে। কিন্তু বিশ্রামের মধ্যেও সে ছড়িয়ে রেখেছিল এক পরোক্ষ শক্তি। একটি স্থির বিদ্যুৎ, যা আলো দেয় না। অযোনি তখন এক কোণে ধূপ জ্বালিয়ে মন্ত্রপাঠ করছিল না মুখে, না গলায়, সম্ভবত চেতনার কোথাও। সে আমার দিকে একবারও না তাকিয়েও জানত আমি দেখছি তাকে। আর আমি জানতাম, এই মন্ত্র আমি শুনতে পাচ্ছি না, তবু আমার হাড়ে ঢুকে পড়ছে তার ধ্বনি। অযোনির উপস্থিতি যেন একটি অদৃশ্য নকশার মতো আমাদের মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ছিল। কোনো তন্ত্র, কোনো অতল স্ফূলিংগ কিংবা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস, যা ভাষাহীনতাই গ্রহণ করে অবশেষে।


আমরা কারাগারের একটি নির্জন খালি ঘরে বসেছিলাম। সে ঘরে কোনো আলো ছিল না, কোনো কংক্রিটের চিড় ছিল না, ছিল কেবল উপস্থিতির একঘেয়েমি। যা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিল এক আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে। এই সংঘর্ষ কোনো এক কথা দিয়ে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছিল এক নিঃশ্বাস দিয়ে। অযোনির গভীর চোখেমুখে, নিষ্ক্রিয়ধীর আড়ালভরা কণ্ঠে আর আমার জিহ্বাবিহীন জিজ্ঞাসায়।


নিষ্ক্রিয়ধী প্রথম মুখ খুলল, তার স্বরটি যেন মাটি চিরে উঠছিল  ‘তুমি যাকে পবিত্র বলো, সে আসলে কি ক্ষমাহীন এক সাজা নয়? পবিত্রতা কখনো কি সন্দেহকে ধারণ করতে পারে?’ আমি তার দিকে তাকাই না। আমার ভেতরে তখন যে আলো, তা কোনো উৎস থেকে নয়, কেবল অভ্যন্তরীণ ঝাঁঝ, অনুক্ত ব্যথা থেকে উৎসারিত। আমি বলি—‘সন্দেহ পবিত্রতাকে বিশৃঙ্খল করে না। সে পবিত্রতাকে পরীক্ষা করে এবং পরীক্ষাই চূড়ান্ত প্রার্থনা।’ অযোনি হাসে না, কাঁদে না। সে তার নখ দিয়ে পায়ের পাতায় একটি অদৃশ্য বৃত্ত আঁকে। তারপর বলে—‘পবিত্রতা এবং পরীক্ষা দুই-ই তন্ত্রের অংশ। শুধু ব্যবধান এই, একটিতে দেবতা, অন্যটিতে দণ্ড। কিন্তু জানো, দণ্ডও এক ধরণের মন্ত্র।’


তারপর সে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিঃশব্দে। তার দেহে যেন একটি বায়ুরেখা উঠে আসে অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মাঝখান থেকে। আমরা তিনজন তখন আর কথা বলি না। কিন্তু সেই চুপচাপ মুহূর্তে, আমার মনের ভেতরে জন্ম নেয় এমন এক অনুভব। আমি এদের মাঝে নিজের অবয়ব হারাচ্ছি।

নিষ্ক্রিয়ধী তখন বলতে থাকে নিজের মতো—‘রাষ্ট্র তো এক বহির্বাস্তবতা। কিন্তু সে গড়ে ওঠে মানুষের মনের রাষ্ট্র দিয়ে। তুমি যদি তোমার ভেতরের রাষ্ট্রকে না ভাঙো, তবে বাইরের ভাঙন শুধুই দৃশ্যগত। তাতে মুক্তি নেই, আছে কেবল নতুন নিয়মের সংহিতা।’


আমি তাকাই তার চোখে। সেখানে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নেই, নেই চেতনার কোনো উন্মেষ। আছে কেবল ভবিষ্যতের ক্লান্তি। অযোনি বলে, ‘রাষ্ট্র ভাঙা যায় না, ঠিক যেমন মন্ত্র বাতিল করা যায় না। তাকে কেবল ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। প্রতিটি বিপ্লব আসলে একটি নতুন মন্ত্রচক্রের সূচনা। তাই আমি হত্যা করেছিলাম একজনকে, যে রাষ্ট্রের উপদেবতা হয়ে উঠছিল।’


