কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কবি যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক শুয়োপোকা || শাফি সমুদ্র - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

লিটলম্যাগাজিন সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন নয়, এটি গুটিকয় অস্থির কবির গোপন চুক্তি

বুধবার, ১১ জুন, ২০২৫

কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কবি যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক শুয়োপোকা || শাফি সমুদ্র

 


কবিতা মরে গেছে এই বাক্যটি আজ এক রাষ্ট্রীয় ও প্রতিষ্ঠানের অনানুষ্ঠানিক এবং কৌশলগত প্রচার। তার চেয়েও বেশি এটি এক সম্মিলিত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কেউ মুখে বলুক আর না বলুক অধিকাংশের মনেই এখন কবিতা এক অপ্রাসঙ্গিক অতীত নস্টালজিয়ার জঞ্জাল এবং সাংস্কৃতিক যাদুঘরে টাঙানো অচল প্রতীক। আমাদের প্রশ্ন অন্যজায়গায়। কবিতা যদি মরে গিয়ে থাকে তবে সে মরেও কেন ভয় দেখায়? কেন রাষ্ট্র আর অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন এত যত্নে এত শৃঙ্খলায় করে? যেন কোনো বিপজ্জনক দেহ পুড়িয়ে ফেলতে হচ্ছে? আর কে সেই কবি যে মৃত কবিতার নিচে নড়ে ওঠা এক অদৃশ্য জীব? সে কী শুধু শব্দের শ্রমিক না কি রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে জন্ম নেওয়া এক চুপচাপ ধর্মডাকাত?


এই ভূমিকা আসলে একটি মৃতদেহের পোস্টমর্টেম। আমরা খোঁজ করব সেই মৃত্যুর কারণ। এটি প্রাকৃতিক না পরিকল্পিত? আর যদি পরিকল্পিত হয়, তবে কে খুনি? রাষ্ট্র? প্রতিষ্ঠান? নাকি কবি নিজেই? আমরা জানি ভাষার মৃত্যু খুব সহজে ঘটে না। ভাষার সম্ভাবনা, ভাষার দ্বিধা, ভাষার যে স্বপ্ন, তার মৃত্যু ঘটানো যায় সেই মৃত্যু যখন কবিতার হয় তখন তা এক ধ্বংসাত্মক সৌন্দর্য তৈরি করে। এক ভয়ংকর নান্দনিকতা, যাকে আমরা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি নামে চিনে থাকবো।


এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভ্রান্তি ভেঙে দেওয়া দরকার। অনেকেই ভাবেন কবিতা এখনো বেঁচে আছে নানান পুরস্কারপ্রাপ্ত সংকলনে, পাঠ্যপুস্তকে, বর্ণমালার সাজানো বিকেলে। মূলত সেই কবিতা আসলে এক অভিশপ্ত পাতলা কাগজ যাকে রাষ্ট্রের ছাঁচে ঢেলে মডেল বানানো হয়েছে। মূল কবিতা অর্থাৎ যা দ্বন্দ্ব তোলে যা অস্থির করে যা পাপ ও পুণ্যের মাঝখানে শুয়ে থাকে সেই কবিতাই মৃত এবং রাষ্ট্র সেই মৃত্যুতে স্বস্তি পায়। কারণ একটি জীবন্ত কবিতা কখনো রাষ্ট্রের পক্ষে যায় না।


তবে মৃত্যু মানেই শেষ নয়। এই মৃত কবিতার নিচে যে আন্দোলন টের পাওয়া যায় তা যেন একটি নিঃশব্দ প্রাণের গর্জন। একটি শুয়োপোকা ভয়ংকর, নোংরা, ধীরে চলে কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালি। সেটি কবির রূপ ধরে অথবা কবিকে রূপ দেয় নিজের মতো করে। এই শুয়োপোকা মৃত কবিতার চামড়া চুষে খায়, তার হাড়ের ভেতরে গর্ত করে। আমরা তাকে দেখতে চাইনা  কারণ সে সৌন্দর্যবোধের পরিপন্থী। আমরা তাকে এড়িয়ে যেতে পারি না কারণ সে আমাদের সাহিত্যের শরীরে ঘুরে বেড়ায়।


আসুন আমরা একটু থেমে গভীরভাবে ভাবি। এই মৃত কবিতার প্রকৃতি আসলে কী? এটি কি সত্যিই মৃত না কি এক তাত্ত্বিক অবস্থা? একটি মৃত কবিতা অর্থ কী? সেটি কি ভাষার মুদ্রাদোষে আক্রান্ত? রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শুকিয়ে যাওয়া কোনও সাংস্কৃতিক গুল্ম? আমাদের ভাষা কি এই কবিতার মৃত্যুতে সত্যিই শোকাহত না কি চুপচাপ উৎসবমুখর?


এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। কবিতার মৃত্যু কোনো আকস্মিকতা নয়। এটি এক দীর্ঘ পরিকল্পিত ব্যাপার। স্তরে স্তরে গঠিত প্রতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ড। শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে যখন কবিতা রাজনীতিকে অস্বীকার করেছিল। যদিও রাজনীতি কখনো কবিতাকে ছাড়েনি। যখন কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘আমরা তো নই রাষ্ট্রের ক্রীতদাস, / আমরা লিখি যন্ত্রণা, / আমরা টের পাই সমাজের ফাটল।’ তখন রাষ্ট্র এই উচ্চারণকে রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে পাঠ্যক্রমে ঢুকল নির্বিষ কবিতা। যেখানে পাহাড়, নদী, ফুল, পাখি আছে। নেই ক্ষুধা, অপমান, ক্রোধ। স্কুলের শিশুরা সেইসব কবিতা মুখস্থ করতে লাগল। শেখার নাম করে ভুলে যেতে থাকল অনুভূতির বিপ্লব। এইভাবে কবিতার মৃত্যু ঘটল একটা এক সাংস্কৃতিক নির্বাসনের দ্বারা। কবিকে রাখা হল মঞ্চে, মাইক্রোফোনের সামনে, দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। যেখানে তার শব্দের ধার নষ্ট হয়ে গেল, বাক্য হয়ে উঠল অলঙ্কার এবং ধীরে ধীরে কবির আঙুলে শিকল পরানো হলো।


কিছু শব্দ তো হার মানে না। কিছু কবিতা—কিছু কবি—কিছু শব্দচয়নের ভেতর এক অসমাপ্ত ক্ষোভ থাকে এবং সেই ক্ষোভ জমে-পচে-গলে গিয়ে এক শুয়োপোকা তৈরি করে। এই শুয়োপোকা তার খাবার খুঁজে নেয় মরা কবিতার কঙ্কালে। তার খাদ্য আমাদের বর্জিত পঙ্‌ক্তিমালা, নিষিদ্ধ ভাষা আর অপ্রকাশিত অনুভব। সে রাষ্ট্রের ঘৃণায় বড় হয় এবং একসময় তার শরীরজুড়ে গজিয়ে ওঠে এমন এক প্রতিবাদ যাকে আর কবিতা বলা যায় না। তাকে শুধু টের পাওয়া যায় হাড়ের কাঁপুনিতে, আতঙ্কে, সাহসহীনতা ও বিস্ময়ে।


আমরা এই লেখায় সেই শুয়োপোকার দিকে তাকাতে চাই। তাকে নাম দিতে চাই না, কারণ সে প্রতীক মাত্র। সে কবি হতে পারে হতে পারে রাজনৈতিক বন্দী হতে পারে ঘরে বসে থাকা এক নারীবাদী মেয়ে অথবা একটা ছিন্নমূল শিশুও। তার ভেতরে যে ভাষা জমে আছে সেই ভাষাই আমাদের মৃত কবিতার বংশধর।


ভাষার এই নতুন প্রজন্ম রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে না কারণ রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেয় না। সে রাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলে। তার অস্তিত্ব নিঃশব্দ, তার কবিতা  গোপন। তবে তারই কারণে রাষ্ট্র ঘুমাতে পারে না। এই ভয়ই কবিতার পুনর্জন্ম। তাই এই ভূমিকা একটি অদৃশ্য নোটিশ, এক ব্যতিক্রমী আবশ্যিক ঘোষণাপত্র, যেখানে আমরা বলছি কবিতা মারা গেছে, প্রতিষ্ঠান তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করেছে, কবি এখনও মাটির নিচে, মৃতদেহের নিচে, কফিনের আঁধারে এক শুয়োপোকা হয়ে বেঁচে আছে এবং আমরা সেই শুয়োপোকার পক্ষে।


কবিতার রাষ্ট্রীয় শবদাহ


রাষ্ট্রের প্রকৃত চারিত্র‍ নির্ধারিত হয় তার ভাষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে। রাষ্ট্র চায় একটি নির্ঝঞ্ঝাট, অভিন্ন, নিয়ন্ত্রিত ভাষা যাতে সমস্ত অনিশ্চয়তা—সম্ভাবনা—বিচ্যুতি স্তব্ধ হয়ে যায়। কবিতা ঠিক এই স্তব্ধতার মধ্যে অনুপযুক্ত এক ঝড়। রাষ্ট্রের চোখে কবিতা মূলত এক রাজনৈতিক সমস্যা। কবিতা নিজের শরীরেই বহন করে উচ্ছৃঙ্খলতা—আত্মবিপর্যয়—উন্মাদনা। যা রাষ্ট্রের পরিকল্পিত নাগরিক কাঠামোকে আঘাত করে। রাষ্ট্র চায় কবিতা একটি আনুষ্ঠানিক কণ্ঠস্বর হোক জাতীয়তা উন্নয়ন আর শৃঙ্খলার প্রতিনিধি। তবে কবিতা কখনোই এই সজ্জিত নাগরিক ভূমিকার সঙ্গে একমত হয় না। কবিতা চায় জিহ্বা থেকে রক্ত পড়ুক, ভাষা হোঁচট খাক, ছন্দে পচন ধরুক। ফলে রাষ্ট্র কবিতাকে আলাদা করে রাখে, নিঃশব্দে সেন্সর করে, উৎসবে বেঁধে ফেলে কিংবা পাঠ্যবইয়ের স্যানিটাইজড কবিতা দিয়ে শিশুকে শেখায় একধরনের সৃজনশীল ও আদর্শ কবিতা। এইভাবেই শুরু হয় কবিতার শবদাহ।


