প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রথমপাঠ - শাফি সমুদ্র

সর্বশেষ লেখা

Home Top Ad

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন...

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রথমপাঠ

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ফ্যাশেনবল বিষয় নয়, যা দিয়ে আপনি নিজের পাছায় একটা সীলমোহর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন।
অধিকাংশ পাঠক-লেখক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ ধারণা মূলত অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিমুলক। কেনোনা এই ধারনার ভেতরে তাদের ঢোকার অনাগ্রসরাতাই কেবল দায়ি নয়, দায়ি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ধারনা নিয়ে যারা একটা জীবন পদ্ধতির চর্চা করছেন তাদেরও। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এই লিটারারি মুভমেন্টে সেইসব শ্রেণিচক্র যারা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ শব্দটির ভেতরে অন্তরসার শূন্য মেধায়, তাত্ত্বিক জ্ঞান শূন্যতা আর দেউলিয়াত্ব মনন নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করে বারবার ফিরে আসেন বুঝতে না পারার দরুন। আসলে তারা নিজেরাও কখনো বুঝতে পারেন না যে তারা কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, কিভাবে তাদের অস্তিমজ্জা গিলে খাচ্ছে অন্য কোনো শক্তি-দেবতা-অপদেবতারা বরং সেক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে উজাড় করে দিতেও কার্পন্য করেন না। নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেন সমস্ত প্রাপ্তির মলাটবন্ধি হিসাবে। ফলে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ নিয়ে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে মতাদর্শগত পরগাছা, তথ্য বিকৃতির উন্নাসিকতা, জরাজীর্ণ জ্ঞান আর ভুল দৃষ্টির পর্যালোচনা। মেরুদ-হীন মধ্যবিত্ত মানসিকতার সেইসব লেখক-পাঠক-চিন্তক-শিল্পীরা ক্রমশ নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠানের করতলে উজবুকের মতো ধেই ধেই করে নেচে চলেছে। যা তাদের সঙ্কটকে আরো মহিমান্বিত করে তুলছে, তারা নিজেরাও অনুধাবন করতে পারে না। তাদের অধিকাংশের ধারনা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ একটি সাময়িক ক্রেজ, গুটি কয়েক লেখকের শুধুমাত্র ‘লেখক’ হয়ে ওঠার পায়তারা, মিডিয়া ঘনিষ্ঠ স্বভাবে নিজেদেরকে তৈরি করা এবং বাজারে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলার খন্ডকালীন প্রচেষ্টা। পক্ষান্তরে সেইসব ধারনাপুষ্ট মানুষেরা কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিরোধিতা করে নতুন উৎপাতের জন্ম দিয়ে সর্বদা আলোচনায় ঢুকে পড়েন।

প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটি সম্পুর্ণ মতাদর্শিক চেতনা, যার প্রকাশ ঘটে শিল্প-সাহিত্য-চিত্রকলায়-জীবনে-যাপনে। এটি শুধু মতাদর্শই নয়, একটি প্লাটফর্মও। সুষ্ঠ রাজনৈতিক চেতনার সামাজিক চিন্তার প্রক্রিয়া, একটি সাহিত্যে চর্চার মাধ্যমে জীবন ও সামাজিক রাজনীতির চর্চা এবং প্রায়োগিক পদ্ধতি। যা একটি সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মধ্যবিত্তের প্রচলিত জীবন পদ্ধতির উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের জীবন ও জীবিকার গতিশীলতা নির্ণয়-উত্তরণ-সমবণ্টন এর মধ্য দিয়ে প্রশান্তির রাষ্ট্র নির্মানের পদ্ধতি। আপনি যদি ভেবে থাকেন, শিল্প সাহিত্য কেবল শিল্পের জন্যই, তবে বলে রাখা ভালো- প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা শুধু শিল্প নির্ভরতাকে বিশ্বাস করে না, শুধু শিল্পের দায় নিয়ে এক জীবন পার করে দেবার পক্ষে নয় কিংবা নন্দনত্ত্বকেই সে একক হিসাবে গ্রহণ করে না। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আবার শুধু বিরোধিতারই নামান্তর নয়, বরং দিক-নির্দেশকও বটে! সামাজিক-দার্শনিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চিন্তার এবং বিশ্বাসের পর্যবেক্ষন হিসেবে প্রাথমিক ভাবে আপনি ভাবতেই পারেন। বিশ্লেষাত্মক মনোভঙ্গি, স্বত:স্ফুর্ত মোহত্যাগ, আত্মবিস্তৃতির শক্তির সক্রিয়তায় নিজেকে এবং নিজের সৃষ্টিকর্মকে সদা প্রস্তুত করে জনগোষ্টির জন্য সমক্ষেত্র তৈরি করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার লক্ষ্য। প্রশ্ন থাকতে পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাই কি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি? তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে সত্যিকার অর্থেই ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ একটি সামাজিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির প্রধানতম বিষয়। অনেকেই এই মনোভঙ্গিকে হয়তো একটি জনবিচ্ছিন্ন মনোভঙ্গি হিসাবে ভেবে একটু দূরেই সরে থাকতে চাইবেন, কেননা, এর ভেতরের বিষয়টি তারা অনুধাবন করা থেকে নিজেকেই বিচ্ছিন্ন রাখেন। সেক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো কোন অচ্ছুৎ বিষয় নয়, কোনো জনবিচ্ছিন্ন বিষয় নয় বরং জীবন ঘণিষ্ঠ এবং জনসম্পৃক্ততার বিষয়। সহজাত মধ্যবিত্তের জীবন ও মননের প্রচলিত অবস্থানের আমূল পরিবর্তনের স্বপক্ষে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দৃঢ় অবস্থান। এই সহজাত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বশীল অবস্থান এবং সমান্তরাল শ্রেণি তৈরির সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে একটি আন্দোলন। 