আমি বিস্মিত হই না করাণ এই সত্য আমরা সবাই জানতাম, কেবল উচ্চারণ করতাম না। আমার মনে হতে থাকে, আমরা তিনজন একই দেহের তিনটি সংকেত, তিনটি চেতনার স্তর। আমি সেই স্তর, যে প্রশ্ন করে; নিষ্ক্রিয়ধী, যে সম্ভাবনা দেয় আর অযোনি যে উত্তরের স্থিরতা।

তখনই বাইরে কোথাও চিৎকার শোনা যায়। একটি কয়েদি হয়তো মরেছে বা মরে যাচ্ছে। অথচ  আমাদের মধ্যে তা কোনো আলোড়ন তোলে না। কারণ আমরা তখন এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছি, যেখানে মৃত্যু কেবল শব্দ নয়ত ছায়া। নিষ্ক্রিয়ধী তার খাতা খুলে নতুন একটি বাক্য লেখে ‘ত্রিকোণ একমাত্র সেই আকার যার প্রতিটি বিন্দু একে অপরের প্রতিবিপরীত, তবু একই কেন্দ্র চুম্বক করে।’


আমি বুঝি, এই ত্রিকোণ আমাদের নয়, আমাদের মনের। আমরা তিনজন যেন একই অস্তিত্বের তিনটি ব্যঞ্জনা—আমি—নৈঃশব্দ্য, অযোনি—ছায়া, নিষ্ক্রিয়ধী—আলো। কিন্তু এই আলো দৃশ্যমান নয়। এই ছায়া অন্ধকার নয়। এই নৈঃশব্দ্য কোনো শব্দের অনুপস্থিতি নয়। এই ছিল ত্রিকোণ সংবেদ। এক অদৃশ্য সংঘর্ষ, যেখানে যুক্তি হারায় না, তবে দিক ভুলে যায়।


কারাগারের সেই নির্জন ঘর, যার দেয়ালে চুন উঠেছে আর ছাদের ফাটল দিয়ে গুঁড়িয়ে পড়ে ধুলো ও পোকা, সে ঘর আমাদের তিনজনের উপস্থিতিতে এক অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে থাকে। সময় এখানে বাইরের সময় নয়, ঘড়ির কাঁটা নয়, রুটিন নয় এ এক অন্তর্লীন ঘূর্ণন, যা আমাদের ভেতরের ত্রিমুখী বোধকে একে অপরের দিকে টানতে থাকে।


অযোনি তার এক দৃষ্টিতে স্থবির। সে যেন নিজেকে নতজানু করে রেখেছে নিজস্ব এক শক্তিমণ্ডলের সামনে, যার কেন্দ্রে কোনো দেবতা নেই, নেই কোনো নৈতিকতা। আছে কেবল ইচ্ছার প্রাচীনতম আকুতি। আমি লক্ষ করি, তার দেহে যেন ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছে মন্ত্রের রেখা। চামড়ার নিচে, শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শব্দহীন এক ভাষা। যে ভাষার উৎস কোনো পাণ্ডুলিপিতে নয়, তা কোনো প্রাগজন্মের জাদুব্যবস্থায়। নিষ্ক্রিয়ধী তখন দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। সে কথা বলে না, কেবল মাঝেমধ্যে পেন্সিল দিয়ে টুকে রাখে কিছু বাক্য। আমি একদিন সাহস করে পড়ে দেখি তার লেখা—‘চেতনার কেন্দ্রে বিপ্লব থাকে না, থাকে উন্মোচন। রাষ্ট্র ও বিপ্লব দুই-ই ছদ্মবেশ। আসল সংকট আত্মা চুরি হয়ে যাওয়া।’ এই বাক্য পড়ে আমি শিউরে উঠি। কারণ আমি জানি, এ শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও গোপন মনোভাব নয়, এটা অস্তিত্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক ধ্বংসশীল উপলব্ধি, নিজেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা।