কবিতা হয়ে গেছে রাষ্ট্রের কাছে এক অবাধ্য চিৎকার। চিৎকার রাষ্ট্রের কাছে এক অশ্লীল শব্দ। অথচ কবিতার জন্মই সেইসব শব্দ থেকে যেগুলো ভাষা হবার আগেই আহত হয়। রাষ্ট্রের চোখে কবিতা এক অকার্যকর প্রলাপময় ক্রিয়া। রাষ্ট্র যদি চায় একরৈখিক উন্নয়নপথ, তবে কবিতা সবসময় চায় এক ভাঙা ক্ষতবিক্ষত কদর্যময়পথ। রাষ্ট্র যেখানে শ্লোগান লিখে দেয় কবিতা সেখানে প্রশ্ন তোলে। ‘এই সমাজ আমাকে বাউণ্ডুলে বলুক,/ আমি তোদের রাষ্ট্র মানি না—আমি তো মানুষের রাষ্ট্র চাই।’ (রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ) এই উচ্চারণ রাষ্ট্রের জন্য অমার্জনীয়। রাষ্ট্র জানে কবিতা যখন সত্য কথা বলে তখন সে নিজের সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলে। রাষ্ট্র জানে এক একাকী কবিতাও কখনো একটি জনতার সমান ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই ভয় থেকেই রাষ্ট্র কবিতাকে সাজঘরে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাকে নির্বিষ করে তোলে।


এখন কবিতা সংশোধিত হচ্ছে। নিরাপদ করে তোলা হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের জন্য। পাঠ্যবইয়ের কবিতা এক নির্বিষ চিত্রপট। রাষ্ট্র কবিতাকে ছাত্র বানায় আর কবিকে বানায় ব্যাকরণ শিক্ষক। সমস্ত ঝুঁকি, দুঃস্বপ্ন, ক্রোধ, কাম—মুছে ফেলা হয়। নজরুলের-‘তোরা সব শালা মুসলমান হ’ কিংবা ‘মসজিদে আজ দিছে তালা, বিধবার ঘরে আজ পূজা’ এই লাইনগুলো পাঠ্যবই থেকে মুছে যায়। সেখানে শুধু বিদ্রোহীর প্রথম তিন লাইন থাকে। রোমান্টিক চেহারার বিপ্লব থাকে, বাস্তবিক বিপ্লবের গন্ধ থাকে না। জীবনানন্দের নিঃসঙ্গতা, লালনের ধর্ম-অতিক্রমী বোধ, শক্তির রক্তমাখা ভাষা সবই সাবধানে বাদ পড়ে যায়। পাঠ্যবইয়ে কবিতা মানে আপদমস্তক নিরাপদ কবিতা।


রাষ্ট্রপোষিত কবিতা সবসময় ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলে। সে দুঃখ প্রকাশ করে অথচ বিদ্রোহ করে না। সে প্রশ্ন তোলে না সে ঘৃণা করে না। ‘আমাদের সূর্য, আমাদের শান্তি, আমাদের ফসল’ এই জাতীয় উচ্চারণ রাষ্ট্রের প্রিয়। এসব কবিতা শুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য এবং প্রোফেশনাল। অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা রক্তাক্ত। ‘আমাকে রাষ্ট্র দেবে না কিছু,/ আমি রাষ্ট্রকে ছিঁড়ে ফেলব একটি কবিতায়’ এই কবিতা রাষ্ট্র চায় না। লিটলম্যাগাজিন মানে স্বতন্ত্রতা, বিকল্প ভাষা, নির্দয় সত্য। এই কবিতা কোনো মঞ্চে পড়ে শোনানো যায় না কারণ সে চিৎকার চেচামেচি করে। তার মধ্যে সামাজিক সৌন্দর্য থাকে না, থাকে দুর্দান্ত কুৎসিততা। রাষ্ট্র এই কবিতা ছাপায় না। কারণ সে জানে এই কবিতা আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে।


সাহিত্য উৎসব রাষ্ট্রের সবচেয়ে মার্জিত অপারেশন। এখানে কবিরা আলোকিত মঞ্চে বসে  মৌলিকতা—সমাজ—মার্জিত প্রতিবাদ নিয়ে আলোচনা করেন। রাষ্ট্রের উৎসব কখনোই খসখসে ভাষাকে টেনে আনে না। কারণ এতে নোংরা বাস্তবতা আছে। এতে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মিথ ভেঙে পড়ে। উৎসবে থাকে ‘সমাজে কবিতার ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনার নামান্তরিত নিস্তব্ধতা। এক প্রকার ফ্যাশনেবল শবদাহ। কবি মৃত তবে নান্দনিক। তার মৃতদেহের গায়ে আছে অলংকার মুখে আছে একটি কোটেশন।


রাষ্ট্র ভাষাকে তদারক করে। রাষ্ট্র চায় নৈতিক ভাষা। যেখানে যোনি—রক্ত—লিঙ্গ—ঘৃণা—উন্মাদনা নিষিদ্ধ। কবিতা এখানে বিব্রত। তাকে বলা হয় শালীন কবিতা লেখো। রাষ্ট্রের নৈতিকতাবোধ আসলে একটি পরিকল্পিত চক্ষুবন্ধীতা। রাষ্ট্র চায় কবিতা শুধু প্রেমিকাকে বলুক ‘তুমি আকাশের মতো সুন্দর’। কবিতা বলতে চায়—‘তুমি হেমন্তের মতো নিষ্ঠুর, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ রাষ্ট্র এই ধাক্কা নিতে পারে না। ভাষার ভেতরে তাই একটি চিহ্নিত সীমারেখা টেনে দেয়। কবিতা যদি সেই রেখা পেরোয় তবে তাকে বলা হয় অসামাজিক—অনৈতিক—বিদ্বেষমূলক।


রাষ্ট্র যখন কবিতাকে পুড়িয়ে ফেলে তখন কবি নিজেকে গোপন করে। সে হয়ে ওঠে একটি শুয়োপোকা। এই রূপান্তর অস্তিত্বগত। এই শুয়োপোকা বহন করে কবিতার সংক্রমণ। সে প্রকাশনায় নেই পাঠ্যবইয়ে নেই কিন্তু তার অস্তিত্ব সর্বত্র বিরাজমান। সে লেখে ফাঁকা দেয়ালে, ফেসবুকের নোটে, চিরকুটে অথবা এক ক্লান্ত রাতের ঘুমহীনতায়। এই শুয়োপোকা জানে রাষ্ট্র তাকে দেখতে পায় না এবং এই দেখার বাইরে সে কবিতা হয়ে ওঠে। একদিন হয়তো তার শরীর থেকে জন্ম নেবে নতুন এক শব্দ—এক ভাষা—এক আগুন।


কবির জীবন চক্রে কবি জন্মায় ভাষার নিষিদ্ধ কোষ থেকে


কবি কখনো নিরাপদ মাতৃভাষায় জন্মায় না। তার জন্ম ভাষার সেই কোষে যেখানে শব্দ এখনো নিষিদ্ধ, উচ্চারণ এখনো অনুশীলিত হয়নি। যেখানে ভাষা আর্তনাদ, বিড়ম্বনা কিংবা অহেতুক ঘৃণার রসায়ন। কবির জন্ম কোনো শিশুর জন্মের মতো নয়। এ জন্ম নিঃশব্দ আর বিপ্লবঘণিষ্ঠ। মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে কবি নিজের ভাষা খুঁজে পায় না। সে শুধু ভাষার এক ছিন্নপত্র হাতে পায়। যা পায় তা অর্ধেক শব্দ, বিকৃত উচ্চারণ এবং ছেঁড়া ছন্দ।


এই ভাষাহীনতা থেকেই কবি শব্দ খোঁজে। সে শুরু করে ব্যর্থ উচ্চারণ দিয়ে। এই ব্যর্থতার মধ্যেই তার শৈশব এবং এই শৈশবেই কবি আবিষ্কার করে ভাষা মানেই অস্ত্র, ভাষা মানেই একটি সম্ভাব্য বিদ্রোহ। সমাজ তাকে শেখায় ভাষার নিয়ম—ব্যাকরণ—নৈতিকতা। কবি শিখে এই নিয়মই বন্দিশালা। ফলে কবির জীবন শুরুই হয় এক অনুশাসন বিরোধী অভিজ্ঞতায়। এই বিরুদ্ধতা সে প্রথমে টের পায় আত্মপরিচয়ের মধ্যে। আমি কে? কেন আমি ভাষার এই দিকটা বেছে নিচ্ছি? কেন আমি ভাষার দুঃস্বপ্নকে ধারণ করছি? সেকারণে প্রথমে সে সমাজ-মনস্ক পরে  লেখক হয়ে ওঠে। শেষে একসময় রাষ্ট্রের চামড়ায় গর্ত করে সে শুয়োপোকা হয়ে যায়। 


কবির জীবনচক্র একটি শারীরিক পরিবর্তনের চেয়ে বেশি। এটি একধরনের অস্তিত্বগত রূপান্তর। প্রথম পর্যায়ে কবি সমাজ-মনস্ক। সে সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে সমাজকেই দেখে তার বঞ্চনা—বৈষম্য—রক্তাক্ততা—শাষণ। সে কবিতা লেখে সমাজ বদলের কথা ভেবে আর বিপ্লবের কথা ভেবে। সে বিশ্বাস করে কবিতায় বদল আনবে। এই পর্যায়ে কবি বহু সময় রাষ্ট্রের ভাষাও ব্যবহার করে। সেই বিশ্বাস থেকে একধরনের অহঙ্কার জন্ম নেয় কবির ভেতরে। সে জানে না এই অহংকার একদিন তার কবিতাকেই হত্যা করবে।