প্রচলিত ব্যবস্থাপনার মুখোশে ঢেকে থাকা মধ্যবিত্তের জর্জরিত বেদনায় নিজেকে নিরাপদে রেখে এক অস্পৃশ্য সময় পার করছি আমরা। বহু ভাষার আধিপত্য, বেওয়ারীশ সংস্কৃতির প্রাচূর্যতা, বাণিজ্যের বহুবিদ প্রক্রিয়াজাতকরন, অগ্নিস্ফুলিংগ থেকে বেরিয়ে আসা হত্যভাগ্য ইতিহাসের টানাছেড়া, মানবধিকারের নৈমিত্তিক বেসাতি, উদ্ভাবিত অর্থনীতির কালো জিহ্বা, বিজ্ঞাপনের সরীসৃপ যন্ত্রণা আর সাম্প্রদায়িকতার ডামাডোলে আমাদের সহজাত মধ্যবিত্ত জীবন ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। পারষ্পারিক প্রতিপক্ষ হয়ে প্রত্যেকেই গিলে খাচ্ছে নিজেকে, নিজের ছায়াকে। এই পারষ্পারিক দ্বিধা থেকে প্রত্যেকেই সামাজিক জনগোষ্ঠির ভেতরেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এক ব্যক্তিগত জীবনের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। যখন প্রতিটি মানুষ এই ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে নিতান্তই বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে সেই সুযোগ দারুণভাবে ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠিত শক্তি। প্রতিষ্ঠান তখন তাকে সহসাই গোগ্রাসে গিলে খেতে থাকে। ব্যক্তির শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি বিক্রি হতে থাকে, তখন তার মননশীলতা ভাড়ায় চালিত হতে থাকে।

প্রতিষ্ঠানের এই রুচির কাছে মধ্যবিত্ত মনন সহজেই ধরা দেয়, কারণ মধ্যবিত্তের রয়েছে সেই অসহায়ত্ব, নিজেকে দ্রুত প্রকাশ করার, নিজের আত্মপরিচয়ের প্রতিষ্ঠা এবং তথাকথিত সামাজিক অবস্থানের সুউচ্ছে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। ফলশ্রুতিতে, এইসব মানুষেরা নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাতিষ্ঠানিক মন নিয়ে এক ধুরন্ধর পথে হেঁটে যাচ্ছেন। আর সেই পথের রেখাচিত্র অঙ্কন করে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি।  

বর্তমান সময়ে আমাদের লেখক-শিল্প-চিন্তকেরা এই প্রতিষ্ঠানের কাছে সহসা ন্যুয়ে পড়েন, পুরষ্কার দ্বারা তারা অলঙ্কৃত হন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলবার আপ্র্রান চেষ্টা,  সাহিত্যর বিনিময়ে অর্থমূল্য খুঁজে পাওয়ার কর্মসূচি, দল উপদল তৈরি করে সামরিক শক্তির মতো দলবদ্ধ হবার চেষ্টা এবং বিভিন্ন দেশে সাহিত্য সফরের নামে নিজেকে জাহির করে তাদের আত্ম সংকট দূর করতে থাকেন। প্রশ্ন থাকতে পারে এতে প্রতিষ্ঠানের কি লাভ? উত্তর, প্রতিষ্ঠানের লাভ বিস্তর। প্রতিষ্ঠান তাদের খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী একধরনের লেখক-শিল্পী উৎপাদন করে বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করেন, মিডিয়া তাদের টিআরপি বাড়িয়ে বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়াতে পারেন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে এইসব লেখক-শিল্পীদের পেছনে ইনভেস্ট করার সুযোগ গ্রহন করে, ইস্যুভিত্তিক এজেন্ডায় বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তাদের বিষয়-আসয় নিয়ে এইসব উৎপাদিত শিল্পী ও লেখকশ্রেণিদেরকে দিয়ে বিবৃতি এবং আলোচনায় নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু জনগনের সামনে আনার সুবিধা বাস্তবায়ন করে থাকে। আরো নানাবিধ সুবিধায় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন পথ ও উপায় অবলম্বন করেন।

প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা এই ধারাকে ভাঙতে থাকেন। তারা নির্মোহ থাকেন তাদের সৃষ্টি ও জীবন যাপনের প্রতি। মানুষের মননের মুক্তি, চিন্তার মুক্তি, জীবন যাপনের এক সুস্থধারাকে প্রবাহমান রাখতে এইসব প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরোধিতা করে এক সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করে। মনেরাখা জরুরি যে, যখন কোন শক্তি ক্রমশ অপশক্তিতে রূপান্তরীত হতে চায়, তখন অপর যে শক্তি প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা।



-শাফি সমুদ্র







Pages