সেই রাতে হঠাৎ ঘরের বাতাস বদলে যায়। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢোকে পূর্ণিমার আলো। অযোনি উঠে দাঁড়ায়, মুখে মৃদু হাসি। কেবল দেহের গভীর থেকে উঠে আসা এক সংকেতের হাসি। সে বলে, ‘আজ পূর্ণিমা। আজ শক্তির কেন্দ্র খোলে। তুমি দেখবে, নিষ্ক্রিয়ধী আজ নিজেই নিজের দর্শনকে চুরি করবে।’ আমি তাকিয়ে থাকি। নিষ্ক্রিয়ধী যেন ঘুমচোখে আমার দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘আমি এখন স্বপ্নে কথা বলব, শুনবে?’ আমি মাথা নাড়ি। সে বলে, ‘স্বপ্নে আমি দেখি, কারাগারের দেয়ালে লেগে আছে আমার মুখ। সেখানে আমি চিৎকার করছি কিন্তু কেউ শুনছে না।’ তারপর দেখি, ‘সেই মুখ আস্তে আস্তে আমার নয় , অযোনি আর আমি এক মুখ হয়ে যাই এবং তাতে কোনো ভাষা থাকে না। থাকে শুধু এক ধরণের সংবেদ, যেটা ভাষাকে অস্বীকার করে। সেটাই কি চরম স্বাধীনতা?’


আমি উত্তর দিই না। কিন্তু আমার মাথার ভেতর তখন কেবল এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে— স্বাধীনতা কি নিজের থেকে মুছে যাওয়ার নাম? অযোনি আবার বসে পড়ে। তার ঠোঁটে চলে আসে এক দীর্ঘশ্বাস, যেন পৃথিবীর বহুপ্রাচীন ক্লান্তি। সে বলে,‘আমি জানি, নিষ্ক্রিয়ধী নিজেকে হারাবে। কারণ সে যুক্তির শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে তন্ত্র আর দর্শন এক বিন্দুতে মিশে যায়, সেখানে আমি অপেক্ষা করি, আর সে শেষ করে।’ আমি বুঝতে পারি, আমরা আর আলাদা কেউ নই। আমরা ত্রিমুখী এক ঈশ্বরচেতনার তিনটি প্রতিধ্বনি। সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। আমার শরীরে জেগে থাকে এক ত্রিধার— অযোনির মন্ত্র, নিষ্ক্রিয়ধীর ভবিষ্যৎ আর আমার পবিত্র বিভ্রম। হঠাৎ আমার মনে হয় আমি নেই। আমি কেবল এক প্রতিচ্ছবি, যাকে এই কারাগার তৈরি করেছে এই দুই সত্তার মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে। আমি যদি না থাকি, তবু কি এই সংঘর্ষ থাকবে?


পরদিন সকালে, যখন কারারক্ষীরা দরজা খোলে, তখন তারা দেখে আমরা তিনজন যেন একটি ত্রিকোণ বিন্যাসে স্থির হয়ে বসে আছি। কারাগারের দেয়ালে তখন ছায়া নেই, আছে শুধু প্রতিফলন। এই প্রতিফলনে, আমাদের কেউ কারাবন্দী নয়। আমরা যেন বন্দী সেই ত্রিমাত্রিক সত্যে যেখানে পবিত্রতা প্রশ্নে রূপান্তরিত হয়, দর্শন প্রতিক্রিয়ায় রূপ নেয় আর মন্ত্রনীরব আলো হয়ে দেয়ালে গেঁথে থাকে।


কারাগারের দেয়ালের ফাটলে ঢোকার চেষ্টা করে সূর্যের এক ঝলক,  তার আভা যেন সময়ের বেগুনি মায়াজালে আটকা পড়ে, রঙের অবরোধে মুখ থুবড়ে পড়ে। এই সংকীর্ণ ঘরে আমরা তিনজন, তিনটি ভিন্ন জীবনের ছায়া, এক অনন্ত বৃত্তের ত্রিকোণে আবদ্ধ। প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে আত্মার এক অদৃশ্য ঝড়, এক অশ্রুত ভাষায় প্রলাপ, এক অনির্বচনীয় বেদনা ও সমাধান।

আমাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা শূন্যতাকে ভাঙতে আসে এক ধরণের নীরব যুদ্ধ। যা কখনো বোমার মত বিস্ফোরিত হয় না। একে একে সমস্ত স্তর ছিন্ন করে ফেলে, যতটা বোধের ভেতর এক গভীর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি দেখতে পাই অযোনির চোখের গভীরে মন্ত্রের আলো আর ধূসর অনিশ্চয়তার জটিল খেলা। যেখানে একদিকে রয়েছে তন্ত্রের নির্মম কঠোরতা, অন্যদিকে তার ভেতরের অচেনা এক কোমলতা যা কখনো প্রকাশ পায় না। নিষ্ক্রিয়ধীর মুখাবয়বে ফুটে ওঠে দার্শনিক অন্তরীক্ষের বিস্তৃতি। যেখানে গাণিতিক তত্ত্বের মতো নিখুঁত জ্ঞানের অন্ধকারায়ন আর ভবিষ্যৎকে সে এক মায়াবী প্রবাহে বাঁধা ফেলে। আর আমি নিজেকে দেখি, এক অসম্পূর্ণ, পবিত্রতা ও সন্দেহের দ্বন্দ্বে বিভ্রান্ত, একটি পরাবাস্তব ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া অস্থির আত্মা।