পরবর্তী পর্যায়ে সে কবি-সাহিত্যক-গল্পকার হয়ে ওঠে। সে পাঠ করতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ—জীবনানন্দ—শক্তি—বিনয়-সুবিমল-রিয়াজুর রশীদ—ঋষি এস্তেবান। সে বোঝে কবিতা শুধু সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, কবিতা নিজেই এক নির্মাণ, এক স্থাপত্য। এই উপলব্ধি তাকে জটিল করে তোলে। সে আর সরল স্লোগান লেখে না। তার কবিতায় আসে বিভ্রান্তি, অন্তর্জগতের নির্বাসন, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং ভাষার ভাঙন। এই পর্যায়ে সে সমাজ থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। তখন সাহিত্য হয়ে ওঠে তার আশ্রয় ও অস্ত্র। 


অবশেষে সেই কবি হয়ে ওঠে একটি শুয়োপোকা। রাষ্ট্রের চামড়ায় গর্ত করা এক নিরব পোকা। এই শুয়োপোকা আর নিজের পরিচয় নিয়ে সচেতন নয়। সে জানে তার অস্তিত্বই এখন বিপজ্জনক। সে নিজেকে ক্রমশ অপ্রকাশিত করে রাখেন। সে চিৎকার করে নিজের প্রতিধ্বনী নিজেই যেনো শুনতে পায়। সে কোনো সংগঠনের অংশ নয়, সে কোনো প্রতীক নয়, সে হয়ে ওঠে এক জৈব প্রতিরোধ। এই অবস্থায় কবিতা আর অস্তিত্ব আলাদা নয়। কবিই কবিতা এবং সেই কবি হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক চলমান সংক্রমণ। তখন সেই কবির অস্তিত্বই বিপজ্জনক। কারণ সে মৃত কবিতার তলায় বেঁচে থাকতে চায়।


আজকের দিনে কবিতা এক মৃত ভাষার অবশেষ। সে এখন উৎসবের স্মারক, পুরস্কারের ক্রেস্ট বা পাঠ্যবইয়ের এক নিস্তরঙ্গ অনুচ্ছেদ। কিন্তু কবি এখনো বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে এই লাশের নিচে। যেখানে কবিতা এক স্যানিটাইজড প্রতিষ্ঠান। কবি এখনো গোপনে ভাষার সীমা ভাঙছে। রাষ্ট্র কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে কারণ সেটা ব্যবহৃত হতে পারে কিন্তু কবিকে বাঁচিয়ে রাখে না কারণ সে নিয়ন্ত্রণের বাইরে অবস্থান করে।


কবি এখন এক অনিয়ন্ত্রিত শুয়োপোকা। যে এই মৃত কবিতার তলায় তার সনদপত্র, পুরস্কার এবং মর্যাদার ছাউনির নিচে ক্রমাগত গর্ত করে যাচ্ছে। এই গর্ত করা মানেই রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রে ছিদ্র তৈরি করা। এই কবি যখন লেখে তখন তা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রবিরোধী দলিল।


কবি আসলে কে? এই প্রশ্ন কোনো আত্মজৈবনিক কৌতূহল নয়। এটি রাষ্ট্রের এবং সমাজের কাছে এক নিবারণযোগ্য ঝুঁকি। কবির আত্মপরিচয় একটি ধোঁয়াটে নৃবিজ্ঞানের মতো যা একইসাথে রাষ্ট্রচিন্তা, ভাষাচিন্তা এবং রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কবি সমাজের দেয়া কোনো পরিচয় মানতে চায় না। সে জাতি, শ্রেণি, ধর্ম বা এমনকি যৌন পরিচয়েও স্থিত নয়। ফলে তার এই পরিচয়হীনতা রাষ্ট্রের চোখে বিপজ্জনক। প্রথম জীবনে কবি ভাবে সে হয়তো একজন শিক্ষিত মানুষ কিংবা একজন মধ্যবিত্ত কণ্ঠ। খুব তাড়াতাড়ি সে বুঝে যায় এই পরিচয়ই সবচেয়ে কৃত্রিম। কারণ শিক্ষার ভেতরেও থাকে দমন, ভাষার ভেতরেও থাকে বর্ণবাদ। একেকটি উচ্চারণে একেকটি শব্দে রাষ্ট্র কবির মুখে তুলে দেয় যে কবিতা তা আসলে এক ধরণের ঐক্যবদ্ধ উপনিবেশ। কবি এই উপনিবেশের ভেতর থেকেই খুঁজে পেতে চায় তার শরীরের ভাষা তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ।


এই খোঁজ থেকেই শুরু হয় পরিচয়ের সংকট। কবি হয়ত পায় এক ভাষিক শিকড়। গ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণের বা ছুঁড়ে ফেলে দেয়া কোনো ভাষার। আর সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান তাকে চায় শুদ্ধ বাংলায়। এ কারণে কবি বিভাজিত হয়ে যায় তার নিজের ভেতরেই। যেখানে একদিকে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানিকতা অন্যদিকে তার আদি ভাষা, শরীর ও উচ্চারণ। এটাই কবির আত্মপরিচয়ের ট্র‍্যাজেডি। সে যে ভাষায় সবচেয়ে সহজ সেই ভাষাতেই সে সবচেয়ে অনাহুত।


কবির ভাষা কখনোই নিরপেক্ষ নয়। সে এক রাজনৈতিক অস্ত্র। কবি যখন ভাষা ব্যবহার করে, তখন সে কেবল অর্থ প্রকাশ করে না। সে ভাষার মাধ্যমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধিতা না হলেও রাষ্ট্র নির্ধারিত ভাষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ভাষাতাত্ত্বিক যুদ্ধ। কবির বাক্য গঠন, তার ছন্দ ভাঙা, তার বাক্যাংশ ছেঁড়া সবই একেকটি প্রতিবাদী ভাষাচরিত্র।


এই সমাজবিরোধিতার ভাষা বহুস্তরীয়। যেমন, একজন কবি যদি বলে—‘আমার শরীরেই রাষ্ট্রের পতাকা পোড়ে’ তাহলে সেটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত করা হয়। কবি ভাষাকে চূর্ণ করে পুনর্গঠন করে। সে শব্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় বহিরাগত ঘ্রাণ, যৌনতা কিংবা গোপন ধর্মানুভূতির রক্তচাপ এবং এইভাবেই কবিতা হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ। যা রাষ্ট্রের রুচিগত ও নীতিগত নির্মাণের বাইরে। এ ভাষাবিজ্ঞান আমাদের শেখায় কবির ভাষা একটি শরীর এবং সেই শরীর রাষ্ট্রের ভাষা-সংহিতা বহন করে না। তার বাক্য এক অব্যাকরণিক অস্তিত্ব। তার বাক্যের ভেতরেই সমাজবিরোধিতা, লিঙ্গবিপর্যয় ও শ্রেণিচ্যুতি প্রবাহিত হয়। ফলে কবি ভাষা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের দেহে একপ্রকার ফাটল সৃষ্টি করতে।


প্রতিটি কবির উচ্চারণের পেছনে থাকে তার ব্যক্তিগত ইতিহাস। যা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ লুকাতে চায়। এই ইতিহাস কখনো যৌন কখনো গোষ্ঠীগত কখনো শ্রেণির অন্তঃস্থ আঘাত থেকে উৎসারিত। কবি যখন সেই ইতিহাস প্রকাশ করে তা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের পবিত্রতার বিরুদ্ধে এক উচ্চকণ্ঠ চিৎকার। তখন কবির উচ্চারণ হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ।


রাষ্ট্র চায়, কবি যেন সমাজের প্রতিনিধি হয়। কবি তো সমাজের অন্তঃস্থ গর্ভফাটা শব্দ! কবির উচ্চারণে আসে ক্লীবতা—লাঞ্ছনা—যৌনতা-আক্রমণ—জাতিবিদ্বেষ—নির্লজ্জতা। এই নিষিদ্ধ উপাদানগুলো সমাজ কখনো কবিতার অংশ হিসেবে মানতে চায় না। কবিকে তার নিজের ইতিহাসের উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয় আর এই নিষেধাজ্ঞার ভেতরেই সে গড়ে তোলে এক বিকল্প কবিতা। যা শুধু অন্তঃশব্দের মতো অনুরণিত।


এই অনুরণনই কবিকে আলাদা করে। সে চিৎকার করে বধ্যভূমির ভাষায়। এই ভাষা কখনো পুরোপুরি কবিতার পঙক্তি হয় না, কখনো কেবল একমাত্রিক উচ্চারণ কান্নার ধ্বনি, ঘৃণার শব্দ, বা এক অপরিচিত ভেতরের ঘ্রাণ।


রাষ্ট্র কবিকে অসাড় করে তোলে একটি একাডেমিক পুরস্কার দিয়ে। একটি গদ্যসংকলনে তার নাম ঢুকিয়ে দিয়ে, একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়ে। তারপর কবি ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু কবি এই নিষ্ক্রিয়তা মেনে নেয় না। তারা মৃত কবিতার ভেতরেও বেঁচে থাকে। এই কবিরাই অবিনশ্বর। তারা রাষ্ট্রের ভাষায় কথা বলে না, রাষ্ট্রের কাঠামোতে মেলে না। তারা কখনোই নিঃশেষ হয় না। এরা এক ধরনের মলাটবিহীন কবি যারা ছায়ার মতো থেকে যায় পাঠকের স্মৃতিতে। তাদের কবিতা মুখে মুখে ফেরে, কখনো পাণ্ডুলিপি হয় না। তারা হয়ে ওঠে কবিতার ভূত। যারা মৃত কিন্তু তাড়িয়ে বেড়ায় জীবিতদের। এই ভূতত্বই কবির অবিনশ্বরতা। সে মরে না কারণ তাকে পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সে রাষ্ট্র, মৃত্যু এবং সাহিত্যতাত্ত্বিকের ক্যাটালগের বাইরে এক বিপন্ন প্রাণ। যে যতবার অবহেলিত হয় ততবার আরও গভীর শব্দ হয়ে ফিরে আসে।


লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ মানেই কবিতার প্রতিরোধ। এটি প্রায় একটি সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়া। তবে সব কবি কি সাংগঠনিক? অনেক কবিই একা, নির্জন, গোপন। ফলে লিটল ম্যাগাজিন ও নিঃসঙ্গ কবির মধ্যে রয়েছে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব। লিটল ম্যাগাজিন চায় ভাষার সামগ্রিক অভ্যুত্থান আর নিঃসঙ্গ কবি চায় ভাষার ব্যক্তিগত বিস্ফোরণ। এই দ্বন্দ্ব গোপনে রচিত করে কবিতার আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বৈরথ। অনেক সময় কবি নিজেই বুঝে না সে কোথায় দাঁড়িয়ে। সে কখনো নিজের কবিতাকে দেয় পাঠযোগ্যতা, কখনো শুধু নিজের মগজে রেখে দেয় অক্ষরগুলিকে। ফলে কবিতার যুদ্ধ শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় নিজের অস্তিত্বেও ভেতরেও।


নিঃসঙ্গ কবি যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনের প্ল্যাটফর্মের বাইরে, তার ভাষা হয়ে ওঠে আরও অগ্রহণযোগ্য, আরও বিকৃত, আরও গোপন। সে যেন নিজের ছায়াকেই কবিতার পৃষ্ঠায় ফেলে রাখে। যার পাঠক শুধুই সে নিজে এবং সেই কবিতা যখন কোন এক অনুপস্থিত পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় তখন সেটি হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ সংলাপ।


ভাষা, শরীর, কাম এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কল্পনাশক্তি শুয়োপোকার একধরনের জৈব বিদ্রোহ। এটি একদম নিঃশব্দে কাজ করে। ধ্বংস করে দেয় কাঠামোর মজ্জা, গিলে ফেলে রাষ্ট্রের চামড়া। এই শুয়োপোকা কবির প্রতীক। তার অন্তঃস্থ কল্পনাশক্তির শরীরী রূপ। সে যে কল্পনা করে তা আর নিস্পৃহ নয়, তা কামোন্মত্ত, তা অশ্লীল, তা রাষ্ট্রবিরোধী। রাষ্ট্র কবিকে চায় শুদ্ধ ভাষায়, শুদ্ধ কামনায়, শুদ্ধ চিন্তায়। কবি চায় ভাষায় কাম, চিন্তায় শরীর এবং কামনায় এক বিপর্যস্ত লালসা। তার কবিতা তাই এক পর্নোগ্রাফি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের চোখে। যা নিষিদ্ধ কিন্তু অবদমনযোগ্য নয়। শুয়োপোকার মতোই এই কবিতাগুলি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আর কামড়ে ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর।


এই কামনাময় কবিতা এক যৌনতাত্ত্বিক বিদ্রোহ, যেখানে শরীর ব্যবহার হয় রাষ্ট্রের নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে এবং এই কাম, এই ভাষা, এই বিদ্রোহই কবিকে পরিণত করে এক শুয়োপোকার মেটাফরে। যে কবিতার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে জীবিত এবং আরও বিপজ্জনক।


শুয়োপোকা ফুল খায়, পাতা খায় আর সেই ক্ষতই কবিতার পুনর্জন্ম


শুয়োপোকা রাষ্ট্রের চোখে কী? এক দানবীয় পোকা, যে রাষ্ট্রীয় পুষ্পবনের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এই শুয়োপোকাই একমাত্র জীব যে ফুলের রস ভোগ করার মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলে নতুন প্রাণের চক্র। ঠিক তেমনই কবিও ভাষার রস খুঁজে বেড়ায়। সে যে পাতা খায় তা আসলে ভাষার অন্ধকার, প্রান্তিক, অব্যবহৃত অঞ্চল। শুয়োপোকার মতোই কবিও এক অদৃশ্য গ্রাসকারী। যে ভাষার ভেতর থেকে শব্দের উপরশরীর ছিঁড়ে ফেলে নতুন শরীর গড়ে।


এই গঠনের ভাষার সৌন্দর্যবোধ নেই, নেই নান্দনিকতার রাজনীতি। এটি কেবল ক্ষত তৈরি করে। এই ক্ষতই তো ভবিষ্যতের ফুল। যে কবি শব্দ ভাঙে, যে কবি ছন্দের ভেতর ফাটল রাখে, যে কবি বাক্যকে ছিন্ন করে উচ্চারণ করে, সে আসলে ভবিষ্যতের কবিতাকে প্রস্তুত করছে। রাষ্ট্র তা বোঝে না। রাষ্ট্র চায় ফুল অক্ষত থাকুক যেন দর্শকদের চোখে ভালো লাগে। কবি চায় সেই ফুল যেন ঝরে পড়ে। যেন তার ভেতরের পোকা বেরিয়ে আসে। যেন সেই ক্ষত এক নতুন জীবন তৈরি করে।


কবির ভাষা যেন এক পোকার লালা আঠালো, তিক্ত, বিকৃত। তাতে থাকে দাগ, দংশন, কামড়ের চিহ্ন। এই ভাষা পাঠকের গায়ে লাগে এবং তাকে অস্বস্তিকর করে তোলে। এই অস্বস্তিই তো সত্য। সৌন্দর্যের নামে যে ভাষা রাষ্ট্র শেখায় ‘স্বচ্ছ—শালীন—নিরাপদ’ তা কবির জন্য এক জেলখানা। সে সে ভাষা ভাঙে, চুলকানি তৈরি করে, যেন পাঠক চামড়া চুলকে ফেলে দেয় সেই রাষ্ট্রীয় চামড়াটাকেই।


যে ভাষা কবি ব্যবহার করে তা ধ্বংসাত্মক, সেই ধ্বংস থেকেই জন্ম নেয় ভবিষ্যৎ চিন্তা। কবি যখন লেখে—‘আমার চামড়ায় রাষ্ট্রের সংবিধান গলে যায়’ তখন সে শুধু শব্দ খরচ করছে না, সে তার নিজস্ব শরীর দিয়ে রাষ্ট্রের গৃহীত ভাষাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করছে এবং এটাই তার চূড়ান্ত কাজ। ভাষাকে ফের শরীর করে তোলা যেখানে রক্ত আছে, লালা আছে, যৌনতা আছে, বমির মতো শব্দ আছে। তাই রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় অথচ চুপিচুপি তারই ভাষা নকল করে বিপণনের জন্য।


রাষ্ট্র—প্রতিষ্ঠান—মিডিয়া—সবাই চায় কবির মুখ বন্ধ থাকুক। অবশ্যই তারা জানে এই মুখেই আছে সেই আগুন। যা দিয়ে তারা নিজেদের বিপণন চালাতে পারে। তাই রাষ্ট্র একদিকে কবিকে নিষিদ্ধ করে অন্যদিকে তার ভাষাকে চুরি করে। আজকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য-ভাষা, বিজ্ঞাপন, এমনকি রাষ্ট্রীয় বার্তাও কবির কাছ থেকেই ধার করা ভাঙা বাক্য, ইঙ্গিতপূর্ণ উচ্চারণ, ছন্দের ভেতর রাগ, শরীরের ইমেজ।


কবি রফিক আজাদ যখন লেখেন ‘আমার জিভে জ্বলে ওঠে এক যন্ত্রণার মশাল’। রাষ্ট্র সেই লাইন চুরি করে বানায় স্বদেশপ্রেমের স্লোগান। মিডিয়া বানায় প্রেমের বিজ্ঞাপন। অথচ কবি জানে তার জিভ এক পোকা, যে দংশন করে, ঘা তৈরি করে এবং সেই ঘা থেকে ফুটে ওঠে এক নতুন সত্য। রাষ্ট্র এই সত্য চায় না তাই কবিকে পরিণত করে দেয় ‘পণ্য’তে। সে কবিকে পুরস্কার দেয়, সংবর্ধনা দেয়, তার বিদ্রোহী জিভকে চেপে ধরে রাখে পুঁজির তলায়।


এভাবে রাষ্ট্র কবির ভাষাকে শোষণ করে আর কবি প্রতিবারই এক নতুন মুখে ফিরে আসে আরও বিকৃত, আরও কামরসপূর্ণ, আরও ধ্বংসাত্মক। এই মুখ রাষ্ট্র কোনোদিন চেনে না কারণ প্রতিবার সে এক নতুন শরীর নিয়ে ফিরে আসে, নতুন বিষ দিয়ে। যেমন শুয়োপোকা তার চামড়া পাল্টায়, কবিও ভাষা পাল্টায়—আর প্রতিবার তার কামড় আরও গভীর হতেই থাকে।


কবিতার অ্যান্টিবডি শুয়োপোকার ভাষার জৈবিক মেটাফোর 


কবিতার সঙ্গে জীববিজ্ঞানের অ্যান্টিবডির মেটাফোর বেছে নেওয়া একান্তই অর্থপূর্ণ। জীবদেহে অ্যান্টিবডি হয় একধরণের সুরক্ষামূলক প্রতিরোধ। এটি জীবদেহে প্রবেশকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদানের বিরুদ্ধে কাজ করে দেহকে সুস্থ রাখে এবং বিপদের হাত থেকে বাঁচায়। কবিতাও একইরকম রাষ্ট্রীয় ভাষা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যে একরঙা, একনায়কবাদী, একপক্ষীয় বাণিজ্যিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার বিরুদ্ধে কবিতার অ্যান্টিবডি হিসেবে কাজ করে একটি বিষাক্ত, ভ্রান্তিকর ও অস্পষ্ট ভাষা। এই ভাষা দেখতে অস্বস্তিকর শুনতে অপ্রীতিকর হলেও কবিতার প্রাণ ও জৈবিক তেজ ধরে রাখে। যখন রাষ্ট্র ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে সে চাইছে ভাষাকে নিখুঁত, শাসনযোগ্য ও বাজার-বান্ধব করতে। তবে কবিতার অ্যান্টিবডি হিসেবে শুয়োপোকার মতো ভাষা সেই নিয়ন্ত্রণকে ভেঙে দেয়। ভাষার নিখুঁত মন্দিরে গর্ত করে গভীর অস্পষ্ট ছায়া ও গন্ধ ছড়ায়। এই ভাষা যতই বিষাক্ত মনে হয়, ততই সে জীবনের অপরিহার্য অংশ।