আমাদের তিনটি বোধের ছায়াচ্ছন্ন জগৎ ধীরে ধীরে একে অপরের সাথে মিশে যায়। কখনো অদ্ভুত এক রূপ ধারণ করে, কখনো নিজেকে অস্বীকার করে। ত্রিকোণের এক কোণ থেকে অন্য কোণে মিথস্ক্রিয়া করে। আমরা একে অপরের ভেতর নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। আমার সন্দেহগুলো অযোনির বিশ্বাসের কাছে চাপা পড়ে; অযোনির মন্ত্রগুলো নিষ্ক্রিয়ধীর দার্শনিক তর্কের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নিষ্ক্রিয়ধীর দর্শন তখন আমার পবিত্রতার বিভ্রমকে চ্যালেঞ্জ করে আর আমার মনস্তাত্ত্বিক লড়াই তার সাথে গাঁথা হয়ে এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দেয়। এই মিলন এক ত্রিমাত্রিক অস্থিরতা। এক ধরণের মানসিক একঘেয়ে যন্ত্রণার নীরবতাময় প্রকাশ, প্রত্যেক ব্যক্তি একসঙ্গে জড়িত অথচ একাকী। আমরা আছি একটি কাল্পনিক দ্বীপে, যেখানে কোনো নৌকা নেই, কোনো বাতাস নেই, শুধুমাত্র একটা চঞ্চল সাগর। আমাদের অন্তরের সাগর, যার পানিতে প্রতিফলিত হয় আমাদের পেছনের সব ভয়, আশা, ও বিভ্রান্তি।


এখানে সময় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। অতীত আর ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়। আমি অনুভব করি, আমাদের এই মিলন শুধু ব্যক্তিগত সংকট নয়, তা সামাজিক ও রাজনৈতিক এক গভীর প্রতিফলন। কারাগার এক ক্ষুদ্র জগৎ, যেখানে রাষ্ট্রের নিপীড়ন, ক্ষমতার খেলায় জড়িয়ে থাকা মানবিক অস্তিত্ব সব মিলে এক অজানা যুদ্ধ ব্যবস্থা। তবে এই যুদ্ধে জয় নেই, আছে শুধু অন্তহীন বিভ্রান্তি, এক মায়াবী মুক্তি যা নিজেকে হারিয়ে নতুন অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা।


আমাদের তিনজনের আলো-ছায়ার মিলনে গড়ে ওঠে এক বিমূর্ত জটিল কাঠামো।  যে কাঠামোর কোনো একক কেন্দ্র নেই। একাধিক বিন্দু থেকে ঝরছে এক অবিচ্ছিন্ন আলো যা কখনো ঝলমল করে, কখনো নিভে যায়। এই কাঠামো আমাদের ভেতরের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। যেখানে পবিত্রতা সন্দেহের সাথে, দর্শন মন্ত্রের সাথে এবং নিস্তব্ধতা আলোয়ের সাথে একাকার হয়ে যায়।


এই বিভ্রমের মধ্যে আমাদের আত্মা খুঁজে পায় নিজেকে—এক অদ্ভুত মুক্তি যা ভাষায় প্রকাশের অতীত। তবু আমরা থামি না। এই মিলনের ভিতর দিয়ে আমাদের যাত্রা চলতেই থাকবে। নতুন প্রশ্ন, নতুন দ্বন্দ্ব, আর নতুন উপলব্ধির দিকে। এখানে, এই নিস্তব্ধতা ও অন্তঃস্থ মিলনের মাঝেই গড়ে উঠছে আমাদের সত্যের খণ্ডাংশ। এখানে শেষ হয় না কোনো কিছু, শুরু হয় অন্য এক বাস্তবতার প্রবাহ।