শুয়োপোকা অনেকের কাছে অপ্রিয়, নিকৃষ্ট ও নিষিদ্ধ প্রাণী। তবুও সে পৃথিবীর এক অদৃশ্য নায়ক। যিনি মৃতদেহের ভেতর থেকে পচনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্জীবনের চক্র শুরু করেন। কবিতার ভাষাও তাই। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মৃতপ্রায় ভাষার ভেতর দিয়ে নিজের পচন ঘটিয়ে নতুন জীবনের সূত্রপাত করে। শুয়োপোকার মতো ভাষা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের ভাষাব্যবস্থায় গর্ত করে সে ভাষার স্থায়িত্বেও ভেতরেই তার অস্থিরতা সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র চাইবে এই গর্তগুলিকে মেরামত করতে, নির্মল করতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে, অন্যদিকে শুয়োপোকার উপস্থিতি তাকে বাধ্য করে তার নিজস্ব কাঠামো ভেঙে ফেলতে। এই গর্ত শুধুমাত্র ভাষার কাঠামোতে নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরেও ভাঙন ধরায়। কবিতার শুয়োপোকার ভাষা তাই একটি বহুত্ববাদী, বহুমাত্রিক বিদ্রোহের প্রতীক, যা একদিকে নিষিদ্ধ, অন্যদিকে প্রাণবন্ত।


কবিতার ভাষার অ্যান্টিবডি রাষ্ট্রের ভাষার নীতি ও আদর্শের বিরুদ্ধেও সজীব প্রতিক্রিয়া। রাষ্ট্র যখন ভাষার শুদ্ধতা—নৈতিকতা—সুশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, কবির ভাষা তখনই তার অপরিচ্ছন্ন—অশ্লীল—অব্যবস্থাপনার উৎসে ফিরে যায়। এই ভাষা হয় এক ধরণের বিষাক্ত তরঙ্গ, যা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণশীল ভাষা-কাঠামোর ভেতর ঢুকে যায়। কবির ভাষার এই বিষাক্ততা রাজনৈতিক অর্থ বহন করে। এটি শ্রেণি—লিঙ্গ—জাতি—ধর্মের নির্ধারিত নিয়ম ভেঙে দেয়। যেখানে রাষ্ট্র ভাষা ক্ষমতার একটি মাধ্যম সেখানে কবিতার ভাষা সেই ক্ষমতার গলদ চিহ্নিত করে এবং সেই কারণে রাষ্ট্র এই ভাষাকে নিষিদ্ধ—অপমানজনক—অনৈতিক ঘোষণা করে। এটি স্বাভাবিক কারণ ভাষা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটি শক্তিশালি অস্ত্র। যা যদি নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যায় তবে রাষ্ট্রের আধিপত্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।


সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতার এই অ্যান্টিবডি ভাষা হলো বহিরাগত, নৈরাশ্যপূর্ণ ও বিপরীতমুখী। এটি রাষ্ট্রীয় অভিজাত ভাষার নিচু স্তর থেকে উঠে আসা শব্দ, উচ্চারণ এবং ভাবনার সমষ্টি। যারা ভাষার সেই দাপুটে কাঠামোর বাইরে তাদের ভাষা, তাদের শরীরের শব্দ, তাদের সামাজিক শ্রেণির ভাষা—সেই সব শব্দ কবিতার অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এটি ব্যক্তিগত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার ভাষা। যা রাষ্ট্রের সাধারণীকরণে উপনিবেশবাদী নিয়ন্ত্রণ এবং সংস্কৃতির শাসন থেকে মুক্ত। সেই ভাষার ভেতর থাকে উচ্চারণের বিকৃতি, দেহের স্পর্শ, কাম ও রাগের অবিকৃত শব্দসমূহ। এটি রাষ্ট্রের ভাষা-প্রতিষ্ঠানকে বারবার আক্রমণ করে।


রাষ্ট্রীয় ভাষা গড়ে উঠে শাসন ও বাণিজ্যের জন্য। এই ভাষা সুশীল—নিরাপদ—স্বচ্ছল হতে হয়। বই, মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী সবাই মিলে একটি কর্তৃত্ববাদী ভাষা-চেতনা বজায় রাখার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কাজ করছে। এই ভাষার উদ্দেশ্য পাঠক বা শ্রোতাকে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে রাখা। এই ভাষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার নিরপেক্ষতার দাবি। রাষ্ট্র দাবি করে তার ভাষা সব মানুষের জন্য এবং সব শ্রেণীর উপযোগী। 


কবিতা যখন এই রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বচ্ছলতা চ্যালেঞ্জ করে তখন তার ভাষা হয়ে ওঠে অশিষ্ট। কবিতার ভাষা হয় আঞ্চলিক উচ্চারণের চূর্ণাংশ, ব্যাকরণগত গণ্ডি ভাঙা শব্দগুচ্ছ কিংবা গোপন ও নিষিদ্ধ উপাদানের সমাহার। এটি একধরনের ভাষাগত বিদ্রোহ। এই ভাষা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে এক অনির্দেশ্য, অদ্ভুত আকার নেয়। যেমন কবির উচ্চারণে এলোমেলো শব্দ, অসমাপ্ত বাক্যাংশ, বাঁকা ছন্দ, অপপ্রয়োগ। এই ভাষা কখনো ধ্বনিতাত্ত্বিক বিবর্ণ, কখনো আবার অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ ও কটূক্তিপূর্ণ। এইসব বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের নির্ধারিত ভাষার বিরুদ্ধাচরণ।


রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান এই ভাষাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়। সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে ‘ভাষা শুদ্ধি অভিযান’। শিক্ষা, মিডিয়া, সাহিত্য পুরস্কার সবকিছু এই ভাষাকে বিবর্তিত ও নির্বাচিত রূপে গড়ে তুলতে চায়। তবে কবিতার ভাষা এই দমনকে মেনে নেয় না বিধায় আরও বেশি অশিষ্ট হয়ে ওঠে। শুদ্ধ ভাষার প্রচারের মুখোমুখি সে আরও বেশি বিক্ষোভাত্মক ও উদ্ভট উচ্চারণের মাধ্যমে অস্তিত্ব প্রমাণ করে।


রাষ্ট্রীয় ভাষা বাণিজ্যকরণের হাতিয়ার। আর তাই কবিতার অশিষ্ট ভাষাকে কখনো কখনো বাজার উপযোগী করে তোলা হয়। যেমন গ্রামীণ বা নিম্নবর্গীয় উচ্চারণ, অশুদ্ধ শব্দ, কটু ভাষা—এসব ব্যবহার করে বিপণন প্রচার চালানো হয়। এখানে একটি প্যারাডক্স তৈরি হয়। রাষ্ট্র কবিতার ভাষাকে নির্ধারিত মানদণ্ডের বাইরে রাখে না কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে তার অপরিহার্যতা মেনে নেয়। এই দ্বৈরথ কবিতার ভাষার বহুমাত্রিকতা বাড়ায়। যেখানে কবিতা হয় একদিকে নিষিদ্ধ অন্যদিকে বাণিজ্যিক, একদিকে বিদ্রোহী, অন্যদিকে জনপ্রিয়।


ভাষার শূন্যস্থান থেকে ভাষার বিপ্লব


রাজনৈতিক ভাষা, সামাজিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক নিয়মের ঘেরা এক ‘সভ্যতা’ বা ‘কৃষ্টি’ থাকে, যা রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এই সভ্যতার কেন্দ্রে থাকে নিয়ন্ত্রিত ভাষা যা সার্বজনীন, নৈতিক ও বাণিজ্যিক মূল্যায়নে প্রাধান্য পায়। কবিতার শূন্যস্থান হলো সেই স্থান যেখানে এই নিয়ন্ত্রিত ভাষা অসফল হয়, শব্দ ভেঙে পড়ে, ব্যাকরণ ভেঙে যায়, অর্থ এবং বোধের স্তর থেকে ভাষা বিচ্ছিন্ন হয়। এই শূন্যস্থান থেকে শুরু হয় বিপরীত-সভ্যতার নির্মাণ। শূন্যস্থান এক ধরনের নির্জন অঞ্চল যেখানে রাষ্ট্রের ভাষা ক্ষমতা শক্তিহীন হয়। এখানে ভাষা হয় এক ধরণের ভ্রান্তি, অশ্রুত, অতিপ্রাকৃত এবং বিদ্রোহী। এই শূন্যস্থানের ভাষা বিদ্রোহের এক প্রাণশক্তি।


রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান ভাষাকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। অথচ শূন্যস্থান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরের এক অবস্থিতি। এখানে ভাষার নিয়ম ভেঙে যায় বাক্যের অর্থচিন্তায় দূর্বলতা দেখা দেয়। এই দুর্বলতা থেকেই নির্মিত হয় বিপরীত-সভ্যতা একটি ভাষিক ও সাংস্কৃতিক জগত যা রাষ্ট্রীয় সভ্যতার বাউন্ডারি ছাড়িয়ে যায়।


কবি শূন্যস্থানকে গঠনমূলক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন। যেখানে ভাষার বিপর্যয় ঘটায় নতুন ধ্বনি, নতুন শব্দ, নতুন ছন্দ এবং নতুন ভাবের জন্ম। এই প্রক্রিয়াটি ভেঙে দেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন এক বিপরীত-সভ্যতা গড়ে ওঠে। এখানে কবিতার ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার বাইরের শব্দ ও ভাবের অন্বেষণ করে। শূন্যস্থান কবির ভাষাকে অচেনা এবং অপরিচিত করে তোলে। যা অন্যদের জন্য অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট। এই অস্বচ্ছতা এই অস্পষ্টতাই কবিতাকে সজীব করে রাখে। বিপরীত-সভ্যতার ভাষা বহুত্ববাদী। এই ভাষার বৈচিত্র‍্য ও অসঙ্গতি তাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার একদম বিপরীতমুখী করে তোলে


কবিতা বিপরীত-সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। একে অপরকে সহায় করে ও সমৃদ্ধ করে। কবিতার শূন্যস্থান থেকেই বিদ্রোহী ভাষা গড়ে ওঠে আর এই ভাষা বিপরীত-সভ্যতার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালন করে। কবিতার বহুমাত্রিক ভাষা ও ভাব বিপরীত-সভ্যতার মূল প্রাণশক্তি। কবিতা বিপরীত-সভ্যতার ভাষার অস্ত্র ও প্রতীক।


বাংলা আধুনিক কবিতার কিছু উদাহরণ (যেমন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রশীদ হারুণ এর কবিতা) দেখায় কীভাবে কবি শূন্যস্থান থেকে ভাষা গড়ে তোলেন। এই ভাষায় আছে আঞ্চলিক উচ্চারণের খাঁজ, ব্যক্তিগত যৌনতা ও শারীরিক অভিজ্ঞতার শব্দ, নিষিদ্ধ উচ্চারণের ভিড়। এমন ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছলতা ও বাজারের ভাষার বিপরীতমুখী। এটি নিষিদ্ধ কিন্তু সজীব, ধ্বংসাত্মক কিন্তু প্রাণবন্ত।


বর্তমান বিশ্বে কবিতা ও বাজারের সম্পর্ক জটিল ও দ্বৈরথপূর্ণ। বাজার কবিতাকে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে গড়ে তোলে। যেখানে কবিতা বাজারের নিয়মে বেঁধে ফেলা হয় পাঠক সংখ্যা, বিক্রয়মান, জনপ্রিয়তা। কিন্তু কবিতা নিজেই একটি বিদ্রোহী জিনিস যা বাজারের নিয়ম ভাঙে। কবিতা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষা বাজারের ভাষা নয়। সে ভাষা অশিষ্ট, নিষিদ্ধ ও অপ্রচলিত।


বাজারিকরণে কবিতার ভাষা সংকুচিত হয় সহজবোধ্য, জনপ্রিয়, একঘেয়ে শব্দ ও ভাবের বন্দী হয়। বাজার চায় কবিতাকে ‘পণ্য’ হিসেবে তৈরি করতে। যেখানে ভাষা শুদ্ধ, মধ্যম ও গণমানুষের জন্য হওয়া দরকার। এই বাজারীয়ীকরণের ফলে কবিতার একাধিক ভাষা, উচ্চারণ, ভাব ও কল্পনা স্তর মুছে যায়। কবিতা বাজারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুয়োপোকার মতো ভাষা তৈরি করে। একটি অশিষ্ট, বহুমাত্রিক, নিষিদ্ধ ও ব্যক্তিগত ভাষা। এই ভাষা বাজারের স্বচ্ছলতা ভেঙে ফেলে। ভাষার অশুদ্ধতা ও অপরিচ্ছন্নতা ফিরিয়ে আনে।


কবিতার ভাষা বাজারের পণ্যীকরণকে বাধা দেয়। বাজারের নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কবিতার এই সজীব প্রতিক্রিয়া হলো এক ভাষাতাত্ত্বিক বিদ্রোহ যা বাজারের সহজবোধ্য ভাষাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। কবিতা যখন একদিকে লিটল ম্যাগাজিন, গুটিকয়েক পাঠক ও বিক্রয়-বিহীন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ পায়, অন্যদিকে কিছু কবিতা জনপ্রিয়তার মুখে বাজারে আসে। এই দ্বৈরথের মধ্যে থাকে কবিতার ভাষার দ্বৈরথ। কোনো কবি তার ভাষার অশিষ্টতা বজায় রেখে বাজারে সফল হতে পারেনা। আবার বাজারের ভাষা গ্রহণ করলে তার বিদ্রোহী ক্ষমতা কমে যায়।


বাজার ও রাষ্ট্র একযোগে কবিতার ভাষাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তারা কবিতার অবাঞ্ছিত ভাষা নির্মূল করতে চায় যাতে কবিতা সুন্দর, গ্রহণযোগ্য ও সুস্থ হয়। অথচ কবিতা শুয়োপোকার মতো শরীর ব্যবহার করে এই নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেয়। সে তার ভাষা দিয়ে রাষ্ট্র ও বাজারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এক নতুন বিপরীত-সভ্যতা গড়ে তোলে।


বাজার ও রাষ্ট্র যখন ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে নিরবধি শাসন করতে চায়, কবিতা তখনই শুয়োপোকার মতো বিদ্রোহী ভাষা তৈরি করে। এই ভাষা নিষিদ্ধ, বিক্ষিপ্ত, বহুত্ববাদী ও বিক্ষোভী। এটি এক বিপরীত-সভ্যতার জন্ম দেয় যেখানে ভাষার নতুন রূপ, নতুন অর্থ ও নতুন সম্ভাবনা গড়ে ওঠে।


কবিতার মৃত্যু কিংবা ভাষার মৃত্যুর পরে কবিতা


‘কবিতার মৃত্যু’—এই শব্দবন্ধের আভিধানিক অর্থেই রয়েছে একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত। তবে এই সংকট কখনও পুরোটাই বাস্তব ছিল না, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারনার উত্থান এবং বিকাশের ফল। সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যখন আমরা দৃষ্টিপাত করি, তখন দেখি ‘কবিতার মৃত্যু’ ধারণা একেবারেই নতুন নয়। পশ্চিমী সাহিত্য ও দর্শনে এটি অনেকবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে যা আধুনিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছে।


১৮৬৭ সালে ফ্রেঞ্চ কবি ও নৃতাত্ত্বিক রেনে ওয়ালেক পোয়েট্রি ইজ ডেড এর মতো বাক্য উচ্চারণ করেননি, তবে তখন থেকেই আধুনিকতার কবিতা নিয়ে চিন্তাভাবনায় প্রথম ধাপের সংকট স্পষ্ট হতে শুরু করে। শিল্প ও সাহিত্য যখন শিল্পকলা ও বাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। তখন কবিতার মৃত্যু বা অচল হওয়ার ধারণা প্রচলিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে মার্কিন কবি ও সাহিত্যিক টি.এস.এলিয়ট তার একটি নিবন্ধতে লিখেছিলেন— কবিতা সেই ক্ষমতাহীনতায় পতিত হয়েছে যা পূর্বে ছিল না। এখানে তিনি মূলত আধুনিকতার এক সংকটকে তুলে ধরেন— কবিতার ঐতিহ্য ও ঐন্দ্রজালিকতা হারিয়ে ফেলার নানান বিপদ।


রোমান্টিক যুগে কবিতাকে জীবনদর্শন, প্রকৃতির উৎসাহ ও মানসিক উৎকর্ষের ভাষা হিসেবে বর্ণনা করা হত। কিন্তু শিল্প বিপ্লব ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে আধুনিকতার শুরুর দিকে কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শিল্পায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় শাসনের ছত্রছায়ায় কবিতার ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংকুচিত হতে শুরু করে। তখন থেকে ‘কবিতার মৃত্যু’ নিয়ে চিন্তাধারা দৃঢ় হয়। ২০ শতকের মধ্যভাগে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘কবিতার মৃত্যু’ ধারণা পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়। আধুনিকতাবাদের বিস্ময়কর পতনের পর পোষ্টমডার্নিজম আসে যা নতুন করে কবিতার অস্তিত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন তোলে।


আধুনিকতা শব্দটির সঙ্গে যুক্ত থাকে অগ্রগতি, বৌদ্ধিকতা, বিজ্ঞান এবং শিল্প বিপ্লব। এই যুগে কবিতা প্রচলিত ধাঁচের বাইরে গিয়ে নতুন ধারণা, গঠন ও ভাষার সন্ধানে নিয়োজিত হয়। আধুনিকতার সীমানার ভেতরেই কবিতাকে নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামো, শিল্পায়ন, বাজার ব্যবস্থা কবিতাকে একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে কবিতার নিজস্ব ঐন্দ্রজালিকতা ও মুক্তির চাহিদা মিশ্রিত হয়ে আধুনিকতার কবিতা নতুন দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে। আধুনিক কবিতা প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয় কিন্তু রাষ্ট্র ও বাজার কবিতার স্বাধীনতা সংকুচিত করতে চায়। ১৯৬০-৭০ এর দশকে পোষ্টমডার্নিজম এসে আধুনিকতার সব রীতিনীতি ভেঙে দেয়। পোষ্টমডার্ন ধারায় ভাষা ও অর্থের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো প্রমুখ দার্শনিকরা ভাষার বিচ্ছিন্নতা ও অন্তহীনতার কথা বলেন।


এই প্রেক্ষাপটে কবিতা যেমন একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে মৃত ঘোষণা পায় তেমনি নতুন রূপে গড়ে ওঠে একটি ভাষার খেলার মঞ্চ, যেখানে অর্থ স্থির নয়, পরিবর্তনশীল ও বহুমাত্রিক। এই ভাষার মৃত্তিকায় কবিতার অস্তিত্ব এক অন্যরকম মৃত্যু পায়। যেখানে পুরানো অর্থ হারায়, নতুন অর্থের সন্ধান চালায়। তবে পোষ্টমডার্ন কবিতার এই খেলার ভেতরেও একটি সংকট রয়ে যায় তা অর্থহীনতার আতঙ্ক। কবিতার ভাষা এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যে তার প্রাসঙ্গিকতা এবং সামাজিক প্রভাব কমে যেতে থাকে।


ভাষা ও সাহিত্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষমতার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। রাষ্ট্রীয় ভাষা ও সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের চিন্তা ও পরিচয় গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। এটি ভাষার স্বাভাবিক বহুমাত্রিকতা ও স্বাধীন চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করে। সাহিত্যের ইতিহাসই সাক্ষী যে, যেখানে যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতা শক্তিশালি হয়েছে, সেখানে কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করা হয়েছে। কবিতা যে ক্ষমতাশালি রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে সেটাই রাষ্ট্র এড়াতে চায়। কারণ কবিতা মুক্তির ভাষা যা রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।


বাজারবাদ অর্থাৎ পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় কবিতা একটি বস্তুরূপে পরিণত হয়েছে। যেখানে কবিতা বিক্রি ও বিপণনের উপকরণ। এই প্রক্রিয়ায় কবিতার সত্যিকারের ক্ষমতা, বিদ্রোহী শক্তি ও অর্থ অনেকাংশে বিলীন হয়ে যায়। ‘মৃত কবিতা’ ধারণা এখানে একটি সুবিধাজনক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা সাহিত্যকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। অর্থাৎ কবিতাকে মৃত বলে চিহ্নিত করে তাকে বাজারের নিয়মে আনতে চায়।


রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ‘মৃত কবিতা’ ধারণাকে ব্যবহার করে কবিতাকে গুটিয়ে ফেলে। কবিতার বিদ্রোহী ও বিপ্লবী শক্তিকে দমন করার জন্য এটি একটি অস্ত্র। কবিতাকে মৃত বলে চিহ্নিত করে, নতুন ভাষার বিকাশ ও বিদ্রোহী কবিতাকে গোপন উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে বাধা দেয়। ফলশ্রুতিতে এখানে কবিতার মৃত্যু ঘোষণা একটি সামাজিক কৌশল। ‘কবিতার মৃত্যু’ ধারণা ব্যবহার করে সমাজের বৃহত্তর অংশকে কবিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এটি একটি সামাজিক কৌশল যার মাধ্যমে কবিতা এবং তার পাঠক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।


‘কবিতার মৃত্যু’ ধারণাটি আদতে কবিতার প্রতি রাষ্ট্র, বাজার ও আধুনিক সাংস্কৃতিক কাঠামোর দ্বন্দ্বের একটি প্রতীক। কবিতা কখনোই সত্যিকার অর্থে মরে না। তা পরিবর্তিত রূপে, নতুন ভাষায়, নতুন স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। ‘মৃত কবিতা’ মিথটি একটি রাজনৈতিক ও বাজারবাদী কৌশল, যা কবিতার বিপ্লবী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।


শুয়োপোকারা এবং নতুন ভাষার ডিম থেকে কবিতার পুনর্জন্ম


শুয়োপোকা, যাকে অনেক সময় অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়, প্রকৃতপক্ষে এক বিস্ময়কর প্রতীক। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি মৃত্যুর এবং ক্ষয়িষ্ণু জীবনের দ্যূত রূপ হলেও ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে শুয়োপোকার গভীরতর অর্থ রয়েছে। যেমন ইউরোপীয় মধ্যযুগে শুয়োপোকাকে ধ্বংসাত্মক জীবজন্তু হিসেবে দেখানো হলেও ফরাসি বিপ্লবের সময় শুয়োপোকা একটি বিপ্লবী প্রতীক হয়ে ওঠে। গোপনভাবে ক্ষমতাবিরোধী শক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে।


বাংলা লোককথা এবং নিত্যজীবনে শুয়োপোকা এক অদৃশ্য বিদ্রোহী, ক্ষুদ্র কিন্তু অবিস্মরণীয়। এটি মরণোত্তর শারীরিক নিষ্পত্তির সাথে জড়িত। যেখানে মৃতদেহের ক্ষয়িষ্ণু শরীর থেকেই নতুন কিছু জন্মায়। কবিতার মেটাফরে শুয়োপোকা সেই শক্তি যা মৃত সংস্কৃতি, মরে যাওয়া ভাষা বা নিষিদ্ধ ভাবনার ভেতর দিয়ে নতুন ভাষা ও ভাবনার সূচনা ঘটায়। শুয়োপোকার গতি ধীর এবং অবহেলিত হলেও তার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এটি এক ধরণের গোপন শক্তি। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান যারা ধ্বংস করে ফেলতে চায় শুয়োপোকাই সেখানে গোপনে বিস্তার লাভ করে। রুদ্ধশ্বাস সমাজের আড়ালে বিদ্রোহী কবিতার নতুন ভাষা তৈরি করে। এই ক্ষুদ্র জীবটি রাষ্ট্রের নীতিমালা ও বাজারের মনোভাবের বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য বিপ্লবের প্রতীক।


শুধু বাইরের জীবজগতেই নয়, কবিতার ভেতরেও শুয়োপোকার উপস্থিতি ও কার্যক্রম বিস্ময়কর। কবিতার ভাষা যখন রাষ্ট্রীয় ভাষার পক্ষে বাধা তখন শুয়োপোকা হয়ে ওঠে চিরস্থায়ী বিদ্রোহী কণিকা। কবিতায় শুয়োপোকার সংজ্ঞা এক ধরণের বিকৃত ভাষার প্রতিনিধিত্ব, যা সমাজের গৃহীত নীতিমালা ও কাঠামোর বাইরে থেকে আসে। শুয়োপোকার উপস্থিতি কবিতায় গোপন উচ্চারণ, অসম্প্রচলিত শব্দ, লেজেন্ডারি মিথ ও কামনাময় ভাবনার রূপ। এর মাধ্যমে কবি ভাষার স্বাভাবিক শুদ্ধতা ভেঙে ফেলে রাষ্ট্রীয় ভাষার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শুয়োপোকার মতো কবিতার শব্দ ও বাক্যাংশ ক্ষুদ্র, অপ্রিয় এবং খসখসে হলেও এগুলোই কবিতাকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। শুয়োপোকা কবিতার ভেতরে একটি ‘অন্তঃস্থ বিদ্রোহী’ চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় যা কবিতার অপ্রকাশিত, বর্জিত, নিষিদ্ধ ভাব ও উচ্চারণের প্রতীক। এটি প্রাচীন শাস্ত্রীয় অলঙ্করণের বিরুদ্ধে এক বিক্ষুব্ধ শৈলী যা কবিতার স্থিতিশীল ভাষাকে ভাঙতে ভাঙতে নতুন ভাষার পথ সুগম করে।


শুয়োপোকার মেটাফর কবিতায় বিদ্রোহের গূঢ়তা প্রকাশ করে। বিদ্রোহী কবিতায় শুয়োপোকার উপস্থিতি হলো ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রতিবাদের সংগ্রহ। কবিতার প্রতিটি শব্দ যদি হয় রাষ্ট্রীয় ভাষার বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র, তাহলে শুয়োপোকার মতো ক্ষুদ্র শব্দগুলি হলো গোপন বোমা যা ধীরে ধীরে কাঠামোর ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি করে। শুয়োপোকা মেটাফর হয়ে ওঠে সেই কবিতার দেহের এক ধরণের অন্তঃস্থ বিরক্তি। যাকে ভাষার প্রতিষ্ঠান ও বাজার চেপে রাখতে চায়। বিদ্রোহী কবিতায় শুয়োপোকার কাজ ভাষার অন্তর্গত শক্তিকে মুক্ত করে তোলা। যা এক নতুন বর্ণমালা ও নতুন উচ্চারণের জন্ম দেয়। এই ভূমিকা আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক কবিতায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূণ। যেখানে কবিতার ভাষা সরকারি ভাষা ও বাজারের নিয়মে সম্পূর্ণরূপে ঢালাও নয়। শুয়োপোকার মতো কবিতা চুপিচুপি গোপন কথা বলে, নিষিদ্ধ চিন্তা উচ্চারিত করে এবং এক নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সম্ভাবনা গড়ে তোলে।


কবিতা অনেক সময় মরছে বলে ঘোষণা করা হয়। তবে বাস্তবে কবিতার ‘মৃতদেহ’ কেবল একটি সাংস্কৃতিক মেটাফর। কবিতার মৃতদেহ রাষ্ট্র ও বাজারের দ্বারা প্রবর্তিত শাসন এবং শৃঙ্খলার প্রতীক হলেও এটি স্বাভাবিক নয় যে কবিতা স্থায়ীভাবে মারা যায় বরং এই মৃতদেহটি একটি সংরক্ষিত স্মৃতি যা থেকে নতুন ভাষার উৎপত্তি ঘটে। মৃতদেহের সংরক্ষণ একরকম স্মৃতিধ্বংস ও পুনর্গঠন। কবিতা যখন একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়মে প্রবাহিত হতে পারে না তখন তার মৃতদেহ রাস্তায়, দেওয়ালে বা ডিজিটাল মাধ্যমের নোটিফিকেশনে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে এটি গোপনভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের সাথে ধীরে ধীরে নতুন কবিতার ডিম পাড়ে। এই মৃতদেহ একটি এক ধরনের ভগ্ন সাংস্কৃতিক পণ্য। যা নিষিদ্ধ, অবহেলিত, একই সাথে সম্ভাবনার উন্মুক্ত খোলা মাঠ। কবিতা যখন মরে তখন তার গন্ধ থেকে নতুন জীবন শুরু হয়। যেমন শুয়োপোকা মৃতদেহ থেকে ডিম পাড়ে।


নতুন ভাষার জন্ম প্রাচীন কবিতার মৃতদেহ থেকে শুরু হয়। যেখানে নিষিদ্ধ উচ্চারণ ও বিদ্রোহী শব্দগুলো গোপন উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কবিতার পুনঃসংস্কার অর্থাৎ নতুন ভাষার গঠন হলো একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যেখানে কবিতা নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং সমাজের নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর বাইরে প্রবাহিত হয়। এই পুনঃসংস্কারে শুয়োপোকাদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা নতুন শব্দ ও নতুন অর্থের ‘ডিম’ পাড়ে, যা এক ধরণের গোপন উৎসবের আঙ্গিক। এটি গোষ্ঠীগত বিক্ষোভ ও সাংগঠনিক অনুপ্রেরণার মাধ্যেমে ঘটে। কবিতা তখন একটি রাজনৈতিক অস্ত্রের মত কাজ করে যা বাজার, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সজীব প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে।