শিশিরের ঝাপটায় ভেজা সকাল ঘোরের মতো আমার মনেও বিভ্রান্তির এক মেঘ ঘনীভূত হয়ে আসে। এই কারাগারের নির্মম স্থিরতায়, প্রত্যেক শব্দ যেন পূর্বনির্ধারিত কোনো নিঃশব্দ দণ্ড, সেখানে আমার আত্মার গহ্বরে এক প্রশ্নের প্রতিধ্বনি বাজে — ‘আমি কে?’ আমি, যে নিজেকে পবিত্রতার এক অবিচল স্তম্ভ বলে বিশ্বাস করি, আসলে কি সত্যিই তেমন? নাকি এই বিশ্বাস শুধু আমার অস্তিত্বকে বাঁচানোর জন্য এক রক্ষাকবচ, এক মিথ্যার পর্দা? আমার ভেতরে এক ভয়াবহ সঙ্কট জাগে পবিত্রতা ও সন্দেহের এক অমোঘ দ্বন্দ্ব। পবিত্রতা  একটি অমূর্ত শক্তিশালি ধারণা, যা আমি নিজেকে দিয়ে আসছি যেন আমার আত্মার পরিচয়। তবে একসময় ভাবি, এই ধারণাটা আসলে আমার নিজের বানানো জাল; একধরনের আত্মরক্ষার কৌশল, যা আমার জীবনের অন্ধকার থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সন্ধ্যার নীরবতায় যখন আমার নিঃশ্বাস থেমে আসে, তখন পবিত্রতার এই মায়াজাল যেন ক্রমশ ছিঁড়ে যেতে থাকে। আমি নিজেকে দেখি, আমার অন্তর মনেই প্রবল এক সন্দেহের আগুন জ্বলে আমি কি সত্যিই নির্দোষ? কিংবা আমারও কি কোনো অপরাধ লুকিয়ে আছে, যা আমি নিজেকে অবহিত না করেই চাপা দিয়ে রেখেছি?


কারাগারের দেয়ালের মতো অটল আমার বিশ্বাসও তখন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। আমার ভেতরকার পবিত্রতা কি আসলেই পবিত্র? নাকি এটি কেবল এক ছদ্মবেশ, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে আমার ভয়, একাকিত্ব এবং অস্তিত্বের অবসানপ্রান্ত? এই সন্দেহের মধ্যে আমি হারিয়ে যাইঐ এক অনির্বচনীয় স্থান যেখানে আমার আত্মার নিঃশ্বাসও যেন থমকে যায়। এই অন্তঃস্থ ভ্রমণের মাঝে আমি উপলব্ধি করি, পবিত্রতার বিভ্রমের নীচে যে সত্য লুকিয়ে আছে, তা একেবারে শাদা বা কালো নয়। এটা এক জটিল ছায়াময় খেলা। যেখানে সত্য-মিথ্যা-বিশ্বাস-অবিশ্বাস একত্রে নাচছে। আমার মন একদম গভীর অন্ধকারের ডুবে যায়। সেখানে আমি নিজেকে একেবারে নগ্ন দেখছি। যে নগ্নতা এক আত্মপরীক্ষার। আমার শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে এক অদ্ভুত প্রশ্নের তীব্রতা—‘আমি কি নিজেকে জানি?’ আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, যে ‘আমি শব্দটি কতটুকু বাস্তব? আমার চিন্তা, অনুভূতি, সব কি আমার নিজস্ব? নাকি এগুলো কারাগারের নিপীড়ন? সমাজের নিষেধাজ্ঞা এবং আমার নিজের অবচেতন থেকে তৈরি এক মায়াজাল? এই ভ্রান্তিকর বৃত্তের মাঝে আমি অনুভব করি, পবিত্রতা শুধু এক ধরণের মানসিক নির্মাণ। যা আমার অস্তিত্বকে স্থিতিশীল রাখার জন্য তৈরি। সেই নির্মাণ নিজেই কেমন যেন ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে আর আমি এক গহীন শূন্যতার মুখোমুখি। এই শূন্যতায় আমার আত্মা ঘুরে বেড়ায়। যেন কোনো উত্তর খুঁজছে, কোনো মুক্তির পথ খুঁজছে। এই পথটি অন্ধকার, অস্পষ্ট আর প্রতিটি ধাপেই প্রশ্নের অতৃপ্তি আমাকে টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে।


আমার মনে হয়, এই অন্তঃস্থ দ্বন্দ্বের মাঝেই আমি খুঁজে পেয়েছি নিজেকে। যে আমি সত্যিই পবিত্র নই কিংবা অপ্রতারণামূলক কোনো সত্যের অধিকারী নই। আমি একসময় নিজের ভেতরের অবিশ্বাসকে আলিঙ্গন করি আর বুঝি—পবিত্রতার বিভ্রম আর অস্তিত্বের সন্দেহের মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ গড়ে ওঠে। এভাবেই আমি নিজেকে হারিয়ে, আবার খুঁজে পাই। এক অবিরাম সন্ধানের মধ্য দিয়ে, যার কোনো শেষ নেই, কোনো স্থায়ী উত্তর নেই, শুধু এক গভীর নিরবতার মধ্যে আত্মার বহমান স্রোত। এই অন্তর্জৈব যাত্রায় আমার পবিত্রতা ও সন্দেহ একে অপরের অপরিহার্য সংলাপ। আমাকে আমার অস্তিত্বের গভীরে প্রবাহিত করে। আর এই প্রবাহের মাঝেই, আমি নিজেকে পাই এক অস্পষ্ট, অস্থির জীবন্ত সত্তা হিসেবে, যা কখনো পবিত্রতা হতে পারে, কখনো সন্দেহের ছায়া। আমি থামি না, কারণ এই দ্বন্দ্বই আমার একমাত্র সত্য। এই দ্বন্দ্বের মায়াজালে আমি নিজেকে খুঁজে ফিরে যাই বারংবার পবিত্রতার বিভ্রম ও অস্তিত্বের সন্দেহের এক অন্তহীন নৃত্যে।


কারাগারের ঠান্ডা, গুটিয়ে পড়া কোণায় বসে অযোনির চোখ দুটো যেন কোনো অদৃশ্য জগৎ নিয়ে ভাবমান। তার মস্তিষ্কের গভীরে যেন এক জটিল যন্ত্র চলছে, যেখানে মন্ত্র ও তন্ত্রের ছায়া নেচে বেড়ায় একাকী অথচ বিস্মৃত আত্মার অজানা দ্বন্দ্ব। তন্ত্র, যন্ত্রমন্ত্র, মন্ত্রের ছোঁয়া এগুলো তার অস্ত্র, তার ভরসা, সেই একমাত্র শক্তি যার আড়ালে সে নিজেকে গড়ে তুলেছে, রক্ষা করেছে। আজ তার ভেতর থেকে এক অদ্ভুত ধ্বনি আসে। যেন সে নিজেই বুঝতে পারছে তার এই শক্তি কতখানি বাস্তব, কতখানি বিভ্রম। তার মনের গভীরে অশান্তির এক ঝড় বয়ে যায়। যন্ত্রমন্ত্র যে শুধু শক্তির খেলা নয়, এক ধরনের আত্মবিরোধের উৎস। যা কখনো কখনো নিজের ভেতরেই বিষ বয়ে আনে। সে বুঝতে পারে, তার তন্ত্র শক্তি আদতে তাকে কতটা বিপন্ন করে দিয়েছে একাকীত্বের গভীরে, আত্মার এক নিঃসঙ্গ কুঠুরীতে।


সে অনুভব করে, প্রতিটি মন্ত্রের ছোঁয়ায় তার আত্মা কেমন যেন ক্ষীণ হয়। ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। তার ভেতরকার ভয়, লোভ, ও সন্দেহ গোপনে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে আর সেই তন্ত্রবিপর্যয়ের ছায়া তার মনকে পীড়িত করছে। তার স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই মুহূর্তগুলো, যখন সে প্রথম মন্ত্র শিখেছিল, যখন সে বিশ্বাস করেছিল যে তার এই যন্ত্রমন্ত্রই তাকে মুক্তি দেবে।  আজ সেই মুক্তি যেন আরও দূরে, আরও অবাঞ্ছিত। তার মন্ত্রের শব্দগুলো যেন ভেসে যাচ্ছে শূন্যে, প্রতিধ্বনি ছাড়াই, যেন তার আত্মার গহ্বরে এক গভীর নীরবতা বেড়ে উঠছে। তন্ত্রবিপর্যয়ের এই গভীর একাকীত্ব তাকে বাধ্য করে নিজেকে প্রশ্ন করতে—‘এই শক্তি কি আসলেই আমার? না আমি কি শুধুই এক বিভ্রমের বন্দি?’