কবিতার পুনর্জন্ম একটি গোপন উৎসবের মতো। যেখানে আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংগঠনিক নিয়মাবলী স্বাভাবিক সংস্কৃতির বাইরে। এই উৎসবের অংশগ্রহণকারীরা একধরনের শুয়োপোকার ক্ষুদ্র বিদ্রোহী কবিরা যারা নিষিদ্ধ ভাষা ও উচ্চারণ নিয়ে এক গোপন ঐক্য গড়ে তোলে। গোপন উৎসব সামাজিক নিয়মের বাইরে একটি অন্তঃস্থ ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিক্ষোভের প্রাণকেন্দ্র। এখানে কবিতা একটি যৌথতন্ত্রের রূপ নেয়, ভাষার নতুনত্ব ও বিদ্রোহ ঐক্যবদ্ধতার সৃষ্টি করে।


কবিতা এক ধরনের গোপন উৎসব, যেখানে কবিরা একত্রিত হয়ে একটি যৌথতন্ত্রের মধ্যে ভাষার নতুন রীতি এবং নতুন অর্থের সন্ধান করে। এই উৎসব যেখানে বহিঃপ্রকাশ থেকে বহু গোপনীয়তা ও সাংগঠনিক নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেই স্থানেই কবিতার সজীবতা ও বিদ্রোহী শক্তি লুকিয়ে থাকে। গোপন উৎসব এবং যৌথতন্ত্র—এই দুই ধারণার মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কিভাবে কবিতা একটি মুক্ত, ক্ষমতাবিরোধী শক্তি হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। 


গোপন উৎসব হলো একটি সাংস্কৃতিক আচার যেখানে সীমিত অংশগ্রহণকারী, বিশ্বাসঘাতকতা অস্বীকারক এবং ভাষা ও চিহ্নের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব ও মত প্রকাশ করে। কবিতার ক্ষেত্রেও এই উৎসব ঘটে যেখানে ভাষা এক বর্হিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপ্রচলিত, গোপনীয় ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কবিতা তখন একটি গোপন ভাষার উৎসবে পরিণত হয় যা প্রকাশ্য সমাজের শাসন ও শৃঙ্খলা ভেঙে নতুন অর্থের জন্ম দেয়। এই গোপন উৎসবের মূল চরিত্র হলেন শুয়োপোকারা ক্ষুদ্র, অদৃশ্য, অত্যন্ত প্রভাবশালি কবিরা। যারা নিষিদ্ধ ভাষা ও বিদ্রোহী ভাবনাকে যৌথভাবে সংরক্ষণ ও প্রসারিত করেন। এই কবিরা রাষ্ট্র ও বাজারের শাসনবাহী ভাষার বাইরে থেকে কাজ করেন, গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে নতুন কবিতার ডিম পাড়েন।


শুয়োপোকারাদের এই যৌথতন্ত্র এক ধরনের গোপন সংগঠন যেখানে প্রত্যেকে নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখে অংশগ্রহণ করেন। এখানে সকলে মিলে একদল ‘ভাষার অভ্যুত্থানকারী’ হিসেবে কাজ করেন। এই যৌথতন্ত্রের মাধ্যমে কবিতার নতুন রীতির জন্ম হয় যা স্থান, সময়, মাধ্যমের সীমা অতিক্রম করে।


কবিতার গোপন উৎসবে আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন রূপে দেখা যায়— রাতের পাঠ, অনলাইন গ্রুপের আড্ডা, গ্রাফিতি ও স্ট্রিট আর্টে কবিতার লুকানো সংকেত’ ইত্যাদি। এই আচারগুলো কবিতাকে একটি গোপন ভাষার রূপ দেয় যা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গভীর অর্থ বহন করে। গোপন উৎসবের ভাষা শুদ্ধ, সম্পূর্ণ এবং স্বচ্ছ নয়। এটি লুকানো, ধ্বনি ও সংকেতের মিশ্রণ। কবিতা এই ভাষার মধ্যে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার বাইরেও চলতে থাকে। যা রাষ্ট্র ও বাজারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। ডিজিটাল মাধ্যমের উত্থানে কবিতার গোপন উৎসব নতুন রূপ নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ এবং মাইক্রোব্লগিং-এর মাধ্যমে শুয়োপোকারা নতুন কবিতা তৈরি ও বিতরণ করেন। এই মাধ্যমগুলো সরকারি ও বাজারের নজর থেকে গোপনে কাজ করার সুযোগ দেয়।


বিশ্বজুড়ে অনেক রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কবিতা গোপন উৎসবের মাধ্যমে বাঁচছে। যেমন হংকংয়ের প্রতিবাদে স্ট্রিট আর্টের কবিতা, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিক্ষোভে গোপন গ্রুপে কবিতার আদানপ্রদান। এই আধুনিক প্রেক্ষাপটে গোপন উৎসব কেবল স্থানীয় নয় বিশ্বব্যাপী এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ। গোপন উৎসব এবং যৌথতন্ত্র কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নতুন জীবন এবং নতুন ভাষার উদ্ভবের মূল চাবিকাঠি। শুয়োপোকারা অর্থাৎ ক্ষুদ্র বিদ্রোহী কবিরা এক 


কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কবি যখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক শুয়োপোকা 


কবিতা কখনোই নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ বা সম্পূর্ণরূপে মৃত হয়নি। সে মরে যায়—অবশেষে মরে যায়—এই ধারণা নিজেই এক বিরাট বিভ্রান্তি। কবিতা, ভাষার একান্ত ব্যক্তিগত এবং সর্বজনীন মিলনস্থল। তার মৃত্যুর পর এক ধরণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করে। যেখানে কবিও হয় রাষ্ট্রদ্রোহী এক শুয়োপোকা। একজন গোপন বিদ্রোহী, যিনি মৃতদেহ থেকে নতুন জীবন বের করে আনে, নতুন ভাষার ডিম পাড়ে এবং রাষ্ট্রের সুরক্ষিত ভাষাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যায়। এই উপসংহারে আমরা কবিতার সেই অন্তরাত্মার কথাই বলব, যা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্যেও বেঁচে থাকে বিবর্জিত হয়, বিদ্রোহ করে এবং পুনর্জন্ম লাভ করে।


আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে ‘কবিতার মৃত্যু’ বহুবার ঘোষণা করা হয়েছে। আধুনিকতার আবির্ভাব থেকে পোষ্টমডার্নিজম পর্যন্ত এই ধারণা নানা পর্যায়ে সামনে এসেছে। তবে এই মিথ বাস্তবতার পর্দা ফাঁস করে দেয়নি যে কবিতা কখনোই নিঃশেষ হয়নি, কবিতার রূপান্তর ঘটেছে। কবিতার ‘মৃত্যু’ হলো রাষ্ট্রীয় ভাষা, বাজারের আধিপত্য এবং সামাজিক শাসনের এক প্রতীক। যেখানে কবিতার স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। এই মিথ যে কিভাবে রাষ্ট্র এবং বাজার কবিতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসে। কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কবিরা শুয়োপোকার মতো গোপনে কাজ করেন। রাজনীতি, ভাষা ও ক্ষমতার কাঠামোর বাইরেই নতুন উপায়ে কবিতার জন্মদানে নিযুক্ত হন।


কবি কেবল স্রষ্টা নয়, একজন বিদ্রোহী। যিনি ভাষার নিয়ম ভেঙে দেয়, রাষ্ট্রের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন ভাষার জন্ম দেন। শুয়োপোকার মতো যিনি ধীরে ধীরে প্রাচীরের ভেতর, নগরের ছায়ায়, ডিজিটাল নেটওয়ার্কের গোপন কোণে কাজ করেন, কবিও তেমনই গোপনে কাজ করে। তার কাজ অতি সূক্ষ্ম, ধীরে ধীরে ভাষার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করে। রাষ্ট্র যখন তার ভাষার আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত থাকে তখন কবি হয়ে ওঠে ভাষার দস্যু, সংকেতের কারবারি। যিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার বাইরে একটি গোপন উৎসবের নেতৃত্ব দেন। এই গোপন উৎসবের মাধ্যমে কবিতা জীবনধারণ করে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে এবং ব্যক্তির আত্মার স্বাধীনতা রক্ষা করে।


কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো এক জটিল আচার যেখানে পুরনো ভাষা ধ্বংসের পর নতুন ভাষার জন্ম হয়। এই মুহূর্তে কবি শুয়োপোকা হিসেবে মৃতদেহ থেকে ডিম পাড়ে নতুন শব্দ, নতুন সংজ্ঞা, নতুন অর্থের সৃষ্টি করে। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনেক সময় লুকানো, সংকেতপূর্ণ, গোপনীয় ভাষার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এই পুনর্জন্মের প্রক্রিয়ায় কবিতা পেয়ে যায় এক নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। যা রাষ্ট্রীয় ও বাজারভিত্তিক ভাষার বাইরে দাঁড়িয়ে কবির স্বতন্ত্রতাকে রক্ষা করে।


বাজার, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র যখন কবিতাকে ‘পণ্য’ বা ‘আইডেন্টিটি’র অংশ বানানোর চেষ্টা করে, তখন কবিতা শোষিত হয় আর তার বিদ্রোহী শক্তি নষ্ট হয়। কিন্তু এই শক্তি যে একেবারেই মরে যায় না। তা দেখায় কবি-শুয়োপোকারাদের গোপন ক্রিয়াকলাপ। কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেই সময় বিকাশ লাভ করে যখন কবি নতুন ভাষা, নতুন রীতি এবং নতুন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বর্তমান ডিজিটাল ও সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলতেই থাকবে, কবিরা শুয়োপোকারাদের মতো গোপনে কাজ করবে। তারা একটি বহুমাত্রিক, বহুভাষিক, বহুত্ববাদী কবিতার পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে প্রতিটি কবিতা একটি নতুন রাজনৈতিক বক্তব্য বহন করবে। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমেই কবিতা বেঁচে থাকবে, ভাষার নতুনত্ব ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করবে। কবি থাকবে রাষ্ট্রের চোখে বিদ্রোহী শুয়োপোকা, প্রতিষ্ঠানবিরোধী যিনি কোনো দিন চুপ থাকবে না, ভাষার পুনর্জন্ম ঘটাতে অবিরত কাজ করবে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Pages