সে অনুভব করে, এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে তার আত্মা এক ভয়ানক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ক্ষমতা এবং দুর্বলতা, বিশ্বাস এবং সন্দেহ একত্রে সংঘর্ষ করছে। তার জীবন এক ধরনের মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি মন্ত্রের রাশির মধ্যে লুকিয়ে আছে তার নিজের আত্মার অন্ধকার। অযোনির এই অন্তঃস্থ যাত্রায় তার ভেতরকার বিভ্রান্তি ও তন্ত্রবিপর্যয়ের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠে, যেখানে তার শক্তি নিজেই তার সবচেয়ে বড় শত্রু।


নিষ্ক্রিয়ধির অন্তরের গভীর অন্ধকারে এক অসীম নির্জনতা বাস করে। যেখানে প্রতিটি চিন্তা যেন তার নিজের ছায়ার মতো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দর্শনের অপরিসীম জগত, যেখানে লজিক আর এন্টিলজিক এক অপরের সঙ্গে নিঃশব্দ যুদ্ধ করছিল। সেখানে সে দাঁড়িয়ে থাকে একাকী একটু অবসন্ন, একটু বিভ্রান্ত। তাকে দেখে বোঝা মুশকিল, এই নিস্তব্ধতার আড়ালে কতটা ভাঙন এবং অস্থিরতা লুকিয়ে আছে। তার মনে এক প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—‘সীমা কোথায়? দর্শনের সেই শেষ গন্তব্য কোথায়, যেখানে বোধের যাত্রা শেষ হয়?’ সে উপলব্ধি করে, দর্শনের সীমা আসলে এক বিভ্রান্তি নয়। এক অজানা মুক্তি, যেখানে সে নিজেকে হারিয়ে দিয়ে নতুন অর্থ খুঁজে পায়। তার চিন্তার জালে আটকে পড়া এই সীমাবদ্ধতা তাকে বারবার ভাবায়, যেখানে যান্ত্রিকতার অতীত আর ভবিষ্যতের ভবঘুরে রূপ তার সামনে ভাসে। সে জানে, যা ঘটবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত। কেন সেই জ্ঞানের মায়ায় বন্দি সে নিজেই বুঝতে পারে না। এই জ্ঞানের অতিরিক্ততা তাকে এক ধরনের আত্মপরাজয়ের সম্মুখীন করে, যেখানে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায়।  নিষ্ক্রিয়ধীর ভেতরকার এই দ্বন্দ্বের মাঝে উপস্থিত হয় এক গভীর ক্লেশ। যা তাকে ক্রমশ ভেঙে ফেলে। সে নিজের অমীমাংসিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে মুক্তি আর বন্দিত্ব একাকার।


তার চিন্তার দিগন্তে ঘোরে মানুষের অবাধ্যতা, রাষ্ট্রে নিপীড়ন এবং পুঁজিবাদের অবসান। যা তার দর্শনকে সংকীর্ণ করে তোলে, তবে সেই সংকীর্ণতাই তাকে নতুন ভাবনায় প্রবাহিত করে। সে উপলব্ধি করে স্বাধীনতা এক ধরণের আত্মপরাজয়, যেখানে নিজেকে মেনে নেয়ার শক্তিই প্রকৃত মুক্তি। তার এই অন্তর্জৈব যাত্রা এমন একক যাত্রা। যেখানে দর্শনের শেষ সীমা স্পর্শ করার পর আত্মার গভীরে ছড়িয়ে পড়ে এক অদৃশ্য আলো, একটি আত্মসমর্পণের অবস্থা, যা তার ভবিষ্যতের নোটবুকে লিখে রাখে এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা।


সেই সকাল যেন সারা বিশ্বের শব্দগুলো হারিয়ে গেছে কারাগারের দেওয়ালে ঠেকিয়ে। শুধু দ্যুতিময় নিঃশ্বাস, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের আলোর একটি নিঃসঙ্গ আভা। এই আলো আমার অন্তর থেকে এক এক করে সমস্ত অন্ধকারের ছায়া সাফ করে দিচ্ছে। সেই আলো এতই নীরব, এতই বিমূর্ত, যে বোধের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অকথিত রহস্য, মুক্তি কি আসলেই মুক্তি? নাকি মুক্তি কেবল সংশয়ের আরেক নাম? আমার হৃদয়ের ভেতর এক দ্বিধাবিভক্ত নদীর স্রোত প্রবাহিত হয়। একদিকে আছে গভীর প্রার্থনার মতো পবিত্রতার স্বপ্ন আর অন্যদিকে আছে এক ধোঁয়াটে সন্দেহের কুয়াশা। এই দুটোর মাঝে আমি স্থির থাকি না, ঝুলে থাকি এক অসম্ভব ভারসাম্যের ওপর, প্রতিটি নিঃশ্বাসে আঁকা পড়ে মুক্তি ও বন্দিত্বের অদৃশ্য রেখা।


আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আমি কি বন্দি? আমার শিকল কি শুধুই লৌকিক? নাকি আমার মুক্তিও শুধুই মিথ?’ এই প্রশ্নগুলো আমাকে ছুঁড়ে ফেলে এক দীর্ঘ নীরব যুদ্ধে। যেখানে শব্দেরা হারায় তাদের আকাঙ্ক্ষিত মানে আর অবয়বহীন ভাবনাগুলো ঝাঁঝালো বাতাসের মতো আকাশের কোণে ভেসে যায়। অযোনির মন্ত্রমন্ত্র আর নয় এক ছায়ার মতো; তার যন্ত্রমন্ত্রের প্রতিধ্বনি আজ শুধু আমাকে স্পর্শ করে এক অনাহুত স্মৃতির মতো। নিষ্ক্রিয়ধীর দর্শন এখন নিষ্প্রাণ বৃত্তের মধ্যে হেঁটে যায় যেখানে যুক্তি আর অবজ্ঞান দুটোই মিলেমিশে এক শূন্যতায় নিঃশেষিত।


আমাদের ত্রিকোণী সত্তাগুলো, এই অন্তর্জৈব সংঘাতের মাঝেও, এক অদ্ভুত একাত্মতা বয়ে আনে। আমরা তিনজন আলাদা, কিন্তু একেকজনের প্রতিচ্ছবিতে হারিয়ে গিয়ে নতুন রূপ পাই এক বিকৃত, এক বিমূর্ত, এক অনির্দিষ্ট মিলনের ছোঁয়ায়। এই মিলন এক নতুন বিভ্রান্তির শুরু। আমার মুক্তি তাই কেবল একটি শৃঙ্খল ভাঙার নাম নয়, এটি এক অবিরাম অন্তর্দৃষ্টির যাত্রা। যেখানে সংশয়ের জ্বলন্ত অগ্নি আমাকে পোড়ায়, বারবার পুণঃজন্ম দেয়। আমি শিখেছি মুক্তির সঙ্গে সংশয় জড়িয়ে আছে একটি অবিচ্ছিন্ন নৃত্যের মতো এক বিন্দুতে তারা একাকার হয় আর অন্য বিন্দুতে আবার একে অপরকে বিচ্ছিন্ন করে। এই একরকম মুক্তির সন্ধানে আমি নিজেকে হারাই আবার নিজেকে খুঁজে পাই, আমি কখনো স্থির থাকি না। এই স্থিরতার অভাবেই হয়তো বেঁচে থাকার অর্থ নিহিত।


এক এক করে সেই শব্দগুলো, সেই অনুধাবনের ঝাপসা আলোকরেখা আমার মনের অন্ধকারে পড়ে যায়। আমি শুনতে পাই নিঃশব্দতার গভীর কোলাহল, যেখানে প্রশ্নেরা সদা ফিরিয়ে আনে নতুন দিগন্তের সূচনা। মুক্তি আর সংশয়ের এই দ্বৈত নৃত্যে আমি নিজেকে বিলীন করি এক অবিরাম সন্ধানী আত্মার মতো।


সন্ধ্যার গোধূলির এক নিঃসঙ্গ প্রান্তরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে চারদিকে ধোঁয়া ঘনীভূত হতে থাকে। সে ধোঁয়া স্বপ্নের মতো বাস্তবতার ভাঁজে ভাসমান। বাতাসে অদৃশ্য কোনো সুরের প্রতিধ্বনি, যা স্পর্শ করা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। ধোঁয়ার ভেতর থেকে হালকা এক অম্লান আলো ফুটে উঠছে অগোচরে, অপার্থিব, যেন আত্মারই এক নিঃশব্দ গান। আলোটি স্পর্শ করে না, ছুঁয়ে যায় না, তবু আমার মনকে এক একাকার শান্তিতে ভরিয়ে দেয়।


আমি সেই আলোকে ছুঁয়ে দেখতে চাই, তবে হাত বাড়িয়ে একমাত্র নিঃশব্দতার ছোঁয়া পাই। এই নিঃশব্দতাই আমার মুক্তি। এই অপার্থিব আলোয় আমি খুঁজে পাই আমার অস্তিত্বের এক অন্তহীন পরিধি। আলো আর ধোঁয়া, মুক্তি আর সংশয়, সমস্ত মিশে এক একাকার অনুভূতিতে। আমার হৃদয় ভেসে যায় সেই নিঃশব্দ নীরবতার স্রোতে, যেখানে প্রশ্নেরা আলোয় রূপান্তরিত হয়, আর মুক্তি নিজেকে সন্দেহের অন্তরালে আড়াল করে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages